বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০০৮

দর্শনের আলোকে নাস্তিক আস্তিক সমাচার

একঃ আরম্ভ
 

আস্তিক বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝে থাকি ঈশ্বর বিশ্বাসী এবং নাস্তিক বলতে বুঝি ঈশ্বর অবিশ্বাসী। কিন্তু একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- শব্দ দুটি সবসময় একই অর্থ ধারণ করে না। বেশ কিছু ধর্মে যেখানে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই (জৈন, প্রথম অবস্থায় বৌদ্ধ, বিভিন্ন টোটেমদের ধর্ম) সেগুলোকে নিশ্চয় নাস্তিকধর্ম বা ঐ সব ধর্ম পালনকারীদের সাধারণভাবে নাস্তিক বলার রেওয়াজ নেই। …….

আবার, দর্শন শাস্ত্রে বিশেষত ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রমতে আস্তিক- নাস্তিকদের সংজ্ঞা একটু অন্যরকম, কিছুটা মজারো বটে। ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলোকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা হয়- নাস্তিক ও আস্তিক।
 

নাস্তিক সম্প্রদায় প্রধানত: তিনটিঃ

১। চার্বাক
২। বৌদ্ধ
৩। জৈন

 

আস্তিক সম্প্রদায় প্রধানত: ছয়টিঃ

১। সাংখ্য
২। যোগ
৩। ন্যায়
৪। বৈশেষিক
৫। পূর্ব-মীমাংসা বা মীমাংসা
৬। উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত

কিন্তু এখানে আস্তিক মানে বেদ-বিশ্বাসী, নাস্তিক মানে বেদ-বিরোধী; – ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস আসলে প্রাসঙ্গিকই নয়। যাঁরা ঈশ্বর মানেননা তাঁরা যদি নাস্তিক হতেন, তবে মীমাংসকাচার্য ও সাংখ্যাচার্য নাস্তিক বলে অভিহিত হতেন, কেননা তাঁরা ঈশ্বর মানেন না। অধিকন্তু ঈশ্বর নাই- ইহা প্রচলিত সাংখ্য-দর্শনে যুক্তি দ্বারা প্রতিপন্ন করা হয়েছে। 

আবার, যাঁরা ঈশ্বর মানেন না, গীতাতে ভগবান তাঁদেরকে অসুর-সম্পদ-যুক্ত বলে নির্দেশ করেছেন, নাস্তিক বলেননি। মীমাংসকাচার্য ও সাংখ্যাচার্য ঈশ্বর মানেননা, কিন্তু বেদের অনুসারী। তাই তাঁরা নাস্তিক নন, অতিশয় আস্তিক। অপরদিকে, চার্বাক দর্শনে, বৌদ্ধদর্শনে বেদের প্রমান অঙ্গীকৃত হয় না বলে তা নাস্তিক।

এবার ইসলাম ধর্মে শব্দদুটিকে দেখা যাক। এখানে আস্তিক শব্দের কাছাকাছি শব্দ হচ্ছে- মু’মিন বা ঈমানদার। এই ঈমান কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহে বিশ্বাস, সাথে সাথে আল্লাহর রাসুল হিসাবে মুহাম্মাদ সা. এর উপরও বিশ্বাস (কালেমা তাইয়েবা)। আর নাস্তিক্যের কাছাকাছি শব্দগুলো হচ্ছে-

১। কুফর
২। শিরক
৩। মোনাফেকি

তবে সম্ভবত সবচেয়ে কাছের শব্দটি হবে কুফর। একইভাবে এই শব্দগুলো সাধারণভাবে ঈশ্বরকে নির্দেশ না করে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি অনাস্থা/অবিশ্বাস/অংশীদ্বারকে নির্দেশ করে। ‘কুফর’ হচ্ছে আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় হিসাবে অস্বীকার করা। সেক্ষেত্রে আল্লাহকে অস্বীকার করে অন্য কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করলেও সে কাফির। শিরক হচ্ছে অংশীদার করা- অর্থাত আল্লাহর গুনসমূহে অন্য কাউকে অংশীদার করলে তা হয় শিরক; সে হিসাবে পৌত্তলিকতা বা মূর্তি-পূজা শিরক। এই শিরককে কিন্তু ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। উল্টোদিকে ‘মোনাফেকি’ও আল্লাহে অবিশ্বাস- কিন্তু এটা হলো তাদের ক্ষেত্রে যারা মুখে বা উপরে-উপরে বিশ্বাস প্রদর্শন করে কিন্তু অন্তরে অবিশ্বাস ধারণ করে।

আবার, প্রচলিত অর্থে শব্দটিকে বিচার করি। ধর্ম পালনকারীদের সাধারণভাবে নাস্তিক বলা হয় না, তা সে ধর্মে ঈশ্বরকে অস্বীকার করা হলেও। অনেক সময়ই পৈত্রিক ধর্মকে অস্বীকারকারীকে নাস্তিক বলা হয়। একজন মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী কেউ হিন্দুধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুললে বা হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণকারী একজন ইসলামধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তুললে, তাকে হয়তো নাস্তিক বলা হয় না, কিন্তু যখন কেউ তার পৈত্রিক ধর্মের বিভিন্ন বিশ্বাস নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন তুলতে থাকে এবং নতুন কোন ধর্মে নিজেকে সমর্পিতও না করে- তখন তাকে কখনও কখনও নাস্তিক বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু এখানেও বিপত্তি আছে। এখন যদি কেউ বলে- সে প্রচলিত কোন ধর্মের অনুশাসন মানে না, বিশ্বাসও করে না; কিন্তু সে জগত-সংসারের সৃষ্টিকর্তা একজন কেউ আছে বলে বিশ্বাস করে- তবে তাকে কি বলে আখ্যায়িত করা হবে? আস্তিক না নাস্তিক?

 

দুইঃ সংশয়

উপরের প্রশ্নের উত্তরে কেউ বলেছেন- তাকে নাস্তিক বলতে হবে, কেউ বলেছেন আস্তিক আবার কেউ বলেছেন সংশয়বাদী। এবং সংশয়বাদ নিয়ে অনেকে একটা ভালো আলোচনাও করেছেন। তাই এবারে সংশয় নিয়ে কিছু কথা বলি।

সংশয়বাদীদের কথা আসলে একালের দার্শনিকদের মধ্যে বার্ট্রান্ড রাসেলের কথা সর্বাগ্রে আসে। তাঁর ‘দি প্রব্লেমস অব ফিলসফি’ গ্রন্থ আরম্ভই করেছেন তিনি এভাবে,

“এমন কোন সুনিশ্চিত জ্ঞান কি আছে যাকে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কখনও সন্দেহ করবে না?”
দর্শনের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন,
“সাধারণ চোখে যাকে জ্ঞান বলে মনে হয়, তার সম্বন্ধে আমাদের মনে সংশয় জাগে এবং এ সংশয়ের উত্তর পাওয়া যেতে পারে কেবল এক বিশেষ ধরণের অনুসন্ধানের মাধ্যমেই। এই অনুসন্ধানের আমরা নাম দেই দর্শন”।


এতো গেল হালের দার্শনিকের কথা। সে আমলে সংশয়বাদী দার্শনিকের কথাও একটু শুনে নেই। গ্রীক দার্শনিক পাইরো (৩৬৫-২৭০ খৃষ্টপূর্ব) বলেন,

“আমরা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ দ্বারা বস্তুর বৈশিষ্ট নয়, এর বাহ্যিক রূপটাকেই শুধু জানতে পারি”।
তাঁর মতে,
“হয়তো কোন যুক্তির বিপরীত আরও মজবুত প্রামান্য যুক্তি পাওয়াও সম্ভব”।
“কোন বস্তুর সংজ্ঞা নির্ণয় করতে হলে প্রমান দরকার- যা কিনা নিস্ফল তর্ক; আবার তাকে খন্ডানোর জন্য নতুন প্রমান চাই”।
এই পাইরো কিন্তু সেকালের স্টোয়িকদের ঈশ্বরবাদকে ক্রমাগত যুক্তি দিয়ে খন্ডন করে গেছেন। সে আমলে আমাদের দেশের নাগার্জুনও কিন্তু পাইরোর অনুরূপ মত ধারণ করতেন।
 
এবার তাহলে আমাদের ভারতীয় দর্শনের দিকে একটু তাকাই। অনেকান্তবাদ ও স্যাদবাদ- খুবই চিত্তাকর্ষক ও মজার এই মতকে কি বলবেন? নিরীশ্বরবাদী জৈনধর্মের আধার হলো স্যাদবাদ। তা কিন্তু আবার এসেছে সঞ্জয় বেলঢ্বিপুত্বের অনেকান্তবাদের হাত ধরে। সঞ্জয় পরলোক, দেবতা প্রভৃতি তত্বের নিশ্চয়াত্মক রূপে কিছু বলতে অস্বীকার করেন এবং সেই অস্বীকারকেও চার প্রকার বলে বর্ণনা করেন-
১। আছে? – বলা যায় না।
২। নেই? – বলা যায় না।
৩। আছেও আবার নেইও? – বলা যায় না।
৪। আছে নেই আবার নাও নেই? – বলা যায় না।
 
এই চারের সাথে আরও তিন যুক্ত করে জৈনধর্মের সপ্তরূপ তথা তাদের স্যাদবাদঃ
১। আছে? – হতে পারে (স্যাদ আস্তি)।
২। নেই? – নাও হতে পারে (স্যাদ নাস্তি)।
৩। আছেও আবার নেইও? – হতেও পারে নাও পারে (স্যাদাস্তি চ নাস্তি চ)।
৪। স্যাদ কি একটা বক্তব্য? – না, অবক্তব্য।
৫। স্যাদাস্তি কি একটা বক্তব্য? – না, অবক্তব্য।
৬। স্যাদ নাস্তি কি একটা বক্তব্য? – না, অবক্তব্য।
৭। স্যাদ আস্তি চ নাস্তি চ কি একটা বক্তব্য? – না, অবক্তব্য।
 
একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে- ধরুন সামনে রাখা একটা কলমকে দেখে প্রশ্ন করা হলো-
১। কলম কি আছে?- থাকতে পারে (স্যাদ আস্তি)।
২। কলম কি নেই?- নাও থাকতে পারে (স্যাদ নাস্তি)।
৩। কলম আছে না নেই? – থাকতে পারে নাও পারে (স্যাদাস্তি চ নাস্তি চ)।
৪। স্যাদ কি একটা বক্তব্য? – অবক্তব্য।
৫। স্যাদাস্তি কি একটা বক্তব্য? – অবক্তব্য।
৬। স্যাদ নাস্তি কি একটা বক্তব্য? – অবক্তব্য।
৭। স্যাদ আস্তি চ নাস্তি চ কি একটা বক্তব্য? – অবক্তব্য।

কিছু বোঝা গেলো?
কি বলবেন?

দুইঃ গৌতম বুদ্ধ

যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস/ অবিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই আস্তিক/নাস্তিকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন, তবে তাকে আস্তিক বলতে হবে বৈকি!

এই সমস্যা দূরীকরণে দার্শনিকগণ আরো দুটি শব্দ ব্যবহার করেন- ঈশ্বরবাদী ও নিরীশ্বরবাদী। জৈন, বৌদ্ধ প্রমুখ ধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকৃত হওয়ার দরুন তাদেরকে নিরীশ্বরবাদী বলতে হবে এবং নিরীশ্বরবাদী অর্থে ব্যবহার করলে ঐসব ধর্মকে নাস্তিকও বলতে হবে। এই ঈশ্বরবাদ বনাম নিরীশ্বরবাদ কিন্তু দর্শন শাস্ত্রে শুধু কিছু অন্ধ-বিশ্বাসের বেড়াজলে আবদ্ধ গুরুবাদী বিদ্যা নয়, বরং ভাববাদ বনাম জড়বাদ বা সেই আমলের আস্তিক বনাম নাস্তিক (বেদ-বিশ্বাসী বনাম বেদ-বিরোধী) বিতর্কের মতই ধারাবাহিক তর্ক-বিতর্ক-যুক্তির হাত ধরেই অগ্রয়মান, গভীর উপলব্ধি ও চিন্তার খেলায় ভাস্কর। আমাদের ভারতীয় দর্শনেও সেই আমলে নিরীশ্বরবাদীদের যুক্তি, যুক্তি করার ধরণ, চিন্তার গভীরতা শুধু চিত্তাকর্ষকই নয়, বরং বিপ্লবাত্মকও বটে। চার্বাক, জৈন, বৌদ্ধ, সাংখ্য, মীমাংসা প্রভৃতি দার্শনিক সম্প্রদায় একাধারে যেভাবে এবং যে যে যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে খন্ডন করেছে মাঝে মাঝে মনে হয় আজও তা প্রাসঙ্গিক।

এবারে আসুন, তাঁদের কিছু যুক্তি দেখি। প্রথমেই বুদ্ধ বা গোতম বুদ্ধ বা গৌতম বুদ্ধঃ

"'বাশিষ্ঠ!……ত্রৈবিদ্য ব্রাহ্মনের মধ্যে এমন একজনও নেই যিনি নিজের চোখে ব্রহ্মাকে দেখেছেন। …..এক আশ্চর্য…. এক আচার্য-প্রাচার্য….. সপ্ত-পর্যায় ধরেও আচার্যই হতে পারে না…. ব্রাহ্মনগণের পূর্বজ ঋষি, মন্ত্রকর্তা, প্রবক্তা…. অষ্টক,বামক, বামদেব, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, অঙ্গিরা, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ, ভৃগু……. এদের মধ্যে কি কেউ ব্রহ্মাকে স্বচক্ষে দেখেছেন? ……যাঁকে দেখেননি, জানেননি তাঁরই অস্তিত্ব নিয়ে উপদেশ করেন!…….. বাশিষ্ঠ! এ যেন সেই অন্ধগণকে ক্রমপর্যায়ে পংক্তিবদ্ধ করা; প্রথমজনও দেখতে পায় না, দ্বিতীয়জনও দেখতে পায় না, তৃতীয়জনও নয়….।'” (তেবিজ্জসূত্র, ১/১৩)।

এখানে বলে রাখা দরকার যে, তখনও পর্যন্ত উপনিষদে ঈশ্বর হিসাবে ব্রহ্মাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী, শিব বা বিষ্ণু তখনও আজকের মত অবস্থায় আসেনি।

 

তিনঃ প্রভাকর

এবারে আস্তিকদের (বেদপন্থি) মধ্যে যারা ঈশ্বরকে অস্বীকার করেন, তাদের একটু দেখি। এদের মধ্যে সাংখ্য ও মীমাংসার নাম উল্লেখ করা হয়। সাংখ্য ও মীমাংসার মধ্যে মীমাংসা অধিক চিত্তাকর্ষক, কেননা সাংখ্যকে বেদমূলক বলে গ্রহণ করার বিরুদ্ধে শংকরাচার্য, রামানুজ প্রমুখ অগ্রণী আস্তিকেরা তীব্র আপত্তি তুলেছেন এবং সে আপত্তি ভিত্তিহীন নয়।
 

ঐতিহ্য অনুযায়ী মীমাংসা সম্প্রদায়টির প্রবর্তকের নাম জৈমিনি, মীমাংসা দর্শনের প্রাচীনতম গ্রন্থের নাম মীমাংসা-সূত্র এবং মীমাংসা-সূত্রের উপর সবচেয়ে বিখ্যাত ভাষ্যকারের নাম শবর। জৈমিনি ও শবরের পর প্রধান দার্শনিক দুজনঃ কুমারিল ভট্ট ও তাঁর শিষ্য প্রভাকর, এবং এ দুজনের মধ্যে মীমাংসা সূত্র ব্যাখ্যায় মৌলিক প্রভেদ থাকায় পরবর্তিতে ভট্ট-মীমাংসা ও প্রভাকর-মীমংসা নামে দুটি সম্প্রদায় তৈরি হয়।
যাহোক, প্রভাকর ও কুমারিলের মধ্যে নানা মৌলিক মতান্তর সত্বেও ঈশ্বর-প্রত্যাখান প্রসঙ্গে উভয়ের সম্প্রদায়ই একমত।

প্রথমে প্রভাকরদের যুক্তি দেখা যাক।

প্রভাকরদের ‘প্রকরণপঞ্চিকা’ গ্রন্থে জগত-স্রষ্টা অর্থে ঈশ্বর স্বীকার করা সম্ভব নয়, এই কথাটিই বিশেষভাবে প্রমান করবার আয়োজন হয়েছে। ইতিমধ্যে নৈয়ায়িকেরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিপাদনার্থে নানা যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন; প্রভাকরেরা প্রধানত এই নৈয়ায়িকদের ও সেই সাথে ন্যায়-বৈশেষিকদের যুক্তি খন্ডন করেই ঈশ্বরকে প্রত্যাখান করেছেন। এবার আসুন এই যুক্তিতর্কে প্রবেশ করি।
 

নৈয়ায়িকগণঃ জগত-স্রষ্টা হিসাবে ঈশ্বরের সত্তা অবশ্য স্বীকার্য; ক্ষিতি, জল প্রভৃতি সমস্ত সংহত বা জটিল বস্তুই কার্যাত্মক, কেননা এগুলো অবয়বদ্বারা গঠিত; এবং কার্য বলেই এগুলোর কারণ থাকতে বাধ্য এবং সেই কারণ কোনো বুদ্ধিমান কর্তা না হয়ে পারে না; অর্থাত পরমাণুপুঞ্জ থেকে সুসামঞ্জস্য ও নির্দিষ্ট আকারে ক্ষিতি, জল প্রভৃতি সংহত বা জটিল বস্তুগুলো কোন বুদ্ধিমান কর্তার নিয়ন্ত্রন ব্যতিত উত্পন্ন হতে পারে না; অতএব এই বুদ্দিমান কর্তা অর্থে জগতের নিমিত্তকারণ হিসাবে সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর অনুমেয়- তাঁরই নিয়ন্ত্রনে সৃষ্টি ও প্রলয় ঘটে।

প্রভাকরগণঃ জাগতিক বস্তু অবশ্যই অবয়ব দ্বারা গঠিত, অতএব এগুলোর উত্পত্তি ও বিনাশ আছে। কিন্তু তাই বলে সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোনো সৃষ্টি বা প্রলয়ের কথা কল্পনামাত্র; অতএব জগতের সৃষ্টি ও প্রলয়ের নিয়ন্ত্রণকর্তা ঈশ্বরের পরিকল্পনাও অবান্তর। পক্ষান্তরে প্রাকৃতিক বস্তুগুলির দৃষ্টান্তে সুস্পষ্টভাবেই অভিজ্ঞতা হয় যে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণেই সেগুলোর জন্ম হচ্ছে- যেমন মানুষ ও জীবজন্তুর দেহ শুধুমাত্র তাদের পিতামাতার দরুনই উত্পন্ন হয়। এবং এ-জাতীয় অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে অতীত ও ভবিষ্যতের উত্পাদন ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অতএব, জাগতিক বস্তুগুলোর স্রষ্টা হিসাবে কোনো অতি-প্রাকৃত নিয়ন্ত্রতার কথা অনুমিত হয় না।

ন্যায়-বৈশেষিকগণঃ মানবদেহ বুদ্ধিবিহীন বলেই তার নিয়ন্ত্রণের জন্য এক বুদ্ধিমান স্রষ্টা বা ঈশ্বর অনুমেয়।  

প্রভাকরঃ নিয়ন্ত্রণ-কার্য উদ্দেশ্যবিহীন হতে পারে না; কিন্তু এই তথাকথিত নিয়ন্ত্রণের পিছনে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কি হতে পারে? কাষ্ঠাদি বস্তুর উপর সূত্রধরের নিয়ন্ত্রণ-কার্যর দৃষ্টান্ত অনুসারেই তাঁরা (নৈয়ায়িক/ ন্যায়-বৈশেষিকগ) জগত্স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণ প্রমান করতে চান; সূত্রধর দেহবিশিষ্ট, তারই উপমান অনুসারে কল্পিত ঈশ্বরও দেহবিশিষ্ট বলে প্রমানিত হবেন। এবং তা যদি হয়, তাহলে দেহবিশিষ্ট বলেই তাঁর নিয়ন্ত্রণের/ পরিচালনার জন্য আরো কোনন স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ-কর্তার কথা স্বীকৃত হতে বাধ্য- এবং এভাবে অনবস্থা দোষ ঘটবে।

 

এইভাবে প্রভাকরেরা স্রষ্টা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব খন্ডন করেছেন। এবং তাঁরা সৃষ্টি এবং প্রলয় মানেননি বলেই বিশ্বজগত তাঁদের কাছে নিয়ত পরিবর্তনশীল ঘটনাস্রোত বলেই প্রতীত হয়েছে।

তবে মজার বিষয় হচ্ছে এই যে, শবর অনুভব করেছেন স্রষ্টার কথা স্বীকার করতে গেলে বেদ এর গুরুত্ব ক্ষণ্ণ হবার আশংকা থাকে এবং বেদের চরম প্রামান্য স্বীকৃতিই মীমাংসার; অতএব স্রষ্টার কথা যুক্তিমূলকভাবে প্রত্যাখান করবার আয়োজন হয়েছে। তাই শবরের যুক্তিগুলোর মধ্যেই মীমাংসা-দর্শনে ঈশ্বর-প্রত্যাখানের সূত্রপাত দেখা যায়; যদিও ঈশ্বর-প্রত্যাখানের আরও সুস্পষ্ট যুক্তিতর্ক পরবর্তী রচনাতেই পাওয়া যায় এবং সেগুলোর দার্শনিক মূল্য উপেক্ষণীয় নয়। আমরা ইতিমধ্যে প্রভাকরদের যুক্তিতর্ক দেখছি, এবার দেখ ভাট্ট-মীমাংসকদের যুক্তি।

চারঃ ভাট্ট সম্প্রদায়

ভাট্ট-সম্প্রদায়েও বেদের চরম আপ্তত্ব প্রতিপাদন করবার উদ্দেশ্যেই ভাট্ট মীমাংসকেরাও সৃষ্টি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব খন্ডন করেছেন। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, এ জাতীয় রক্ষণশীল চাহিদায় উদ্ভাবিত হলেও স্বকীয় দার্শনিক গুরুত্বের দিক থেকে ভাট্ট মীমাংসকদের বিশেষত কুমারিলের যুক্তিগুলো ভারতীয় দর্শনের পটভূমিতে প্রায় বৈপ্লবিক। এবারে তাহলে কুমারিলের আলোচনার সংক্ষিপ্তসার উদ্ধৃত করা যাক।


কুমারিল বিশ্বস্রষ্টা প্রজাপতির(ঈশ্বর) পরিকল্পনা নিয়ে নানা রকম বিদ্রুপ করেছেন।

“যদি বল, কোন এক কালে বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্ট হয়েছিল তাহলে প্রশ্ন করব, সৃষ্টির আগে বিশ্বের অবস্থা কি ছিল? এবং বিশ্বই যদি তখন না থাকে তাহলে বিশ্বস্রষ্টা প্রজাপতিই(ঈশ্বর) বা কোথায় ছিলেন? তাঁর রূপই বা কিরকম ছিল? আর তখন তো কোন মানুষেরই অবস্থান সম্ভব ছিল না; তাই প্রজাপতি(ঈশ্বর) তখন যে উপস্থিত ছিলেন এ কথা কার পক্ষেই বা জানা সম্ভব? এবং কেইই বা পরবর্তীকালে সৃষ্ট মানুষদের কাছে প্রজাপতির(ঈশ্বরের) কথা পৌঁছে দিতে পারেন? যদি বল, প্রজাপতির(ঈশ্বরের) পক্ষে কোন মানুষেরই প্রত্যক্ষাদি জ্ঞানের বিষয় হওয়া সম্ভব নয়, তাহলে প্রশ্ন করবো তাঁর যে একান্তই কোনরকম অস্তিত্ব আছে সেকথাই বা জানা গেল কিভাবে?”
“তোমাদের মতে কোন এককালে বিশ্বের সৃষ্টি বা শুরু হয়েছিল; কিন্তু তা কিভাবে সম্ভবপর হতে পারে? প্রজাপতির(ঈশ্বরের) ইচ্ছায় সৃষ্টির শুরু হলো? কিন্তু সেকথা তোমারা কি করে বলবে? কেননা, তোমাদের মতেই স্রষ্টা দেহবিশিষ্ট নয়; এবং দেহ ছাড়া ইচ্ছা সম্ভবই নয়। তাই দেহবিহীন স্রষ্টার পক্ষে সৃষ্টি করার ইচ্ছাও অসম্ভব। যদি বলো, স্রষ্টার দেহ আছে, তাহলে সে দেহটিকেও তাঁরই সৃষ্টি বলতে পারো না। অতএব তাঁর দেহ সৃষ্টির জন্য আরেকটি স্রষ্টার কথা, আবার তাঁরও দেহ সৃষ্টির জন্য আরেকটি স্রষ্টার কথা- এভাবে অবিশ্রাম ভেবে যেতে হবে। স্রষ্টার দেহকে নিত্য বা অনাদিও বলা যায় না, কেননা সৃষ্টির পূর্বে ক্ষিতি, অপ্ প্রভৃতি দেহের উপাদানই যখন নেই তখন কী দিয়ে তাঁর দেহ নির্মিত হতে পারে?”

“তাছাড়া, প্রাণীদের পক্ষে নানারকম জ্বালা-যন্ত্রণায় পূর্ণ এই পৃথিবীটি সৃষ্টি করবার ইচ্ছাই বা তাঁর হলো কেন? এ-কথাও বলতে পার না যে প্রাণীদের কর্মফলের দরুনই এইসব জ্বালা-যন্ত্রণা। কেননা, সৃষ্টির পূর্বে এ জাতীয় কর্মফল সম্ভবই নয় এবং অতএব প্রাণীদের কর্মফল অনুসারে স্রষ্টার পক্ষে পৃথিবী সৃষ্টি করাও সম্ভব নয়।”

“উপকরণাদি ব্যতিরেকেও সৃষ্টি সম্ভব নয় এবং সৃষ্টির পূর্বে এ-জাতীয় উপকরণ বলে কিছুর অস্তিত্ব অসম্ভব। উর্ণনাভ বা মাকড়সার জালও উপাদানহীন সৃষ্টি নয়, কেননা ভক্ষিত পতঙ্গ থেকে মাকড়সার লালা উত্পাদন হয় এবং জালের উপাদান হিসাবে এই লালা ব্যবহৃত।”
 

বৈশেষিকেরা যে মনে করেন, ঈশ্বরের ইচ্ছায় অকস্মাত সৃষ্টি- কুমারিলের মতে তা সম্ভব নয়; কেননা

“ঘট প্রভৃতি নির্মাণের দৃষ্টান্তে দেখা যায় একটি বস্তুর নির্মাণ ক্রমপদ্ধতি মাত্র। দ্বিতীয়ত বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রলয় স্বীকার করা যায় না, কেননা তার কোন প্রমান নেই। তাছাড়া প্রলয়ের কথা স্বীকার করলে মানতে হবে যে ঈশ্বরের মনে প্রলয়ের ইচ্ছা জাগে; কিন্তু এ জাতীয় ইচ্ছায় লাভ কী? অর্থাত কোনো বুদ্ধিমান স্রষ্টার পক্ষেই নিজের সৃষ্টিকে ধ্বংস করবার ইচ্ছা জাগা সম্ভব নয়।”
“তোমাদের মতে তাঁর মধ্যে সৃষ্টির ইচ্ছা জেগেছিল; কিন্তু বলতে পার কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থর জন্য তাঁর এই ইচ্ছা জেগেছিল- এমন কোন উদ্দেশ্যই বা সম্ভব হতে পারে যা কিনা সৃষ্টি-ব্যতিরেকে চরিতার্থ হওয়া অসম্ভব? নির্বোধও উদ্দেশ্য-বিহীন কাজ করে না। অতএব তিনি যদি বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করে থাকেন তাঁর বুদ্ধিকে নিস্ফল বলতে হবে। যদি বল, এই সৃষ্টি তাঁর লীলা- প্রমোদ বা বিলাসমাত্র, তাঁকে আর সদানন্দ বা চিরসন্তুষ্ট বলতে পার না (অর্থাত সৃষ্টির পূর্বে তিনি নিশ্চয়ই প্রমোদের অভাব অনুভব করেছিলেন)।”

“বৈশেষিকেরা বলেন, সকলের দেহই বুদ্ধিমান দেহর নিয়ন্ত্রণাধীন। কিন্তু এই যুক্তি অনুসারে ঈশ্বর-দেহের নিয়ন্ত্রণ-কর্তা কে হবেন?”
 

ঈশ্বর এবং সৃষ্টি-প্রলয় সংক্রান্ত বৈশেষিক মত খন্ডন করেই কুমারিল ক্ষান্ত নন; এই প্রসঙ্গে তিনি বৈদান্তিক সৃষ্টিতত্বকেও খন্ডন করতে অগ্রসর হয়েছেন।

“নিত্য শুদ্ধ বা পরম পবিত্র পুরুষ (ব্রহ্ম বা পরমাত্মা) থেকেই যদি জগতের সৃষ্টি হয়, তাহলে জগতটিও তো পরম পবিত্র বা বিশুদ্ধ হওয়ার কথা; কিন্তু জগতে পাপাদি দোষ বা অশুদ্ধতা বর্তমান”। 

“যদি বলা হয়, জগতের পাপাদি মানুষের অতীত অধর্মের ফল (অতএব এগুলোর জন্য নিত্যশুদ্ধ পরমাত্মা দায়ী নন), তাহলে”

কুমারিল উত্তর দিচ্ছেন,

মানুষের এই অধর্ম তো তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন; অতএব পরম পবিত্র পরমাত্মার পক্ষে মানব ধর্মাধর্মকে সুনিয়ন্ত্রিত করে একটি পরম নিষ্কলুষ জগত সৃষ্টি করাই উচিত ছিল।”
বৈদান্তিকেরা বলে, জগত সৃষ্টির মূলে অবিদ্যা বা মায়া। কিন্তু কুমারিলের মতে এ কথা যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। কেননা
“তাঁদের মতে সৃষ্টির সময় ঈশ্বর (বা ব্রহ্ম) ছাড়া আর কিছুরই সত্বা ছিল না; আর যদি তাইই হয় তাহলে কিসের প্রভাবে এই মায়ার পক্ষে কার্যকরী হওয়া সম্ভব? মায়া হলো স্বপ্নের মত মিথ্যা এবং ব্রহ্ম বিশুদ্ধ; তাই একথা বলা যায় না যে ব্রহ্মই এ মায়াকে সৃষ্টিকার্যে প্রণোদিত করেন।”

সংক্ষেপে, প্রভাকর ও কুমারিল উভয়েই সামগ্রিকভাবে জগতের সৃষ্টি বা প্রলয় স্বীকার করেননি; বিভিন্ন জাগতিক বস্তুর উত্পত্তি ও বিনাশ উভয়ের মতে জাগতিক কারণ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। ঐকান্তিক অর্থে বেদপন্থী বলেই মনে হতে পারে সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর অস্বীকার করলেও মীমাংসকেরা অন্তত বৈদিক দেবতাদের কর্তৃত্বে বিশ্বাসী হবেন, এবং এই অর্থে তাঁদের মত বহু-দেববাদী হওয়াই সম্ভব। কিন্তু আপাত বিস্ময়ের কথা, মীমাংসকেরা বৈদিক দেবতাদের কর্তৃত্ব – এমনকি তাঁদের সত্বাও – সম্পূর্ণ ভাবেই অস্বীকার করেছেন।

 

পাঁচঃ চার্বাক

এতক্ষণ, আমরা বেদপন্থী আস্তিক নিরীশ্বরবাদীদের মধ্যে মীমাংসকদের আলোচনা দেখলাম। এবারে আবারো একটু বেদ-বিরোধীদের দেখি। এবারে চার্বাক প্রসঙ্গ।

চার্বাক। নামান্তরে লোকায়ত বা বার্হস্পত্য (বৃহস্পতি-প্রতিষ্ঠিত) দর্শন। চার্বাক বা লোকায়ত বলতে প্রাচীণকালের কোনো এক বস্তুবাদী বা জড়বাদী বা দেহবাদী দার্শনিক সম্প্রদায় বোঝাত। আধুনিক যুগের বস্তুবাদের সাথে ঐ প্রাক-বৌদ্ধ যুগের সুপ্রাচীণ বস্তুবাদের অভিন্নত্ব প্রত্যাশা করা যায় না; তবু নিঃসন্দেহে বলা যায় এই সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা আত্মা অস্বীকার করে জড়দেহকেই চুড়ান্ত সত্য মনে করেছিলেন এবং তাঁদের মতে ঈশ্বর ও পরলোকের কথা কল্পনামাত্র। তাঁরা দাবি করেছেন, বেদ বা শ্রুতির কোনো প্রামান্য নেই, এবং বৈদিক যাগযজ্ঞ শুধু অর্থহীনই নয়- প্রবঞ্চনামূলকও।

এই দর্শনের আলোচনায় সবচেয়েও বড় সমস্যায় পড়তে হয় তা হচ্ছে লোকায়ত সংক্রান্ত তথ্য অত্যন্ত বিরল এবং এগুলি একান্তই খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত। লোকায়তিকদের নিজস্ব কোন রচনাই খুঁজে পাওয়া যায় না (গার্বে, তুচি, দাসগুপ্ত প্রমুখের মতে লোকায়তিকদেরও পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ ছিল; এটা মেনে নিলেও বলতে হবে যে, তা বিলুপ্ত- সম্ভবত বিপক্ষেরা সেগুলো স্বেচ্ছায় ধ্বংস করেছিল)। সুতরাং চার্বাক বা লোকায়ত দর্শন সম্পর্কে আমাদের একমাত্র সম্বল বলতে বিরোধী সম্প্রদায়গুলির লোকায়ত খণ্ডন। সুতরাং বলতেই হচ্ছে, এ সম্প্রদায়ের এমনই দুর্ভাগ্য যে একমাত্র বিপক্ষের রচনা থেকেই আমাদের একে বোঝবার চেষ্টা করা সম্ভব।

স্বভাবতই বিপক্ষের প্রধান উৎসাহ লোকায়ত খণ্ডন- লোকায়ত বর্ণন নয়। ফলে এই সূত্রে লোকায়ত সংক্রান্ত যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তা যে অবিকৃত এবং নৈর্ব্যক্তিক হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা বিভিন্ন সমস্যা-প্রসঙ্গে লোকায়ত খণ্ডনের আয়োজন করেছেন; ফলে তাদের রচনায় লোকায়ত-সংক্রান্ত যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তাও নেহাতই খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত- লোকায়তের কোনো সামগ্রিক বা ধারাবাহিক পরিচয় নয়। একমাত্র মাধবাচার্যের সর্বদর্শন সংগ্রহ, শংকরাচার্য রচিত বলে খ্যাত সর্বসিদ্ধান্ত সংগ্রহ এবং হরিভদ্রসুরীর ষড়দর্শনসমুচ্চয়- প্রধানতই প্রথম গ্রন্থটি – এই উক্তির আপাত ব্যতিক্রম। মাধবাচার্যের সর্বদর্শনসংগ্রহে যে লোকায়ত আলোচনা পাই, সেটিও মূলত লোকায়তের খণ্ডন। তারপরেও মাধবাচার্যের এই গ্রন্থের উপর নির্ভর করতে হয় এই কারণে যে, এখানেই লোকায়তের তুলনামূলক পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়। আসলে মাধবাচার্য তার দর্শন-গ্রন্থটি লিপিবদ্ধ করার সময় লোকায়ত মতকে খণ্ডন করার তাগিদ বোধ করেন, কেননা তার মতে লোকায়ত খণ্ডন করতে না পারলে দর্শন গ্রন্থটি পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারবে না। এবং শেষ পর্যন্ত তাকে স্বীকার করতে হয় যে, এই লোকায়ত খন্ডন নিতান্ত সহজ সাধ্য কোন কাজ নয়।

“দুরচ্ছেদং হি চার্বাকস্য চেষ্টিতম”।
অর্থাৎ চার্বাক মত উচ্ছেদ করা নেহাত চাট্টিখানি কথা নয়।

এবারে তাহলে এই চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের কিছু আলোচনার দিকে দৃষ্টি দেয়া যাকঃ

 

আত্মা বস্তুজাত বলে চার্বাক মনে করতেন-  

পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু এই চতুর্ভূত। চার ভূত থেকেই চৈতন্য উৎপন্ন হয়, যেমন (উপযোগী সামগ্রী)….. থেকে মদ্যের শক্তি (মাদকতা)।” [কায়াদেব ততো জ্ঞানম প্রাণাপানাদ্যধিষ্ঠিতাত। যুক্তম জায়ত ইত্যেতত কম্বলাশ্যতরোদিতম। । (সর্বদর্শন-সংগ্রহ)]

 

আশ্চর্য সরল উদাহরণ দিয়ে তারা ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিতে চান: 

কিন্বাদিভ্যঃ সমতেভ্যো দ্রব্যেভো মদশ্চক্তিবৎ। কিন্ব (সুরাবীজ) ইত্যাদি কয়েটি দ্রব্য একত্রে মেশানোর ফলে যে-রকম মদশক্তির আবির্ভাব হয়, ঠিক সেই রকম। 

 

আরেকটি এরকম সরল উদাহরণ চার্বাকপন্থীদের নামে প্রচলিত আছে:  

পান, চুন, খয়ের, সুপুরি- এগুলোর কোনটার মধ্যেই টুকটুকে লাল রঙ নেই, অথচ এগুলি দিয়ে পান সেজে মুখে দিলে পর ঠোঁট দুটি টুকটুকে লাল হয়ে যায়। লাল রঙ এলো কোথা থেকে? এ রং পান-চুন-খয়ের-সুপুরি ছাড়া কিছুই নয়, অথচ পান-চুন-খয়ের-সুপুরির উপর এক অপূর্ব আবির্ভাব বৈকি। ঠিক তেমনি ক্ষিতি, তেজ, অপ, মরুৎ ছাড়া মানুষ আর কিছুই নয়, তবু এই চতুর্ভূতের এক বিশেষ সমাবেশের ফলেই চেতনা নামে ওই অপূর্ব গুনের আবির্ভাব।

সৃষ্টির জন্য নির্মাতার আবশ্যকতা নেই, একে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে:

“অগ্নি গরম, জল ঠাণ্ডা এবং বায়ু শীতল স্পর্শযুক্ত। কে এসব সৃষ্টি করেছেন? এগুলি তাদের বস্তুধর্ম বা স্বভাবানুযায়ীই হয়েছে।” (“কায়াদেব … রোদিতম”) বিশ্বসৃষ্টি তার স্বভাব থেকেই হয়, এর জন্য তার কর্তাকে অনুসন্ধান করা অনাবশ্যক- “কন্টকের তীক্ষ্ণতা, মৃগ বা পক্ষীর রূপ বৈচিত্র কে করেন? এসবই স্বভাব থেকে হয়।” (সাংখ্যকারিকার মাঠর ভাষ্য)

“আত্মা, স্বর্গ, নরক, পরলোক কোথাও যায় না। বর্ণাশ্রমাদির সকল ক্রিয়াই নিস্ফল। মৃতের উদ্দেশে প্রেতকার্য প্রভৃতি ব্রাহ্মনদের জীবনোপায় ছাড়া কিছু নয়। যারা তিন-তিনটে বেদ রচনা করেছে তারা বেবাক ভণ্ড-ধূর্ত-নিশাচরের দল।”

“জ্যোতিষ্টম যজ্ঞে যদি নিহত পশু সোজা স্বর্গেই যায়, তা হলে যজমান কেন নিজের বাপকে হাড়িকাঠে ফেলে না? শাদ্ধপিণ্ড যদি পরলোকগত মানুষের পেট ভরাতে পারে, তাহলে কেউ বিদেশ যাত্রার সময় তার সঙ্গে চিড়েমুড়ি বেঁধে দেবার আর দরকার কি? (ঘরে বসে তার উদ্দেশ্যে পিণ্ডি দিলেই চলা উচিত; হাজার হোক পরলোকের চেয়ে ইহলোকের দেশান্তর অনেক কাছের-পিঠের ব্যাপার)। আত্মা যদি দেহ থেকে নির্গত হয়ে পরলোকে যেতে পারে তবে আত্মীয়বন্ধুর স্নেহে ব্যাকুল হয়ে কেন পুনরাগমন করে না? … ব্রাহ্মনগণ নিজেদের জীবিকার্জনের উপায় হিসেবেই মৃতের শ্রাদ্ধাদির বিধান দেন।” (সর্বদর্শন-সংগ্রহ, চার্বাক দর্শন)

বুঝাই যাচ্ছে, এই দর্শনের আশ্চর্য ক্ষমতা এর সারল্য। ভারী জ্ঞানের কচকচানি নেই, ভাষার মারপ্যাচ নেই- সহজ সরল ভাষায়, দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় আশ্চর্য জীবনবোধ দিয়েই এই দর্শনের যেন পথচলা। হবেই না বা কেন? এ যে সাধারণ জনমানুষের দর্শন- নিম্নবর্গীয় লোকের, পুরোহিত শ্রেণীর কাছে নির্যাতিত মানুষের দর্শন। সেজন্যেই এর নাম লোকায়ত দর্শন। এ মতবাদের প্রচলন ঠিক বৈদিক যুগের ঠিক পরেই, পুরোহিত শ্রেণী তখন অনেকাংশে দেশের শাসক সম্প্রদায়, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই চার্বাকদের মূল প্রেরণা।

ফলে, এই দর্শনকে, এই সম্প্রদায়কে মোকাবেলা হতে হয় পুরোহিত শ্রেণীর রক্তচক্ষুকে। পুরোহিত শ্রেণী তথা শাসক গোষ্ঠী যে এই সম্প্রদায়ের উপর খড়্গহস্ত ছিল, তার প্রমাণ- তাদের স্বকীয় কোন গ্রন্থ আজ পাওয়া যায় না, পূর্ণাঙ্গ কোন তথ্য মেলাও আজ ভার। সাথে এটাও লক্ষণীয় যে, সাধারণ নিম্নবর্গের দর্শন হওয়াতে একেবারে নিশ্চিহ্নও করা সম্ভবপর হয়নি। আজও আমরা গ্রামে-গঞ্জে প্রবাদ-প্রবচনে যেসমস্ত বস্তুবাদী ছোঁয়া পাই তা তো এই দর্শনের ফল। “রাখে আল্লা মারে কে” এর বিপরীতে “সাবধানের মার নাই” বা “ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন” এর বিপরীতে “”, “ঝোপ বুঝে কোপ মারো”, “সময়ের এক ফোঁড় কি অসময়ের নয় ফোঁড়”, এসব তারই সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, শেষ পর্যন্ত চার্বাকদের বা লোকায়তিকদের দমিয়ে রাখতে, এই সম্প্রদায়ের নিদর্শন মুছে ফেলতে পুরোহিত তন্ত্র সফলকাম হয়। আর, এ থেকেই বুঝা যায় লোকায়ত মত পুরোহিত শ্রেণী বা বাহ্মণ্যবাদকে যে কতখানি ব্যতিব্যস্ত-তটস্থ করে রেখেছিল।

লোকায়তদের প্রতি পুরোহিতদের রাগের বহিপ্রকাশ আমরা তাদের প্রচারিত ধর্ম গ্রন্থ- দর্শন গ্রন্থে পাই। পুরাণ সাহিত্যে তাই চার্বাক দর্শনের কথিত প্রতিষ্ঠাতা বৃহস্পতিকে অন্য ভূমিকায় দেখা যায়। একবার দেবতাদের সাথে অসুরদের মারাত্মক এক যুদ্ধ হয়েছিল- যেখানে কোনমতেই দেবতারা পেরে উঠছিল না। তখন বৃহস্পতি মুনি অসুরদের মধ্যে গিয়ে এই দর্শনের প্রচার করে, এতে অসুরদের পতন ঘটে এবং দেবতারা জয় লাভ করে! শুধু তাই নয় চার্বাক বা লোকায়তিকদের ভোগসর্বস্ব, লোভী, নীতিবিবর্জিত হিসাবে দেখানোর এবং প্রচারের মহান(!) কর্তব্য তারাই পালন করে। চার্বাক নামটির মধ্যেও সে বিষয়টিই আমরা পাই, চার্বাক শব্দটি এসেছে চর্বন থেকে, খাওয়া-দাওয়া তথা ভোগসর্বস্ব জীবন যাপন যারা করে তারাই চার্বাক। (আজও আস্তিকরা নাস্তিকদের এমন ভোগবাদী-নীতিবর্জিত বলে প্রচার করে, যেনবা পরলোকের লোভ আর ভয় ছাড়া ইহলোকে নৈতিকতা সম্ভবই নয়!!)।

আসলে, এ পুরোহিতদের এ রকম প্রচারণার কোনরূপ সত্যতা নেই। কেননা, প্রকৃত লোভী-ভোগী ছিল পুরোহিতরা, তারা তাদের ভোগের স্বর্গ টিকিয়ে রাখার জন্যই পুরোহিততন্ত্র তথা ধর্মকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। আর উল্টোদিকে লোকায়ত মত ছিল নিম্নবর্গের মানুষের মতবাদ, তাদের ভোগসর্বস্ব জীবন যাপন কল্পনা মাত্র। ফলে, চার্বাক দর্শনের যেসমস্ত আলোচনা, বক্তব্যকে আপাত ভোগবাদী মনে হয়- সেগুলোকে ইতিহাসের বিশেষ বাস্তবতার নীরিখেই বিচার করা দরকার। “ধার করে হলেও ঘি খাও” চার্বাকদের নামে বহুল প্রচলিত এই উক্তিকে সত্যি ধরে নিলেও পুরোহিততন্ত্রের বিপরীতে একে দেখলে সম্ভবত একই রকম ভোগসর্বস্ব মনে হওয়ার কথা নয়। যেমনঃ
 

পুরোহিততন্ত্র: ধার করে হোক আর যেমন করেই হোক- পিতৃশ্রাদ্ধের দিন পুরোহিত ভোজন করাতে ভুললে চলবে না।
লোকায়ত:: ধার করে হোক করেই হোক আর যেমন করেই হোক নিজের পেট টাকে ঠাণ্ডা রাখাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। ‘ধার করে হলেও ঘি খাও’।

পুরোহিততন্ত্র: এ পৃথিবী কেবল দুঃখময়, তাই ভোগান্বেষণ করতে গেলে শেষ পর্যন্ত দুঃখের জালেই জড়িয়ে পড়তে হবে।
লোকায়ত:: মাছ খেতে গেলে গলায় কাঁটা বেঁধবার ভয় নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তাই বলে কি মাছ খাবার চেষ্টাই করবে না? জড়জগতই যেহেতু একমাত্র সত্য সেহেতু ইহলোকের সুখভোগই মানুষের একমাত্র পুরুষার্থ। দেহ একবার ভস্মীভূত হলে পুনরাগমনের আর সম্ভবনাই নেই- অতএব যতদিন বাঁচা যায়, সুখে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে।

এই “ইহকালের ইহলোকের সুখভোগই মানুষের একমাত্র পুরুষার্থ”কে পুরোহিত তন্ত্রের ভোগবাদীতার বিরুদ্ধে নিম্নবর্গীয় লোকেদের পাল্টা জবাব হিসাবেই দেখতে হবে। কেননা এতদিন পরলোকের সুখভোগের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ইহলোকের সুখলাভ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে নিম্নবর্গের মানুষদের, আর সে সুযোগে পুরোহিত-তন্ত্র ইহলোকেই গড়ে তুলেছে সুখভোগের স্বর্গ!

আর, সহজবোধ্যতা- সারল্য- বিশুদ্ধ জ্ঞানের বোঝাকে ছাপিয়ে অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির মিশেলে জগৎ-সংসারকে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা -এসব কিছুর চেয়েও তাই লোকায়ত দর্শনের এই তেজ, এই বিদ্রোহের জন্য এই দর্শন অনন্য।

 

গ্রন্থসূত্রঃ
১। দর্শন দিগ দর্শন- রাহুল সাংকৃত্যায়ন
২। ভারতীয় দর্শন- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
৩। বার্ট্রান্ড রাসেল, দর্শনের রূপরেখা – অনুবাদ ডঃ আব্দুল মতিন
৪। লোকায়াত দর্শন- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

৫। ভাববাদ খণ্ডন- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

 

প্রথম প্রকাশঃ সামহোয়ারইনব্লগ ও মুক্তমনা ব্লগ, নভেম্বর - ২০০৮।

মঙ্গলবার, ২৪ জুন, ২০০৮

নবীজী মুহম্মদ সা. এর বিয়েসমূহ এবং কিছু প্রশ্ন


নবীজীর ব হুবিবাহের পক্ষে যুক্তি করে বিভিন্ন সময়ে সাচ্চা মুসলমানদের নানারকম যুক্তি করতে দেখা যায়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো ভুলে ও মিথ্যায় ভরা। সেরকম কিছু যুক্তি দেখেছিলাম আলামা ইউসুফ আল কারদাওয়ী ও আরো কয়েকজনের বিভিন্ন প্রবন্ধে। সেখানকার যুক্তি গুলো যাচাই করতে গিয়েই যে বিষয়গুলো ধরা পড়লো, তা নিয়ে এই প্রবন্ধটি সাজিয়েছি।

এক
এক জায়গায় একজনের আলোচনায় দেখলাম গড়পরতায় বলা হয়েছে:
"নবীজী সা: এর স্ত্রীদের দুজনের বয়স শুধু ৩৬ বছরের নীচে ছিল। বাকী স্ত্রীগনের বয়স ছিল ৩৬ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে"।

এটা যে একটি নির্জলা মিথ্যাচার তা নিচের তালিকা দেখলেই পরিষ্কার হবে।
 
৩৬ বছরের নীচের স্ত্রীদের তালিকাঃ(1)
১। আয়েশাঃ আয়েশাকে বিয়ে করেন ৬ বছর বয়সে (2) এবং আয়েশা মুহম্মদ সা এর ঘরে প্রবেশ করেন (বাসর হয়) ৯ বছর বয়সে। এমনকি বাচ্চা আয়েশার সাথে বন্ধুবর বা ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখা বয়স্ক মুহম্মদ সা এর বিয়ের প্রস্তাবে প্রথমে আবু বকর রা ও অবাক হয়েছিলেন এবং নবীজীকে প্রশ্ন ছুড়েছিলেন। (3)
 
২। হাফসাঃ হাফসা বিধবা হন ১৮ বছর বয়সে, উমর রা পর্যায়ক্রমে আবু বকর রা ও ওসমান রা কে প্রস্তাব পাঠালে তাঁরা উভয়েই হাফসা কে বিয়ে করতে অসম্মত হন কেননা তাঁরা জানতেন যে মুহম্মদ সা হাফসা কে বিয়ে করতে মনস্থির করেছেন (4)! অবশেষে মুহম্মদ সা যখন হাফসাকে বিয়ে করেন তখন তার বয়স ছিল ২০ বছর
 
৩। সাফিয়াঃ খায়বরের যুদ্ধে সাফিয়ার (5) স্বামিকে হত্যা করে সাফিয়াকে বন্দী করা হয়। প্রথমে মালে গনীমতের ভাগাভাগিতে সাফিয়া অন্য এক সাহাবার ভাগে পড়েছিল। কিন্তু সাফিয়ার রূপের কথা ছড়িয়ে পড়লে, মুহম্মদ সা তাকে নিজের করায়ত্তে নেন এবং বিয়ে করেন। বিয়ের সময় সাফিয়ার বয়স ছিল ১৭ বছর
 
৪। জুহারিয়াঃ বনী মুস্তালকের যুদ্ধে গোত্র প্রধানের কন্যা জুহারিয়াকে গনীমতের মালের সাথে মদীনায় আনা হয়। বাবা মুক্তিপণ দিয়ে পাঠাতে চাইলেও মুহাম্মদ সা ফিরিয়ে দেন এবং জুহারিয়াকে বিয়ে করেন। তখন জুহারিয়ার বয়স ছিল ২০ বছর
 
৫। সালমাঃ সালমা ও তার স্বামী ইসলামের প্রথম যুগে ইসলাম গ্রহণকারী এবং যথেস্ট নির্যাতন সহ্যকারী। একসময় সালমা তার স্বামী সন্তানকেও হারিয়েছিলেন, সেখান থেকে অনেক কষ্ট স্বীকার করে তিনি স্বামী সন্তানের সাথে মদীনায় মিলিত হন (এই ঘটনা পড়লে বুঝবেন কতখানি ভালোবাসতেন তার স্বামীকে!)। উহুদের যুদ্ধে ওনার স্বামী খুব খারাপভাবে আহত হন এবং একসময় মৃত্যুবরণ করেন। স্বামী মারা যাবার মাত্র ৪ মাস ১০ দিন পরেই (৪ ইদ্দত পার হলে) সুন্দরী সালমাকে বিয়ে করার জন্য আবু বকর প্রস্তাব পাঠান, আবু বকরকে না করে দিলে এবারে উমর বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠান। তাকেও না করে দেন। এবারে মুহম্মদ সা প্রস্তাব পাঠালে তিনি তার সন্তান-সন্ততির কথা সহ আরো কিছু আপত্তির কথা জানালেও মুহম্মদ সা কে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি! সালমাকে বিয়ে করার সময় বয়স ছিল ২৯ বছর।
 
৬। জয়নবঃ জয়নবকে বিয়ে করার সময় তার বয়স ছিল ৩০ বছর। (বিয়ের পর মাত্র ৮ মাস বেঁচে ছিলেন তিনি)।
 
এর বাইরে হাবিবার কথা বলা যায়। অবশ্য তাকে ওনার তালিকাতে রাখতেও আপত্তি নেই।
 
৭। হাবিবাঃ হাবশায় স্বামী সহ হিজরত করার পর স্বামী ইসলাম ত্যাগ করে খৃস্টান হয়ে গেলে স্বামীর সাথে তালাক হয়ে যায়। তখন মুহম্মদ সা দূত মারফত ১ হিজরী সনে হাবিবাকে বিয়ে করেন। তখন হাবিবার বয়স ছিল ২৯ বছর। তারো প্রায় ৬ বছর পরে হাবিবা মদীনায় আসেন এবং নবীজির ঘর করেন। যেসময় মদীনায় নবীর ঘরে আসেন সেসময় তার বয়স ছিল ৩৫।
 
১১ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জনের বয়স বিবাহ কালীন সময়ে ৩৬ উর্ধ্ব ছিল (যয়নবের বয়স অবশ্য ছিল ৩৫!)। আর নবী পত্নী মতান্তরে উপপত্নী মারিয়া ও রায়হানার কারোরই বয়স ২০/২২ বছর এর বেশী ছিল না।
 
 
দুই
অনেকেই যুক্তি করেন যে,
"তার দুটো বিয়েকেই শুধু স্বাভাবিক বিয়ে বলা যায়। বাকীগুলো ছিল মুলত সোসাল রিফর্ম কিংবা রাজনৈতিক কারনে"।
কোন দুটি বিয়ে স্বাভাবিক?
খাদিজার সাথে বিয়ে কি সোসাল রিফর্ম বা রাজনৈতিক কারণে?
সওদা ছিলেন মধ্যবয়স্ক ও বিধবা। সওদা কে বিয়ের পেছনে মূল কারণ হিসাবে জানা যায় মুহম্মদ সা এর সন্তানদের দেখাশুনা ও ঘর সামাল দেয়া। সেখানে রাজনৈতিক কারণ কি?
 
আয়শা ও হাফসা যথক্রমে আবু বকর রা ও উমর রা এর কন্যা। যেসময়ে বিয়ে করেন তখন আবু বকর ও উমর রা উভয়েই ইসলামের পরীক্ষিত সেনা। এখানে রাজনৈতিক কারণ কি? বা সোশাল রিফর্ম ই বা কি?
জয়নবকে (পালক পুত্রের স্ত্রী যয়নব না) বিয়ের পেছনে রাজনৈতিক বা সোশাল রিফর্ম কি?
 
মায়মুনা নিজে থেকে মুহম্মদ সা কে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মায়মুনার এক বৈমাত্রীয় বোন জয়নবকে নবীজি আগেই বিয়ে করেছিলেন, অপর বৈমাত্রীয় বোন আসমা আবু বকরের স্ত্রী এবং আরেক বৈমাত্রীয় বোন সালমা 'আসাদুল্লাহ' হামজার স্ত্রী। সেকারণে মায়মুনাকে "আহলুল বায়েত" বলা হতো। মায়মুনাকে বিয়ে করায় কোথায় কি সোশাল রিফর্ম হয়েছে বা রাজনৈতিক কারণ ছিল?? মায়মুনার এক বোন নাজাদ গোত্র প্রধানের স্ত্রী ছিল ঠিকই, কিন্তু সেই নাজাদ গোত্র প্রধানের স্ত্রী তো জয়নব, আসমা, সালমারও বোন ছিলেন!!!
 
সালমার স্বামী মারা যাবার পরে তাকে বিয়ে করার পেছনে রাজনৈতিক কারণ কি ছিল? এই বিধবা বিয়ের মধ্য দিয়ে কি-ই বা সোশাল রিফর্ম হয়েছে?হাবিবার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক কারণ কি ছিল? হাবশায় হিজরত করলেও পিতা আবু সুফিয়ান ইসলামের শত্রুতা কমান নি। এমনকি ১ম স্বামী ইসলাম ত্যাগ করার পরে নবিজি হাবিবাকে বিয়ে করার পরেও অসংখ্যা যুদ্ধে কোরায়েশদের আর্থিক সাহায্য করে গেছেন, হাবিবা মদীনায় সংসার শুরু করার পরেও আবু সুফিয়ান একই কাজ করে গেছেন। কেবল মক্কা বিজয়ের পরেই যখন কোরায়েশরা মুসলিম বাহিনীর করায়ত্ত হয় তখনই সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন।
 
খায়বরের যুদ্ধে আর বনী মুস্তালকের যুদ্ধে হস্তগত সাফিয়া ও জুহারিআর সাথে বিয়েকে আপনি রাজনৈতিক বলতে পারেন। কিন্তু একে চরম অন্যায় না বলার কোন কারণ দেখি না। যুদ্ধে পরাজিত পক্ষের নারীদের ধরে ধরে ভোগ করা, বন্দী করা, কৃতদাসী বানানো এসব খুবই ঘৃণ্য কাজ।
 
একই ভাবে পালক পুত্রের স্ত্রীকে তালাকের পরে বিয়ে করাটাকে সোশাল রিফর্ম বলতে পারেন, তবে সেই সোশাল রিফর্ম কেন জরুরী হলো কেউ কি বলবেন?
 
 
তিন
কারদাওয়ী বলেছেন,
"চিন্তা করে দেখুন রাসুল সা. যদি চারজন স্ত্রী রেখে অন্যদের তালাক দিতেন তবে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীদের বাকী জীবন অন্যকোন পুরুষের সাথে নিষিদ্ধ হতো। ফলে বাকী জীবন তাদেরকে স্বামীবিহীন অবস্থায় কাটাতে হতো। ..."

খাদীজার মৃত্যুর পরেই মুহম্মদ সা বাকি বিয়ে গুলো করেন - মূলত ৫৩ থেকে বছর থেকে ৬০ মতান্তরে ৬২ বছর বয়স পর্যন্ত। মুহম্মদ সা এর জন্য নতুন বিয়ে নিষিদ্ধ করে আয়াত আসে ওনার ৬০ বছর বয়সে, সে হিসাবে মায়মুনাই ওনার শেষ স্ত্রী হওয়ার কথা। মুহম্মদ সা মৃত্যুবরণ করেন ১১ হিজরীতে ৬৩ বছর বয়সে, মানে ৩ বছর পরেই। ফলে ৬০ বছর বয়সে ৪ জনকে রেখে বাকিদের তালাক দিয়ে দিলে স্ত্রীরা সঙ্গীহীন অবস্থায় অতিরিক্ত ৩ বছর কাটাতো। সঙ্গীহীন অবস্থায় যতটা ওনারা এমনিতেই কাটিয়েছেন- তার তুলনায় এই ৩ বছর মনে হয় নগণ্যই!!

 
এক পলক দেখি কে কত বছর সঙ্গীহীন কাটিয়েছেন?(6)
 
সওদাঃ মৃত্যুবরণ করেন ৫৩ হিজরীতে। মানে ৪২ বছর সঙ্গীহীন কাটিয়েছেন।
 
আয়শাঃ ১১ হিজরীতে বয়স ১৬ বছর। মৃত্যুবরণ করেন ৫৮ হিজরীতে ৬৩ বছর বয়সে। মানে বিধবা অবস্থায় কাটান ৪৭ বছর।
 
হাফসাঃ ১১ হিজরীতে বয়স ২৭ বছর। মৃত্যবরণ করেন ৪৫ হিজরীতে ৬১ বছর। মানে ৩৪ বছর বিধবা অবস্থায় কাটিয়েছেন।
 
সালমাঃ ১১ হিজরীতে বয়স ৩৫, মৃত্যুবরণ করেন ৬১ হিজরীতে ৮৫ বছর বয়সে। মানে বিধবা অবস্থায় সঙ্গীহীন কাটাতে হয়েছে ৫০ বছর।
 
যয়নবঃ ১১ হিজরীতে বয়স ৪০, মৃত্যুবরণ করেন ২০ হিজরীতে ৫০ বছর বয়সে। মানে সঙ্গীহীন থাকেন ১০ বছর।
 
জুহারিআঃ ১১ হিজরীতে বয়স ২৬ বছর, মৃত্যুবরণ করেন ৫০ হিজরীতে ৬৫ বছর বয়সে। মানে বিধবা অবস্থায় কাটান ৩৯ বছর।
 
হাবিবাঃ ১১ হিজরীতে বয়স ৩৯ বছর। মৃত্যুবরণ করেন ৪৪ হিজরীতে ৭২ বছর বয়সে। মানে ৩৩ বছর সঙ্গীহীন কাটান।
 
সাফিয়াঃ ১১ হিজরীতে বয়স ২১ বছর। মৃত্যুবরণ করেন ৫০ হিজরীতে ৬০ বছর বয়সে। মানে বিধবা অবস্থায় কাটান ৩৯ বছর।
 
মায়মুনাঃ ১১ হিজরীতে বয়স ছিল ৪০ এবং ৮০ বছর বয়সে ৫১ হিজরীতে মারা যান, তার মানে বিধবা অবস্থায় ৪০ বছর একা কাটিয়েছেন।
 
খাদিজা ও জয়নব মুহম্মদ সা এর জীবদ্দশায় মারা যান। সওদা মুহম্মদ সা এর ওফাতের ৫ বছর পরে ও মারিয়া কিবতিয়া ১ বছর পরেই মারা যান।
 
উপরের এই তালিকা উল্লেখের আরেকটি গুরুত্ব আছে তা হলোঃ এটাই যে মুহম্মদ সা যেসকল নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তাদের প্রতি কতখানি অবিচার করা হয়েছে তা বুঝা। নবীজীর বিয়েগুলোর মধ্যে অধিকাংশই বিধবা বিয়ে। তারমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে নবীজী ২য় নন, ৩য় স্বামী। অনেকে ৩৫/৪০ বছর বয়সে এসেও নবীকে বিয়ে করেছেন। অন্য সাহাবীদের খোঁজ নিলেও দেখা যায় ওনাদের বিয়ের মধ্যেও বিধবা বিবাহ আছে। সুতরাং,বলা যায়আরবে এই বিদঃবা বিয়ে একটি সাধারণ ও স্বাভাবিক চল ছিল। যেমন খাদিজা নিজেই ৪০ বছর বয়সে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন, তেমনি অনেক বিধবাই নতুন বিয়েতে আগ্রহী ছিলেন। অথচ, নবীজী শেষ বয়সে কম বয়স্ক নারীদের বিয়ে করে সেই নারীদের জীবনের একটা বড় সময় সঙ্গীহীন রাখতে বাধ্য করেছেন। মৃত্যুর সময়ে আয়েশার বয়স ছিল মাত্র ১৬, সাফিয়ার ২১, জুহারিআর ২৬, হাফসার ২৭ বছর বয়স ছিল। এবং তাদেরকে বাকি জীবনটি (৪০ থেকে ৫০ বছর) একা নিঃসঙ্গ কাটাতে বাধ্য করা হয়েছে!!!
 
 সাফিয়া-মায়মুনাকে নবীজী ৬০ বছর বয়সে বিয়ে করেন, অর্থাৎ মাত্র ৩ বছর ছিল তাদের দাম্পত্য জীবন!!!
 
এবং এ সমস্ত অন্যায় সবই করা হয়েছে কোরআনের বরাদ দিয়ে!!
 
 
চারঃ
কারদাওয়ী এক পর্যায়ে ঘোষণা করেছেন,
"বিস্তরিত এ আলোচনায় বোঝা যায় যে, রাসুল সা. এর প্রতিটি বিয়ের পিছনেই ছিল মহত উদ্দেশ্য। রুপ সৌন্দর্য, অর্থ সম্পদ বা যৌন কামনা তাড়িত বিয়ে একটিও ছিলো না"।

এই বাক্য দুটির আগের আলোচনা কয়েকবার পড়ে দেখলাম, মুহম্মদ সা এর কয়েকটি বিয়ের ব্যাপারে একটা গড়পরতা আলোচনা (সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে) করার চেষ্টা হয়েছে। যেমন:
সালমা রা. ধৈর্যের সাথে বৈধব্যকাল অতিবাহিত করায় আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যের পুরস্কার স্বরূপ রাসুল সা. এর স্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন। জুওয়াইয়া রা. কে রাসুল সা. এ উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছিলেন যে, বিয়ের পর জুওয়াইয়ার কওমের লোক ইসলাম গ্রহণ করবে। আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবিবাকে তার কষ্ট লাঘবের জন্য (হাবশায় হিজরতের পর তার স্বামি মুরতাদ হয়েছিল ও মারা গিয়েছিল) রাসুল সা. বিয়ে করেন এবং ইসলামের প্রতি আবু সুফিয়ানের শত্রুতা যাতে কমে সে উদ্দেশ্যও ছিল।
এ আলোচনায় কোনভাবেই কি পরিষ্কার হয় যে, রূপ সৌন্দর্য, অর্থ সম্পদ বা যৌন কামনা তাড়িত বিয়ে একটিও ছিলো না?
 
মুহম্মদ সা এর বিয়ে গুলোর পেছনে রূপ-সৌন্দর্য, বংশ গরিমা, অর্থ-সম্পদ, যৌন কামনাই মূল নিয়ামক এটা আমি দাবী করছি না, তবে ইতিহাস যতখানি দেখি, সেখান থেকে এটুকু বলতে পারি- ওনার স্ত্রীদের কারো কারো ছিল অঢেল অর্থ-সম্পদ, কারো ছিল বংশ গরিমা, অনেকেই ছিল নজরকাড়া সুন্দরী; এবং বিভিন্ন ঘটনায় ওনার যৌন কামনার বিষয়টিও ফুটে ওঠে বৈকি!!
 
খাদিজা ছিলেন আরবের শীর্ষ ধনীর অন্যতম। আয়েশা, হাফসা, মায়মুনা, সালমা, হাবিবা, যয়নব প্রত্যেকেই উচু বংশের। এমনকি যুদ্ধে ধৃত জোহারিআ ও সাফিয়াও ছিলেন স্ব স্ব গোত্রপ্রধানের মেয়ে। আয়েশা নাবালিকা হলেও, একসময় তিনি হন খুবই রূপবতী। যেকারণে ওমর রা তার মেয়েকে সাবধান করে বলেন যে,
"... এবং কখনোই তোমার প্রতিবেশীকে (আয়েশা রা. কে) নবীজীর প্রতিপক্ষ বানিয়ো না, যদিও সে তোমার চেয়ে অধিক সুন্দরী ও মুহম্মদ সা. এর বেশী প্রিয়"। (7)

সালমা, যয়নব, জুহারিআ, সাফিয়া, মারিয়া যে ভীষণ সুন্দরী ছিলেন তা অনেক গুলো হাদিসে পাওয়া যায়, অনেক আলেম-ইতিহাস রচয়িতার বয়ানেও আমরা তার সমর্থন পাই। জুহারিআকে যখন বন্দী অবস্থায় মদীনায় আনা হয়, তখন তিনি মুহম্মদ সা এর সাথে দেখা করার জন মনস্থির করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শুরুতে আয়েশা যখন দেখেন যে জুহারিআ অনেক সুন্দরী, বংশও উচু, তখন আয়েশা জুহারিআর সাথে যাতে মুহম্মদ সা এর সাক্ষাৎ না হয়, সে চেস্টা করেছিলেন! সালমা এমন সুন্দরী ছিলেন যে, সালমার স্বামী মারা যাওয়ার পরে ৪ ইদ্দত কাল পার হতে না হতে একে একে আবু বকর, উমর বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে পাঠান এবং ওনাদের প্রত্যাখ্যান করলে মুহম্মদ সা নিজে প্রস্তাব পাঠান ও বিয়ে করেন। খায়বরের যুদ্ধে সাহাবীদের মধ্যেই মৃত কিনানার স্ত্রীর সৌন্দর্য নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল, এবং নবীজী নিজের ভাগে শোকাহত সাফিয়াকে নিয়ে নেন এবং বিয়ে করেন।
 
যৌন কামনার বিষয়টি বুঝা যায়, এতগুলো স্ত্রী থাকার পরেও তার কৃতদাসী বা উপপত্নীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার ঘটনাসমূহ থেকে। রায়হানা ও মারিয়ার কথা ইসলামী স্কলারেরা(8) অস্বীকার করেন না। অনেকেই তাদের উম্মুল মুমিনীন বলেও মানেন। তবে সুন্দরী মারিয়াকে বিয়ে করলেও সেটা তিনি করেছেন, সন্তান ইব্রাহীম জন্মানোর আগে নয়। মারিয়াকে নিয়ে তার স্ত্রীদের সাথে একবার বড় ধরণের মনোমালিন্যও তৈরী হয়েছিল (9), এবং সুরা তাহরীমের ১ম ৫টি আয়াত (10) অবতীর্ণ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছিল!! একসময় নবীজীর যে ৯ স্ত্রী ছিল এবং যাদের কাছে পর্যায়ক্রমে যেতেন- সেই ৯ জনের তালিকায় মারিয়া বা রায়হানা কেউ ছিলেন না।
 
আরেকটি ঘটনাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো- সাওদা যখন বয়স্ক ও যৌন অক্ষম হয়ে যান- তখন তাকে তালাক দিতে চেয়েছিলেন(11)। পরে সাওদা তার পালা আয়েশাকে দিতে চাইলে নবীজী তালাক আর দেননি এবং এ প্রসঙ্গে আয়াত ৪:১২৮ অবতীর্ণ হয়। প্রশ্ন হলো, যৌন কামনা যদি ওনার বিয়ে গুলোর কোন উদ্দেশ্য না হয় তবে কেন সাওদা বয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে তাকে তালাক দিতে চাইবেন? কেন ই বা ৮ স্ত্রীর সাথে ও কিছু উপপত্নী/দাসীর সাথে সম্পর্ক থাকার পরেও এক বুড়িয়ে যাওয়া সাওদার সাথে পালার একটা দিন / রাত কাটাতে পারেন না???
 
তথ্যসূত্র ও টীকাঃ
 
2. Volume 5, Book 58, Number 234 :
Narrated Aisha: The Prophet engaged me when I was a girl of six (years). We went to Medina and stayed at the home of Bani-al-Harith bin Khazraj. Then I got ill and my hair fell down. Later on my hair grew (again) and my mother, Um Ruman, came to me while I was playing in a swing with some of my girl friends. She called me, and I went to her, not knowing what she wanted to do to me. She caught me by the hand and made me stand at the door of the house. I was breathless then, and when my breathing became Allright, she took some water and rubbed my face and head with it. Then she took me into the house. There in the house I saw some Ansari women who said, "Best wishes and Allah's Blessing and a good luck." Then she entrusted me to them and they prepared me (for the marriage). Unexpectedly Allah's Apostle came to me in the forenoon and my mother handed me over to him, and at that time I was a girl of nine years of age.
 
Volume 8, Book 73, Number 151:Narrated 'Aisha: I used to play with the dolls in the presence of the Prophet, and my girl friends also used to play with me. When Allah's Apostle used to enter (my dwelling place) they used to hide themselves, but the Prophet would call them to join and play with me. (The playing with the dolls and similar images is forbidden, but it was allowed for 'Aisha at that time, as she was a little girl, not yet reached the age of puberty.) (Fateh-al-Bari page 143, Vol.13)

Sahih Muslim, Book 8, Number 3309:'A'isha (Allah be pleased with her) reported: Allah's Messenger (may peace be upon him) married me when I was six years old, and I was admitted to his house at the age of nine. She further said: We went to Medina and I had an attack of fever for a month, and my hair had come down to the earlobes. Umm Ruman (my mother) came to me and I was at that time on a swing along with my playmates. She called me loudly and I went to her and I did not know what she had wanted of me. She took hold of my hand and took me to the door, and I was saying: Ha, ha (as if I was gasping), until the agitation of my heart was over. She took me to a house, where had gathered the women of the Ansar. They all blessed me and wished me good luck and said: May you have share in good. She (my mother) entrusted me to them. They washed my head and embellished me and nothing frightened me. Allah's Messenger (, may peace be upon him) came there in the morning, and I was entrusted to him.
Sahih Muslim, Book 8, Number 3310 :'A'isha (Allah be pleased with her) reported: Allah's Apostle (may peace be upon him) married me when I was six years old, and I was admitted to his house when I was nine years old.
 
Sahih Muslim, Book 8, Number 3311:'A'isha (Allah be pleased with her) reported that Allah's Apostle (may peace be upon him) married her when she was seven years old, and he was taken to his house as a bride when she was nine, and her dolls were with her; and when he (the Holy Prophet) died she was eighteen years old.
 
3. Volume 7, Book 62, Number 18:
(http://www.usc.edu/dept/MSA/fundamentals/hadithsunnah/bukhari/062.sbt.html#007.062.018)
Narrated 'Ursa: The Prophet asked Abu Bakr for 'Aisha's hand in marriage. Abu Bakr said "But I am your brother." The Prophet said, "You are my brother in Allah's religion and His Book, but she (Aisha) is lawful for me to marry."

4. Volume 5, Book 59, Number 342:
Narrated 'Abdullah bin 'Umar: Umar bin Al-Khattab said, "When (my daughter) Hafsa bint 'Umar lost her husband Khunais bin Hudhaifa As-Sahrni who was one of the companions of Allah's Apostle and had fought in the battle of Badr and had died in Medina, I met 'Uthman bin 'Affan and suggested that he should marry Hafsa saying, "If you wish, I will marry Hafsa bint 'Umar to you,' on that, he said, 'I will think it over.' I waited for a few days and then he said to me. 'I am of the opinion that I shall not marry at present.' Then I met Abu Bakr and said, 'if you wish, I will marry you, Hafsa bint 'Umar.' He kept quiet and did not give me any reply and I became more angry with him than I was with Uthman . Some days later, Allah's Apostle demanded her hand in marriage and I married her to him. Later on Abu Bakr met me and said, "Perhaps you were angry with me when you offered me Hafsa for marriage and I gave no reply to you?' I said, 'Yes.' Abu Bakr said, 'Nothing prevented me from accepting your offer except that I learnt that Allah's Apostle had referred to the issue of Hafsa and I did not want to disclose the secret of Allah's Apostle , but had he (i.e. the Prophet) given her up I would surely have accepted her."
 
5. শায়খুল হাদীস মওলানা মোঃ আজিযজুল হক অনুদিত সহীহ বোখারী শরীফঃ সপ্তম খন্ড, প্রথম অধ্যায়ের ১৮৪২, ১৮৪৪, ২৪২১ নং হাদীসঃ
 
১৮৪২ নং হাদীসঃ হজরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা মদীনা থেকে রওনা দিয়ে খায়বর পৌঁছলাম। আল্লাহ তা'আলা হজরত নবী করিম (স)-কে খায়বরের দূর্গ গুলোর উপর বিজয় দান করেন। এ সময় হজরত নবী করিম (স) এর কাছে ইহুদী নেতা হুয়াই ইবনে আখতাবের কন্যা সফিয়ার সৌন্দর্যের কথা বলা হয়। তিনি ছিলেন সদ্য পরিনীতা। তাঁর স্বামী কেনানা ইবনে রবী খায়বর যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। হজরত নবী করিম (স) তাঁকে নিজের জন্য মনোনীত করেন এবং সাথে নিয়ে খায়বর থেকে রওয়ানা হন। আমরা যখন সাদ্দুস সাহবা নামক জায়াগায় উপনীত হই, সফিয়া তখন ঋতু থেকে পবিত্রতা লাভ করেন। হজরত নবী করিম (স) এ স্থানে তাঁর সাথে নির্জনবাস করেন।ওয়ালিমা স্বরূপ হজরত নবী করিম (স) - ঘিয়ের মধ্যে খেজুর ভিজিয়ে হাইস নামক এক প্রকার উপাদেয় খাবার প্রস্তুত করে ছোট দস্তরখান সাজিয়ে আমাকে বললেন, তোমার আশেপাশে যারা আছে তাদেরকে জানিয়ে দাও। এটাই ছিল হজরত নবী করিম (স) এর সাথে সফিয়ার বিয়ের ওয়ালিমা। এরপর আমরা মদীনার দিকে রওয়ানা হলাম। আমি নবী করিম (স) কে তাঁর পেছনে হজরত সফিয়ার জন্য একখানা চাদর বিছাতে দেখলাম। তারপর তিনি উটের উপর নিজের হাটুদ্বয় মেলে বসলেন, আর সফিয়া হজরত নবী করিম (স) এর হাটুর উপর পা রেখে সওয়ারীতে পেছনে আরোহন করলেন।
 
১৮৪৪ নং হাদীসঃ হজরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত তিনি বলেন, হজরত নবী করিম (স) খায়বর থেকে মদীনায় যেতে পথিমধ্যে তিনদিন অবস্থান করেন। এসময় তিনি সফিয়ার সাথে নির্জনবাস করেন। আমি মুসলমানদেরকে ওয়ালিমার দাওয়াত দিলাম। কিন্তু ওয়ালিমার এ দাওয়াতে রুটি বা গোশতের ব্যবস্থা ছিল না। ব্যবস্থা যা ছিল তা হলো, তিনি বেলাল (রাঃ) কে দস্তরখন বিছাতে বলেন। দস্তরখান বিছানো হলে তিনি সবার জন্য কেজুর, পনির ও ঘৃত পরিবেশন করেন। এ ব্যবস্থা দেখে মুসলমানরা পরষ্পর বলাবলি শুরু করলো, সফিয়া কি উম্মুল মুমেনীন না ক্রীতদাসী? তখন সবাই বলল, যদি হজরত নবী করিম (স) তাকে পর্দা করান, তবে তিনি উম্মুল মুমিনীন, অন্যথায় বুঝতে হবে তিনি ক্রীতদাসী। অত:পর হজরত নবী করিম (স) রওয়ানা হওয়ার সময় তাঁর (সফিয়ার) জন্য নিজের পেছনে বসার জায়গা করে পর্দা টানিয়ে আড়াল করে দেন।
 
২৪২১ নং হাদীসঃ হজরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স) সফিয়াকে আযাদ করে বিয়ে করলেন এবং আযাদ করাই তাঁর মোহরানা ধার্য হলো। তাঁর বিয়েতে হাইস দ্বারা ওয়ালিমা করা হয়।
 
 
7. সহীহ বুখারী শরীফঃ ভলিউম ৩, বই ৪৩, হাদীস ৬৪৮:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, যে দুইজন নারী সম্পর্কে কোরআন পাকে (আয়াত ৬৬:৪) বলা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে হযরত ওমর রা. কে প্রশ্ন করার ইচ্ছা বেশ কিছুকাল পর্যন্ত আমার মনে ছিল। অবশেষে একবার তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে আমিও সফরসঙ্গী হয়ে গেলাম। (হজ্জ থেকে ফেরার পথে) ওমর একপাশে গেলে (প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে), আমিও (ওযুর)পানি নিয়ে তার সাথে যাই। যখন তিনি ফিরলেন, আমি তার হাতে পানি ঢালছিলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, "ওহ বিশ্বাসীদের প্রধান! নবী করিম সা. এর কোন দুজন নারীর ব্যাপারে কোরআনের এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছেঃ যদি তোমরা দুজন তওবা করো (৬৬:৪)।"

 

তখন ওমর রা. বললেন, "আমি এবং বনী উমাইয়া বিন জাহিদ গোত্রের আমার এক আনসারী প্রতিবেশী মদীনার আওয়ালীতে বাস করতাম ও পর্যায়ক্রমে রাসুলুল্লাহ সা. কাছে যেতাম। তিনি একদিন যেতেন আর আমি অন্যদিন। যেদিন আমি যেতাম রাসুলুল্লাহ সা. এর সেদিনকার আদেশ-নির্দেশাবলী সমেত ঘটনাসমূহ তাকে (প্রতিবেশীকে) বলতাম এবং যেদিন তিনি যেতেন, তিনিও আমার কাছে অনুরূপ করতেন। আমরা, কোরায়েশ পুরুষরা, যখন মক্কায় বাস করতাম তখন নারীদের উপর অধিক কর্তৃত্ব ভোগ করতাম, কিন্তু আমরা যখন মদীনায় আসলাম তখন লক্ষ করলাম যে, আনসার নারীরা পুরুষদের উপর অধিক কর্তৃত্ব ভোগ করে। ফলে, আমাদের নারীরা আনসার নারীদের অভ্যাস গ্রহণ করতে শুরু করে। একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি চিৎকার করলে আমার স্ত্রীও আমার সাথে মুখে মুখে তর্ক করলেন ও পাই পাই বুঝিয়ে দিলেন। আমি এটা অপছন্দ করলে তিনি বললেন, "আপনাকে প্রতি উত্তর দিলে সেটাকে আপনি খারাপভাবে নিচ্ছেন কেন? আল্লাহর কসম! নবী করিম সা. এর স্ত্রীরাও তাঁর সাথে মুখে মুখে তর্ক করেছেন এবং স্ত্রীদের কেউ কেউ দিন থেকে রাত অবধি তাঁর সাথে কথা পর্যন্ত বলেননি"। আমার স্ত্রী যেটি বললো আমাকে ভীত করলো এবং আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তাঁদের মধ্যে যেই এমন করে, সে-ই ভয়ানক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন"। আমি পোশাক পরিধান করে হাফসার কাছে গেলাম এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কি দিন থেকে রাত অবধি রাসুলুল্লাহ সা. কে রাগান্বিত রেখেছ?" সে হ্যাঁ বোধক জবাব দিল। আমি বললাম, "তুমি বিধ্বস্ত পরাজিত নারী! তুমি কি আল্লাহর রাসুলকে রাগান্বিত করে আল্লাহর ক্রোধের কারণ হতে ভীত হও নাই? এভাবে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে! আল্লাহর রাসুলকে বেশী কথা বলো না, কোন অবস্থাতেই তাঁর সাথে মুখে মুখে তর্ক করো না এবং তাঁকে অসন্তুষ্ট করো না। তোমার যা খুশী দরকার আমার কাছে চাও এবং কখনোই তোমার প্রতিবেশীকে (আয়েশা রা. কে) নবীজীর প্রতিপক্ষ বানিয়ো না, যদিও সে তোমার চেয়ে অধিক সুন্দরী ও মুহম্মদ সা. এর বেশী প্রিয়"।

 

সে সময় গুজব ছিল যে, ঘাসানরা (শ্যাম দেশের একটি গোত্র) আমাদের আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে ঘোড়া প্রস্তুত করছে। এক রাতে আমার আনসার প্রতিবেশী (তাঁর পালায় রাসুলুল্লাহ সা. এর বাড়ি থেকে ফিরে) খুব স্বন্ত্রস্তভাবে আমার দরজায় কড়া নাড়তে লাগলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কি হয়েছে? ঘাসানেরা কি এসেছে?" তিনি বললেন, "তারচেয়েও খারাপ, আরো অধিক গুরুত্বপূর্ণ! রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন"। আমি বললাম, হাফসা বিধ্বস্ত হয়েছে। আমি এমনটি আগেই ভেবেছিলাম। আমি পোশাক পরিধান করে রাসুলুল্লাহ সা. এর সাথে ফজরের নামাজ আদায় করলাম। এরপরে তিনি উপরের কামরায় চলে গেলেন। আমি হাফসার কাছে গিয়ে তাকে ক্রন্দনরত পেলাম। আমি তাকে বললাম, "কেন কাঁদছ? আমি কি তোমাকে আগেই সাবধান করিনি?" আমি জিজ্ঞেস করলাম, "রাসুলুল্লাহ সা. কি তোমাদের সকলকে তালাক দিয়েছেন?" সে বললো, "আমি জানি না। তিনি সেখানে উপরের ঘরে আছেন"। আমি বের হলাম এবং কিছু মানুষের জটলা দেখতে পেলাম যাদের কেউ কেউ কাঁদছিল। আমি তাদের সাথে কিছুক্ষণ বসলাম, কিন্তু আমি পরিস্থিতি সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই আমি উপরে গেলাম এবং নবীজীর এক কৃষ্ণাজ্ঞ দাসকে বললাম, "তুমি কি ওমরের জন্য রাসুলুল্লাহ সা এর অনুমতি প্রার্থনা করবে?" সে ভেতরে গেল এবং এসে বললো, "আমি আপনার কথা তাঁর কাছে বলেছি কিন্তু তিনি কোন জবাব দেন নি"। আমি জটলার কাছে ফিরে এসে বসলাম, কিন্তু পরিস্থিতি সহ্য করতে না পেরে আবার উপরে দাসের নিকট গিয়ে বললাম, "তুমি কি ওমরের জন্য নবীজীর অনুমতি প্রার্থনা করতে পার?"সে গেল এবং ফিরে এসে একই কথা বললো। যখন আমি ফিরে আসছি, তখন দাস বললো, "রাসুলুল্লাহ সা. আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন"। সুতরাং আমি ভিতরে রাসুলুল্লাহ সা. এর কাছে গেলাম এবং তাকে একটি মাদুরে শয়নরত অবস্থায় পেলাম। আমি বললাম, "আপনি কি আপনার স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন?" তিনি আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন এবং না বোধক উত্তর দিলেন। আমি দাঁড়িয়ে বলতে লাগলাম, "আপনি কি আমার কথা শুনবেন? হে আল্লাহর রাসুল! আমরা কোরায়েশরা নারীদের উপর অধিক কর্তৃত্ব পেতাম, এবং এখানে আমরা যাদের কাছে এসেছি তাদের নারীরা তাদের উপর অধিক কর্তৃত্ব ভোগ করে"।

 

এরপরে আমি পুরো ঘটনা তাঁকে বলি (তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে)। এতে তিনি হাসলেন। আমি তখন বললাম, "আমি হাফসার নিকট গিয়েছিলাম এবং তাকে বলেছি: তোমার প্রতিবেশীকে (আয়েশা রা. কে) নবীজীর প্রতিপক্ষ বানিয়ো না, যদিও সে তোমার চেয়ে অধিক সুন্দরী ও মুহম্মদ সা. এর বেশী প্রিয়"। এতে নবীজী আবার হাসলেন। আমি বসলাম এবং বললাম, "আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করুন যেন আপনার অনুসারীরা অনেক উন্নতি করতে পারে, যেহেতু পারস্যীয়রা ও বাইজেন্টাইনরা আল্লাহকে না মেনেও কতই না উন্নতি করেছে, তাদের কতই না সম্পদ"। রাসুলুল্লাহ সা. উঠে বসলেন এবং বললেন, "ওহ ইবনে আল খাত্তাব! তোমার কি কোন সন্দেহ আছে (যে এস্থান দুনিয়ার মধ্যে সেরা)? মানুষ তার ভালো কাজেরই কেবল প্রতিফল পায়"। আমি তাঁকে আল্লাহর কাছে আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা বললাম।রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর স্ত্রীদের কাছে যাননি কারণ হাফসা গোপন কথা আয়েশার নিকট ফাঁস করে দিয়েছিলেন। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন যে, তিনি একমাস তাঁর স্ত্রীদের কাছে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কেননা তিনি তাদের উপর রাগান্বিত হয়েছেন যখন আল্লাহ তাকে সাবধান করে দেন (মারিয়ার প্রতি আকৃষ্ট না হওয়ার শপথ করার জন্য)। যখন ২৯ দিন অতিবাহিত হলো, তখন তিনি সর্বপ্রথম আয়েশার নিকট গিয়েছিলেন। আয়েশা বললেন, "আপনি শপথ করেছিলেন যে, একমাস আমাদের কাছে আসবেন না, আজ কেবল মাত্র ২৯ দিন অতিবাহিত হয়েছে। আমি এক এক করে দিন গুনে রেখেছি"। মুহম্মদ সা. জবাবে বললেন, "২৯ দিনেও মাস হয়"। সে মাস ২৯ দিনে ছিল। রাসুলুল্লাহ সা. আয়েশা রা. কে বললেন, "আমি তোমাকে কিছু বলতে যাচ্ছি, কিন্তু জবাব দেয়ার জন্য তোমার পিতামাতার সাথে পরামর্শ করার আগ পর্যন্ত তাড়ার কিছু নেই। আয়েশা রা. জানতেন যে, তাঁর পিতামাতা নবীজীর থেকে পৃথক হওয়ার অনুমতি দিবেন না। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন যে, আল্লাহ বলেছেনঃহে নবী! তোমার স্ত্রীগণকে বলো,- "তোমরা যদি দুনিয়ার জীবনটা ও তার শোভা-সৌন্দর্য কামনা করো, তবে এসো আমি তোমাদের ভোগ্যবস্তুর ব্যবস্থা করে দিব এবং তোমাদের বিদায় করে দিব সৌজন্যময় বিদায়দানে"। (সুরা আহযাব, আয়াত ২৮) আয়েশা বললেন, "আমি কি আমার পিতামাতার সাথে পরামর্শ করতে পারি?" পরে আয়েশা নবীজীকে বললেন, "আমি অবশ্যই আল্লাহকে, তাঁর রাসুলকে এবং এই স্থানকে অধিকতর পছন্দ করি"।
এরপরে রাসুলুল্লাহ সা. একে একে অন্য স্ত্রীদের কাছে গিয়েও এই আহবান জানালে তাঁরাও আয়েশার অনুরূপ জবাব দেন।

একই ধরণের হাদীস পাওয়া যায় মুসলিম শরীফের ৯/৩৫১১ এ এবং বোখারী শরীফের ৭/৬২/১১৯ এ।
 
8. ইসলামী ফতোয়া সাইট (আরবী সাইট http://www.islamweb.net/ver2/Fatwa/ShowFatwa.php?lang=A&Option=FatwaId&Id=20780) থেকে দেখিঃ
(অনুবাদ করেছেন মুফতি আল ফাদী)
Fatwa # 20780
Fatwa Title: His wives "Alayhi wa-Salat wa-Salam" who were slaves
Fatwa Date: 04 Jumady al-Thania 1423
Question
There are two slave women that the messenger (SAW) married, who are they?
Fatwa
Thanks be to Allah and prayer and peace be upon the messenger of Allah and on his family and companions. As to this:If the questioner meant that Allah’s messenger (SAW) married two slave women while they were still slaves? This cannot be of the messenger of Allah (SAW), and this is not permitted in Islam except to those who cannot marry a free woman and fears immorality.And if he meant that he [Muhammad] married those women after they were freed from slavery? Hence Juwayrah bint al-Harith al-Mustaliqia was from those who were enslaved (captured) from Bani al-Mustaliq (the tribe of Mustaliq), and she was the daughter of their leader, the prophet (SAW) freed her and married her. Same with Safiyah bint Huyay bin Akhtab who was one of the slaves of Khaybar, and the prophet (SAW) freed her and married her.But if he meant the slaves that the messenger used to enjoy (ya ta sarra behina), meaning sleeping with them by virtue of their being his right hand possession? It was said four: Mariyah al -Qibtiyah, and Rayhanah from Bani Quraytha (the tribe of Quraytha), and a third slave woman whom he slept with during her slavery, and a fourth one who was given to him by Zaynab bint Jahsh.

9. টীকা 7 দ্রষ্টব্য।
 
10. সুরা আত তাহরীম (নিষিদ্ধকরণ)-
 
আয়াত ১: হে নবী, কেন তুমি নিষিদ্ধ করেছ, যা আল্লাহ তোমার জন্য বৈধ করেছেন? তুমি চাইছ তোমার স্ত্রীদের খুশী করতে? আর আল্লাহ পরিত্রাণকারী ও অফুরন্ত ফলদাতা।
 
আয়াত ২: আল্লাহ তোমাদের জন্য বিধান দিয়ে রেখেছেন তোমাদের শপথগুলো থেকে মুক্তির উপায়; আর আল্লাহ তোমাদের রক্ষাকারী বন্ধু, আর তিনিই সর্বজ্ঞাতা, পরমজ্ঞানী।
 
আয়াত ৩: আর স্মরণ করো! নবী তাঁর স্ত্রীদের কোন একজনের কাছে গোপনে একটি সংবাদ দিয়েছিলেন, - কিন্তু তিনি যখন তা বলে দিলেন, এবং আল্লাহ তার কাছে এটি জানিয়ে দিয়েছিলেন; তখন তিনি তাকে কতকটা জানিয়েছিলেন এবং চেপে গিয়েছিলেন অন্য কতকটা। তিনি যখন তাকে তা জানিয়েছিলেন তখন তিনি বললনে, - "কে আপনাকে এ কথা বললেন?" তিনি বলেছিলেন, "আমাকে সংবাদ দিয়েছেন সেই সর্বজ্ঞাতা ও চির- ওয়াকিফহাল"।
 
আয়াত ৪: যদি তোমরা উভয়ে আল্লাহর দিকে ফেরো, কেননা তোমাদের হৃদয় ইতোপূর্বেই ঝোঁকে গিয়েছে। কিন্তু যদি তোমরা উভয়ে তার বিরুদ্ধে পৃষ্ঠপোষকতা করো, তাহলে আল্লাহ,- তিনিই তাঁর রক্ষাকারী বন্ধু, আর জিব্রীল ও পুণ্যবান মুমিনগণ উপরন্তু ফেরেস্তারাও তাঁর পৃষ্ঠপোষক।
 
আয়াত ৫: হতে পারে তাঁর প্রভু, যদি তিনি তোমাদের তালাক দিয়ে দেন, তবে তিনি তাঁকে বদলে দিবেন তোমাদের চাইতেও উৎকৃষ্ট স্ত্রীদের- আত্মসমর্পিতা, বিশ্বাসিনী, বিনয়াবনতা, অনুতাপকারিনী, উপাসনাকারিনী, রোযাপালনকারিনী, স্বামিঘরকারিনী ও কুমারী।(অনুবাদঃ ড. জহুরুল হক)
 
11. ইবনে কাথিরের তাফসির দ্রষ্টব্য ( http://www.tafsir.com/default.asp?sid=4&tid=12406)
.....Abu Dawud At-Tayalisi recorded that Ibn `Abbas said,
"Sawdah feared that the Messenger of Allah might divorce her and she said, `O Messenger of Allah! Do not divorce me; give my day to `A'ishah.' And he did, and later on Allah sent down,

[وَإِنِ امْرَأَةٌ خَـفَتْ مِن بَعْلِهَا نُشُوزاً أَوْ إِعْرَاضاً فَلاَ جُنَاْحَ عَلَيْهِمَآ]
(And if a woman fears cruelty or desertion on her husband's part, there is no sin on them both) Ibn `Abbas said, "Whatever (legal agreement) the spouses mutually agree to is allowed.''. At-Tirmidhi recorded it and said, "Hasan Gharib''. In the Two Sahihs, it is recorded that `A'ishah said that when Sawdah bint Zam`ah became old, she forfeited her day to `A'ishah, and the Prophet used to spend Sawdah's night with `A'ishah. There is a similar narration also collected by Al-Bukhari. Al-Bukhari also recorded that `A'ishah commented;

[وَإِنِ امْرَأَةٌ خَـفَتْ مِن بَعْلِهَا نُشُوزاً أَوْ إِعْرَاضاً]
(And if a woman fears cruelty or desertion on her husband's part), that it refers to, "A man who is married to an old woman, and he does not desire her and wants to divorce her. So she says, `I forfeit my right on you.' So this Ayah was revealed.''Allah said,

[وَالصُّلْحُ خَيْرٌ]
(And making peace is better). `Ali bin Abi Talhah related that Ibn `Abbas said that
the Ayah refers to, "When the husband gives his wife the choice between staying with him or leaving him, as this is better than the husband preferring other wives to her.'' However, the apparent wording of the Ayah refers to the settlement where the wife forfeits some of the rights she has over her husband, with the husband agreeing to this concession, and that this settlement is better than divorce. For instance,
the Prophet kept Sawdah bint Zam`ah as his wife after she offered to forfeit her day for `A'ishah. By keeping her among his wives, his Ummah may follow this kind of settlement. Since settlement and peace are better with Allah than parting, .......

ডিম্বের সন্ধান এবং রাশাদ খলীফা ও তার ম্যাথমিটিকল মিরাকল অব কোরআন তত্ত্ব

একঃ ডিম্বের সন্ধানে
 
আমার আগের প্রবন্ধ "ধর্মে বিজ্ঞানঃ নিম গাছে আমের সন্ধান" এর একখানে উল্লেখ করিয়াছিলাম, "আফসোস তৈরী হয়, নিজ হাতে লেখার পরেও কেন আল্লাহ গোটা কোরআনে একবারো সরাসরি উল্লেখ করতে পারলেন না যে পৃথিবী গোলাকার"।
 
হঠাৎই সেইদিন একবিজ্ঞজনের আলোচনায় দেখিলাম তিনি সদর্পে ঘোষণা করিয়াছেন যে, "মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামিন কোরআন মাজীদে পৃথিবীর ‘গোলাকার’ আকৃতি এরশাদ করিয়াছেন”। আমার তো ভীমিড়ি খাইবার দশা, হায়! হায়! ইহা তিনি কি বলিতেছেন। চক্ষু রগড়াইয়া দেখিলাম আল্লাহ পাকের সেই বানীঃ 
"And we have made the earth egg shaped".[Al-Qur’an 79:30]
 
যাহার মানে দাঁড়াইতেছে পৃথবীকে আল্লাহ পাক ডিম্বাকৃতির করিয়া বানাইয়াছেন!
 
এ যাবৎ আমার দেখা সকল ডিম্বই দুইদিকে সুচালাকৃতির হইলেও, ভাবিলাম 'ডিম্বাকৃতির পৃথিবী' 'সমতল পৃথিবী'র তুলনায় অধিক গোলাকৃতির হইবার সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং, কাল বিলম্ব না করিয়া আমার সেই প্রবন্ধখানির জন্য নাকে খত দিবার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা আরম্ভ করি। যদিও আমি কোরআন মাজীদের কয়েকখানি অনুবাদ আদ্যপান্ত পাঠ করিয়াই উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত জানাইয়াছিলাম, তথাপি বিশালাকায় কোরআন পাক পাঠকালে উক্ত আয়াত হয়তোবা কোন কুক্ষণে আমার দৃষ্টির আড়ালে চলিয়া গিয়াছিল ইহা ভাবিয়া মনে বড়ই ক্লেশ অনুভব করিতেছিলাম।
 
তো, আমার সেই প্রবন্ধখানিতে আমার এই বক্তব্য তুলিয়া নিবার ও করজোরে ক্ষমা প্রার্থণার উদ্দেশ্যে যাইতেছিলাম। ইত্যবসরে কি মনে করিয়া জহুরুল হক সাহেবের অনুবাদখানি খুলিয়া দেখিলাম। ৭৯ নম্বর সুরা। সুরা আন নাযিয়াত। ৩০ নম্বর আয়াত। এইবার আবারো ভীমড়ি খাইবার দশা। অনুবাদে ডিম্ব খুঁজিয়া পাইলাম না। অনুবাদে যাহা পাইলাম তাহা এইরূপঃ "আর পৃথিবী- এর পরে তাকে প্রসারিত করেছেন"। ভাবিবালাম, কেবলমাত্র জহুরুল সাহেবের অনুবাদের উপর নির্ভর করা ঠিক হইবে না। অন্য অনুবাদের খবর লইতে হইবে। ঢুকিলাম ইসলামী সাইট কোরআনা শরীফ ডট অর্গে (1)। সেইখানেও দেখি অনুবাদ করা হইয়াছে এইরূপে:
"পৃথিবীকে এরপরে তিনি বিস্তৃত করেছেন"
"And after that He spread the earth "
 
তথাপি মন ভরিলো না। ভাবিলাম, বিজ্ঞজন যেহেতু বলিয়াছেন সেহেতু নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও ডিম্ব পাওয়া যাইবেই যাইবে। তাই খুঁজিতে থাকিলাম। এবার আরেকটি সাইটে (2) খোঁজ লাগাইলাম। সেইখানেও দেখি :
YUSUFALI: "And the earth, moreover, hath He extended (to a wide expanse)"
PICKTHAL: "And after that He spread the earth"
SHAKIR: "And the earth, He expanded it after that"
 
কিছুখানি দমিয়া যাইলেও হতাশ হইলাম না, কেননা ইহার মধ্যেই ডিম্ব খুঁজিয়া পাইবার দুর্বার আকাঙ্খা আমার মধ্যে বাসা বাঁধিয়াছে। প্রথমে ভাবিলাম, সেই বিজ্ঞজনের শরনাপন্ন হওয়াই বুদ্ধিমানের কর্ম হইবে। ওনাকে বিস্তারিত জানাইলে তিনি সদয় হইয়া আমাকে একখানি সাইটের লিংক (http://www.irf.net/irf/dtp/dawah_tech/t15/t15b/pg1.htm) দিলেন। খুশীমনে সেইখানে ঢুকিয়া দেখিলাম তাহা কোরআন শরীফের অনুবাদমূলক সাইট নহে, বরং কোরআনকে নিয়া বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবমূলক সাইট। সেইখানে অবশ্য ডিম্ব সংক্রান্ত একখানা আলোচনা পাইলাম। একই ধরণের আলোচনা পরবর্তীতে আরেক বিজ্ঞজনের একখানি আলোচনাতেও দেখিলাম যাহা মহাগুরু জাকির নায়েক সাহেবের আলোচনা হইতে অনুবাদকৃত। তাহাই এইখানে তুলিয়া দেওয়া সকলের জন্য সুবিধাজনক হইতে পারে:
ذَلِكَ دَحَاهَاوَالْأَرْضَ بَعْدَ
"And we have made the earth egg shaped" [Al-Qur'an 79:30]
"এবং আমি পৃথিবীকে তৈরী করেছি ডিম্বাকৃতিতে।" (আল কুরআন - ৭৯ : ৩০)
 
এখানে লক্ষ্য করার মতো বিষয় : প্রদত্ত আয়াতে আরবী শব্দ دَحَاهَا ( দাহাহা) মানে ডিম্বাকৃতি। ইহা বর্ধিত হওয়াকেও বুঝায়। دَحَاهَا ( দাহাহা) শব্দটা এসেছে "দুহিয়া" থেকে যার অর্থ বিশেষভাবে অস্ট্রিচ পাখির ডিম যেটা geospherical সাইজের, ঠিক পৃথিবীর আকৃতির মতো"।
 
অবশেষে ডিম্বের সন্ধান পাইয়া কিছুখানি আস্বস্ত হইলেও একেবারে নির্ভার হইতে পারিলাম না। মাথায় প্রশ্ন আসিয়া বড়ই ক্লেশ তৈরী করিতে লাগিলো: دَحَاهَا অর্থ যদি ডিম্বাকৃতিই হইবে তবে কেনবা সকল অনুবাদে (এই পর্যন্ত ১১ জন কৃত অনুবাদ দেখিয়াছি, আরো দেখিতেছি..) বিস্তৃত, spread, extended, wide expanse প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হইলো?তাই ভাবিলাম এইবারে دَحَاهَا শব্দ খানি দেখা যাউক। যেইভাবা সেই কাজ। ড. ফজলুর রহমান সাহেবের বাংলা-আরবী অভিধানে দেখিলাম, বাংলা একাডেমির অভিধানেও দেখিলাম এবং সর্বশেষে নেটেও কয়েকখানা অনলাইন ডিকশনারি সাইটে দেখিলাম। সর্বত্রই পাইলাম এইরূপ অর্থ:
دَحَا অর্থ বিস্তৃত, spread, extended প্রভৃতি অর্থসমূহ। আর هَا অর্থ এই, এটি বা This। দুঃখের সহিত লক্ষ করিলাম যে, কোথাও কোন রূপ ডিম্ব পাওয়া যাইতেছে না। দুহিয়া শব্দটিও খোঁজার চেষ্টা করিলাম, উল্টোদিকে উটপাখির ডিম্ব, ডিম্ব, ডিম্বাকৃতি, উটপাখি প্রভৃ্তি শব্দসমূহের আরবী প্রতিশব্দও খুঁজিয়াও কোথাও دَحَاهَا বা "দুহিয়া" পাইলাম না। মন ভাঙিয়া যাইবার দশা যখন দেখিলাম (3) ডিম্বের আরবী بيضة, بييصة, شخص متساهل এইসকল শব্দ। দেখিলাম ডিম্বাকৃতির আরবী بيضاوي । দেখিলাম উটপাখির আরবী نعامة, النعامة من يحاول إجتناب الخطر برفض مواجهته ।
 
ব্যর্থ মনোরথে হাল ছাড়িয়া দেওয়ার আগে শেষ চেষ্টা চালাইলাম। তাফসীর দেখিলাম। সমস্ত মুসলিম বিশ্বে শ্রদ্ধার পাত্র Ibn Kathir এর কোরআন তাফসীর (4) দেখিতে লাগিলাম। যাহা পাইলাম তাহা এইরূপ:
"Then Allah says,
[وَالاٌّرْضَ بَعْدَ ذَلِكَ دَحَـهَا ]
(And after that He spread the earth,) He explains this statement by the statement that follows it,
[أَخْرَجَ مِنْهَا مَآءَهَا وَمَرْعَـهَا ]
(And brought forth therefrom its water and its pasture.) It already has been mentioned previously in Surat Ha Mim As-Sajdah that the earth was created before the heaven was created, but it was only spread out after the creation of the heaven. This means that He brought out what was in it with a forceful action. This is the meaning of what was said by Ibn `Abbas and others, and it was the explanation preferred by Ibn Jarir. In reference to the statement of Allah,
[وَالْجِبَالَ أَرْسَـهَا ]
(And the mountains He has fixed firmly,) meaning, He settled them, made them firm, and established them in their places. And He is the Most Wise, the All-Knowing. He is Most Kind to His creation, Most Merciful. Allah then says,
[مَتَـعاً لَّكُمْ وَلاًّنْعَـمِكُمْ ]
(As provision and benefit for you and your cattle.) meaning, He spread out the earth, caused its springs to gush forth, brought forth its hidden benefits, caused its rivers to flow, and caused its vegetation, trees, and fruits to grow. He also made its mountains firm so that it (the earth) would be calmly settled with its dwellers, and He stabilized its dwelling places. All of this is a means of beneficial enjoyment for His creatures (mankind) providing them of what cattle they need, which they eat and ride upon. He has granted them these beneficial things for the period that they need them, in this worldly abode, until the end of time and the expiration of this life."
 
এইবারে ভাবিলাম, থাক আর কাজ নেই। এত খুঁজিয়াও যেহেতু ডিম্বের খোঁজ মিলিতেছে না, তবে আমার বরাতে সম্ভবত ডিম্ব নাই। কিন্তু দুই দুই জন বিজ্ঞ মহাশয় এবং মহাগুরু জাকির নায়েকের কথাও বা অবিশ্বাস করি কেমনে? শেষে তাই ভাবিলাম, ওনারাও সম্ভবত বেঠিক কিছু বলেন নাই। আসলেই কোরআনে উক্ত আয়াতে ডিম্বের কথা বলা হইয়াছে। তবে তাহা হয়তোবা উটপাখির নহে, অশ্বের হইবার সম্ভাবনাই অত্যাধিক।
 
 
দুইঃ রাশাদ খলীফা, ম্যাথমেটিকল মিরাকল অব কোরআন এবং কোরআন টেম্পারিং
গত কয়েকদিন ডিম্ব খুঁজতে খুঁজতে অবস্থা একেবারে কেরোসিন। শেষে তো হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।
কিন্তু পুরো ছাড়িনি।তার ফলও পেলাম হাতেনাতে।
 
অবশেষে ডিম্ব পেলাম। অশ্ব ডিম্ব নয়, একেবারে উটের ডিম্ব। এখান থেকেই دَحَاهَا অর্থ যে ডিম্বাকৃতির তা সকলে প্রথম জানতে পারে।লিংকটি হচ্ছে সাবমিশন ডট অর্গের (5), আরবী থেকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেছেন রাশাদ খলীফা। অনুবাদটি আগে দেখে নিই:
[79:30] He made the earth egg-shaped.
এবং শেষে স্পেশাল নোটও আছেঃ
79:30 The Arabic word “dahhaahaa” is derived from “Dahhyah” which means “egg”.
 
অবশেষে ডিম্বের সন্ধান পেয়ে আমি তো যারপরনাই খুশী। এবং এই রাশাদ খলীফার প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞবোধ করতে থাকি। সেই কৃতজ্ঞতাবোধের জায়গা থেকেই তাঁর প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠি এবং ওনার সম্পর্কে খোঁজ শুরু করে দেই।
 
রাশাদ খালীফাঃ
তিনি মূলত একজন বায়োকেমিস্ট ছিলেন। মিশরে জন্ম হলেও ১৯৫৯ সালে আমেরিকায় বায়োকেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করতে যান এবং সেখানেই থেকে যান। তিনি ইউনাইটেড সাবমিটার ইন্টারন্যাশনাল (USI) নামে গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন, যারা নিজেদেরকে প্রকৃত ইসলামের অনুসারী বলে দাবী করতো। এই গ্রুপ কখনো ইসলাম শব্দ ব্যবহার করেনি, বদলে ব্যবহার করে সাবমিশন এবং মুসলিমের বদলে ব্যবহার করে সাবমিটার। (6)
 
ম্যাথমেটিকল মিরাকল অব কোরআন এর জনকঃ
রাশাদ খলীফা ১৯৭৪ সালে তার বিখ্যাত ম্যাথমেটিকল মিরাকল অব কোরআন প্রকাশ করেন। এই তত্ত্বের মূলে আছে একটি সংখ্যা ১৯। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এ আছে ১৯ টি অক্ষর, মোট সুরার সংখ্যা ১১৪ যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য, আয়াতের সংখ্যা ৬৩৪৬ যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য, মোট অক্ষর ১৬২১৪৬ যাও ১৯ দ্বারা বিভাজ্য। এমন আরো বিশাল একটি তালিকা তিনি বের করেন, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য বা কোন না কোন ভাবে ১৯ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। (7)
 
কোরআনের বাইরেও প্রাকৃতিক বিভিন্ন ঘটনার মধ্যেও তিনি ১৯ কে নিয়ে আসেন (যেমন হ্যালির ধুমকেতু ৭৬ বছর (১৯*৪) পর পর আবির্ভুত হয়)।
 
রাশাদ খলীফার মতে এই ১৯ এর ব্যাপারটি কোরআনের ৭৪ নম্বর সুরাতেই বিদ্যমান। কোরআন ৭৪:৩০: তার উপরে রয়েছে "ঊনিশ"।
 
আল্লাহর ম্যাসেঞ্জারঃ
এরপরে তিনি নিজেকে আল্লাহর ম্যাসেঞ্জার হিসাবে দাবি করেন। (8)। তিনি কোরআনের ৩:৮১ কে নিজের মত করে অনুবাদ ও তাফসীর করে জানান যে, প্রোফেট বা রাসুল হলেন তারা যারা আল্লাহর ওহী প্রাপ্ত হন, এবং ম্যাসেঞ্জার হলো তিনি যিনি রাসুলের প্রতি নাযিলকৃত ওহীকে যথার্থতা প্রদান করবেন। তিনিই কোরআনকে তার প্রকৃত রূপে সকলের সামনে তুলে ধরেছেন বিধায় তিনি সেই ম্যাসেঞ্জার। একইভাবে সুরা আত তাকবীরে (৮১:১৯-২৪) তিনি তাঁর বিখ্যাত ১৯ তত্ত্ব দিয়ে দেখিয়েছেন যে সেখানে যে ম্যাসেঞ্জারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি আর কেউ নন, রাশাদ খলীফা নিজেই। (সুরা আত-তাকবীরের সুরা নাম্বার, আয়াত সংখ্যা, 'রাশাদ' ও 'খলীফা' শব্দদুটির gematrical value যোগ করলে হয় ১৩৩০, যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য। সুতরাং এই সুরায় উল্লেখিত ম্যাসেঞ্জার আর কেউ নন, রাশাদ খলীফা!!)। এবং তার অনুবাদে তিনি ২২ নং আয়াতে "সে" এর পাশে ব্রাকেটে "রাশাদ" যুক্ত করেও দিয়েছেন! 81:22: Your friend (Rashad) is not crazy. (9)
 
এবারে আবার ম্যাথমেটিকল মিরাকল দিয়ে প্রমাণ করে দেন যে তিনিই সেই ম্যাসেঞ্জার। তিনি এই আবিষ্কার জানান ১৯৭৪ সালে। এই ১৯ এর অলৌকিকত্ব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে ৭৪ নম্বর সুরায়, তিনি এই আবিষ্কার করেন ১৯৭৪ সালে। এই বছরটি হলো হিজরী ১৪০৬। ১৪০৬ = ১৯*৭৪। অতএব, তিনিই আল্লাহর ম্যাসেঞ্জার। (10)
 
কোরআনকে যথার্থতা প্রদানঃ
আজকের মোটামুটি যে গোটা দুনিয়ায় মোটামুটি একই ধরণের আদর্শ কোরআন পাওয়া যায় তা ১৯২৪ সালে মিশরের কায়রোতে ছাপানো এবং পরবর্তীতে সৌদি বাদশা ফাহাদের ছাপানো। কিন্তু বর্তমান প্রচলিত কোরআন এবং প্রাপ্ত প্রাচীণতম Tashkent কোরআনের মধ্যে বিভিন্ন জায়গার অমিলগুলো ধরে ধরে তিনি দেখিয়ে দেন (11), একই ভাবে দেখান Hafs এর কোরআন এবং Warsh এর কোরআনের মধ্যকার অমিল (12); সেখান থেকেই তিনি তার সিদ্ধান্ত জানান যে, দুনিয়াজুড়ে সমস্ত কোরআন-ই একই বলে যে দাবী করা হয় তা সত্য নয় এবং আমরা বর্তমানে যে কোরআন পাই তা আল্লাহ প্রদত্ত মূল কোরআন নয়, বরং তা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হওয়া কোরআন। সুতরাং প্রকৃত কোরআন পাওয়া সম্ভব একমাত্র ১৯ থিউরি দিয়েই, যেটি আল্লাহ ৭৪:৩০ এ এরশাদ করেছেন।
 
আর যেহেতু এসব কোরআনের বিভিন্ন কপিতে মনুষ্যকৃত ভুল থেকে গিয়েছে এবং প্রকৃত কোরআন পাওয়া সম্ভব সেই ১৯ দিয়েই, সুতরাং তিনি আসল কোরআনের সন্ধানে নেমে পড়েন।
সেখানে ধরে ধরে বিভিন্ন শব্দের শেষে, মাঝে শুরুতে অক্ষর দেয়া, আয়াত বাড়ানো-কমানো প্রভৃতি কাজ সমূহ করেন- যার ভিত্তি ছিল ১৯ থিউরি। একটি উদাহরণ দেই। প্রচলিত সমস্ত কোরআনেই আমরা জানি সর্বমোট আয়াত সংখ্যা ৬২৩৬ টি, যাকে ১৯ দ্বারা ভাগ করলে পাওয়া যায় ৩২৮.২১০৫২৬৩১....। কিন্তু রাশাদ খলীফার হিসাবে আমরা অন্য একটি সংখ্যা পাই, সেটি হলো ৬৩৪৬ যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য। তার হিসাবে দুধরণের আয়াতকে নিয়েছেন, নাম্বারড আয়াত ও আননাম্বারড আয়াত (সুরার শুরুর বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম)। এই আননাম্বারড আয়াতের সংখ্যা ১১২ টি এবং নাম্বারড আয়াত ৬২৩৪ টি। এভাবে ১৯ থিউরি অনুযায়ী কোরআনের প্রকৃত উদ্ধার করেছেন, এবং সেটা করতে গিয়ে প্রচলিত কোরআনের তুলনায় নাম্বারড আয়াতের সংখ্যা ২টি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই দুটি আয়াত কমানো হয়েছে সুরা আত-তাওবাহ থেকে (১২৮ ও ১২৯ নং আয়াত দুটি বাদ দেয়া হয়েছে)। এ দুটি আয়াত দেয়ার ক্ষেত্রেও মূল যুক্তি সেই ১৯ থিউরি এবং একটি বুখারী হাদীসের সমর্থন যেখানে বলা হয়েছে, 
Narrated Zaid bin Thabit: Abu Bakr sent for me and said, "You used to write the Divine Revelations for Allah's Apostle : So you should search for (the Qur'an and collect) it." I started searching for the Qur'an till I found the last two Verses of Surat At-Tauba with Abi Khuzaima Al-Ansari and I could not find these Verses with anybody other than him. (Volume 6, Book 61, Number 511). (13) 
 
পুরা কোরআনের মোট আয়াত সংখ্যার বিষয়টি তো আছেই, সেই সাথে তিনি দেখিয়ে দেন যে, সুরা তাওবার ১ম ১২৭ টি আয়াতে আল্লাহ শব্দটি এসেছে মোট ১২৭৩ বার যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য, কিন্তু ১২৮ ও ১২৯ নং আয়াত যুক্ত করলে- আল্লাহ শব্দটি যতবার এসেছে সেই সংখ্যাটি ১৯ দ্বারা বিভাজ্য হয় না। অতএব প্রমাণ হলো যে, ১২৮ ও ১২৯ নং আয়াত দুটি ভুল আয়াত! (14) মুসলিম ওলামায়ে বিশ্ব যখন খলীফার এই তত্ত্বকে এবং দাবীকে অস্বীকার করতে চাইলেন, তখনো তিনি কোরআনের সুরা আশ-শুরা এর ২৪ নং আয়াতের মাধ্যমে দেখিয়ে দিলেন যে, তাঁর এই উদ্ভাবনকে অনেকে মিথ্যা বলতে পারে সেটা অনেক আগেই কোরআনে জানান দেয়া হয়েছে এবং তিনি আসলে মিথ্যা নন।
৪২:২৪: অথবা তারা কি বলে,- "সে আল্লাহ সম্পর্কে এক মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে?" কিন্তু আল্লাহ যদি চাইতেন তবে তোমার হৃদয়ে তিনি মোহর মেরে দিতেন। বস্তুত আল্লাহ মিথ্যাকে মুছে ফেলেন এবং সত্যকে সত্য প্রতিপন্ন করবেন তার বাণী দ্বারা। নিসন্দেহে তাদের অন্তরে যা রয়েছে তা সম্পর্কে তিনি সম্যক জ্ঞাতা”। 
 
এই আয়াতটিতে যে সে মানে রাশাদ খলীফা সেটির ব্যাখ্যাও কিন্তু ১৯ তত্ত্ব থেকেই পাওয়া যায় (রাশাদ খলীফার gematrical value (১২৩০) এর সাথে এই আয়াত নাম্বার (২৪) যোগ করলে পাওয়া যায় ১২৫৪ যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য, সুতরাং প্রমানিত হলো যে এখানে "সে" মানে "রাশাদ খলীফা")- এবং রাশাদ খলীফা কর্তৃক অনুবাদে "সে" এর পাশে ব্রাকেটে রাশাদ খলীফার নাম আমরা পাই।
[42:24] Are they saying, "He (Rashad) has fabricated lies about GOD!"? If GOD willed, He could have sealed your mind, but GOD erases the falsehood and affirms the truth with His words. He is fully aware of the innermost thoughts. (15)
 
প্রশ্নঃ
১। কোনটি ঠিক?
২। রাশাদ খলীফা যদি বেঠিক হন, তবে তার প্রচারিত থিউরি দিয়ে দুর্বল মুসলমানদের ইমান শক্ত-পোক্ত করার চেষ্টা কেমন? 
 
তথ্যসূত্রঃ 

সোমবার, ২৩ জুন, ২০০৮

ধর্মে বিজ্ঞানঃ নিম গাছে আমের সন্ধান

শুরু করছি একটি পৌরানিক কাহিনী দিয়ে, মহাভারতে এটি পাওয়া যাবে, ভাগবতেও এ কাহিনী আছে। দেবতাকূল সমুদ্র মন্থনের মাধ্যমে অমৃত আহরণ করে যখন তা পান করতে যাবে, সে সময় দানবদের মধ্য থেকে একজন, নাম রাহু, দেবতা সাজে সেখানে উপস্থিত হয়ে দেবতাদের সাথে অমৃত পান আরম্ভ করে। কিন্তু দেবতাদের মধ্যে সূর্য এবং চন্দ্র হঠাৎই রাহুকে চিনতে পারায় তারা দেবতাদের জানিয়ে দেয় এবং দেবরাজ ইন্দ্র এককোপে রাহুর মস্তক ছিন্ন করে ফেলে। ঠিক সেই মুহুর্তে রাহু কর্তৃক পানকৃত অমৃত কেবল মস্তক হতে গলা পর্যন্ত এসেছিল বিধায় মস্তক পর্যন্ত অংশটুকু অমর হয়ে যায় এবং আকাশের একস্থানে অবস্থান করতে থাকে। সূর্য এবং চন্দ্রের কারণে ধরা পড়ে যাওয়ার কারণে তাদের প্রতি শুরু হয় ভীষণ শত্রুতা এবং যখনই তাদের সঞ্চারপথে রাহুর নাগালের মধ্যে আসে, তখনই রাহু সূর্য ও চন্দ্রকে গিলে খায়। যেহেতু রাহুর শুধু মস্তকই আছে, ফলে সে সূর্য-চন্দ্রকে হজম করতে পারে না বরং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কাটা গলা দিয়ে বের হয়ে পড়ে। যেসময়টুকু তার মুখের মধ্যে থাকে সে সময়েই হয় সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ।
বিভিন্ন জায়গার উপকথা, পুরাণ, প্রাচীণ গাঁথায় এরকম অসংখ্য কাহিনী আমরা পাই, যেখানে আমাদের চারপাশের প্রকৃতির বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এগুলো পড়লে আমরা বুঝতে পারি- এককালে মানুষ কি'করে বিভিন্ন ঘটনার উত্তর কল্পনা করেছে। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই যখন মানুষ এসব নানা কাহিনীকে স্ব স্ব ধর্মের মোড়কে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা আরম্ভ করে এবং তার একটা সার্বজনীন রূপ দেয়ার চেষ্টা করে। আর এই সার্বজনীন রূপ দিতে গিয়ে আজকের বিজ্ঞানের যুগে এসে, বিজ্ঞানের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যার সাথে সেইসব পৌরানিক কাহিনীর একটা যোগসূত্র বের করে ফেলে অনেকেই। উপরের ঘটনাটির একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেখেছিলাম তেমনি একটি আলোচনায়। সেটি এবার শুনা যাকঃ ভাগবতে আছে,
"রাহুর মস্তক অমৃতের স্পর্শ লাভ করিবার ফলে অমর হইয়াছিল। তাই ব্রহ্মা রাহুর মস্তককে একটি ছায়া গ্রহরূপে স্বীকৃতি দিয়াছিলেন। রাহু যেহেতু চন্দ্র এবং সূর্যের চিরশত্রু, তাই অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে চন্দ্র ও সূর্যের প্রতি ধাবিত হয়"। (ভাঃ ৮/৯/২৬)
কিংবা
"রাহু সূর্য এবং চন্দ্র উভয়ের প্রতিই বৈরীভাবাপন্ন এবং তাই সে প্রত্যেক অমাবস্যা ও পূর্ণিমাতে তাহাদের আচ্ছাদিত করতে চেষ্টা করে"। (ভাঃ ৫/২৪/২)
এই আলোচনার পরেই সেখানে আনা হলো চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ সম্পর্কিত বিজ্ঞানের আলোচনা এবং দুটিতে অদ্ভুতভাবে মিল দেখিয়ে দাবী করা হলো, রাহু হলো ছায়া যা চন্দ্রের উপরে পড়ে, সব পূর্ণিমা তিথিতে চন্দ্রগ্রহণ হয় না- সব অমাবস্যায় সূর্যগ্রহণ হয় না, কেবল যখন রাহু বা ছায়া পড়ে তখনই এই গ্রহণ হয়। অতএব, বিজ্ঞানের সমস্ত ব্যাখ্যা ভাগবতেই বিদ্যমান!!
ধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাঃ
এই যে, ধর্মের মধ্যে বিজ্ঞানকে খুঁজে বের করা- ধর্মের বিভিন্ন ঘটনা-ব্যাখ্যা-আলোচনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো, বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারকে ধর্মের প্রাচীণ গ্রন্থের মাঝে খুঁজে পাওয়া এসবের উদ্দেশ্য জানতে বেশী চিন্তা করতে হয় না। যে সময়ে ধর্মসমূহের উদ্ভব, সে সময়টি বা যুগটি মানুষ পার হয়ে এসেছে অনেক আগেই। একসময় কোপার্নিকাস-ব্রুনো-গ্যালিলিও-হাইপেশিয়াদের মেরে, লাইব্রেরী পুড়িয়ে, পেশী শক্তি দিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা সাময়িক স্তব্ধ করা গেলেও, মানুষকে পুরোপুরি আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। এখন এই যুগে মানুষের জ্ঞানজগতে বিচরণ হাজার বছর আগের কুসংষ্কারকে অগ্রাহ্য করতে চায় বারেবারে। আর উল্টোদিকে প্রতিটি ধর্মই যে শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিয়ে এসেছিল, তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। একে টিকিয়ে রাখতে তাই আজকের বিজ্ঞানের সাথে একটা ব্লেণ্ডিং যাকে বলে মিলে-মিশে জগা-খিচুরী বানানোটা হয়ে ওঠে অপরিহার্য। এভাবে ধর্মসমূহ হয়ে ওঠে বিজ্ঞানময়, ধর্মগ্রন্থ হয়ে ওঠে সায়েন্স এনসাইক্লোপিডিয়া!!কিছু নমুনা দেখিঃ
কোরানঃ "অতঃপর আমি নিদর্শন দিতেছি। ওই সকল তারকার যাহারা পিছনে হটিয়া যায়।" - ৮১:১৫
বিজ্ঞানঃ অন্যান্য সকল দরবর্তী গ্যালাক্সী আমাদের এই মিলকীওয়ে গ্যালাক্সি থেকে সর্বদা দুরে সরে যাচ্ছে। ১৯২০ এর দশকে বৈজ্ঞানিক এডুইন হাবল দূরবর্তী গ্যালাক্সিসমূহের তারকার আলো পর্যবেক্ষন করে দেখতে পান- সেগুলি সর্বদা পশ্চাদপসরণ করছে।
কোরানঃ "আকাশমন্ডলীকে আমিই সৃষ্টি করিয়াছি শক্তিদ্বারা এবং নিশ্চই আমি উহাকে সম্প্রসারিত করিতেছি।" - ৫১:৪৭
বিজ্ঞানঃ সকল দিকের সব দূরবর্তী গ্যালাক্সিই প্রতিনিয়ত আমাদের মিলকীওয়ে গ্যালাক্সী থেকে দুরে সরে যাচ্ছে। এর অর্থ দাড়ায়, মহাবিশ্ব সর্বদাই সম্পসারিত হচ্ছে।

কোরানঃ "কাফিরেরা কি দেখে না যে, এই আসমান যমীন সবকিছু মিলিত অবস্থায় ছিল, পরে আমি
এইগুলিকে আলাদা আলাদা করিয়া দিয়াছি।" - ২১:৩০
বিজ্ঞানঃ মহাবিশ্ব বর্তমানে সম্প্রসারিত হচ্ছে, যার অর্থ দাড়ায়, আদিতে কোন এক সময় মহাবিশ্বের সমস্ত গ্রহ, নক্ষত্র তথা সমস্ত পদার্থ একত্রিত অবস্থায় ছিল, সম্ভবত কোন এক আদি বিস্ফোরণ থেকে এই সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে। (বিগব্যাঙ)
কোরানঃ "তৎপর তিনি আসমানের প্রতি মন দিলেন, তখন উহা ধোঁয়া ছিল, পরে তিনি আসমান ও যমীনকে বলিলেন, 'আস, ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায়', তাহারা বলিল, 'আমরা একান্ত অনুগতভাবেই আসিলাম।'" - ৪১:১১
বিজ্ঞানঃ সৃষ্টির প্রারম্ভে মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের মিশ্রিত ধোয়া উৎপন্ন হয়েছিল। অজানা কারনবশত এই ধোয়া বিভক্ত হয়ে বিশাল আকৃতির সব ধোয়ার মেঘে রূপান্তরিত হয়েছিল। পরবর্তিতে এক একটি ধোয়ার মেঘ রূপান্তরিত হয়েছে এক একটি গ্যালাক্সিতে। ধোয়া থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এ মহাবিশ্ব সব গ্যালাক্সি তথা সম্পূর্ন মহাবিশ্ব।
কোরানঃ সূর্য তার নিজ অক্ষে ঘুরিতেছে। ইহা পরাক্রমশালী প্রভুর নির্ধারিত। আমি চন্দ্রকে যথাস্থানে বসিয়ে দিয়েছি এমনকি চন্দ্রটি শীর্ণ খেজুর পাতার মতো হয়ে যায়। সূর্য চন্দ্রকে ধরতে পারে না ও রাত্রিও দিনকে আতিক্রম করতে পারে না। তারা নিজ নিজ কক্ষ পথে চলতেছে। (৩৬: ৩৮, ৩৯, ৪০)
বিজ্ঞানঃ সূর্য তার নিজ অক্ষে ঘুরছে...স্থির ভাবে। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষ পথে ঘুরছে... বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল.. সবার কক্ষপথ আলাদা। সূর্য এদের মাঝখানে।
কোরানঃ হে জ্বিন ও মানবমণ্ডলী, যদি তোমরা প্রবেশ করিতে পার আসমান ও জমিনের এলাকায়, তাহা হইলে উহাতে প্রবেশ কর৷ তোমরা উহাতে প্রবেশ করিতে পারিবে না মহাবমতা ব্যতিরেকে। (৫৫:৩৩)
বিজ্ঞানঃ মহাশূন্য বিজয়ের কথা এখানে আয়াতে ইঙ্গিত দেয়া আছে। অর্থাৎ আল্লাহ বলছেন, তোমরা মহাৰমতা অর্জন করেই কেবল উহাতে প্রবেশ করতে পারবে৷ বলাবাহুল্য, এই মহাৰমতা হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাকর্ষের বাধা অতিক্রমকারী দ্রম্নতগামী প্রযুক্তি অর্জন৷ বিগত শতকের শেষ দিকে মানুষ এই প্রযুক্তি করায়ত্ত করে এবং সফলভাবে চাঁদে অবতরণ করে৷
একটু দেখলেই বুঝা যায় এরকম বিজ্ঞানীকিকরণের ক্ষেত্রে দুটি কাজ সচেতনভাবে করা হয়, দুধরণের বিচ্যুতি, বিজ্ঞানের কোন স্বীকৃত তথ্যক কোরানজাত করতে গিয়ে প্রথম বিচ্যুতি ঘটানো হয় অনুবাদে ও দ্বিতীয় বিচ্যুতিটি ঘটে ব্যাখ্যায়। যেমন,
অনুবাদগত বিচ্যুতিঃ
উপরের নমুনা থেকে দেখি, ৮১:১৫ ও ১৬ এর অনুবাদ করা হয়েছে এভাবে: "অতঃপর আমি নিদর্শন দিতেছি। ওই সকল তারকার যাহারা পিছনে হটিয়া যায়"। জহুরুল হকের অনুবাদে আমরা পাই, "আমি স্বাক্ষী মানছি গ্রহ-নক্ষত্রদের। যারা চলে থাকে, অদৃশ্য হয়ে যায়"। আরো তিনটি অনুবাদ দেখি:
"YUSUFALI: So verily I call to witness the planets - that recede, Go straight, or hide;
PICKTHAL: Oh, but I call to witness the planets, The stars which rise and set,
SHAKIR: But nay! I swear by the stars, That run their course (and) hide themselves,"
একইভাবে, ৫১:৪৭ এর অনুবাদ করা হয়েছে, "আকাশমন্ডলীকে আমিই সৃষ্টি করিয়াছি শক্তিদ্বারা এবং নিশ্চই আমি উহাকে সম্প্রসারিত করিতেছি"। জহুরুল হকের অনুবাদে এটি অনেকটা এমন : "আর মহাকাশমণ্ডল, আমরা তা নির্মাণ করেছি হাতে, আর আমরাই বিশালতার নির্মাতা"। ইংরেজী অনুবাদে পাই:
YUSUFALI: With power and skill did We construct the Firmament: for it is We Who
create the vastness of pace.
PICKTHAL: We have built the heaven with might, and We it is Who make the vast extent (thereof).
SHAKIR: And the heaven, We raised it high with power, and most surely We are the makers of things ample.
এরপরে আসি সূর্য ও পৃথিবীর গতিসংক্রান্ত আয়াতের অনুবাদে। ৩৬:৩৮ এর অনুবাদে এখানে বলা হয়েছে, "সূর্য তার নিজ অক্ষে ঘুরিতেছে"। জহুরুল হকের অনুবাদ: "সূর্য তার গন্তব্যপথে বিচরণ করে"। এবং ইংরেজী অনুবাদে পাই:
YUSUFALI: And the sun runs his course for a period determined for him.
PICKTHAL: And the sun runneth on unto a resting-place for him.
SHAKIR: And the sun runs on to a term appointed for it;
এরকম আরো দেখানো যেতে পারে, আশা করি আপনার নিজেও কয়েকটি অনুবাদের সাথে মিলিয়ে দেখলেই বুঝবেন।
ব্যাখ্যাগত বিচ্যুতিঃ
এখানে আরো মজা, কেননা সবচেয়ে বড় জোচ্চুরী ঘটে এখানেই। "গ্রহ-নক্ষত্ররা চলে ও অদৃশ্য হয়" (৮১:১৫) এই অনুবাদের বদলে "তারারা পিছু হটে" এই অনুবাদ ধরলেও যখন এর সাথে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিসমূহ দূরে সরে যাচ্ছে বিজ্ঞানী হাবলের এই আবিষ্কারের যোগসূত্র বের করা হয়, তখন হাসবো না কাঁদবো সহসা বুঝে আসে না। আবার যখন "সূর্য চন্দ্রকে ধরতে পারে না ও রাত্রিও দিনকে আতিক্রম করতে পারে না। তারা নিজ নিজ কক্ষ পথে চলতেছে" (৩৬:৪০) এর ব্যাখ্যায় বলা হয় তারা মানে পৃথিবী, গ্রহ সমূহ নিজ নিজ কক্ষে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, তখন ব্যকরণ নতুন করে শিখতে ইচ্ছে করে। প্রশ্ন এসে খেলা করে, বিশেষ্যের (সূর্য, চন্দ্র বা রাত্রি ও দিন) পরে যে সর্বনাম (তারা) বসে, সেই সর্বনাম কোন বিশেষ্যকে নির্দেশ করে! "আসমান যমীন সবকিছু মিলিত অবস্থায় ছিল, পরে আমি এইগুলিকে আলাদা আলাদা করিয়া দিয়াছি" (২১:৩০) এর ব্যাখ্যায় যখন বিগব্যাঙ থিওরি খুঁজে পাওয়া যায়, তখন মনে আসে এখন না থাক সৃষ্টির আদিতে নিশ্চয় আসমান বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নিশ্চয় ছিল। আরেকবার বিগব্যাঙ থিওরি খুঁজে দেখি শুরুতেই পৃথিবীর (যমীন) সৃষ্টি হয়েছিল কি-না। "হে জ্বিন ও মানবমণ্ডলী, যদি তোমরা প্রবেশ করিতে পার আসমান ও জমিনের এলাকায়, তাহা হইলে উহাতে প্রবেশ কর" (৫৫:৩৩) এর ব্যাখ্যায় যখন বলা হয় মানুষের চন্দ্রে অভিযান সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী কোরানেই করা হয়েছে, তখন আর হাসি চেপে রাখতে পারি না, মনে পড়ে যায় সেই গল্পের কথা, যেখানে অর্ধশিক্ষিত এক গ্রাম্য যুবক বকলম গ্রামবাসীদের নিজের মত টেলিগ্রাম অনুবাদ করে শুনিয়েছিল!!
বিজ্ঞান বনাম কোরানঃ
মজা এখানেই শেষ নয়। আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, এ ধরণের বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনায় আড়ালে আবডালে থেকে যায় কোরান- হাদীসের আরো কিছু সুরা, আয়াত, হাদীস। একইভাবে সেখানে ঘুণাক্ষরেও আনা হয় না বিজ্ঞানের অন্য কিছু স্বীকৃত আবিষ্কারের কথা। আর কোনক্রমেই যদিবা এসব কেউ নিয়েও আসে, সাথে সাথে ফতোয়াও হাজির হয়ে যায়ঃ
"এসব কোরান-হাদীস বুঝার সামর্থ্য আমাদের মত অর্বাচীনের নেই, কোন কোনটি আবার নাকি বিয়োণ্ড হিউম্যান ইমাজিনেশন",
কিংবা আক্রমণ চলে আসে বিজ্ঞানের উপরেই:
"বিজ্ঞান কি সব কিছু কখনো জানতে পারে?"
এই আক্রমণের সাথে সাথে অবশ্য কোরান ও বিজ্ঞানের যোগসূত্র বের করার হার কমা শুরু করে না। যাহোক, এমন ফতোয়া আসবে ধরে নিয়েই আসুন কিছু কোরান-হাদীস পর্যালোচনা করিঃ
১৮: ৮৬: পরে যখন তিনি সূর্য অস্ত যাবার স্থানে পৌঁছলেন, তিনি এটিকে দেখতে পেলেন কালো জলাশয়ে অস্তগমন করছে, আর তার কাছে পেলেন এক অধিবাসী। আমরা বললাম- "হে যুলক্কারনাইন, তোমরা শাস্তি দিতে পার অথবা এদের সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পার"।
১৮: ৯০:পরে যখন তিনি সূর্য উদয় হওয়ার জায়গায় পৌঁছলেন তখন তিনি এটিকে দেখতে পেলেন উদয় হচ্ছে এক অধিবাসীর উপরে যাদের জন্য আমরা এর থেকে কোন আবরণ বানাই নি।
এখানে কথক আল্লাহ যুলক্বারাইন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলছেন, তিনি সূর্য উদয় স্থলে একবার গেলেন এবং আরেকবার গেলেন সূর্য অস্তের স্থানে। যেখানে গিয়ে যুলক্বারাইন দেখে সূর্যের কালো জলাশয়ে অস্ত যাওয়াও প্রত্যক্ষ করেন। এখান থেকে মনে প্রশ্ন আসে, তখন কি আরবের মানুষ জানতো না যে পৃথিবী গোলাকৃতির, কেননা, সমতল হলেই পৃথবীতে সূর্যের উদয় ও অস্ত যাওয়ার দুদিকে দুটি স্থানের প্রয়োজন পড়ে। (শানে নুযুল দ্রষ্টব্যঃ কাফিরেরা তাওরাত-ইঞ্জীলে উল্লেখিত আশ্চর্য মানুষ সম্পর্কে মুহম্মদ সা কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যে ব্যক্তি গোটা বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন উভয় দিকে মানে পশ্চিমে ও পূর্বে)। এরপরে আরো কটি সুরায় কিছু আয়াত দেখলে একই প্রশ্ন আবারো উকিঝুকি মারতে থাকে মনে:
২১: ৩১: আর পৃথিবীতে আমরা পাহাড় পর্বত স্থাপন করেছি, পাছে তাদের সঙ্গে এটি আন্দোলিত হয়; আর ওতে আমরা বানিয়েছি চওড়া পথঘাট যেন তারা সৎপথ প্রাপ্ত হয়।
২১: ৩২: আর আমরা আকাশকে করেছি এক সুরক্ষিত ছাদ। কিন্তু তারা এর নিদর্শনাবলী থেকে বিমুখ থাকে।
১৫: ১৯: আর পৃথিবী- আমরা তাকে প্রসারিত করেছি, আর তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা, আর তাতে উৎপন্ন করেছি হরেক রকমের জিনিস সুপরিমিতভাবে।
৭৮: ৬, ৭: আমরা কি পৃথিবীটাকে পাতানো বিছানো রূপে বানাইনি? আর পাহাড় পর্বতকে খুঁটি রূপে?
২: ২২: যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে ফরাশ (couch) বানিয়েছেন, আর আকাশকে চাঁদোয়া (canopy).....
৩১: ১০: তিনি মহাকাশমণ্ডলীকে সৃষ্টি করেছেন কোন খুঁটি ছাড়াই,- তোমরা তো দেখতেই পাচ্ছ; আর তিনি পৃথিবীতে স্থাপন করেছেন পর্বতমালা পাছে এটি তোমাদের নিয়ে ঢলে পড়ে।
এসব যখন পড়ি, তখন আধুনিক বিজ্ঞান আকাশ সম্পর্কে কি বলে তা মনে আসলেই বিপদ। যখন মহাশূণ্যে নিয়ত গতিশীল জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর বিচরণের দিকে তাকাই তখন কোরানের এই আকাশমণ্ডলী যাকে খুটি ছাড়াই আল্লাহ মানুষের ছাদ বা চাঁদোয়া হিসাবে সৃষ্টি করেছেন, যার আবার ৭টি স্তরও বিদ্যমান, সম্পর্কে ধাধায় পড়ে যাই। আর, জমিন বা পৃথিবীকে পাতানো বিছানো হিসাবে তৈরী করে সেখানে পাহাড়-পর্বত দিয়েছেন, যার দরুন পৃথিবী হেলেও পড়ে না, নড়াচড়াও করতে পারে না। এ আল্লাহর অসীম দয়া নিসন্দেহে, কিন্তু এখন যখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, এত বড় বড় পর্বতমালা থাকার পরেও শুধু নড়াচড়া নয় প্রতি ২৪ ঘন্টায় এক ডিগবাজীর সাথে সাথে ৩৬৫ দিনে সূর্যের চারদিকে নেচে বেড়াচ্ছে এই পৃথিবী, তখন আল্লাহর জ্ঞানের পরিধি নিয়ে মন সন্দেহগ্রস্ত হয়ে উঠতে চায়!
এবারে নিচের আয়াত দেখিঃ
৩৬: ৪০: সূর্যের নিজের সাধ্য নেই চন্দ্রকে ধরার, রাতেরও নেই দিনকে অতিক্রম করার। আর সবকটিই কক্ষপথে ভাসছে।
এখানে সূর্য ও চন্দ্রের সংঘর্ষের সম্ভাবনা নেই বলে যখন ঘোষণা করা হয়, তখন হঠাতই মনে হয় সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন কক্ষপথের কথা জানলে কি এই সংঘর্ষের কথা উঠতে পারে? মনে পড়ে এক বালকের কথা, যে অবাক হয়ে তার বাবাকে প্রশ্ন করে যে, আচ্ছা বাবা- একই আকাশে সূর্যও পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাচ্ছে, চন্দ্রও। তাহলে ওদের মধ্যে ঠোকাঠুকি হয় না কেন? বাবা বলতে পারেন, ভিন্ন কক্ষপথের কথা অথবা বলতে পারেন আল্লাহর কুদরতের কথা। আল্লাহ নিজে তো নিজের কুদরতের কথা ঘোষণা করবেনই।
সূর্য নিজ অক্ষে ঘুরছে দাবী করা হয়েছে যে আয়াতটি দিয়ে সেটি হলো ৩৬: ৩৮, সেটির PICKTHAL কর্তৃক অনুবাদ হচ্ছে: "And the sun runneth on unto a resting-place for him". এই রেস্টিং প্লেসের বিষয়টি আমরা এবার দেখি সহীহ বুখারী হাদীসেঃ
"হযরত আবূ যর গিফারী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন নবী করিম সা. আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আবূ যর, তুমি কি জান যে, অস্ত যাওয়ার পরে সূর্য কোথায় যায়?" আমি উত্তর করলাম, "আমি জানি না, একমাত্র আল্লাহর রাসুল সা. ই ভালো বলতে পারেন"। তখন তিনি বললেন, "অস্ত যাবার পরে সূর্য আল্লাহর আরশের নিচে অবস্থান করে এবং আবার পূর্বদিকে উদয় হওয়ার জন্য আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় থাকে। এমন দিন আসবে যখন সূর্য উদয়ের অনুমতি পাবে না এবং তখন পৃথিবীতে কেয়ামত নেমে আসবে"। (ভলিউম ৪, বুক ৫৪, হাদীস ৪২১)
এবারে মুহম্মদ সা. ও তাঁর সমসাময়িক আরববাসীদের বিজ্ঞানের দৌড় সম্পর্কে ধারণা করা আমাদের জন্য কিছুটা সহজ হলো বিধায়। মুহম্মদ সা এর বিজ্ঞান দৌড়ই বা বলি কেমনে, ওনাকে তো শিখিয়েছেন আল্লাহ স্বয়ং!!
এমনতো অসংখ্যই আছে। ভুরি ভুরি। কোনটা বাদে কোনটা লিখবো? জ্বিন, ফেরেশতা এসব আর রূপকথার দেও-দানবের কোন পার্থক্য নেই। তার উপরে নদীর দুভাগ হওয়া, বোরাকে করে সপ্ত আসমান পরিভ্রমণ, লাঠির সর্প হয়ে যাওয়া, হাতের ইশারায় চাদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া, হাতের স্পর্শে কুষ্ঠরোগ ভালো হয়ে যাওয়া প্রভৃতি ঘটনাকে চিত্তাকর্ষক পৌরাণিক কাহিনী বলা যেতে পারে, যেখানে বিজ্ঞান না টানাই হয়তো সবার জন্য মঙ্গলজনক।
যে লাউ সে-ই কদুঃ
এবারে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের সাথে বিজ্ঞানের সংযোগ দেখি:
ভাগবত ২/১৬/১৭: হে মাতঃ হে স্বায়ম্ভুব মনুর কন্যা! আমি পূর্বেই বর্ণনা করিয়াছি যে, কাল হইতেছে পরমেশ্বর ভগবানের শক্তি, প্রকৃতির সাম্য, অব্যক্ত অবস্থা বিক্ষুব্ধ হওয়ার ফলে, যাঁহার থেকে সৃষ্টির শুরু হয়।
বিজ্ঞানঃ এই শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে প্রকৃতির সাম্য, অব্যক্ত অবস্থা বিক্ষুব্ধ হওয়ার ফলে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি শুরু হয়। বিক্ষুব্ধ শব্দটির অর্থ বিস্ফোরণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি বৃহৎ বিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্বের শুরু হয়েছে। একে বিগব্যাঙ বলে।
ভাগবত ৩/২০/১৬: গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভী থেকে একটি সহস্র সূর্যের মতো উজ্জ্বল পদ্ম উদ্ভুত হয়েছিল। সেই পদ্মটি সমস্ত বদ্ধ জীবের অধিষ্ঠান স্বরূপ এবং প্রথম জীব সর্বশক্তিমান ব্রহ্মা সেই পদ্মটি থেকে আবির্ভুত হয়েছিলেন।
বিজ্ঞানঃ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বইটির মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং পরিণতি অধ্যায়ে (১০০ পাতা) আলোচনা করেছেন যে, মনে করা হয় বিস্ফোরণের সময় মহাবিশ্বের আয়তন ছিল শুণ্য, সুতরাং উত্তাপ ছিল অসীম। মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে তাপমাত্রা নেমে এসেছিল প্রায় এক হাজার কোটি ডিগ্রীতে। এ তাপ সূর্যের কেন্দ্রের তাপের চেয়ে প্রায় এক হাজার গুণ বেশী। ভাগবতে বর্ণনা করা হয়েছে বিস্ফোরণের পর তাপমাত্রার পরিমাণ ১০০০ জ্বলন্ত সূর্যের তাপের সমান, যেটি বিজ্ঞানীরাও এখন আবিস্কার করেছেন।
স্কন্ধ পুরাণম ৩৮/৫৪: হে ভরত বংশাবতংস মেঘ সকল ধুম ও সমুদ্রের বাষ্প হইতে বৃষ্টি হয়। সেজন্য এরা জলপূর্ণ হলে নীল বর্ণ হয়ে থাকে এবং বর্ষণ করতে পারে।
ঋকবেদ ৭/৩৬/১: যজ্ঞের সদন হতে স্ত্রোত্র প্রকৃষ্ট রুপে গমন করুক। সূর্য কিরণসমূহ দ্বারা বৃষ্টি সৃষ্টি করিয়াছেন।
বিজ্ঞানঃ আজকের বিজ্ঞানীরা বৃষ্টির কারণ হিসাবে যে পানিচক্রের কথা বলছেন, সেখানে এই সূর্যের তাপে প্রতিদিন সমুদ্র ও জলাশয়ের পানি বাষ্পীভুত হয়ে উপরে উঠে ঘনীভূত ও শীতলীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হয়, যা ভারী হয়ে পরবর্তীতে বৃষ্টি হয়ে মাটিতে নেমে আসে। এটিই স্কন্ধ পুরাণ ও ঋকবেদের উপরের শ্লোকে বলা হয়েছে।
ভাগবত ২/৭/৩৭: কলিযুগে নাস্তিক অসুর স্বভাব মহাবিজ্ঞানীরা বৈদিক জ্ঞানে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে মহাশূণ্য যানে চড়ে গগনমার্গে অদৃশ্যভাবে বিচরণ করবে....
বিজ্ঞানঃ এই শ্লোকে কলিযুগ সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বানী করে বলা হয়েছে কলিযুগে বিজ্ঞানীরা বৈদিক জ্ঞান অর্জন করে বিমান বা মহাশূণ্যযান তৈরী করবে। কলিযুগ মানে বর্তমান যুগ। সুতরাং বলা যায় বর্তমান যুগে বিজ্ঞানীরা যে বিমান তৈরী করেছেন, সে সম্পর্কে ভাগবতে লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বে ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে। ভাগবতে বেশ কয়েক রকমের মহাশূণ্য যানের বর্ণনা আছে।
এমন অনেক নমুনা দেখানো যেতে পারে, বাইবেলের বিজ্ঞানিকীকরণ নিয়েও কিছু নমুনা দেয়া যেতে পারে। মুসলিম পাঠকের কাছে এখানকার আলোচনাগুলো হাস্যকর, অবৈজ্ঞানিক, অবান্তর, অযৌক্তিক খুব সহজেই মনে হতে পারে; কিন্তু আদতে কোরানের সাথে বিজ্ঞানের যোগসূত্র বের করার আলোচনার সাথে এই আলোচনাসমূহের কোন পার্থক্য নেই। যে লাউ সে-ই কদু, এখানেও হয়েছে অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগত বিচ্যুতি, আজকের বিজ্ঞান এসব কিচ্ছা-কাহিনীকে আর যাই হোক বিজ্ঞান হিসাবে স্বীকার করে না। আরেকটি তুলনামূলক নমুনা দেখিয়ে এ পরিচ্ছেদের আলোচনা শেষ করছি।
কোরান ২৩:১৩,১৪: তারপর আমরা তাকে বানাই শুক্রকীট এক নিরাপদ অবস্থান স্থলে। তারপর শুক্রকীটকে বানাই একটি রক্তপিণ্ড, তারপর রক্তপিণ্ডকে বানাই একতাল মাংসের তাল, তারপরে মাংসের তালে আমরা সৃষ্টি করি হাড়গোড়, তারপর হাড়গোড়কে ঢেকে দেই মাংসপেশী দিয়ে, তারপরে আমরা তাকে সৃষ্টি করি অন্য এক সৃষ্টিতে। সেইজন্য আল্লাহরই অপার মহিমা, কত শ্রেষ্ঠ এই স্রষ্টা।
বিজ্ঞানঃ সেই কোন আমলে কোরানেই মাতৃগর্ভে ভ্রুণ সৃষ্টি ভ্রূণ থেকে ধীরে মানব শিশুর আকৃতি লাভের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।
বায়ুপুরাণম ১৪/১৮, ১৯: গর্ভকালে শুক্র এবং শোনিত মিলিত হয়ে কলল আকার ধারণ করে। পরে কলল থেকে বুদবুদ আকার প্রাপ্ত হয়। চক্রের উপর মাটির পিণ্ড যেমন চক্রের ঘুর্ণন দ্বারা বিবর্তিত হয়ে ঘট, শরাদি বিভিন্ন নানাকার ধারণ করে, তদ্রূপ আত্মাও বায়ুদ্বারা পরিচালিত হয়ে কালবশে অস্থিযুক্ত বিবিধ মনঃসম্পন্ন মানুষরূপে উৎপন্ন করে।
ভাগবত ৩/৩১/২: সেই রেতকণা গর্ভে পতিত হলে, একরাত্রে শোনিতের সাথে মিশ্রিত হয়, পঞ্চ রাত্রিতে বুদ্বুদের আকার প্রাপ্ত হয় এবং ধীরে ধীরে তা মাংসপিণ্ডে বা অণ্ডে পরিণত হয়।
বিজ্ঞানঃ বৈদিক সাহিত্যে শুক্রাণুকে রেতকণা বা শুক্র, ডিম্বাণুকে শোনিত এবং জাইগোটকে কলল নামে অভিহিত করা হয়। আধুনিক বিজ্ঞান আজ অনুরূপ কথাই বলে।উভয় আলোচনাই আধুনিক বিজ্ঞানকে টেনে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করলেও, ধুনিক ভ্রূণতত্ত্ব অনুসারে অবশ্য কোরান বা ভাগবত ও বায়ুপুরাণের এসব ব্যখ্যা সম্পূর্ণ ভুল প্রমানিত!!
১৪০০ বছর আগের এক নিরক্ষরের গল্পঃ
এই ধরণের বিজ্ঞান আলোচনার পরে সকলের উদ্দেশ্যে প্রায়শই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়ঃ "আজ হতে ১৪০০ বছর আগে যে আরবে একজন নিরক্ষর মানুষ এই কথাগুলো কিভাবে ভাবতে পেরেছিলেন তা কি কখনো চিন্তা করেছেন? আজ বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করছে আজ হতে ১৪০০ বছর আগেই একজন মানুষ তা বললে তা কিভাবে তার মস্তিষ্ক প্রসূত হয়?" এভাবেই প্রমাণ হয়ে গেল কোরান মনুষ্য সৃষ্ট নয়, এটা ঐশী।
এখানেই গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটলে ভালো হতো, কিন্তু যখন আমরা মানব ইতিহাসের কিছু দারুণ কিছু কর্মের সন্ধান পাই তখন বিস্ময়াভূত হয়ে যাই। সেই ১৪০০ বছরেরও আরো প্রায় ২ শতাধিক বছর পূর্বেই (কোপারনিকাসেরও সহস্র বছর পূর্বে) আর্যভট্ট (৪৭৬ খৃস্টাব্দ) বলেছেন, পৃথিবী গোলাকার, এটি নিজ অক্ষের চারদিকে ঘুরে এবং সাথে সাথে এটি সূর্যকেও প্রদক্ষিণ করে। ২ সহস্রাধিক বছর আগে (খৃষ্টের জন্মেরও ৩০০/ ৩৫০ বছর পূর্বে) এরিস্টোটল বলেছেন, বায়ুশূণ্য অবস্থায় বস্তু একই অবস্থানে থাকবে নতুবা সমগতিতে চিরকাল চলতে থাকবে। (এরিস্টোটল অবশ্য তার সিদ্ধান্তের পেছনে কোন প্রমাণ তো হাজির করতে পারেনই নি, বরং পরক্ষণেই তার সেই আবিস্কারকে অস্বীকার করেছেন এই ধারণা থেকে যে, বায়ুশূণ্য স্থান থাকতে পারে না, ফলে ইহা অসম্ভব)। ভাস্করাচার্য (২), নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র প্রদানেরও ৫ শতাধিক বছর পূর্বে বলেছেন, পৃথবীতে বস্তুসমূহ পতিত হয় পৃথিবীর টানেই, এবং পৃথিবী, গ্রহসমূহ, জ্যোতিস্কসমূহ, চাঁদ ও সূর্য নিজ নিজ কক্ষে এই আকর্ষণের কারণেই অবস্থান করে। এসব যখন দেখি তখন ভাবি, আল্লাহর পূর্বে মানুষই তো সঠিক জ্ঞান তো আমাদের দিতে পারলো। আর, আল্লাহ এমনভাবে পেচিয়ে পুচিয়ে যে জ্ঞান দিলেন, তাও দেখা যাচ্ছে অনেক জায়গায় ভুলে ভরা!! আফসোস তৈরী হয়, নিজ হাতে লেখার পরেও কেন আল্লাহ গোটা কোরানে একবারো সরাসরি উল্লেখ করতে পারলেন না যে, পৃথিবী গোলাকার, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে।
সূত্রঃ
১। আল কুরআন- বাংলা অনুবাদ, ডঃ জহুরুল হক
২। Translation of quran( http://www.usc.edu/dept/MSA/quran/)
৩। তাফসিরুল মারেফুল কোরআন ( http://www.banglakitab.com/quran.htm)
৪। সৈয়দ কামরান মির্জা কর্তৃক প্রণীত Samples of Quranic Contradictions, Inconsistencies and Errors ( http://www.faithfreedom.org/Articles/SKM/contradictions.htm)
৫। কোরআন বাইবেল বেদ ও বিজ্ঞান- ডাঃ সি এন সি বোস