নাস্তিকের ধর্মকথা

: নাস্তিকের ধর্মকথা কেন?

:: আমি নাস্তিক। আমার ধর্মকথন তথা একজন নাস্তিকের ধর্ম সম্পর্কিত কথাবার্তা তুলে ধরাই আমার উদ্দেশ্য।
 

: কি আপনার ধর্ম?
:: মানবধর্ম এবং নাস্তিক্যবাদ।
 

: আপনি মানবজাতির জন্য কি কাজ করেছেন?
:: কিছুই না। বলার মত আসলেই কিছু পাচ্ছি না।
 

: আপনার ধর্ম বলছেন মানবধর্ম, আর মানবজাতির জন্য কিছুই করেন নি? আপনাকে বুঝা হয়ে গেছে! কাজের বেলায় ঠনঠন !!
:: হা হা। আসলে ‘মানবতাবাদ/হিউম্যানিটি আমার ধর্ম’- এটা আমি একটু অন্যভাবে বুঝি- দর্শনগত দিক থেকে বিষয়টা দেখলে বুঝানোটা সহজ হবে। আমি কি একটা উদাহরণ দেব?
 

: কি বলবেন জানি।
:: ও, তাহলে থাক।
 

: না বলেন।
:: মানবসমাজে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের একটা ধারণা আছে। প্রচলিত ধর্মগুলো নিজ নিজ ব্যাখ্যা অনুযায়ি স্ব স্ব ধারণা গড়ে তুলে এবং বিভিন্ন ধর্মে এই ধারণার মিল ও অমিলও পাওয়া যায়। প্রচলিত প্রধান ধর্মগুলোর ক্ষেত্রে এই ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের ধারণার মূলে আছে কোন অশরীরি একজনের নির্দেশ বা পবিত্র ও ঐশী দাবিকৃত কোন এক ধর্মগ্রন্থের দেখানো পথ বা পরলোকের ভয়/চিন্তা কিংবা কোন এক বা একাধিক মহাপুরুষ/নবী/ঋষীর আদেশ-উপদেশ। ফলে, এই ধারণা বড় বেশী স্থবির – স্ট্যাটিক। দেশ-কাল-পাত্র-পরিস্থিতি সেখানে গৌন, মানুষকে নিয়ে এই সমস্ত আদেশ-উপদেশ-নির্দেশ উত্থাপিত হলেও মানুষও যেন সেখানে গৌন; মূল হচ্ছে অশরীরি সেই একজন বা বহুজন, পবিত্র ও ঐশী দাবিকৃত সেই গ্রন্থ কিংবা কোন যুগ/আমলের এক বা একাধিক সেই মহাপুরুষ। আপরদিকে আমার ধর্ম যখন বলছি মানবধর্ম বা হিউম্যানিটি, তখন বুঝাতে চাচ্ছি আমার কাছে সবকিছু বিচারের মানদন্ড হচ্ছে এই মানবজাতি- সমগ্র মানবসমাজ, যার দেশ-কাল-পাত্র ভেদে বৈচিত্র আছে এবং যা নিয়ত প্রবাহমান ও গতিশীল। সুতরাং আমার ক্ষেত্রে ভালো-মন্দের ধারণাটাও স্ট্যাটিক তো নয়ই, প্রচন্ড গতিশীল। কোন কাল্পনিক সত্ত্বা বা বিশেষ কোন গ্রন্থ যা একান্তই মর্মর কাগজের তৈরি ও ব্যক্তি বিশেষের লিখিত কিংবা কোন সে কালের এক বা একাধিক রক্তমাংসের মানুষের উপর যুগ যুগ ধরে ও সর্বভূতে অর্থহীন এবং অন্ধ নির্ভরতার কোন স্থান এই মানবধর্মে নেই।
 

: ‘ধর্ম’ শব্দটার মানে কি- সেটা আপনি জানেন?
:: আমার মত করে আমি জানি বৈকি, এবং এটাও মানি যে সেটা আপনার মত করে না-ও মিলতে পারে।
 

: বলেন।
:: ধর্ম মানে কি এটা নানাভাবেই বলা যেতে পারে, বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে এই শব্দটাকে দেখা যেতে পারে, কেননা বাংলা ‘ধর্ম’ শব্দটি কিছুটা ব্যাপক। রিলিজিওন, ন্যাচার, ক্যারাক্টারিস্টিকস সবগুলোই কিন্তু ধর্ম। আমার মত করে ধর্মের সংজ্ঞায়নের চেস্টা করে দেখি।
 

: ধন্যবাদ। চেস্টা করেন।
:: সাদামাটাভাবে বললে বলা যায়, কোন কিছুর সাধারণ ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য তথা গুনাগুনকে তার ধর্ম বলা যায়। যেমন হাইড্রোজেন একটা গ্যাস, এটা বাতাস অপেক্ষা হালকা, এটা পুড়ালে পানি উৎপন্ন হয় .. ইত্যাদি হচ্ছে হাইড্রোজেনের ধর্ম। একইভাবে মানুষের ধর্ম হচ্ছে হিউম্যানিটি। একজন মানুষকে চেনা যাবে তার মানবধর্ম বা হিউম্যানিটি দিয়ে, যেমন করে হাইড্রোজেন বা লোহাকে চেনা যায় হাইড্রোজেন বা লোহার ধর্ম দিয়ে। তবে, বাংলায় মানুষ শব্দটাও ব্যাপক। ম্যান আর হিউম্যান এক না। দুই হাত, দুই পা থাকা, সোজা হয়ে হাটতে পারাটাই কিন্তু হিউম্যানিটি না, বড়জোর সেটা হোমো স্যাপিয়েনসের বৈশিষ্ট বা ধর্ম হতে পারে। ম্যান যখন ম্যানকাইন্ডের অন্তর্গত- তখনই সে হিউম্যান। এই ম্যানকাইন্ড বা মানব সমাজের অন্তর্গত মানুষের ধর্মই হচ্ছে হিউম্যানিটি।
 

আবার, একজন নাস্তিক যে কারণে নাস্তিক- সেটাই তার নাস্তিক্য ধর্ম। নাস্তিক হচ্ছে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। ফলে, নাস্তিকের ধর্ম হচ্ছে তার এই অবিশ্বাস। কেন অবিশ্বাসী সেই যুক্তিবোধ, সেই চিন্তাচেতনা প্রসূত কথাবার্তাই হচ্ছে নাস্তিকের ধর্মকথা।
 

: এসব তো আপনি বলছেন বৈশিষ্টের কথা। ইসলাম বা খ্রিস্ট ধর্মগুলোর কথা বলছি। মানে রিলিজিওন অর্থে ধর্ম। সেটা কি?
:: মুসলমানদের ধর্ম ইসলাম বা খ্রিস্টানদের খ্রিস্টধর্ম। মানে আসলে কি? একজন মুসলমান কেন মুসলমান? কারণ সে কিছু জিনিস বিশ্বাস করে, কিছু বিষয় মেনে চলে – পালন করে। এই জিনিসগুলো, বিষয়গুলোকে, বিশ্বাসগুলোকেই (যার কারণে তাকে মুসলমান বলা যায়) মুসলমানের ধর্ম তথা ইসলাম বলা হয়। অন্যান্য প্রচলিত ধর্মগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। তাহলে, একইভাবে একজন নাস্তিক যে কারণে নাস্তিক, অর্থাৎ তার অবিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা এগুলোই হচ্ছে তার ধর্ম। ইসলাম-খ্রিস্ট-জৈন প্রভৃতি যেমন একেকটা রিলিজিওনের নাম নির্দেশ করে, একইভাবে নাস্তিকদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, চিন্তা-চেতনাকে নাস্তিক্য ধর্ম হিসাবে বিবেচিত করা যায়।
 

যদিও রিলিজিওন/ ধর্ম শব্দটা প্রচলিত ধর্মগুলোর জন্য এমনভাবে বহুল ব্যবহৃত এবং প্রচলিত ধর্মগুলো একেকটা এমনই কুসংস্কার-কুপমন্ডুকতার আধার যে- রিলিজিওন/ধর্ম শব্দটাই অনেকটা ঋণাত্মক বোধ তৈরি করে ফেলেছে, এবং অনেক নাস্তিকই এই শব্দটায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। ধর্ম কি এর জবাবে তারা বলেন, তাদের কোন ধর্ম নেই, অর্থাৎ ‘তোমরা যে অর্থে ও যে দৃষ্টিতে ধর্মকে বুঝো- সেইরকম কোন ধর্ম আমাদের নেই’।
 

: তাহলে, আপনি কেন ধর্মকথা বলছেন।
:: আমার শব্দের প্রতি কোন বিদ্বেষ তো নেই। ফলে, আমি বলি না যে আমার কোন ধর্ম নেই। অবশ্যই আমার ধর্ম আছে- সেটা প্রচলিত ধর্মগুলো থেকে স্বতন্ত্র এবং আলাদা। আরেকটা কারণে অনেক নাস্তিক বন্ধুরা নিজেদের ধর্মহীন বলতে ভালোবাসেন, তা হচ্ছে- নাস্তিকরা নিজেদের গন্ডিবদ্ধ বা সীমাবদ্ধ ভাবতে ভালোবাসেন না, ধর্মীয় পরিচয় তাদের কাছে সীমাবদ্ধতারই নামান্তর। আমি তারপরেও ধর্মের কথা বলি, কারণ এর মাধ্যমেই অন্য ধর্মগুলো থেকে স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরতে পারি। আইডেন্টিটি বা পরিচয় বহনেও আমার কোন এলার্জি নেই, বরং জরুরিই মনে করি। নাস্তিকরা স্থান-কাল-পাত্রের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়- এই আইডেন্টিটি আমাদের দরকার।
 

: আজকাল হিউম্যানিজম বা নাস্তিকতাকে ধর্ম হিসাবে বলাটা অনেকের কাছে ফ্যাশনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনিও যে সে গ্রুপের না কে জানে!
:: কেউ যদি বলে, নাস্তিকতা আমার ফ্যাশন- তবে আপত্তি করি না। বরং ফ্যাশন বলেন আর স্টাইলই বলেন- এই নাস্তিকতা আমায় এগিয়ে যাবার শক্তি যোগায়, মানুষ যে কোন রোবট বিশেষ নয় বা অদৃশ্য কারো খেলার কোন পুতুল নয় বা মনোরঞ্জনের সামগ্রী নয়- মানুষ নিজেই নিজের জীবনের বিধাতা- এমন আত্মবিশ্বাস আমার কাছে অমূল্য। ফলে, এহেন ফ্যাশনের জন্য আমি গর্ববোধই করি।
 

: এমন গর্ব করা ভালো নয়। যে বিষয়ে আপনি সঠিকভাবে জানেন না- তা নিয়ে গর্ব করবেন কেন?
:: হা হা। যতটুকু জানি তার জন্য গর্ব, কারণ যতটুকু জানি না- তার জন্য নিরন্তর চেস্টা। অন্তত, হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকাটা কাজের কিছু না বলেই মনে করি- সবকিছুর মূলে কাল্পনিক সত্ত্বার ভূমিকা নিয়ে আসাটাকে যে জানা বলে মনে করি না।
 

: সবকিছুতেই আপনি বেশী তত্ত্বকথা নিয়ে আসছেন! ঘুম পেয়ে যাচ্ছে।
:: হা হা। আপনার প্রশ্নগুলো যে বড় বেশী তত্ত্বমূলক। শুরুতেই বলেছিলাম- আমার জবাব/ব্যাখ্যাগুলো হবে দর্শনগত দিক থেকে।
 

: আজকে তাহলে থাক। শুভ রাত্রি।
:: বিদায়, ভালো থাকবেন।

দোহাইঃ

১। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের কথপোকথনকে নিজের মত সাজিয়ে পোস্টখানি তৈরি করা হয়েছে।
২।  একই সাথে মুক্তমনা, সামহোয়ারইনব্লগ, আমার ব্লগ ও নাগরিক ব্লগে ফেব্রুয়ারি ২০১১ সালে প্রকাশিত।

কোন মন্তব্য নেই: