সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৯

ঈশ্বরের সাথে কিছুক্ষণ

সোলায়মান সাহেবকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে তিনি একজন পাঁড় নাস্তিক। মিষ্টভাষী, সদাপ্রফুল্ল এই মানুষটি কারো কখনো উপকার বই ক্ষতি করেননি। একাধারে তিনি প্রকৃতিপ্রেমী ও মানবদরদী, অধ্যাবসায়ী ও নীতিবান। মহামান্য শয়তানের কেরামতি বলতে কেবল ঐ বিশ্বাসে ঘাটতি আনাতেই, শয়তান মহাশয়ের যে আর অন্য কোন কাজ আছে- তা সোলায়মান সাহেবকে দেখে বুঝার উপায় নেই। চোখে মোটা চশমা, মধ্যবয়স্ক- যদিও এখনো যথেস্ট তরুন দেখায়, চোখদুটো দারুন বুদ্ধিদীপ্ত ও একই সাথে আত্মবিশ্বাসী- একজন জনপ্রিয় অধ্যাপকের যা যা দরকার। তবে এমন ভালো একজন মানুষ হয়েও, অকপট-সাবলীল-জ্ঞানী হয়েও তিনি একই সাথে জনপ্রিয় ও কুখ্যাত; কুখ্যাত কারণ তিনি একজন নাস্তিক, নিজেকে তিনি যুক্তিবাদী হিসাবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন, বস্তুবাদী দার্শনিক হিসাবে এবং একই সাথে বিবর্তনবিদ্যায় যথেস্ট দখল থাকায় দেশে বিদেশে মোটামুটি নামডাক থাকলেও, ধার্মিক তথা আস্তিক মহলে “নাস্তিক” গালিও তার হজম করতে হয়- যদিও নাস্তিক হিসাবে অভিহিত হতে তিনি গর্ববোধই করেন এবং “নাস্তিকতা”কে গালি হিসাবে উত্থাপিত হতে দেখে তিনি বিরক্তি বোধ করেন। তবে আস্তিকদের গালি কেবল “নাস্তিক” শব্দটিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সামনা-সামনি বিভিন্ন ডিবেটে গলার আওয়াজ কিছুটা চড়া হওয়া, ভুরু কুচকানো- মুখমণ্ডল বাংলার পাঁচ হওয়া এবং যুক্তির ছলে পিতা-মাতা ও জন্ম সংক্রান্ত নানাবিধ প্রশ্ন যথাসম্ভব ভদ্রভাষায় বলা .. প্রভৃতি এবং আড়ালে আবডালে লুকিয়ে, উড়োচিঠিতে এমনকি ক্যাম্পাসের দেয়াললিখনে অকথ্য গালি-গালাজ থেকে শুরু করে এমনকি মৃত্যুর হুমকি …. সবই এখন অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। সচরাচর তিনি এসবকে অগ্রাহ্য করেন, তবে মাঝেমধ্যে মানুষ হয়েও মানুষের এসব আচরণে তিনি খুব হতাশ বোধ করেন। ঈশ্বর ঈদানিং নাস্তিকদের বদলে আস্তিকদের জন্য শয়তান মহাশয়কে নিয়োজিত করেছেন, না কি আস্তিকদের এসমস্ত শয়তানি কাজ-কারবার স্বয়ং ঈশ্বরের ইন্ধনে ঘটছে- সেটা একটা প্রশ্নও বটে! (দ্বিতীয়টি ঘটে থাকলে এ কাজগুলোকে আর ‘শয়তানি’ না বলে অবশ্য ‘ঐশ্বরীয়’ বলাটাই শ্রেয়)।

 

পাঠক! এই হলো আমাদের গল্পের সোলায়মান সাহেব। ওনাকে নিয়ে লিখতে বললে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যাবে এবং সেটা একই কথার পুনরাবৃত্তি না করেই। তদুপরি, মূল গল্পে সরাসরি প্রবেশ করার লক্ষে পরিচয় পর্বটা আমাকে এমন সংক্ষিপ্ত করতেই হলো। অন্তত দশপৃষ্ঠার বর্ণনাকে একটি ছোট প্যারায় নিয়ে আসাটা সবসময়ই খুব কঠিন কাজ, তবে কাজটি নেহাত মন্দ করিনি বলেই আমার বিশ্বাস, আমার ধারণা সোলায়মান সাহেব সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি। এবার তাহলে সরাসরি গল্পেই প্রবেশ করা যাক।

 

একদিনের কথা। যথারীতি সৃষ্টিবাদীদের সাথে বিবর্তনবাদীদের একটি বিতর্কসভায় সোলায়মান সাহেব সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের ভালোই নাজেহাল করেই ফেলেছিলেন, কিন্তু শেষে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা, উপস্থিত দর্শকদের একটা অংশ (এমনকি উপস্থাপকও না কি?) অনেকটা শোরগোল তুলে দেয়।

-“মৃত্যুর পরে কি কিছুই নেই? কেবল অন্ধকার, আর পঁচে যাওয়া, ধুলামাটিতে পরিণত হওয়া?” (এটা মানলে যে সাধের অনন্ত আনন্দের বেহেশতি জীবন হারাইতে হয়!)
-“যুক্তি দিয়ে তো খুব প্রমাণ করছেন যে ঈশ্বর নেই- কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি তিনি থেকে থাকেন তো?” (যেনবা ঈশ্বরের থাকা না থাকাটা যুক্তির উর্ধে!)
-“আজ বুঝতে পারছেন না, কিন্তু যখন বুঝতে পারবেন- তখন আর সময় পাবেন না।” (যেনবা ওনার জন্য তাদের অনেক দরদ!)
-“যে সৃষ্টি করলো- তাকে অস্বীকার করা মানে তো নিজের বাপ-মা-জন্মকেই অস্বীকার করা।” (আহা! কি যুক্তির ছিরি!) … ইত্যাদি নানা প্রশ্নের ভীড়।

শেষ পর্যন্ত সোলায়মান সাহেব বলতে বাধ্য হোন: “এই বিতর্কসভা যুক্তি-তর্কের উপর ভিত্তি করেই আয়োজিত। যুক্তির বাইরে কোন প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই, ব্যক্তিগত প্রশ্নের তো নই-ই”।

 

হলরুম থেকে বের হয়ে যেন কিছুটা স্বস্তি পেলেন। আজ একটু বেশী বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন ভেবে কিছুটা লজ্জিত হন। বয়সের প্রভাব হয়তো বা। চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে যত্ন করে মুছে আবার চোখে দেন। ভাবেন- বিশ্বাসের কত জোর! যুক্তি টলে গেলেও বিশ্বাস টলে না, বিশ্বাসটাই তখন যুক্তির স্থান নিয়ে নেয়! মৃত্যুর পরের শূণ্য জগৎ মানতে এরা নারাজ! যদি ঈশ্বর সত্যি সত্যি থেকে থাকেন- এই রিস্ক নিতে তারা অপারগ! অপরপক্ষের কথাগুলো নিয়ে ভাবতে থাকেন তিনি, কিছুটা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটছেন- এমন সময় …..। রাস্তার অপর পাড়ে গাড়ি পার্ক করা ছিল, ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হতে গিয়ে- কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলেন হয়তো, কিন্তু শেষ মুহুর্তে একটি সন্দেহও তাঁর মাথায় উকি দিয়ে যায়। এই রাস্তায় তো এত গতিতে গাড়ি চলার কথা নয়! অন্যমনস্কতার জন্য নিজেকে ধিক্কার জানাবেন, না কি এটা একটা পরিকল্পিত খুন হতে পারে- সিদ্ধান্তে আসার আগেই চারদিকে সব অন্ধকার।

 

সোলায়মান সাহেব যখন চোখ খুললেন, তখন অবাক হয়ে গেলেন। ছোট্ট একটা বদ্ধ প্রকোষ্ঠে নিজেকে আবিষ্কার করলেন, এবং আবছাভাবে মনে পড়ে গেল- তিনি একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং তারপরে তাকে মাটির নীচে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও, ধাতস্থ হতে তাঁর সময় লাগে না; নার্ভ তাঁর বরাবরই শক্ত। মাটির নীচে কিভাবে আবার চোখ খুললেন, কিভাবে এমনটা সম্ভব হতে পারে এমন চিন্তায় মনোনিবেশ করতে চাইলেন- কিন্তু বাঁধ সাধলো দুই স্বর্গীয় দূত। চিন্তায় মগ্ন থাকতেই তিনি চাইছিলেন, কিন্তু দূত দুটি একটু বেয়াড়া ধরণের। তারা কয়েকটি প্রশ্ন করতে চায় যেগুলোর জবাব না নিয়ে তারা যাবে না- সাফ সাফ জানিয়ে দেয়। ভারী মুশকিলে পড়া গেলো তো- সোলায়মান সাহেব বিরক্তি নিয়ে তাদের দিকে তাকালেন। দূত দুটোকে তার নিম্নশ্রেণীর রোবট ছাড়া কিছুই মনে হলো না, নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন করা আর প্রশ্নের জবাব নেয়ার জন্য যারা প্রোগ্রামড। কি আর করা, সোলায়মান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাদের বললেন- ঠিক আছে! বলো তোমরা – কি প্রশ্নের জবাব চাও?
 

: বলো- তোমার রব কে?
: কি উদ্ভট প্রশ্ন? ‘রব’ বলতে আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছো তোমরা?
 

: ‘রব’ মানে হচ্ছে প্রভু, ‘রব’ মানে সৃষ্টিকর্তা, তোমার নিয়ন্ত্রা।
: আমার প্রভু আবার কে? আমরা দাস ব্যবস্থা, সামন্তীয় যুগ পার করে এখন আধুনিক গণতন্ত্রের যুগের মানুষ- এখানে প্রভুত্ব আর নেই। তবে শিল্প মালিকরা এখনো শ্রমদাসদের প্রভু হয়ে উঠে কখনো কখনো- কিন্তু শ্রমিকরা সেই দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙ্গার সংগ্রামও করে। আর আমি একজন শিক্ষক, ছাত্রদের পড়াই, ডিপার্টমেন্টের ডীনকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে কখনো কখনো বস বলেছি ঠিকই- কিন্তু তাদের সাথে আমার সম্পর্ক কখনোই প্রভু-দাসের ছিল না। সৃষ্টিকর্তা বিষয়টা বাজে ও কল্পনাপ্রসূত। আমার নিয়ন্ত্রণকারী আমি নিজেই- তবে সমাজ-সংস্কৃতি-শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবকে অস্বীকার করবো না। ফলে, এবার তোমরাই বলো- আমার কোন ‘রব’ থাকার দরকার আছে কি না? তোমাদেরই তেমন কোন ‘রব’ আছে কি?
 

: হ্যাঁ! আমাদেরও ‘রব’ আছে, প্রত্যেকেরই ‘রব’ থাকেই থাকে- তোমারো আছে- এবং তিনি একজনই- বলো তিনি কে? তাঁকে কি চেনো না?
: না! তোমরা সঠিক বললে না। তোমাদের হয়তো একজন প্রভু থাকতে পারে যিনি তোমাদের চাকর-বাকরের মতো খাটায়, তিনি তোমাদের নিয়ন্ত্রণকারীও হতে পারে; কিন্তু তিনিই যে তোমাদের সৃষ্টিকর্তা সে ব্যাপারে তোমরা কি নিশ্চিত?
 

: (একটু মাথা চুলকিয়ে) অবশ্যই নিশ্চিত।
: কিভাবে?
 

: তিনিই আমাদের বলেছেন।
: আরে বুদ্ধু, এটাকে বলে সার্কুলার লজিক। তোমরা কি দেখেছো যে তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন?
 

: (আবার মাথা চুলকিয়ে ও একে অপরের দিকে তাকিয়ে) উ- আ- হু – না …
: হুম, আরো ভালো করে চিন্তা করো। চিন্তা করতে শিখো, তবেই না মানুষ হবে। আর, আমার ক্ষেত্রেতো অন্য দুটোও খাটছে না। তোমরা যেমন এখানে এসেছো- তোমাদের সেই কথিত ‘রবে’র নির্দেশ মোতাবেক, কিন্তু আমি কার দাসত্ব করছি বলতে পারো? তোমাদের ‘রব’ তোমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতেই পারে, কিন্তু আমাকেও কি নিয়ন্ত্রণ করছেন? আমার নিয়ন্ত্রণকারী আমাকে কেন প্রশ্ন করার জন্য তোমাদের পাঠাবেন? আবার তোমাদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার স্বাধীনতা যদি আমার থাকে তবে কি তিনি আর নিয়ন্ত্রণকারী থাকতে পারেন? বলো তোমরা।

স্বর্গীয় দূত দুজনকেই একটু বিভ্রান্ত মনে হয়। তাদেরকে পাঠানো হয়েছে কয়েকটি প্রশ্ন করার জন্য, ফটাফট প্রশ্নের জবাব শুনে তারা ঈশ্বরের কাছে রিপোর্ট করবে; বরাবরই এমনটাই হয়েছে, সকলে জবাব দিয়েছে- কেউ ভুল আর কেউ সঠিক; কিন্তু এই আজব লোকটি তাদের উল্টো প্রশ্ন করছে এবং তারা ঠিক জবাব দিতে পারছে না। বুঝতেও পারছে না- কি করবে। একবার মনে হচ্ছে- পাল্টা প্রশ্ন করলেও লোকটি ঠিকই জবাব দিয়েছে- পরের প্রশ্ন করা দরকার, আরেকবার মনে হচ্ছে- ১ম প্রশ্ন নিয়ে যেহেতু লোকটি কিছু জানতে চাচ্ছে- সেহেতু পরের প্রশ্নে যাওয়া ঠিক হবে না, কেননা প্রশ্ন করেছে মানেই লোকটি তার আলোচনা বা জবাব শেষ করেনি। এ অবস্থায় কি করা যেতে পারে? ঈশ্বরের কাছে সাহায্যের জন্য চলে যাবে? তিন প্রশ্নের জবাব না নিয়েই? এটা ঠিক হবে? কি বিপদেই না পড়া গেলো! হতবুদ্ধি হয়ে তার ঠায় দাঁড়িয়েই থাকে।

শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরই তাদের সে অবস্থা থেকে রক্ষা করে। তিনজনকেই তলব করেন তিনি। সচরাচর এমনটা তিনি করেন না, কিন্তু এবারে দূতদ্বয়ের উপর তিনি ঠিক আস্থা রাখতে পারলেন না, তাছাড়া এটা ভাবলেন যে- এই লোকের সাথে সরাসরি কথা বলাই ভালো হবে। দূতদুটিকে শিখিয়ে পড়িয়ে আবার পাঠানো যেত, কিন্তু নতুন কি না কি প্রশ্ন করে বসে কে জানে! ফলে,সোলায়মান সাহেবকেই ডেকে পাঠান। সোলায়মান সাহেব ঈশ্বরের মুখোমুখি হন।

সপ্তম আসমানে উপস্থিত হওয়ার পরে এবং ঈশ্বরের মুখোমুখি হওয়ার আগে সোলায়মান সাহেব দুটো সমস্যা নিয়ে ভাবছিলেন, কি করে এত দ্রুতগতিতে মহাশূণ্যে চলে আসলেন, এবং মহাশূণ্যে কিভাবে তিনি স্থিরভাবে ভাসছেন, দ্বিতীয় সমস্যার সমাধানটাও প্রায় বের করে ফেলেছিলেন (সম্ভবত তার উপর ক্রিয়ারত আপেক্ষিক গ্রাভিটেশনাল ফোর্স জিরো), কিন্তু এবারো বেশীক্ষণ ভাববার সময় পেলেন না। ঈশ্বর তার সামনে এসে হাজির হলেন। প্রথম দর্শনে ঈশ্বরকে তার খারাপ লাগে না। চারদিক ধবধবে সাদা আলোয় ভরে গেলো, ঈশ্বরের চেহারার মধ্যেও শ্বেত-শুভ্র একটা ভাব আছে, আর সোলায়মান সাহেব আগে থেকেই সাদা রংটি খুব পছন্দ করতেন, ফলে ঈশ্বরকে দেখতে তার ভালোই লাগলো। ঈশ্বরের চোখ দুটোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন- উদ্ধত একটা ভাব থাকলেও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত মনে হলো, সোলায়মান সাহেব একটু খুশী হন- একজন বোকার চেয়ে বুদ্ধিমান কারো সাথে কথা বলা অনেক মজার, তা সে যে-ই হোক না কেন। ঈশ্বর গমগম কন্ঠে বলে উঠলেন: কি হে সোলায়মান!

এই সম্বোধনে সোলায়মান সাহেবের খুব একটা পছন্দ হলো না। ভদ্রলোক কি কার্টেসি জানে না? প্রথম সাক্ষাতে প্রথম কথাতেই এরকম নাম ধরে ডাকাডাকি! যাহোক, তিনি বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। তিনিও কথা শুরু করলেন। 

: জ্বি বলুন! অবশ্য আপনাকে ঠিক চিনলাম না। আপনার পরিচয়টা যদি প্রথমে দিতেন..
 

: হ্যাঁ! আমিই ‘রব’।
:
(পাশেই দূত দুজন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলো, তাদের দিকে তাকিয়ে) ওহ, এই দুজনের রব! ভালো। ওদের কিন্তু বুদ্ধির বিকাশটা ঠিকভাবে ঘটেনি।
 

: নাহ! (হুংকারের শব্দ) আমি সকলের রব! সবাই আমার বান্দা। সবকিছুই আমার হাতে সৃষ্ট। আমি সবকিছুর প্রভু, সবই আমার হুকুমের দাস!

হুংকার শুনে সোলায়মান সাহেব কিছুটা চমকে উঠেন। সামনা-সামনি দুজন কথা বলার সময় এমন চিৎকার করার কি দরকার তা ঠিক বুঝে আসেনা। ভোকাল কর্ডে সমস্যা, না কি সমস্যাটা মস্তিস্কে সেটা ভাবেন। দ্বিতীয়টির সম্ভাবনাকে অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়- শেষের প্রলাপগুলোর কথা মনে পড়ায়। একটু হাসিও পেয়ে যায়। যাহোক, সোলায়মান সাহেবকে নীরব থাকতে দেখে কিংবা ঠোটের কোণে হাসির ঝিলিক দেখে ঈশ্বর আবার গমগম করে বলে ওঠেন: 

: কি! এবার তো বিশ্বাস হচ্ছে যে, আমিই তোমার ‘রব’? আমিই ঈশ্বর?
: দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে নাস্তিক, ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না।
 

: কি? ঈশ্বরকে দেখেও তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে পারছো না? তুমি না দুনিয়ায় বলতে যে, ঈশ্বরকে বিশ্বাস করো না কারণ তুমি ঈশ্বর দেখোনি! আজ এই মুহুর্তে তোমার সামনে তোমার ঈশ্বর দন্ডায়মান- তুমি তোমার ঈশ্বরকে কেবল দেখছোই না, তার সাথে কথাও বলছো, তারপরেও বলছো যে, তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করো না! কোন যুক্তিতে তোমার ঈশ্বরকে অস্বীকার করছো?
: জনাব, রাগ করবেন না। যুক্তি আমার আছে। সেটা হচ্ছে প্রমাণের অভাব। দুনিয়াতে আমার জন্য আমি ঐ যুক্তি করতাম ঠিকই, কিন্তু সাথে এই যুক্তিও করতাম- যে দেখেছে বলে দাবী করছে, তাকে তার দেখার সঠিকতাও প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ, কেউ কেউ যখন দাবী করতো যে সে বা তারা ভূত যেহেতু দেখেছে, সেহেতু ভূত আছে, তাদের তখন বলতাম- তোমরা যেটাকে দেখে ভূত বলছো- সেটা কি আসলেই তোমাদের দাবীকৃত ভূত? আপনিই যে ঈশ্বর সে ব্যাপারে এখনো কোন প্রমাণ পাই নি আমি। দুঃখিত।
 

: প্রমাণ চাও? (আবার হুংকার) জানো! তোমাকে নিয়ে আমি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারি!

সোলায়মান সাহেব কিঞ্চিত ভয় পান। ইতিহাসে হিটলার-মুসোলিনির কথা পড়েছেন। অধুনা বিশ্বে জর্জ ডব্লিউ বুশকে মিডিয়ায় ভালোই প্রত্যক্ষ করেছেন। ঈশ্বর হিসাবে দাবী করা ভদ্রলোকটি দেখতে যতই শেত-শুভ্র হোক না কেন, এই মুহুর্তে তাকে এদের মতোই স্বেচ্ছাচারী একনায়ক মনে হয়। ক্ষমতাধরেরা এমন অমানুষ হয় কেন? ক্ষমতাই কি তবে সব নষ্টের গোড়া?


: জানি জনাব! আজ যেমন করেই হোক আমি আপনার কব্জায়, আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা করতে পারেন। যা ইচ্ছা করতে পারাটা কি ন্যায় সংগত? ঈশ্বরের ধারণা কি ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়? দুর্বলের উপর সবলেরা এমনটা সবসময় করেও থাকে। দুনিয়াতে আমরা গৃহপালিত পশপাখির সাথে যা ইচ্ছা করে থাকি। একসময় আফ্রিকা থেকে নিগ্রোদের ধরে এনে কৃতদাস বানানো হতো- তাদের সাথেও তাদের মালিকেরা যা ইচ্ছা করতে পারতো, আমাদেরকে গৃহপালিত পশুর ঈশ্বর বলবেন? দাসমালিকদের ঐসব কৃতদাসেদের ঈশ্বর বলবেন?
 

: আহ! বুঝতে পারছো না যে, আমি স্রষ্টা। আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি।
: হ্যাঁ আসলেই বুঝতে পারছি না। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন? কবে, কোথায়, কিভাবে? প্রমাণ দেন।
 

: আমি সৃষ্টি না করলে- তবে কে তোমাকে সৃষ্টি করেছে?
: কেন, আমার বাবা-মা’র মিলনেই আমার জন্ম।
 

: কিভাবে?
: বাবার কাছ থেকে এসেছে শুক্রাণু, আর মা’র আছে ডিম্বাণু- শুক্রাণু দ্বারা ডিম্বাণু নিষিক্ত হলে হয় জাইগোট বা ভ্রূণ, সেখান থেকে ….
 

: বাস বাস! হয়েছে হয়েছে! পুরা প্রসেস বলতে হবে না। আমাকে বলো- প্রতিটা ধাপ বা প্রসেস কিভাবে সম্পন্ন হলো?
: সব কিছুই প্রাকৃতিকভাবে।
 

: প্রাকৃতিকভাবে? তা-ও আমার কথা বলবে না? কেন?
: কারণ, প্রাকৃতিকভাবে যখন বলছি- সেটার একটা মানে আছে। প্রকৃতির অভ্যন্তরে সুস্পষ্ট কিছু নিয়ম আছে- এই নিয়ম মেনেই সব কিছু হয়। বিজ্ঞান এই নিয়মগুলোকেই খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। বিজ্ঞান ঐ ঈশ্বরকে মানে না- যে প্রকৃতির এই নিয়মগুলোকে তোয়াক্কা করে না। অর্থাৎ মানব ভ্রূণ তৈরী করতে চাইলে ঈশ্বরকে শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর নিষিক্তকরণের মধ্য দিয়েই যেতে হবে; আলু আর পটল মিলায়া হাজার চেষ্টা করলেও ঈশ্বর কেন- তারও ঈশ্বর- তারও ঈশ্বর- কোনদিন মানবভ্রূণ তৈরী করতে পারবে না। এখন কেউ যদি প্রাকৃতিক নিয়ম সমূহকেই ঈশ্বর বলে অভিহিত করতে চায়, বা প্রকৃতিক নিয়মের অধীন, অথর্ব, সীমাবদ্ধ ক্ষমতা ও সামর্থ্যের অধিকারী একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস আনয়ন করতে চায় তবে তেমন আপত্তি দেখি না; কিন্তু আমি ঈশ্বর শব্দটির চেয়ে ‘প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে’ বলতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো, কেননা ঈশ্বর শব্দের প্রচলিত অর্থের সাথে এর কোন মিলই নেই।
 

: দেখো- তোমার সাথে এত তর্ক করার কিছু নেই। তোমাকে তো বিশ্বাস করতে হবে যে এককালে তুমি ছিলে না- আমিই তোমাকে তোমার মায়ের পেটে জীবন দিয়েছি।
: কিভাবে বিশ্বাস করবো? আমার জন্ম পদ্ধতি তো আগে বলেইছি। বিজ্ঞান এটা প্রমাণ করেছে। আর জন্মের সময় আপনাকে আমি দেখিওনি যে আপনি আমাকে সৃষ্টি করছেন!
 

: কি আশ্চর্য! ঐ সময়ের স্মৃতি কারো থাকে না কি?
: ফলে যে সময়ের স্মৃতি থাকে না- সে সময়কে নিয়ে আলোচনাও অনর্থক। ধরেন- কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ের স্মৃতি আপনি হারিয়ে ফেললেন। এখন ঐ সময়ে আপনি এই করেছেন- সেই করেছেন এমন দাবী যদি আমি তুলি- তবে সেটা কি আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য থাকবেন?
 

: তাহলে তো আমি যে তোমাকে সৃষ্টি করেছি- সেটার প্রমাণ তোমার কখনো পাওয়া হবে না!
: সেই প্রমাণ পাওয়ার খুব দরকারো দেখি না!
 

: কিন্তু সবকিছুরই তো একটা শুরু আছে, মানে সৃষ্টি আছে। ফলে সৃষ্টিকর্তা থাকাটাই কি স্বাভাবিক নয়?
: না, বিষয়টা এমন নয়। সবকিছুর শুরু একসাথে নয় এবং শুরু বা সৃষ্টিগুলোও প্রাকৃতিকভাবে ও প্রকৃতির নিয়মানুসারেই। আর, আপনার যুক্তি মোতাবেক যদি ধরেও নিই যে- সবকিছুর সৃষ্টি আছে বিধায় সৃষ্টিকর্তাও আবশ্যক- তবে স্বভাবতই প্রশ্ন চলে আসে যে- আপনার তাহলে সৃষ্টিকর্তা কে, তার সৃষ্টিকর্তা কে, …। আপনি যদি অস্বীকার করতে চান- তবে বলবো, আপনার জন্মকালীন সময়কার স্মৃতিভ্রস্টতাই আপনাকে আপনার সৃষ্টিকর্তা থেকে অজ্ঞাতে রেখেছে!
 

: খামোস! (ভীষণ হুংকার)- তোমার এতো বড় আস্পর্ধা! সেই কখন থেকে মুখে মুখে তর্ক করছো! আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার সৃষ্টিকর্তার গল্প করছো! এত সাহস! তোমাকে আমি নরকের আগুনে পুড়াবো! পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দেবো! …. ইত্যাদি। (দূতদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে)- তোমরা এখুনি বের হও, খুঁজে খুঁজে বের করো দোযখের সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টদায়ক জায়গা- সেখানে আজ একে ঝুলাবো!

 

সোলায়মান সাহেব প্রথমে ভেবেছিলেন- দুতদ্বয়ের সামনে এইসব কথা বলায় ভদ্রলোক অপমানিত ও ক্ষিপ্ত হয়েছেন বলেই তাদের বের করে দিলেন। কিন্তু দূতদ্বয় চলে যাওয়ার পরেও যখন তিনি কিভাবে সোলায়মান সাহেবকে নরকে শাস্তি দিবেন- তা গমগম গলায় বর্ণনা করছেন, তখন তিনি একটু দমে গেলেন এবং অজানা বিপদের আশংকায় একটু কেঁপেও উঠলেন। শাস্তির ব্যাপারটা ভালো করে ঠিকঠাক করে দূতদ্বয় আসলে এবারে তিনি তাদের সোলায়মান সাহেবকে নিয়ে একটু স্বর্গ দেখিয়ে নিয়ে আসার হুকুম দিলেন।
 

দূতদ্বয়ের সাথে করে সোলায়মান সাহেব স্বর্গ দর্শনে বের হলেন। স্বর্গের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই একটা নির্মল শীতল বায়ুর পরশ, মনমাতানো এক সুবাস, সুরের মুর্ছনা সবমিলিয়ে সোলয়মান সাহেবের শুরুতে ভালোই লাগলো। তার উপর যখন তাকিয়ে দেখেন চারদিকে- তখন সবকিছুকে ছবির মত সাজানো একটা বাগান মনে হয়, খুব সুন্দর একটা বাগান। মোটের উপর প্রথমে স্বর্গ সোলায়মান সাহেবকে আকর্ষণ করেছিল, দুঃখ-কষ্টহীন জীবনের জন্য নয়, বরং নরুপদ্রব জীবনে চিন্তা করার ও গবেষণা করার প্রচুর সময় পাওয়া যাবে এই ভাবনায়। কিন্তু স্বর্গের আরেকটু ভেতরে গিয়ে, সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন যাপন দেখে- তার আগের সেই ভাব দূর হতেও সময় লাগে না! সুরা আর নারীতে মত্ত স্বর্গবাসীদের দেখে দুঃখ বোধ হলো। এটা কি কোন জীবন হলো? একেকজনকে অসংখ্য নারী পরিবেষ্টিত দেখে এই বেহিসেবী জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরী হয়। স্বর্গকে তার খুব অশ্লীল মনে হতে থাকে। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেলেন। তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। নাহ! এই জায়গায় বাস করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। দুনিয়াতেই তো কতো পাব-বার- কত সেক্স শপ ছিল, সেখানে যাবার প্রয়োজন কখনো হয়নি। তার গা-গুলিয়ে উঠে। কিছুদূর যেতে তিনি অবাক হয়ে দেখেন- কিছু স্বর্গবাসী কেমন যেন উদাস হয়ে বসে আছে, সুরার পাত্র অযত্নে পাশে পড়ে আছে- সুন্দরী নারীরা তাদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নানা ভাব-ভঙ্গী করছে, কিন্তু তারা ঠিক সেভাবে সাড়া দিচ্ছে না! অবাক হয়ে দূতদের জিজ্ঞেস করেন- ঘটনা কি? দূতরা বলে- ঘটনা কি ঠিক বলতে পারবো না, তবে এরা স্বর্গের পুরান বাসিন্দা, অনেকদিন ধরেই এরা এখানে আছে। সোলায়মান সাহেব মুহুর্তেই বুঝতে পারেন- কেন এরা এমন উদাসী ও বিষন্ন। অনন্ত সুখ বলে আসলে তো কিছুই থাকতে পারে না। এক বিখ্যাত কবিতায় তিনি পড়েছিলেন- অন্ধকার আছে বলেই না আলোর মাহাত্ম, সেই কথাটা অনেক বেশী অনুভব করতে পারলেন। এই লোকগুলোর জন্য তিনি অন্তরে একটা বেদনা বোধ করেন। স্বর্গ দেখার সাধ তার মিটে গিয়েছে, তিনি ফিরতে চান। দূতদ্বয়ের সাথে তিনি আবার ঈশ্বরের কাছে ফিরে আসেন।

 

নরকের সীমাহীন যন্ত্রণার কথা শুনে সেটায় যেতে ভয় পাচ্ছিলেন ঠিকই, একইসাথে স্বর্গকে চাক্ষুষ দেখেও যে অভিজ্ঞতা হলো- তাতে সেই জীবনে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারছেন না। সবদিক দিয়ে দুনিয়ার জীবনটাকেই অসাধারণ মনে হয়। তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী, ছোট ছোট দু সন্তান, বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, ছাত্র, বই-পত্র, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম, সেমিনার কক্ষ, গবেষণাগার, দুনিয়ার প্রকৃতি- গাছ-পালা, ফসলের মাঠ, নদী, পাহাড়, পশু পাখি … সবকিছুই তার কত না প্রিয়, সবকেই আজ যেন আরো বেশী অনুভব করতে থাকেন।

ঈশ্বরের গমগম কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ে।

: কি সোলায়মান! নরকবাসের জন্য প্রস্তুত তো?
: আমার প্রস্তুতিতে কি আর এসে যায়, বলেন!
: স্বর্গ কেমন দেখলে? লোভ হচ্ছে না? এখনও স্বীকার করো যে, আমিই ঈশ্বর! নরকে কিন্তু রয়েছে সীমাহীন যন্ত্রণা।
: দেখুন- ভয় বা লোভ দেখিয়ে ঈশ্বরের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা কি ন্যায় সংগত? আর, স্বর্গের জন্য কোন লোভ হচ্ছে না, বরং স্বর্গ ও নরক উভয়কেই ভয় পাচ্ছি।
: হা হা! তোমাকে তোমার কৃতকর্মের শাস্তি পেতেই হবে!
: শাস্তি? কোন অপরাধ করেছি যে, শাস্তি পেতে হবে?
: তুমি তোমার ঈশ্বরকে অস্বীকার করেছো!
: আপনি শাস্তি বা পুরষ্কৃত করেন কোন সময়কার কাজকে গণনায় নিয়ে? সামনা-সামনি কথাবার্তায় আপনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে শাস্তি দিতে চাচ্ছেন?
: নাহ! দুনিয়াতেও তুমি তোমার ঈশ্বরকে অস্বীকার করেছো!
: সেটা কোন অপরাধ হতে পারে না- ঈশ্বরে বিশ্বাস করার মতো কোন প্রমাণ ছিল না।
: কেন? তোমাদের জন্য আমি মহাগ্রন্থ পাঠাইনি?
: সেই গ্রন্থগুলো মানুষকেই লিখতে দেখেছি, মানুষের মুদ্রণযন্ত্রে ছাপানো হতে দেখেছি, কিন্তু কোন গ্রন্থকে কখনো কোন অশরীরীকে লেখতে দেখিনি, আকাশ থেকেও টুপ করে পড়তে দেখিনি। ফলে, কিভাবে বিশ্বাস করি যে- সেই গ্রন্থ ঈশ্বরের লেখা?
: এই বিশ্বাস করতে না পারাটাই তোমার অপরাধ, সে জন্যেই তোমার শাস্তি পেতে হবে।
: কিন্তু আমি দুনিয়ায় অনেক ভালো কাজ করেছি।
: তো?
: আমি গরীব-দুঃখীদের পাশে দাড়িয়েছি সবসময়। দুস্থদের জন্য একটা আশ্রম খুলেছি।
: তো?
: আমি সবসময় মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছি।
: তো?
: আমি প্রকৃতিপ্রেমী ছিলাম, প্রচুর গাছ লাগিয়েছি, যত্ন নিয়েছি- পশুপাখিও যাতে ভালো থাকে সে জন্য কাজ করে গিয়েছি।
: তো?
: আমি কোন অন্যায় করিনি। কারো ক্ষতি কখনো করিনি।
: তো?
: এসবের কোনটির জন্যই কি আমি পুরস্কৃত হতে পারিনা?
: তোমার ঈশ্বর, তোমার সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করায় সমস্ত কিছুই মূল্যহীন হয়ে গিয়েছে।
: মানি না তোমার এ আইন। এবারে আরো ভালো করে বুঝতে পারলাম যে, ঈশ্বর একটা অন্যায় প্রতিষ্ঠান, ন্যায়ের কোন স্থান এখানে নেই।
: কি! এত বড় কথা! এক্ষুনি তোমাকে নরকে পাঠাবো- আর তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছো?
: যেকোন পরিস্থিতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সৎসাহস আমার আছে। জেনে রাখো আমি মানুষ! মানুষই যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।
: হা! মানুষ! আমার সৃষ্ট পুঁচকে জীব কোথাকার! এত কথা না বলে আমাকে বলো- তুমি এখন কোথায়? তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে? কার সাথে কথা বলছো? কোন জগতে আছো? কিভাবে আছো? তোমার সাধের বিজ্ঞান এর কি ব্যাখ্যা দিবে? হা হা হা হা ….
: হাসবেন না, হাসবেন না! শুরুতে একটু কনফিউজড ছিলাম, কিন্তু এটাও জানতাম একটু চিন্তা করার ফুসরত পেলেই সব বের করতে পারবো। ফুসরতটাই ঠিক ভাবে পাচ্ছিলাম না বলে সবকিছু বের করতে এত সময় লাগলো। এখন আমি জানি এসব কিছুর ব্যাখ্যা।
: কি?
: সব কিছুই আমার উত্তপ্ত মস্তিস্কের কল্পনা! অর্থাৎ আপনার, আপনার এই জগতের, আপনাদের সৃষ্টি আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কে!
: কি ! এত সাহস! (তীব্র হুংকার) এই তোমাকে এখন নরকে নিক্ষেপ করছি।
: আরে ধুর! এক তুড়ি মেরে আপনারে আপনার নরক সমেত উধাও করে দিতে পারবো ..

 

 

এই কথার সাথে সাথে ঈশ্বর সোলায়মান সাহেবকে নরকে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলেন- সোলায়মান সাহেবও তুড়ি মারতে উদ্যত…। তারপর আবার সব অন্ধকার।

সোলায়মান সাহেব যখন চোখ খুললেন- তখন মুখে অক্সিজেন মাস্ক, নাকে নল, চোখের সামনে স্যালাইনের স্ট্যান্ড-নল, নানা মেডিক্যল ইকুয়েপমেন্টের ফাঁক দিয়ে আবছাভাবে প্রিয়তমা স্ত্রীর অশ্রুসজল মুখ দেখে দারুন প্রশান্তি বোধ করলেন। সন্তানদের মুখ দেখার জন্য মাথা ঘুরাতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। না পারলেও ঠিকই অনুভব করতে পারছিলেন- প্রাণপ্রিয় সন্তানেরা আশেপাশেই আছে। তিনি নিশ্চিত জানেন অসংখ্য উদ্বিগ্ন মুখ এই রুমের বাইরে অপেক্ষায় আছে। তার মনে হলো- পরকালের কল্পিত স্বর্গ-নরক উভয়ই আসলে নরক, আসল স্বর্গ তো দুনিয়ার মানুষের ভালোবাসা। নাহ! তাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে। মস্তিষ্ককে একটু বিশ্রাম দেয়া দরকার। পরম শান্তিতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

[ গল্পটি এই ইউটিউব  ভিডিও দেখার পরে, মাথায় আসে। প্রথম প্রকাশঃ মুক্তমনা ব্লগ। ]

রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০০৯

আধুনিক এটমিক তত্ত্বের জনক জন ডাল্টন, না কি স্বয়ং আল্লাহ?

 এক

কোরআনকে বিজ্ঞানময় করার আপ্রাণ চেস্টা মোল্লারা অব্যাহত রেখেছে। ফলে নানারকম দাবির কথাও কানে আসে। সেদিন সেরকমই এক মজার দাবির কথা চোখে পড়লো। কোরআনেই নাকি সেই ১৪০০ বছর আগেই পরমাণুর কথা বলা আছে!! কি সেই দাবি? আল কোরআনের ৩৪ নং সুরার ৩ নং আয়াতে নাকি আল্লাহ পরিস্কারভাবে পরমাণুর কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন যে- কোন কিছুই আল্লাহর অজ্ঞাত নয়।

তাহলে প্রথমে সুরা সাবা’র ৩ নং আয়াতটি দেখা যাক। ইউসুফ আলি, পিকথাল ও শাকির তিনজনের অনুবাদেই দেখা যায় “atom” শব্দটি বিদ্যমান:

034.003
YUSUFALI:
The Unbelievers say, “Never to us will come the Hour”: Say, “Nay! but most surely, by my Lord, it will come upon you;- by Him Who knows the unseen,- from Whom is not hidden the least little atom in the heavens or on earth: Nor is there anything less than that, or greater, but is in the Record Perspicuous:

PICKTHAL: Those who disbelieve say: The Hour will never come unto us. Say: Nay, by my Lord, but it is coming unto you surely. (He is) the Knower of the Unseen. Not an atom‘s weight, or less than that or greater, escapeth Him in the heavens or in the earth, but it is in a clear Record,

SHAKIR: And those who disbelieve say: The hour shall not come upon us. Say: Yea! by my Lord, the Knower of the unseen, it shall certainly come upon you; not the weight of an atom becomes absent from Him, in the heavens or in the earth, and neither less than that nor greater, but (all) is in a clear book.

অবাক হয়ে যাই। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে, কোরআনেই তো পরমাণুর কথা উল্লেখ আছে। একদম তাজ্জব ব্যাপার। আরবী কোন শব্দের অনুবাদ atom করা হয়েছে- তা জানার আগ্রবোধ করি। পুরা আয়াতটি হচ্ছে:

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُواْ لاَ تَأْتِينَا السَّاعَةُ قُلْ بَلَى وَرَبِّى لَتَأْتِيَنَّكُمْ عَـلِمِ الْغَيْبِ لاَ يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِى السَّمَـوَتِ وَلاَ فِى الاٌّرْضِ وَلاَ أَصْغَرُ مِن ذَلِكَ وَلاَ أَكْبَرُ إِلاَّ فِى كِتَـبٍ مُّبِينٍ

এখানে مِثْقَالُ ذَرَّةٍ এর অনুবাদ ধরা হয়েছে পরমাণু পরিমাণে। এই শব্দটি নিয়ে ঘাটাঘাটির আগে ভাবলাম আরো কিছু কোরআনের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। হাতের কাছে ডঃ মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান কর্তৃক অনুদিত কোরআন শরীফ ছিল- সেটাই হাতে নিলাম। সেখানে কোন পরমাণু অবশ্য পেলাম না। অনুবাদটি অনেকটা এরকম:

“কাফিররা বলেঃ আমাদের উপর কিয়ামত আসবে না। আপনি বলে দিন, কেন আসবে না? কসম আমার রবের! অবশ্যই তা তোমাদের উপর আসবে। তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। আসমানে ও যমীনে রেণু পরিমাণ বস্তুও তাঁর অগোচরে নয়, কিংবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্রও নেই এবং বৃহৎও নেই, কিন্তু এ সবই সুস্পষ্ট কিতাবে আছে।”

এখানে তো مِثْقَالُ ذَرَّةٍ এর অর্থ করা হয়েছে রেণু পরিমাণ। কি মুশকিল? একেক জায়গায় একেক রকম অনুবাদ! ফলে নিরূপায় হয়ে ইবনে কাথিরের শরণাপন্ন হলাম:

Those who disbelieve say: “The Hour will not come to us.” Say: “Yes, by my Lord, the All-Knower of the Unseen, it will come to you; not even the weight of a speck of dust or less than that or greater escapes His knowledge in the heavens or in the earth but it is in a Clear Book.”

ইবনে কাথিরও তো দেখি এটম ব্যবহার করেননি- করেছেন “বালিকণার সমান ওজনের”। এবারে কি করা যায়? খুঁজতে গিয়ে দেখি এই مِثْقَالُ ذَرَّةٍ শব্দটি কোরআণের সুরা যিলযাল (৯৯ নং) এর ৭ ও ৮ নং আয়াতেও আছে:

فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ
৭. অতঃপর কেউ অনু পরিমান সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে ।
وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
৮. এবং কেউ অনু পরিমান অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে ।

বাংলা অনুবাদে তো দেখি পরমাণুর বদলে এবার অণু! হায় হায়! তাহলে কি হুজুরেরা এবার দাবি জানাবে কোরআনে কেবল “পরমাণু” নয় “অণু”র কথাও আল্লাহ পাক সেই ১৪০০ বছর আগে জানিয়েছেন? কি মসিবতে পড়লাম! তাড়াতাড়ি করে আবার ইউসুফ আলি, পিকথাল ও শাকিরের অনুবাদ দেখি:

099.007
YUSUFALI:
Then shall anyone who has done an atom‘s weight of good, see it!
PICKTHAL: And whoso doeth good an atom‘s weight will see it then,
SHAKIR: So. he who has done an atom‘s weight of good shall see it

099.008
YUSUFALI:
And anyone who has done an atom‘s weight of evil, shall see it.
PICKTHAL: And whoso doeth ill an atom‘s weight will see it then.
SHAKIR: And he who has done an atom‘s weight of evil shall see it.

এবং দেখি- ইবনে কাথির কি অনুবাদ করেছেন:

7. So, whosoever does good equal to the weight of a speck of dust shall see it.

8. And whosoever does evil equal to the weight of a speck of dust shall see it.

ভালো মুশকিলেই পড়া গেল! অণু পরিমাণ, পরমাণু বা এটমের ওজনের সমান, রেণু পরিমাণ, ধুলিকণার সমান- কোনটা ঠিক? নাকি সবই? সবগুলো আয়াত ভালো করে পড়ার চেস্টা করলাম। পড়ে মনে হলো- সব অনুবাদই সঠিক। সবগুলোকে সঠিক অবশ্য কেবল তখনই বলা যাবে যখন مِثْقَالُ ذَرَّةٍ শব্দটিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বা সামান্য পরিমাণে এরকম অর্থে ধরা হবে। অর্থাৎ আয়াতসমূহে উল্লেখিত ‘পরমাণু’ বা ‘অণু’ পরিমাণ মানে পদার্থের গঠন উপাদান “অণু” বা “পরমাণু” নয়- বা ‘ধুলি কণা সম’ মানে রাস্তাঘাটের ধুলাবালিও নয়- এটা মানে একদম ক্ষুদ্র পরিমাণ। এভাবে ধরলে কোন সমস্যাই থাকে না। তাই ভাবলাম- দেখি অভিধানে مِثْقَالُ ذَرَّةٍ শব্দটির কি অর্থ করা হয়েছে? হাতের কাছে ছিল ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান এর “আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান” বইটা, সেখানে দেখলাম مِثْقَالُ শব্দের অর্থ করা হয়েছে: পরিমাণ বা ওজন, বাটখারা, সামান্য পরিমাণ, বিন্দুমাত্র, রত্তি। আর, ذَرَّة এর অর্থ করা হয়েছে- বিন্দু (ডট), অতি ক্ষুদ্র, শস্যদানা, ক্ষুদ্র কণিকা, বালি কণা। এবং এই ذَرَّة শব্দের অর্থ কখনো কখনো পরমাণুও করা হয়েছে বটে!

তারপরেও বলববো- সুরা সাবা আর সুরা যিলযাল এ مِثْقَالُ ذَرَّة এর ব্যবহারই বলে দেয় ব্যবহৃত অণু-পরমাণু কোনমতেই পদার্থের মৌলিক কণিকারূপী অণু-পরমাণু নয়।

 

দুই
তদুপরি তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে- সুরা সাবা’র ৩ নং আয়াতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুর কথাই বলা হয়েছে, তাহলেও কিছু কথা থেকে যায়:

১। আজকে আমরা জানি যে- পরমাণুও ক্ষুদ্রতম কণা নয়, একেও ভাঙ্গা যায়। আমি ভাবছি- একসময় مِثْقَالُ ذَرَّة কে “সামান্য পরিমাণে” বা “বিন্দুমাত্র” হিসাবে ধরা হতো, তারপরে ইবনে কাথির এর অর্থ করেছেন “ধুলি কণা সম”, তারপরে এসে করা হলো “অণু পরিমাণে” বা “পরমাণুর পরিমাণে”- এই ধারাবাহিকতায় তো অচিরেই কোরআনের কোন এক অনুবাদে দেখবো مِثْقَالُ ذَرَّة এর অর্থ করা হবে “ইলেকট্রন” বা “প্রোটন” বা ফোটন- পজিট্রন-এন্টি নিউট্রিনো .. ইত্যাদি।

২। খৃস্টের জন্মেরও কয়েকশো বছর আগে ভারতীয় ও গ্রীক দর্শনে এটম এর আবির্ভাব। গ্রীক দার্শনিক Leucippus, তার ছাত্র Democritus জানান – বস্তুজগৎ মাত্রই ক্ষুদ্রতম কণিকার সমন্বয়ে গঠিত এবং সবচেয়ে ক্ষুদ্র কণিকার নাম এটম বা পরমাণু বা অবিভাজ্য কণিকা। আমাদের ভারতীয় দর্শনেও জৈন, ন্যায় ও বৈশেষিকরাও অনুরূপ অবিভাজ্য ক্ষুদ্রতম কণিকার কথা বলেছিল (ন্যায় ও বৈশেষিকেরা যাকে পরমব্রহ্মা হিসাবে অভিহিত করেছিলেন)। আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে কেউ একথা বললে যতখানি অবাক হই- তারচেয়েও কি আজ থেকে ২৫০০ বছর আগে বললে বেশী অবাক হওয়া উচিৎ নয়?

৩। ডালটনের এটমিক থিউরির ৫ টি অনুসিদ্ধান্তের একটির সাথে সরাসরি মিলে গেলেও Leucippus, Democritus বা জৈন-ন্যায় ও বৈশেষিক দার্শনিকদের এটম আর ডালটনের এটমের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ফলে- আজকের পরমাণু আর প্রাচীণ গ্রীক বা ভারতীয় দর্শনের পরমাণু মোটেও একই নয়। দেকার্ত প্রথম মোলিকিউল শব্দটি ব্যবহার করলেও এটাও আজকের অণু থেকে যোজন যোজন দুরতম বিষয়। আর, কোরআনের পরমাণু তো- আজকের পরমাণুর সাথে দূরের কথা- গ্রীক-ভারতীয় দর্শনের পরমাণুর সাথে তুলনীয় হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।

 

তিন
ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান খোঁজাটা আজ যেন বাতিকে পরিণত হয়েছে। আগেও একটা পোস্টে (ধর্মে বিজ্ঞানঃ নিম গাছে আমের সন্ধান) এবিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। দেখছি- এ আলোচনা শেষ হবার নয়- কেননা মোল্লারা নিত্য নতুন আবিষ্কার করছে। সামনে হয়তো এরকম পোস্ট আরো লিখতে হবে। তবে, এ মুহুর্তে অতীতে এরকম কাজ আরেক ব্যক্তি করেছিলেন- তার কথা স্মরণ করেই আজকের এই পোস্টে শেষ করবো।

প্রথিতযশা বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা (অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের জনক হিসাবে বিবেচিত) একবার এক উকিলের সাথে কথা বলছিলেন, উকিল সাহেব মেঘনাদ সাহার গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নক্ষত্রের উপাদান ও নানা বিষয়ে বুঝাতে বসলেন। এক পর্যায়ে সেই উকিল সাহেব বলেই ফেললেন, ” এ আর নতুন কি- এসবই তো বেদে আছে”। সাহা আপত্তি জানিয়ে বলেন, “অনুগ্রহ করে বলবেন কি- বেদের কোন জায়গাটিতে নক্ষত্রের আয়নীভবনের তথ্যটি আছে?” ভদ্রলোক অবলীলায় জবাব দেন, “আসলে আমার বেদ পড়া হয়নি, তবে আমার বিশ্বাস বেদে সমস্তই আছে”। এ ঘটনার পরে মেঘনাদ সাহা ২০ বছর ধরে বেদ, উপনিষদ, হিন্দু জ্যোতিষ আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলেন। তারপরে লিখেন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ “সবই ব্যাদে আছে”

এতে তিনি লিখেন:

” ….. বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্রগ্রন্থ এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীণ গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীণ গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। …..”
” … বর্তমান লেখক বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হিন্দুর বেদ ও অপরাপর ধর্মের মূলতত্ত্ব বুঝিতে চেস্টা করিয়াছেন। ইহাতে অবজ্ঞা বা অবহেলার কথা উঠিতে পারে না। তাঁহার বিশ্বাস যে, প্রাচীণ ধর্মগ্রন্থসমূহ যে সমস্ত জাগতিক তথ্য, ঐতিহাসিক জ্ঞান ও মানবচরিত্রের অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত , তাহাদের উপর বর্তমান যুগের উপযোগী জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। ….”

মেঘনাদ সাহা প্রাচীণ ভারতীয় জ্যোতিষ (যাকে হিন্দু জ্যোতিষ আখ্যা দিয়ে ধর্মের শ্রেষ্টত্ব খুঁজে পায় একদল পুরোহিত শ্রেণীর লোকেরা) নিয়েও কথা বলেছেন:

” … এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন আর নতুন কি করিয়াছে? কিন্তু এ সমস্ত ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্কারাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন না। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণ কক্ষ নিরূপন করা যায়। সুতরাং, ভাস্করাচার্য বা কোনো হিন্দু, গ্রিক বা আরবীয় পণ্ডিত কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছুই নয়। ….”

 

চার
আজকের বিজ্ঞান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোন আবিষ্কার বা কোন জ্ঞানের কাছাকাছি কিছূ বা অংশত কিছু সরাসরি বা ঘুরিয়ে পেচিয়ে যদি কোন ধর্মগ্রন্থে মিলেও যায়- তারপরেও তাকে আজকের বিজ্ঞানের সাথে মেলানো যাবে না, কারণ বিজ্ঞান হতে গেলে একটা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি লাগে। কেন ধর্মগ্রন্থের ঐ সব মিলকে বিজ্ঞান বলা যাবে না- তা আশা করি মেঘনাদ সাহা’র উপরের আলোচনা থেকেই পরিষ্কার হয়েছে!

আর, এত কিছুর পরেও যদি পরিষ্কার না হয়- আমার আর কিছুই করার নেই। চোখের ঠুলি যদি কেউ সরাতে না চায় – অন্যের কি সাধ্য?

শনিবার, ২১ নভেম্বর, ২০০৯

কোরআন ও নারী এবং একজন জাকির নায়েক

মাঝে মধ্যেই “কোরআন ও নারী”, “ইসলামে নারী” বা “কোরআনের আলোকে নারী” প্রভৃতি শিরোনামের নানা পোস্ট দেখা যায়- যেখানে বিভিন্নভাবে প্রমান করার চেস্টা করা হয় যে, ইসলাম নারীকে ব্যাপক মর্যাদা দেয়, কোরআনে নারীর মর্যাদা অনেক উচ্চে- যেনবা ইসলামের মাধ্যমেই নারীর সমস্ত অধিকার আদায় সম্ভব। বলাই বাহুল্য এগুলোর সবই নানাবিধ মিথ্যায় সাজানো। সবচেয়ে বেশী আপত্তিকর হচ্ছে- মাঝে মধ্যে এমনসব বিষয়ের পক্ষে যুক্তি হাজির করা হয় যেগুলো ইতিমধ্যেই আমাদের সমাজব্যবস্থায়- আমাদের সংস্কৃতিতে পরিত্যজ্য বলে পরিগনিত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পোস্টের কমেন্টে কথা বলেছি-আরো অনেকেই অনেক কিছু বলেছেন, চমৎকার সব যুক্তি করেছেন- কিন্তু জাকের নায়েকদের শিষ্যদের কোন লাজ-লজ্জার বালাই নেই, একই কাসুন্দি তারা বারেবারে ঘুরেফিরে বাজাতেই থাকে, বাজাতেই থাকে। আজকের পোস্টে সেগুলো নিয়েই কথা বলবো।

 

জাকির নায়েকরা কি বলছেন?

আজ সুস্থ বুদ্ধি ও বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই ইসলামের যে বিষয়গুলো নিয়ে দ্বন্দ্বে থাকে, প্রশ্ন উত্থাপন করে- আপত্তি করে, সেগুলো নিয়ে জাকির নায়েকরা এক ধরণের যুক্তি করার চেস্টা করছে, আর জাকির নায়েকদের এই ব্যাখ্যায় বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক- কাঠমোল্লারা দারুন উচ্ছসিত, পায়ের নীচে মাটি পাওয়ার মতই তাদের অবস্থা। আর, তাই জাকির নায়েকরা খুব জোরেশোরে “ইসলাম নিয়ে অমুসলিমদের জিজ্ঞাসার জবাবে”, বা “কোরআন নিয়ে বিভ্রান্তির জবাবে” বা “কোরআন ও বিজ্ঞান” – এমন নানা শিরোনামে তারা বক্তব্য হাজির করছে। অন্য বিষয়গুলো আজ আপাতত আনছি না- শুরুতে ইসলাম ও নারী বিষয়ক আলোচনায় দৃষ্টি দেয়া যাক। এই লেখাটিতে মুহম্মদ সা কে কেন্দ্র করে কোন আলোচনা করছি না কারণ আগেই সেটা যথেস্ট করেছি- যারা এখনও পড়েননি তারা এখানেএখানে ক্লিক করতে পারেন।

 

প্রথমে জাকির নায়েকদের দ্বারা জবাব দেয়া ইসলাম সম্পর্কিত ‘অমুসলিম’দের (মানে যারাই প্রশ্ন তুলবে- তারাই অমুসলিম!) প্রধান তিনটি প্রশ্ন দেখা যাক:

১। “মুসলমান পুরুষদের একাধিক বিবাহের অনুমতি দেয়া হয়েছে কেন?”
২। “পুরুষদের একাধিক বিয়ের অনুমতি থাকলেও নারীদের নেই কেন?”
৩। “নারীদের বোরকার আড়ালে রেখে অবমাননা করা হয় কেন?”

প্রশ্ন তিনটিই খুবই যৌক্তিক এবং প্রত্যাশিত। এসবের জবাবাএ জাকির নায়েক গং কি বলছে সেটা দেখি। এর বাইরেও আরো কিছু প্রশ্নকে মোল্লারা “কাফিরদের অভিযোগ” হিসাবে উত্থাপন করে কিভাবে জবাব দেয়ার চেস্টা করে সেগুলোও একে একে আলোচনা করবো। সাথে সাথে এদের করা যুক্তিগুলোও খণ্ডন করার চেস্টা করবো।

 

১। “মুসলমান পুরুষদের একাধিক বিবাহের অনুমতি দেয়া হয়েছে কেন?”
জাকির নায়েকের “Answers to the Non-Muslims Common Questions about Islam” গ্রন্থে অমুসলিমদের করা নানা প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। সরাসরি জাকির নায়েকের মুখ থেকে এগুলো শুনতে ও দেখতে ইউটিউবে যেতে পারেন।
জাকির নায়েক: এক

জাকির নায়েক: দুই

কি সেই জবাব- কি সেই যুক্তি? এবারে সেটাই তাহলে সংক্ষেপে দেখা যাক:

“পৃথিবীতে কোরআনই একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যেখানে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র একটি বিয়েই করা উচিত”– ঠিক এমনটি বলেই জাকির নায়েকদের যুক্তির শুরু। যেন বা নৈতিকতার বিচার অন্যসব ধর্মের সাথে তুলনা করেই হয়! মোল্লাদের খুব গর্বের সাথে গল্প করতে শুনা যায়- “বাকী সকল ধর্মগ্রন্থে (রামায়ন, গীতা, বাইবেল…) ইচ্ছেমত বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে, পুরোহিতরা মিলে একবিবাহ নিয়ম চালু করেন। কিন্তু তাদের ধর্মগ্রন্থতে এব্যাপারে কোন নির্দেশনা নেই। .. ১৯৫০ সালেও ইহুদীদের মধ্যে বহুবিবাহের প্রথা চালু ছিল। তারপর ইহুদী নেতারা এই প্রথা বন্ধ করেন।…. ১৯৫৪ সালে হিন্দু বিবাহ আইনে একবিবাহ প্রথা চালু হয়”। 

কথায় আছে- ভেড়ার পালে বাছুর পরমানিক, এ যেন গোবরের সাথে তুলনা করে হাঁস-মুরগীর বিষ্ঠাকে কম দুর্গন্ধময় বলে ঘোষণা দেয়া! কিন্তু এরা যে বুঝতেও পারে না - ধর্মগ্রন্থে না থাকার পরেও যুগপ্রয়োজনে- সময়ের পরিবর্তনে ধর্মীয় প্রথাকে পাল্টিয়ে দেয়া যে কত মহৎ, কত বৈপ্লবিক!

যাহোক- একদম শুরুর যে দাবি- সেটা জাকির নায়েকরা কিসের ভিত্তিতে বলছে?
কোরআনে বলা হয়েছে:

“মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও, দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত। তবে যদি আশঙ্কা হয় যে, তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরন করতে পারবে না তবে শুধুমাত্র একটি।” আল কোরআন (৪:৩)।

এবং:

“তোমরা চাইলেও নারীদের মাঝে ন্যায়বিচার করতে পারবে না…।” আল কোরআন (৪:১২৯)।

সুরা নিসার ৩ নং আয়াত এবং ১২৯ নং আয়াতের প্রথম বাক্যকে পাশাপাশি রেখে এরা এমনই ধারণা তৈরি করতে চায় যে- কোরআন অনুযায়ি- চারটি পর্যন্ত বিয়ার অনুমতি থাকলেও তার ক্ষেত্রে শর্ত প্রযোজ্য এবং মূল শর্তটি হচ্ছে স্ত্রীদের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে হবে এবং ন্যায়বিচার করতে না পারার আশংকামাত্র থাকলেই শুধুমাত্র একটা বিয়ে করতে হবে (৪:৩) এবং স্পষ্টতই আল্লাহ জানিয়ে দিচ্ছেন- চাইলেও নারীদের মধ্যে ন্যায়বিচার করা সম্ভব না (৪:১২৯)- সেহেতু চুড়ান্ত বিচারে দাঁড়াচ্ছে- কোরআনে একটি বিয়ের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। জাকির নায়েকের এই যুক্তিটুকু পড়লে বা শুনলে মনে হয় বাহ কি সুন্দর, ভালোই তো! কিন্তু জাকির নায়েক সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকায় জানি যে, এই লোক নিজের যুক্তি সাজাতে মিথ্যাচার করতে, কোরআনের আয়াত নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করে সুকৌশলে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করতে- এমনকি মাঝে মধ্যে কোরআনের আয়াত-শব্দের প্রচলিত অর্থ পাল্টে ফেলতে সিদ্ধহস্ত। তাই সুরা নিসার ৩ নং ও ১২৯ নং আয়াত দুটি একটু যাচাই করার চেস্টা করি। ১২৯ নং আয়াতটি পুরো পড়লেই বুঝা যাবে:

And you will never be able to be equal [in feeling] between wives, even if you should strive [to do so]. So do not incline completely [toward one] and leave another hanging. And if you amend [your affairs] and fear Allah – then indeed, Allah is ever Forgiving and Merciful.

অর্থাৎ, “তোমরা চাইলেও নারীদের মাঝে ন্যায়বিচার করতে পারবে না”- এটা বলার পরপরেই যখন আল্লাহ মুমিন বান্দাদের উদ্দেশ্যে আহবান জানায়- “সুতরাং তোমরা কোন একজনের প্রতি সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়ো না ও অন্যজনকে ত্যাগ করো না”- তখন কি বলা যায়, জাকির নায়েক এর টানা সিদ্ধান্তটা খোদ আল্লাহর টানা সিদ্ধান্তর অনুরূপ? একটা ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স করেছিলাম- সেখানে আইজেনস্টাইনের মনতাজ সম্পর্কে কিছু লেকচার দেয়া হয়েছিল। বিষয়টা অনেকটা এরকম। (আমার উদাহরণে বলছি)- ধরেন বারাক ওবামার একটা ৫ সেকেন্ডের শট – যেখানে ওবামা খুব উৎফুল্ল- দারুন হাসিখুশী- হাত তালি দিচ্ছেন। এডিটিং প্যানেলে এই শটের আগে আরেকটি শট যেখানে দেখা যায় ইরাকে বোমা ফেলা হচ্ছে- সেটা যুক্ত করে দিলে একরকম অর্থ তৈরি হয়, আবার পূর্ববর্তী শটে যদি নির্বাচনে জেতার নিউজ দেখানো হয় তবে আরেক অর্থ, পূর্ববর্তী শটে মিশেল ওবামাকে দেখালে একরকম অর্থ- আর হিলারি ক্লিনটনকে দেখালে আরেক রকম ইমপ্রেশন তৈরি হয়। সুরা নিসার দুই জায়গার দুটি আয়াতকে পাশাপাশি বসিয়ে একরকমের ইমপ্রেশন তৈরি চেস্টা দেখে মনে হলো- জাকির নায়েক ফিল্ম ডিরেকটর হলে খুব ভালো করতেন।

যাহোক, মোল্লাদের আরেকটি যুক্তি খুব জোরের সাথে করতে দেখা যায়- সেটা হলো: একের অধিক বিয়ে (চারটি পর্যন্ত) বিয়ে তো ফরজ না, সুন্নতও না, ওয়াজিব না, মুস্তাহাবও না। এটা কেবলমাত্র মুবাহ, মানে করলেও হয়- না করলেও হয়, একে কখনো উৎসাহিত করা হয়নি। অনেকে রেগে গিয়ে বলেই বসে- “আপনাকে তো বহুবিবাহ করতে বাধ্য করছে না- আপনার করতে ইচ্ছা না হলে করবেন না”। অবাক হয়ে ভাবি- এরা কি আপত্তির জায়গাটাই ধরতে পারছে না? বহুবিবাহ কেন নিষিদ্ধ নয়? কেন এটা একজন পুরুষের মর্জির উপর ছেড়ে দেয়া হলো? যে বহুবিবাহ করতে চায় না তাকে বাধ্য করা হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু মূল প্রশ্নতো- যে কামুক ব্যক্তি একের পর এক বিয়ে করে যেতে চায়- তার জন্য কি কোন বাধ্যবাধকতা রাখতে পেরেছে কোরআন?

না পারেনি। তবে কেন বাধ্যবাধকতা রাখেনি সেটার একটা বৈজ্ঞানিক কারণ হাজির করেছে জাকির নায়েকরা। বড়ই অভিনব সে কারণ। সেটাই তাহলে শুনি:

“সাধারনত নারীশিশু ও পুরুষশিশু সমান অনুপাতে জন্মায়। তবে নারীশিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বিধায়, তুলনামূলক নারীশিশু বেশি বাঁচে। এছাড়াও যুদ্ধ-বিগ্রহে, নারীর তুলনায় পুরুষের মৃত্যুর হার বেশি। দুর্ঘটনা ও রোগে, পুরুষদের মৃত্যুর হার বেশি। এটা স্বীকৃত যে, পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশিদিন বাঁচে। এসব কারনে, যেকোন নির্দিষ্ট সময়ে জরিপ করলে দেখা যায়, বিপত্নীকদের চেয়ে বিধবার সংখ্যা বেশি।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ৭৮ লক্ষ বেশি। শুধুমাত্র নিউইয়র্কে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা ১০ লক্ষ বেশি। নিউইয়র্কে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ নারী। যুক্তরাষ্ট্রে ২ কোটি ৫০ লক্ষ পুরুষ সমকামী (নারীদের বিয়ে করতে উৎসাহী নয়)। কাজেই, যদি একজন পুরুষ একজন নারীকে বিয়ে করে তাহলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ৩ কোটি নারী সঙ্গীহীন থেকে যাবে। একইভাবে যুক্তরাজ্যে ৪০ লক্ষাধিক, জার্মানীতে ৫০ লক্ষাধিক, রাশিয়ায় ৯০ লক্ষাধিক নারী সঙ্গীহীন থাকবে। ধরা যাক, আমার বোন যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গীহীন অবস্থায় আছে অথবা ধরুন আপনার বোন যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গীহীন রয়েছে। তাহলে, তার সামনে ২টি পথ খোলা আছে।

১. বিবাহিত কোন পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে মেনে নিতে হবে।
২. ‘জনগণের সম্পত্তি (public property) হতে হবে।”

এই যুক্তি অভিনব তো বটেই, তারচেয়ে বেশি এটা অশ্লীল। সঙ্গীহীন থাকলে আমার বোনের সামনে দুটো পথই খোলা থাকবে? বিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করতেই হবে, নচেত প্রোস্টিটিউশনে নামতেই হবে? এই যুক্তির পক্ষে বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলা হচ্ছে:

“এটা ঠিক যে, অধিকাংশ নারীই স্বামীকে শুধু নিজের বলেই প্রত্যাশা করেন। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে এই ক্ষুদ্র প্রত্যাশা ত্যাগ করা শ্রেয়”।
অবাক লাগে- কতখানি পারভার্ট হলে এমন কথা লোকে বলতে পারে! নারীদের এরা কি চোখে দেখে? আর জাকির নায়েক যে তথ্য-উপাত্ত দিয়েছে সেখানেও একটা বড় রকমের ফাঁক আছে। সেটাই এবারে দেখি:
 

জাকির নায়েকের তথ্যমতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানী, রাশিয়ায় পুরুষের চেয়ে নারীর মোট সংখ্যা বেশি। ঠিক আছে। কিন্তু গোটা দুনিয়ায় নারী-পুরুষ এর অনুপাতটা কেমন? এই অনুপাত- ১:১.০৫, মানে পুরুষের সংখ্যাই বেশী।
 

এবারে আসুন বয়সের হিসেবে দেখি-
নারী:পুরুষ-
জন্মের সময়- ১:১.০৫
১৫ বছরের নিচে- ১:১.০৫
১৫-৬৪ বছর- ১:১.০২
৬৫ কিংবা তদুর্ধ- ১:০.৭৮
 

কাজেই দেখা যাচ্ছে এই যুক্তি তখনই খাটে যখন নবীন পুরুষ অতি প্রবীণ নারীদের বহুবিবাহ করে!!!!
 

এবার, জাকির নায়েকদের উল্লেখ করা যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৩৪,৭৭৪,৮৯৪ জন পুরুষ এবং ১৪০,৭৮৭,৭৭৯ জন নারী।
অর্থাৎ ৬ মিলিয়নের মত নারী বেশি। এদের মধ্যে ৫.৯ মিলিয়নই কিন্তু ৬৫ বছরের উর্ধে!!
 

সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ১৮ থেকে ৬৪ বছর পর্যন্ত নারী পুরুষের অনুপাত প্রায় সমান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষেরা মোটামুটি ১৮-৪০/৪৫ বছর বয়সে তাদের প্রথম বিয়ে করে থাকে বলেই জানি। সেক্ষেত্রে এক পুরুষ এক নারী বিয়ে করলে অনেক নারীকে বিয়ে করার মত পুরুষ পাওয়া যাবে না বলে যে দাবী করা হচ্ছে তা অবান্তর।

আর, ৬৫ উর্ধ নারীদের সংখ্যা বেশী। সেক্ষেত্রে দুটো বিষয় হতে পারে। এক: এরা বিবাহিত কিন্তু স্বামী মারা গিয়েছে অর্থাৎ এরা বিধবা; অথবা এরা ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত কোন কোন কারণে বিয়ে করেনি।

এই অংশটুকু যদি স্বামীর ঘর করতে চায় তবে পুরুষ পেতে সমস্যা হতে পারে। বিধবাদের ক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়ই দেখা যায় সন্তান-সন্ততি, নাতিপুতি নিয়েই এমন ব্যস্ত এবং সামাজিক অবস্থা এমনই যে বিয়ে করা হয় না, বা বিয়ে করার চিন্তাই মাথাতে আসে না। কেননা, মেনোপেজের পরে শারীরিক চাহিদাটাও সেরকম থাকে না, ফলে সঙ্গী শুধু মানসিক সঙ্গের জন্যই প্রয়োজন হতে পারে, সেটা সামাজিক পরিমণ্ডলই পূরণ করতে পারে। আর যাই হোক পোস্টদাতার কথা মত অন্য বউ আছে এমন লোককে ৬৫ বছরের এক বুড়ি বিয়ে করতে না যাওয়ারই কথা, আর পাবলিক সম্পত্তিতে পরিণত হওয়াটা তো শুধুই পাগলের প্রলাপ। আর ৬৫ বছর পর্যন্ত বিয়ে না করে থাকলে, ৬৫ বছর পার হওয়ার পরে বিয়ে করার জন্য উতলা হবে এমন সম্ভাবনাও কম দেখি। আর যদি ৬৫ বছরে এসে বিয়ে করতে মনস্থির করে শেষে পাত্র যদি নাই পাওয়া যায়, তবে সেটাও মনে হয় সেই নারী মেনেই নিবেন। পাবলিক সম্পত্তিতে পরিণত হওয়া বা সতীনের ঘরে প্রবেশ করার সম্ভাবনা পোস্টদাতার মত কিছু ধর্মান্ধের প্রভাবপুষ্ট নারী আত্মীয় স্বজনেরা ব্যতিত কমই দেখি।

এবারে আসুন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেখানে বহুবিবাহের হার অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি সেগুলোর নারী-পুরুষের অনুপাত দেখি-
নারী : পুরুষ-
বাহরাইন- ১ : ১.৩
জর্দান- ১ : ১.১
কুয়েত- ১ : ১.৫
ওমান- ১ : ১.৩১
কাতার- ১ : ১.৯৩
সৌদি আরব- ১ : ১.২৪
আরব আমিরাত- ১ : ১.৫১
(২০০০ সাল পর্যন্ত) (সূত্র: উইকিপিডিয়া এবং সি আই এ ফ্যাক্ট বুক)
 

উপর থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে এরা কেউই নারীর আধিক্যের কারণে বহুবিবাহ করেনা। এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে এই নারীদের অনেকেই ৬৫ বছরের উর্ধে, কাজেই বিবাহযোগ্য নারীর সংখ্যা কিন্তু আরো কমে যাচ্ছে!!

অনেককে আবার এমনও যুক্তি করতে শুনা যায়:  

“বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বহু বিবাহ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সে প্রয়োজনকে সামনে রেখেই ইসলাম বহু বিবাহের অনুমোদন দান করেছে। এখন আসুন আমরা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি বহু বিবাহের সেই বিশেষ প্রয়োজনীয় দিক গুলি কি কি? (১) কেউ তার বংশের ধারা অব্যাহত রাখতে ইচ্ছুক; কিন্তু তার বর্তমান স্ত্রী সন্তান ধারণে অক্ষম। এ ক্ষেত্রে পুরুষ বর্তমান স্ত্রীকে সাথে রেখে আরেকটি বিয়ে করতে পারেন। (২) বর্তমান স্ত্রী স্বামীর যৌন চাহিদা মিটাতে অক্ষম হলে (৩) কোন কোন মানুষের যৌন শক্তি খুব প্রবল ও প্রচন্ড হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তার একাধিক বিয়ের প্রয়োজন হতে পারে। (৪) যুদ্ধ বিগ্রহ-মহামারী- ‍দুর্ঘটনা ইত্যাদির কারণে কোন দেশে পুরুষের সংখ্যা সাংঘাতিক ভাবে হ্রাস পেলে মহিলাদের সার্থেই বহু বিবাহ প্রয়োজন হতে পারে। উপরোক্ত ক্ষেত্রে সমাজ এবং মহিলাদের উচিৎ সহেযোগীতা করা”।

এই সমস্ত যুক্তিকে মানতে হলে- আরো কিছু প্রশ্ন চলে আসে- জাকির নায়েকরা সেসবের জবাব কেমন করে দিবেন?


# এই সমস্ত ঘটনা কোন নারীর সাথে হলে , মানে ১) কেউ তার বংশের ধারা অব্যাহত রাখতে ইচ্ছুক; কিন্তু তার বর্তমান স্বামী সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হলে, (২) বর্তমান স্বামী স্ত্রীর যৌন চাহিদা মিটাতে অক্ষম হলে (৩) কোন কোন স্ত্রীর যৌন শক্তি খুব প্রবল ও প্রচন্ড হলে (৪) কোন কারণে কোন দেশে নারীর সংখ্যা সাংঘাতিক ভাবে হ্রাস পেলে —— তখন কি নারীর বহু স্বামী জায়েজ হবে?
 

# যদি লিঙ্গনির্দিষ্ট গর্ভপাত নাও করা হয়, জীববৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুসারেই একটি জনগোষ্ঠীতে জন্মগ্রহণের ক্ষেত্রে মেয়ে শিশুর অনুপাতের থেকে ছেলে শিশুর অনুপাত বেশি থাকে (জার্মানিতে ৯৪:১০০)। কিন্তু সমান সুযোগ-সুবিধা পেলে বিভিন্ন বয়স-বর্গে মেয়েদের থেকে ছেলেদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি হওয়ার ফলে মোট জনসংখ্যায় নারীর আধিক্য দেখা যায়। বাংলাদেশে লিঙ্গনির্দিষ্ট গর্ভপাত ধর্তব্যের মধ্যে না হলেও, খাদ্য, পুষ্টি, চিকিৎসা পরিষেবা ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকায় পুরুষের আধিক্য (১০৬:১০০) রয়েছে। আপনাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা (!) অনুযায়ী এখানে প্রায় ৩০ লক্ষ পুরুষ অবিবাহিত থেকে যাবে। তাদের জন্য সমাধান কি?
 

# যুক্তরাষ্ট্রের সমকামী পুরুষদের হিসাবের পাশে সমকামী নারীর হিসাবকে কেনো গোপন রাখা হলো?
 

# পাশ্চাত্যে যেমন অনেক পুরুষ বিবাহের বাইরে সম্পর্ক বজায় রাখে, অনেক নারীও নিশ্চয়ই রাখে। এই প্রসঙ্গ কতটা প্রাসঙ্গিক?

২। পুরুষদের একাধিক বিয়ের অনুমতি থাকলেও নারীদের নেই কেন?
জাকির নায়েকের কাছ থেকে শুনতে ইউটিউবে যান।
জাকির নায়েক: তিন

সুরা নিসায় (৪:২২-২৪) এমন নারীদের তালিকা দেয়া আছে যাদের মুসলমান পুরুষ বিয়ে করতে পারে না। সেখানে বিবাহিত নারীদের কথাও বলা আছে। অর্থ্যাৎ, বিবাহিত নারীদের বিয়ে করা মুসলমান পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধ। নারীদের বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার জন্য কারণ হিসাবে জাকির নায়েকরা যেসব যুক্তি হাজির করেছেন সেগুলো হচ্ছেঃ

১) “একজন পুরুষ যদি একাধিক বিয়ে করে তাহলে সহজেই তার সন্তানের পরিচয় পাওয়া যায়। অর্থ্যাৎ, আলাদাভাবে সেই সন্তানের পিতা-মাতা সনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু যদি একজন নারী যদি একাধিক বিয়ে করে তাহলে জাত সন্তানের পিতার পরিচয় নিয়ে সংশয় হতে পারে। ইসলামে মাতা-পিতা উভয়েরই সণাক্তকরণের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, যে সন্তান তার মাতা-পিতা এবং বিশেষত পিতার পরিচয় জানে না তারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জীবনের প্রতি পদক্ষেপেই সন্তানের তার পিতার নামের প্রয়োজন হবে। সেক্ষেত্রে সেই সন্তানের পিতার নাম কি একাধিক হবে? যদিও আমরা জানি যে, বর্তমানে বিজ্ঞান যথেষ্টই উন্নতি সাধন করেছে এবং আজকাল নিভূলভাবে পিতা-মাতার সণাক্তকরন সম্ভব। সেক্ষেত্রে হয়তো বিষয়টি বর্তমানের জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্তু এই প্রযুক্তি এই তো সেদিনের, আর ইসলাম সবসময়ের ধর্ম- কিছুদিন আগেও এতা সনাক্ত করা সম্ভব ছিল না।”

২) “প্রকৃতিগতভাবেই বহুবিবাহের ক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে পুরুষেরা বেশি আগ্রহী। পুরুষ স্বভাবতই বহুগামী। একইকারনে, একজন পুরুষ একের অধিক স্ত্রীর প্রয়োজন পূরণে সক্ষম। কিন্তু একজন নারী সাধারনত এই সক্ষমতার অধিকারী নয়”।

৩) “আলাদা আলাদা পুরুষের প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে একজন নারী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে। শারীরিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। শারীরিক প্রয়োজন মেটানোর তাগিদ নারীর চেয়ে পুরুষের বেশি”।

৪) “যদি নারীর একাধিক স্বামী থাকে তবে দেখা যাবে, একই সময়ে তাকে একাধিক পুরুষের প্রয়োজন পূরণ করতে হতে পারে। আর এভাবে যৌনবাহিত বিভিন্ন রোগের ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবণা অত্যধিক। কিন্তু বিপরীতক্রমে, একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকার ক্ষেত্রে এই সমস্যার উদ্ভব হয় না”।

জাকির নায়েকদের করা উপরের যুক্তিগুলো একাধারে মিথ্যাচার ও ভুলে ভরপুর, অশ্লীল, উদ্ভট এবং বিকৃত মস্তিস্কজাত। সেগুলো নিয়ে ধরে ধরে কথা বলার আগে- মানব ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টি দেই। আমরা জানি যে- একসময় মানুষের সমাজব্যবস্থা ছিল মাতৃতান্ত্রিক এবং তখন নারীদের বহুগামিতা সামাজিকভাবে সমর্থনযোগ্য ছিল। সে সময়ে সন্তানেরা কেবল মায়ের পরিচয়েই বেড়ে উঠতো। বলা হয়ে থাকে- দুনিয়ার প্রথম ডিফাইনড সম্পর্ক হচ্ছে “মা”। আজকের যুগেও তিব্বত- নেপাল সহ অনেক জায়গাতেই নারীর বহুবিবাহের চল আছে। নীচের এই ভিডিওতে নেপালের এমনই একটি পরিবারকে দেখা যাচ্ছে।
নারীর বহুবিবাহ: নেপাল

এবারে জাকির নায়েকদের করা (কু)যুক্তিগুলো একে একে দেখা যাক:
১) নারীর একাধিক স্বামী থাকলে, সন্তানের বাবাকে নির্দিষ্ট করণ আজ সম্ভব। সবসময়ের ধর্ম বলে যে দাবী সেটা খাটে না কারণ- কোন নিয়ম-কানুনই সবসময়ের জন্য একই থাকতে পারে না, যেহেতু মানুষ-মানুষের সমাজ- তার জানা বুঝা- আহরিত জ্ঞান, বিজ্ঞান-প্রযুক্ত সবই পরিবর্তনশীল। আর, বাবা কে না জানলে সন্তান খুব কষ্টে থাকে – এটাও যে মিথ্যা সেটা উপরের ভিডিওতে নেপালের সন্তানদের দেখেই বুঝতে পারছেন। জাকির নায়েক সোসাল সাইকোলজির এই দিকটা বেমালুম চেপে গেছেন । আমাদের এই সমাজে কয়েক জন বাবা থাকাটাকে আমরা “খারাপ” বলি বলেই সন্তান নির্দিষ্ট বাবার পরিচয়ের অভাবে মানসিকভাবে সমস্যায় ভোগে- কিন্তু বুঝতে হবে সেটা এই সমাজই সন্তানকে অমন করতে বাধ্য করে। যে সমাজে কোন সন্তানের একাধিক বাবা থাকাটা খুব স্বাভাবিক, সেখানে সন্তান একাধিক বাবা দেখেই অভ্যস্ত এবং এটাতে সে মানসিকভাবে কোন সমস্যায় না ভুগারই কথা।

২। পুরুষ স্বভাবতই বহুগামী – কথাটাই আপত্তিকর। পুরুষরা কি সারাক্ষণ বহুনারীতে উপগত হইবার চিন্তায় ব্যস্ত থাকে? আর যদি থাকেই , তাহলে নিজের চারটা স্ত্রী থাকলেও তারা ৫ম, ৬ষ্ঠ কোন নারির প্রতি আকর্ষিত হতে পারে?

৩। মানসিক ও বায়োলজিকাল কারনে নারী বহু স্বামীর সাথে ঘর করতে পারে না – এটাও নেপালের ভিডিও দেখে বুঝবেন যে মিথ্যা । শিডুল মেনে সব কয়জন স্বামীর সাথেই সুখে দাম্পত্য করতে দেখা যাচ্ছে নেপালী বউদের ।

৪। বহু স্বামী থাকলে যৌন রোগের সম্ভাবনা আছে, বহু স্ত্রী থাকলে নাই- এমন কথা একজন মূর্খের পক্ষেই বলা সম্ভব। জাকির নায়েকদের মুখ থেকে এই ধরনের “জেন্ডার বেসড” রোগের নাম শুনতে পারলে ভালো হতো। আর, রোগ ছড়ানোর ব্যাপারে- নারীর বহুগামিতা নয়, একগামি পুরুষ থেকে নারীতে বা নারী থেকে পুরুষে যৌনবাহিত রোগ ছড়াতে পারে। ফলে- এক পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকলে কোন একজনের যৌনবাহিত রোগ হলে সেটা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে- সেক্ষেত্রে রোগের বাহক হিসাবে স্বামী ব্যবহৃত হবে, অপরদিকে এক নারীর একাধিক স্বামী থাকলে- কারো কোন যৌনবাহিত রোগ হলে- ঐ নারী বাহক হিসাবে কাজ করবে।

 

৩। নারীদের বোরকার আড়ালে রেখে অবমাননা করা হয় কেন?
এবারেও জাকির নায়েকের বক্তৃতা শুনে ও দেখে আসুন।
জাকির নায়েক: চার

জাকির নায়েকরা এই প্রশ্নের জবাবের শুরুতেই – আগের সমাজগুলোতে নারীর অবস্থা কেমন ছিল সে সম্পর্কে একটা লম্বা ফিরিস্তি দেয়। ব্যবিলীয়নীয় যুগে, গ্রীক সভ্যতায়, রোমান সভ্যতায়, মিশরীয় সভ্যতায় এবং ইসলাম পূর্ব আরবে নারীদের খুব খারাপ অবস্থা ছিল- নারীদের জ্যান্ত পুড়ানো হতো- মেরে ফেলা হতো, নগ্নতা – পতিতাবৃত্তি খুব সাধারণ ছিল, নারীরা সব ধরণের অধিকার ও সুবিধা বঞ্চিত ছিল.. ইত্যাদি। এমন ঢালাও আলাপ যে প্রলাপমাত্র তা বলাই বাহুল্য, ইতিহাস নিয়ে যাদের নাড়াচাড়া আছে- তারা এটা জানে। যাহোক, জাকির নায়েকদের আলোচনায় ফিরে যাই। তাদের এই ফিরিস্তি হাজির করার উদ্দেশ্য ভালোই বুঝা যায়। তারা এই ফিরিস্তি দেয়ার মাধ্যমে এটাই প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে- ইসলামই প্রথম নারীদের তাদের সুষম মর্যাদায় অধিষ্টিত করেছে এবং এই মর্যাদা যেন বলবৎ থাকে তার ব্যবস্থাও ইসলাম করেছে, অর্থাৎ ইসলাম যেসমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছে তা এই মর্যাদা বলবৎ রাখার জন্য। কি সেই ব্যবস্থা? নারীদের হিজাব।

কোরআনে বলা হয়েছে:  

“মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে এবং যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া তারা যেন সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, তারা যেন মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে। তারা যেন স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাদী, যৌণকামনামুক্ত পুরুষ বা বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতিত কারও কাছে সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। গোপন সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য তারা যেন জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগন, তোমরা আল্লাহর সামনে তওবা কর যেন সফলকাম হতে পার।” [সুরা আন-নূর (২৪:৩১)]

হিজাবের অত্যাবশ্যকীয়তা নিয়ে কোরআনে বলা হয়েছে:

“হে নবী, আপনি আপনার পত্নীগণ, কন্যাগণ, ও মুমিন স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের অংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়, এতে তাদের চেনা সহজ হবে এবং তারা উত্যক্ত হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালূ।” [সুরা আল-আহযাব (৩৩:৫৯)]।

নানা কথার ভিতর দিয়ে আসলে এই হিজাবের পেছনে একটি যুক্তিই পেলাম। তা হলো মোদ্দা কথায়- নারীরা হিজাব না পরলে- পুরুষদের কাম জাগ্রত হতে পারে। জাকির নায়েকরা একটা চমৎকার (!) উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বুঝিয়ে দেয়:

“দুজন যমজ বোনের কথা ধরা যাক। তারা দুজনই সমান সুন্দরী। রাস্তায় হেটে যাবার সময় তাদের একজন ইসলামী হিজাব পরিধান করেছে অর্থ্যাৎ সম্পূর্ণ দেহ কাপড়ে আবৃত শুধু মুখ ও হাতের কব্জি বাদে। এবং অন্যজন পাশ্চাত্যের মিনি স্কাট ও শটস পরেছে। রাস্তার পাশে কিছু বখাটে ছেলে বসে আছে। আপনার কী মনে হয়, তারা এই দুই বোনের মধ্যে কাকে উত্যক্ত করবে? যে ইসলামী হিজাব পরিধান করেছে তাকে নাকি যে পাশ্চাত্যের পোশাক করেছে তাকে। নিঃসন্দেহে যে পাশ্চাত্যের পোশাক পরেছে তাকে। আসলে এই ধরনের পোশাক বিপরীত লিঙ্গকে আগ্রাসী হবার পরোক্ষ আমন্ত্রণ জানায়”।

বখাটে ছেলেরা তো হিজাব পরিরহিত একজনকেও উত্যক্ত করতে পারে, আমার প্রশ্ন হলো- ঐ জায়গায় জাকির নায়েক থাকলে কাকে করতো? কোনজনকে দেখে উত্যক্ত করতেন বা তার কামের উদ্রেক ঘটতো? যাহোক, নায়েকদের কথা আরেকটু শুনি। পাশ্চাত্যের তথা যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের নগ্নতা জাকির নায়েকদের মোক্ষম যুক্তি, সর্বশেষ অস্ত্র। জাকির নায়েকরা যুক্তরাষ্ট্রকে পৃথিবীর সর্বাধিক উন্নত দেশ হিসাবে অভিহিত করে জানান দেয় যে- যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের সংখ্যাও সর্বাধিক। শেষে চমৎকার একটা সমাধানও দেয়া হলো, “কোন নারীকে দেখামাত্র পুরুষ তার দৃষ্টি নত করবে, নারীরা ইসলামী হিজাব পরিধান করবে এবং এরপরও যদি কোন ব্যক্তি ধর্ষণ করে তবে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে”। জাকির নায়েকরা নিশ্চিত, এতে করেই যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণ একদম না-ই হয়ে যাবে। যেনবা, যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশগুলোতে ধর্ষণের মূল কারণ নারীদের বেপর্দা থাকা বা হিজাব না পরা! আজব!!

যুক্তরাষ্ট্রের গল্প শোনানো হচ্ছে- কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য বা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নারীর সেক্সুয়াল এবিউজমেন্টের হার কি কম? এইসব অঞ্চলে- বেশীরভাগ ঘটনাই প্রকাশ পায় না- আড়ালে থেকে যায়। সেদিন একটি রিপোর্টে পড়ছিলাম- শিশুকন্যার সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্ট নিয়ে- আমাদের মতো দেশগুলোতে ৬০ ভাগেরও বেশী শিশুকন্যা সেক্সুয়ালি কোন না কোন ভাবে হ্যারাজড হয় (শিশুকন্যা বলতে ১২/১৪ বছর বয়সের পূর্বে বাচ্চাদের বুঝিয়েছে)। আরো মজার কাহিনী হচ্ছে- এদের ৯০ ভাগেরও বেশী হ্যারাজড হয় না কি ফ্যামিলি মেম্বারদের দ্বারা- কাজিন, চাচা-মামা-দাদা কেউ সেই লিস্ট থেকে বাদ নেই! ঐ বাচ্চাগুলোকে বোরখা দিয়ে ঢেকে রাখলেই এসব বন্ধ হবে?

আর, উত্যক্ত করার যে উদাহরণটা জাকির নায়েক দিয়েছে- সেটা তার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে তুল্যজ্ঞান করেই দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, উত্যক্ত করাটা সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন হবে। যে সমাজে মিনি স্কার্ট ও শর্টস একটি স্বাভাবিক পোষাক হিসেবে ব্যবহৃত ও স্বীকৃত কিন্তু হিজাব নয়, সেখানে হিজাবধারীকে উত্যক্ত করা হতে পারে। আর যে সমাজে হিজাব স্বাভাবিক, শর্টস ও মিনি অব্যবহৃত সেখানে উল্টো ঘটনা ঘটবে।

নীচে দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু আদিবাসীদের নাচের একটা ভিডিও দেয়া হলো, এই লিংকে (Pretty Zulu Girls show their Wedding Dance.ইথিওপিয়া) আর কিছু ভিডিও আছে,- দেখে আমাকে বলেন- এই সব ন্যাংটো-আধা ন্যাংটো ট্রাইবাল নারীদের বুক পাছা দেখে জাকির নায়েকদের যেমন অনুভূতি হয়- তা কি ওদের পুরুষদেরও হয়?

শুধু একটা তথ্য দিতে পারি- এইসব ন্যাংটো মেয়েদের দিনে রাতে দেখেও ওদের পুরুষেরা উত্যক্ত করার কথা কল্পনাও করতে পারেনা, এরা হয়তো- অন্য সমাজের পুরুষদের (যারা নিজেদের সমাজে লজ্জা নিবারনের পোষাকে অভ্যস্ত) হাতে রেপড হতে পারে- কিন্তু এখানকার পুরুষদের হাতে তাদের নারীদের রেপ করার তেমন কোন নজির নেই।

 

পরিশিষ্ট:এক
এসব প্রশ্নের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আছে, কিন্তু সেগুলো নিয়ে উল্লেখযোগ্য তেমন কোন আলোচনা পেলাম না। প্রশ্নগুলো এখানে উল্লেখ করছি। জাকির নায়েক বা অন্য কোন মোল্লাকে এসবের জবাব দেয়ার চেস্টা করতে দেখলে- অনুগ্রহ করে একটু জানান দিয়েন।
১) কোরআনে যেহেতু একজন পুরুষের স্থলে দু’জন নারী সাক্ষীর কথা বলা আছে কেন? এর মধ্য দিয়ে দুইজন পুরুষকে একজন নারীর সমকক্ষ হিসাবে কি গণ্য করা হলো না?

২) কোরআনে স্ত্রীকে বেধরক প্রহারের অধিকার স্বামীকে দেয়া হয়েছে। এটা কি অমানবিক নয়? একই অধিকার স্ত্রীকে দেয়া হয়নি কেন? এটা কি সম অধিকার বা ন্যায়পরায়নতা প্রকাশ করে?

৩) কোরআনে নারীদের মাসিক রজঃস্রাবকে অশুচি হিসাবে গণ্য করা হয়েছে কেন? এসময়ে নারী কেন ধর্মীয় কাজকর্মের (নামাজ-রোযা প্রভৃতি) পর্যন্ত অধিকার পাবে না?

৪) কোরআনে স্ত্রীকে শষ্যক্ষেত্রের সাথে তুলনা করে হেয় করা হয়নি কি?

৫) কোরআনে যেহেতু নারীকে পুরুষের অর্ধেক সম্পত্তি দেয়া হয়েছে। কেন? এর মধ্য দিয়ে কি প্রমাণ হয় না যে নারী-পুরুষকে সমান অধিকার দেয়া হয়নি?

৬) কোরআনে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকাদের বিয়ে করাকে নিষিদ্ধ করা হয় নি কেন?

৭) কোরআনে অমানবিক হিলা বিয়ের কথা লিখা আছে কেন?

৮) কোরআনে যুদ্ধবন্দী/ক্রীতদাসীদের সাথে সেক্স করার কথা লিখা আছে- এটা অমানবিক নয় কি? (এ প্রসঙ্গে মাহমুদ রহমানের এই পোস্টও দেখেতে পারেন।)

 

পরিশিষ্ট:দুই
পরিশেষে, প্রাসঙ্গিক কিছু কোরআনের আয়াত উল্লেখ করাও হচ্ছে:

তোমাদের স্ত্রীরা হলো তোমাদের জন্য শস্য ক্ষেত্র। তোমরা যেভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর। আর নিজেদের জন্য আগামী দিনের ব্যবস্খা কর এবং আল্লাহ্কে ভয় করতে থাক। আর নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ যে, আল্লাহর সাথে তোমাদেরকে সাক্ষাত করতেই হবে। আর যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সুসংবাদ জানিয়ে দাও। ২-২২৩

আর তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন হায়েয পর্যন্ত। আর যদি সে আল্লাহর প্রতি এবং আখেরাত দিবসের উপর ঈমানদার হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ্ যা তার জরায়ুতে সৃষ্টি করেছেন তা লুকিয়ে রাখা জায়েজ নয়। আর যদি সদ্ভাব রেখে চলতে চায়, তাহলে তাদেরকে ফিরিয়ে নেবার অধিকার তাদের স্বামীরা সংরক্ষণ করে। আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনি ভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর নিয়ম অনুযায়ী। আর নারীরদের ওপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ্ হচ্ছে পরাক্রমশালী, বিজ্ঞ। ২-২২৮

আল্লাহ্ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন: একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর অংশের সমান। অত:পর যদি শুধু নারীই হয় দু-এর অধিক, তবে তাদের জন্যে ঐ মালের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে মরে এবং যদি একজনই হয়, তবে তার জন্যে অর্ধেক। মৃতের পিতা-মাতার মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্যে ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের পুত্র থাকে। যদি পুত্র না থাকে এবং পিতা-মাতাই ওয়ারিস হয়, তবে মাতা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। অত:পর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই থাকে, তবে তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ ওছিয়্যেতর পর, যা করে মরেছে কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রের মধ্যে কে তোমাদের জন্যে অধিক উপকারী তোমরা জান না। এটা আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত অংশ নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, রহস্যবিদ। ৪-১১

হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ঋনের আদান-প্রদান কর, তখন তা লিপিবদ্ধ করে নাও এবং তোমাদের মধ্যে কোন লেখক ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লিখে দেবে; লেখক লিখতে অস্বীকার করবে না। আল্লাহ্ তাকে যেমন শিক্ষা দিয়েছেন, তার উচিত তা লিখে দেয়া। এবং ঋন গ্রহীতা যেন লেখার বিষয় বলে দেয় এবং সে যেন স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহ্কে ভয় করে এবং লেখার মধ্যে বিন্দুমাত্রও বেশ কম না করে। অত:পর ঋণগ্রহীতা যদি নির্বোধ হয় কিংবা দূর্বল হয় অথবা নিজে লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে অক্ষম হয়, তবে তার অভিভাবক ন্যায়সঙ্গতভাবে লিখাবে। দুজন সাক্ষী কর, তোমাদের পুরুষদের মধ্যে থেকে। যদি দুজন পুরুষ না হয়, তবে একজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। ঐ সাক্ষীদের মধ্য থেকে যাদেরকে তোমরা পছন্দ কর যাতে একজন যদি ভুলে যায়, তবে একজন অন্যজনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যখন ডাকা হয়, তখন সাক্ষীদের অস্বীকার করা উচিত নয়। তোমরা এটা লিখতে অলসতা করোনা, তা ছোট হোক কিংবা বড়, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এ লিপিবদ্ধ করণ আল্লাহ্র কাছে সুবিচারকে অধিক কায়েম রাখে, সাক্ষ্যকে অধিক সুসংহত রাখে এবং তোমাদের সন্দেহে পতিত না হওয়ার পক্ষে অধিক উপযুক্ত। কিন্তু যদি কারবার নগদ হয়, পরপর হাতে হাতে আদান-প্রদান কর, তবে তা না লিখলে তোমাদের প্রতি কোন অভিযোগ নেই। তোমরা ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সাক্ষী রাখ। কোন লেখক ও সাক্ষীকে ক্ষতিগ্রস্ত করো না। যদি তোমরা এরূপ কর, তবে তা তোমাদের পক্ষে পাপের বিষয়। আল্লাহ্কে ভয় কর তিনি তোমাদেরকে শিক্ষা দেন। আল্লাহ্ সব কিছু জানেন। ২-২৮২

তারপর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয়বার) তালাক দেয়া হয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোন স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়। অত:পর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোন পাপ নেই। যদি আল্লাহর হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এই হলো আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা; যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য এসব বর্ণনা করা হয়। ২-২৩০

তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যাদের ঋতুবর্তী হওয়ার আশা নেই, তাদের ব্যাপারে সন্দেহ হলে তাদের ইদ্দত হবে তিন মাস। আর যারা এখনও ঋতুর বয়সে পৌঁছেনি, তাদেরও অনুরূপ ইদ্দতকাল হবে। গর্ভবর্তী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তানপ্রসব পর্যন্ত। যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ্ তার কাজ সহজ করে দেন। ৬৫-৪

পুরুষেরা নারীদের উপর কৃর্তত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ্ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ্ সবার উপর শ্রেষ্ঠ। ৪-৩৪

সকল সধবা নারীদের তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে, কিন্তু তোমাদের স্বত্বাধীন যেসব দাসী রয়েছে তাদের হারাম করা হয়নি। এ হল তোমাদের জন্য আল্লাহর বিধান। এদের ছাড়া অন্য সব নারীকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে এ শর্তে যে, তোমরা তাদের কামনা করবে অর্থের বিনিময়ে বিয়ে করার জন্য, ব্যভিচারের জন্য নয়। বিয়ের মাধ্যমে যে নারীদের তোমরা সম্ভোগ করেছ তাদের দিয়ে দিবে তাদের নির্ধারিত মহর। আর তোমাদের কোন গুনাহ হবে না যদি মহর নির্ধারণের পর তোমরা কোন বিষয়ে পরষ্পর সম্মত হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, হেকমতওয়ালা। ৪-২৪

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
সামহোয়ারইনব্লগের রাগ ইমন, আমি ও আঁধার, মনির হাসান, নিরুদ্দেশ নীহারিকা, খলদুন,বৃত্তবন্দী প্রমুখ ব্লগার (তারাও এই বিতর্কে দারুণ অংশ নিয়েছেন, পোস্টের কিছু যুক্তিসূত্র বা তথ্যসূত্র তাদের আলোচনা থেকে পাওয়া)।

[মুক্তমনা ব্লগে নভেম্বর ২০০৯ সালে প্রকাশিত]

সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০০৯

আমার অবিশ্বাসের সূত্রপাত

এক

শুরুটা বলতে হবে পরিবারের হাত ধরেই….

জন্মাবার পরে আমার বাবা-মা আমাকে একটি নিখাঁদ বাংলা নাম দেন। এবং ছোটবেলায় যে এলাকায় বেড়ে উঠি সেখানে বেশ কিছু হিন্দু পরিবার ছিল, যাদের সাথে খুব স্বাভাবিক-সাধারণ সুসম্পর্ক ছিল- মানে পুঁজায় তাদের বাসায় আমাদের দাওয়াত খাওয়া- আমাদের ঈদে আমাদের বাসায় তাদের দাওয়াত খাওয়াটা নৈমত্তিক বিষয় ছিল। এটা আপাতভাবে সামান্য ব্যাপার মনে হতে পারে, তবে আমি মনে করি- আমার নিজের অসাম্প্রদায়িক হওয়ার পেছনে এ দুটি বিষয়ের ব্যাপক ভূমিকা আছে।

আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (বেবি-ওয়ান-টু) এক হিন্দু শিক্ষক আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন- এবং মাঝে মধ্যে তার সাথে স্কুলে যাওয়া আসা করতাম। তো, আমার বাংলা তথা হিন্দু নাম এবং একজন হিন্দু শিক্ষকের সাথে স্কুলে যাতায়াতের কারণে সেই ওয়ান-টু তেই ক্লাসের বিভিন্ন ছেলেমেয়ের কাছ থেকে একটা ছড়া মাঝে মধ্যেই শুনতে হতো- “হিন্দু হিন্দু তুলসীর পাতা, হিন্দু খায় গরুর মাথা”। আমাকে হিন্দু হিন্দু বলে খেপানো হতো (খেপাতো বাচ্চারাই- এখন যখন ভাবি, শিউরে উঠি- কত বাচ্চাকাল থেকেই এরা সাম্প্রদায়িক হয়ে গড়ে উঠে!!)। “হিন্দু” যেন একটা গালি!! আমার নামটিই যেন আমাকে বাচিয়ে দেয় ওদের মত সাম্প্রদায়িক হওয়ার হাত থেকে- এবং সেই বাচ্চাকাল থেকেই এই মুসলমান-হিন্দু বিভেদ মনে কষ্টের অনুভূতিই তৈরী করতো।

 

কিন্তু নাস্তিক্যের পাঠ আরো পরের ঘটনা, আরো কিছুটা বড় হয়ে।
 

ক্লাসের ধর্মের বই খুব মনোযোগ সহাকারে পড়া ও খুব আগ্রহ নিয়ে কায়দা-আমপারা- তারপরে কোরআন পড়াও শিখে নেই। পাড়ায় কম্পিটিশন করে নামাজ পড়া, বাসায় জোর করে রোযা রাখা এসবও চলতে থাকে। আর ধর্মের প্রতি এই আগ্রহের কারণে এমনটা অবস্থা হলো যে- ধর্মীয় বা ইসলাম সংক্রান্ত বই পেলেই তা মনোযোগ সহকারে পড়তাম। এটা করতে গিয়ে- একদম প্রাথমিক কিছু কিছু প্রশ্নও মনে তৈরী হতে থাকে।

 

তবে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সর্বপ্রথম মাথায় আসে- সেটা এখনো মনে আছে: ঠিক প্রশ্ন না- বলা যায় একটা আঘাত। তখন সম্ভবত ক্লাস ফাইভ কি ফোরে পড়ি। বাসায় এক স্যার বিজ্ঞান-অংক করাতেন, নামাজের সময় হলে একসাথে নিয়ে নামাজ পড়ান। ওনার সংস্পর্শেই বলা যায় নামাজের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস হয়েছিলাম। সেই স্যার একদিন বিজ্ঞান পড়াচ্ছিলেন- তো সূর্য ও পৃথিবীর আবর্তনের বিষয়টি বই এ যা ছিল; ঠিক বিপরীত একটি আলোচনা তিনি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞান যতই বলুক পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরুক; আসলে সূর্যই ঘুরে। কোরআনে এটা আছে- আল্লাহর সবকিছু সৃষ্টির মূলে আছে মানুষ- মানুষের পৃথিবীকেই কেন্দ্র করেই সূর্য ঘুরছে।

 

এই কথায় ঠিকই একটা ধাক্কা খাই। কোনটি ঠিক? বিজ্ঞান না ধর্ম? ওনার কথা পুরো বিশ্বাস করতে পারলাম না- আবার অবিশ্বাসও করতে পারিনি। মাথার মধ্যে থেকে গিয়েছিল। আরো পরে অবশ্য অন্য ইসলামী আলোচনায় দেখেছি- কোরআন এ কোথাও বলা হয়নি যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে- বরং পৃথিবীর ঘুর্ণনের ব্যাপারেই নাকি কোরআনের আলোচনায় সমর্থন পাওয়া যায়, তথাপি মনের মধ্যে এটি ভালো দাগ ফেলেছিল।

 

একজন মানুষের ভীষণ ভূমিকা আছে। তিনি সরাসরি নাস্তিকতার কোন পাঠ আমাকে দেননি- তবে বিজ্ঞানমনস্ক করার ব্যাপারে তার অবদান প্রথমেই স্বীকার করি। তিনি আমার এক দূরসম্পর্কীয় কাকা, আমাদের গ্রামের বাড়ির এক মাদ্রাসার বিজ্ঞানের শিক্ষক। এবং একজন বিজ্ঞান সাধক। বিজ্ঞান পাগল এই মানুষটি বিজ্ঞান সম্পর্কিত যে কোন বই পেলেই হলো- তা সংগ্রহ করেন এবং গভীর মনোযোগের সাথে পড়েন, নিজ হাতে টেলিস্কোপ, রেডিও… এরকম নানারকম জিনিস তৈরী করেন- তার সংস্পর্শেই আমার নিজেরো বিজ্ঞানের প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মে।

 

একদিন তার সাথে আলোচনা কালে তিনি (তখন সম্ভবত সেভেন-এইটে পড়ি) বললেন,

“বিজ্ঞানের একদম ছোট থেকে বড় যেকোন বিষয়ের আলোচনায় আল্লাহ-ভগবান-দেবতা-ফেরেশতা কারোরই কোন আলোচনা পাবেনা। বৃষ্টি কিভাবে হয়? এটার জবাবে যে পানি চক্র বা অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে যত যাই আলোচনা করা হবে- সেখানে কিন্তু কোন মিকাইলের বা কোন অতিপ্রাকৃত কোন কিছুর আলোচনা নেই।”
 

এই কথাটি আমার সামনে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দেয় বলা যায়। অনেক অনেক ভাবতে থাকি। এর আগে- ধর্ম ও বিজ্ঞানের যে দ্বন্দ্ব তৈরী হয়েছিল- সেখানে নিজের পক্ষপাত বিজ্ঞানের প্রতি ঝুকতে থাকে।

 

দুই

এই ব্যাপারটি লিখতে গিয়ে দেখছি- ঠিক গুছিয়ে লেখতে পারছি না। আসলে ছোটবেলাটা জুড়ে বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন বিষয়, বিভিন্ন প্রশ্ন এর মিলিত প্রভাবেই আমার অবিশ্বাসের সূত্রপাত- এবং লিখতে গিয়ে বুঝছি এটা অবশ্যই সরল রৈখিক নয়। বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন ঘটনাকে তাই আনতেই হচ্ছে, আর সেগুলো যেহেতু ধারাবাহিক নয়- তাই সেগুলোকে গুছানোর দায়িত্ব পাঠকের হাতে ছেড়ে দেয়া ছাড়া কোন উপায়ও দেখছি না।
 
 ক্লাস থ্রি’র দিকের ঘটনা। পাড়ার মসজিদে ইমাম হুজুর আসরের নামাজের পরে আরবী শেখান। অনেক পিচ্চি-পাচ্চার সাথে আমিও গেলাম। যদিও তখন আমি কায়দা শেষ করে আমপাড়া পড়া শিখেছি, তথাপি সবার সাথে কোরাস করে আলিফ যাবর আ, বা যাবর বা…. এসব পড়তে লাগলাম। যেহেতু পারি- সেহেতু একটু হালকা ভাব ছিল- বসে বসে মাঝে মধ্যে দুষ্টামিও করতাম। এখানে দুটি ঘটনা ঘটে। একটি হলো- প্রথমদিনই আমার নাম শুনে হুজুর জানান দেন যে, এই হিন্দু নাম রাখা চলবে না। শেষ বিচারের দিনে বেহেশতে যাবার শেষ উপায় হলো একটা মুসলমানী নাম, আরবী নাম। আমার নাম পাল্টে তিনি করে দিলেন কবির হাসান। দ্বিতীয় ঘটনা হলো- একদিন পেশ সম্পর্কে পড়াচ্ছিলেন, তো গাইন পেশ হয় “গু”। হুট করে মাথায় আসলো- “গু”। আমি আশপাশের বাচ্চাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম গাইন পেশ কি হয়? জবাবে যখন বলছে- “গু” , তখন আমার কি ব্যাপক হাসি। কিন্তু সমস্যা হলো- একজন হঠাৎ করেই হুজুরকে জানিয়ে দেয়, এবং হুজুর প্রচণ্ড রুষ্ট হোন। আরবী ভাষা হলো আল্লাহর ভাষা- সেই ভাষাকে নিয়ে মশকরা! আমাকে দারুন বকা-ঝকা করেন, অনেকগুলো ছেলে-মেয়ের মাঝে খুব অপমান করেন। সেদিন থেকে আর ওখানে যেতে পারিনি।
 
ঘটনাটি মাথায় থেকে যায়। আল্লাহর প্রতি, আরবী ভাষার প্রতি তখন আমার আসলেই খুব শ্রদ্ধা ছিল; কিছুদিন পরে কোরআন পড়া শিখতে হবে- এমন তাগিদ বোধ করতাম। আমি বুঝতেই পারিনি- গাইন পেশ গু- এটা নিয়ে হাসলে যে আল্লাহ বা আরবী ভাষাকে মশকরা করা হয়! আমি সেরকম মশকরা করার কথা তখন কল্পনাও করতে পারতাম না, সেরকম সাহস আমার ছিলই না।
 
ঐ বয়সে এই ঘটনা আমার মনের মধ্যে ভালো প্রভাব ফেলে, অনেক দিনই সেই ঘটনার কথা মনে পড়তো, ভাবতাম এবং একসময় এটা মনে হতে লাগলো যে, আরবী ভাষা তো একটা ভাষা বিশেষ, ভাষা ছাড়া কিছুই না- এবং এই ভাষা দিয়ে “গু”-ও লেখা যায়। অনেক পরে যখন দেখলাম আরবী ভাষাতেও গালিগালাজ আছে, অমুক-তমুকের বাচ্চা- বেশ্যা, বিভিন্ন গালিমূলক অঙ্গবিশেষ…. এসবের প্রচলনও আছে; তখন সেই ছোটবেলাকার কথা মনে পড়লে দারুন হাসি পেয়েছিল।
 
আর, নামের বিষয়টি তো খুব সাধারণ ঘটনা। নাম শোনার পরে- আমি হিন্দু না মুসলমান এই প্রশ্ন এখনো শুনি। ছোটবেলায় স্কুলে এক স্যারকে মুহম্মদ সহকারে আমার নামটি বলায় তিনি জানিয়ে দিলেন- আমার নাম নাকি মুসলমান- হিন্দু এবং খৃস্টান নামের সমাহার। আরেক স্যার আমার বাবার নাম শুনলেন, এটি নির্ভেজাল আরবী নাম। শুনে রায় দিলেন- আমার দাদা তো ভালোই ছিলেন- কিন্তু বাবার মাথায় এমন ভূত চাপলো কি করে? কিশোর বয়সে এসব কিছুই হজম করে যেতে হয়েছে- যদিও তখনও আমি আস্তিক ছিলাম এবং মোটামুটি নিয়মিত নামাজ-রোযা পালনের চেষ্টা করতাম।
 
একটা সুবিধা অবশ্য ছিল- সেটা হলো বাবা-মা’র কাছ থেকে একটা জিনিস পেয়েছিলাম- সেটা হলো আমার বাংলা নাম নিয়ে গর্ব। নিজের ভাষায় নাম কতজনেরই বা আছে? আর এটাই আমাকে টিকিয়ে দিল ও নতুন অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিল।
 
 : বাংলা ভাষা কেন শুধু হিন্দুর ভাষা হতে যাবে? প্রিন্স- ডলার প্রভৃতি ইংরেজী নাম বা অন্য উর্দু-ফারসী নাম রাখলে তো তাকে কেউ বলছে না যে আরবি নাম রাখো?
 
 অনেক কিছু মুখ বুজে সহ্য করে গেলেও একটা সময় তর্ক করা আরম্ভ করে দেই। স্যার গোত্রের নয় বা সমবয়সী এমনদের সাথে। ভাষা নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে একসময় দেখি যুক্তি করছি: “আরবী তো আমরা বুঝিনা- ফলে নাবুঝে সেটা আউরিয়ে কিভাব আল্লাহর ইবাদত সম্ভব?” তখন থেকে শুরু- নামাজ রোযার নিয়্যত, বিভিন্ন দোআ আরবীর পরিবর্তে বাংলায় পড়া (যদিও নামাজে সুরা আরবীতেই পড়তাম- তারপরেও মনে হতো এটাও বাংলায় পড়লে সমস্যা কি?- এ ব্যাপারে অবশ্য হুজুরদের সমর্থন পাইনি)। এক সময় দেখা গেল- কোরআন খতম দেয়ার আগের সেই উত্তেজনা- আগ্রহ উবে গেল, ৫/৬ পারা শেষ করেছি এরকম অবস্থায় কোরআন পড়া বন্ধ করে দেই; বাংলা কোরআন যোগাড় করি এবং বাংলায় পড়তে থাকি। (আগে সুর করে এবং সহী করে পড়ার ব্যাপারে আমার বিশেষ সুনাম ছিল এবং আমি এতবার কোরআন খতম দিয়েছি- এটা প্রশংসা সহকারে প্রচার করা হতো- ফলে রোযার মাস এলে এই খতমের প্রতি বিশেষ আগ্রহ তো জাগতোই)।
 
 এই বাংলায় কোরআন পড়াটা আমার পক্ষে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ করে দেয়।

 

তিন

 প্রথম পর্বে জানিয়েছিলাম আমার এক বিজ্ঞান পাগল কাকার কথা, যার মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতার শুরু। বিজ্ঞানকে দিন দিন আকড়ে ধরতে লাগলাম। বাসায় রাখা হতো দৈনিক সংবাদ, তার প্রতি মঙ্গলবার বেরুতো বিজ্ঞান পাতা (পরে তা দু পৃষ্ঠার করেছিল)। ঐ পাতাটি শুধু গোগ্রাসে গিলতাম না- সংগ্রহও করতাম, সংবাদের বিজ্ঞান পাতা দিয়ে সুটকেস ভরিয়ে ফেলেছিলাম। কত ক যে জানতে পেরেছিলাম ঐটুকু বয়সে! হয়তো অনেক কিছু বুঝিনি, তবে দুনিয়াটা যে আমার আগের জানা ছোট্ট গণ্ডির নয়, তার কত বৈচিত্র আছে- দুনিয়ার বা বিশ্ব জগতের সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা কার্যকরণ সম্পর্ক আছে- এটা বুঝতে শিখতে থাকি।

এসময় আরেকটি কাজও করতে থাকি- চোখের সামনে বিভিন্ন ঘটনার বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা করা আরম্ভ করি। এবং একসময় নিশ্চিত হতে পারি যে, অলৌকিক বলে কিছু থাকতে পারে না। (এই সিদ্ধান্তে আসার পেছনে অবদান প্রথমত সেই কাকার, তারপরে সংবাদের বিজ্ঞান পাতার এবং আরেকটু পরে- মানে বড় হয়ে প্রবীর ঘোষের “অলৌকিক নয় লৌকিক” বই পড়ার পরে আর কোন সন্দেহই থাকে না)।

ফলে, এই সময়টাতে বিভিন্ন সময়ে দাদী-নানী প্রমুখদের কাছ থেকে শুনা এবং এক সময় বিশ্বাস করা ভূত-প্রেত-জ্বিন-পরীদের অবিশ্বাস করা আরম্ভ করি, আমাদের এলাকায় একটি বড় পেয়ারা গাছে জ্বিন/ভূতের গল্প প্রচলিত ছিল- ভর দুপুরে বা আযানের সময় গাছে উঠে থাকলে জ্বিন/ভূত এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, এটাও আমাদের বয়সী প্রায় সবাই বিশ্বাস করতাম, সাহস করে উঠে দেখলাম- কিছুই হলো না (প্রথমবার প্রচণ্ড ভয় অবশ্য পেয়েছিলাম)।

একবার সেই কাকা আরেকটা গল্প শোনালেন। গ্রামের একলোক নাকি গল্প করছিল- বিমান ক্রাশে জিয়াউল হকের শরীর টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছিল- কিন্তু তার পকেট-কোরআন অক্ষত ছিল, কোরআন কখনো নষ্ট হতে পারে না, আগুনে পুড়তে পারে না … ইত্যাদি। এটা শুনে তিনি আস্ত কোরআন নিয়ে এসে সেখানকার কয়েকপাতা ছিড়ে আগুন ধরিয়ে দেখিয়ে দেন- কোরআনও তো কাগজে ছাপা অক্ষর বিশেষ, এবং তা পুড়ানো যেতে পারে। কিন্তু কোরআন ছেড়া ও পুড়ানোয় গুনাহ হবে কি না জিজ্ঞেস করায় জানালেন- আল্লাহ যদি সত্যি থেকেই থাকেন- তিনি মানুষের তৈরী ঐ কাগজের চেয়ে সত্যের ধারক হওয়ার কথা। মনে গেথে যায়।

বিশ্বাস করতাম “সুরা এখলাস উল্টাদিক করে পড়লে” চাইলে ইঁদুর হওয়া যায়, বিজ্ঞানের বদৌলতে সেটাকে সন্দেহ করতে শিখলাম। প্রমাণের জন্য উল্টো করে পড়ে দেখলাম, গুনাহর ভয় কাটানোর জন্য কাকার সেই যুক্তির কথা ভাবলাম। দেখা গেল- ইঁদুর হইনি। এমন অনেক সংষ্কারই ধীরে ধীরে মাথা থেকে দূর হতে থাকে। অবশ্য এক্ষেত্রে “সংবাদ” এর বিজ্ঞান পাতার ভূমিকা ছিল- সেখানে প্রচলিত কুসংষ্কার নিয়ে সত্যিকার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি কি হতে পারে সেরকম লেখা নিয়মিত ছাপাতো। এই মুহুর্তে সাপ ও ওঝাদের নিয়ে একটা বিশাল লেখা এবং জ্যোতিশাস্ত্র ও রাশিফল নিয়ে বিশাল লেখার কথা মনে পড়ছে।

একদিনের কথা। প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে, যথারীতি পাড়ার এক মাঝবয়স্ক ভদ্রলোক চিৎকার করে আযান দিতেছেন। আযান দিলে নাকি ঝড় থেমে যায়, ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি করার সম্ভাবনা কমে যায়। আগে বিশ্বাস করলে- তখন আমি ঝড়ের প্রকৃত কারণ জানি (ক্লাসের বিজ্ঞান বইয়েই ছিল), ঝড়ের সাথে যে আযানের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না এটাও নিশ্চিত। কিন্তু ঐ সময় আমার উপস্থিতি প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারটির বাসায় ছিল। সেখানে এই কথা বলার সাথে সাথে আমাকে দিদি-কাকি দারুনভাবে সাপোর্ট করলেন- মনে মনে খুশী হলাম এই ভেবে যাক এনারা অনেক বিজ্ঞানমনস্ক। কিন্তু দুদিন পরেই তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখি তারা এক কালী মন্দিরের কথা বলছেন- যার চারদিকে সাত বার ঘুরলে নাকি কেউ বাঁচতে পারে না। যতই বিজ্ঞানের কথা বলি- ওনারা ততই তাদের বিশ্বাসের কথা বলতে থাকেন। মেজাজ-মুজাজ খারাপ করে শেষ পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ জানাই- সেখানে যাবো। পরে অবশ্য আর যাওয়া হয়নি- আমার মায়ের জন্য; মায়ের যুক্তি- কালীর অলৌকিক ক্ষমতা না থাকুক- মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা তো মানুষের থাকতে পারে! (আসলে ঐ সময়ে তখনও প্রবীর ঘোষ পড়া ছিল না- ফলে মায়ের কথায় সহজেই ভয় পেয়ে থেমে গিয়েছিলাম….)

সেদিন কালীর অলৌকিকত্ব নিয়ে কাজ করার সুযোগ না পেলেও, কিছুদিনের মধ্যেই দুটো ঘটনা কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাই। একটা মাংসে আল্লাহ লেখা, আরেকটা একজনের বাড়িতে বিগত এক পীর সাহেবের কবর জেগে উঠা। দুটি ঘটনাই হাজার হাজার মানুষের সাথে সাথে আমিও প্রত্যক্ষ করার জন্য ছুটে যাই, কিন্তু দুঃখের কথা, অন্য সকলের মত এতে আমার ঈমান পোক্ত হয়নি- বরং ধাপ্পাবাজিই মনে হয়েছে (আমি তখনও স্কুল পড়ুয়া, আমার কথায় কান দেয়ার মত কেউ ছিল না- ফলে আমার পক্ষে ধাপ্পাবাজিটা পুরো উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি; কেবল কিছু বন্ধুবান্ধব, পাড়ার কিছু লোকের সাথে যুক্তি-তর্ক করেছি)।

ঐ মাংসে আল্লাহ লেখা দেখে তো এক বন্ধু মাংস খাওয়াই বাদ দিয়ে দিল- মাংস খেতে গেলেই নাকি তার মনে হতো- এখানে যদি আল্লাহ লেখা থাকে- তাহলে সেই আল্লাহ লেখাঅ’লা মাংস খেয়ে ফেললে কতই না গুনাহ হবে! তার সাথে তর্ক হলো। বললাম- “আল্লাহ লেখাটার দিকে ভালো করে খেয়াল করো। পাশাপাশি চারটা খাড়া দাগ বা লাইনের বামের তিনটার নিচের দিকে যদি কোনরকমে মিলে যায়- তবে সেটাকেই আল্লাহ বলে চালানো যায় কি-না?” মজার ব্যাপার হলো- অলৌকিক যে মাংস খণ্ডটি দেখতে গিয়েছিলাম- সেটাতে এরকমই ছিল- সর্ববামে ‘হা’ বা ‘হু’ ছিলই না। বন্ধুকে বললাম- “এবারে গরু-ছাগলের মাংসের দিকে খেয়াল করো- সেখানে আড়াআড়ি অনেক দাগ থাকে- ফলে এগুলো থেকে সহজেই যেকেউ চাইলেই আল্লাহ বানাতে পারবে। সে হিসাবে আমরা প্রতিবার মাংস ভক্ষণেই অনেকবার আল্লাহকে হজম করে ফেলছি”। তাকে আরো জানালাম- “ঐ একই নিয়মে চাইলে মাংসেখণ্ডে ‘লাইলাহা’ মানে ‘কোন মাবুদ নাই’ এটাও খুঁজে বের করা সম্ভব”। তর্কের আউটপুট হলো- বন্ধুটি নাস্তিক না হয়ে গেলেও (নাস্তিক হবে কি- তখনও তো আমি পুরো নাস্তিক নই)- আবার মাংস খাওয়া শুরু করে দেয়।

আর- পীর বাবার কবরের ঘটনাটি হলো- ঐ ঘরের পাশে এক বড় গাছের শিকড়ের কীর্তি (কবরটা ভেঙ্গে বা জায়গাটা খুড়তে পারলেই ভালো প্রমান হয়ে যেত- সেটা অ্যারেঞ্জ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না- আমি কেবল নিজের যুক্তির জায়গাটা পরিষ্কার করতে পেরেছিলাম)। এর সাথে ঐ বাড়ির এক বৃদ্ধা মহিলার স্বপ্নে পীরবাবার হাজির হওয়া ও নানান রকম নির্দেশনা দেয়াটাও আমার খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক মনে হয়েছে। কেননা- এরচেয়েও উদ্ভট টাইপের স্বপ্ন আমরা অনেকেই দেখি।

 

 চার

 

দ্বিতীয় পর্বে বলেছিলাম, একটা সময় বাংলা কোরআন পড়া আরম্ভ করি। বেশীদূর যেতে হয়নি- ২য় সুরাতেই মানে সুরা বাকারা পড়তে গিয়েই হোচট খাওয়া আরম্ভ করি। কোরআনের অনেক কিছুই আছে যা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মেলে না- কিন্তু ঐ সময়ে সবচেয়ে বেশী ধাক্কা খাই- অলৌকিক ঘটনাগুলোতে, বিভিন্ন নবী-রাসুলের অলৌকিক ক্ষমতা বা মু’জিজা ছিল এটা বিশ্বাস করতেই হবে। কিন্তু পারছিলাম না। নবীজীর হাতের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল? মুসা আ এর লাঠি সাপ হয়ে যেত, লাঠির আঘাতে নীল দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল? আবাবিল পাখির পাথর নিক্ষেপ দিয়ে বড় বাহিনী পরাস্ত হয়েছিল? নবীজী এক গ্লাস দুধ দিয়ে অনেক সাহাবী পেট পুরে খাওয়া হয়েছিল? ঈসা আ এর হাতের ছোয়ায় কুষ্ঠ রোগ, অন্ধত্ব ভালো হয়ে যেত? মরা বেচে উঠতো? পুরো অবিশ্বাস করতে না পারলেও দিনে দিনে এসবে বিশ্বাস করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।

 

ক্লাস এইট পর্যন্ত ক্লাসে আরবী আবশ্যিক ছিল- পাশে ছিল অনেক বড় এক মাদ্রাসা- সেই মাদ্রাসার এক হুজুর বাসায় এসে আরবী পড়াতো- বয়সে বছর ৩/৪ বড়, বন্ধুর মতই সম্পর্ক হয়েছিল। তার সাথেও অনেক কথা হতো- মুজিজা নিয়ে কথা বলায় তিনি নিশ্চিত করেন যে- এটাতে বিশ্বাস রাখতেই হবে। তিনি একে একে অনেকগুলো মু’জিজার কথা জানান- একটা বই দেন, যেখানে কোরআনে উল্লেখিত বিভিন্ন মু’জিজার কথা উল্লেখ ছিল। এছাড়া শুক্রবারে জুমার নামাজে মসজিদের ঈমামও প্রায়ই বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার কথা বলতেন। নবী-রাসুলের মু’জিজার ব্যাপারে সন্দেহ থাকতো- কিন্তু পুরো অবিশ্বাস হয়তো তখনো করে উঠতে পারিনি- কিন্তু ঈমাম সাহেব বর্তমানেরও বিভিন্ন জায়গার নানা অলৌকিক ঘটনার বয়ান দিতেন- সেগুলোকে সে সময়েই ভুয়া মনে হয়েছিল। 

 

 

যাহোক, দিনে দিনে সন্দেহ বাড়তেই থাকে। এককালের প্রাণের ধর্ম- গর্বের ধর্ম ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়েই প্রশ্ন তৈরী হতে থাকে। একটি তো বললাম- বিজ্ঞানের সাথে দ্বন্দ্ব। দ্বিতীয়টি হলো- অন্য ধর্মের প্রতি এর দৃষ্টিভঙ্গি। আগেই বলেছি- আমার বাংলা নাম (হিন্দু! নাম) এর কারণে হিন্দু(!) গালিটা অনেকবারই শুনতে হয়েছে। এমনকি একবার এলার্জীর কারণে বেশকিছুদিন গরুর মাংস খাওয়া নিষেধ ছিল- সেটার জন্য শুনতে হয়েছে- হিন্দু না-কি? আর এই গালি শুনতে শুনতে এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীদের সাথে মেশা- হিন্দু বন্ধু- খেলার সাথী থাকার কারণে, ওদের প্রতি একটি সফট কর্ণার জন্মে গিয়েছিল- মানে “হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানেরা ভালো” এমন চিন্তাকে খুব খারাপ চোখে দেখতাম। আর ঠিক এই জায়গাটিতেই আমার মুসলমান বন্ধু/পাড়ার বড় ভাইদের সাথে দারুন তর্ক হতো। যত তর্ক করেছি, দেখেছি আগের চেয়ে আরেকটু ভালো ভাবতে পারছি- অনেক সময় দেখা গেছে, তর্ক করতে করতে এমন একটি যুক্তি করে ফেলেছি- আগে তেমনটি সচেতন ভাবে নিজেও ভাবিনি। এভাবেই শুরু….। বিশেষ করে স্কুলে কয়েকজন বন্ধুর সাথে নিয়মিত তর্ক হতো- সেটা আমার চিন্তাগুলোকে অনেক গুছিয়ে আনতে সাহায্য করে।

তো যেটা বলছিলাম…
ক্লাসের বই এ শিরক সম্পর্কে পড়লাম। টিচার-ছাত্ররা হিন্দুদের মুর্তি নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি করলো। প্রাণ নেই- কিছু করার ক্ষমতা নেই- সে আবার দেবতা!!! বিষয়টি ভালো লাগে না। পড়লাম, সবচেয়ে ভয়াবহ পাপ শিরক!! এটার কোন ক্ষমা নেই!! প্রচণ্ড খারাপ লাগলো- কুফরি বা আল্লাহকে অস্বীকার/অবিশ্বাস করলেও মাফ আছে, অন্য ঈশ্বরকে মানলেও হয়তো মাফ আছে- কিন্তু শিরক এর কোন মাফ নেই!!!! এমনটা কেন হবে? এই প্রশ্ন মাথায় আসতে থাকলো। হিন্দু কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম- এরকম মাটির মুর্তিকে পুজা করেন কেন? তিনি বললেন- মাটির মুর্তি হিসাবে তো পুজা করিনা- আসলে তো পুজা করি দেবতাকে। মুর্তি তো মাধ্যম মাত্র। অনেক ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতে দেখি একসময় মনে হলো- আসলে ইসলাম, হিন্দু, খৃস্টানেরা যা পালন করে তা অনুশাসন মাত্র। সেখান থেকেই মনে হলো- এসবে তো কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহকে ডাকতে গেলেও মুসলামনদের কিছু কাজ করতে হয়- নামাজ পড়তে হয়, মসজিদে যেতে হয়, পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হয়…., তাহলে হিন্দুরা মুর্তি বানিয়ে দেবতাকে ডাকলে দোষ কি? ছোটবেলা থেকে মসজিদকে আল্লাহর ঘর বলে এসেছি- আল্লাহর যদি ঘর থাকতে পারে- তবে মুর্তিতে দোষ কি? ক্লাসে হজ্জের নিয়ম পড়তে গিয়ে দেখি- এখনও কাল্পনিক শয়তানের দিকে পাথর ছুড়তে হয়। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে যদি শয়তানের দিকে পাথর ছুড়া যায়- তবে মুর্তি পুজায় সমস্যা কি? ক্লাসের ধর্ম স্যার হজরে আসওয়াদের কাহিনী শুনালেন। সেই পাথরে এখনো মুসলমানেরা চুমু খায়, মনে হলো তবে মুর্তি পুজায় সমস্যা কি? আল্লাহর যদি গণ্ডায় গণ্ডায় ফেরেশতা থাকে তবে ভগবানের দেবতা-দেবী থাকতে দোষ কি? ফেরেশতারা যদি মানুষের রূপ নিয়ে আসতে পারে, তবে এক ভগবান-ই বা বিভিন্ন রূপ নিতে পারবে না কেন?

এমন চিন্তা করা শুরু করেছি, বন্ধুদের সাথে যুক্তি-তর্ক করি; কেউ কেউ ভয়ে আমার সাথে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে আসে না- ধর্ম বিষয়ক কথা শুরু হলেই দেখা যায়- কেউ কেউ কথা বন্ধ করে দেয়- জানায়, এ বিষয়ে নাকি আমার সাথে কথা বলা যাবে না। তারপরেও অনেকের সাথে যুক্তি-তর্ক হতো। এবং এই তর্ক করতে গিয়ে হঠাৎ করেই একজনকে বলে ফেলি- “তুই আজ ইসলামের নামে এত বড় বড় কথা বলছিস- এই তোর জন্ম একটা হিন্দুর ঘরে হলে- মা কালীর নামে তোর মুখ দিয়ে ফেনা ছুটতো!” এটা বলার দেখি আমি চুপ- সেই বন্ধুও চুপ। সে-ও প্রচণ্ড ধাক্কা খায়, আর আমার ভাবনার আরেকটি দিক উন্মোচিত হয়ে যায়….

এই চিন্তাটিই আমাকে আমার ধর্মীয় বিশ্বাসকে দূরে ঠেলে দিতে দারুন সাহায্য করে। আমি মুসলমান কারণ আমার বাবা-মা মুসলমান, পারিবারিক পরিবেশ মুসলমান, জন্ম পরবর্তী সমস্ত কিছুই আমাকে মুসলমান হিসাবে গড়ে তুলেছে। একজন হিন্দু বা একজন খৃস্টানের ক্ষেত্রেও তা-ই। তাহলে আমার আল্লাহ বা অন্যদের ভগবান বা গড এর ভূমিকা কি?

এবারে চিন্তার ক্ষেত্রটিতে ঝড় আসে আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে। সন্দেহ তৈরী হয়- কিন্তু পুরো নিসন্দেহ হতে পারি না….

 

পাঁচ

(১)

আমার ক্লাস নাইন আর টেন- দুটো বছরই গেছে প্রচণ্ড দ্বিধায়, অস্থিরতায়। এই সময়কালটাকেই বলবো আমার ট্রানজিশন পিরিয়ড। ইসলাম ধর্মের অসংখ্য বিষয় নিয়ে প্রশ্ন চলে এসেছে- অন্যান্য প্রচলিত ধর্ম সম্পর্কে তো আগে থেকেই খারাপ ধারণা ছিল- গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে যতটুকু পড়েছি ভালোই লাগে- কিন্তু বৌদ্ধ মন্দিরে তো দেখি বুদ্ধ মূর্তি- তাকে কেন্দ্র করে পুজার মত অনুষ্ঠানও হয়- শুনলাম বৌদ্ধরা নাকি বুদ্ধরে ভগবানও বলে। কি করি?

ঈশ্বর/আল্লাহকে নিয়ে ভাবলাম, অনেক চিন্তা করলাম- অনেক সন্দেহ তৈরী হয়েছে- কিন্তু মন থেকে পুরো নাস্তিক হতে পারছি না। বিজ্ঞানকেই আকড়ে ধরে চিন্তাগুলোকে সাজাবার চেষ্টা করছি- এইট/নাইন পর্যন্ত বিজ্ঞানের বই-ই ভরসা- অনেক কিছুই জানি না; তবু সেই সময়ে বস্তু-শক্তির নিত্যতা সূত্র আর গণিতের সংখ্যা রেখা দিয়ে নিজের মত কিছু যুক্তি বানিয়ে নিলাম। ডিটেইলস না জেনেই বিজ্ঞানের বিবর্তনকেই সঠিক মনে হতে থাকে। ক্লাসের বই এ ছিল, অভিযোজন। সেটাকে কেন্দ্র করে নিজের মত করে বিবর্তনবাদকে সাজালাম (আজ বুঝি ল্যামার্কীয় ভুল ধারণার মধ্যে ছিলাম)। কিন্তু তারপরেও নাস্তিকতার ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চিত হতে পারিনা।

সে সময়ের ডায়েরী এখনো মাঝে মধ্যে উল্টে পাল্টে নাড়ি। সেখানকার তিনটি লেখা এখানে তুলে দিচ্ছি- এটাতে আমার ট্রানজিশন পিরিয়ডের চিন্তার গতি বুঝা যেতে পারে। লেখা তিনটি সম্ভবত আমার ক্লাস নাইন/টেনের দিককার লিখা। তবে মজার ব্যাপার হলো- এগুলোর কোনটি কোনটি আমি পরে (ঐ নাইন টেনেই) আবার কেটে দিয়ে পাশে লিখেছি- “আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি”, “আমার পুরা বিশ্বাস আছে”, “আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দাও”… ইত্যাদি।

প্রথমটি: “আমার ধর্ম কি?”
আমার বাবা-মা দুজনই মুসলমান। সুতরাং জন্মের পর থেকেই আমিও মুসলমান ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে এই ধর্মের বেশ কয়েকটি ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করায় আমি কাফির। যেমন, খাবারের ব্যাপারেই ধরা যাক। কাছিম, কুচে বা যেকোন খাবার যা হিন্দুদের বা অন্য দেবদেবীর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে, সবই হারাম করা হয়েছে এই ধর্মে। কিন্তু এটা আমি মানতে পারিনা। কাছিম-ব্যঙ-কুচে হয়তো আমি ঘৃণার কারণে খেতে পারবো না, কিন্তু ওটা খেলেই আমার ধর্ম আমাকে ত্যাগ করবে, এটা আমি মানতে পারছি না। যেখানে অন্য ধর্মের লোকেরা এসব খেতে পারছে সেখানে মুসলমানেরা এসব খাবার খেতে পারবে না কেন? আর, দেবদেবীর নামে উৎসর্গ করলে তা খাওয়া যাবে এই নিয়মকে বলতে গেলে আমি ঘৃণা করি। কেননা এভাবে আমাদের ধর্মে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। কোন খাবার দেবদেবী আর জাহান্নামের (নরক) নামেই উৎসর্গ করা হোক- তাতে খাবারটির গুনগত মানের কোন পার্থক্য হয় না, এটা যেকেউ ১০০% নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারবে। তাহলে সেই খাবার খেতে অসুবিধা কোথায়? অবশ্য সকল ধর্মেই এ ধরণের কুসংষ্কার আছে। যেমন: হিন্দু ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। এটাও আমি মানতে পারিনা। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, বর্তমানে আমি কোন ধর্মেই নেই, অর্থাৎ আমি নাস্তিক। তবে ইসলাম ধর্মের বেশ কিছু জিনিস অবশ্য ভালোলাগে। তাই এই ধর্ম এখনো আমি পুরোপুরি ছাড়িনি।
সুতরাং আমি ৭০% নাস্তিক, এবং ২৯% মুসলমান, ০.৯% বৌদ্ধ ও ০.১% অন্যান্য।

দ্বিতীয়টি:
“এলেবেলে”

সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? এই প্রশ্নটা প্রায়শই আমার মনে উদিত হয়। নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করি, যদিও এখনো সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি।

আচ্ছা, আমাদের এই পৃথিবীকেই নিয়ে শুরু করা যাক। এই পৃথিবীর জন্ম কিভাবে? সঠিক উত্তর পাওয়া না গেলেও অনেকে মনে করেন- সূর্যেরই একটা অংশ পৃথিবী। তাহলে সূর্যের জন্ম কোথা থেকে বা কিভাবে? হয়তো বলা যাবে- সূর্য জন্ম নিয়েছে বড় কোন ধুমকেতু বা জ্যোতিস্ক থেকে। কিন্তু সেই বড় জ্যোতিস্কই বা কোথা থেকে এসেছে? ….. আমরা বস্তুর নিত্যতা সূত্র থেকে জানতে পারি সৃষ্টির পর থেকে কোন বস্তুর বা বস্তুর ভরের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, এসব গ্রহ-উপগ্রহ কোন বিন্দু থেকে উৎপন্ন হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এসব উৎপন্ন করতে নিশ্চয়ই কারো হাত আছে, তিনিই সৃষ্টিকর্তা।

উপরের আলোচনা হতে বুঝা গেল যে, কোন জিনিসের সৃষ্টির জন্যই প্রয়োজন সৃষ্টিকর্তা। তাহলে আরেকটি প্রশ্ন জাগে এই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকর্তা কে, তার সৃষ্টিকর্তা কে? এক্ষেত্রেও আমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছি। সুতরাং এতটুকু আলোচনা হতে আমরা যেমন নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না যে সৃষ্টিকর্তা নেই, তেমনি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না যে সৃষ্টিকর্তা আছে।

এবার আলোচনার একটু গভীরে প্রবেশ করি। সংখ্যারেখায় সবচেয়ে বড় সংখ্যা কত? আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারেনি সবচেয়ে বড় সংখ্যাটি কত, কেউ পারবেও না। তেমনি আমাদের মহাবিশ্বের বিস্তৃতি কত ব্যাপক তার শেষ কারও পক্ষে দেখা সম্ভব হবে না। একজন মানুষের মগজ তার তুলনায় নগন্য, মানুষটি আবার পৃথিবীর তুলনায় নগণ্য, পৃথিবী আবার সৌরজগতের তুলনায় নগন্য, সৌরজগৎ আবার আমাদের গ্যালাক্সির তুলনায় খুবই নগন্য। অসংখ্য গ্যালক্সির সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বজগতের তুলনায় সেই গ্যালাক্সি নগন্য, তেমনি অসংখ্য বিশ্বজগৎ নিয়ে তৈরী হয় আরেকটি জগৎ, তাদের নিয়ে তৈরী হয় আরো বিশাল একটি জগৎ……… আর বিশালতার মাঝে সৌরজগৎ বা পৃথিবীর সৃষ্টি কোন ঘটনাই না। বস্তুর নিত্যতা সূত্র থেকে জানি- বস্তুর রূপান্তর সম্ভব- সৃষ্টি বা ধংস হয় না। পৃথিবী বা সৌরজগৎ সৃষ্ট তেমনি একটি রূপান্তর। প্রকৃতপক্ষে এই ধরণের বিশ্বজগৎ অসীম-অনন্ত।

অনুরূপভাবে আমরা বিশ্বজগৎ সৃষ্টিকে অর্থাৎ এর সময়কালকেও আমরা অসীম বা অনন্ত বলতে পারি। অর্থাৎ অনন্তকাল ধরেই চলে আসছে এই প্রকৃতিজগৎ। সামগ্রিকভাবে (সম্পূর্ণ) বিশ্বজগৎ কিভাবে এবং কখনো সৃষ্টি হলো- তা ঐ সংখ্যারেখার সবচেয়ে বড় সংখ্যার মতই অসীম ও অনন্ত।

আবার সৃষ্টিকর্তা যদি সত্যিই থেকে থাকেন- তবে এক্ষেত্রেও প্রশ্ন রয়েছে, তিনি কে? তিনি কেমন? অর্থাৎ তার স্বরূপ কিরূপ? আমাদের পৃথিবীতে এতগুলো ধর্মের মধ্যে কোনটির প্রভু আসল সৃষ্টিকর্তা? সকল ধর্মের জন্ম ঘটনা থেকে জানা যায় যে, একজন রক্ত মাংসের মানুষ এসে সেই ধর্ম প্রবর্তন করেন। এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সেই ধর্মপ্রচারক তার নিজের সাথে প্রচারিত সৃষ্টিকর্তার যে একটা সম্পর্ক আছে তা প্রচার করেন। (যেমন মুহম্মদ সা আল্লাহর বন্ধু, যীশুখৃস্ট ঈশ্বরের পুত্র। কৃষ্ণ-দেবতা-দেবী তারা তো ভগবানেরই ভিন্ন রূপ)।

তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে প্রতিটা ধর্মেরই কেরামতি মৃত্যু বা মৃত্যু পরবর্তী জগৎ নিয়ে। কেননা মৃত্যু বা মৃত্যু পরর্বর্তী জগৎ সম্বন্ধে সবাই অজ্ঞ।
যাহোক, সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নেগেটিভ দিকে আছি ৬০%
এবং পজিটিভ দিকে ৪০%।

তৃতীয়টি (ঈষৎ সংক্ষেপিত)
“নাস্তিক বনাম গোঁড়া ধার্মিক”

আমার কেন জানি নাস্তিকদের একটা আলাদা টান রয়েছে, … গোড়া ধার্মিকদের প্রতি কেমন যেন একটা অবজ্ঞাভাব প্রকাশ করে। কারণ কি? কারণ সম্ভবত:
ক) নাস্তিকেরা সাহসী, গোড়া ধার্মিকেরা ভীতু। সাহস না থাকলে কেউ নাস্তিক হতে পারেনা।
খ)নাস্তিকদের চিন্তাশক্তি প্রখর। নাস্তিকেরা তীক্ষ্ণভাবে চিন্তা করতে পারে, যুক্তিতর্কের মাঝ্যমে তারা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে। কিন্তু গোঁড়া ধার্মিকরা কোন রকম যুক্তিতর্ক ছাড়াই অন্ধভাবে সৃষ্টিকর্তাকে মনে করতো!!!!!!! এদের অনেকের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার ভয় এমনভাবে গাঁথা যে তারা কোন যুক্তিতর্কই মানতে চায় না, তাদের চিন্তাগত শক্তি ভোঁতা হয়ে থাকে। তারা যা বিশ্বাস করে তা কখনোই প্রমাণ করতে পারে না….
গ) নাস্তিকেরা পরোপকারী কিন্তু গোড়া ধার্মিক: যারা নাস্তিক- তারা পরোপকারী, তারা পরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে। অপরপক্ষে ধর্মকর্ম সবসময়ই মানুষকে স্বার্থপর হতে শেখায়। একজন মুসলমান নামাজ, রোযা, হজ্জ পড়ে তার নিজের পূণ্য হাসিলের জন্য বা বেহেশত লাভের লোভে।

এগুলোকে একজন ক্লাস নাইন/টেনের ছেলের চিন্তাভাবনা হিসাবে দেখলেই বুঝা যাবে- কিভাবে কোন পদ্ধতিতে ঈশ্বর ভাবনার দীর্ঘদিনের জেঁকে বসা পাথরটি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে- নাস্তিকতার প্রতিই প্রধানত ঝোঁক- কিন্তু তারপরেও একটা ভয়: যদি শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর বলে কিছু থেকেই থাকে? ফলে আর পুরো নাস্তিক হওয়া হলো না। কোন দুর্বল মুহুর্তে- যেমন পরীক্ষার আগে আগে- যখন কোনভাবেই পড়ায় মন বসাতে পারছি না- তখন হয়তো ডায়েরীর এরকম নাস্তিক কথা কেটে তার পাশে বিশ্বাসের কথা লিখছি- এককথা অসংখ্যবার লিখছি (যেনবা জিকির করছি!), মাঝে মধ্যে ভালো করে নামাজ পড়া শুরু করছি…।

এমনই অস্থিরভাবে কেটেছে আমার এই ট্রানজিশন পিরিয়ডটা।

(২)

একদিন এক আস্তিক বন্ধুর সাথে তর্ক করছিলাম। আগেই বলেছি- এই তর্ক-বিতর্ক সবসময়ই আমার চিন্তাকে গুছিয়ে নিতে সাহায্য করেছে, বিপরীত যুক্তি-মত-প্রশ্ন আমাকে নতুন ভাবনার খোরাকই দিয়েছে। তো- সেই বন্ধুর সাথে যুক্তি-তর্ক করছি, আমি একেক করে বিজ্ঞানের কথা বলছি- সবগুলোতেই সে আল্লাহর মহিমা খুঁজে পাচ্ছে। এমনি যুক্তি করতে করতে অনেকটা বিরক্ত হয়ে আল্লাহকেই চ্যালেঞ্জ জানাই।

পাশে একটা ইট ছিল- সেটা ধরে একটু উচুতে নিয়ে ফেলে দিলাম। দিয়ে বললাম- আল্লাহ তো শুধু “হও” বললেই সব হয়ে যায়, তাঁর তো অসীম ক্ষমতা- এখন দেখি আল্লাহ কেমনে পারে- এই ইটকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে চালিত করুক। নিজে আবার আমি ইটকে উপরে তুলে বললাম- এই যে আমি কিন্তু ঠিকই উপরে তুলতে পারছি- কিন্তু আল্লাহ পারলো না- আবার ছেড়ে দিয়ে বলি, কই আল্লাহর ক্ষমতা তো কিছু দেখছি না। বন্ধুটি কি বলবে- খুঁজে পাচ্ছিল না, এবং ধীরে ধীরে ক্ষেপে উঠছিল। স্বীকার করছি- তার এই যে অক্ষম ক্রোধ, এটাতে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। (নাস্তিকতার শুরুর দিকে- আস্তিকরা যুক্তিতে না পেরে যখন ক্ষেপে যেত- সেটা অনেকদিন পর্যন্ত খুব আনন্দ দিত; কিন্তু একটা সময় এই এপ্রোচের ভুল ধরতে পারি- কেননা আস্তিকদের খেপানোর মাধ্যমে শুধু দূরত্বই তৈরী হতো- আর কিছু হতো না। এপ্রোচের কথা যদি বলতেই হয় বলবো আরজ আলী মাতুব্বরের কথা। যার কাছ থেকে এপ্রোচের স্টাইল সম্পর্কে শিখেছি ও এখনো শিখছি- তিনি আরজ আলী মাতুব্বর।)

এই যে আল্লাহকে অক্ষম বলে প্রমাণ করে দেয়া- সেটা শুরুতে যুক্তি-পাল্টা যুক্তির ধারাবাহিকতায় বলেছিলাম- অনেকটা ঝোঁকের মাথায়। সেটা আমার জন্য তখনও সহজ ছিল না, কারণ আমি তখনও আল্লাহর অনস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত নই। ভয় ছিল যে, সত্যি আল্লাহ যদি থেকে থাকেন- এবং এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে হঠাৎ কোন গজব নামিয়ে দেন!! তো প্রথম চ্যালেঞ্জ এই জিতে যাওয়ার পরে যেন সাহস আরো বাড়তে থাকে- চ্যালেঞ্জ বাড়াতে বাড়াতে একসময় নিজেকে নিয়েও চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকি। বলি- আল্লাহ যদি সত্যি থেকে থাকেন, তবে চ্যালেঞ্জ জানানচ্ছি- আমাকে এই মুহুর্তে টুপ করে মেরে ফেলুক.. ইত্যাদি। আস্তিক বন্ধুদের কেউ আমার জন্যে ভয়ে তওবা করে, আবার কেউবা যথারীতি ক্ষেপে ভূত!!

তো, কেউ কেউ যুক্তি করতো – আল্লাহর তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই- যার তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে? আমি বুঝতে পারি – আল্লাহর খেয়েদেয়ে কোন কাজই আসলে নেই। আল্লাহ যদি থেকেই থাকেন, প্রচণ্ড অথর্ব টাইপের কেউ- কেননা প্রকৃতির কোন একটি নিয়ম ভাঙ্গার মতো সামর্থ বা ক্ষমতা তার নেই। (অনেক পরে দেখি আইনস্টাইনও একই রকমের কথা বলেছেন!!)

এগুলো- প্রশ্ন হিসাবেই ছিল- কিন্তু কেউ তো তার জবাব দিতে পারতো না, উল্টো যা দিতো তা প্রশ্নকেই বরং বাড়িয়ে তুলতো। এর মধ্যেই আস্তিকদের কাছ থেকে আরেক ধরণের যুক্তির সাথে পরিচিত হলাম। সবকিছুই কোরআন-হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেয়া। আল্লাহ আছেন কিনা- এটার জবাব আল্লাহ কোরআনে কি বলেছেন সেটা দিয়ে দেয়া!!

ক্লাস টেনে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত একটা স্যারের কাছে ব্যাচে পড়তে যেতাম- মাঝখানে এশার নামাজ পড়ার জন্য স্যার সবাইকে ধরে মসজিদে নিয়ে যেত। আমি আর একদুজন যথারীতি ফাকি দিতাম। তো একদিন ব্যাচেরই এক আস্তিক বন্ধু স্যার মসজিদে যাওয়ার পরে আমাকেও মসজিদে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল। শেষে বলতেই হলো- আমার ধর্ম নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। সে খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- কি? আমার ইন্সট্যান্ট জবাব(মানে প্রশ্ন): “এই যে নামাজের আগে আমরা ওযু করি- ওযু ভঙ্গের অন্যতম কারণ বায়ু নির্গত করা ও ওযু ভেঙ্গে গেলে নিয়ম আবার ওযু করা। এখন, ধর- আমি মাত্রই ওযু করেছি- এখনও আমার হাত-পা-মুখ ভেজা, এমন সময় আমার বায়ু নির্গত হলো- আমাকে কেন ওযুর নাম করে আবার সেই ভেজা হাত-পাগুলোই ধুতে হবে? এমনতো নয় যে- আমি পশ্চাদ্দেশ পরিষ্কার করার মাধ্যমে ওযু করছি?” বেচারি জবাব দিতে না পেরে স্যারকে জানিয়ে দিল। পিঠে বেতের বাড়ি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম- কিন্তু সে পথে না গিয়ে স্যার জবাব দেয়ার চেষ্টা করলেন। স্যার কোরআন-হাদীস থেকে কোট করলেন- পুরো আরবীতে, মুখস্থ। বাংলায় জানালেন- আল্লাহ জানিয়েছেন- পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ, ফলে মুমীনদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, প্রতিদিন গোসল করা- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে ওযু করার মাধ্যমে মুসল্লীরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে…… ইত্যাদি। কিন্তু আমার জবাব আর পাওয়া হলো না। যাহোক- ততদিনে এধরণের যুক্তি শুনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম- কি আর করা….।

এভাবেই বিভিন্ন টুকরো টুকরো ঘটনায়-ভাবনায়-প্রশ্নে মোটাদাগে আমার নাস্তিকতার সূত্রপাত। অন্য অনেকের ক্ষেত্রে যেমন আরজ আলী, হুমায়ুন আজাদ, আহমদ শরীফ প্রমুখের বই পড়ে বিশ্বাসে আঘাত খাওয়া, প্রশ্ন তৈরী হওয়া- আমার ক্ষেত্রে তেমনটি নয়। এনারা আমার জীবনে এসেছেন- নাস্তিক হওয়ার অনেক পরে। এঁদের কাছেও আমার অবশ্যই অনেক ঋণ, তাঁদের কাছ থেকে আমি অনেক যুক্তি পেয়েছি। কিন্তু নাস্তিকতার প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁদের ভূমিকা নেই। ভূমিকা যদি কারও থেকেই থাকে- তবে এ মুহুর্তে তিনজনের নাম বলবো- কাজী নজরুল ইসলাম- হুমায়ুন আহমেদ ও তসলিমা নাসরিনের।

পরিচিত অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের দেখেছি- প্রিয় কবি বা লেখকের কথা আসলেই যার যার ধর্ম অনুযায়ী প্রিয় নির্ধারিত হয়। মুসলমান বন্ধুর অবধারিত নজরুল, আর হিন্দু বন্ধুটি রবীন্দ্রনাথ বলতে অজ্ঞান। এটা প্রায় কমন। শুধু এতটুকু থাকলেই হতো- কিন্তু দেখা গেল, মুসলমান বন্ধুরা একটা বড় অংশই রবীন্দ্রনাথ বিরোধি আর হিন্দু বন্ধুদের বড় অংশ নজরুল বিরোধি। আমি ক্লাস এইট/নাইন/টেনের কথা বলছি। আমারও সে সময়ে প্রিয় কবি ছিল সুকান্ত আর নজরুল- বলাই বাহুল্য তেজী কবিতা সেসময়ে পছন্দ করতাম। নজরুল প্রিয় হলেও- ধর্মানুযায়ী এই ভালো লাগালাগিতে বিরক্তি তৈরি হতো। অনেকে নজরুলের হামদ-নাতের কথা, ইসলামী গানের কথা বলতো। মেলাতে পারতাম না। প্রিয় কবিতা “বিদ্রোহী”র কিছু লাইন খুব ভালো লাগতো- “ভয়ে হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাপিয়া”, “আমি জাহান্নামের আগুনে বসি হাসি পুষ্পের হাসি”, “ধরি জীব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি”, “ভগবান বুকে একে দেই পদচিহ্ন”। এলাইন কটি থেকে একটা ধারণা ছিল- তিনি অন্যরকম। পরে এক কাকুর (বাবার বন্ধু) কাছ থেকে শুনি- নজরুলের বিরুদ্ধেও মুরতাদ/কাফির ঘোষনা হয়েছিল। তিনি যেমন হামদ-নাত লিখেছেন- লিখেছেন রাধা-কৃষ্ণ কীর্তন। শুনে খুব ভালো লাগে।

হুমায়ুন আহমেদের “শ্রাবণ মেঘের দিন” বইটিতে দুটি বাক্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছি। “আল্লাহর অংক জ্ঞান কাঁচা” আর “ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেনি- ম্যান ক্রিয়েটেড গড”। সুরা নিসা মিলিয়ে দেখি আসলেই আল্লাহর (প্রকৃতপক্ষে নবীজীর) অংকজ্ঞান মারাত্মক কাঁচা। আর- দ্বিতীয় বাক্যটি দীর্ঘদিন আমার কানে বাজতো। এবং অনুরূপ বাক্য পরে পেয়েছি- নজরুলের কবিতায়- যার জন্য তাকে মুরতাদ ঘোষনার দাবি তুলেছিল মোল্লারা:
“মানুষ এনেছে গ্রন্থ; –
গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!”

বা আরেক জায়গায় দেখেছিলাম- “পথ মানুষের সৃষ্টি- উল্টোটা নয়”। অর্থাৎ চালু একটা পথ অনেক পথিককে কাছে টানে ঠিকই- পথ আছে জন্যই সে পথ দিয়ে পথিক চলাচল করে বটেই- কিন্তু শুরুর কথা যদি আমরা দেখি- অবশ্যই একদম শুরুতে মানুষের দ্বারাই পথের সৃষ্টি হয়েছে। “মুহম্মদ সা:-ই ইসলাম- আল্লাহ- কোরআন প্রভৃতির স্রষ্টা” – এই ভাবনাটি অনেক বেশী যৌক্তিক মনে হতে লাগলো।

আমি যখন ক্লাস নাইনে- তখন সারাদেশে ঘাদানিক এর যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ব্যাপক আন্দোলন চলছে। আমি আমার এলাকাতে বসেই সে আন্দোলনের তেজ টের পাচ্ছিলাম, ঘাদানিক এর সিগনেচার ক্যাম্পেইন আমার জীবনের প্রথম রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। জামাত উল্টোদিকে ব্লাসফেমী আইনের জন্য আন্দোলন করছে, তসলিমা নাসরিনকে মুরতাদ ঘোষণার জন্য আন্দোলন করছে। এসময়টিতে আমার অনেকের সাথে এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রচুর তর্ক করতে হয়েছে এবং তসলিমাকে নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে তার বই পড়া আরম্ভ করে দেই। তার নির্বাচিত কলাম বলতে গেলে গোগ্রাসে গিলি। এখান থেকে প্রচুর আয়াত-হাদীস টুকে রাখি, মুখস্থ করি। মুসলমান মাত্রেরই মুহম্মদ সা এর প্রতি দারুন শ্রদ্ধা ও ভক্তি থাকে, কলেমা তাইয়েবা থেকে সকল মুসলমান জানে শুধু আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আনলেই হবে না- নবীজীকেও রাসুল হিসাবে মানলে পরে ঈমান পূর্ণ হবে। সে হিসাবে আমার নিজেরও নবীজীর প্রতি ভক্তির জায়গা ছিল। মনে হতো- নবীজী যদি সত্যি থেকে থাকেন- তবে কোরআনও আছে। কোরআন থাকলে তো আল্লাহও আছে- কেননা নবীজী তো আর মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। এই গদগদ ভক্তিভাব কাটাতে তসলিমা নাসরিন কিছুটা হলেও সাহায্য করেছেন। তার আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে ইসলাম-কোরআন-মোহাম্মদ সা কে উড়িয়ে দেয়া, বিশেষ করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে কোরআন-হাদীস দেখিয়ে নবীজীর একের পর এক বিয়ে করা, নারীদের প্রতি অবমাননাকর হাদীস-কোরআন লিপিবদ্ধ করা এসব আমার খুব কাজে দেয়। মানে আগে একটা ভয় কাজ করতো, সেই ভয়টা দূরীকরণে তসলিমা নাসরিনের সেই আক্রমণাত্মক লেখাগুলো আমাকে অনেক সাহায্য করে!

 

এমন করে বলতে গেলে হয়তো আরো অনেক কিছুই বলা যেতে পারে। তবে মনে হয়- এরই মধ্যে যথেষ্ট বলেছি, পাঠকেরাও যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে কৃতজ্ঞ করেছেন। এই হলো আমার অবিশ্বাসের শুরুর গল্প। পুরোপুরি- দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠি বলা যায় এসএসসি পরীক্ষার পরে। এসময়টায় অনেক বই (গল্প-উপন্যাস) হাতে পাই, একাডেমিক পড়ার চাপবিহীন কিছু ফ্রি সময়ও পাই- ফলে চাপমুক্ত ভাবার অবকাশও তৈরী হয়। প্রথম ভাবনাটা আসে- পরীক্ষার আগে আগে ভয়ে অস্থিরতায় অনেকটা কুপোকাত হওয়ার জন্য একটা লজ্জাবোধ। সেখান থেকে আরেকটা চিন্তা মাথায় আসে- সেটা হলো: বুঝতে পারি- ঈশ্বর বিশ্বাস মানুষের দুর্বল মুহুর্তের সঙ্গী। অবলম্বনহীন অবস্থায় মানসিক শক্তি পাওয়ার একটা বায়বীয় অবলম্বন মাত্র। নিজেকে এমন দুর্বল ভাবতে ইচ্ছা করলো না। এই চিন্তাকে সাথে নিয়ে আল্লাহ বা ঈশ্বর, কোরআন-ইসলাম-মুহম্মদ সা সবকিছু নিয়ে আবার ভালো করে ভাবতে লাগলাম- শুরু শেষ পর্যন্ত। একসময় বুঝতে পারলাম- এতদিন অহেতুক ভয় পেয়েছি- দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সব ছুড়ে ফেলে ঝেড়ে কাশার সময় এসেছে।

ঝেড়ে কাশলাম।

সবাইকে ধন্যবাদ।

(প্রথম প্রকাশঃ সামহোয়ারইনব্লগ। সেই ব্লগেই অনেক অবিশ্বাসী, সংশয়বাদী ব্লগাররা মিলে নিজেদের নাস্তিক হওয়ার গল্পগুলো লেখছিলাম, ইচ্ছে ছিল - একটা সংকলন বের করার, দরকারে একটা বই প্রকাশ করার। একজন ব্লগার এরকম অনেকগুলো লেখা একটা ওয়েবসাইট বানিয়ে তুলেও রেখেছিলেন। সেই ওয়েবসাইটটা এখন নেই। ২০১৩-২০১৪ সালের দিকে সামু থেকে আমার অনেক লেখার মত এই লেখাটা লাপাত্তা করেছিলাম। ২০০৯ সালে লেখাটা পাঁচ পর্বে মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশ করছিলাম বলে পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি!)