সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০০৯

আমার অবিশ্বাসের সূত্রপাত

এক

শুরুটা বলতে হবে পরিবারের হাত ধরেই….

জন্মাবার পরে আমার বাবা-মা আমাকে একটি নিখাঁদ বাংলা নাম দেন। এবং ছোটবেলায় যে এলাকায় বেড়ে উঠি সেখানে বেশ কিছু হিন্দু পরিবার ছিল, যাদের সাথে খুব স্বাভাবিক-সাধারণ সুসম্পর্ক ছিল- মানে পুঁজায় তাদের বাসায় আমাদের দাওয়াত খাওয়া- আমাদের ঈদে আমাদের বাসায় তাদের দাওয়াত খাওয়াটা নৈমত্তিক বিষয় ছিল। এটা আপাতভাবে সামান্য ব্যাপার মনে হতে পারে, তবে আমি মনে করি- আমার নিজের অসাম্প্রদায়িক হওয়ার পেছনে এ দুটি বিষয়ের ব্যাপক ভূমিকা আছে।

আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (বেবি-ওয়ান-টু) এক হিন্দু শিক্ষক আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন- এবং মাঝে মধ্যে তার সাথে স্কুলে যাওয়া আসা করতাম। তো, আমার বাংলা তথা হিন্দু নাম এবং একজন হিন্দু শিক্ষকের সাথে স্কুলে যাতায়াতের কারণে সেই ওয়ান-টু তেই ক্লাসের বিভিন্ন ছেলেমেয়ের কাছ থেকে একটা ছড়া মাঝে মধ্যেই শুনতে হতো- “হিন্দু হিন্দু তুলসীর পাতা, হিন্দু খায় গরুর মাথা”। আমাকে হিন্দু হিন্দু বলে খেপানো হতো (খেপাতো বাচ্চারাই- এখন যখন ভাবি, শিউরে উঠি- কত বাচ্চাকাল থেকেই এরা সাম্প্রদায়িক হয়ে গড়ে উঠে!!)। “হিন্দু” যেন একটা গালি!! আমার নামটিই যেন আমাকে বাচিয়ে দেয় ওদের মত সাম্প্রদায়িক হওয়ার হাত থেকে- এবং সেই বাচ্চাকাল থেকেই এই মুসলমান-হিন্দু বিভেদ মনে কষ্টের অনুভূতিই তৈরী করতো।

 

কিন্তু নাস্তিক্যের পাঠ আরো পরের ঘটনা, আরো কিছুটা বড় হয়ে।
 

ক্লাসের ধর্মের বই খুব মনোযোগ সহাকারে পড়া ও খুব আগ্রহ নিয়ে কায়দা-আমপারা- তারপরে কোরআন পড়াও শিখে নেই। পাড়ায় কম্পিটিশন করে নামাজ পড়া, বাসায় জোর করে রোযা রাখা এসবও চলতে থাকে। আর ধর্মের প্রতি এই আগ্রহের কারণে এমনটা অবস্থা হলো যে- ধর্মীয় বা ইসলাম সংক্রান্ত বই পেলেই তা মনোযোগ সহকারে পড়তাম। এটা করতে গিয়ে- একদম প্রাথমিক কিছু কিছু প্রশ্নও মনে তৈরী হতে থাকে।

 

তবে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সর্বপ্রথম মাথায় আসে- সেটা এখনো মনে আছে: ঠিক প্রশ্ন না- বলা যায় একটা আঘাত। তখন সম্ভবত ক্লাস ফাইভ কি ফোরে পড়ি। বাসায় এক স্যার বিজ্ঞান-অংক করাতেন, নামাজের সময় হলে একসাথে নিয়ে নামাজ পড়ান। ওনার সংস্পর্শেই বলা যায় নামাজের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস হয়েছিলাম। সেই স্যার একদিন বিজ্ঞান পড়াচ্ছিলেন- তো সূর্য ও পৃথিবীর আবর্তনের বিষয়টি বই এ যা ছিল; ঠিক বিপরীত একটি আলোচনা তিনি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞান যতই বলুক পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরুক; আসলে সূর্যই ঘুরে। কোরআনে এটা আছে- আল্লাহর সবকিছু সৃষ্টির মূলে আছে মানুষ- মানুষের পৃথিবীকেই কেন্দ্র করেই সূর্য ঘুরছে।

 

এই কথায় ঠিকই একটা ধাক্কা খাই। কোনটি ঠিক? বিজ্ঞান না ধর্ম? ওনার কথা পুরো বিশ্বাস করতে পারলাম না- আবার অবিশ্বাসও করতে পারিনি। মাথার মধ্যে থেকে গিয়েছিল। আরো পরে অবশ্য অন্য ইসলামী আলোচনায় দেখেছি- কোরআন এ কোথাও বলা হয়নি যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে- বরং পৃথিবীর ঘুর্ণনের ব্যাপারেই নাকি কোরআনের আলোচনায় সমর্থন পাওয়া যায়, তথাপি মনের মধ্যে এটি ভালো দাগ ফেলেছিল।

 

একজন মানুষের ভীষণ ভূমিকা আছে। তিনি সরাসরি নাস্তিকতার কোন পাঠ আমাকে দেননি- তবে বিজ্ঞানমনস্ক করার ব্যাপারে তার অবদান প্রথমেই স্বীকার করি। তিনি আমার এক দূরসম্পর্কীয় কাকা, আমাদের গ্রামের বাড়ির এক মাদ্রাসার বিজ্ঞানের শিক্ষক। এবং একজন বিজ্ঞান সাধক। বিজ্ঞান পাগল এই মানুষটি বিজ্ঞান সম্পর্কিত যে কোন বই পেলেই হলো- তা সংগ্রহ করেন এবং গভীর মনোযোগের সাথে পড়েন, নিজ হাতে টেলিস্কোপ, রেডিও… এরকম নানারকম জিনিস তৈরী করেন- তার সংস্পর্শেই আমার নিজেরো বিজ্ঞানের প্রতি একটা ভালোবাসা জন্মে।

 

একদিন তার সাথে আলোচনা কালে তিনি (তখন সম্ভবত সেভেন-এইটে পড়ি) বললেন,

“বিজ্ঞানের একদম ছোট থেকে বড় যেকোন বিষয়ের আলোচনায় আল্লাহ-ভগবান-দেবতা-ফেরেশতা কারোরই কোন আলোচনা পাবেনা। বৃষ্টি কিভাবে হয়? এটার জবাবে যে পানি চক্র বা অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে যত যাই আলোচনা করা হবে- সেখানে কিন্তু কোন মিকাইলের বা কোন অতিপ্রাকৃত কোন কিছুর আলোচনা নেই।”
 

এই কথাটি আমার সামনে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দেয় বলা যায়। অনেক অনেক ভাবতে থাকি। এর আগে- ধর্ম ও বিজ্ঞানের যে দ্বন্দ্ব তৈরী হয়েছিল- সেখানে নিজের পক্ষপাত বিজ্ঞানের প্রতি ঝুকতে থাকে।

 

দুই

এই ব্যাপারটি লিখতে গিয়ে দেখছি- ঠিক গুছিয়ে লেখতে পারছি না। আসলে ছোটবেলাটা জুড়ে বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন বিষয়, বিভিন্ন প্রশ্ন এর মিলিত প্রভাবেই আমার অবিশ্বাসের সূত্রপাত- এবং লিখতে গিয়ে বুঝছি এটা অবশ্যই সরল রৈখিক নয়। বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন ঘটনাকে তাই আনতেই হচ্ছে, আর সেগুলো যেহেতু ধারাবাহিক নয়- তাই সেগুলোকে গুছানোর দায়িত্ব পাঠকের হাতে ছেড়ে দেয়া ছাড়া কোন উপায়ও দেখছি না।
 
 ক্লাস থ্রি’র দিকের ঘটনা। পাড়ার মসজিদে ইমাম হুজুর আসরের নামাজের পরে আরবী শেখান। অনেক পিচ্চি-পাচ্চার সাথে আমিও গেলাম। যদিও তখন আমি কায়দা শেষ করে আমপাড়া পড়া শিখেছি, তথাপি সবার সাথে কোরাস করে আলিফ যাবর আ, বা যাবর বা…. এসব পড়তে লাগলাম। যেহেতু পারি- সেহেতু একটু হালকা ভাব ছিল- বসে বসে মাঝে মধ্যে দুষ্টামিও করতাম। এখানে দুটি ঘটনা ঘটে। একটি হলো- প্রথমদিনই আমার নাম শুনে হুজুর জানান দেন যে, এই হিন্দু নাম রাখা চলবে না। শেষ বিচারের দিনে বেহেশতে যাবার শেষ উপায় হলো একটা মুসলমানী নাম, আরবী নাম। আমার নাম পাল্টে তিনি করে দিলেন কবির হাসান। দ্বিতীয় ঘটনা হলো- একদিন পেশ সম্পর্কে পড়াচ্ছিলেন, তো গাইন পেশ হয় “গু”। হুট করে মাথায় আসলো- “গু”। আমি আশপাশের বাচ্চাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম গাইন পেশ কি হয়? জবাবে যখন বলছে- “গু” , তখন আমার কি ব্যাপক হাসি। কিন্তু সমস্যা হলো- একজন হঠাৎ করেই হুজুরকে জানিয়ে দেয়, এবং হুজুর প্রচণ্ড রুষ্ট হোন। আরবী ভাষা হলো আল্লাহর ভাষা- সেই ভাষাকে নিয়ে মশকরা! আমাকে দারুন বকা-ঝকা করেন, অনেকগুলো ছেলে-মেয়ের মাঝে খুব অপমান করেন। সেদিন থেকে আর ওখানে যেতে পারিনি।
 
ঘটনাটি মাথায় থেকে যায়। আল্লাহর প্রতি, আরবী ভাষার প্রতি তখন আমার আসলেই খুব শ্রদ্ধা ছিল; কিছুদিন পরে কোরআন পড়া শিখতে হবে- এমন তাগিদ বোধ করতাম। আমি বুঝতেই পারিনি- গাইন পেশ গু- এটা নিয়ে হাসলে যে আল্লাহ বা আরবী ভাষাকে মশকরা করা হয়! আমি সেরকম মশকরা করার কথা তখন কল্পনাও করতে পারতাম না, সেরকম সাহস আমার ছিলই না।
 
ঐ বয়সে এই ঘটনা আমার মনের মধ্যে ভালো প্রভাব ফেলে, অনেক দিনই সেই ঘটনার কথা মনে পড়তো, ভাবতাম এবং একসময় এটা মনে হতে লাগলো যে, আরবী ভাষা তো একটা ভাষা বিশেষ, ভাষা ছাড়া কিছুই না- এবং এই ভাষা দিয়ে “গু”-ও লেখা যায়। অনেক পরে যখন দেখলাম আরবী ভাষাতেও গালিগালাজ আছে, অমুক-তমুকের বাচ্চা- বেশ্যা, বিভিন্ন গালিমূলক অঙ্গবিশেষ…. এসবের প্রচলনও আছে; তখন সেই ছোটবেলাকার কথা মনে পড়লে দারুন হাসি পেয়েছিল।
 
আর, নামের বিষয়টি তো খুব সাধারণ ঘটনা। নাম শোনার পরে- আমি হিন্দু না মুসলমান এই প্রশ্ন এখনো শুনি। ছোটবেলায় স্কুলে এক স্যারকে মুহম্মদ সহকারে আমার নামটি বলায় তিনি জানিয়ে দিলেন- আমার নাম নাকি মুসলমান- হিন্দু এবং খৃস্টান নামের সমাহার। আরেক স্যার আমার বাবার নাম শুনলেন, এটি নির্ভেজাল আরবী নাম। শুনে রায় দিলেন- আমার দাদা তো ভালোই ছিলেন- কিন্তু বাবার মাথায় এমন ভূত চাপলো কি করে? কিশোর বয়সে এসব কিছুই হজম করে যেতে হয়েছে- যদিও তখনও আমি আস্তিক ছিলাম এবং মোটামুটি নিয়মিত নামাজ-রোযা পালনের চেষ্টা করতাম।
 
একটা সুবিধা অবশ্য ছিল- সেটা হলো বাবা-মা’র কাছ থেকে একটা জিনিস পেয়েছিলাম- সেটা হলো আমার বাংলা নাম নিয়ে গর্ব। নিজের ভাষায় নাম কতজনেরই বা আছে? আর এটাই আমাকে টিকিয়ে দিল ও নতুন অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিল।
 
 : বাংলা ভাষা কেন শুধু হিন্দুর ভাষা হতে যাবে? প্রিন্স- ডলার প্রভৃতি ইংরেজী নাম বা অন্য উর্দু-ফারসী নাম রাখলে তো তাকে কেউ বলছে না যে আরবি নাম রাখো?
 
 অনেক কিছু মুখ বুজে সহ্য করে গেলেও একটা সময় তর্ক করা আরম্ভ করে দেই। স্যার গোত্রের নয় বা সমবয়সী এমনদের সাথে। ভাষা নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে একসময় দেখি যুক্তি করছি: “আরবী তো আমরা বুঝিনা- ফলে নাবুঝে সেটা আউরিয়ে কিভাব আল্লাহর ইবাদত সম্ভব?” তখন থেকে শুরু- নামাজ রোযার নিয়্যত, বিভিন্ন দোআ আরবীর পরিবর্তে বাংলায় পড়া (যদিও নামাজে সুরা আরবীতেই পড়তাম- তারপরেও মনে হতো এটাও বাংলায় পড়লে সমস্যা কি?- এ ব্যাপারে অবশ্য হুজুরদের সমর্থন পাইনি)। এক সময় দেখা গেল- কোরআন খতম দেয়ার আগের সেই উত্তেজনা- আগ্রহ উবে গেল, ৫/৬ পারা শেষ করেছি এরকম অবস্থায় কোরআন পড়া বন্ধ করে দেই; বাংলা কোরআন যোগাড় করি এবং বাংলায় পড়তে থাকি। (আগে সুর করে এবং সহী করে পড়ার ব্যাপারে আমার বিশেষ সুনাম ছিল এবং আমি এতবার কোরআন খতম দিয়েছি- এটা প্রশংসা সহকারে প্রচার করা হতো- ফলে রোযার মাস এলে এই খতমের প্রতি বিশেষ আগ্রহ তো জাগতোই)।
 
 এই বাংলায় কোরআন পড়াটা আমার পক্ষে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ করে দেয়।

 

তিন

 প্রথম পর্বে জানিয়েছিলাম আমার এক বিজ্ঞান পাগল কাকার কথা, যার মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতার শুরু। বিজ্ঞানকে দিন দিন আকড়ে ধরতে লাগলাম। বাসায় রাখা হতো দৈনিক সংবাদ, তার প্রতি মঙ্গলবার বেরুতো বিজ্ঞান পাতা (পরে তা দু পৃষ্ঠার করেছিল)। ঐ পাতাটি শুধু গোগ্রাসে গিলতাম না- সংগ্রহও করতাম, সংবাদের বিজ্ঞান পাতা দিয়ে সুটকেস ভরিয়ে ফেলেছিলাম। কত ক যে জানতে পেরেছিলাম ঐটুকু বয়সে! হয়তো অনেক কিছু বুঝিনি, তবে দুনিয়াটা যে আমার আগের জানা ছোট্ট গণ্ডির নয়, তার কত বৈচিত্র আছে- দুনিয়ার বা বিশ্ব জগতের সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা কার্যকরণ সম্পর্ক আছে- এটা বুঝতে শিখতে থাকি।

এসময় আরেকটি কাজও করতে থাকি- চোখের সামনে বিভিন্ন ঘটনার বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা করা আরম্ভ করি। এবং একসময় নিশ্চিত হতে পারি যে, অলৌকিক বলে কিছু থাকতে পারে না। (এই সিদ্ধান্তে আসার পেছনে অবদান প্রথমত সেই কাকার, তারপরে সংবাদের বিজ্ঞান পাতার এবং আরেকটু পরে- মানে বড় হয়ে প্রবীর ঘোষের “অলৌকিক নয় লৌকিক” বই পড়ার পরে আর কোন সন্দেহই থাকে না)।

ফলে, এই সময়টাতে বিভিন্ন সময়ে দাদী-নানী প্রমুখদের কাছ থেকে শুনা এবং এক সময় বিশ্বাস করা ভূত-প্রেত-জ্বিন-পরীদের অবিশ্বাস করা আরম্ভ করি, আমাদের এলাকায় একটি বড় পেয়ারা গাছে জ্বিন/ভূতের গল্প প্রচলিত ছিল- ভর দুপুরে বা আযানের সময় গাছে উঠে থাকলে জ্বিন/ভূত এসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, এটাও আমাদের বয়সী প্রায় সবাই বিশ্বাস করতাম, সাহস করে উঠে দেখলাম- কিছুই হলো না (প্রথমবার প্রচণ্ড ভয় অবশ্য পেয়েছিলাম)।

একবার সেই কাকা আরেকটা গল্প শোনালেন। গ্রামের একলোক নাকি গল্প করছিল- বিমান ক্রাশে জিয়াউল হকের শরীর টুকরা টুকরা হয়ে গিয়েছিল- কিন্তু তার পকেট-কোরআন অক্ষত ছিল, কোরআন কখনো নষ্ট হতে পারে না, আগুনে পুড়তে পারে না … ইত্যাদি। এটা শুনে তিনি আস্ত কোরআন নিয়ে এসে সেখানকার কয়েকপাতা ছিড়ে আগুন ধরিয়ে দেখিয়ে দেন- কোরআনও তো কাগজে ছাপা অক্ষর বিশেষ, এবং তা পুড়ানো যেতে পারে। কিন্তু কোরআন ছেড়া ও পুড়ানোয় গুনাহ হবে কি না জিজ্ঞেস করায় জানালেন- আল্লাহ যদি সত্যি থেকেই থাকেন- তিনি মানুষের তৈরী ঐ কাগজের চেয়ে সত্যের ধারক হওয়ার কথা। মনে গেথে যায়।

বিশ্বাস করতাম “সুরা এখলাস উল্টাদিক করে পড়লে” চাইলে ইঁদুর হওয়া যায়, বিজ্ঞানের বদৌলতে সেটাকে সন্দেহ করতে শিখলাম। প্রমাণের জন্য উল্টো করে পড়ে দেখলাম, গুনাহর ভয় কাটানোর জন্য কাকার সেই যুক্তির কথা ভাবলাম। দেখা গেল- ইঁদুর হইনি। এমন অনেক সংষ্কারই ধীরে ধীরে মাথা থেকে দূর হতে থাকে। অবশ্য এক্ষেত্রে “সংবাদ” এর বিজ্ঞান পাতার ভূমিকা ছিল- সেখানে প্রচলিত কুসংষ্কার নিয়ে সত্যিকার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি কি হতে পারে সেরকম লেখা নিয়মিত ছাপাতো। এই মুহুর্তে সাপ ও ওঝাদের নিয়ে একটা বিশাল লেখা এবং জ্যোতিশাস্ত্র ও রাশিফল নিয়ে বিশাল লেখার কথা মনে পড়ছে।

একদিনের কথা। প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে, যথারীতি পাড়ার এক মাঝবয়স্ক ভদ্রলোক চিৎকার করে আযান দিতেছেন। আযান দিলে নাকি ঝড় থেমে যায়, ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি করার সম্ভাবনা কমে যায়। আগে বিশ্বাস করলে- তখন আমি ঝড়ের প্রকৃত কারণ জানি (ক্লাসের বিজ্ঞান বইয়েই ছিল), ঝড়ের সাথে যে আযানের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না এটাও নিশ্চিত। কিন্তু ঐ সময় আমার উপস্থিতি প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারটির বাসায় ছিল। সেখানে এই কথা বলার সাথে সাথে আমাকে দিদি-কাকি দারুনভাবে সাপোর্ট করলেন- মনে মনে খুশী হলাম এই ভেবে যাক এনারা অনেক বিজ্ঞানমনস্ক। কিন্তু দুদিন পরেই তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখি তারা এক কালী মন্দিরের কথা বলছেন- যার চারদিকে সাত বার ঘুরলে নাকি কেউ বাঁচতে পারে না। যতই বিজ্ঞানের কথা বলি- ওনারা ততই তাদের বিশ্বাসের কথা বলতে থাকেন। মেজাজ-মুজাজ খারাপ করে শেষ পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ জানাই- সেখানে যাবো। পরে অবশ্য আর যাওয়া হয়নি- আমার মায়ের জন্য; মায়ের যুক্তি- কালীর অলৌকিক ক্ষমতা না থাকুক- মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা তো মানুষের থাকতে পারে! (আসলে ঐ সময়ে তখনও প্রবীর ঘোষ পড়া ছিল না- ফলে মায়ের কথায় সহজেই ভয় পেয়ে থেমে গিয়েছিলাম….)

সেদিন কালীর অলৌকিকত্ব নিয়ে কাজ করার সুযোগ না পেলেও, কিছুদিনের মধ্যেই দুটো ঘটনা কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাই। একটা মাংসে আল্লাহ লেখা, আরেকটা একজনের বাড়িতে বিগত এক পীর সাহেবের কবর জেগে উঠা। দুটি ঘটনাই হাজার হাজার মানুষের সাথে সাথে আমিও প্রত্যক্ষ করার জন্য ছুটে যাই, কিন্তু দুঃখের কথা, অন্য সকলের মত এতে আমার ঈমান পোক্ত হয়নি- বরং ধাপ্পাবাজিই মনে হয়েছে (আমি তখনও স্কুল পড়ুয়া, আমার কথায় কান দেয়ার মত কেউ ছিল না- ফলে আমার পক্ষে ধাপ্পাবাজিটা পুরো উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি; কেবল কিছু বন্ধুবান্ধব, পাড়ার কিছু লোকের সাথে যুক্তি-তর্ক করেছি)।

ঐ মাংসে আল্লাহ লেখা দেখে তো এক বন্ধু মাংস খাওয়াই বাদ দিয়ে দিল- মাংস খেতে গেলেই নাকি তার মনে হতো- এখানে যদি আল্লাহ লেখা থাকে- তাহলে সেই আল্লাহ লেখাঅ’লা মাংস খেয়ে ফেললে কতই না গুনাহ হবে! তার সাথে তর্ক হলো। বললাম- “আল্লাহ লেখাটার দিকে ভালো করে খেয়াল করো। পাশাপাশি চারটা খাড়া দাগ বা লাইনের বামের তিনটার নিচের দিকে যদি কোনরকমে মিলে যায়- তবে সেটাকেই আল্লাহ বলে চালানো যায় কি-না?” মজার ব্যাপার হলো- অলৌকিক যে মাংস খণ্ডটি দেখতে গিয়েছিলাম- সেটাতে এরকমই ছিল- সর্ববামে ‘হা’ বা ‘হু’ ছিলই না। বন্ধুকে বললাম- “এবারে গরু-ছাগলের মাংসের দিকে খেয়াল করো- সেখানে আড়াআড়ি অনেক দাগ থাকে- ফলে এগুলো থেকে সহজেই যেকেউ চাইলেই আল্লাহ বানাতে পারবে। সে হিসাবে আমরা প্রতিবার মাংস ভক্ষণেই অনেকবার আল্লাহকে হজম করে ফেলছি”। তাকে আরো জানালাম- “ঐ একই নিয়মে চাইলে মাংসেখণ্ডে ‘লাইলাহা’ মানে ‘কোন মাবুদ নাই’ এটাও খুঁজে বের করা সম্ভব”। তর্কের আউটপুট হলো- বন্ধুটি নাস্তিক না হয়ে গেলেও (নাস্তিক হবে কি- তখনও তো আমি পুরো নাস্তিক নই)- আবার মাংস খাওয়া শুরু করে দেয়।

আর- পীর বাবার কবরের ঘটনাটি হলো- ঐ ঘরের পাশে এক বড় গাছের শিকড়ের কীর্তি (কবরটা ভেঙ্গে বা জায়গাটা খুড়তে পারলেই ভালো প্রমান হয়ে যেত- সেটা অ্যারেঞ্জ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না- আমি কেবল নিজের যুক্তির জায়গাটা পরিষ্কার করতে পেরেছিলাম)। এর সাথে ঐ বাড়ির এক বৃদ্ধা মহিলার স্বপ্নে পীরবাবার হাজির হওয়া ও নানান রকম নির্দেশনা দেয়াটাও আমার খুব সাধারণ ও স্বাভাবিক মনে হয়েছে। কেননা- এরচেয়েও উদ্ভট টাইপের স্বপ্ন আমরা অনেকেই দেখি।

 

 চার

 

দ্বিতীয় পর্বে বলেছিলাম, একটা সময় বাংলা কোরআন পড়া আরম্ভ করি। বেশীদূর যেতে হয়নি- ২য় সুরাতেই মানে সুরা বাকারা পড়তে গিয়েই হোচট খাওয়া আরম্ভ করি। কোরআনের অনেক কিছুই আছে যা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মেলে না- কিন্তু ঐ সময়ে সবচেয়ে বেশী ধাক্কা খাই- অলৌকিক ঘটনাগুলোতে, বিভিন্ন নবী-রাসুলের অলৌকিক ক্ষমতা বা মু’জিজা ছিল এটা বিশ্বাস করতেই হবে। কিন্তু পারছিলাম না। নবীজীর হাতের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল? মুসা আ এর লাঠি সাপ হয়ে যেত, লাঠির আঘাতে নীল দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল? আবাবিল পাখির পাথর নিক্ষেপ দিয়ে বড় বাহিনী পরাস্ত হয়েছিল? নবীজী এক গ্লাস দুধ দিয়ে অনেক সাহাবী পেট পুরে খাওয়া হয়েছিল? ঈসা আ এর হাতের ছোয়ায় কুষ্ঠ রোগ, অন্ধত্ব ভালো হয়ে যেত? মরা বেচে উঠতো? পুরো অবিশ্বাস করতে না পারলেও দিনে দিনে এসবে বিশ্বাস করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।

 

ক্লাস এইট পর্যন্ত ক্লাসে আরবী আবশ্যিক ছিল- পাশে ছিল অনেক বড় এক মাদ্রাসা- সেই মাদ্রাসার এক হুজুর বাসায় এসে আরবী পড়াতো- বয়সে বছর ৩/৪ বড়, বন্ধুর মতই সম্পর্ক হয়েছিল। তার সাথেও অনেক কথা হতো- মুজিজা নিয়ে কথা বলায় তিনি নিশ্চিত করেন যে- এটাতে বিশ্বাস রাখতেই হবে। তিনি একে একে অনেকগুলো মু’জিজার কথা জানান- একটা বই দেন, যেখানে কোরআনে উল্লেখিত বিভিন্ন মু’জিজার কথা উল্লেখ ছিল। এছাড়া শুক্রবারে জুমার নামাজে মসজিদের ঈমামও প্রায়ই বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার কথা বলতেন। নবী-রাসুলের মু’জিজার ব্যাপারে সন্দেহ থাকতো- কিন্তু পুরো অবিশ্বাস হয়তো তখনো করে উঠতে পারিনি- কিন্তু ঈমাম সাহেব বর্তমানেরও বিভিন্ন জায়গার নানা অলৌকিক ঘটনার বয়ান দিতেন- সেগুলোকে সে সময়েই ভুয়া মনে হয়েছিল। 

 

 

যাহোক, দিনে দিনে সন্দেহ বাড়তেই থাকে। এককালের প্রাণের ধর্ম- গর্বের ধর্ম ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়েই প্রশ্ন তৈরী হতে থাকে। একটি তো বললাম- বিজ্ঞানের সাথে দ্বন্দ্ব। দ্বিতীয়টি হলো- অন্য ধর্মের প্রতি এর দৃষ্টিভঙ্গি। আগেই বলেছি- আমার বাংলা নাম (হিন্দু! নাম) এর কারণে হিন্দু(!) গালিটা অনেকবারই শুনতে হয়েছে। এমনকি একবার এলার্জীর কারণে বেশকিছুদিন গরুর মাংস খাওয়া নিষেধ ছিল- সেটার জন্য শুনতে হয়েছে- হিন্দু না-কি? আর এই গালি শুনতে শুনতে এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীদের সাথে মেশা- হিন্দু বন্ধু- খেলার সাথী থাকার কারণে, ওদের প্রতি একটি সফট কর্ণার জন্মে গিয়েছিল- মানে “হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানেরা ভালো” এমন চিন্তাকে খুব খারাপ চোখে দেখতাম। আর ঠিক এই জায়গাটিতেই আমার মুসলমান বন্ধু/পাড়ার বড় ভাইদের সাথে দারুন তর্ক হতো। যত তর্ক করেছি, দেখেছি আগের চেয়ে আরেকটু ভালো ভাবতে পারছি- অনেক সময় দেখা গেছে, তর্ক করতে করতে এমন একটি যুক্তি করে ফেলেছি- আগে তেমনটি সচেতন ভাবে নিজেও ভাবিনি। এভাবেই শুরু….। বিশেষ করে স্কুলে কয়েকজন বন্ধুর সাথে নিয়মিত তর্ক হতো- সেটা আমার চিন্তাগুলোকে অনেক গুছিয়ে আনতে সাহায্য করে।

তো যেটা বলছিলাম…
ক্লাসের বই এ শিরক সম্পর্কে পড়লাম। টিচার-ছাত্ররা হিন্দুদের মুর্তি নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি করলো। প্রাণ নেই- কিছু করার ক্ষমতা নেই- সে আবার দেবতা!!! বিষয়টি ভালো লাগে না। পড়লাম, সবচেয়ে ভয়াবহ পাপ শিরক!! এটার কোন ক্ষমা নেই!! প্রচণ্ড খারাপ লাগলো- কুফরি বা আল্লাহকে অস্বীকার/অবিশ্বাস করলেও মাফ আছে, অন্য ঈশ্বরকে মানলেও হয়তো মাফ আছে- কিন্তু শিরক এর কোন মাফ নেই!!!! এমনটা কেন হবে? এই প্রশ্ন মাথায় আসতে থাকলো। হিন্দু কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম- এরকম মাটির মুর্তিকে পুজা করেন কেন? তিনি বললেন- মাটির মুর্তি হিসাবে তো পুজা করিনা- আসলে তো পুজা করি দেবতাকে। মুর্তি তো মাধ্যম মাত্র। অনেক ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতে দেখি একসময় মনে হলো- আসলে ইসলাম, হিন্দু, খৃস্টানেরা যা পালন করে তা অনুশাসন মাত্র। সেখান থেকেই মনে হলো- এসবে তো কোন পার্থক্য নেই। আল্লাহকে ডাকতে গেলেও মুসলামনদের কিছু কাজ করতে হয়- নামাজ পড়তে হয়, মসজিদে যেতে হয়, পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হয়…., তাহলে হিন্দুরা মুর্তি বানিয়ে দেবতাকে ডাকলে দোষ কি? ছোটবেলা থেকে মসজিদকে আল্লাহর ঘর বলে এসেছি- আল্লাহর যদি ঘর থাকতে পারে- তবে মুর্তিতে দোষ কি? ক্লাসে হজ্জের নিয়ম পড়তে গিয়ে দেখি- এখনও কাল্পনিক শয়তানের দিকে পাথর ছুড়তে হয়। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে যদি শয়তানের দিকে পাথর ছুড়া যায়- তবে মুর্তি পুজায় সমস্যা কি? ক্লাসের ধর্ম স্যার হজরে আসওয়াদের কাহিনী শুনালেন। সেই পাথরে এখনো মুসলমানেরা চুমু খায়, মনে হলো তবে মুর্তি পুজায় সমস্যা কি? আল্লাহর যদি গণ্ডায় গণ্ডায় ফেরেশতা থাকে তবে ভগবানের দেবতা-দেবী থাকতে দোষ কি? ফেরেশতারা যদি মানুষের রূপ নিয়ে আসতে পারে, তবে এক ভগবান-ই বা বিভিন্ন রূপ নিতে পারবে না কেন?

এমন চিন্তা করা শুরু করেছি, বন্ধুদের সাথে যুক্তি-তর্ক করি; কেউ কেউ ভয়ে আমার সাথে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে আসে না- ধর্ম বিষয়ক কথা শুরু হলেই দেখা যায়- কেউ কেউ কথা বন্ধ করে দেয়- জানায়, এ বিষয়ে নাকি আমার সাথে কথা বলা যাবে না। তারপরেও অনেকের সাথে যুক্তি-তর্ক হতো। এবং এই তর্ক করতে গিয়ে হঠাৎ করেই একজনকে বলে ফেলি- “তুই আজ ইসলামের নামে এত বড় বড় কথা বলছিস- এই তোর জন্ম একটা হিন্দুর ঘরে হলে- মা কালীর নামে তোর মুখ দিয়ে ফেনা ছুটতো!” এটা বলার দেখি আমি চুপ- সেই বন্ধুও চুপ। সে-ও প্রচণ্ড ধাক্কা খায়, আর আমার ভাবনার আরেকটি দিক উন্মোচিত হয়ে যায়….

এই চিন্তাটিই আমাকে আমার ধর্মীয় বিশ্বাসকে দূরে ঠেলে দিতে দারুন সাহায্য করে। আমি মুসলমান কারণ আমার বাবা-মা মুসলমান, পারিবারিক পরিবেশ মুসলমান, জন্ম পরবর্তী সমস্ত কিছুই আমাকে মুসলমান হিসাবে গড়ে তুলেছে। একজন হিন্দু বা একজন খৃস্টানের ক্ষেত্রেও তা-ই। তাহলে আমার আল্লাহ বা অন্যদের ভগবান বা গড এর ভূমিকা কি?

এবারে চিন্তার ক্ষেত্রটিতে ঝড় আসে আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে। সন্দেহ তৈরী হয়- কিন্তু পুরো নিসন্দেহ হতে পারি না….

 

পাঁচ

(১)

আমার ক্লাস নাইন আর টেন- দুটো বছরই গেছে প্রচণ্ড দ্বিধায়, অস্থিরতায়। এই সময়কালটাকেই বলবো আমার ট্রানজিশন পিরিয়ড। ইসলাম ধর্মের অসংখ্য বিষয় নিয়ে প্রশ্ন চলে এসেছে- অন্যান্য প্রচলিত ধর্ম সম্পর্কে তো আগে থেকেই খারাপ ধারণা ছিল- গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে যতটুকু পড়েছি ভালোই লাগে- কিন্তু বৌদ্ধ মন্দিরে তো দেখি বুদ্ধ মূর্তি- তাকে কেন্দ্র করে পুজার মত অনুষ্ঠানও হয়- শুনলাম বৌদ্ধরা নাকি বুদ্ধরে ভগবানও বলে। কি করি?

ঈশ্বর/আল্লাহকে নিয়ে ভাবলাম, অনেক চিন্তা করলাম- অনেক সন্দেহ তৈরী হয়েছে- কিন্তু মন থেকে পুরো নাস্তিক হতে পারছি না। বিজ্ঞানকেই আকড়ে ধরে চিন্তাগুলোকে সাজাবার চেষ্টা করছি- এইট/নাইন পর্যন্ত বিজ্ঞানের বই-ই ভরসা- অনেক কিছুই জানি না; তবু সেই সময়ে বস্তু-শক্তির নিত্যতা সূত্র আর গণিতের সংখ্যা রেখা দিয়ে নিজের মত কিছু যুক্তি বানিয়ে নিলাম। ডিটেইলস না জেনেই বিজ্ঞানের বিবর্তনকেই সঠিক মনে হতে থাকে। ক্লাসের বই এ ছিল, অভিযোজন। সেটাকে কেন্দ্র করে নিজের মত করে বিবর্তনবাদকে সাজালাম (আজ বুঝি ল্যামার্কীয় ভুল ধারণার মধ্যে ছিলাম)। কিন্তু তারপরেও নাস্তিকতার ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চিত হতে পারিনা।

সে সময়ের ডায়েরী এখনো মাঝে মধ্যে উল্টে পাল্টে নাড়ি। সেখানকার তিনটি লেখা এখানে তুলে দিচ্ছি- এটাতে আমার ট্রানজিশন পিরিয়ডের চিন্তার গতি বুঝা যেতে পারে। লেখা তিনটি সম্ভবত আমার ক্লাস নাইন/টেনের দিককার লিখা। তবে মজার ব্যাপার হলো- এগুলোর কোনটি কোনটি আমি পরে (ঐ নাইন টেনেই) আবার কেটে দিয়ে পাশে লিখেছি- “আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি”, “আমার পুরা বিশ্বাস আছে”, “আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দাও”… ইত্যাদি।

প্রথমটি: “আমার ধর্ম কি?”
আমার বাবা-মা দুজনই মুসলমান। সুতরাং জন্মের পর থেকেই আমিও মুসলমান ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে এই ধর্মের বেশ কয়েকটি ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করায় আমি কাফির। যেমন, খাবারের ব্যাপারেই ধরা যাক। কাছিম, কুচে বা যেকোন খাবার যা হিন্দুদের বা অন্য দেবদেবীর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে, সবই হারাম করা হয়েছে এই ধর্মে। কিন্তু এটা আমি মানতে পারিনা। কাছিম-ব্যঙ-কুচে হয়তো আমি ঘৃণার কারণে খেতে পারবো না, কিন্তু ওটা খেলেই আমার ধর্ম আমাকে ত্যাগ করবে, এটা আমি মানতে পারছি না। যেখানে অন্য ধর্মের লোকেরা এসব খেতে পারছে সেখানে মুসলমানেরা এসব খাবার খেতে পারবে না কেন? আর, দেবদেবীর নামে উৎসর্গ করলে তা খাওয়া যাবে এই নিয়মকে বলতে গেলে আমি ঘৃণা করি। কেননা এভাবে আমাদের ধর্মে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। কোন খাবার দেবদেবী আর জাহান্নামের (নরক) নামেই উৎসর্গ করা হোক- তাতে খাবারটির গুনগত মানের কোন পার্থক্য হয় না, এটা যেকেউ ১০০% নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারবে। তাহলে সেই খাবার খেতে অসুবিধা কোথায়? অবশ্য সকল ধর্মেই এ ধরণের কুসংষ্কার আছে। যেমন: হিন্দু ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। এটাও আমি মানতে পারিনা। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, বর্তমানে আমি কোন ধর্মেই নেই, অর্থাৎ আমি নাস্তিক। তবে ইসলাম ধর্মের বেশ কিছু জিনিস অবশ্য ভালোলাগে। তাই এই ধর্ম এখনো আমি পুরোপুরি ছাড়িনি।
সুতরাং আমি ৭০% নাস্তিক, এবং ২৯% মুসলমান, ০.৯% বৌদ্ধ ও ০.১% অন্যান্য।

দ্বিতীয়টি:
“এলেবেলে”

সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? সৃষ্টিকর্তা আসলেই কি আছে? এই প্রশ্নটা প্রায়শই আমার মনে উদিত হয়। নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করি, যদিও এখনো সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি।

আচ্ছা, আমাদের এই পৃথিবীকেই নিয়ে শুরু করা যাক। এই পৃথিবীর জন্ম কিভাবে? সঠিক উত্তর পাওয়া না গেলেও অনেকে মনে করেন- সূর্যেরই একটা অংশ পৃথিবী। তাহলে সূর্যের জন্ম কোথা থেকে বা কিভাবে? হয়তো বলা যাবে- সূর্য জন্ম নিয়েছে বড় কোন ধুমকেতু বা জ্যোতিস্ক থেকে। কিন্তু সেই বড় জ্যোতিস্কই বা কোথা থেকে এসেছে? ….. আমরা বস্তুর নিত্যতা সূত্র থেকে জানতে পারি সৃষ্টির পর থেকে কোন বস্তুর বা বস্তুর ভরের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, এসব গ্রহ-উপগ্রহ কোন বিন্দু থেকে উৎপন্ন হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে এসব উৎপন্ন করতে নিশ্চয়ই কারো হাত আছে, তিনিই সৃষ্টিকর্তা।

উপরের আলোচনা হতে বুঝা গেল যে, কোন জিনিসের সৃষ্টির জন্যই প্রয়োজন সৃষ্টিকর্তা। তাহলে আরেকটি প্রশ্ন জাগে এই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকর্তা কে, তার সৃষ্টিকর্তা কে? এক্ষেত্রেও আমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছি। সুতরাং এতটুকু আলোচনা হতে আমরা যেমন নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না যে সৃষ্টিকর্তা নেই, তেমনি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবো না যে সৃষ্টিকর্তা আছে।

এবার আলোচনার একটু গভীরে প্রবেশ করি। সংখ্যারেখায় সবচেয়ে বড় সংখ্যা কত? আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারেনি সবচেয়ে বড় সংখ্যাটি কত, কেউ পারবেও না। তেমনি আমাদের মহাবিশ্বের বিস্তৃতি কত ব্যাপক তার শেষ কারও পক্ষে দেখা সম্ভব হবে না। একজন মানুষের মগজ তার তুলনায় নগন্য, মানুষটি আবার পৃথিবীর তুলনায় নগণ্য, পৃথিবী আবার সৌরজগতের তুলনায় নগন্য, সৌরজগৎ আবার আমাদের গ্যালাক্সির তুলনায় খুবই নগন্য। অসংখ্য গ্যালক্সির সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বজগতের তুলনায় সেই গ্যালাক্সি নগন্য, তেমনি অসংখ্য বিশ্বজগৎ নিয়ে তৈরী হয় আরেকটি জগৎ, তাদের নিয়ে তৈরী হয় আরো বিশাল একটি জগৎ……… আর বিশালতার মাঝে সৌরজগৎ বা পৃথিবীর সৃষ্টি কোন ঘটনাই না। বস্তুর নিত্যতা সূত্র থেকে জানি- বস্তুর রূপান্তর সম্ভব- সৃষ্টি বা ধংস হয় না। পৃথিবী বা সৌরজগৎ সৃষ্ট তেমনি একটি রূপান্তর। প্রকৃতপক্ষে এই ধরণের বিশ্বজগৎ অসীম-অনন্ত।

অনুরূপভাবে আমরা বিশ্বজগৎ সৃষ্টিকে অর্থাৎ এর সময়কালকেও আমরা অসীম বা অনন্ত বলতে পারি। অর্থাৎ অনন্তকাল ধরেই চলে আসছে এই প্রকৃতিজগৎ। সামগ্রিকভাবে (সম্পূর্ণ) বিশ্বজগৎ কিভাবে এবং কখনো সৃষ্টি হলো- তা ঐ সংখ্যারেখার সবচেয়ে বড় সংখ্যার মতই অসীম ও অনন্ত।

আবার সৃষ্টিকর্তা যদি সত্যিই থেকে থাকেন- তবে এক্ষেত্রেও প্রশ্ন রয়েছে, তিনি কে? তিনি কেমন? অর্থাৎ তার স্বরূপ কিরূপ? আমাদের পৃথিবীতে এতগুলো ধর্মের মধ্যে কোনটির প্রভু আসল সৃষ্টিকর্তা? সকল ধর্মের জন্ম ঘটনা থেকে জানা যায় যে, একজন রক্ত মাংসের মানুষ এসে সেই ধর্ম প্রবর্তন করেন। এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সেই ধর্মপ্রচারক তার নিজের সাথে প্রচারিত সৃষ্টিকর্তার যে একটা সম্পর্ক আছে তা প্রচার করেন। (যেমন মুহম্মদ সা আল্লাহর বন্ধু, যীশুখৃস্ট ঈশ্বরের পুত্র। কৃষ্ণ-দেবতা-দেবী তারা তো ভগবানেরই ভিন্ন রূপ)।

তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে প্রতিটা ধর্মেরই কেরামতি মৃত্যু বা মৃত্যু পরবর্তী জগৎ নিয়ে। কেননা মৃত্যু বা মৃত্যু পরর্বর্তী জগৎ সম্বন্ধে সবাই অজ্ঞ।
যাহোক, সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে নেগেটিভ দিকে আছি ৬০%
এবং পজিটিভ দিকে ৪০%।

তৃতীয়টি (ঈষৎ সংক্ষেপিত)
“নাস্তিক বনাম গোঁড়া ধার্মিক”

আমার কেন জানি নাস্তিকদের একটা আলাদা টান রয়েছে, … গোড়া ধার্মিকদের প্রতি কেমন যেন একটা অবজ্ঞাভাব প্রকাশ করে। কারণ কি? কারণ সম্ভবত:
ক) নাস্তিকেরা সাহসী, গোড়া ধার্মিকেরা ভীতু। সাহস না থাকলে কেউ নাস্তিক হতে পারেনা।
খ)নাস্তিকদের চিন্তাশক্তি প্রখর। নাস্তিকেরা তীক্ষ্ণভাবে চিন্তা করতে পারে, যুক্তিতর্কের মাঝ্যমে তারা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে। কিন্তু গোঁড়া ধার্মিকরা কোন রকম যুক্তিতর্ক ছাড়াই অন্ধভাবে সৃষ্টিকর্তাকে মনে করতো!!!!!!! এদের অনেকের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার ভয় এমনভাবে গাঁথা যে তারা কোন যুক্তিতর্কই মানতে চায় না, তাদের চিন্তাগত শক্তি ভোঁতা হয়ে থাকে। তারা যা বিশ্বাস করে তা কখনোই প্রমাণ করতে পারে না….
গ) নাস্তিকেরা পরোপকারী কিন্তু গোড়া ধার্মিক: যারা নাস্তিক- তারা পরোপকারী, তারা পরের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে। অপরপক্ষে ধর্মকর্ম সবসময়ই মানুষকে স্বার্থপর হতে শেখায়। একজন মুসলমান নামাজ, রোযা, হজ্জ পড়ে তার নিজের পূণ্য হাসিলের জন্য বা বেহেশত লাভের লোভে।

এগুলোকে একজন ক্লাস নাইন/টেনের ছেলের চিন্তাভাবনা হিসাবে দেখলেই বুঝা যাবে- কিভাবে কোন পদ্ধতিতে ঈশ্বর ভাবনার দীর্ঘদিনের জেঁকে বসা পাথরটি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে- নাস্তিকতার প্রতিই প্রধানত ঝোঁক- কিন্তু তারপরেও একটা ভয়: যদি শেষ পর্যন্ত ঈশ্বর বলে কিছু থেকেই থাকে? ফলে আর পুরো নাস্তিক হওয়া হলো না। কোন দুর্বল মুহুর্তে- যেমন পরীক্ষার আগে আগে- যখন কোনভাবেই পড়ায় মন বসাতে পারছি না- তখন হয়তো ডায়েরীর এরকম নাস্তিক কথা কেটে তার পাশে বিশ্বাসের কথা লিখছি- এককথা অসংখ্যবার লিখছি (যেনবা জিকির করছি!), মাঝে মধ্যে ভালো করে নামাজ পড়া শুরু করছি…।

এমনই অস্থিরভাবে কেটেছে আমার এই ট্রানজিশন পিরিয়ডটা।

(২)

একদিন এক আস্তিক বন্ধুর সাথে তর্ক করছিলাম। আগেই বলেছি- এই তর্ক-বিতর্ক সবসময়ই আমার চিন্তাকে গুছিয়ে নিতে সাহায্য করেছে, বিপরীত যুক্তি-মত-প্রশ্ন আমাকে নতুন ভাবনার খোরাকই দিয়েছে। তো- সেই বন্ধুর সাথে যুক্তি-তর্ক করছি, আমি একেক করে বিজ্ঞানের কথা বলছি- সবগুলোতেই সে আল্লাহর মহিমা খুঁজে পাচ্ছে। এমনি যুক্তি করতে করতে অনেকটা বিরক্ত হয়ে আল্লাহকেই চ্যালেঞ্জ জানাই।

পাশে একটা ইট ছিল- সেটা ধরে একটু উচুতে নিয়ে ফেলে দিলাম। দিয়ে বললাম- আল্লাহ তো শুধু “হও” বললেই সব হয়ে যায়, তাঁর তো অসীম ক্ষমতা- এখন দেখি আল্লাহ কেমনে পারে- এই ইটকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে চালিত করুক। নিজে আবার আমি ইটকে উপরে তুলে বললাম- এই যে আমি কিন্তু ঠিকই উপরে তুলতে পারছি- কিন্তু আল্লাহ পারলো না- আবার ছেড়ে দিয়ে বলি, কই আল্লাহর ক্ষমতা তো কিছু দেখছি না। বন্ধুটি কি বলবে- খুঁজে পাচ্ছিল না, এবং ধীরে ধীরে ক্ষেপে উঠছিল। স্বীকার করছি- তার এই যে অক্ষম ক্রোধ, এটাতে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। (নাস্তিকতার শুরুর দিকে- আস্তিকরা যুক্তিতে না পেরে যখন ক্ষেপে যেত- সেটা অনেকদিন পর্যন্ত খুব আনন্দ দিত; কিন্তু একটা সময় এই এপ্রোচের ভুল ধরতে পারি- কেননা আস্তিকদের খেপানোর মাধ্যমে শুধু দূরত্বই তৈরী হতো- আর কিছু হতো না। এপ্রোচের কথা যদি বলতেই হয় বলবো আরজ আলী মাতুব্বরের কথা। যার কাছ থেকে এপ্রোচের স্টাইল সম্পর্কে শিখেছি ও এখনো শিখছি- তিনি আরজ আলী মাতুব্বর।)

এই যে আল্লাহকে অক্ষম বলে প্রমাণ করে দেয়া- সেটা শুরুতে যুক্তি-পাল্টা যুক্তির ধারাবাহিকতায় বলেছিলাম- অনেকটা ঝোঁকের মাথায়। সেটা আমার জন্য তখনও সহজ ছিল না, কারণ আমি তখনও আল্লাহর অনস্তিত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত নই। ভয় ছিল যে, সত্যি আল্লাহ যদি থেকে থাকেন- এবং এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে হঠাৎ কোন গজব নামিয়ে দেন!! তো প্রথম চ্যালেঞ্জ এই জিতে যাওয়ার পরে যেন সাহস আরো বাড়তে থাকে- চ্যালেঞ্জ বাড়াতে বাড়াতে একসময় নিজেকে নিয়েও চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকি। বলি- আল্লাহ যদি সত্যি থেকে থাকেন, তবে চ্যালেঞ্জ জানানচ্ছি- আমাকে এই মুহুর্তে টুপ করে মেরে ফেলুক.. ইত্যাদি। আস্তিক বন্ধুদের কেউ আমার জন্যে ভয়ে তওবা করে, আবার কেউবা যথারীতি ক্ষেপে ভূত!!

তো, কেউ কেউ যুক্তি করতো – আল্লাহর তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই- যার তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে? আমি বুঝতে পারি – আল্লাহর খেয়েদেয়ে কোন কাজই আসলে নেই। আল্লাহ যদি থেকেই থাকেন, প্রচণ্ড অথর্ব টাইপের কেউ- কেননা প্রকৃতির কোন একটি নিয়ম ভাঙ্গার মতো সামর্থ বা ক্ষমতা তার নেই। (অনেক পরে দেখি আইনস্টাইনও একই রকমের কথা বলেছেন!!)

এগুলো- প্রশ্ন হিসাবেই ছিল- কিন্তু কেউ তো তার জবাব দিতে পারতো না, উল্টো যা দিতো তা প্রশ্নকেই বরং বাড়িয়ে তুলতো। এর মধ্যেই আস্তিকদের কাছ থেকে আরেক ধরণের যুক্তির সাথে পরিচিত হলাম। সবকিছুই কোরআন-হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেয়া। আল্লাহ আছেন কিনা- এটার জবাব আল্লাহ কোরআনে কি বলেছেন সেটা দিয়ে দেয়া!!

ক্লাস টেনে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত একটা স্যারের কাছে ব্যাচে পড়তে যেতাম- মাঝখানে এশার নামাজ পড়ার জন্য স্যার সবাইকে ধরে মসজিদে নিয়ে যেত। আমি আর একদুজন যথারীতি ফাকি দিতাম। তো একদিন ব্যাচেরই এক আস্তিক বন্ধু স্যার মসজিদে যাওয়ার পরে আমাকেও মসজিদে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল। শেষে বলতেই হলো- আমার ধর্ম নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। সে খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- কি? আমার ইন্সট্যান্ট জবাব(মানে প্রশ্ন): “এই যে নামাজের আগে আমরা ওযু করি- ওযু ভঙ্গের অন্যতম কারণ বায়ু নির্গত করা ও ওযু ভেঙ্গে গেলে নিয়ম আবার ওযু করা। এখন, ধর- আমি মাত্রই ওযু করেছি- এখনও আমার হাত-পা-মুখ ভেজা, এমন সময় আমার বায়ু নির্গত হলো- আমাকে কেন ওযুর নাম করে আবার সেই ভেজা হাত-পাগুলোই ধুতে হবে? এমনতো নয় যে- আমি পশ্চাদ্দেশ পরিষ্কার করার মাধ্যমে ওযু করছি?” বেচারি জবাব দিতে না পেরে স্যারকে জানিয়ে দিল। পিঠে বেতের বাড়ি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম- কিন্তু সে পথে না গিয়ে স্যার জবাব দেয়ার চেষ্টা করলেন। স্যার কোরআন-হাদীস থেকে কোট করলেন- পুরো আরবীতে, মুখস্থ। বাংলায় জানালেন- আল্লাহ জানিয়েছেন- পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ, ফলে মুমীনদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে, প্রতিদিন গোসল করা- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে ওযু করার মাধ্যমে মুসল্লীরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে…… ইত্যাদি। কিন্তু আমার জবাব আর পাওয়া হলো না। যাহোক- ততদিনে এধরণের যুক্তি শুনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম- কি আর করা….।

এভাবেই বিভিন্ন টুকরো টুকরো ঘটনায়-ভাবনায়-প্রশ্নে মোটাদাগে আমার নাস্তিকতার সূত্রপাত। অন্য অনেকের ক্ষেত্রে যেমন আরজ আলী, হুমায়ুন আজাদ, আহমদ শরীফ প্রমুখের বই পড়ে বিশ্বাসে আঘাত খাওয়া, প্রশ্ন তৈরী হওয়া- আমার ক্ষেত্রে তেমনটি নয়। এনারা আমার জীবনে এসেছেন- নাস্তিক হওয়ার অনেক পরে। এঁদের কাছেও আমার অবশ্যই অনেক ঋণ, তাঁদের কাছ থেকে আমি অনেক যুক্তি পেয়েছি। কিন্তু নাস্তিকতার প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁদের ভূমিকা নেই। ভূমিকা যদি কারও থেকেই থাকে- তবে এ মুহুর্তে তিনজনের নাম বলবো- কাজী নজরুল ইসলাম- হুমায়ুন আহমেদ ও তসলিমা নাসরিনের।

পরিচিত অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের দেখেছি- প্রিয় কবি বা লেখকের কথা আসলেই যার যার ধর্ম অনুযায়ী প্রিয় নির্ধারিত হয়। মুসলমান বন্ধুর অবধারিত নজরুল, আর হিন্দু বন্ধুটি রবীন্দ্রনাথ বলতে অজ্ঞান। এটা প্রায় কমন। শুধু এতটুকু থাকলেই হতো- কিন্তু দেখা গেল, মুসলমান বন্ধুরা একটা বড় অংশই রবীন্দ্রনাথ বিরোধি আর হিন্দু বন্ধুদের বড় অংশ নজরুল বিরোধি। আমি ক্লাস এইট/নাইন/টেনের কথা বলছি। আমারও সে সময়ে প্রিয় কবি ছিল সুকান্ত আর নজরুল- বলাই বাহুল্য তেজী কবিতা সেসময়ে পছন্দ করতাম। নজরুল প্রিয় হলেও- ধর্মানুযায়ী এই ভালো লাগালাগিতে বিরক্তি তৈরি হতো। অনেকে নজরুলের হামদ-নাতের কথা, ইসলামী গানের কথা বলতো। মেলাতে পারতাম না। প্রিয় কবিতা “বিদ্রোহী”র কিছু লাইন খুব ভালো লাগতো- “ভয়ে হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাপিয়া”, “আমি জাহান্নামের আগুনে বসি হাসি পুষ্পের হাসি”, “ধরি জীব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি”, “ভগবান বুকে একে দেই পদচিহ্ন”। এলাইন কটি থেকে একটা ধারণা ছিল- তিনি অন্যরকম। পরে এক কাকুর (বাবার বন্ধু) কাছ থেকে শুনি- নজরুলের বিরুদ্ধেও মুরতাদ/কাফির ঘোষনা হয়েছিল। তিনি যেমন হামদ-নাত লিখেছেন- লিখেছেন রাধা-কৃষ্ণ কীর্তন। শুনে খুব ভালো লাগে।

হুমায়ুন আহমেদের “শ্রাবণ মেঘের দিন” বইটিতে দুটি বাক্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছি। “আল্লাহর অংক জ্ঞান কাঁচা” আর “ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেনি- ম্যান ক্রিয়েটেড গড”। সুরা নিসা মিলিয়ে দেখি আসলেই আল্লাহর (প্রকৃতপক্ষে নবীজীর) অংকজ্ঞান মারাত্মক কাঁচা। আর- দ্বিতীয় বাক্যটি দীর্ঘদিন আমার কানে বাজতো। এবং অনুরূপ বাক্য পরে পেয়েছি- নজরুলের কবিতায়- যার জন্য তাকে মুরতাদ ঘোষনার দাবি তুলেছিল মোল্লারা:
“মানুষ এনেছে গ্রন্থ; –
গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!”

বা আরেক জায়গায় দেখেছিলাম- “পথ মানুষের সৃষ্টি- উল্টোটা নয়”। অর্থাৎ চালু একটা পথ অনেক পথিককে কাছে টানে ঠিকই- পথ আছে জন্যই সে পথ দিয়ে পথিক চলাচল করে বটেই- কিন্তু শুরুর কথা যদি আমরা দেখি- অবশ্যই একদম শুরুতে মানুষের দ্বারাই পথের সৃষ্টি হয়েছে। “মুহম্মদ সা:-ই ইসলাম- আল্লাহ- কোরআন প্রভৃতির স্রষ্টা” – এই ভাবনাটি অনেক বেশী যৌক্তিক মনে হতে লাগলো।

আমি যখন ক্লাস নাইনে- তখন সারাদেশে ঘাদানিক এর যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ব্যাপক আন্দোলন চলছে। আমি আমার এলাকাতে বসেই সে আন্দোলনের তেজ টের পাচ্ছিলাম, ঘাদানিক এর সিগনেচার ক্যাম্পেইন আমার জীবনের প্রথম রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। জামাত উল্টোদিকে ব্লাসফেমী আইনের জন্য আন্দোলন করছে, তসলিমা নাসরিনকে মুরতাদ ঘোষণার জন্য আন্দোলন করছে। এসময়টিতে আমার অনেকের সাথে এ বিষয়গুলো নিয়ে প্রচুর তর্ক করতে হয়েছে এবং তসলিমাকে নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে তার বই পড়া আরম্ভ করে দেই। তার নির্বাচিত কলাম বলতে গেলে গোগ্রাসে গিলি। এখান থেকে প্রচুর আয়াত-হাদীস টুকে রাখি, মুখস্থ করি। মুসলমান মাত্রেরই মুহম্মদ সা এর প্রতি দারুন শ্রদ্ধা ও ভক্তি থাকে, কলেমা তাইয়েবা থেকে সকল মুসলমান জানে শুধু আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আনলেই হবে না- নবীজীকেও রাসুল হিসাবে মানলে পরে ঈমান পূর্ণ হবে। সে হিসাবে আমার নিজেরও নবীজীর প্রতি ভক্তির জায়গা ছিল। মনে হতো- নবীজী যদি সত্যি থেকে থাকেন- তবে কোরআনও আছে। কোরআন থাকলে তো আল্লাহও আছে- কেননা নবীজী তো আর মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। এই গদগদ ভক্তিভাব কাটাতে তসলিমা নাসরিন কিছুটা হলেও সাহায্য করেছেন। তার আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে ইসলাম-কোরআন-মোহাম্মদ সা কে উড়িয়ে দেয়া, বিশেষ করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে কোরআন-হাদীস দেখিয়ে নবীজীর একের পর এক বিয়ে করা, নারীদের প্রতি অবমাননাকর হাদীস-কোরআন লিপিবদ্ধ করা এসব আমার খুব কাজে দেয়। মানে আগে একটা ভয় কাজ করতো, সেই ভয়টা দূরীকরণে তসলিমা নাসরিনের সেই আক্রমণাত্মক লেখাগুলো আমাকে অনেক সাহায্য করে!

 

এমন করে বলতে গেলে হয়তো আরো অনেক কিছুই বলা যেতে পারে। তবে মনে হয়- এরই মধ্যে যথেষ্ট বলেছি, পাঠকেরাও যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে কৃতজ্ঞ করেছেন। এই হলো আমার অবিশ্বাসের শুরুর গল্প। পুরোপুরি- দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠি বলা যায় এসএসসি পরীক্ষার পরে। এসময়টায় অনেক বই (গল্প-উপন্যাস) হাতে পাই, একাডেমিক পড়ার চাপবিহীন কিছু ফ্রি সময়ও পাই- ফলে চাপমুক্ত ভাবার অবকাশও তৈরী হয়। প্রথম ভাবনাটা আসে- পরীক্ষার আগে আগে ভয়ে অস্থিরতায় অনেকটা কুপোকাত হওয়ার জন্য একটা লজ্জাবোধ। সেখান থেকে আরেকটা চিন্তা মাথায় আসে- সেটা হলো: বুঝতে পারি- ঈশ্বর বিশ্বাস মানুষের দুর্বল মুহুর্তের সঙ্গী। অবলম্বনহীন অবস্থায় মানসিক শক্তি পাওয়ার একটা বায়বীয় অবলম্বন মাত্র। নিজেকে এমন দুর্বল ভাবতে ইচ্ছা করলো না। এই চিন্তাকে সাথে নিয়ে আল্লাহ বা ঈশ্বর, কোরআন-ইসলাম-মুহম্মদ সা সবকিছু নিয়ে আবার ভালো করে ভাবতে লাগলাম- শুরু শেষ পর্যন্ত। একসময় বুঝতে পারলাম- এতদিন অহেতুক ভয় পেয়েছি- দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সব ছুড়ে ফেলে ঝেড়ে কাশার সময় এসেছে।

ঝেড়ে কাশলাম।

সবাইকে ধন্যবাদ।

(প্রথম প্রকাশঃ সামহোয়ারইনব্লগ। সেই ব্লগেই অনেক অবিশ্বাসী, সংশয়বাদী ব্লগাররা মিলে নিজেদের নাস্তিক হওয়ার গল্পগুলো লেখছিলাম, ইচ্ছে ছিল - একটা সংকলন বের করার, দরকারে একটা বই প্রকাশ করার। একজন ব্লগার এরকম অনেকগুলো লেখা একটা ওয়েবসাইট বানিয়ে তুলেও রেখেছিলেন। সেই ওয়েবসাইটটা এখন নেই। ২০১৩-২০১৪ সালের দিকে সামু থেকে আমার অনেক লেখার মত এই লেখাটা লাপাত্তা করেছিলাম। ২০০৯ সালে লেখাটা পাঁচ পর্বে মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশ করছিলাম বলে পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি!)