সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৯

ঈশ্বরের সাথে কিছুক্ষণ

সোলায়মান সাহেবকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে তিনি একজন পাঁড় নাস্তিক। মিষ্টভাষী, সদাপ্রফুল্ল এই মানুষটি কারো কখনো উপকার বই ক্ষতি করেননি। একাধারে তিনি প্রকৃতিপ্রেমী ও মানবদরদী, অধ্যাবসায়ী ও নীতিবান। মহামান্য শয়তানের কেরামতি বলতে কেবল ঐ বিশ্বাসে ঘাটতি আনাতেই, শয়তান মহাশয়ের যে আর অন্য কোন কাজ আছে- তা সোলায়মান সাহেবকে দেখে বুঝার উপায় নেই। চোখে মোটা চশমা, মধ্যবয়স্ক- যদিও এখনো যথেস্ট তরুন দেখায়, চোখদুটো দারুন বুদ্ধিদীপ্ত ও একই সাথে আত্মবিশ্বাসী- একজন জনপ্রিয় অধ্যাপকের যা যা দরকার। তবে এমন ভালো একজন মানুষ হয়েও, অকপট-সাবলীল-জ্ঞানী হয়েও তিনি একই সাথে জনপ্রিয় ও কুখ্যাত; কুখ্যাত কারণ তিনি একজন নাস্তিক, নিজেকে তিনি যুক্তিবাদী হিসাবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন, বস্তুবাদী দার্শনিক হিসাবে এবং একই সাথে বিবর্তনবিদ্যায় যথেস্ট দখল থাকায় দেশে বিদেশে মোটামুটি নামডাক থাকলেও, ধার্মিক তথা আস্তিক মহলে “নাস্তিক” গালিও তার হজম করতে হয়- যদিও নাস্তিক হিসাবে অভিহিত হতে তিনি গর্ববোধই করেন এবং “নাস্তিকতা”কে গালি হিসাবে উত্থাপিত হতে দেখে তিনি বিরক্তি বোধ করেন। তবে আস্তিকদের গালি কেবল “নাস্তিক” শব্দটিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সামনা-সামনি বিভিন্ন ডিবেটে গলার আওয়াজ কিছুটা চড়া হওয়া, ভুরু কুচকানো- মুখমণ্ডল বাংলার পাঁচ হওয়া এবং যুক্তির ছলে পিতা-মাতা ও জন্ম সংক্রান্ত নানাবিধ প্রশ্ন যথাসম্ভব ভদ্রভাষায় বলা .. প্রভৃতি এবং আড়ালে আবডালে লুকিয়ে, উড়োচিঠিতে এমনকি ক্যাম্পাসের দেয়াললিখনে অকথ্য গালি-গালাজ থেকে শুরু করে এমনকি মৃত্যুর হুমকি …. সবই এখন অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। সচরাচর তিনি এসবকে অগ্রাহ্য করেন, তবে মাঝেমধ্যে মানুষ হয়েও মানুষের এসব আচরণে তিনি খুব হতাশ বোধ করেন। ঈশ্বর ঈদানিং নাস্তিকদের বদলে আস্তিকদের জন্য শয়তান মহাশয়কে নিয়োজিত করেছেন, না কি আস্তিকদের এসমস্ত শয়তানি কাজ-কারবার স্বয়ং ঈশ্বরের ইন্ধনে ঘটছে- সেটা একটা প্রশ্নও বটে! (দ্বিতীয়টি ঘটে থাকলে এ কাজগুলোকে আর ‘শয়তানি’ না বলে অবশ্য ‘ঐশ্বরীয়’ বলাটাই শ্রেয়)।

 

পাঠক! এই হলো আমাদের গল্পের সোলায়মান সাহেব। ওনাকে নিয়ে লিখতে বললে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যাবে এবং সেটা একই কথার পুনরাবৃত্তি না করেই। তদুপরি, মূল গল্পে সরাসরি প্রবেশ করার লক্ষে পরিচয় পর্বটা আমাকে এমন সংক্ষিপ্ত করতেই হলো। অন্তত দশপৃষ্ঠার বর্ণনাকে একটি ছোট প্যারায় নিয়ে আসাটা সবসময়ই খুব কঠিন কাজ, তবে কাজটি নেহাত মন্দ করিনি বলেই আমার বিশ্বাস, আমার ধারণা সোলায়মান সাহেব সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি। এবার তাহলে সরাসরি গল্পেই প্রবেশ করা যাক।

 

একদিনের কথা। যথারীতি সৃষ্টিবাদীদের সাথে বিবর্তনবাদীদের একটি বিতর্কসভায় সোলায়মান সাহেব সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের ভালোই নাজেহাল করেই ফেলেছিলেন, কিন্তু শেষে সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা, উপস্থিত দর্শকদের একটা অংশ (এমনকি উপস্থাপকও না কি?) অনেকটা শোরগোল তুলে দেয়।

-“মৃত্যুর পরে কি কিছুই নেই? কেবল অন্ধকার, আর পঁচে যাওয়া, ধুলামাটিতে পরিণত হওয়া?” (এটা মানলে যে সাধের অনন্ত আনন্দের বেহেশতি জীবন হারাইতে হয়!)
-“যুক্তি দিয়ে তো খুব প্রমাণ করছেন যে ঈশ্বর নেই- কিন্তু শেষ পর্যন্ত যদি তিনি থেকে থাকেন তো?” (যেনবা ঈশ্বরের থাকা না থাকাটা যুক্তির উর্ধে!)
-“আজ বুঝতে পারছেন না, কিন্তু যখন বুঝতে পারবেন- তখন আর সময় পাবেন না।” (যেনবা ওনার জন্য তাদের অনেক দরদ!)
-“যে সৃষ্টি করলো- তাকে অস্বীকার করা মানে তো নিজের বাপ-মা-জন্মকেই অস্বীকার করা।” (আহা! কি যুক্তির ছিরি!) … ইত্যাদি নানা প্রশ্নের ভীড়।

শেষ পর্যন্ত সোলায়মান সাহেব বলতে বাধ্য হোন: “এই বিতর্কসভা যুক্তি-তর্কের উপর ভিত্তি করেই আয়োজিত। যুক্তির বাইরে কোন প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই, ব্যক্তিগত প্রশ্নের তো নই-ই”।

 

হলরুম থেকে বের হয়ে যেন কিছুটা স্বস্তি পেলেন। আজ একটু বেশী বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন ভেবে কিছুটা লজ্জিত হন। বয়সের প্রভাব হয়তো বা। চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে যত্ন করে মুছে আবার চোখে দেন। ভাবেন- বিশ্বাসের কত জোর! যুক্তি টলে গেলেও বিশ্বাস টলে না, বিশ্বাসটাই তখন যুক্তির স্থান নিয়ে নেয়! মৃত্যুর পরের শূণ্য জগৎ মানতে এরা নারাজ! যদি ঈশ্বর সত্যি সত্যি থেকে থাকেন- এই রিস্ক নিতে তারা অপারগ! অপরপক্ষের কথাগুলো নিয়ে ভাবতে থাকেন তিনি, কিছুটা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটছেন- এমন সময় …..। রাস্তার অপর পাড়ে গাড়ি পার্ক করা ছিল, ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হতে গিয়ে- কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলেন হয়তো, কিন্তু শেষ মুহুর্তে একটি সন্দেহও তাঁর মাথায় উকি দিয়ে যায়। এই রাস্তায় তো এত গতিতে গাড়ি চলার কথা নয়! অন্যমনস্কতার জন্য নিজেকে ধিক্কার জানাবেন, না কি এটা একটা পরিকল্পিত খুন হতে পারে- সিদ্ধান্তে আসার আগেই চারদিকে সব অন্ধকার।

 

সোলায়মান সাহেব যখন চোখ খুললেন, তখন অবাক হয়ে গেলেন। ছোট্ট একটা বদ্ধ প্রকোষ্ঠে নিজেকে আবিষ্কার করলেন, এবং আবছাভাবে মনে পড়ে গেল- তিনি একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন এবং তারপরে তাকে মাটির নীচে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও, ধাতস্থ হতে তাঁর সময় লাগে না; নার্ভ তাঁর বরাবরই শক্ত। মাটির নীচে কিভাবে আবার চোখ খুললেন, কিভাবে এমনটা সম্ভব হতে পারে এমন চিন্তায় মনোনিবেশ করতে চাইলেন- কিন্তু বাঁধ সাধলো দুই স্বর্গীয় দূত। চিন্তায় মগ্ন থাকতেই তিনি চাইছিলেন, কিন্তু দূত দুটি একটু বেয়াড়া ধরণের। তারা কয়েকটি প্রশ্ন করতে চায় যেগুলোর জবাব না নিয়ে তারা যাবে না- সাফ সাফ জানিয়ে দেয়। ভারী মুশকিলে পড়া গেলো তো- সোলায়মান সাহেব বিরক্তি নিয়ে তাদের দিকে তাকালেন। দূত দুটোকে তার নিম্নশ্রেণীর রোবট ছাড়া কিছুই মনে হলো না, নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন করা আর প্রশ্নের জবাব নেয়ার জন্য যারা প্রোগ্রামড। কি আর করা, সোলায়মান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাদের বললেন- ঠিক আছে! বলো তোমরা – কি প্রশ্নের জবাব চাও?
 

: বলো- তোমার রব কে?
: কি উদ্ভট প্রশ্ন? ‘রব’ বলতে আসলে কি বুঝাতে চাচ্ছো তোমরা?
 

: ‘রব’ মানে হচ্ছে প্রভু, ‘রব’ মানে সৃষ্টিকর্তা, তোমার নিয়ন্ত্রা।
: আমার প্রভু আবার কে? আমরা দাস ব্যবস্থা, সামন্তীয় যুগ পার করে এখন আধুনিক গণতন্ত্রের যুগের মানুষ- এখানে প্রভুত্ব আর নেই। তবে শিল্প মালিকরা এখনো শ্রমদাসদের প্রভু হয়ে উঠে কখনো কখনো- কিন্তু শ্রমিকরা সেই দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙ্গার সংগ্রামও করে। আর আমি একজন শিক্ষক, ছাত্রদের পড়াই, ডিপার্টমেন্টের ডীনকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে কখনো কখনো বস বলেছি ঠিকই- কিন্তু তাদের সাথে আমার সম্পর্ক কখনোই প্রভু-দাসের ছিল না। সৃষ্টিকর্তা বিষয়টা বাজে ও কল্পনাপ্রসূত। আমার নিয়ন্ত্রণকারী আমি নিজেই- তবে সমাজ-সংস্কৃতি-শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবকে অস্বীকার করবো না। ফলে, এবার তোমরাই বলো- আমার কোন ‘রব’ থাকার দরকার আছে কি না? তোমাদেরই তেমন কোন ‘রব’ আছে কি?
 

: হ্যাঁ! আমাদেরও ‘রব’ আছে, প্রত্যেকেরই ‘রব’ থাকেই থাকে- তোমারো আছে- এবং তিনি একজনই- বলো তিনি কে? তাঁকে কি চেনো না?
: না! তোমরা সঠিক বললে না। তোমাদের হয়তো একজন প্রভু থাকতে পারে যিনি তোমাদের চাকর-বাকরের মতো খাটায়, তিনি তোমাদের নিয়ন্ত্রণকারীও হতে পারে; কিন্তু তিনিই যে তোমাদের সৃষ্টিকর্তা সে ব্যাপারে তোমরা কি নিশ্চিত?
 

: (একটু মাথা চুলকিয়ে) অবশ্যই নিশ্চিত।
: কিভাবে?
 

: তিনিই আমাদের বলেছেন।
: আরে বুদ্ধু, এটাকে বলে সার্কুলার লজিক। তোমরা কি দেখেছো যে তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন?
 

: (আবার মাথা চুলকিয়ে ও একে অপরের দিকে তাকিয়ে) উ- আ- হু – না …
: হুম, আরো ভালো করে চিন্তা করো। চিন্তা করতে শিখো, তবেই না মানুষ হবে। আর, আমার ক্ষেত্রেতো অন্য দুটোও খাটছে না। তোমরা যেমন এখানে এসেছো- তোমাদের সেই কথিত ‘রবে’র নির্দেশ মোতাবেক, কিন্তু আমি কার দাসত্ব করছি বলতে পারো? তোমাদের ‘রব’ তোমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতেই পারে, কিন্তু আমাকেও কি নিয়ন্ত্রণ করছেন? আমার নিয়ন্ত্রণকারী আমাকে কেন প্রশ্ন করার জন্য তোমাদের পাঠাবেন? আবার তোমাদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার স্বাধীনতা যদি আমার থাকে তবে কি তিনি আর নিয়ন্ত্রণকারী থাকতে পারেন? বলো তোমরা।

স্বর্গীয় দূত দুজনকেই একটু বিভ্রান্ত মনে হয়। তাদেরকে পাঠানো হয়েছে কয়েকটি প্রশ্ন করার জন্য, ফটাফট প্রশ্নের জবাব শুনে তারা ঈশ্বরের কাছে রিপোর্ট করবে; বরাবরই এমনটাই হয়েছে, সকলে জবাব দিয়েছে- কেউ ভুল আর কেউ সঠিক; কিন্তু এই আজব লোকটি তাদের উল্টো প্রশ্ন করছে এবং তারা ঠিক জবাব দিতে পারছে না। বুঝতেও পারছে না- কি করবে। একবার মনে হচ্ছে- পাল্টা প্রশ্ন করলেও লোকটি ঠিকই জবাব দিয়েছে- পরের প্রশ্ন করা দরকার, আরেকবার মনে হচ্ছে- ১ম প্রশ্ন নিয়ে যেহেতু লোকটি কিছু জানতে চাচ্ছে- সেহেতু পরের প্রশ্নে যাওয়া ঠিক হবে না, কেননা প্রশ্ন করেছে মানেই লোকটি তার আলোচনা বা জবাব শেষ করেনি। এ অবস্থায় কি করা যেতে পারে? ঈশ্বরের কাছে সাহায্যের জন্য চলে যাবে? তিন প্রশ্নের জবাব না নিয়েই? এটা ঠিক হবে? কি বিপদেই না পড়া গেলো! হতবুদ্ধি হয়ে তার ঠায় দাঁড়িয়েই থাকে।

শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরই তাদের সে অবস্থা থেকে রক্ষা করে। তিনজনকেই তলব করেন তিনি। সচরাচর এমনটা তিনি করেন না, কিন্তু এবারে দূতদ্বয়ের উপর তিনি ঠিক আস্থা রাখতে পারলেন না, তাছাড়া এটা ভাবলেন যে- এই লোকের সাথে সরাসরি কথা বলাই ভালো হবে। দূতদুটিকে শিখিয়ে পড়িয়ে আবার পাঠানো যেত, কিন্তু নতুন কি না কি প্রশ্ন করে বসে কে জানে! ফলে,সোলায়মান সাহেবকেই ডেকে পাঠান। সোলায়মান সাহেব ঈশ্বরের মুখোমুখি হন।

সপ্তম আসমানে উপস্থিত হওয়ার পরে এবং ঈশ্বরের মুখোমুখি হওয়ার আগে সোলায়মান সাহেব দুটো সমস্যা নিয়ে ভাবছিলেন, কি করে এত দ্রুতগতিতে মহাশূণ্যে চলে আসলেন, এবং মহাশূণ্যে কিভাবে তিনি স্থিরভাবে ভাসছেন, দ্বিতীয় সমস্যার সমাধানটাও প্রায় বের করে ফেলেছিলেন (সম্ভবত তার উপর ক্রিয়ারত আপেক্ষিক গ্রাভিটেশনাল ফোর্স জিরো), কিন্তু এবারো বেশীক্ষণ ভাববার সময় পেলেন না। ঈশ্বর তার সামনে এসে হাজির হলেন। প্রথম দর্শনে ঈশ্বরকে তার খারাপ লাগে না। চারদিক ধবধবে সাদা আলোয় ভরে গেলো, ঈশ্বরের চেহারার মধ্যেও শ্বেত-শুভ্র একটা ভাব আছে, আর সোলায়মান সাহেব আগে থেকেই সাদা রংটি খুব পছন্দ করতেন, ফলে ঈশ্বরকে দেখতে তার ভালোই লাগলো। ঈশ্বরের চোখ দুটোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন- উদ্ধত একটা ভাব থাকলেও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত মনে হলো, সোলায়মান সাহেব একটু খুশী হন- একজন বোকার চেয়ে বুদ্ধিমান কারো সাথে কথা বলা অনেক মজার, তা সে যে-ই হোক না কেন। ঈশ্বর গমগম কন্ঠে বলে উঠলেন: কি হে সোলায়মান!

এই সম্বোধনে সোলায়মান সাহেবের খুব একটা পছন্দ হলো না। ভদ্রলোক কি কার্টেসি জানে না? প্রথম সাক্ষাতে প্রথম কথাতেই এরকম নাম ধরে ডাকাডাকি! যাহোক, তিনি বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। তিনিও কথা শুরু করলেন। 

: জ্বি বলুন! অবশ্য আপনাকে ঠিক চিনলাম না। আপনার পরিচয়টা যদি প্রথমে দিতেন..
 

: হ্যাঁ! আমিই ‘রব’।
:
(পাশেই দূত দুজন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলো, তাদের দিকে তাকিয়ে) ওহ, এই দুজনের রব! ভালো। ওদের কিন্তু বুদ্ধির বিকাশটা ঠিকভাবে ঘটেনি।
 

: নাহ! (হুংকারের শব্দ) আমি সকলের রব! সবাই আমার বান্দা। সবকিছুই আমার হাতে সৃষ্ট। আমি সবকিছুর প্রভু, সবই আমার হুকুমের দাস!

হুংকার শুনে সোলায়মান সাহেব কিছুটা চমকে উঠেন। সামনা-সামনি দুজন কথা বলার সময় এমন চিৎকার করার কি দরকার তা ঠিক বুঝে আসেনা। ভোকাল কর্ডে সমস্যা, না কি সমস্যাটা মস্তিস্কে সেটা ভাবেন। দ্বিতীয়টির সম্ভাবনাকে অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়- শেষের প্রলাপগুলোর কথা মনে পড়ায়। একটু হাসিও পেয়ে যায়। যাহোক, সোলায়মান সাহেবকে নীরব থাকতে দেখে কিংবা ঠোটের কোণে হাসির ঝিলিক দেখে ঈশ্বর আবার গমগম করে বলে ওঠেন: 

: কি! এবার তো বিশ্বাস হচ্ছে যে, আমিই তোমার ‘রব’? আমিই ঈশ্বর?
: দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না। আমি আসলে নাস্তিক, ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না।
 

: কি? ঈশ্বরকে দেখেও তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে পারছো না? তুমি না দুনিয়ায় বলতে যে, ঈশ্বরকে বিশ্বাস করো না কারণ তুমি ঈশ্বর দেখোনি! আজ এই মুহুর্তে তোমার সামনে তোমার ঈশ্বর দন্ডায়মান- তুমি তোমার ঈশ্বরকে কেবল দেখছোই না, তার সাথে কথাও বলছো, তারপরেও বলছো যে, তুমি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করো না! কোন যুক্তিতে তোমার ঈশ্বরকে অস্বীকার করছো?
: জনাব, রাগ করবেন না। যুক্তি আমার আছে। সেটা হচ্ছে প্রমাণের অভাব। দুনিয়াতে আমার জন্য আমি ঐ যুক্তি করতাম ঠিকই, কিন্তু সাথে এই যুক্তিও করতাম- যে দেখেছে বলে দাবী করছে, তাকে তার দেখার সঠিকতাও প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ, কেউ কেউ যখন দাবী করতো যে সে বা তারা ভূত যেহেতু দেখেছে, সেহেতু ভূত আছে, তাদের তখন বলতাম- তোমরা যেটাকে দেখে ভূত বলছো- সেটা কি আসলেই তোমাদের দাবীকৃত ভূত? আপনিই যে ঈশ্বর সে ব্যাপারে এখনো কোন প্রমাণ পাই নি আমি। দুঃখিত।
 

: প্রমাণ চাও? (আবার হুংকার) জানো! তোমাকে নিয়ে আমি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারি!

সোলায়মান সাহেব কিঞ্চিত ভয় পান। ইতিহাসে হিটলার-মুসোলিনির কথা পড়েছেন। অধুনা বিশ্বে জর্জ ডব্লিউ বুশকে মিডিয়ায় ভালোই প্রত্যক্ষ করেছেন। ঈশ্বর হিসাবে দাবী করা ভদ্রলোকটি দেখতে যতই শেত-শুভ্র হোক না কেন, এই মুহুর্তে তাকে এদের মতোই স্বেচ্ছাচারী একনায়ক মনে হয়। ক্ষমতাধরেরা এমন অমানুষ হয় কেন? ক্ষমতাই কি তবে সব নষ্টের গোড়া?


: জানি জনাব! আজ যেমন করেই হোক আমি আপনার কব্জায়, আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা করতে পারেন। যা ইচ্ছা করতে পারাটা কি ন্যায় সংগত? ঈশ্বরের ধারণা কি ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়? দুর্বলের উপর সবলেরা এমনটা সবসময় করেও থাকে। দুনিয়াতে আমরা গৃহপালিত পশপাখির সাথে যা ইচ্ছা করে থাকি। একসময় আফ্রিকা থেকে নিগ্রোদের ধরে এনে কৃতদাস বানানো হতো- তাদের সাথেও তাদের মালিকেরা যা ইচ্ছা করতে পারতো, আমাদেরকে গৃহপালিত পশুর ঈশ্বর বলবেন? দাসমালিকদের ঐসব কৃতদাসেদের ঈশ্বর বলবেন?
 

: আহ! বুঝতে পারছো না যে, আমি স্রষ্টা। আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি।
: হ্যাঁ আসলেই বুঝতে পারছি না। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন? কবে, কোথায়, কিভাবে? প্রমাণ দেন।
 

: আমি সৃষ্টি না করলে- তবে কে তোমাকে সৃষ্টি করেছে?
: কেন, আমার বাবা-মা’র মিলনেই আমার জন্ম।
 

: কিভাবে?
: বাবার কাছ থেকে এসেছে শুক্রাণু, আর মা’র আছে ডিম্বাণু- শুক্রাণু দ্বারা ডিম্বাণু নিষিক্ত হলে হয় জাইগোট বা ভ্রূণ, সেখান থেকে ….
 

: বাস বাস! হয়েছে হয়েছে! পুরা প্রসেস বলতে হবে না। আমাকে বলো- প্রতিটা ধাপ বা প্রসেস কিভাবে সম্পন্ন হলো?
: সব কিছুই প্রাকৃতিকভাবে।
 

: প্রাকৃতিকভাবে? তা-ও আমার কথা বলবে না? কেন?
: কারণ, প্রাকৃতিকভাবে যখন বলছি- সেটার একটা মানে আছে। প্রকৃতির অভ্যন্তরে সুস্পষ্ট কিছু নিয়ম আছে- এই নিয়ম মেনেই সব কিছু হয়। বিজ্ঞান এই নিয়মগুলোকেই খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। বিজ্ঞান ঐ ঈশ্বরকে মানে না- যে প্রকৃতির এই নিয়মগুলোকে তোয়াক্কা করে না। অর্থাৎ মানব ভ্রূণ তৈরী করতে চাইলে ঈশ্বরকে শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর নিষিক্তকরণের মধ্য দিয়েই যেতে হবে; আলু আর পটল মিলায়া হাজার চেষ্টা করলেও ঈশ্বর কেন- তারও ঈশ্বর- তারও ঈশ্বর- কোনদিন মানবভ্রূণ তৈরী করতে পারবে না। এখন কেউ যদি প্রাকৃতিক নিয়ম সমূহকেই ঈশ্বর বলে অভিহিত করতে চায়, বা প্রকৃতিক নিয়মের অধীন, অথর্ব, সীমাবদ্ধ ক্ষমতা ও সামর্থ্যের অধিকারী একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস আনয়ন করতে চায় তবে তেমন আপত্তি দেখি না; কিন্তু আমি ঈশ্বর শব্দটির চেয়ে ‘প্রাকৃতিক নিয়ম অনুসারে’ বলতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো, কেননা ঈশ্বর শব্দের প্রচলিত অর্থের সাথে এর কোন মিলই নেই।
 

: দেখো- তোমার সাথে এত তর্ক করার কিছু নেই। তোমাকে তো বিশ্বাস করতে হবে যে এককালে তুমি ছিলে না- আমিই তোমাকে তোমার মায়ের পেটে জীবন দিয়েছি।
: কিভাবে বিশ্বাস করবো? আমার জন্ম পদ্ধতি তো আগে বলেইছি। বিজ্ঞান এটা প্রমাণ করেছে। আর জন্মের সময় আপনাকে আমি দেখিওনি যে আপনি আমাকে সৃষ্টি করছেন!
 

: কি আশ্চর্য! ঐ সময়ের স্মৃতি কারো থাকে না কি?
: ফলে যে সময়ের স্মৃতি থাকে না- সে সময়কে নিয়ে আলোচনাও অনর্থক। ধরেন- কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ের স্মৃতি আপনি হারিয়ে ফেললেন। এখন ঐ সময়ে আপনি এই করেছেন- সেই করেছেন এমন দাবী যদি আমি তুলি- তবে সেটা কি আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য থাকবেন?
 

: তাহলে তো আমি যে তোমাকে সৃষ্টি করেছি- সেটার প্রমাণ তোমার কখনো পাওয়া হবে না!
: সেই প্রমাণ পাওয়ার খুব দরকারো দেখি না!
 

: কিন্তু সবকিছুরই তো একটা শুরু আছে, মানে সৃষ্টি আছে। ফলে সৃষ্টিকর্তা থাকাটাই কি স্বাভাবিক নয়?
: না, বিষয়টা এমন নয়। সবকিছুর শুরু একসাথে নয় এবং শুরু বা সৃষ্টিগুলোও প্রাকৃতিকভাবে ও প্রকৃতির নিয়মানুসারেই। আর, আপনার যুক্তি মোতাবেক যদি ধরেও নিই যে- সবকিছুর সৃষ্টি আছে বিধায় সৃষ্টিকর্তাও আবশ্যক- তবে স্বভাবতই প্রশ্ন চলে আসে যে- আপনার তাহলে সৃষ্টিকর্তা কে, তার সৃষ্টিকর্তা কে, …। আপনি যদি অস্বীকার করতে চান- তবে বলবো, আপনার জন্মকালীন সময়কার স্মৃতিভ্রস্টতাই আপনাকে আপনার সৃষ্টিকর্তা থেকে অজ্ঞাতে রেখেছে!
 

: খামোস! (ভীষণ হুংকার)- তোমার এতো বড় আস্পর্ধা! সেই কখন থেকে মুখে মুখে তর্ক করছো! আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার সৃষ্টিকর্তার গল্প করছো! এত সাহস! তোমাকে আমি নরকের আগুনে পুড়াবো! পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দেবো! …. ইত্যাদি। (দূতদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে)- তোমরা এখুনি বের হও, খুঁজে খুঁজে বের করো দোযখের সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টদায়ক জায়গা- সেখানে আজ একে ঝুলাবো!

 

সোলায়মান সাহেব প্রথমে ভেবেছিলেন- দুতদ্বয়ের সামনে এইসব কথা বলায় ভদ্রলোক অপমানিত ও ক্ষিপ্ত হয়েছেন বলেই তাদের বের করে দিলেন। কিন্তু দূতদ্বয় চলে যাওয়ার পরেও যখন তিনি কিভাবে সোলায়মান সাহেবকে নরকে শাস্তি দিবেন- তা গমগম গলায় বর্ণনা করছেন, তখন তিনি একটু দমে গেলেন এবং অজানা বিপদের আশংকায় একটু কেঁপেও উঠলেন। শাস্তির ব্যাপারটা ভালো করে ঠিকঠাক করে দূতদ্বয় আসলে এবারে তিনি তাদের সোলায়মান সাহেবকে নিয়ে একটু স্বর্গ দেখিয়ে নিয়ে আসার হুকুম দিলেন।
 

দূতদ্বয়ের সাথে করে সোলায়মান সাহেব স্বর্গ দর্শনে বের হলেন। স্বর্গের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই একটা নির্মল শীতল বায়ুর পরশ, মনমাতানো এক সুবাস, সুরের মুর্ছনা সবমিলিয়ে সোলয়মান সাহেবের শুরুতে ভালোই লাগলো। তার উপর যখন তাকিয়ে দেখেন চারদিকে- তখন সবকিছুকে ছবির মত সাজানো একটা বাগান মনে হয়, খুব সুন্দর একটা বাগান। মোটের উপর প্রথমে স্বর্গ সোলায়মান সাহেবকে আকর্ষণ করেছিল, দুঃখ-কষ্টহীন জীবনের জন্য নয়, বরং নরুপদ্রব জীবনে চিন্তা করার ও গবেষণা করার প্রচুর সময় পাওয়া যাবে এই ভাবনায়। কিন্তু স্বর্গের আরেকটু ভেতরে গিয়ে, সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন যাপন দেখে- তার আগের সেই ভাব দূর হতেও সময় লাগে না! সুরা আর নারীতে মত্ত স্বর্গবাসীদের দেখে দুঃখ বোধ হলো। এটা কি কোন জীবন হলো? একেকজনকে অসংখ্য নারী পরিবেষ্টিত দেখে এই বেহিসেবী জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরী হয়। স্বর্গকে তার খুব অশ্লীল মনে হতে থাকে। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেলেন। তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। নাহ! এই জায়গায় বাস করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। দুনিয়াতেই তো কতো পাব-বার- কত সেক্স শপ ছিল, সেখানে যাবার প্রয়োজন কখনো হয়নি। তার গা-গুলিয়ে উঠে। কিছুদূর যেতে তিনি অবাক হয়ে দেখেন- কিছু স্বর্গবাসী কেমন যেন উদাস হয়ে বসে আছে, সুরার পাত্র অযত্নে পাশে পড়ে আছে- সুন্দরী নারীরা তাদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নানা ভাব-ভঙ্গী করছে, কিন্তু তারা ঠিক সেভাবে সাড়া দিচ্ছে না! অবাক হয়ে দূতদের জিজ্ঞেস করেন- ঘটনা কি? দূতরা বলে- ঘটনা কি ঠিক বলতে পারবো না, তবে এরা স্বর্গের পুরান বাসিন্দা, অনেকদিন ধরেই এরা এখানে আছে। সোলায়মান সাহেব মুহুর্তেই বুঝতে পারেন- কেন এরা এমন উদাসী ও বিষন্ন। অনন্ত সুখ বলে আসলে তো কিছুই থাকতে পারে না। এক বিখ্যাত কবিতায় তিনি পড়েছিলেন- অন্ধকার আছে বলেই না আলোর মাহাত্ম, সেই কথাটা অনেক বেশী অনুভব করতে পারলেন। এই লোকগুলোর জন্য তিনি অন্তরে একটা বেদনা বোধ করেন। স্বর্গ দেখার সাধ তার মিটে গিয়েছে, তিনি ফিরতে চান। দূতদ্বয়ের সাথে তিনি আবার ঈশ্বরের কাছে ফিরে আসেন।

 

নরকের সীমাহীন যন্ত্রণার কথা শুনে সেটায় যেতে ভয় পাচ্ছিলেন ঠিকই, একইসাথে স্বর্গকে চাক্ষুষ দেখেও যে অভিজ্ঞতা হলো- তাতে সেই জীবনে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারছেন না। সবদিক দিয়ে দুনিয়ার জীবনটাকেই অসাধারণ মনে হয়। তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী, ছোট ছোট দু সন্তান, বাবা-মা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, ছাত্র, বই-পত্র, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম, সেমিনার কক্ষ, গবেষণাগার, দুনিয়ার প্রকৃতি- গাছ-পালা, ফসলের মাঠ, নদী, পাহাড়, পশু পাখি … সবকিছুই তার কত না প্রিয়, সবকেই আজ যেন আরো বেশী অনুভব করতে থাকেন।

ঈশ্বরের গমগম কথায় চিন্তায় ছেদ পড়ে।

: কি সোলায়মান! নরকবাসের জন্য প্রস্তুত তো?
: আমার প্রস্তুতিতে কি আর এসে যায়, বলেন!
: স্বর্গ কেমন দেখলে? লোভ হচ্ছে না? এখনও স্বীকার করো যে, আমিই ঈশ্বর! নরকে কিন্তু রয়েছে সীমাহীন যন্ত্রণা।
: দেখুন- ভয় বা লোভ দেখিয়ে ঈশ্বরের স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা কি ন্যায় সংগত? আর, স্বর্গের জন্য কোন লোভ হচ্ছে না, বরং স্বর্গ ও নরক উভয়কেই ভয় পাচ্ছি।
: হা হা! তোমাকে তোমার কৃতকর্মের শাস্তি পেতেই হবে!
: শাস্তি? কোন অপরাধ করেছি যে, শাস্তি পেতে হবে?
: তুমি তোমার ঈশ্বরকে অস্বীকার করেছো!
: আপনি শাস্তি বা পুরষ্কৃত করেন কোন সময়কার কাজকে গণনায় নিয়ে? সামনা-সামনি কথাবার্তায় আপনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে শাস্তি দিতে চাচ্ছেন?
: নাহ! দুনিয়াতেও তুমি তোমার ঈশ্বরকে অস্বীকার করেছো!
: সেটা কোন অপরাধ হতে পারে না- ঈশ্বরে বিশ্বাস করার মতো কোন প্রমাণ ছিল না।
: কেন? তোমাদের জন্য আমি মহাগ্রন্থ পাঠাইনি?
: সেই গ্রন্থগুলো মানুষকেই লিখতে দেখেছি, মানুষের মুদ্রণযন্ত্রে ছাপানো হতে দেখেছি, কিন্তু কোন গ্রন্থকে কখনো কোন অশরীরীকে লেখতে দেখিনি, আকাশ থেকেও টুপ করে পড়তে দেখিনি। ফলে, কিভাবে বিশ্বাস করি যে- সেই গ্রন্থ ঈশ্বরের লেখা?
: এই বিশ্বাস করতে না পারাটাই তোমার অপরাধ, সে জন্যেই তোমার শাস্তি পেতে হবে।
: কিন্তু আমি দুনিয়ায় অনেক ভালো কাজ করেছি।
: তো?
: আমি গরীব-দুঃখীদের পাশে দাড়িয়েছি সবসময়। দুস্থদের জন্য একটা আশ্রম খুলেছি।
: তো?
: আমি সবসময় মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছি।
: তো?
: আমি প্রকৃতিপ্রেমী ছিলাম, প্রচুর গাছ লাগিয়েছি, যত্ন নিয়েছি- পশুপাখিও যাতে ভালো থাকে সে জন্য কাজ করে গিয়েছি।
: তো?
: আমি কোন অন্যায় করিনি। কারো ক্ষতি কখনো করিনি।
: তো?
: এসবের কোনটির জন্যই কি আমি পুরস্কৃত হতে পারিনা?
: তোমার ঈশ্বর, তোমার সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করায় সমস্ত কিছুই মূল্যহীন হয়ে গিয়েছে।
: মানি না তোমার এ আইন। এবারে আরো ভালো করে বুঝতে পারলাম যে, ঈশ্বর একটা অন্যায় প্রতিষ্ঠান, ন্যায়ের কোন স্থান এখানে নেই।
: কি! এত বড় কথা! এক্ষুনি তোমাকে নরকে পাঠাবো- আর তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছো?
: যেকোন পরিস্থিতিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সৎসাহস আমার আছে। জেনে রাখো আমি মানুষ! মানুষই যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।
: হা! মানুষ! আমার সৃষ্ট পুঁচকে জীব কোথাকার! এত কথা না বলে আমাকে বলো- তুমি এখন কোথায়? তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে? কার সাথে কথা বলছো? কোন জগতে আছো? কিভাবে আছো? তোমার সাধের বিজ্ঞান এর কি ব্যাখ্যা দিবে? হা হা হা হা ….
: হাসবেন না, হাসবেন না! শুরুতে একটু কনফিউজড ছিলাম, কিন্তু এটাও জানতাম একটু চিন্তা করার ফুসরত পেলেই সব বের করতে পারবো। ফুসরতটাই ঠিক ভাবে পাচ্ছিলাম না বলে সবকিছু বের করতে এত সময় লাগলো। এখন আমি জানি এসব কিছুর ব্যাখ্যা।
: কি?
: সব কিছুই আমার উত্তপ্ত মস্তিস্কের কল্পনা! অর্থাৎ আপনার, আপনার এই জগতের, আপনাদের সৃষ্টি আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কে!
: কি ! এত সাহস! (তীব্র হুংকার) এই তোমাকে এখন নরকে নিক্ষেপ করছি।
: আরে ধুর! এক তুড়ি মেরে আপনারে আপনার নরক সমেত উধাও করে দিতে পারবো ..

 

 

এই কথার সাথে সাথে ঈশ্বর সোলায়মান সাহেবকে নরকে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলেন- সোলায়মান সাহেবও তুড়ি মারতে উদ্যত…। তারপর আবার সব অন্ধকার।

সোলায়মান সাহেব যখন চোখ খুললেন- তখন মুখে অক্সিজেন মাস্ক, নাকে নল, চোখের সামনে স্যালাইনের স্ট্যান্ড-নল, নানা মেডিক্যল ইকুয়েপমেন্টের ফাঁক দিয়ে আবছাভাবে প্রিয়তমা স্ত্রীর অশ্রুসজল মুখ দেখে দারুন প্রশান্তি বোধ করলেন। সন্তানদের মুখ দেখার জন্য মাথা ঘুরাতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। না পারলেও ঠিকই অনুভব করতে পারছিলেন- প্রাণপ্রিয় সন্তানেরা আশেপাশেই আছে। তিনি নিশ্চিত জানেন অসংখ্য উদ্বিগ্ন মুখ এই রুমের বাইরে অপেক্ষায় আছে। তার মনে হলো- পরকালের কল্পিত স্বর্গ-নরক উভয়ই আসলে নরক, আসল স্বর্গ তো দুনিয়ার মানুষের ভালোবাসা। নাহ! তাকে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে। মস্তিষ্ককে একটু বিশ্রাম দেয়া দরকার। পরম শান্তিতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

[ গল্পটি এই ইউটিউব  ভিডিও দেখার পরে, মাথায় আসে। প্রথম প্রকাশঃ মুক্তমনা ব্লগ। ]

রবিবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০০৯

আধুনিক এটমিক তত্ত্বের জনক জন ডাল্টন, না কি স্বয়ং আল্লাহ?

 এক

কোরআনকে বিজ্ঞানময় করার আপ্রাণ চেস্টা মোল্লারা অব্যাহত রেখেছে। ফলে নানারকম দাবির কথাও কানে আসে। সেদিন সেরকমই এক মজার দাবির কথা চোখে পড়লো। কোরআনেই নাকি সেই ১৪০০ বছর আগেই পরমাণুর কথা বলা আছে!! কি সেই দাবি? আল কোরআনের ৩৪ নং সুরার ৩ নং আয়াতে নাকি আল্লাহ পরিস্কারভাবে পরমাণুর কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন যে- কোন কিছুই আল্লাহর অজ্ঞাত নয়।

তাহলে প্রথমে সুরা সাবা’র ৩ নং আয়াতটি দেখা যাক। ইউসুফ আলি, পিকথাল ও শাকির তিনজনের অনুবাদেই দেখা যায় “atom” শব্দটি বিদ্যমান:

034.003
YUSUFALI:
The Unbelievers say, “Never to us will come the Hour”: Say, “Nay! but most surely, by my Lord, it will come upon you;- by Him Who knows the unseen,- from Whom is not hidden the least little atom in the heavens or on earth: Nor is there anything less than that, or greater, but is in the Record Perspicuous:

PICKTHAL: Those who disbelieve say: The Hour will never come unto us. Say: Nay, by my Lord, but it is coming unto you surely. (He is) the Knower of the Unseen. Not an atom‘s weight, or less than that or greater, escapeth Him in the heavens or in the earth, but it is in a clear Record,

SHAKIR: And those who disbelieve say: The hour shall not come upon us. Say: Yea! by my Lord, the Knower of the unseen, it shall certainly come upon you; not the weight of an atom becomes absent from Him, in the heavens or in the earth, and neither less than that nor greater, but (all) is in a clear book.

অবাক হয়ে যাই। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে, কোরআনেই তো পরমাণুর কথা উল্লেখ আছে। একদম তাজ্জব ব্যাপার। আরবী কোন শব্দের অনুবাদ atom করা হয়েছে- তা জানার আগ্রবোধ করি। পুরা আয়াতটি হচ্ছে:

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُواْ لاَ تَأْتِينَا السَّاعَةُ قُلْ بَلَى وَرَبِّى لَتَأْتِيَنَّكُمْ عَـلِمِ الْغَيْبِ لاَ يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِى السَّمَـوَتِ وَلاَ فِى الاٌّرْضِ وَلاَ أَصْغَرُ مِن ذَلِكَ وَلاَ أَكْبَرُ إِلاَّ فِى كِتَـبٍ مُّبِينٍ

এখানে مِثْقَالُ ذَرَّةٍ এর অনুবাদ ধরা হয়েছে পরমাণু পরিমাণে। এই শব্দটি নিয়ে ঘাটাঘাটির আগে ভাবলাম আরো কিছু কোরআনের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। হাতের কাছে ডঃ মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান কর্তৃক অনুদিত কোরআন শরীফ ছিল- সেটাই হাতে নিলাম। সেখানে কোন পরমাণু অবশ্য পেলাম না। অনুবাদটি অনেকটা এরকম:

“কাফিররা বলেঃ আমাদের উপর কিয়ামত আসবে না। আপনি বলে দিন, কেন আসবে না? কসম আমার রবের! অবশ্যই তা তোমাদের উপর আসবে। তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। আসমানে ও যমীনে রেণু পরিমাণ বস্তুও তাঁর অগোচরে নয়, কিংবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্রও নেই এবং বৃহৎও নেই, কিন্তু এ সবই সুস্পষ্ট কিতাবে আছে।”

এখানে তো مِثْقَالُ ذَرَّةٍ এর অর্থ করা হয়েছে রেণু পরিমাণ। কি মুশকিল? একেক জায়গায় একেক রকম অনুবাদ! ফলে নিরূপায় হয়ে ইবনে কাথিরের শরণাপন্ন হলাম:

Those who disbelieve say: “The Hour will not come to us.” Say: “Yes, by my Lord, the All-Knower of the Unseen, it will come to you; not even the weight of a speck of dust or less than that or greater escapes His knowledge in the heavens or in the earth but it is in a Clear Book.”

ইবনে কাথিরও তো দেখি এটম ব্যবহার করেননি- করেছেন “বালিকণার সমান ওজনের”। এবারে কি করা যায়? খুঁজতে গিয়ে দেখি এই مِثْقَالُ ذَرَّةٍ শব্দটি কোরআণের সুরা যিলযাল (৯৯ নং) এর ৭ ও ৮ নং আয়াতেও আছে:

فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ
৭. অতঃপর কেউ অনু পরিমান সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে ।
وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
৮. এবং কেউ অনু পরিমান অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে ।

বাংলা অনুবাদে তো দেখি পরমাণুর বদলে এবার অণু! হায় হায়! তাহলে কি হুজুরেরা এবার দাবি জানাবে কোরআনে কেবল “পরমাণু” নয় “অণু”র কথাও আল্লাহ পাক সেই ১৪০০ বছর আগে জানিয়েছেন? কি মসিবতে পড়লাম! তাড়াতাড়ি করে আবার ইউসুফ আলি, পিকথাল ও শাকিরের অনুবাদ দেখি:

099.007
YUSUFALI:
Then shall anyone who has done an atom‘s weight of good, see it!
PICKTHAL: And whoso doeth good an atom‘s weight will see it then,
SHAKIR: So. he who has done an atom‘s weight of good shall see it

099.008
YUSUFALI:
And anyone who has done an atom‘s weight of evil, shall see it.
PICKTHAL: And whoso doeth ill an atom‘s weight will see it then.
SHAKIR: And he who has done an atom‘s weight of evil shall see it.

এবং দেখি- ইবনে কাথির কি অনুবাদ করেছেন:

7. So, whosoever does good equal to the weight of a speck of dust shall see it.

8. And whosoever does evil equal to the weight of a speck of dust shall see it.

ভালো মুশকিলেই পড়া গেল! অণু পরিমাণ, পরমাণু বা এটমের ওজনের সমান, রেণু পরিমাণ, ধুলিকণার সমান- কোনটা ঠিক? নাকি সবই? সবগুলো আয়াত ভালো করে পড়ার চেস্টা করলাম। পড়ে মনে হলো- সব অনুবাদই সঠিক। সবগুলোকে সঠিক অবশ্য কেবল তখনই বলা যাবে যখন مِثْقَالُ ذَرَّةٍ শব্দটিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বা সামান্য পরিমাণে এরকম অর্থে ধরা হবে। অর্থাৎ আয়াতসমূহে উল্লেখিত ‘পরমাণু’ বা ‘অণু’ পরিমাণ মানে পদার্থের গঠন উপাদান “অণু” বা “পরমাণু” নয়- বা ‘ধুলি কণা সম’ মানে রাস্তাঘাটের ধুলাবালিও নয়- এটা মানে একদম ক্ষুদ্র পরিমাণ। এভাবে ধরলে কোন সমস্যাই থাকে না। তাই ভাবলাম- দেখি অভিধানে مِثْقَالُ ذَرَّةٍ শব্দটির কি অর্থ করা হয়েছে? হাতের কাছে ছিল ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান এর “আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান” বইটা, সেখানে দেখলাম مِثْقَالُ শব্দের অর্থ করা হয়েছে: পরিমাণ বা ওজন, বাটখারা, সামান্য পরিমাণ, বিন্দুমাত্র, রত্তি। আর, ذَرَّة এর অর্থ করা হয়েছে- বিন্দু (ডট), অতি ক্ষুদ্র, শস্যদানা, ক্ষুদ্র কণিকা, বালি কণা। এবং এই ذَرَّة শব্দের অর্থ কখনো কখনো পরমাণুও করা হয়েছে বটে!

তারপরেও বলববো- সুরা সাবা আর সুরা যিলযাল এ مِثْقَالُ ذَرَّة এর ব্যবহারই বলে দেয় ব্যবহৃত অণু-পরমাণু কোনমতেই পদার্থের মৌলিক কণিকারূপী অণু-পরমাণু নয়।

 

দুই
তদুপরি তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে- সুরা সাবা’র ৩ নং আয়াতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুর কথাই বলা হয়েছে, তাহলেও কিছু কথা থেকে যায়:

১। আজকে আমরা জানি যে- পরমাণুও ক্ষুদ্রতম কণা নয়, একেও ভাঙ্গা যায়। আমি ভাবছি- একসময় مِثْقَالُ ذَرَّة কে “সামান্য পরিমাণে” বা “বিন্দুমাত্র” হিসাবে ধরা হতো, তারপরে ইবনে কাথির এর অর্থ করেছেন “ধুলি কণা সম”, তারপরে এসে করা হলো “অণু পরিমাণে” বা “পরমাণুর পরিমাণে”- এই ধারাবাহিকতায় তো অচিরেই কোরআনের কোন এক অনুবাদে দেখবো مِثْقَالُ ذَرَّة এর অর্থ করা হবে “ইলেকট্রন” বা “প্রোটন” বা ফোটন- পজিট্রন-এন্টি নিউট্রিনো .. ইত্যাদি।

২। খৃস্টের জন্মেরও কয়েকশো বছর আগে ভারতীয় ও গ্রীক দর্শনে এটম এর আবির্ভাব। গ্রীক দার্শনিক Leucippus, তার ছাত্র Democritus জানান – বস্তুজগৎ মাত্রই ক্ষুদ্রতম কণিকার সমন্বয়ে গঠিত এবং সবচেয়ে ক্ষুদ্র কণিকার নাম এটম বা পরমাণু বা অবিভাজ্য কণিকা। আমাদের ভারতীয় দর্শনেও জৈন, ন্যায় ও বৈশেষিকরাও অনুরূপ অবিভাজ্য ক্ষুদ্রতম কণিকার কথা বলেছিল (ন্যায় ও বৈশেষিকেরা যাকে পরমব্রহ্মা হিসাবে অভিহিত করেছিলেন)। আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে কেউ একথা বললে যতখানি অবাক হই- তারচেয়েও কি আজ থেকে ২৫০০ বছর আগে বললে বেশী অবাক হওয়া উচিৎ নয়?

৩। ডালটনের এটমিক থিউরির ৫ টি অনুসিদ্ধান্তের একটির সাথে সরাসরি মিলে গেলেও Leucippus, Democritus বা জৈন-ন্যায় ও বৈশেষিক দার্শনিকদের এটম আর ডালটনের এটমের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ফলে- আজকের পরমাণু আর প্রাচীণ গ্রীক বা ভারতীয় দর্শনের পরমাণু মোটেও একই নয়। দেকার্ত প্রথম মোলিকিউল শব্দটি ব্যবহার করলেও এটাও আজকের অণু থেকে যোজন যোজন দুরতম বিষয়। আর, কোরআনের পরমাণু তো- আজকের পরমাণুর সাথে দূরের কথা- গ্রীক-ভারতীয় দর্শনের পরমাণুর সাথে তুলনীয় হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।

 

তিন
ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান খোঁজাটা আজ যেন বাতিকে পরিণত হয়েছে। আগেও একটা পোস্টে (ধর্মে বিজ্ঞানঃ নিম গাছে আমের সন্ধান) এবিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। দেখছি- এ আলোচনা শেষ হবার নয়- কেননা মোল্লারা নিত্য নতুন আবিষ্কার করছে। সামনে হয়তো এরকম পোস্ট আরো লিখতে হবে। তবে, এ মুহুর্তে অতীতে এরকম কাজ আরেক ব্যক্তি করেছিলেন- তার কথা স্মরণ করেই আজকের এই পোস্টে শেষ করবো।

প্রথিতযশা বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা (অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের জনক হিসাবে বিবেচিত) একবার এক উকিলের সাথে কথা বলছিলেন, উকিল সাহেব মেঘনাদ সাহার গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নক্ষত্রের উপাদান ও নানা বিষয়ে বুঝাতে বসলেন। এক পর্যায়ে সেই উকিল সাহেব বলেই ফেললেন, ” এ আর নতুন কি- এসবই তো বেদে আছে”। সাহা আপত্তি জানিয়ে বলেন, “অনুগ্রহ করে বলবেন কি- বেদের কোন জায়গাটিতে নক্ষত্রের আয়নীভবনের তথ্যটি আছে?” ভদ্রলোক অবলীলায় জবাব দেন, “আসলে আমার বেদ পড়া হয়নি, তবে আমার বিশ্বাস বেদে সমস্তই আছে”। এ ঘটনার পরে মেঘনাদ সাহা ২০ বছর ধরে বেদ, উপনিষদ, হিন্দু জ্যোতিষ আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলেন। তারপরে লিখেন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ “সবই ব্যাদে আছে”

এতে তিনি লিখেন:

” ….. বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্রগ্রন্থ এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীণ গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীণ গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। …..”
” … বর্তমান লেখক বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হিন্দুর বেদ ও অপরাপর ধর্মের মূলতত্ত্ব বুঝিতে চেস্টা করিয়াছেন। ইহাতে অবজ্ঞা বা অবহেলার কথা উঠিতে পারে না। তাঁহার বিশ্বাস যে, প্রাচীণ ধর্মগ্রন্থসমূহ যে সমস্ত জাগতিক তথ্য, ঐতিহাসিক জ্ঞান ও মানবচরিত্রের অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত , তাহাদের উপর বর্তমান যুগের উপযোগী জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। ….”

মেঘনাদ সাহা প্রাচীণ ভারতীয় জ্যোতিষ (যাকে হিন্দু জ্যোতিষ আখ্যা দিয়ে ধর্মের শ্রেষ্টত্ব খুঁজে পায় একদল পুরোহিত শ্রেণীর লোকেরা) নিয়েও কথা বলেছেন:

” … এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন আর নতুন কি করিয়াছে? কিন্তু এ সমস্ত ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্কারাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন না। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণ কক্ষ নিরূপন করা যায়। সুতরাং, ভাস্করাচার্য বা কোনো হিন্দু, গ্রিক বা আরবীয় পণ্ডিত কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছুই নয়। ….”

 

চার
আজকের বিজ্ঞান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোন আবিষ্কার বা কোন জ্ঞানের কাছাকাছি কিছূ বা অংশত কিছু সরাসরি বা ঘুরিয়ে পেচিয়ে যদি কোন ধর্মগ্রন্থে মিলেও যায়- তারপরেও তাকে আজকের বিজ্ঞানের সাথে মেলানো যাবে না, কারণ বিজ্ঞান হতে গেলে একটা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি লাগে। কেন ধর্মগ্রন্থের ঐ সব মিলকে বিজ্ঞান বলা যাবে না- তা আশা করি মেঘনাদ সাহা’র উপরের আলোচনা থেকেই পরিষ্কার হয়েছে!

আর, এত কিছুর পরেও যদি পরিষ্কার না হয়- আমার আর কিছুই করার নেই। চোখের ঠুলি যদি কেউ সরাতে না চায় – অন্যের কি সাধ্য?