“আমি অনেক বার শুনিয়াছি যে আমাদের “জঘন্য অবরোধ প্রথা” ই নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায়। উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত ভগ্নীদের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারা প্রায়ই আমাকে “বোরকা” ছাড়িতে বলেন। বলি উন্নতি জিনিসটা আসলে কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তাহলে জেলেনী, চামারিনী, ডুমিনী, প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে ।” [বোরকা, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (পৃষ্ঠাঃ ৫৯, রোকেয়া রচনাবলী)]
মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাত ও বিশেষায়িত বেগম রোকেয়া যখন এভাবে অবরোধ প্রথাকে সমর্থন দিয়েছেন, সেখানে তাকে কি নারী জাগরণের পথিকৃৎ বলা যায়? মতিচূর, প্রথম খন্ডে স্থান পাওয়া “বোরকা” শীর্ষক প্রবন্ধটিতে তিনি আরো বলেছেনঃ
“আমাদের ত বিশ্বাস যে অবরোধের সহিত উন্নতির বেশী বিরোধ নাই। উন্নতির জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই। কেহ কেহ বলেন যে ঐ উচ্চশিক্ষা লাভ করিতে হইলে এফ, এ, বি,এ পরীক্ষার জন্য পর্দা ছাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (university hall-এ) উপস্থিত হইতে হইবে। এ যুক্তি মন্দ নহে! কেন? আমাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় (university) হওয়া এবং পরীক্ষক স্ত্রীলোক হওয়া কি অসম্ভব? যতদিন এইরূপ বন্দোবস্ত না হয়, ততদিন আমাদের পাশকরা বিদ্যা না হইলেও চলিবে”।
চিন্তা করে দেখেন, কিভাবে তিনি অবরোধ প্রথাকে সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, অবরোধ প্রথার সাথে উন্নতির নাকি কোন বিরোধ নাই। এই অবরোধ প্রথার সাথে নাকি কোনরকম আপোশরফা করা যাবে না, দরকারে যতদিন নারীদের স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় ও স্ত্রীলোক পরীক্ষকের বন্দোবস্ত না হচ্ছে, ততদিন পাশকরা বিদ্যা না হলেও নাকি চলবে! এরকম একজনকে তবে কেন নারীশিক্ষার, নারী জাগরণের পুরোধা বলা হয়? মুসলিমদের মত নাস্তিক-সেক্যুলাররাও কেন তাঁকে নিয়ে আপ্লুত থাকে, শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যায়? কেবল, অবরোধ প্রথাকে এমন সমর্থনই নয়, তিনি প্রাথমিক শিক্ষায় কোরআন শিক্ষার গুরুত্বের কথাও বলেছেনঃ
“আমার অমুসলমান ভগিনীগণ! আপনারা কেহ মনে করিবেন না যে, প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কোরআন শিক্ষা দিতে বলিয়া আমি গোড়াঁমীর পরিচয় দিলাম। তাহা নহে, আমি গোঁড়ামী হইতে বহুদূরে। প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থা কোরআনে পাওয়া যায়। আমাদের ধর্ম ও সমাজ অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য কোরআন শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন।”[বঙ্গীয় নারী- শিক্ষা সমিতি,অগ্রন্থিত প্রবন্ধ,(রোকেয়া-রচনাবলী,পৃষ্ঠাঃ ২৩০)]
কি ভয়ঙ্কর! এ তো নির্ঘাত "তালেবান" বানানোর শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন বেগম রোকেয়া! তাই নয় কি? "রোকেয়ার মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনার সবচেয়ে প্রকট রূপ দেখা যায় তাঁর ‘বোরকা’ প্রবন্ধে"। মুক্তমনা ব্লগে ফরিদ আহমেদ তাঁর "রোকেয়াঃ অন্য আলোয় দেখা" প্রবন্ধে বলেছিলেনঃ
"রোকেয়া যতই বলুক না কেন যে তিনি গোঁড়ামী হইতে বহু দূরে, আমরা কিন্তু ঠিকই তাঁর মধ্যে একজন গোঁড়া মুসলমানকে দেখে ফেলি। কোরান পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, মোল্লাদের এই ধারণার সাথে রোকেয়ার অসম্ভব মিল খুঁজে পেয়েও বিস্মিত হই আমরা"।
বেগম রোকেয়া গবেষক এবং রোকেয়াকে নিয়ে লেখা বই ‘বিবি থেকে বেগম’ এর লেখক আকিমুন রহমান এর সাথে একমত হয়ে তিনি উদ্ধৃত করেছিলেনঃ
"সীমাহীন স্ববিরোধ ও পুরুষতন্ত্রের প্রথা মান্য করার অন্য নামই হচ্ছে রোকেয়া। নারীর জীবন গড়ে তোলার কাজে নিবেদিত এক ব্রতী বলে মান্য হন রোকেয়া, তবে তাঁর নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছেমতো কাঠামো দেবার শক্তি ও ইচ্ছেই তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। তাঁর নিজের জীবনই তাঁর নিজের তৈরি নয়। রোকেয়া নারীপ্রতিভা হিশেবে নন্দিত; রোকেয়া প্রতিভা ঠিকই, তবে স্বামীর ছাঁচে বিকশিত প্রতিভা। তিনি অভিজাত পুরুষতন্ত্রের কুপ্রথা ও অবরোধ পীড়নের বিরুদ্ধে মুখর, আর নিজের জীবনে অতিনিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন পতিপ্রভুর পরিয়ে দেওয়া শৃঙ্খল; আমৃত্যু নিয়ন্ত্রিত হন একটি শবদেহ দ্বারা। তাঁর বিবাহিত জীবন স্বল্পকালের, বৈধব্যের কাল দীর্ঘ; স্বল্প বিবাহিত জীবন কাটে তাঁর মহাপাথরের বন্দনায় আর দীর্ঘ বৈধব্যের কাল কাটে মৃতি পতির তৈরি করে রেখে যাওয়া ছক অনুসারে। রোকেয়া বাঙালি মুসলমান নারীর জাগরণের জন্যে লিখে যান জ্বলাময়ী প্রবন্ধ আর নিজের জীবনে অনড় করে রাখেন অন্ধকার ও প্রথার মহিমা। রোকেয়া আদ্যপান্ত স্ববিরোধিতাগ্রস্ত"।
এমন বেগম রোকেয়ার প্রতি কি আমাদের, বিশেষ করে আমাদের মত সেক্যুলার নাস্তিকদের উচ্চবাচ্য করা উচিৎ? দেখাই যাচ্ছে যে, মুক্তমনারা সকলে তার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন না, হুমায়ুন আজাদ যদিও বেগম রোকেয়াকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেছিলেন, ফরিদ আহমেদ এর ভাষায়- ‘বেগম রোকেয়াকে নারীবাদী হিসাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছেন’। নারী গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেনঃ
"রোকেয়া পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে চালিয়েছিলেন সার্বিক আক্রমণ। তিনি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছেন পুরুষতন্ত্রের তৈরি নারী ও পুরুষের ভাবমূর্তি, বর্জন করেছেন নারীপুরুষের প্রথাগত ভূমিকা; তুলনাহীনভাবে আক্রমণ করেছেন পুরুষতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থা ধর্মকে। রোকেয়া পরে ধর্মের সাথে কিছুটা সন্ধি করেছেন আত্মরক্ষার জন্যে; নইলে তাঁকে ও তাঁর আদর্শকে অত্যন্ত বিপন্ন করে তুলতো মুসলমান পিতৃতন্ত্র। তিনি এমন এক পিতৃতন্ত্রের সদস্য ছিলেন, যেখানে পুত্র মাকে শেখায় সতীত্ব"।
হুমায়ুন আজাদ অন্য অনেকের চাঁছাছোলা সমালোচনা করলেও বেগম রোকেয়ার প্রতি কেন এরকম সহমর্মিতা দেখালেন, সেটা মুক্তমনা ব্লগের অনেকেই আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করেছেন! ফরিদ আহমেদ তো পুরুষবাদী পুরুষের সাথেও তুলনা করে বেগম রোকেয়াকে অনেক পশ্চাদপদ দেখেছেন। তিনি লিখেছেন,
সুগৃহিনীদের ঘরকন্নার কাজগুলোর তালিকা এবং সেই সাথে সাথে এগুলোকে সফল করার উপায়ও বাতলে দিয়েছেন তিনি। আসুন দেখি রোকেয়া বর্ণিত সুগৃহিনীদের ঘরকন্নার তালিকাগুলো কী কী।"ঘরকন্নার কাজগুলি প্রধানতঃ এই-পুরুষবাদী পুরুষেরাও মনে হয় না এরকম নির্লজ্জভাবে মেয়েদের ঘরকন্নার তালিকা তৈরি করে হাতে ধরিয়ে দেবে। সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে সুগৃহিনী হওয়ার জন্য মেয়েদের উদ্দেশ্যে সবশেষে তিনি বলেছেনঃ "যদি সুগৃহিণী হওয়া আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে স্ত্রীলোকের জন্য সুশিক্ষার আয়োজন করিবেন"।
(ক) গৃহ এবং গৃহসামগ্রী পরিস্কার ও সুন্দররূপে সাজাইয়া রাখা।
(খ) পরিমিত ব্যয়ে সুচারুরূপে গৃহস্থালী সম্পন্ন করা।
(গ) রন্ধন ও পরিবেশন।
(ঘ) সূচিকর্ম্ম।
(ঙ) পরিজনদিগকে যত্ন করা।
(চ) সন্তানপালন করা"।
ফরিদ আহমেদ রচিত "রোকেয়াঃ অন্য আলোয় দেখা" ব্লগ পোস্টে (প্রবন্ধে) মুগ্ধ অভিজিৎ রায় কমেন্টের শুরুতেই জানান, "না পারি গিলতে না পারি উগরাইতে"। কেননা, বেগম রোকেয়া বেশ কিছু লেখা, বক্তব্য বা বানীতে অভিজৎ রায় লিখেছেন,
"রোকেয়ার এই স্ববিরোধিতাটা আমাকেও ভাবায়। ... নারীবাদের ইতিহাসে রোকেয়া একটি অনন্য নাম হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু বলতে হয়, রোকেয়ার মধ্যে স্ব-বিরোধ ছিলো বিস্তর, চোখে পড়ার মতই। ... আসলে এ ধরনের ‘পর্দানসীন ভদ্রবেশী নারী’ যিনি কিনা মাঝে মাঝে উচ্চকিত হবেন নারীমুক্তির বন্দনায়, কিন্তু নিশি-দিন যাপন করে যাবেন এক প্রথাগ্রস্ত, বিনীত, মান্য করে ধন্য হয়ে যাওয়া ছকে বাঁধা জীবন – এমন ‘অধুনিকা’ নারীরূপ কিন্তু পুরুষতন্ত্রের খুব পছন্দের। রোকেয়া তসলিমা বা মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের মত উগ্র, ঝাঁঝালো, আমূল নারীবাদী নন; তিনি বাঙালী মুসলমান নারী জাগরণের জন্য লিখে গেছেন কিছু অমূল্য রচনা, কিন্তু নিজের জীবনে অনড় করে রেখেছিলেন অন্ধকার, বোরখা ও প্রথার মহিমা। যেহেতু তিনি তুষ্ট করেন পুরুষতন্ত্রের ‘উদারনৈতিক’ সকল চাহিদা, তাই বিনিময়ে পুরুষতন্ত্র আজ তাকে দিয়েছে ‘মহীয়সী’ অভিধা, এখন নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে ‘নারী জাগরনের অগ্রদূত’ হিসেবে। আজ তাই দেখা যায় এমনকি চরম রক্ষণশীল, প্রথাগ্রস্ত পুরুষটিকেও রোকেয়া বন্দনায় মুখর হতে"।
"রোকেয়ার জন্যে এবং বালিকা বিদ্যালয়ের জন্যে সমান অংকের অর্থ বরাদ্দ হবার কারণ অতি স্পষ্ট। রোকেয়াকে বৈধব্যের কাল কৃচ্ছতায় কাটাবার এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটাবার ব্যবস্থা সম্পন্ন করার জন্যেই প্রভু এমন ব্যবস্থা করে। আর ওই তরুণীকে নিয়ন্ত্রণ করার শৃঙ্খল প্রস্তুতের এককালীন প্রস্তুতির জন্যে এমন অর্থ বরাদ্দ করতে প্রভু মুক্তহস্ত ও দরাজ হওয়াই স্বাভাবিক। রোকেয়ার জীবন হচ্ছে নিরবচ্ছিন্নভাবে মান্য করার ও মান্য করে নিজেকে ধন্য করার বাস্তবরূপ মাত্র। প্রভুর এমন অন্ধত্ব তাঁকে তাই ক্ষুব্ধ করে না। প্রভুকন্যার পীড়নে স্বামীর ভিটা থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েও তাই রোকেয়া প্রভুর প্রদর্শিত পথ থেকে একচুল বিচ্যুত হয় না। তাঁর এই মর্ষকামিতা ও স্বেচ্ছাদাসীত্বকে অচিরেই পুরস্কৃত করা হয়। তাঁর স্তব রচনা করে পুরুষতন্ত্র এভাবেঃ তাহার অসামান্য এবং পতিব্রতা পত্নী স্বামীর সেই ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্যে কলিকাতায় বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা করিয়া পবিত্রাত্মা স্বর্গীয় সাখাওয়াতের স্মৃতির পূজা করিতেছেন। রোকেয়ার স্কুল চালনা প্রকৃত অর্থেই স্বর্গীয় প্রভুর স্মৃতির পূজা ছাড়া আর কিছু নয়"। - আকিমুন নাহার
রোকেয়া শেকল মুক্তির লড়াইরত লড়াকু মানুষ নন, যদিও তাঁর রচনাবলী পাঠে জাগে অমনই বিভ্রম। রোকেয়া পাথর চাপা ঘাস বা স্বামীর ছাঁচে বিকশিত এক পরিতৃপ্ত বেগম, এখন নারী মুক্তির অগ্রদূত বলে যে পেয়েছে ভুল প্রসিদ্ধি। - - আকিমুন নাহার"কন্যাকে এরূপ শিক্ষা দেওয়া হয় না, যাহাতে সে স্বামীর ছায়াতুল্য সহচরী হইতে পারে। প্রভুদের বিদ্যার গতির সীমা নাই, স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সচরাচর বোধোদয় পর্যন্ত"। বেগম রোকেয়ার এই উদ্ধৃতি উল্লেখ করে ফরিদ আহমেদ লিখেছেন,
নারী জাগরণের অগ্রদূতের কী চমৎকার কথাবার্তা! স্বামীও নয়, একেবারে প্রভুই বলছেন আর দাসীদের সবক দিয়ে চলেছেন প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে। এর পরেও যদি বাংলাদেশের কোনো নারী রোকেয়ার হয়ে সাফাই গায় তবে তাঁকে পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ বিভ্রান্ত নারী ছাড়া আর কি কিছু বলা যায়? এ কারণেই পুরুষতন্ত্রের অত্যন্ত পছন্দের রমণী এই রোকেয়া। রোকেয়ার মাধ্যমেই নারীকে মানসিকভাবে দাসী বানিয়ে রাখা সম্ভব।
এহেন বেগম রোকেয়া সম্পর্কে আমার মনোভাব কি? আমি কিভাবে দেখি? আমতা আমতা করে যে, বলবো, ঐ সময়ের ও ঐ যুগের তুলনায় বেগম রোকেয়া অনেক এগিয়ে ছিলেন, সেটারও জবাব দেয়া হয়েছে মুক্তমনার ঐ পোস্টে এবং তার কমেন্টে! ইউরোপ – আমেরিকা- রাশিয়ার নারীবাদীরা যে আরো কত আগে কত এগিয়ে ছিল- সেই বিবরণ এসেছে! বেগম রোকেয়ার জন্মের আগে বাংলায় এগিয়ে থাকা নারীদের তালিকাও কমেন্টগুলোতে এসছে! চন্দ্রমুখী বসু, কাদম্বিনী বসু, হেমপ্রভা বসু, বামাসুন্দরী দেবী, সরলা দেবী প্রমুখের নাম এসেছে, ১৯০০ সালের মধ্যেই ২৭ জন নারী বি এ পাশ করেছেন- সেটাও এসেছে।
এরপরেও কি বেগম রোকেয়াকে বর্জন করবো না? তারপরেও পারছি না। বেগম রোকেয়া আমার চোখে বাংলার মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ। পিছিয়ে পড়া মুসলিম নারীদের জাগরণে তার অবদান ভীষণ। সেই অর্থে মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ। মোটেও ইসলামিস্ট ফেমিনিস্ট নন। ঐ সময়ের ইসলামী রক্তচক্ষুকে সহ্য করেই তাকে এগুতে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তিনি আপোস করেছেন বা আপোস করতে বাধ্য হয়েছে- মূল লক্ষকে এগিয়ে নিতে, কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে- সেখানেও তার নিজের অবস্থানকে তুলে ধরতে পিছপা হননি এবং অন্যত্র ঠিক ভিন্ন রকম বা র্যাডিকাল বক্তব্যও দিয়েছেন।
ইতঃপূর্ব্বে আমি “স্ত্রীজাতির অবনতি” প্রবন্ধে আমাদের প্রকৃত অবস্থার চিত্র দেখাইতে প্রয়াস পাইয়াছি কিন্তু সত্য কথা সর্ব্বদাই কিঞ্চিৎ শ্রুতিকটু বলিয়া অনেকে উহা পছন্দ করেন নাই।
যাহা হউক আধ্যাত্মিক সমকতার ভাষা যদি স্ত্রীলোকেরা না বুঝেন, তবে উচ্চ আকাঙ্খা বা উচ্চভাবের কথায় কাজ নাই। আজি আমি জিজ্ঞাসা করি, আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি? বোধ হয় আপনারা সমস্বরে বলিবেনঃ
“সুগৃহিণী হওয়া”
বেশ কথা। আশা করি আপনারা সকলেই সুগৃহিণী হইতে ইচ্ছা করেন, এবং সুগৃহিণী হইতে হইলে যে যে গুণের আবশ্যক, তাহা শিক্ষা করিতে যথাসাধ্য চেষ্টাও করিয়া থাকেন। কিন্তু আজ পর্য্যন্ত আপনাদের অনেকেই প্রকৃত সুগৃহিণী হইতে পারেন নাই। কারণ আমাদের বিশেষ জ্ঞানের আবশ্যক, তাহা আমরা লাভ করিতে পারি না। সমাজ আমাদের উচ্চশিক্ষা লাভ করা অনাবশ্যক মনে করেন। পুরুষ বিদ্যালাভ করেন অন্ন উপার্জ্জনের আশায়, আমরা বিদ্যালাভ করিব কিসের আশায়? অনেকের মত আমাদের বুদ্ধি বিবেচনার প্রয়োজন নাই। যেহেতু আমাদিগকে অন্নচিন্তা করিতে হয় না, সম্পত্তি রক্ষার্থে মোকদ্দমা করিতে হয় না, চাকরীলাভের জন্য সার্টিফিকেট ভিক্ষা করিতে হয় না, “নবাব” “রাজা” উপাধিলাভের জন্য স্বেতাঙ্গ প্রভুদের খোসামোদ করিতে হয় না, কিংবা কোন সময়ে দেশরক্ষার্থে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে হইবে না। তবে আমরা উচ্চশিক্ষা লাভ (অথবা Mental culture) করিব কিসের জন্য? আমি বলি, সুগৃহিণী হওয়ার নিমিত্তই সুশিক্ষা (Mental culture) আবশ্যক।
যদি সুগৃহিণী হওয়া আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে স্ত্রীলোকের জন্য সুশিক্ষার আয়োজন করিবেন।
যাহোক, প্রথম যে- কোটেশন, অবরোধ প্রথার পক্ষে রোকেয়ার একটি প্রবন্ধকে সামনে এনে সকলে যেভাবে রোকেয়াকে একদম শিবির, তালেবান বানানোর কাজ হলো- তাতে মনটি বেশ খারাপ হলো! বেগম রোকেয়াকে কি আমরা হৃদয় দিয়ে পাঠ করেছি? অনুভবে নেয়ার চেস্টা করেছি? অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে তার যে কি ভয়ানক সংগ্রাম ছিল, অবরোধবাসিনীদের প্রতি কি রকম মমত্ব, করুণা, এই প্রথার বিরুদ্ধে কি রকম যে শ্লেষ তিনি ফিল করতেন- সেটা আমার মুক্তমনা বন্ধুরা কেউ বুঝতে পারলো না! অবাকই লাগে! একটি আস্ত বই লিখেছিলেন- বেগম রোকেয়া। নাম অবরোধবাসিনী। সেখানে ৪৭ টি ঘটনায় বিবৃত করেছেন- তার আশেপাশের অবরোধবাসিনীর অবস্থা! তারা তার ঐ সময়ের মুসলিম নারী, তার পরিচিত, আত্মীয়, ছাত্রী, শিক্ষিকা ...। বইটা ওনারা পড়েছেন কি না জানি না, কেননা মনে হয়েছ, এই বইটা অন্তত পড়লে- গড়েবড়ে সবাই ইউরোপ আমেরিকা রাশিয়ার নারীদের, বাংলার হিন্দুসমাজের নারীদের নাম ওভাবে কেউ দিতে যেত না ...। যে হিন্দু নারীদের কথা বলা হলো- সেটার জমিন তৈরি করেছিল- কথিত বাংলার রেনেসাঁস, বিদ্যাসাগর- রামমোহন প্রমুখ পুরুষ অগ্রদূতদের হাত ধরে, ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠিত নারী স্কুলগুলোর হাত ধরে, বিদ্যানুরাগী জমিদারদের হাত ধরে- বেগম রোকেয়ার জন্মের আগেই যেসমস্ত নারী বিএ এমএ পাশ করলো, ডাক্তার হলো, স্কুল প্রতিষ্ঠা করলো- তাদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই; কিন্তু কোন নারী এককভাবে একক চেস্টায় একটা সমাজে প্রথম এই বাতি জ্বালালেন? মুসলিম সমাজে মাথার উপরে রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মত কে ছিল? কোন জমিদার ছিল? মুসলিম সমাজে যত আশরাফ- তত বেশি নারীর কথিত কৌলিন্য ও সম্মান রক্ষার নামে তাদের অন্দর মহলে ঢুকিয়ে রাখার আয়োজন কি ছিল না?
যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমতঃ যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগন …… ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।
অবরোধবাসিনীর ভূমিকা থেকেই কোট করছিঃ
"আমরা বহু কাল হইতে অবরোধ থাকিয়া থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের-বিশেষতঃ আমার কিছুই নাই। মেছোণীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, “পচা মাছের দুর্গন্ধ ভাল না মন্দ?”-সে কি উত্তর দিবে? এস্থলে আমাদের ব্যক্তিগত কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা পাঠিকা ভগিনীদেরকে উপহার দিব-আশা করি, তাঁহাদের ভাল লাগিবে। এস্থলে বলিয়া রাখা আবশ্যক যে গোটা ভারতবর্ষে কুলবালাদের অবরোধ কেবল পুরুষের বিরুদ্ধে নহে, মেয়েমানুষদের বিরুদ্ধেও। অবিবাহিতা বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ীর চাকরাণী ব্যতীত অপর কোন স্ত্রীলোকে দেখিতে পায় না। বিবাহিতা নারীগণও বাজীকর-ভানুমতী ইত্যাদি তামাসাওয়ালী স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে পর্দ্দা করিয়া থাকেন। যিনি যত বেশী পর্দ্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশী পেঁচকের মত লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশী শরীফ। শহরবাসিনী বিবিরাও মিশনারী মেমদের দেখিলে ছুটাছুটি করিয়া পলায়ন করেন। মেম ত মেম-সাড়ী পরিহিতা খ্রীষ্টান বা বাঙ্গালী স্ত্রীলোক দেখিলেও তাঁহারা কামরায় গিয়া অর্গল বন্ধ করেন"।
ফলে, অবরোধ প্রথাকে উন্নতির অন্তরায় না বলা বেগম রোকেয়াই আস্ত একটি বই লিখেছেন- ভগিনীদিগকে এটা দেখাতে যে- এই অবরোধ প্রথায় অভ্যস্ততা পচা মাছের ভীড়ে থাকা মেছোনির মতই! ৪৭ টির মধ্যে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যাকঃ
** আজিকার (২৮ শে জুন ১৯২৯) ঘটনা শুনুন। স্কুলের একটী মেয়ের বাপ লম্বা চওড়া চিঠি লিখিয়াছেন যে, মোটর বাস তাঁহার গলির ভিতর যায় না বলিয়া তাঁহার মেয়েকে “বোরকা” পড়িয়া মামার (চাকরাণীর) সহিত হাঁটিয়া বাড়ী আসিতে হয়। গতকলা গলিতে এক ব্যক্তি চায়ের পাত্র হাতে লইয়া যাইতেছিল, তাহার ধাক্কা লাগিয়া হীরার (তাঁহার মেয়ের) কাপড়ে চা পড়িয়া গিয়া কাপড় নষ্ট হইয়াছে। আমি চিঠিখানা আমাদে জনৈকা শিক্ষয়িত্রীর হাতে দিয়া ইহার তদন্ত করিতে বলিলাম। তিনি ফিরিয়া আসিয়া উর্দ্দু ভাষায় যাহা বলিলেন, তাহার অনুবাদ এইঃ “অনুসন্ধানে জানিলাম হীরার বোরকায় চক্ষু নাই। (হীরাকে বোরকা মে আঁখ নেহী হায়)! অন্য মেয়েরা বলিল, তাহারা গাড়ী হইতে দেখে, মামা প্রায় হীরাকে কোলের নিকট লইয়া হাঁটাইয়া লইয়া যায়। বোরকায় চক্ষু না থাকায় হীরা ঠিকমত হাঁটিতে পারে না-সেদিন একটা বিড়ালের গায়ে পড়িয়া গিয়াছিল,-কখনও হোঁচট খায়। গতকল্য হীরাই সে চায়ের পাত্রবাহী লোকের গায়ে ধাক্কা দিয়া তাহার চা ফেলিয়া দিয়াছে।”* দেখুন দেখি, হীরার বয়স মাত্র ৯ বৎসর-এতটুকু বালিকাকে “অন্ধ বোরকা” পরিয়া পথ চলিতে হইবে! ইহা না করিলে অবরোধের সন্মান রক্ষা হয় না!
** প্রায় ২১/২২ বৎসর পূর্ব্বেকাল ঘটনা। আমার দূর-সম্পর্কীয়া এক মামীশাশুড়ী ভাগলপুল হইতে পাটনা যাইতেছিলেন; সঙ্গে মাত্র একজন পরিচারিকা ছিল। কিউল ষ্টেশনে ট্রেণ বদল করিতে হয়। মামানী সাহেবা অপর ট্রেণে উঠিবার সময় তাঁহার প্রকাণ্ড বোরকায় জড়াইয়া ট্রেণ ও প্লাটফরমের মাঝখানে পড়িয়া গেলেন। ষ্টেশনে সে সময় মামানীর চাকরাণী ছাড়া অপর কোন স্ত্রীলোক ছিল না। কুলিরা তাড়াতাড়ি তাঁহাকে ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হওয়ায় চাকরাণী দোহাই দিয়া নিষেধ করিল-“খবরদার! কেহ বিবি সাহেবার গায়ে হাত দিও না।” সে একা অনেক টানাটানি করিয়া কিছুতেই তাঁহাকে তুলিতে পারিল না। প্রায় আধ ঘন্টা পর্য্যন্ত অপেক্ষা করার পর ট্রেণ ছাড়িয়া দিল! ট্রেণের সংঘর্ষে মামানী সাহেবা পিষিয়া ভিন্নভিন্ন হইয়া গেলেন,-কোথায় তাঁহার “বোরকা”-আর কোথায় তিনি! ষ্টেশন ভরা লোক সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়া এই লোমহর্ষক ব্যাপার দেখিল,-কেহ তাঁহার সাহায্য করিতে অনুমতি পাইল না। পরে তাঁহার চুর্ণপ্রায় দেহ একটা গুদামে রাখা হইল; তাঁহার চাকরাণী প্রাণপণে বিনাইয়া কাঁদিল, আর তাঁহাকে বাতাস করিতে থাকিল। এই অবস্থায় ১১ (এগার) ঘণ্টা অতিবাহিত হইবার পর তিনি দেহত্যাগ করিলেন! কি ভীষণ মৃত্যু!
** “এগারো বৎসর বয়সে তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল। শ্বশুরবাড়ী গিয়া তাঁহাকে এক নির্জ্জন কক্ষে থাকিতে হইত। তাঁহার এক ছোট ননদ দিনে তিন চার বার আসিয়া তাঁহাকে প্রয়োজন মত বাথ-রুমে পৌঁছাইয়া দিত। একদিন কি কারণে সে অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত তাঁহার সংবাদ লয় নাই। এদিকে বেচারী প্রকৃতির তাড়নায় অধীরা হইয়া পড়িলেন। লক্ষ্ণৌ-এ মেয়েকে বড় বড় তামার পানদান যৌতুক দেওয়া হয়। তাঁহার মস্ত পানদানটা সেই কক্ষেই ছিল। তিনি পানদান খুলিয়া সুপারীর ডিবেটা বাহির করিয়া সুপারীগুলি একটা রুমালে ঢালিয়া ফেলিলেন। পরে তিনি সেই ডিবেটা যে জিনিষ দ্বারা পূর্ণ করিয়া খাটের নীচে রাখিলেন, তাহা লিখিতব্য নহে! সন্ধ্যার সময় তাঁহার পিত্রালয়ের চাকরাণী বিছানা বাড়িতে আসিলে তিনি তাহার গলা ধরিয়া কাঁদিয়া ডিবের দুর্দ্দশার কথা বলিলেন। সে তাঁহাকে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, “থাক, তুমি কেঁদ না; আমি কালই ডিবেটা কালাই করাইয়া আনিয়া দিব। সুপারী এখন রুমালের বাঁধা থাকুক।”
** এক বাড়ীতে আগুন লাগিয়াছিল। গৃহিণী বুদ্ধি করিয়া তাড়াতাড়ি সমস্ত অলঙ্কার একটা হাত বাক্সে পূরিয়া লইয়া ঘরের বাহির হইলেন। দ্বারে আসিয়া দেখিলেন সমাগত পুরুষেরা আগুন নিবাইতেছে। তিনি তাহাদের সম্মুখে বাহির না হইয়া অলঙ্কারের বাক্সটী হাতে করিয়া ঘরের ভিতর খাটের নীচে গিয়া বসিলেন। তদবস্থায় পুড়িয়া মরিলেন, কিন্তু পুরুষের সম্মুখে বাহির হইলেন না। ধন্য! কুল-কামিনীর অবরোধ!
** গত ১৯২৪ সনে আমি আরায় গিয়াছিলাম। আমার দুই নাতিনীর বিবাহ এক সঙ্গে হইতেছিল, সেই বিবাহের নিমন্ত্রণে গিয়াছিলাম। নাতিনীদের ডাক নাম মজু ও সবু। বেচারীরা তখন “মাইয়াখানায়” ছিল। কলিকাতায় ত বিবাহের মাত্র ৫/৬ দিন পূর্ব্বে “মাইয়াখানা” নামক বন্দীখানায় মেয়েকে রাখে। কিন্তু বেহার অঞ্চলে ৬/৭ মাস পর্য্যন্ত এইরূপ নির্জ্জন কারাবাসে রাখিয়া মেয়েদের আধমরা করে। আমি মজুর জেলখানায় গিয়া অধিকক্ষণ বসিতে পারি না-সে রুদ্ধ গৃহে আমার দম আটকাইয়া আসে। শেষে এক দিন একটা জানালা একটু খুলিয়া দিলাম। দুই মিনিট পরেই এক মাতব্বর বিবি, “দুলহিনকো হাওয়া লাগেগী” বলিয়া জানালা বন্ধ করিয়া দিলেন। আমি আর তিষ্ঠিতে না পারিয়া উঠিয়া আসিলাম। আমি সবুদের জেলখানায় গিয়া মোটেই বসিতে পারিতাম না। কিন্তু সে বেচারীর ছয় মাস হইতে সেই রুদ্ধ কারাগারে ছিল। শেষে সবুর হিষ্টিরিয়া রোগ হইয়া গেল। এইরূপে আমাদের অবরোধে বাস করিতে অভ্যস্ত করা হয়।
** সমাজ আমাদিগকে কেবল অবরোধ-কারাগারে বন্ধ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই। হজরতা আয়শা সিদ্দিকা নাকি ৯ বৎসর বয়সে বয়োপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন; সেই জন্য সম্ভ্রান্ত মুসলমানের ঘরের বালিকার বয়স আট বৎসর পার হইলেই তাহাদের উচ্চহাস্য করা নিষেধ, উচ্চৈস্বরে কথা বলা নিষেধ, দৌড়ান লাফান ইত্যাদি সবই নিষেধ। এক কথায়, তাহার নড়াচড়াও নিষেধ। সে গৃহকোণে মাথা গুঁজিয়া বসিয়া কেবল সূচি-কর্ম্ম করিতে থাকিবে,-নড়িবে না। এমনকি দ্রুতগতি হাঁটিবেও না।
কোন এক সম্ভ্রান্ত ঘরের একটি আট বৎসরের বালিকা একদিন উঠানে আসিয়া দেখিল, রান্নাঘরের চালে ঠেকান ছোট মই আছে। তাহেরা (সেই বালিকা)র মনে কি হইল, সে অন্যমনস্ড়্গভাবে ঐ মইয়ের দুই ধাপ উঠিল। ঠিক সেই সময় তাহার পিতা সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি কন্যাকে মইয়ের উপর দেখিয়া দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া তাহার হাত ধরিয়া এক হেঁচকা টানে নামাইয়া দিলেন। তাহেরা পিতার অতি আদরের একমাত্র কন্যা,-পিতার আদর ব্যতীত অনাদর কখনও লাভ করে নাই; কখনও পিতার অপ্রসন্ন মুখ দেখে নাই। অদ্য পিতার রুদ্রমূর্ত্তি দেখিয়া ও রূঢ় হেঁচকা টানে সে এত অধিক ভয় পাইল যে কাঁপিতে কাঁপিতে বে-সামাল হইয়া কাপড় নষ্ট করিয়া ফেলিল! অ-বেলায় স্নান করাইয়া দেওয়া হইল বলিয়া এবং অত্যধিক ভয়ে বিহবল হইয়াছিল বলিয়া সেই রাত্রে তাহেরার জ্বর হইল।
একে বড় ঘরের মেয়ে, তায় আবার অতি আদরের মেয়ে, সুতরাং চিকিৎসার ক্রটি হয় নাই। সুদূর সদর জেলা হইতে সিভিল সার্জ্জন ডাক্তার আনা হইল। সেকালে (অর্থাৎ ৪০/৫০ বৎসর পূর্ব্বে) ডাক্তার ডাকা সহজ ব্যাপার ছিল না। ডাক্তার সাহেবের চতুর্গুণ দর্শনী, পাল্কী ভাড়া, তদুপরি বত্রিশজন বেহারার সিধা ও পান তামাক যোগান-সে এক বিরাট ব্যাপার। এত যত্ন সত্ত্বেও তৃতীয় দিনেও তাহেরার জ্বর ত্যাগ হইল না। ডাক্তার সাহেব বে-গতিক দেখিয়া বিদায় হইলেন। পিতার রূঢ় ব্যবহারের নিষ্ঠুর প্রত্যুত্তর দিয়া তাহেরা চিরমুক্তি লাভ করিল!
পারলে ৪৭ টি ঘটনাই এখানে কপি করে দিতাম। পড়তে পড়তে অনেক অনেকবার চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়েছে। কোন সমাজে বসে তিনি কি করছেন, কি সংগ্রাম করে গিয়েছেন- এটা যে অনুভব না করবে- তার কাছে আজকের সমাজের সাথে তুলনা আসবে (ফরিদ আহমেদ বলেছেন- আমাদের গীতাদি আর তসলিমা নাসরিনের সামনে বেগম রোকেয়ার ঐ বানী পড়লে যে কি হইতো!), কেউবা ঐ আমলের ইউরোপ- আমেরিকা- রাশিয়ার নারীরা, বিপ্লবীরা কি করছে সেই ফিরিস্তি দিবে, এবং কেউবা এই বাংলার হিন্দু সমাজের এগিয়ে থাকা নারীদের গল্প শুনাবেন! যাহোক, যে নারী স্কুল হয়ে উঠেছিল বেগম রোকেয়া সমস্ত সংগ্রামের স্থল- সেটার অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করেছেন- এই অবরোধবাসিনী। সেটা একটু উল্লেখ করিঃ
প্রায় তিন বৎসরের ঘটনা, আমাদের প্রথম মোটর বাস প্রস্তুত হইল। পূর্ব্বদিন আমাদের স্কুলের জনৈকা শিক্ষয়িত্রী, মেম সাহেবা মিস্ত্রীখানায় গিয়া বাস দেখিয়া আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, মোটর ভয়ানক অন্ধকার···“না বাবা! আমি কখনও মোটরে যা’ব না।” বাস আসিয়া পৌঁছিলে দেখা গেল,-বাসের পশ্চাতের দ্বারের উপর সামান্য একটু জাল আছে এবং সম্মুখ দিকে ও উপরে একটু জাল আছে। এই তিন ইঞ্চি চওড়া ও দেড় ফুট লম্বা জাল দুই টুকরা না থাকিলে বাসখানাকে সম্পূর্ণ “এয়ার টাইট” বলা যাইতে পারিত।
প্রথম দিন ছাত্রীদের নূতন মোটরে বাড়ী পৌঁছান হইল। চাকরাণী ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল-গাড়ী বড্ড গরম হয়,-মেয়েরা বাড়ী যাইবার পথে অস্থির হইয়াছিল। কেহ কেহ বমি করিযাছিল। ছোট মেয়েরা অন্ধকারে ভয় পাইয়া কাঁদিয়াছিল।
দ্বিতীয় দিন ছাত্রী আনাইবার জন্য মোটর পাঠাইবার সময় উপরোক্তা মেম সাহেবা মোটরের দ্বারের খড়খড়িটা নামাইয়া দিয়া একটা রঙীন কাপড়ের পর্দ্দা ঝুলাইয়া দিলেন। তথাপি ছাত্রীগণ স্কুলে আসিলে দেখা গেল,-দুই তিন জন অজ্ঞান হইয়াছে, দুই চারিজনে বমি করিয়াছে, কয়েক জনের মাথা ধরিয়াছে, ইত্যাদি। অপরাহ্নে মেম সাহেবা বাসের দুই পাশের দুইটী কড়খড়ি নামাইয়া দুই খণ্ড কাপড়ের পর্দ্দা দিলেন। এইরূপে তাহাদের বাড়ী পাঠাইয়া দেওয়া গেল।
সেই দিন সন্ধ্যায় আমার এক পুরাতন বন্ধু মিসেস মুখার্জ্জি আমার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। স্কুলের বিবিধ উন্নতির সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করিয়া বলিলেন,-“আপনাদের মোটরবাস ত বেশ সুন্দর হয়েছে। প্রথমে রাস্তায় দেখে আমি মনে করেছি যে আলমারী যাচ্ছে না কি-চারিদিকে একেবারে বন্ধ, তাই বড় আলমারী বলে ভ্রম হয়! আমার ভাইপো এসে বলেল, “ও পিসীমা! দেখ, সে Moving Black Hole (চলন্ত অন্ধকূপ) যাচ্ছে।” তাই ত, ওর ভিতর মেয়েরা বসে কি করে?”
তৃতীয় দিন অপরাহ্নে চারি পাঁচ জন ছাত্রীর মাতা দেখা করিতে আসিয়া বলিলেন, “আপকা মোটর ত খোদা কা পানাহ! আপ লাড়কীয়োঁ কো জীতে জী ক্ববর মে ভয় রহি হয়ঁ।” আমি নিতান্ত অসহায়ভাবে বলিলাম, “কি করি, এরূপ না হইলে ত আপনারাই বলিতেন, “বেপর্দ্দা গাড়ী।” তাঁহারা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, ‘তব কেয়া আপন জান মারকে পর্দ্দা করেঙ্গী? কালসে হামারী লাড়কীয়াঁ স্কুল নেহী আয়েঙ্গী।” সে দিনও দুই তিনটী বালিকা অজ্ঞান হইয়াছিল। প্রত্যেক বাড়ী হইতে চাকরাণীর মারফতে ফরিয়াদ আসিয়াছিল যে, তাহার আর মোটর বাসে আসিবে না।
সন্ধ্যার পর চারিখানা ঠিকানারহিত ডাকের চিঠি পাইলাম। ইংরাজী চিঠির লেখক স্বাক্ষর করিয়াছেন, “Muslim Brotherhood” বাকী তিনখানা উর্দ্দু ছিল-দুইখানা বেনামী আর চতুর্থখানায় পাঁচজনের স্বাক্ষর ছিল। সকল পত্রেরই বিষয় একই-সকলেই দয়া করিয়া আমাদের স্কুলের কল্যাণ কামনায় লিখিয়াছেন যে, মোটরের দুই পার্শ্বে যে পর্দ্দা দেওয়া হইয়াছে, তাহা বাতাসে উড়িয়া গাড়ী বে-পর্দ্দা করে। যদি আগামীকল্য পর্য্যন্ত মোটরে ভাল পর্দ্দার ব্যবস্থা না করা যায়, তবে তাঁহারা তাতোধিক দয়া করিয়া “খবিছ” “পলীদ” প্রভৃতি উর্দ্দু দৈনিক পত্রিকায় স্কুলের কুৎসা রটনা করিবেন এবং দেখিয়া লইবেন, এরূপ বে-পর্দ্দা গাড়ীতে কি করিয়া মেয়েরা আসে। এ তো ভারী বিপদ,-
“না ধরিলে রাজা বধে,-ধরিলে ভুজঙ্গ!”
রাজার আদেশে এমন করিয়া আর কেহ বোধ হয় জীবন্ত সাপ ধরে নাই!অবরোধ-বন্দিনীদের পক্ষে বলিতে ইচ্ছা করিল,-
“কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে,
কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নশীন ঘরে!”
যে অবরোধ প্রথাকে বেগম রোকেয়া উন্নতির জন্যে মোটেও অন্তরায় বলছেন না- সেই অবরোধ প্রথার ঘরে কেন জন্ম হলো- তা নিয়ে খেদ করছেন! অবাক না?
[৫ মে ২০২১ তারিখে লিখিত ফেসবুক নোটের ঈষৎ পরিবর্তিত ও বর্ধিত সংস্করণ।]