এক
আজ বড়দিন। ছোটবেলাতে প্রশ্ন করেছিলাম, এইরকম শীতকালে সকাল সাতটা-আটটার দিকে সূর্য ওঠে আর বিকেলে পাঁচটার আগেই সূর্য ডুবে যায়- এত ছোটদিনকে বড়দিন বলার মানে কি? এমন জবাব পেয়েছিলাম বা ধরে নিয়েছিলাম- এইদিনে যীশুর জন্ম হয়েছিল বা ঈসা নবীর জন্ম হয়েছিল, সেজন্যে একে বড়দিন বলা হয়, এই বড় মানে লম্বায় বা দৈর্ঘ্যে বড় না, এই বড়দিনের মানে হচ্ছে- মহান, বিশাল, গ্রেট - সেই অর্থে বড়দিন।
কিছুকাল পরে যখন ক্লাসে পৃথিবীর বার্ষিক গতির কারণে ঋতু পরিবর্তন সম্পর্কে পড়লাম, তখন এই বড়দিনের আসল মানে বুঝতে পারলাম। উত্তর গোলার্ধে ২১ জুন সবচেয়ে বড় দিন এবং ২২-২৪ ডিসেম্বর সবচেয়ে ছোট দিন হয়। ২২ জুন থেকে দিনের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে, কমতে কমতে ডিসেম্বরের ২২-২৪ তারিখে এসে দিনের দৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম হয় আর ২৫ ডিসেম্বর থেকে দিনের দৈর্ঘ্য আবার বাড়া শুরু করে। সেই অর্থেই ২৫ ডিসেম্বরকে বড়দিন বলা হয়।
দুই
Peter Joseph এর Zeitgeist নামে একটা মুভিতে দারুন কিছু বিষয় দেখেছিলাম। যীশুকে কেন্দ্র করে কয়েকটা মিথের সাথে আরো কিছু প্রাচীণ মিথের সাদৃশ্য এবং সেসবের ব্যাখ্যা। বিষয়টা খুবই চমকপ্রদ।
যীশুর জন্ম মৃত্যু নিয়ে প্রচলিত মিথগুলো হচ্ছেঃ
- যীশুর জন্ম ২৫ ডিসেম্বর
- যীশুর জন্ম কুমারি মাতা থেকে
- তিন ম্যাজাই উপহার নিয়ে আসে
- জন্মের আগে পূর্ব আকাশে তারা দেখা যায়
- যীশুকে ক্রুসিফাই করা হয়
- ৩ দিন পরে তার পুনর্জন্ম হয়
- যীশুর ১২ অনুসারী সঙ্গী ছিল
অন্য কিছু মিথের সাথে মিলগুলো দেখি;
মিশরের সূর্যদেবতা হোরাস সম্পর্কিত মিথঃ
- হোরাসের জন্ম ২৫ ডিসেম্বর
- হোরাসের জন্ম কুমারি মাতা থেকে
- জন্মের সময়ে তিন রাজা দ্বারা সমাদৃত
- ১২ অনুসারী ছিল
- ক্রশুবিদ্ধ্ব হয়ে মারা যায়
- তিনদিন পরে পুনর্জন্ম ঘটে
ফ্রিজিয়ান/ গ্রীক (Phrygian/ Greek) দেবতা আটিস (Attis) সম্পর্কিত মিথঃ
- তার জন্ম ২৫ ডিসেম্বর
- কুমারি মাতা থেকে জন্ম
- ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যায়
- ৩ দিন পরে পুনর্জন্ম ঘটে
গ্রীক দেবতা ডাইনোসিস (Dionysus) সম্পর্কিত মিথঃ
- তার জন্ম ২৫ ডিসেম্বর
- কুমারি মাতা থেকে জন্ম
- মৃত্যুর পরে পুনর্জন্ম ঘটে
পার্সিয়ান দেবতা মিথ্র (Mythra) সম্পর্কিত মিথঃ
- তার জন্ম ২৫ ডিসেম্বর
- কুমারি মাতা থেকে জন্ম
- ১২ জন অনুসারী সঙ্গী ছিল
- মৃত্যুর ৩ দিন পরে পুনর্জন্ম ঘটে
এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাচীণ আরো অসংখ্য মিথেই পাওয়া যায়। তার কারণ কি? এর জবাব হচ্ছে- এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলোই এসেছে এস্ট্রোলজিকালি। অর্থাৎ, উত্তর গোলার্ধে সূর্য সবচেয়ে দূরতম স্থানে যায় বা সূর্যের মৃত্যু ঘটে ২২ ডিসেম্বরে, আর সূর্য আবার জাগ্রত হওয়া শুরু করে, তথা দিন বড় হওয়া শুরু হয় বা সূর্যের জন্ম হয় ২৫ ডিসেম্বর বা পুনর্জন্ম ঘটে মৃত্যুর ৩ দিন পরে। প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোই ঘুরেফিরে সূর্যদেবতা, বা দেবরাজ বা মহান ধর্মপুরুষের নামে প্রচলিত প্রাচীণ মিথলজিতে স্থান পেয়েছে।
তিন
পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে ২৫ ডিসেম্বর আসলেই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এখনো পৃথিবীর যাবতীয় শক্তির মূল আধার সূর্য। এ আমাদের আলো- তাপ দিয়ে বাঁচিয়েই কেবল রাখে না- পৃথিবীকে জীবের জন্যে বাসযোগ্যও করে তোলে এই সূর্য। প্রাচীণকালে প্রকৃতির অধিক কাছাকাছি থাকার কারণে মানুষ এটা আরো ভালো করে বুঝতে পারতো। আর সে কারণে- প্রধান দেবতা, দেবতাদের রাজারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছিল সূর্যদেবতা এবং অন্ধকারের দেবতাই বাস্তবে হয়ে ওঠে অমঙ্গল- অকল্যানের দেবতা এবং কালক্রমে শয়তান। দেবতাদের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, ২৫ ডিসেম্বর থেকে উত্তর গোলার্ধে সূর্য পুনরায় হাসতে শুরু করে। ফলে, উত্তর গোলার্ধের লোকজনের জন্যে ২৫ ডিসেম্বর বিশেষ উৎসবের দিন হতেই পারে (দক্ষিণ গোলার্ধের মানুষজনের জন্যে এই উৎসব পালন করার ভালো দিন হচ্ছে ২২-২৩ জুন)!
তাই সকলকে যীশু, আটিস, মিথ্র, ডাইনোসিস প্রভৃতি সূর্যদেবতার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই, অর্থাৎ সূর্যের জন্মদিনের শুভেচ্ছা, অর্থাৎ সূর্যের আবার জেগে ওঠার শুভেচ্ছা! শুভ বড়দিন!