মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০০৮

"আল্লাহ" শব্দটি নিয়ে কিছু কথা

১। আল্লাহ শব্দটি কোরআনেই প্রথম ব্যবহৃত শব্দ নয়!! মুহম্মদ সা এর বাবার (যিনি ওনার জন্মের আগেই মারা যান) নাম ছিল আবদুল্লাহ- যার মানে আল্লাহর দাস। এ ধরণের নাম কোরাইশ পৌত্তলিকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং ইসলাম পূর্বযুগ থেকেই কাবাকে পৌত্তলিকেরা বায়াতুল্লাহ বলে ডাকতো। একইভাবে অন্যান্য দেবদেবীর নামের আগে আবদ (দাস) কিংবা আমাত (দাসী) যুক্ত করে নাম রাখার প্রচলন ছিল। যেমনঃ মুহম্মদ সা এর নানার (মা আমিনার বাবা) নাম ছিল ওয়াহাব ইবনে আবদ-মানাফ (অর্থাৎ আমিনার দাদার নাম ছিল আবদ-মানাফ বা মানাফের দাস)। সুতরাং "আল্লাহ" শব্দটির মালিক শুধু মুসলিমেরা নয়- বরং আরব পোত্তলিকেরাও এই শব্দটি ব্যবহার করতো। পৌত্তলিকেরা আল্লাহ শব্দটি দ্বারা একটি নির্দিষ্ট অর্থই বুঝতো, যা নিশ্চয়ই মুসলমানদের অনুরূপ নয়।

 
২। অনেকে দাবী করেন, আল্লাহ শব্দটি নাকি "আল ইলাহ" থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ইলাহ শব্দটি দিয়ে সাধারণভাবে উপাস্য, বিভিন্ন দেব দেবীকে কমনলি বুঝা যায়। যেমন সে সময়ের দেবতা "উদ" অন্যতম ইলাহ, উজ্জাও আরেক ইলাহ। লাত এক ধরণের ইলাহ। বস্তুত, মুহম্মদ সা এর সময়ে আরব পৌত্তলিকদের সবচেয়ে প্রধান ইলাহসমূহ হলো উদ, ইয়াউক, হুবাল, লাত, উজ্জা, মানা। লাত, উজ্জা আর মানা ছিল দেবী। এই তিন দেবীকে সে সময়ে আল্লাহর তিন কন্যা বলে পৌত্তলিকেরা উপাসনা করতো।
Allat (Alnilam), Mannat (Mintaka) and Aluzza (Alnitak)
 
 
৩। প্রাচীণ আরবে আকাশ ও স্বর্গের দেবতা ও দেবীর উপাসনা করা হতো বলে বিভিন্ন সোর্স থেকে আমরা জানতে পারি। এবং পরবর্তীতে সেই দেবীই রূপান্তরিত হয়েই হয় লাত। চন্দ্র দেবী। আরব পৌত্তলিকদের মধ্যে চন্দ্র দেবী লাত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেবী। চন্দ্রমাস যেমন প্রচলিত ছিল, তেমনি চাঁদ দেখে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার আচরণ পালনের চলও প্রচলিত ছিল। চাঁদের প্রতীকও ছিল ধর্মীয় প্রতীক। (এসবের অনেক কিছুই ইসলামে যুক্ত হয়ে যায় পরবর্তীতে)।
 
৪। আরবীতে আল লাত শব্দটির পুরুষবাচক শব্দটি হলো আল-লাহ বা আল-লাহু। অনেক গবেষকের মতে, প্রাচীণ আরবে আল্লাহ ছিল চন্দ্র দেবতা।
 
৫। "আল্লাহ" শব্দটি একটি প্রোপার নাউন হিসাবেই আরববাসীদের ভাষায় ব্যবহৃত হতো। এবং সেটিও এক বিশেষ ইলাহকে বুঝাতো। শব্দগতভাবে ইলাহ আর আল-ইলাহের (আল্লাহ) মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে a god এবং the god এর মত। এই বিশেষ ইলাহ- আল্লাহই হচ্ছে আব্দুল্লাহ, বায়াতুল্লাহ এর পৌত্তলিক বিশেষ ইলাহ- আল্লাহ!
 
৬। বদর যুদ্ধে আবু সুফিয়ানের সাথে মুহম্মদ সা এর সাহাবীদের কিছু কথা চালাচালি হয়েছিল। আবু সুফিয়ান বলেছিলঃ "O Hubal, be high!” শুনে নবী তার সাহাবীদের জবাব দিতে বললেন, সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন- কি জবাব দিবেন। তখন নবী এটা বলতে বললেনঃ “Allah is Higher and more Sublime." তখন আবু সুফিয়ান বললোঃ "We have the (idol) Al Uzza, and you have no Uzza." নবী তার সাহাবীদের জবাব দিতে বললেন এবং সাহাবীরা কি বলবেন সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। নবী এটা বলতে বললেনঃ “Allah is our Helper and you have no helper." (Bukhari Volume 4, Book 52, Number 276)। হুবল আর আল্লাহ’র এই তুলনামূলক কথপোকথন থেকে দেখা যাচ্ছে যে, হুবল ও আল্লাহ পৃথক দেবতা ছিল।
 
৭। তবে অনেকের মতে, আল্লাহ আর হুবল একই দেবতা ছিল। হবল ছিল কুরায়শদের উপাসনাকৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। এই হুবলের উপাধি ছিল- আল্লাহ বা প্রধান দেবতা। হুবল তথা আল্লাহর তিন কন্যার কথা কোরআনে থাকলেও অনেকের মতে আল লাত হচ্ছে হুবল বা আল্লাহর স্ত্রী আর আল উজ্জা ও মানাত হচ্ছে তাদের দুই কন্যা।
 
৮। মুহম্মদ সা এসে যে কালিমা তাইয়্যিবা প্রচার করা আরম্ভ করেন, সেখানেও আমরা "আল্লাহ" শব্দটি একটি নামবাচক বিশেষ্য হিসাবে পাই। "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু,...." লা ইলাহা মানে কোন উপাস্য বা ইলাহা নাই, ইল্লাল্লাহু মানে আল্লাহ ছাড়া। তারমানে এখানে "আল্লাহ" নামক বিশেষ এক ইলাহা ব্যতীত সকল ইলাহকে খারিজ করে দেয়া হয়েছে।
 
৯। মুহম্মদ সা আরব পৌত্তলিকদের কাছ থেকে যে আল্লাহকে ধার করেছেন, সেই আল্লাহর একসময় কন্যা ছিল- সন্তানও ছিল; স্ত্রী তো ছিলই। সেকারণে সুরা ইখলাস, সুরা জ্বিন সহ কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের মাধ্যমে বিশেষভাবে জানিয়ে দিতে হয়েছে- এই আল্লাহর কোন বউ- বাচ্চা- বাপ, মা নেই। আল্লাহ’র কোন লিঙ্গ নেই দাবি করা হলেও কোরআন জুড়ে ভাষাগতভাবে আল্লাহ পুংলিঙ্গ বাচ্য এবং তার কোন বউ নেই দাবি করা হয়েছে (স্বামী নেই দাবি করা হয়নি)।
 
১০। সবশেষে এটুকুই বলা যেতে পারে যে, মুহম্মদ সা তথা কোরআন শিরককে ক্ষমার অযোগ্য ঘোষণা করলেও, তৎকালীন আরব পৌত্তলিকদের কাছ থেকে উপাসানলয় কাবা, হাজরে আসওয়াদ, হজ্জ, কল্পিত শয়তানের উদ্দেশ্যে প্রস্তর নিক্ষেপ প্রভৃতি গ্রহণ করার সাথে সাথে পৌত্তলিক দেবতা "আল্লাহ"কেও নিজের করে নিয়েছে।
(প্রথম প্রকাশঃ সামুব্লগ, ২০০৮)

কোন মন্তব্য নেই: