বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৭

আত্মহত্যা !!!

 এক

আত্মহত্যা করার ইচ্ছে বিভিন্ন সময়ে অনেকেরই হয়। আমার চারপাশের পরিচিত ও কাছের অনেক মানুষের কাছেই শুনেছি- বিভিন্ন সময়ে তাদের আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হয়েছিল। সাহিত্যেও এই প্রবণতা প্রচুর দেখেছি। গোটা দুনিয়া জুড়েই প্রতিবছর প্রচুর মানুষ আত্মহত্যা করে। ভারতের একদম হতদরিদ্র চাষী যেমন আত্মহত্যা করে, তেমনি জাপান সহ উন্নত বিশ্বেরও প্রচুর মানুষ প্রতিবছর আত্মহত্যা করে। অবশ্য আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হলেই যে আত্মহত্যা করে ফেলে মানুষ, তা নয়। আত্মহত্যা করা বাস্তবে খুবই কঠিন এক কাজ। নাহলে, বর্তমানে যত আত্মহত্যা আমরা দেখি- তার বহুগুন বেশি মানুষ আত্মহত্যা করতো। নানাবিধ কারণেই মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রচণ্ড ধার্মিক ব্যক্তি যেমন আত্মহত্যা করে, পাঁড় নাস্তিকও আত্মহত্যা করে। তবে, নাস্তিকের চাইতে একজন ধার্মিকের জন্যে আত্মহত্যা করা কঠিন, কেননা তাকে জান্নাতের লোভ বা দোজখের ভয়কে অতিক্রম করতে হয়, যেরকম কোন কিছু নাস্তিকের হয় না (আজকেও এক আত্মহত্যা করা মেয়ের শেষ মেসেজের একটা লাইন পড়লামঃ “জানি জান্নাত পাবো না”!)। কেউ আত্মহত্যা করলে- সাধারণত তার জন্যে আমার খুব কষ্টবোধ হয় না, বরং মনে হয়- যে জীবন যে বহন করতে পারছিলো না, সেখান থেকে একরকম মুক্তিই সে পেল! হ্যাঁ, কষ্টবোধ যতখানি হয়- সেটা তার কাছের মানুষের জন্যে, যদি কাছের মানুষ থেকে থাকে- এরকম মৃত্যু কাছের মানুষদের পক্ষে মেনে নেয়া আসলেই খুব কঠিন।

https://www.kalerkantho.com/_next/image?url=https%3A%2F%2Fcdn.kalerkantho.com%2Fpublic%2Fnews_images%2F2024%2F01%2F27%2F1706338269-4ab9eeb013d762b85d594a0e858dd0af.jpg&w=1920&q=100
(প্রতীকি ছবিটি কালের কন্ঠ থেকে সংগৃহীত)

 

দুই
আত্মহত্যার ইচ্ছা যেমন বাস্তব, তেমনি তার চাইতেও বাস্তব হচ্ছে বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছা। সে কারণেই হয়তো আত্মহত্যা করাটা এত কঠিন। আত্মহত্যা করার পূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেও মানুষ তাই আত্মহত্যা করতে পারে না। তার সমস্ত শরীর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেস্টা করে। সেকারণে সম্ভবত নিজের হাত দিয়ে নিজের নাক মুখ চেপে শ্বাস বন্ধ করে আত্মহত্যা করা সম্ভব হয় না। যে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে- সেও শেষ মুহুর্তে পানিতে দাপাদাপি করে বেঁচে থাকার চেস্টায়। বিষ খেয়ে (হারপিক বা ঘুমের ওষুধ) আত্মহত্যার চেস্টা করা মানুষকে আমি দেখেছি- মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসার আপ্রাণ ও তীব্র সংগ্রাম করতে। সে কারণে বলা হয়- আত্মহত্যার প্রচেস্টা সফল হয় নিজেকে হত্যার আকস্মিক ও দ্রুত প্রচেস্টায়। নিজেকে মারার অসংখ্য উপাদান ও উপায় আমাদের চারপাশেই আছে, তারপরেও যারা বসে বসে সুন্দরতম উপায়ে আত্মহত্যার উপায় খুঁজে এবং নানাজনকে আত্মহত্যার ভয় দেখায়, বুঝতে হবে- তার পক্ষে আত্মহত্যা করা বেশ কঠিন, কেননা সে মরতে আসলে ভয় পায়।

 

তিন
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? বেশ কঠিন প্রশ্ন। এবং এর জবাব নিশ্চয়ই সকল মানুষের জন্যে একরকম নয়। কেননা- মানুষ খুব বিচিত্র এক প্রাণী। দুনিয়ার ৭০০ কোটি মানুষ আসলে ৭০০ কোটি রকম। তারপরেও আত্মহত্যার প্রবণতার জন্যে মোটাদাগে যে কারণগুলির কথা বলা হয় সেগুলো হচ্ছে- হতাশা, বিষন্নতা, একাকিত্ব, জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা, চরম ব্যর্থতা, নিজের প্রতি চরম আস্থাহীনতা তথা ভয়ানক হীনমন্যতা ইত্যাদি। এগুলো একটার সাথে আরেকটি সম্পর্কিত যেমন হতে পারে, তেমনি নানা কারণেই এগুলো একজন মানুষের মাঝে আসতে পারে।

 

চার
আমাদের এই অঞ্চলে প্রেম, প্রেমে ব্যর্থতা, প্রতারণা, ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে অবহেলা- এইসব কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা একটু আশঙ্কাজনকভাবেই বেশি। কেন জানি- এইসব কারণে আত্মহত্যা যারা করে- তাদের প্রতি আমার করুনাই হয়। যাকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি- সে আমাকে নাও ভালোবাসতে পারে- যত খারাপ লাগুক বা কষ্টই হোক- এটা মেনে নিতে পারাটা খুব জরুরি। কিংবা একদিন যে আমাকে ভালোবেসেছে- তার সেই ভালোবাসা সারাটা জীবন একইরকম নাই থাকতে পারে- বুঝতে হবে প্রেম ভালোবাসা দ্বিপাক্ষিক একটা ব্যাপার। যৌনতাও তাই। এবং পারস্পরিক প্রেম ভালোবাসা কিংবা যৌন আকাঙ্খা আজীবন একইরকম না থাকাটাও একটা বাস্তবতা। কেউ আমাকে আজ তীব্র ভালোবাসে বলে, কাল আমার প্রতি একই রকম ভালোবাসা না থাকলে- আমার দুনিয়া যদি অন্ধকার হয়ে যায়, তাহলে আমার চাইতে বেকুব কেউ আছে বলে মনে হয় না। আমার ভালোবাসার মানুষ যদি আমার সাথে প্রতারণা করে, আমার বিশ্বাস-আস্থা নষ্ট করে- তাহলেও যত কষ্ট হোক- মেনে নিতে হবে এই কারণে যে, এইসবই মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। বরং, এইসব প্রতারণার পরেও সেই ব্যক্তিকে যদি আমি একইরকম ভালোবেসে যাই এবং বসে বসে কষ্ট পাই- তার চাইতে চরম বেকুবি কিছু হতে পারে না। আমাদের সমাজে এইসব ছিলি ব্যাপারে মানুষ অহেতুক কষ্ট পায় এবং আত্মহত্যা প্রবণ হয়- তার কারণ সম্ভবত প্রেম- ভালোবাসা এবং যৌনতা খুব দুষ্প্রাপ্য বস্তু। ছেলেমেয়েদের স্বাভাবিক মেলামেশা, একসাথে মিলেমিশে- খেলেদুলে- ভালোবেসে- প্রেম করে- বেড়ে ওঠার সুযোগ কম। তার উপর আছে- যৌনতা, বিয়ে, পরিবার এইসব নিয়ে নানারকম ট্যাবু। তারও উপর আবার আছে- সামাজিক- পারিবারিক নানা বাঁধা। নারীর উপর তার সাথে যুক্ত হয়েছে- সতীত্ব নামক আরেক ট্যাবু এবং সামাজিক ভয়।

অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি- যে সমাজে ছেলেমেয়েরা পিওবার্টিতে আসার আগেই দুই তিনবার প্রেমে পড়েছে এবং বিচ্ছেদে অভ্যস্থ হয়েছে, পিওবার্টির পরের প্রেম-ভালোবাসার ব্যর্থতা কিংবা সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়া মেনে নিতে তাদের সমস্যা কম হওয়ার কথা- এমনকি শৈশবে ছেলেমেয়েদের একসাথে বেড়ে উঠতে দিলে- খেলার সময়ে যে বন্ধুত্ব হয়- যে ঝগড়া হয়- আড়ি নেয় আবার আড়ি ভাঙে, একজনের সাথে আড়ি নেয়ার পরে আরেকজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়- তাদের মধ্যেও বড়কালের প্রেম-বিচ্ছেদ-বিরহ এইসবে মানসিক বৈকল্য কম আসে। যৌনতাকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রবণতা হিসেবে দেখতে শিখালে- এই কেন্দ্রিক ফ্যান্টাসি অনেক কমে আসবে বৈকি। কারো সাথে একবার যৌনতার সম্পর্ক হয়ে গেলে- দুনিয়ার আর সব পুরুষের কাছে অসতী, আর কেউ বিয়ে করতে আসবে না- এই ধারণা থেকে বের হতে না পারলে- কিভাবে ঐ নারীর পক্ষে তার সাথে যৌন সম্পর্ক করা ব্যক্তির সাথে সাম্ভাব্য সম্পর্কচ্ছেদ মেনে নেয়া সম্ভব হবে?

 

পাঁচ
কিছু আত্মহত্যাকে আমি হত্যা হিসেবে গণ্য করি। সেই মানুষগুলোর জন্যে প্রচণ্ড কষ্ট অনুভব করি এবং যারা এই আত্মহত্যা তথা হত্যার জন্যে দায়ী- সেই হত্যাকারীর প্রতি ক্ষুব্ধ হই। যেমন- স্বামীর সীমাহীন লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অত্যাচার, নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে যে নারী আত্মহত্যা করে কিংবা পাড়ার মাস্তানদের নির্যাতন- নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে যে আত্মহত্যা করা সীমা, ঋতু, মিনুরা আসলে হত্যার শিকার। একইভাবে গ্রামীণ ব্যাংক- ব্রাক সহ নানা প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র ঋণের জালে আটকা পড়ে যে সর্বস্বান্ত চাষী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় কিংবা শেয়ার বাজারে সর্বস্বান্ত হয়ে যে ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়- তাদের হত্যার জন্যে দায়ী যারা তাদের প্রতি এবং এই সমাজের প্রতি বিক্ষুব্ধ হই। ভারতে গত ২০ বছরে যে ৩ লাখ হতদরিদ্র চাষী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে- কিংবা দুনিয়াজুড়ে ক্ষূধা-দারিদ্রের কারণে যেসব বাবা-মা সন্তান সমেত আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় (সন্তানকে বাস্তবে হত্যা করে)- তাদের কথা ভাবলে সুস্থ হয়ে বসে থাকতে পারি না, নিজের মাঝে অপরাধবোধ তৈরি হয় এবং এরকম অসম, অসুন্দর দুনিয়ার প্রতি তথা জীবনের প্রতি একরকম বিতৃষ্ণা তৈরি হয়।

 

ছয়
জীবনের প্রতি বিভিন্ন সময়েই আমার বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে, এখনো হয়। সামাজিক নানা ন্যায়-নীতিবোধ, দায়িত্ব ইত্যাদি যেমন একরকম আমাকে চালনা করে, তেমনি একেক সময়ে এসব খুব ক্লান্ত করে। তখন এসব কোন কিছুর মানে খুঁজে পাই না। দৈনন্দিন রুটিনের প্রতিটা কাজ, বিশেষ বা সাধারণ- সব কিছুকেই অহেতুক, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। বেঁচে থাকাটাও মনে হয় একটা বোঝার মত। অন্যদের এরকম হয় কি না জানি না, আমার হয়। প্রতিটি মানুষই আসলে একা। যেহেতু সে আলাদা। আবার প্রতিটি মানুষই সামাজিক, ফলে অবশ্যই সে কোন না কোন সম্পর্কে যুক্ত। কোন কোন সম্পর্ক এমনই তীব্র- যার জন্যে সে বেঁচে থাকাকে কর্তব্যজ্ঞান করে। তারপরেও সে প্রচণ্ড একা হতে পারে। অন্যের জন্যে বেঁচে থাকার যে কর্তব্যজ্ঞান, সেটাও তাকে মাঝেমধ্যে ক্লান্ত করতে পারে।

আমার অনেকবারই আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হয়েছে। ‘আত্মহত্যা’ বিষয়টি নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেই- ইচ্ছেটা ফিরে আসে। আত্মহত্যাকে তখন খুব সুন্দর ও সাহসী একটা ব্যাপার মনে হয়। সাহসী ব্যাপার মনে হয়, কেননা আমার ধারণা আমি আত্মহত্যা করতে পারি না- কেননা আমার সেই পরিমাণ সাহস নেই। ফলে, যারা আত্মহত্যায় সফল হন- তাদের প্রতি একরকম শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। আমি যেটা পারি না, সেটা তারা পারে; আমার মত তারা ভীতু নয়। কেউ কেউ বলতে পারে, জীবনের প্রতি আমি যতখানি বীতশ্রদ্ধ- তার চাইতেও বাঁচার প্রতি আমার আকুতি বেশি, সে কারণেই আমি আত্মহত্যা করার মত সাহস অর্জন করতে পারিনি। হয়তো বা! হতে পারে। জীবনের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা আছে, নানা সময়ে নানা বিষয়ে হতাশা তৈরি হয়, নিজেকে নিয়েও আমার প্রচণ্ড হতাশা আছে, নিজের সারাজীবনের পাহাড়সম ব্যর্থতা শুধু নয়, সারাজীবনের যাবতীয় ভুল- অপরাধ- অন্যায় আমাকে ভোগায়, একই সাথে সফলতার আকাঙ্ক্ষা আর নীতি-নৈতিকতার বোঝা আমাকে প্রচণ্ড ক্লান্ত করে- সমস্ত বৈপরীত্য আর টানাপোড়েন আমার কাছে মাঝেমধ্যে অসহ্য লাগে। তারপরেও স্বীকার করি, জীবনের প্রতি একেবারেই বীতশ্রদ্ধ বলতে যা বুঝায়, সে অবস্থা আমার না। সারাক্ষণ বিষন্ন হয়ে বসে থাকি না, কিংবা বিষন্নতা এসে আমার অন্যসব আনন্দে ভাগ বসাতে পারে না। একটা ভালো বই, একটা ভালো সিনেমা, একটা বিতর্ক, আলোচনা, প্রিয় মানুষদের সাথে সময় কাটানো, কিংবা একটিভিজম- এসবে তীব্র আনন্দের সাথে মগ্ন হতে পারি। ফলে, বলা যায়- আমার বিষন্নতা সাময়িক এবং নিঃসঙ্গ ও অবসর সময়ের অনুষঙ্গ।

আত্মহত্যায় সফল অনেকের মত জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ না হলেও, বলতে পারি বেঁচে থাকার প্রতি তীব্র আকুতি বা আকর্ষণও আমি বোধ করি না। বেঁচে থাকার কোন অর্থ, মানে, উদ্দেশ্য খুঁজে পাই না। মাঝে মধ্যে বেঁচে থাকাটা প্রচণ্ড ক্লান্তিকর ও অনর্থক পণ্ডশ্রম মনে হয়। সেজায়গা থেকে আত্মহত্যার ইচ্ছেও হয় মাঝে মধ্যে, কিন্তু আত্মহত্যা করতে পারি না- তার প্রধান কারণ মৃত্যুর ভয়। আমার অবর্তমানে প্রিয় মানুষদের সীমাহীন কষ্টের কথা অনুভব করতে পারি, যখন ভাবি আমার প্রিয় মানুষ কেউ যদি একইভাবে আত্মহত্যা করে, তখন আমি কেমন অনুভব করবো! এই চিন্তাও আমাকে আত্মহত্যা করা থেকে বিরত রাখে। তবে, মাঝেমধ্যে মনে হয়- মৃত্যুভয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্যেই হয়তো এমন যুক্তি খুঁজে নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয়- আত্মহত্যা করারও বা মানে কি, অর্থ কি, কি এর প্রয়োজনীয়তা? আত্মহত্যার উদ্যোগও কম ক্লান্তিকর মনে হয় না তখন!

 

সাত
আস্তিকদের সাথে তর্কের সময়ে অনেকেই বলতো ঈশ্বর না থাকলে, পরকাল না থাকলে, আল্লাহ’র ধারণা না থাকলে- বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যই তো নাই হয়ে যায়! আমি কথাটার সাথে একমত; কিন্তু বেঁচে থাকার জন্যে অতিপ্রাকৃত ও মিথ্যা উদ্দেশ্য রাখার কোন প্রয়োজনীয়তাও দেখি না। একইভাবে বিবর্তনের নিয়ম মোতাবেক প্রাকৃতিক সিলেকশন তথা প্রজাতি টিকে রাখার উদ্দেশ্যে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা বা দায় আমি ঠিক অনুভব করি না। দুনিয়ার অসংখ্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, আরো অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে, প্রকৃতি তা আপন নিয়মে নির্বাচন করবে- সেটা নিয়ে আমার কোন হেডেক নেই, কেননা মানুষ নামক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও আসলে কিছু যায় আসে না, কেননা মানুষের উদ্ভব ও মানুষের মানুষ হয়ে ওঠাটাই একটি আকস্মিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা। মানুষের উদ্ভব না ঘটলে, মানব সমাজ না তৈরি হলে, কিংবা আমার জন্ম না হলে- কোন কিছুরই কিছু যায় আসতো না। এই কোন কিছু যায় না আসার পরেও, এই চরমতম উদ্দেশ্যহীনতার পরেও বিবর্তনের নিয়মে মানুষের উদ্ভব হয়েছে, বিবর্তনের পথ ধরেই মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার তীব্র চেস্টা অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য হিসেবে বাসা বেঁধেছে এবং আমার জন্ম হয়েছে, আমার মাঝে হয়তো সেই বৈশিষ্ট যুক্ত হয়েছে। আত্মহত্যার প্রবণতাও বিবর্তনের ফল, কিন্তু মানুষ যে যুগ যুগ বেঁচে আছে- নিজের মত করে উদ্দেশ্যের কথা ভেবে কিংবা কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই, কিংবা বলতে গেলে বেঁচের থাকার উদ্দেশ্যেই বেঁচে থাকছে- সেটাও বিবর্তনের পথ ধরে এবং আমারও মাঝে যে মৃত্যু ভয় সেটাও হয়তো বিবর্তনের ফল।

 

আট
আর সেকারণেই হয়তো- যে আমি আত্মহত্যার সুখ কল্পনায় ভাসি, সেই আমিই আবার ধর্মান্ধদের চাপাতির কোপে বেঘোরে প্রাণ দিতে অস্বীকার করি। পালিয়ে বেড়াই, এবং সময় সুযোগে তীব্র ক্ষোভে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াই। উদ্দেশ্যহীন দুনিয়ায় আবার এই ধর্মান্ধ মানুষগুলোকে যখন নগন্য কীটের মত মনে হয়, সব ক্ষোভ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আর যখন বুঝতে পারি- মানুষ আসলে কীটের চাইতেও নগণ্য, তখন অসহায় লাগে। মানুষ তার হাতে তৈরি সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম, নীতি নৈতিকতা, জ্ঞান, বিজ্ঞানের দাস হয়ে উন্নত হচ্ছে, অবনত হচ্ছে, ভালোবাসছে, ঘৃণা করছে, একে অপরকে বাঁচাচ্ছে, মারছে- এ সমস্তকেই অনর্থক, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। কীটের জীবন, প্রাণীর জীবন, গাছের জীবনকে বড় আকর্ষণীয় মনে হয়, সভ্যতার কোন দায় নেই, নেই কোন বোঝা! সেই আদিম, বন্য, অসভ্য মানুষের জীবনকে আকর্ষণীয় মনে হয়, সভ্য হতে গিয়ে মানুষ কত কি যে হারিয়েছে, মানুষ কি তা জানে?

 

নয়
বেঁচে থাকা যেমন অর্থহীন, মৃত্যুও তাই। অথচ, আমরা কেবল মৃত্যুকে জয় করতে চাই। কেননা আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই। কিন্তু কেবল মৃত্যু ভয়ই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে না, সে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে, উদ্দেশ্য খুঁজে। অলৌকিক, অপ্রাকৃত, মিথ্যা উদ্দেশ্য ও অর্থ যেমন অনেকে খুঁজে, তেমনি অনেকে – এমনকি চরম ধার্মিক ব্যক্তিও- কেবল এইসব অপ্রাকৃত মিথ্যার মাঝে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। তারা প্রাত্যহিক ছোট ছোট নানা কিছুর মাঝে জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়ায়। বেঁচে থাকা অনেকটা সংগ্রামের মত, অনেকের কাছে এই সংগ্রামে প্রতিনিয়ত জয়ী হওয়াটাই জীবনের উদ্দেশ্য, অনেকের কাছে একটা সম্পর্কই হয়তো তার জীবনের উদ্দেশ্য, অনেকের কাছে ছোট ছোট সুখ- আনন্দ- অনুভূতি- হাসি -কান্না, এইসবও জীবনের উদ্দেশ্য।

 

দশ
আমার কাছে এগুলো জীবনের বা বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য বা অর্থ নয়। এরকম ছোটখাট টুকরো টুকরো বিষয়গুলো আমার সামনে চলার অনুপ্রেরণা। আমি হাঁসতে ভালোবাসি, কাঁদতে ভালোবাসি, প্রচণ্ড আনন্দে কাঁদার মাঝে আনন্দ আছে, প্রচণ্ড দুঃখে পাগলের মত হাসার মাঝে একরকম মাদকতা আছে। আমি শান্তির বানীকে ঘৃণা করি, আমি ধ্বংসকে ভালোবাসি। কেননা আমি জানি যাবতীয় যুদ্ধের মূলে আছে শান্তি নামক প্রতারণা, ঠিক শান্তির ধর্মের মতই। তাই আমি ধ্বংস কামনা করি- সমাজ সভ্যতার, ধর্মের, অসাম্যের, ভেদাভেদের। সে কারণে আমি মৃত্যুকেও ভালোবাসি- কেননা মৃত্যুর সাথে সাথে সমাজ- সভ্যতা- ধর্ম- অসাম্য- ভেদাভেদ সবেরই সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু কাঁদার জন্যে, হাঁসার জন্যে, ঘৃণার জন্যে, ভালোবাসার জন্যে, ধ্বংস করার জন্যে, সৃষ্টি করার জন্যে, এমনকি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্যেও অন্তত বেঁচে থাকতে হয় বৈকি। তাই আমি বেঁচে থাকতেও ভালোবাসি। এবং এ কারণেই হয়তো- বেঁচে থাকি …

আত্মহত্যার পরিসংখ্যানঃ
১। http://www.suicide.org/international-suicide-statistics.html

২। "এক বছরে ৫১৩ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, নারীর সংখ্যা বেশি" - দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, https://www.kalerkantho.com/online/national/2024/01/27/1358413


[প্রথম প্রকাশঃ মুক্তমনা ব্লগ, ১৭ মার্চ, ২০১৭]

শুক্রবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৭

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে

[প্রায় ৯ বছর আগে যেভাবে জামাতী ও হিজবুত তাহরীর এর পেইড ব্লগাররা (যেমনঃ ত্রিভুজ, আশরাফ রহমান প্রমুখ) সামহোয়াইনব্লগে "হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের" বিরুদ্ধে নানারকম বিভ্রান্তি, মিথ্যা ইতিহাস, অপপ্রচার চালিয়ে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত পাল্টানোর দাবি তুলতো, এখন এই ফেসবুক ও ওয়াজের যুগে - মাঝেমধ্যেই সেই ত্রিভুজীয় ভাষাতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে নানান হুজুর ওয়াজ গরম করেন, ফেসবুকেও দুদিন পর পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে নানান অপপ্রচার চালিয়ে ঘৃণা উৎপাদন করা হয়। সে কারণেই, ৯ বছর আগে লেখা পোস্টটিকেই নতুন করে কিছুটা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত রূপে ব্লগে নিয়ে আসলাম।]

তাদের মূল বক্তব্য কী?
“আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির যৌক্তিকতা কতখানি? যেখানে, এর রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশ চেতনার বিরোধী ছিলেন, বা বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গের উন্নতির বিরুদ্ধপক্ষ মানুষ ছিলেন। কেননা-
১। তিনি বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে কলকাতায় আয়োজিত সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৩। আমাদের স্বাধীনতা হরণকারী ব্রিটিশদের তাবেদার ছিলেন। কেননা, তিনি জনগণমন ভাগ্যবিধাতা গানটি রচনা করেছিলেন সাদা চামড়ার স্তুতির উদ্দেশ্যে।
 

উপরের তিনটি ঘটনাকে একটু বিশ্লেষণ করা যাক!
 

 ১। বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকাঃ  

বঙ্গভঙ্গের ঘটনার সাথে বাংলাদেশ চেতনার কোন সম্পর্কই নেই, যেমনটি নেই বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনের সাথে বাংলাদেশ চেতনার বিরোধিতার। এটা ঠিক যে, পূর্ববঙ্গের মুসলিম উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণীর তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বুর্জোয়া শ্রেণী বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে ছিল, কেননা- তারা মুসলিমদের আগে থেকেই ইংরেজী শিক্ষার দিকে ঝুকেছিল এবং বণিকী পেশাতেও তারা অগ্রজ ছিল। ফলে, ইংরেজরা যখন ডিভাইড এণ্ড রুল এর নীতিতে বঙ্গভঙ্গ করলো- ঐ হিন্দু বুর্জোয়া অংশ স্বভাবতই তার বিরোধীতা করে। এবং মুসলিম অংশটিকে গোষ্ঠী স্বার্থেই ইংরেজরা পক্ষে পায়। তবে, এই অংশদুটির বাইরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দুই বঙ্গের অনেক উদারমনা ব্যক্তিই এই বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করেছিল এই জায়গা থেকে যে, প্রথমত ইংরেজরা প্রথমবারের মত সাফল্যের সাথে হিন্দু-মুসলিমে বিভেদ টানতে সক্ষম হয়, যা স্পষ্ট হয় পরবর্তি দাঙ্গায়, [যার চুড়ান্ত ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মকেন্দ্রিক পাকিস্তান নামক হাস্যকর রাষ্ট্রটির উদ্ভব]; এবং দ্বিতীয়ত- অবিভক্ত বাংলার স্বপ্নচারী ও অভ্যস্ত মানসিকতায় ইংরেজ কর্তৃক নির্মম আঘাতের কষ্ট।
 

এটা পরিস্কার যে,

– এই বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনাকারী ইংরেজরা,
– মুসলিম লীগের উৎত্তির পেছনেও তাদের ভূমিকা ছিল
– এ উপমহাদেশে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী আরেকটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন ছিল- এবং
– হিন্দু ও মুসলিমকে বিভক্ত করাও প্রয়োজন ছিল; বেশীদিন এখানে তাদের শাসন-নির্যাতনের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার তাগিদেই।

আমার “বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমান” শীর্ষক পোস্টে বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছিলামঃ

মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৭

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমান

 [ত্রিভুজদের মাঝেমধ্যেই বলতে দেখা যায়- রবীন্দ্রনাথ যেহেতু বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করেছিলেন, সেহেতু তিনি পূর্ববঙ্গের তথা বংলাদেশ চেতনারই বিরোধী মানুষ ছিলেন। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী অবস্থান থেকে লেখা আমার সোনার বাংলা গানটিও বাংলাদেশের চেতনার সাথেই বিরোধাত্মক! সব মিলিয়ে অনেককেই বলতে দেখা যায়- বঙ্গভঙ্গ পূর্ববঙ্গের স্বার্থেই ব্রিটিশ-রাজ করেছিল এবং এই বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করা মানেই পূর্ববঙ্গের উন্নতি না চাওয়া।  সামহোয়াইনব্লগে বিবর্তনবাদীর 'বঙ্গভঙ্গ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট' শীর্ষক পোস্টে এ বিষয়ে বেশ কিছু আলোচনা করেছিলাম। মুসলমানরাও যে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন- সে ইতিহাসই এই পোস্টে তুলে ধরার চেস্টা করেছি।]

বঙ্গভঙ্গঃ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলেও এর ইতিহাস আরেকটু আগের। ১৮৭৪ সালে আসামকে বাংলার থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক প্রদেশ গড়ে তোলা হয়। তখনই কাছাড়-গোয়ালপাড়া-শ্রীহট্ট বাংলা ভাষভাষী এই তিন জেলাকেও আসামের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। এর আগে আসাম ‘বঙ্গ’ বা ‘বাঙলা’ প্রেসিডেন্সির অংশ ছিলো। ১৮৭৪ এর পরে ‘বঙ্গ’ প্রেসিডেন্সির অংশ ছিলো বাঙলা, বিহার, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর। আয়তন ১,৯০,০০০ বর্গমাইল ও লোকসংখ্যা ৭ কোটি ৮ লক্ষ ৫০ হাজার। ১৮৯১ সালে কয়েকজন উচ্চপদস্থ আমলা এই প্রস্তাব করলেন যে, লুশাই পাহাড়-অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম বিভাগ আসামের সঙ্গে মিশে যাওয়া উচিত। ১৮৯২ তে এই সংযোগ সরকার বাহাদুর মেনে নিলেন; কিন্তু আমাদের ততকালীন চিফ কমশনার স্যার উইলিয়াম ওয়ার্ড ১৮৯৬ সালে ঢাকা বিভাগকেও আসামের অংশ করতে চাইলেন, চাইলেন ময়মনসিংহকেও। আর্থিক, বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক সুবিধার ধুয়া তুলে এই সংযোগের প্রস্তাব করা হলেও তাঁর দুরভিসন্ধি মানুষ ধরতে পারে এবং প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রবল গণবিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়, ফলে ওয়ার্ড সাহেব পিছু হটতে বাধ্য হন। ১৯০৩ সালে বাংলার ছোটলাট অ্যানড্রু ফ্রেজার বাংলাভাগের নতুন একটা খসড়া প্রস্তাব আনেন। তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রসচিব রিজলি’র মাধ্যমে পেশকৃত প্রস্তাবটিতে (রিজলির পরিকল্পনা বা পত্র নামে খ্যাত) চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সাথে যুক্ত হওয়ার কথাই বলা হয়। এটিও দিনের আলোয় আসার সাথে সাথেই চারদিকে প্রবল আলোড়ন শুরু হয়ে যায় এবং সরকার বাধ্য হয় পিছিয়ে যেতে। এবারে পরিকল্পনাটিকে ঢেলে সাজানো হয়। নতুন পরিকল্পনায় স্থির হয়-ঢাকা বিভাগ, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগ এবং পার্বত্য ত্রিপুরা, মালদহ জেলা ও দার্জিলিং, অর্থাত উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গকে আসামের সাথে যুক্ত করে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে একটি প্রদেশ গড়ে তোলা হবে, এই প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্বয়ং লর্ড কার্জন মাঠে নামেন- ঢাকায় এসে মুসলমানদের বুঝানো আরম্ভ করেন- এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে মুসলমানদের জন্য কত ভালো হবে। অনেক প্রতিবাদের মুখেও অবশেষে ১৯০৫ সালে অক্টোবরে বাঙলা ভাগ কার্যকর করা হয়।
 
বঙ্গভঙ্গের উদ্দেশ্যঃ বাঙলাদেশ, বিহার ও উড়িষ্যার একটি প্রদেশ হিসাবে থাকার প্রশাসনিক দিক থেকে অনেক অসুবিধা ছিলো একথা সত্য। কাজেই সেই বিশাল প্রদেশকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুনভাবে গঠন করা কোনো দোষের ব্যাপার ছিলো না। বৃটিশ ভারতীয় সরকার প্রধানত এই কারণটিকেই বঙ্গভঙ্গের মূল যুক্তি হিসাবে উপস্থিত করেছিলো। কিন্তু প্রদেশ পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও সেটাই যে বঙ্গভঙ্গের মূল কারণ ছিলো না তা বৃটিশ সরকার ও বৃটিশ ভারতীয় সরকারের বিভিন্ন নীতি, সরকারী ভাষ্য এবং দলিলপত্র থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়। বঙ্গ বিভাগের আসল কারণ ছিলো রাজনৈতিক। রিজলির নোটে আমরা দেখি,
“ঐক্যবদ্ধ বাঙলা একটি শক্তি। …. আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হলো তাকে বিভক্ত করা এবং এভাবে আমাদের শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিরুধীদের দুর্বল করে তোলা”।
১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরের সময় লর্ড কার্জন খুব পরিস্কারভাবে বলেন,
“বাঙালীরা যারা নিজেদেরকে একটি জাতি হিসাবে চিন্তা করতে ভালোবাসে এবং যারা এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যেখানে ইংরেজদেরকে বিতাড়িত করে একজন বাঙালী বাবু কলকাতার গভর্মেন্ট হাউজে অধিষ্ঠিত হবে, তারা অবশ্যই সেই ধরণের যেকোন ভাঙ্গনের বিরুদ্ধে তিক্ত মনোভাব পোষণ করে যা তাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাঁধাস্বরূপ। এখন তাদের চিতকারের কাছে নতি স্বীকার করার মত দুর্বল হয়ে পড়লে আমরা আর কখনো বাঙলাকে বিভক্ত অথবা ছোট করতে সক্ষম হবো না এবং তার দ্বারা আপনারা ভারতের পূর্বদিকে এমন একটা শক্তিকে জমাটবদ্ধ ও কঠিন করবেন যে শক্তি ইতোমধ্যেই অপ্রতিরোধ্য হয়েছে এবং যা ভবিষ্যতে ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার নিশ্চিত উৎস হিসেবে বিরাজ করবে”।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানঃ নবাব সলিমুল্লাহকে দিয়ে শুরু করি। কেননা, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তিনি ছিলেন ইংরেজদের পক্ষে। কিন্তু প্রথম দিকে তিনিও বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব মেনে নেননি। ১১ জানুয়ারি ১৯০৪ নবাব সলিমুল্লাহ একটি সভা ডাকেন, এখানে তিনি ও অন্যান্যরা সরকারের তীব্র বিরোধীতা করেন- এমনকি এই প্রস্তাবকে Besatly বলতেও তিনি দ্বিধা করেননি। ‘দ্য মুসলিম ক্রনিকল’ পত্রিকা এক সম্পাদকীয়তে(জানুয়ারি ১৯০৪) স্বীকার করেছে যে, “জনগণ- সম্পর্কিত কোনও বিষয়ে দেশবাসী এতখানি ঐক্যবদ্ধ আগে কখনও হয়নি, যতটা প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হয়েছে” ১৭ জানুয়ারি ১৯০৪ ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত এক বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সভায় উপস্থিত ৮০০০ শ্রোতার ৭৭০০ জনই ছিলো মুসলমান (অবশ্য এ সভায় উপস্থিত হওয়ার পেছনে অভিজাত হিন্দুদের চাপ প্রয়োগের অভিযোগ আছে)। ২৫ জানুয়ারি ১৯০৪ মহমেডান ফ্রেণ্ডস ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের ডাকে ঢাকায় এক জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জমিদার কায়েসউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী। ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় আয়োজিত সেন্ট্রাল মহমেডান অ্যাসোসিয়েশনের সভায় মৌলবি শামসুল হুদা ও মৌলবি সিরাজুল ইসলাম প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধীতা করেন। শামসুল হুদা দাবি করেন,

“মুসলিম সংগঠনগুলির ততখানি জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করা উচিত যতটা হিন্দু সংগঠন গুলি করছে, কারণ এতে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের স্বার্থ জড়িত”।

সেন্ট্রাল মহমেডান অসোসিয়েশনের সম্পাদক আমির হোসেন সংস্থার পক্ষে ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারকে একটি চিঠি লিখে জানান,

“বাঙালি জাতির কোন অংশকে বাঙলা থেকে আলাদা করা উচিত হবে না,…… যদি প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানোই বিভাজনের উদ্দেশ্য হয় তাহলে সমগ্র বাঙলাকে মাদ্রাজ এবং বোম্বাইয়ের মতো নির্বাহী পরিষদ (Executive Council) গঠন করে গভর্ণরের শাসনাধীনে আনা হোক”।

মুনতাসীর মামুন কর্তৃক সংকলিত “উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র” গ্রন্থের অষ্টম খণ্ডে আমরা দেখি- ‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকাটির অবস্থান ছিলো স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে। ১৯০৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ‘বেঙ্গল টাইমস’ (পূর্ববঙ্গ থেকে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজী সাপ্তাহিক ও পরে দৈনিক) -এও অবিশ্রান্তভাবে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যদিও ‘বেঙ্গল টাইমস’ অতীতে সবসময় নবাব পরিবারের পক্ষাবলম্বন করেছে, কিন্তু বঙ্গভঙ্গের বেলায় নবাব সলিমুল্লাহর পথ অনুসরণ করেনি ওই পত্রিকা। ৪ জানুয়ারি ১৯০৪, ঢাকার সদরঘাটের এক সভায় সভাপতিত্ব করেন একজন মুসলমান জমিদার। সভাতে যে আটাশজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন বঙ্গভঙ্গের সরকারি প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অন্যান্য জেলার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য, তার মধ্যে ৭ জন মুসলমান, ৪ জন ইঙ্গ-ভারতীয় এবং বাকিরা ছিলেন হিন্দু। নারায়নগঞ্জের এক জনসভায় বিভিন্ন প্রস্তাবের উত্থাপক ও সমর্থকের মধ্যে বেশ কয়েকজনই ছিলেন মুসলমান। ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ এ লর্ড কার্জন ঢাকা সফরে মুসলমানদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করার চেস্টা করলেও তাঁর ফিরে যাওয়ার ঠিক পরেই, মার্চ মাসে, ঢাকার জগন্নাথ কলেজে হিন্দু-মুসলমানের এক যৌথ সমাবেশ হয় এবং তাতে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এই মর্মে যে, “ভাইসরয়ের মিষ্টি কথাতে জেলার জনগণের মন ভোলেনি” ২৭ অক্টোবর ১৯০৫ ‘ছোলতান’ পত্রিকায় একটি সংবাদে প্রকাশ, “কলকাতার মুসলমানের বেশিরভাগই ছিলেন স্বদেশি আন্দোলনের সমর্থক, শুধু কয়েকজন রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানহীন মুসলমান বাদে, যারা অন্যদের স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিতে বাঁধা দিচ্ছিলেন”স্বদেশি আন্দোলনে মুসলিম অংশগ্রহণের সাক্ষ্য হিসাবে কিছু মুসলমান নেতার নাম বিভিন্ন আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে। এঁদের একজন হলেন খাজা আতিকুল্লাহ- নবাব সলিমুল্লাহর বৈমাত্রেয় ভাই, তিনি ছিলেন বঙ্গভঙ্গের প্রবল বিরোধী। ডিসেম্বর ১৯০৬ কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রস্তাব উত্থাপন করেন খাজা আতিকুল্লাহ। ওই প্রসঙ্গে তিনি বলেন,

“পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা সকলেই বঙ্গভঙ্গের পক্ষে একথা ঠিক নয়। কিছু ধনী মুসলমান নিজেদের স্বার্থে সরকারের এই পদক্ষেপ সমর্থন করছে”।

নিজের পরিবার সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিলো,

“নবাব সলিমুল্লাহর মত গোটা খাজা পরিবারের মত নয়। এই পরিবারের অন্যরা বঙ্গভঙ্গকে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের প্রতি অবিচার বলে মনে করেন এবং চান যে তা রদ হোক”।

প্রসঙ্গত, এই সভায় আতিকুল্লাহ ছাড়াও ঢাকা নবাব বাড়ির আরো কিছু সদস্য উপস্থিত ছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে অন্যান্যরা যাঁরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য-
* সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মহমেডান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খান বাহাদুর মহম্মদ ইউসুফ- ১৯০৬ সালে ফেডারেশন হলের সভায় সভাপতিত্ব করার জন্য ঐ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেয়া হয়,
* বরিশালের জমিদার সৈয়দ মোতাহার হোসেন- বঙ্গভঙ্গ-রদের আন্দোলনের বর্ষপূর্তির সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন,
* ফরিদপুরের উকিল আলীমুজ্জামান চৌধুরী- ১৯০৭ সালে নিজের জেলার এক হাজার মুসলমানের সইসহ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এক স্মারকলিপি পেশ করেছিলেন,
* বর্ধমান জেলার কংগ্রেস নেতা আবুল কাসেম,
* কলকাতার আইনজীবী ও টাঙ্গাইলের জমিদার আবদুল হালিম গজনভি,
* ব্যরিস্টার আবদুল রসুল- হালিম ও রসুল মিলে মুসলিম লীগ বিরোধী ‘বেঙ্গল মহমেডান অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন,
* যশোরের স্বদেশি নেতা দীন মহম্মদ,
* ‘দ্য মুসলমান’ পত্রিকার সম্পাদক মুজিবর রহমান,
* মৌলবি কাজেম আলি মাস্টার,
* মৌলানা মহম্মদ আকরাম খাঁ- আজাদ পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক,
* পাটনার আলি ইমাম ও তার সহোদর হাসান ইমাম,
* ব্যারিস্টার মজহারুল হক- সাদাকত আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা,
* মৌলানা আবুল কালাম আজাদ,
* কলকাতার শিক্ষক দেদার বক্স- স্বদেশি আন্দোলনের বক্তা হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন,
* ঢাকার শিক্ষক হেদায়েত বক্স, স্বদেশি প্রচারক দেদার বক্স ও ‘ছোলতান’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মৌলবি মনিরুজ্জামান ইসলামবাদি- স্বদেশি আন্দোলনে এই তিনজনেরও বক্তা হিসাবে সুনাম ছিলো,
* কবি সৈয়দ আবু মহম্মদ ইসমাইল হোসেন সিরাজী- স্বদেশি করতে গিয়ে নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে লাঞ্ছিত হন,
* অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটির সক্রিয় সদস্য লিয়াকত হোসেন,
* হুগলির আবুল হোসেন এবং ‘হাবলুল মতীন’ পত্রিকার সম্পাদক প্রাক্তন ফারসি শিক্ষক আবদুল গফুর- দুই বাঙলায় এঁরা বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা করেন।…… প্রমুখ।
১৯০৭ সালের গোড়ায় যে স্মারকলিপি পেশ করেন আলিমুজ্জামান চৌধুরী ও তাঁর সহ-স্বাক্ষরকারী খানপাড়ার জমিদার রহমতজান চৌধুরি, তাতে তাঁরা বলেন,

“সরকার যদি চাকরি-বাকরির ব্যাপারে বিশেষ কিছু সুবিধা দিতে চায় মুসলমানদের তাহলে সেটা বাঙলা ভাগ না করেও দেওয়া যেত”।

১৯০৭ সালের এপ্রিল মাসে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এক বিশাল জনসভা হয় দক্ষিণ মালদায়। তাতে শ্রোতাদের অর্ধেকই ছিলেন মুসলমান। মৌলবি মুহম্মদ সালেহ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বিশ্বনাথপুরের মুন্সি মুহম্মদ গুলজার। ১৯০৭ সালের অক্টোবর শেষ সপ্তাহে খুলনা জেলার সেনহাটিতে ঐ রকম একটি সভা হয়েছিলো প্রায় পুরোপুরি মুসলিম উদ্যোগে। শুধু অবস্থাপন্নই নন, অনেক মুসলমান চাষীও এই সভায় যোগ দিয়েছিলেন। এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

উপসংহারঃ তবে এটা ঠিক, এ বঙ্গের অধিকাংশ মুসলমানই পরবর্তিতে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেন। কারণ কি? হিন্দুদের তুলনায় পশ্চাদপদ মুসলমানরা মনে করেছিলো এতে তাদের সমূহ উন্নতি সম্ভব- এবং এ প্রলোভনটিই প্রথম থেকে ব্রিটিশরা মুসলমানদের দিয়ে এসেছে। ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সফরে লর্ড কার্জন বলেন,

“বঙ্গভঙ্গ পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে এমন এক নতুন ঐক্য আনবে যা মুসলমান শাসকদের আমলেও তাঁরা পাননি”।

বাস্তবিকই এসময় ব্রিটিশদের কিছু উদ্যোগ দেখা যায়। বঙ্গভঙ্গের ঠিক পরেই পাট চাষে কৃষকরা লাভবান হন। এবং পরীক্ষামূলকভাবে বর্গা বা আধিয়ারি আইন প্রচলিত হওয়ায় কৃষকরা জমিদারের খাস জমিতে বর্গাচাষি হিসাবে স্বীকৃতি পেতে লাগলেন। শুধু ঢাকা জেলাতেই ৭০ হাজার কৃষক খাসজমির প্রজা হিসাবে নিজেদের নাম তালিকাভুক্ত করতে পেরেছিলেন। (অথচ- এই ইংরেজ সরকারই একদিন চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের মাধ্যমে- কৃষকদের জমি থেকে উতখাত করেছিলো!!), একে বঙ্গভঙ্গের সুফল মনে করে মুসলমান কৃষকরাও বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করতে আরম্ভ করেন। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের নতুন গভর্ণর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার মুসলমানদের উন্নতির জন্য বিশেষ নজর দেন, এতে কিছু পরিবর্তনও খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে- যার মধ্যে মুসলমানদের শিক্ষা অন্যতম। ফুলার বলেছিলেন,

“হিন্দু-মুসলমান তাঁর দুই স্ত্রী এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতিই টান বেশি তাঁর”।

ব্রিটিশ সরকার এপর্বে নানাভাবে মুসলমান তোষণ চালিয়ে যেতে থাকে, নতুন প্রশাসনে মুসলমান ও হিন্দুর অনুপাত ২:১ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। নবাব সলিমুল্লাহর অবদানও কম নয়- বঙ্গভঙ্গের পক্ষে মুসলমানদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে। ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহকে দেনার দায় থেকে বাঁচাতে ১৪ লক্ষ টাকা ঋণ দেয়া হয় সরকারি কোষাগার থেকে। কেননা, বৃটিশ সরকারের একথা অজানা ছিলো না যে, পূর্ববঙ্গের অভিজাত মুসলমান সম্প্রদায় এবং মুসলমান তালুকদার-ধনী কৃষক গোষ্ঠীর ওপরে নবাব সলিমুল্লাহর যথেস্ট প্রভাব আছে। নবাব সলিমুল্লাহর মদতপুষ্ট প্রচারকরা প্রচার করতে থাকে যে, নতুন গঠিত হওয়া প্রদেশটিতে মুসলমান কৃষকদের কোন রাজস্ব দিতে হবে না এবং বৃটিশদের শেষ হয়ে ইসলামের পুনরুত্থান আসন্ন, যে ইসলামি শাসনের কর্ণধার হবেন নবাব সলিমুল্লাহ।

অথচ, অসংখ্য আত্মমর্যাদাশীল মুসলিম নেতাই এভাবে উপঢৌকন নিয়ে বিভক্ত হয়ে উন্নত হতে আপত্তি জানিয়েছিলেন- বলেছিলেন-

“পিছিয়ে পড়া অবহেলিত অংশ হিসাবে আমাদের উন্নতিতে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি অবশ্যই যৌক্তিক ও এটা আমাদের ন্যায্য দাবিও, কিন্তু এহেন ঐতিহাসিক ক্ষণে বঙ্গমাতাকে দ্বিখণ্ডিত করার লক্ষে আমাদেরকে দাবার বড়ে হিসাবে ব্যবহৃত করতে- যতই আমাদের উন্নতি করা হোক না কেন- আমরা কি সেই উন্নতিকে সমর্থন জানাতে পারি? কেননা এতে যে ইতিহাসে আমরা মাতার অঙ্গচ্ছেদকারির তল্পিবাহক হিসাবেই চিহ্নিত হবো!”

প্রশ্নঃ যেসব মুসলমান বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করেছিলেন- তাঁরাও কি বাঙলাদেশ চেতনার বিরোধী?

সূত্রঃ
১। বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি- বদরুদ্দীন উমর,
২। বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন- শতবর্ষ স্মারক সংগ্রহ,
৩। উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ-সাময়িকপত্র (অষ্টম খণ্ড)- মুনতাসীর মামুন সংকলিত,
৪। Swadeshi Movement in Bengal- Sumit Sarkar,
৫। উপনিবেশপূর্ব বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি – গোলাম রব্বানী,
৬। Bengal divided- জয়া চ্যাটার্জি

প্রথম প্রকাশঃ তারিখ: সামহোয়ারইন ব্লগ, ০২ , ২০০৮ 

দ্বিতীয় প্রকাশঃ  মুক্তমনা ব্লগ, জানুয়ারি ১০, ২০১৭

[সামহোয়ারইনব্লগে "ত্রিভুজ"  আইডি সহ বেশ কিছু জামাতী পেইড ব্লগার মাঝে মধ্যেই আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস নিয়ে নানা রকম সাম্প্রদায়িক বক্তব্য প্রদান করতো, যেখানে খুব আলোচিত ও বিতর্কিত ("হট") টপিকগুলো মধ্যে ছিলঃ “হিন্দু রবীন্দ্রনাথ", "হিন্দুয়ানি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি” প্রভৃতি। যেহেতু তাদের এসব আলাপে, তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের পরতে পরতে সাম্প্রদায়িকতার একটা প্রলেপ থাকতো  চটকদারি বিভিন্ন যুক্তি-ব্যাখ্যার মোড়কে, সেহেতু অনেক শিক্ষিত ব্লগারও বিভ্রান্ত হয়ে যেত! ঐ সময়ে ত্রিভুজ গোষ্ঠীর সাথে আমরা অনেকেই অনেক তর্ক-বিতর্ক করেছিলাম। ইদানিং ত্রিভুজ গোষ্ঠীর বক্তব্য ও ভাষা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হুজুরের ওয়াজে স্থান পাওয়ায় এসব বিষয় নিয়ে আবারও আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে বিধায় পুরাতন কয়েকটি লেখাকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।]

শেরে বাংলা এবং সাতচল্লিশের দেশভাগে প্রগতিশীল মুসলিম বাঙালির ভূমিকা

নাস্তিক ব্লগার ও লেখক সুষুপ্ত পাঠক তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে সাতচল্লিশের দেশভাগের পুরো দায় "প্রগতিশীল মুসলমান বাঙালির উপরে দিয়ে বলেছেন,
"মুসলমান পরিচয়ে দেশভাগ করেছিল যে ‘প্রগতিশীল মুসলমান বাঙালীরা’- তারাই সুযোগ পেলে রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণ করতে চেয়েছে সব সময়। ফয়জুল করীম বাংলা সাহিত্যের ধার ধারেন না। মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন- এরকম ইতিহাস জানার সুযোগ তার নেই। এই ইতিহাস যারা সৃষ্টি করেছে তারাই ৪৭ সালে দেশভাগ করেছিল। লাহোর প্রস্তাব অর্থাৎ হিন্দুদের খেদিয়ে শুধু মুসলমানদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবী যারা করেছিল তারা কেউ মোল্লা-মুন্সি ছিল না। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সাহেবকে তো আর মুফতী ফয়জুল করীমের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না- তাই না? এটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না- পূর্ববঙ্গকে খাৎনা যারা করেছিলেন তারা কেউই পীর-মাশায়েক মুফতি-মাওলানা ছিলেন না"!
সুষুপ্ত পাঠকের এই আলোচনার সাথে একমত পোষণ করা কঠিন। দ্বিমতের মূল জায়গাগুলো হচ্ছেঃ
 
প্রথমত, মুসলিম পরিচয়ে দেশভাগ করেছিল প্রগতিশীল মুসলমান বাঙালিরা- এ কথা সঠিক নয়। ৪৭ এর দেশভাগের দায় এদের আছে, কিন্তু সেটি প্রধান নয়। বরং ৪৭ এর দেশভাগে প্রগতিশীল মুসলিম বাঙালির একটি বড় অংশ বিরোধিতা করেন।
দ্বিতীয়ত, লাহোর প্রস্তাবের কোথাও হিন্দুদের খেদিয়ে শুধুমাত্র মুসলমানদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ছিল না। লাহোর প্রস্তাবে ছিল- মুসলমান সংখাগরিষ্ঠ অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠিত হবে- যেগুলো হবে স্বায়ত্বশাসিত ও সার্বভৌম। লাহোর প্রস্তাবে এমনকি "পাকিস্তান" নামও ছিল না। পাকিস্তান থেকে হিন্দু খেদানো বা হিন্দুস্তান (ভারত) থেকে মুসলমান খেদানোর অনুষঙ্গ আরো পরের ঘটনা- ১৯৪৬ এর দাঙ্গার মাধ্যমে এর সূচনা বলা যায়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে একটি একক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা ১৯৪১ সালের লাহোর প্রস্তাবের না- এটি ১৯৪৬ সালে সোহরাওয়ার্দী উত্থাপন করেন।
তৃতীয়ত, লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনকারী হিসেবে কিছুটা দায় অবশ্যই শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের আছে- কিন্তু সম্পূর্ণ দায় এককভাবে তার নয়, বিশেষ করে ১৯৩৭ পরবর্তী সময়ে বাংলার রাজনীতিতে কিভাবে মুসলিম লীগের রাজনীতি জাঁকিয়ে বসলো, কোন পরিস্থিতিতে কৃষক প্রজা পার্টি থেকে নির্বাচিত মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা মুসলিম লীগের কাছে নতজানু হতে বাধ্য হলেন সেইসব ইতিহাস যদি জানা থাকে কিংবা ১৯৪২ সাল থেকেই তীব্রভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করার ইতিহাসটিও যদি জানা থাকে- আশা করি- শেরে বাংলাকে নিয়ে অন্তত এই বিষয়ে এভাবে অশ্রদ্ধাসূচক কথা বলা সম্ভব নয়!
 
প্রথম ও দ্বিতীয় পয়েন্টে আলাপ করা ছোট পরিসরে সম্ভব নয়, সময় সুযোগও কম, তাই তৃতীয় পয়েন্টেই কিছুটা ইতিহাস তুলে ধরছি।
শেরে বাংলার পুরো রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস দারুণ বৈচিত্র্যময়। তিনি একই সাথে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস করেছেন, নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি- কৃষক প্রজা পার্টি নামে পার্টিও তৈরি করেছেন। মুসলিম লীগের বঙ্গীয় সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি, কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বঙ্গীয় আইন পরিষদের সাথে জড়িত ছিলেন (মাঝে দুবছর কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন), ১৯২৪ সালে অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী, কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হন, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলার মূখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। যেহেতু লাহোর প্রস্তাবের ঘটনাটি এই সময়কালের, সেহেতু ১৯৩৭ সালের নির্বাচন থেকেই ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছি।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে শেরে বাংলা অংশ নেন তার কৃষক প্রজা পার্টির পক্ষ থেকে। এই নির্বাচনে শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি বাংলায় ১১৯ আসনের মধ্যে ৪৩ আসন লাভ করেন, মুসলিম লীগ ৩৮ টি। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রয়োজন পড়ে। শেরে বাংলার আগ্রহ ছিল- কংগ্রেসের সাথে এই কোয়ালিশন গড়া। কিন্তু কিংগ্রেস রাজী না হওয়ায় শেরে বাংলা বাধ্য হয় মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গড়তে। জিন্নাহ যেন এর অপেক্ষাতেই ছিলেন। কেননা, পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে দাঁড়িয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেই কৃষক প্রজা পার্টি প্রধান দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।
১৯৩৪ সালে এম.এ জিন্নাহ মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়ার পরে মুসলিম লীগের কর্মসূচিতে শেরে বাংলা সন্তুষ্ট ছিলেন না, জিন্নাহর সঙ্গে তার পার্থক্য তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯৩৬ সালে ফজলুল হক তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া তৈরি করেন এবং তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় তিনি জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি জনগোষ্ঠীর সকল অংশ নিয়ে এক নতুন বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে, যা মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ্য! এবং সলিমুল্লাহর হাতে- এই পূর্ববঙ্গে গড়া মুসলিম লীগ কিন্তু অপেক্ষাকৃত নবীন পার্টির কাছে পরাজিত হয়। খাজা নাজিমুদ্দিনের বিপরীতে আড়াই গুণ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। ফলে, ভোটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এতটুকু আমরা বলতে পারি - ১৯৩৭ সালেও পূর্ববঙ্গের মানুষ সকল জনগোষ্ঠীর বাংলা চেয়েছিল। মাত্র ৩ বছরের মাথায় জিন্নাহর দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে লাহোর প্রস্তাব পূর্ব বঙ্গের মুসলমান জনগণের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় হয় এবং দ্রুতই প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়, কিন্তু এতে শেরে বাংলার অবদান- কেবল ঐ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন পর্যন্তই, কেননা ১৯৪২ থেকেই এর বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে তার কৃষক প্রজা পার্টি মুসলিম লীগের বিপরীতে দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে হারাতে ১৯৪৬ এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ জয়লাভ করে সোহরাওয়ার্দী মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেন।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শেরে বাংলা বাস্তবে তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেন। শুরুতেই কংগ্রেসের পরিবর্তে মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন, তাকে কোনঠাসা করে ফেলে। কৃষক প্রজা পার্টি জোর দিয়েছিল ভূমি সম্বন্ধীয় মৌলিক সংস্কারের, মুসলিম লীগের চাইতে কংগ্রেস ছিল সহায়ক, কেননা মুসলিম লীগ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বিলোপের বিরুদ্ধে; এছাড়া সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মনোভাবের দিক দিয়েও কৃষক প্রজা পার্টি ও কংগ্রেস কাছাকাছি ছিল- এরকম বিবেচনার জায়গা থেকেই শেরে বাংলা কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশন করতে চেয়েছিল, কিন্তু কংগ্রেসের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে সেটি সম্ভব হলো না। এটি হচ্ছে, মুসলিম লীগের উপর সওয়ার হয়ে মুসলিম লীগকে আশ্রয় - প্রশ্রয় দেয়ার প্রথম ধাপ। এর মাঝে এই কোয়ালিশন সরকারের মাঝে নানা কলহ, দ্বন্দ্ব বিবাদ তো আছেই। বিরোদীদল কংগ্রেস তার রাজনৈতিক অপোনেন্ট মুসলিম লীগের বিরোধিতায় শেরে বাংলার সরকারকে সম্পূর্ণভাবেই অসহযোগিতার লাইন নেয়ায়, মুসলিম লীগের উপরে আরো নির্ভরশীল হতে হয়। প্রতিটি সুযোগ জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের বঙ্গীয় নেতারা কাজে লাগায়। এর মধ্যে প্রজা পার্টির মধ্যেও কোন্দল শুরু হয়। সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন খানকে গভর্ণর তার ক্ষমতাবলে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করলে এই কোন্দল চরমে ওঠে। মন্ত্রীসভার মুসলিম সদস্যদের মধ্যেও মুসলিম লীগের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় শেরে বাংলা কোনঠাসা ছিলেন, এর মধ্যে বাজেট অধিবেশনে কৃষক প্রজা পার্টির কয়েকজন সদস্য শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে বিরোধীদল কংগ্রেসের পক্ষে ভোট দিয়ে বসে। তারপরে- ২১ জন সদস্য পদত্যাগই করে বসে। এরপরে আইন প্রণয়নের জন্যে শেরে বাংলার মুসলিম লীগের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা ছাড়া উপায়ই ছিল না। এমনকি- মুসলিম লীগের শর্ত মানতে দলত্যাগীদের ইসলাম বিরোধী বলে আখ্যা দিতেও হয় তাকে।
এমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে শেরে বাংলা আবার মরিয়া চেস্টা করেন- কংগ্রেসকে আবারো প্রস্তাব দেন- কোয়ালিশন গঠনে। কিন্তু কংগ্রেস আবারো ফিরিয়ে দেয়। এদিকে একে একে তার দলের নেতারা, কোয়ালিশনের অন্য সদস্যরাও মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। এক পর্যায়ে এই সরকারে এক মুসলিম লীগ ছাড়া আর কেউ ছিল না, শেরে বাংলার পাশে। ফলে, শেরে বাংলাকে আবারো মুসলিম লীগের মতবাদ গ্রহণ করার ঘোষণা দিতে হয়। কৃষক প্রজা পার্টির নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ছাড়েন না, কিন্তু নেতা ছাড়া যেমন কৃষক প্রজা পার্টির ছন্নছাড়া অবস্থা হয়- তেমনি শেরে বাংলারও জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে।
মনে হতে পারে যে, মরিয়া হয়ে মুসলিম লীগকে আকড়ে ধরার কারণ হয়তো বা যেন তেন প্রকারে ক্ষমতা আকড়ে ধরার জন্যেই! মূখ্যমন্ত্রীত্বের লোভেই! কিন্তু ১৯৩৭ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত শেরে বাংলার সরকারের কিছু কাজের দিকে খেয়াল করা যায়ঃ প্রথম মন্ত্রিসভার আমলে (১৯৩৭-১৯৪১) হক কৃষকদের দুঃখকষ্ট মোচনের জন্য কিছু প্রশংসনীয় কাজ করেছিলেন। তিনি ‘Bengal Agricultural Debtors' Act’ (১৯৩৮) কার্যকর করে উচ্চহারে সুদ নেয় এমন মহাজনদের কবল থেকে দরিদ্র কৃষকদের রক্ষা করেন। তিনি বাংলার সব এলাকায় ঋণ সালিশি বোর্ডও স্থাপন করেছিলেন। ‘Money Lenders' Act’ (১৯৩৮) এবং ১৯৩৮ সালের ‘Bengal Tenancy (Amendment) Act’ কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটিয়েছিল। স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডিকে সভাপতি করে ১৯৩৮ সালের ৫ নভেম্বর বাংলা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ‘ল্যান্ড রেভেনিউ কমিশন’ ১৯৪০ সালের ২১ মার্চ চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। এটি ছিল দেশের ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কিত সবচেয়ে মূল্যবান দলিল। ১৯৩৮ সালের আইন দ্বারা ১৮৮৫ সালের প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন করা হয়েছিল এবং এর দ্বারা খাজনা বৃদ্ধির সকল ধারা দশ বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। এটি রায়তদের উপর প্রথাগতভাবে জমিদারগণ কর্তৃক ধার্যকৃত সব ধরনের আবওয়াব ও সেলামির (কর) বিলোপ সাধন করে। জমিদারকে কোনো হস্তান্তর-ফি না দিয়ে রায়তরা তাদের জমি হস্তান্তর করার অধিকার লাভ করে। এ আইন বকেয়া খাজনার সুদের হার ১২.৫০% থেকে ৬.২৫%-এ হ্রাস করে। নদীর ভাঙ্গনে হারানোর ২০ বছরের মধ্যে চারবছরের খাজনা দিয়ে রায়তরা নদী-সিকস্তি (নদীর ভাঙনের ফলে লুপ্ত জমির পুন জেগে ওঠা) জমির মালিকানার অধিকার লাভ করে। হক তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার সময় জনগণকে প্রতিশ্রুত ডাল-ভাতের কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করতে না পারলেও তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদে কার্যকর রক্ষা বহু আইন কৃষকদের বোঝা কিছুটা লাঘব করতে সাহায্য করেছিল। এগুলো কোনকালেই মুসলিম লীগের এজেন্ডা ছিল না, আগ্রহও ছিল না। মন্ত্রীসভায় সম্পূর্ণ একা হয়ে এসব কাজ করতে শেরে বাংলাকে মূল্য কম দিতে হয়নি।
মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কার্যকর করতে শেরে বাংলাকে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হয়েছিলেন। এ মন্ত্রিসভার সুযোগ নিয়ে মুসলিম লীগ ধর্মীয় উপদলীয়তাকে উদ্দীপিত করে। ১৯৩৯ সাল নাগাদ তারা বাংলার শহর ও গ্রামাঞ্চলের সর্বত্রই তাদের প্রভাব বিস্তার করে। এ সময়ে জিন্নাহর সমর্থকদের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মুসলমান জনসাধারণের রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ব্যক্তিগত জীবনে ফজলুল হক ধর্মীয় উপদলীয়তা থেকে মুক্ত হলেও মন্ত্রিসভার কাজ চালাতে তাঁকে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য জিন্নাহ তাঁকে নির্বাচিত করেন। তীক্ষ্ণধীর অধিকারি জিন্নাহ তার কঠিন চালটি চালেন। পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানের মধ্যে দ্রুত দ্বি-জাতি তত্ত্বকে ছড়িয়ে দিতে বাংলার মূখ্যমন্ত্রীর চাইতে ভালো অপশন আর কেউ ছিল না! ১৯৪১ সালে মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রের অংশ হয়ে যায় এই লাহোর প্রস্তাব। এর পর থেকে এটিই মুসলিম লীগের প্রধান রাজনৈতিক বক্তব্য। খুব দ্রুতই পূর্ববঙ্গের মুসলিম বাঙালির মাঝেও পাকিস্তান আন্দোলন খুব জনপ্রিয় হয়। এই জনপ্রিয় হওয়ার কারণ কেবল সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। বিস্তারিত ব্যাখ্যা অন্যত্র করা যাবেখন।
১৯৪১ সালে জিন্নাহর আপত্তির পরেও শেরে বাংলা ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদান করলে জিন্নাহ তাঁকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করে এবং কোয়ালিশন দল থেকে মুসলিম লীগকে প্রত্যাহার করে। ঠিক এর পরের ইতিহাসটির দিকে তাকালে কেবল আফসোসই বাড়ে। ১৯৪১ সালের ২ ডিসেম্বরে শেরে বাংলা পদত্যাগ করেন। এরপরে দেখা যায়, কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড ব্লক সহ কৃষক প্রজা পার্টির দুই গ্রুপ মিলিতভাবে আবার কোয়ালিশন সরকার গঠন করে! যে কোয়ালিশন গঠনের জন্যে শেরে বাংলা ১৯৩৭ সালেই চেস্টা করেছিলেন, মাঝেও আরেকবার চেস্টা করেছিলেন- সেটি হলো দ্বিতীয় দফায়। ততদিনে বাস্তবে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। মুসলিম লীগ তখন বাংলার মুসলমানদের মধ্যে প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে, শেরে বাংলার জনপ্রিয়তা অনেক হ্রাস পেয়েছে, পাকিস্তান আন্দোলন জনপ্রিয় হওয়া শুরু করেছে। ফলে, মুসলিম লীগ খুব সহজেই এই প্রচারণা দিতে পারলো- দ্বিতীয় কোয়ালিশন সরকার আদতে মুসলিম লীগ বিরোধী সরকার। তারপরেও কিছু কাজ করতে চেয়েছিল এই সরকার। কিন্তু প্রাদেশিক সরকার বাধ সাধে। প্রতি পদে পদে বাঁধার মধ্যে ১৯৪৩ সালে শেরে বাংলা আইনসভায় প্রকাশ্যে এ বিষয়ে বলে আরো বিরাগভাজন হন। ফলশ্রুতিতে গভর্ণরের উদ্যোগে দুবার অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়- সামান্য ব্যবধানে দুবারই প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেলে- গভর্ণর ক্ষমতাবলে সরকারের শাসনভার নিজে হাতে নিয়ে নেয় এবং শেরে বাংলাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন।
মুসলিম লীগের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকেই ১৯৪২ সাল থেকে শেরে বাংলা তীব্রভাবে দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরোধিতায় লিপ্ত হন। ততদিনে বাস্তবে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এই বিরোধিতা কেবল তাকেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন তথা মুসলিম লীগকে আরো জনপ্রিয়ই করে তুলেছে!