নাস্তিক ব্লগার ও লেখক সুষুপ্ত পাঠক তার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে সাতচল্লিশের দেশভাগের পুরো দায় "প্রগতিশীল মুসলমান বাঙালির উপরে দিয়ে বলেছেন,
"মুসলমান পরিচয়ে দেশভাগ করেছিল যে ‘প্রগতিশীল মুসলমান বাঙালীরা’- তারাই সুযোগ পেলে রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণ করতে চেয়েছে সব সময়। ফয়জুল করীম বাংলা সাহিত্যের ধার ধারেন না। মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলেন- এরকম ইতিহাস জানার সুযোগ তার নেই। এই ইতিহাস যারা সৃষ্টি করেছে তারাই ৪৭ সালে দেশভাগ করেছিল। লাহোর প্রস্তাব অর্থাৎ হিন্দুদের খেদিয়ে শুধু মুসলমানদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবী যারা করেছিল তারা কেউ মোল্লা-মুন্সি ছিল না। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সাহেবকে তো আর মুফতী ফয়জুল করীমের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না- তাই না? এটা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না- পূর্ববঙ্গকে খাৎনা যারা করেছিলেন তারা কেউই পীর-মাশায়েক মুফতি-মাওলানা ছিলেন না"!
সুষুপ্ত পাঠকের এই আলোচনার সাথে একমত পোষণ করা কঠিন। দ্বিমতের মূল জায়গাগুলো হচ্ছেঃ
প্রথমত, মুসলিম পরিচয়ে দেশভাগ করেছিল প্রগতিশীল মুসলমান বাঙালিরা- এ কথা সঠিক নয়। ৪৭ এর দেশভাগের দায় এদের আছে, কিন্তু সেটি প্রধান নয়। বরং ৪৭ এর দেশভাগে প্রগতিশীল মুসলিম বাঙালির একটি বড় অংশ বিরোধিতা করেন।
দ্বিতীয়ত, লাহোর প্রস্তাবের কোথাও হিন্দুদের খেদিয়ে শুধুমাত্র মুসলমানদের নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ছিল না। লাহোর প্রস্তাবে ছিল- মুসলমান সংখাগরিষ্ঠ অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠিত হবে- যেগুলো হবে স্বায়ত্বশাসিত ও সার্বভৌম। লাহোর প্রস্তাবে এমনকি "পাকিস্তান" নামও ছিল না। পাকিস্তান থেকে হিন্দু খেদানো বা হিন্দুস্তান (ভারত) থেকে মুসলমান খেদানোর অনুষঙ্গ আরো পরের ঘটনা- ১৯৪৬ এর দাঙ্গার মাধ্যমে এর সূচনা বলা যায়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলকে একটি একক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা ১৯৪১ সালের লাহোর প্রস্তাবের না- এটি ১৯৪৬ সালে সোহরাওয়ার্দী উত্থাপন করেন।
তৃতীয়ত, লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনকারী হিসেবে কিছুটা দায় অবশ্যই শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের আছে- কিন্তু সম্পূর্ণ দায় এককভাবে তার নয়, বিশেষ করে ১৯৩৭ পরবর্তী সময়ে বাংলার রাজনীতিতে কিভাবে মুসলিম লীগের রাজনীতি জাঁকিয়ে বসলো, কোন পরিস্থিতিতে কৃষক প্রজা পার্টি থেকে নির্বাচিত মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা মুসলিম লীগের কাছে নতজানু হতে বাধ্য হলেন সেইসব ইতিহাস যদি জানা থাকে কিংবা ১৯৪২ সাল থেকেই তীব্রভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করার ইতিহাসটিও যদি জানা থাকে- আশা করি- শেরে বাংলাকে নিয়ে অন্তত এই বিষয়ে এভাবে অশ্রদ্ধাসূচক কথা বলা সম্ভব নয়!
প্রথম ও দ্বিতীয় পয়েন্টে আলাপ করা ছোট পরিসরে সম্ভব নয়, সময় সুযোগও কম, তাই তৃতীয় পয়েন্টেই কিছুটা ইতিহাস তুলে ধরছি।
শেরে বাংলার পুরো রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস দারুণ বৈচিত্র্যময়। তিনি একই সাথে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস করেছেন, নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি- কৃষক প্রজা পার্টি নামে পার্টিও তৈরি করেছেন। মুসলিম লীগের বঙ্গীয় সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি, কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বঙ্গীয় আইন পরিষদের সাথে জড়িত ছিলেন (মাঝে দুবছর কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন), ১৯২৪ সালে অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী, কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হন, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলার মূখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। যেহেতু লাহোর প্রস্তাবের ঘটনাটি এই সময়কালের, সেহেতু ১৯৩৭ সালের নির্বাচন থেকেই ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছি।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে শেরে বাংলা অংশ নেন তার কৃষক প্রজা পার্টির পক্ষ থেকে। এই নির্বাচনে শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টি বাংলায় ১১৯ আসনের মধ্যে ৪৩ আসন লাভ করেন, মুসলিম লীগ ৩৮ টি। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কোয়ালিশন সরকার গঠনের প্রয়োজন পড়ে। শেরে বাংলার আগ্রহ ছিল- কংগ্রেসের সাথে এই কোয়ালিশন গড়া। কিন্তু কিংগ্রেস রাজী না হওয়ায় শেরে বাংলা বাধ্য হয় মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গড়তে। জিন্নাহ যেন এর অপেক্ষাতেই ছিলেন। কেননা, পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে দাঁড়িয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেই কৃষক প্রজা পার্টি প্রধান দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল।
১৯৩৪ সালে এম.এ জিন্নাহ মুসলিম লীগের সভাপতি হওয়ার পরে মুসলিম লীগের কর্মসূচিতে শেরে বাংলা সন্তুষ্ট ছিলেন না, জিন্নাহর সঙ্গে তার পার্থক্য তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯৩৬ সালে ফজলুল হক তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া তৈরি করেন এবং তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় তিনি জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি জনগোষ্ঠীর সকল অংশ নিয়ে এক নতুন বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে, যা মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ্য! এবং সলিমুল্লাহর হাতে- এই পূর্ববঙ্গে গড়া মুসলিম লীগ কিন্তু অপেক্ষাকৃত নবীন পার্টির কাছে পরাজিত হয়। খাজা নাজিমুদ্দিনের বিপরীতে আড়াই গুণ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। ফলে, ভোটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এতটুকু আমরা বলতে পারি - ১৯৩৭ সালেও পূর্ববঙ্গের মানুষ সকল জনগোষ্ঠীর বাংলা চেয়েছিল। মাত্র ৩ বছরের মাথায় জিন্নাহর দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে লাহোর প্রস্তাব পূর্ব বঙ্গের মুসলমান জনগণের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় হয় এবং দ্রুতই প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়, কিন্তু এতে শেরে বাংলার অবদান- কেবল ঐ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন পর্যন্তই, কেননা ১৯৪২ থেকেই এর বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে তার কৃষক প্রজা পার্টি মুসলিম লীগের বিপরীতে দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে হারাতে ১৯৪৬ এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ জয়লাভ করে সোহরাওয়ার্দী মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠন করেন।
১৯৩৭ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শেরে বাংলা বাস্তবে তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেন। শুরুতেই কংগ্রেসের পরিবর্তে মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন, তাকে কোনঠাসা করে ফেলে। কৃষক প্রজা পার্টি জোর দিয়েছিল ভূমি সম্বন্ধীয় মৌলিক সংস্কারের, মুসলিম লীগের চাইতে কংগ্রেস ছিল সহায়ক, কেননা মুসলিম লীগ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার বিলোপের বিরুদ্ধে; এছাড়া সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মনোভাবের দিক দিয়েও কৃষক প্রজা পার্টি ও কংগ্রেস কাছাকাছি ছিল- এরকম বিবেচনার জায়গা থেকেই শেরে বাংলা কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশন করতে চেয়েছিল, কিন্তু কংগ্রেসের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে সেটি সম্ভব হলো না। এটি হচ্ছে, মুসলিম লীগের উপর সওয়ার হয়ে মুসলিম লীগকে আশ্রয় - প্রশ্রয় দেয়ার প্রথম ধাপ। এর মাঝে এই কোয়ালিশন সরকারের মাঝে নানা কলহ, দ্বন্দ্ব বিবাদ তো আছেই। বিরোদীদল কংগ্রেস তার রাজনৈতিক অপোনেন্ট মুসলিম লীগের বিরোধিতায় শেরে বাংলার সরকারকে সম্পূর্ণভাবেই অসহযোগিতার লাইন নেয়ায়, মুসলিম লীগের উপরে আরো নির্ভরশীল হতে হয়। প্রতিটি সুযোগ জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের বঙ্গীয় নেতারা কাজে লাগায়। এর মধ্যে প্রজা পার্টির মধ্যেও কোন্দল শুরু হয়। সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন খানকে গভর্ণর তার ক্ষমতাবলে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করলে এই কোন্দল চরমে ওঠে। মন্ত্রীসভার মুসলিম সদস্যদের মধ্যেও মুসলিম লীগের সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় শেরে বাংলা কোনঠাসা ছিলেন, এর মধ্যে বাজেট অধিবেশনে কৃষক প্রজা পার্টির কয়েকজন সদস্য শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে বিরোধীদল কংগ্রেসের পক্ষে ভোট দিয়ে বসে। তারপরে- ২১ জন সদস্য পদত্যাগই করে বসে। এরপরে আইন প্রণয়নের জন্যে শেরে বাংলার মুসলিম লীগের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা ছাড়া উপায়ই ছিল না। এমনকি- মুসলিম লীগের শর্ত মানতে দলত্যাগীদের ইসলাম বিরোধী বলে আখ্যা দিতেও হয় তাকে।
এমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে শেরে বাংলা আবার মরিয়া চেস্টা করেন- কংগ্রেসকে আবারো প্রস্তাব দেন- কোয়ালিশন গঠনে। কিন্তু কংগ্রেস আবারো ফিরিয়ে দেয়। এদিকে একে একে তার দলের নেতারা, কোয়ালিশনের অন্য সদস্যরাও মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে। এক পর্যায়ে এই সরকারে এক মুসলিম লীগ ছাড়া আর কেউ ছিল না, শেরে বাংলার পাশে। ফলে, শেরে বাংলাকে আবারো মুসলিম লীগের মতবাদ গ্রহণ করার ঘোষণা দিতে হয়। কৃষক প্রজা পার্টির নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ছাড়েন না, কিন্তু নেতা ছাড়া যেমন কৃষক প্রজা পার্টির ছন্নছাড়া অবস্থা হয়- তেমনি শেরে বাংলারও জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে।
মনে হতে পারে যে, মরিয়া হয়ে মুসলিম লীগকে আকড়ে ধরার কারণ হয়তো বা যেন তেন প্রকারে ক্ষমতা আকড়ে ধরার জন্যেই! মূখ্যমন্ত্রীত্বের লোভেই! কিন্তু ১৯৩৭ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত শেরে বাংলার সরকারের কিছু কাজের দিকে খেয়াল করা যায়ঃ প্রথম মন্ত্রিসভার আমলে (১৯৩৭-১৯৪১) হক কৃষকদের দুঃখকষ্ট মোচনের জন্য কিছু প্রশংসনীয় কাজ করেছিলেন। তিনি ‘Bengal Agricultural Debtors' Act’ (১৯৩৮) কার্যকর করে উচ্চহারে সুদ নেয় এমন মহাজনদের কবল থেকে দরিদ্র কৃষকদের রক্ষা করেন। তিনি বাংলার সব এলাকায় ঋণ সালিশি বোর্ডও স্থাপন করেছিলেন। ‘Money Lenders' Act’ (১৯৩৮) এবং ১৯৩৮ সালের ‘Bengal Tenancy (Amendment) Act’ কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটিয়েছিল। স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডিকে সভাপতি করে ১৯৩৮ সালের ৫ নভেম্বর বাংলা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ‘ল্যান্ড রেভেনিউ কমিশন’ ১৯৪০ সালের ২১ মার্চ চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। এটি ছিল দেশের ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কিত সবচেয়ে মূল্যবান দলিল। ১৯৩৮ সালের আইন দ্বারা ১৮৮৫ সালের প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন করা হয়েছিল এবং এর দ্বারা খাজনা বৃদ্ধির সকল ধারা দশ বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। এটি রায়তদের উপর প্রথাগতভাবে জমিদারগণ কর্তৃক ধার্যকৃত সব ধরনের আবওয়াব ও সেলামির (কর) বিলোপ সাধন করে। জমিদারকে কোনো হস্তান্তর-ফি না দিয়ে রায়তরা তাদের জমি হস্তান্তর করার অধিকার লাভ করে। এ আইন বকেয়া খাজনার সুদের হার ১২.৫০% থেকে ৬.২৫%-এ হ্রাস করে। নদীর ভাঙ্গনে হারানোর ২০ বছরের মধ্যে চারবছরের খাজনা দিয়ে রায়তরা নদী-সিকস্তি (নদীর ভাঙনের ফলে লুপ্ত জমির পুন জেগে ওঠা) জমির মালিকানার অধিকার লাভ করে। হক তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার সময় জনগণকে প্রতিশ্রুত ডাল-ভাতের কর্মসূচি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করতে না পারলেও তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদে কার্যকর রক্ষা বহু আইন কৃষকদের বোঝা কিছুটা লাঘব করতে সাহায্য করেছিল। এগুলো কোনকালেই মুসলিম লীগের এজেন্ডা ছিল না, আগ্রহও ছিল না। মন্ত্রীসভায় সম্পূর্ণ একা হয়ে এসব কাজ করতে শেরে বাংলাকে মূল্য কম দিতে হয়নি।
মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কার্যকর করতে শেরে বাংলাকে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হয়েছিলেন। এ মন্ত্রিসভার সুযোগ নিয়ে মুসলিম লীগ ধর্মীয় উপদলীয়তাকে উদ্দীপিত করে। ১৯৩৯ সাল নাগাদ তারা বাংলার শহর ও গ্রামাঞ্চলের সর্বত্রই তাদের প্রভাব বিস্তার করে। এ সময়ে জিন্নাহর সমর্থকদের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মুসলমান জনসাধারণের রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ব্যক্তিগত জীবনে ফজলুল হক ধর্মীয় উপদলীয়তা থেকে মুক্ত হলেও মন্ত্রিসভার কাজ চালাতে তাঁকে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়েছিল। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য জিন্নাহ তাঁকে নির্বাচিত করেন। তীক্ষ্ণধীর অধিকারি জিন্নাহ তার কঠিন চালটি চালেন। পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানের মধ্যে দ্রুত দ্বি-জাতি তত্ত্বকে ছড়িয়ে দিতে বাংলার মূখ্যমন্ত্রীর চাইতে ভালো অপশন আর কেউ ছিল না! ১৯৪১ সালে মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রের অংশ হয়ে যায় এই লাহোর প্রস্তাব। এর পর থেকে এটিই মুসলিম লীগের প্রধান রাজনৈতিক বক্তব্য। খুব দ্রুতই পূর্ববঙ্গের মুসলিম বাঙালির মাঝেও পাকিস্তান আন্দোলন খুব জনপ্রিয় হয়। এই জনপ্রিয় হওয়ার কারণ কেবল সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। বিস্তারিত ব্যাখ্যা অন্যত্র করা যাবেখন।
১৯৪১ সালে জিন্নাহর আপত্তির পরেও শেরে বাংলা ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদান করলে জিন্নাহ তাঁকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করে এবং কোয়ালিশন দল থেকে মুসলিম লীগকে প্রত্যাহার করে। ঠিক এর পরের ইতিহাসটির দিকে তাকালে কেবল আফসোসই বাড়ে। ১৯৪১ সালের ২ ডিসেম্বরে শেরে বাংলা পদত্যাগ করেন। এরপরে দেখা যায়, কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড ব্লক সহ কৃষক প্রজা পার্টির দুই গ্রুপ মিলিতভাবে আবার কোয়ালিশন সরকার গঠন করে! যে কোয়ালিশন গঠনের জন্যে শেরে বাংলা ১৯৩৭ সালেই চেস্টা করেছিলেন, মাঝেও আরেকবার চেস্টা করেছিলেন- সেটি হলো দ্বিতীয় দফায়। ততদিনে বাস্তবে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। মুসলিম লীগ তখন বাংলার মুসলমানদের মধ্যে প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে, শেরে বাংলার জনপ্রিয়তা অনেক হ্রাস পেয়েছে, পাকিস্তান আন্দোলন জনপ্রিয় হওয়া শুরু করেছে। ফলে, মুসলিম লীগ খুব সহজেই এই প্রচারণা দিতে পারলো- দ্বিতীয় কোয়ালিশন সরকার আদতে মুসলিম লীগ বিরোধী সরকার। তারপরেও কিছু কাজ করতে চেয়েছিল এই সরকার। কিন্তু প্রাদেশিক সরকার বাধ সাধে। প্রতি পদে পদে বাঁধার মধ্যে ১৯৪৩ সালে শেরে বাংলা আইনসভায় প্রকাশ্যে এ বিষয়ে বলে আরো বিরাগভাজন হন। ফলশ্রুতিতে গভর্ণরের উদ্যোগে দুবার অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়- সামান্য ব্যবধানে দুবারই প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেলে- গভর্ণর ক্ষমতাবলে সরকারের শাসনভার নিজে হাতে নিয়ে নেয় এবং শেরে বাংলাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন।
মুসলিম লীগের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকেই ১৯৪২ সাল থেকে শেরে বাংলা তীব্রভাবে দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরোধিতায় লিপ্ত হন। ততদিনে বাস্তবে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এই বিরোধিতা কেবল তাকেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন তথা মুসলিম লীগকে আরো জনপ্রিয়ই করে তুলেছে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন