শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১

শুভ বড়দিন

এক
আজ বড়দিন। ছোটবেলাতে প্রশ্ন করেছিলাম, এইরকম শীতকালে সকাল সাতটা-আটটার দিকে সূর্য ওঠে আর বিকেলে পাঁচটার আগেই সূর্য ডুবে যায়- এত ছোটদিনকে বড়দিন বলার মানে কি? এমন জবাব পেয়েছিলাম বা ধরে নিয়েছিলাম- এইদিনে যীশুর জন্ম হয়েছিল বা ঈসা নবীর জন্ম হয়েছিল, সেজন্যে একে বড়দিন বলা হয়, এই বড় মানে লম্বায় বা দৈর্ঘ্যে বড় না, এই বড়দিনের মানে হচ্ছে- মহান, বিশাল, গ্রেট - সেই অর্থে বড়দিন।
 
কিছুকাল পরে যখন ক্লাসে পৃথিবীর বার্ষিক গতির কারণে ঋতু পরিবর্তন সম্পর্কে পড়লাম, তখন এই বড়দিনের আসল মানে বুঝতে পারলাম। উত্তর গোলার্ধে ২১ জুন সবচেয়ে বড় দিন এবং ২২-২৪ ডিসেম্বর সবচেয়ে ছোট দিন হয়। ২২ জুন থেকে দিনের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে, কমতে কমতে ডিসেম্বরের ২২-২৪ তারিখে এসে দিনের দৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম হয় আর ২৫ ডিসেম্বর থেকে দিনের দৈর্ঘ্য আবার বাড়া শুরু করে। সেই অর্থেই ২৫ ডিসেম্বরকে বড়দিন বলা হয়।
 
দুই
Peter Joseph এর Zeitgeist নামে একটা মুভিতে দারুন কিছু বিষয় দেখেছিলাম। যীশুকে কেন্দ্র করে কয়েকটা মিথের সাথে আরো কিছু প্রাচীণ মিথের সাদৃশ্য এবং সেসবের ব্যাখ্যা। বিষয়টা খুবই চমকপ্রদ।
 
যীশুর জন্ম মৃত্যু নিয়ে প্রচলিত মিথগুলো হচ্ছেঃ
- যীশুর জন্ম ২৫ ডিসেম্বর
- যীশুর জন্ম কুমারি মাতা থেকে
- তিন ম্যাজাই উপহার নিয়ে আসে
- জন্মের আগে পূর্ব আকাশে তারা দেখা যায়
- যীশুকে ক্রুসিফাই করা হয়
- ৩ দিন পরে তার পুনর্জন্ম হয়
- যীশুর ১২ অনুসারী সঙ্গী ছিল
অন্য কিছু মিথের সাথে মিলগুলো দেখি;
 
মিশরের সূর্যদেবতা হোরাস সম্পর্কিত মিথঃ
- হোরাসের জন্ম ২৫ ডিসেম্বর
- হোরাসের জন্ম কুমারি মাতা থেকে
- জন্মের সময়ে তিন রাজা দ্বারা সমাদৃত
- ১২ অনুসারী ছিল
- ক্রশুবিদ্ধ্ব হয়ে মারা যায়
- তিনদিন পরে পুনর্জন্ম ঘটে
 
ফ্রিজিয়ান/ গ্রীক (Phrygian/ Greek) দেবতা আটিস (Attis) সম্পর্কিত মিথঃ
- তার জন্ম ২৫ ডিসেম্বর
- কুমারি মাতা থেকে জন্ম
- ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যায়
- ৩ দিন পরে পুনর্জন্ম ঘটে
 
গ্রীক দেবতা ডাইনোসিস (Dionysus) সম্পর্কিত মিথঃ
- তার জন্ম ২৫ ডিসেম্বর
- কুমারি মাতা থেকে জন্ম
- মৃত্যুর পরে পুনর্জন্ম ঘটে
 
পার্সিয়ান দেবতা মিথ্র (Mythra) সম্পর্কিত মিথঃ
- তার জন্ম ২৫ ডিসেম্বর
- কুমারি মাতা থেকে জন্ম
- ১২ জন অনুসারী সঙ্গী ছিল
- মৃত্যুর ৩ দিন পরে পুনর্জন্ম ঘটে
 
এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রাচীণ আরো অসংখ্য মিথেই পাওয়া যায়। তার কারণ কি? এর জবাব হচ্ছে- এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলোই এসেছে এস্ট্রোলজিকালি। অর্থাৎ, উত্তর গোলার্ধে সূর্য সবচেয়ে দূরতম স্থানে যায় বা সূর্যের মৃত্যু ঘটে ২২ ডিসেম্বরে, আর সূর্য আবার জাগ্রত হওয়া শুরু করে, তথা দিন বড় হওয়া শুরু হয় বা সূর্যের জন্ম হয় ২৫ ডিসেম্বর বা পুনর্জন্ম ঘটে মৃত্যুর ৩ দিন পরে। প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোই ঘুরেফিরে সূর্যদেবতা, বা দেবরাজ বা মহান ধর্মপুরুষের নামে প্রচলিত প্রাচীণ মিথলজিতে স্থান পেয়েছে।
 
তিন
পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে ২৫ ডিসেম্বর আসলেই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এখনো পৃথিবীর যাবতীয় শক্তির মূল আধার সূর্য। এ আমাদের আলো- তাপ দিয়ে বাঁচিয়েই কেবল রাখে না- পৃথিবীকে জীবের জন্যে বাসযোগ্যও করে তোলে এই সূর্য। প্রাচীণকালে প্রকৃতির অধিক কাছাকাছি থাকার কারণে মানুষ এটা আরো ভালো করে বুঝতে পারতো। আর সে কারণে- প্রধান দেবতা, দেবতাদের রাজারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছিল সূর্যদেবতা এবং অন্ধকারের দেবতাই বাস্তবে হয়ে ওঠে অমঙ্গল- অকল্যানের দেবতা এবং কালক্রমে শয়তান। দেবতাদের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, ২৫ ডিসেম্বর থেকে উত্তর গোলার্ধে সূর্য পুনরায় হাসতে শুরু করে। ফলে, উত্তর গোলার্ধের লোকজনের জন্যে ২৫ ডিসেম্বর বিশেষ উৎসবের দিন হতেই পারে (দক্ষিণ গোলার্ধের মানুষজনের জন্যে এই উৎসব পালন করার ভালো দিন হচ্ছে ২২-২৩ জুন)! 
 
তাই সকলকে যীশু, আটিস, মিথ্র, ডাইনোসিস প্রভৃতি সূর্যদেবতার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই, অর্থাৎ সূর্যের জন্মদিনের শুভেচ্ছা, অর্থাৎ সূর্যের আবার জেগে ওঠার শুভেচ্ছা! শুভ বড়দিন!

রবিবার, ২৫ জুলাই, ২০২১

ইসলামবিদ্বেষী ???

 একঃ "ব্লগের নাস্তিকেরা কি কেবল ইসলাম বিদ্বেষী"?

"ব্লগের নাস্তিকেরা কি কেবল ইসলাম বিদ্বেষী"???

মাঝে মাঝেই এই প্রশ্ন পাওয়া যায়। ঠিক প্রশ্ন নয়, অনেকটা অভিযোগ আকারে এটি বলেন অনেকে, কেউ কেউ তো প্রচণ্ড রাগ-ক্ষোভও ঝেড়ে দেন। যেমন সেদিন আমার এক পোস্টে ব্লগার সাইফুর বললেন, 
"নাস্তিক ভাই অন্য ধর্ম নিয়েও এরকম পোষ্ট দিন দয়া করে"। 
 
একই পোস্টে ব্লগার ‘কে আমি’ বললেন,  
"নাস্তিকের ধর্মকথা আর এই ব্লগের অনান্য নাস্তিকদের একটা বিনম্র প্রশ্ন: আপনাদের সব লেখাগুলোই ইসলাম কেন্দ্রিক: পৃথিবীর অন্য ২টা ধর্ম: খৃষ্টান আর ইহূদিজম আর সবচেয়ে পুরাতন ধর্ম সনাতন (হিন্দু) ধর্মকে কি ধর্ম মনে হয় না? নাস্তিক হলে তো সব ধর্ম নামের ভন্ডামির বিপক্ষেই চিন্তা আর অবস্থান থাকার কথা!! তাহলে কি আপনারা ইসলামকেই একমাত্র ধর্ম মেনে নিচ্ছেন না???" 
 
এমন অভিযোগ অনেক আগে ফারজানা১৬ তার এক পোস্টেও করেছিলেন, 
"নাস্তিক, এবার এই পোস্টের বিষয়ের বাইরে আপনাকে একটা প্রশ্ন আছে। আপনার নিক অনুযায়ী আপনি নাস্তিক, তাই ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করছেন ভাল কথা। হয়ত আপনি জানতে চাচ্ছেন, মানলাম। কিন্তু আপনিতো নাস্তিক হলে সব ধর্ম নিয়ে নাস্তিক হওয়ার কথা। এখন আপনার সব পোস্ট দেখি শুধু ইসলাম, মুসলিম আর কোরআন নিয়ে। এ থেকে দু’টা সন্দেহ দেখা দেয়-

১- আপনার কাছে একমাত্র সত্যিকার ধর্ম ইসলাম। তাই শুধু ইসলাম নিয়েই জানতে চাচ্ছেন।
২- অথবা, আপনি মোটেও নাস্তিক নন। আপনি শুধু ইসলাম-নাস্তিক। অর্থাৎ, আপনি অন্য কোনো ধর্মালম্বী, তাই ইসলামকে ভুল প্রমান করতে চান।  
৩- অথবা, আপনার পোস্টগুলো সম্পূর্ণভাবে উদ্দেশ্যমূলক, শুধুমাত্র ইসলাম নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোই উদ্দেশ্য"।  
আরো অনেকেই এইরকম অভিযোগ করেন মাঝে মধ্যেই। এসব বিষয়ে দুচারটি কথা তাহলে বলি। 
 
প্রথমেই আমার কৈফিয়াৎঃ
 
১। আমি শুধু ইসলাম-নাস্তিক নই।
 
২। আমি ইসলাম-বিদ্বেষী তো নই-ই, কোন ধর্ম বিদ্বেষীও নই, অর্থাৎ কোন ধর্ম বা ধর্মমতের বিরুদ্ধে কোন রকম বিদ্বেষ আমি পোষণ করি না। তবে, এ সমস্ত ধর্মদর্শনকে ভ্রান্ত দর্শন বলে মনে করি, যদিও এসব ধর্মসমূহের উন্মেষকালীন কিছু ইতিবাচক অবদানকে অস্বীকার করি না।
 
৩। আমার ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম-দর্শন নিয়েও পোস্ট বা আলোচনা আছে। যেমনঃ আমার "নাস্তিক আস্তিক সমাচার" পোস্টে ভারতীয় বিভিন্ন দার্শনিকেরা কিকরে ব্রহ্মার ধারণাকে নাকচ করেছিলেন- সে আলোচনা করেছি। আমার "বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর.." পোস্টে এক জায়গায় আলোচনায় রামকে নিয়েও সমালোচনা করেছি (যুদ্ধনীতির ক্ষেত্রে তাঁকে আমার কাপুরুষ মনে হয়েছে)। "ধর্মে বিজ্ঞানঃ নিম গাছে আমের সন্ধান" শীর্ষক পোস্টে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থের মাঝে বিজ্ঞান খোঁজা সংক্রান্ত আলাপেরও সমালোচনা করেছি, ... ইত্যাদি।
 
৪। আমি ধর্মতত্ত্ব-দর্শন-ইতিহাস-বিজ্ঞান নিয়ে খুবই আগ্রহ বোধ করি এবং যথাসাধ্য পড়ার চেষ্টা করি। এ কারণেই আমার পোস্টগুলোতে ঘুরে-ফিরে এ বিষয়গুলো আসে।
 
৫। এটা ঠিক যে, আমার পোস্টসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, অন্য ধর্মের তুলনায় ইসলাম নিয়ে আলোচনা তুলনামূলক বেশী করেছি। এর কারণ সম্ভবত এরকমঃ
 
 
ক) মুসলিম পরিবারে জন্ম সুবাদে ইসলাম সম্পর্কেই তুলনামূলক বেশী জানি, এবং আস্তিক অবস্থান থেকে যখন নাস্তিক হই তখন ইসলামকে খণ্ডন করেই নাস্তিক হতে হয়েছে। ফলে, এই যুক্তিগুলোই ভালো জানি।
 
খ) আমার চারপাশের মানুষগুলোর মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা বেশী, ফলে তাদের সাথে যখন ধর্ম-দর্শন নিয়ে কথা হয়, ইসলাম-ই বেশীর ভাগ সময় আলোচনার কেন্দ্রে থাকে। কেননা, একজন মুসলিমের সাথে শিব-ব্রহ্মা-নারায়ন প্রমুখকে নিয়ে আলোচনা করলে তার প্রতিক্রিয়া হয় সমর্থনমূলক, যদিও সেই সমর্থনমূলক অবস্থান তার মুক্তচিন্তাকে প্রকাশ করে না। 
 
গ) এই ব্লগেও অধিকাংশ ব্লগার মুসলিম পরিবারের। সেকারণে, এখানে ইসলাম নিয়েই তর্ক-বিতর্ক হওয়া সম্ভব। আমার অন্য ধর্মের সমালোচনামূলক পোস্টগুলোতে সেইসব ধর্মালম্বী কাউকে তর্ক করতে দেখিনা এবং সেগুলো সাধারণত মুসলিম ব্লগারদেরও চোখের অন্তরালে তা চলে গিয়েছে। অথচ, ইসলাম নিয়ে কোন কিছু বললেই আশেপাশের মুসলিম ব্লগাররা যেভাবে ঝাপিয়ে পড়ে- তাতে সেই ব্যাপারটি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে- তর্ক বিতর্কের ফলে। 
 
ঘ) ভারতের বা পশ্চিমবঙ্গের কোন ব্লগে লিখলে (যেখানকার ব্লগাররা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ) নিশ্চিৎভাবেই হিন্দু-ধর্ম নিয়ে বেশী আলোচনা করতাম। কেননা, সেখানে ইসলাম নিয়ে আলোচনা করা মানে সেখানকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সাম্প্রদায়িকতাকেই সুড়সুড়ি দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ হতো না! তেমনি এখানে অন্য ধর্ম নিয়ে বেশী আলোচনা করলে মুসলিম ব্লগারদের সাম্প্রদায়িক চেতনাকে আরো উসকে দেয়ার কাজই হবে বলে মনে হয়! 
 
ঙ) আমার পোস্ট গুলো দেখলে বুঝবেন, অধিকাংশ পোস্টই বিভিন্ন পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় লেখা। এখানে (সামু ব্লগে) ইসলাম নিয়ে যে ধরণের আজে বাজে পোস্ট পড়ে, সেগুলোকে খণ্ডন করতে গিয়েই আমার অনেক পোস্ট অবতারণা করতে হয়। অন্য ধর্মকে নিয়ে যদি এরকম পোস্টের সংখ্যা বেড়ে যায়- তবে সেগুলো নিয়েও আমি লিখবো বৈকি..
 
আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।
 
[প্রথম প্রকাশঃ সামু ব্লগ, তারিখ: ০৪ , ২০০৮ ]
 
দুইঃ  ইসলাম-ই কি সব নাস্তিকের শত্রু?
 
ফেসবুকে আমার কোন এক পোস্টের নীচে এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করেছিলেন, "ভাই, আমি আজ পর্যন্ত একজন নাস্তিক দেখলাম না যে ইসলাম বাদ দিয়ে অন্য কোন ধর্মের সমালোচনা বা কটুক্তি করে ... ইসলাম-ই কি সব নাস্তিকের শত্রু? নাস্তিকদের প্রথম টার্গেট থাকে ইসলাম - এটা যখনই বিভিন্ন নাস্তিক পেজগুলোতে দেখি, তখনই নিজের ধর্মের প্রতি আস্থা চলে আসে। নিঃসন্দেহে ইসলাম ধর্মই সত্য, নাইলে ইসলামের এত শত্রু কেন?" 
 
 
এই প্রশ্নের জবাবে বলবো এর কারণ, -
প্রথমত- আপনি নিজে মুসলমান এবং ইসলাম ধর্মের সমালোচনামূলক লেখাই আপনার চোখে বেশি পড়ে। আমার একাধিক লেখা ছিল/ আছে- যেখানে বিশেষ কোন ধর্মের ব্যাপারে সমালোচনা নেই- ওভারল ইশ্বর, সৃষ্টি -এসবকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞান ভিত্তিক বা দর্শন ভিত্তিক লেখা; সেখানেও তর্ক করতে এসেছে, মুসলমান ব্যক্তি এবং কমেন্টে যেহেতু তারা ইসলাম, কোরআন, আল্লাহ প্রভৃতি নিয়ে এসেছে- ফলে আলোচনা, তর্ক- বিতর্ক শেষ পর্যন্ত ইসলাম কেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে। আবার আমার এমনও লেখা আছে- যেখানে একাধিক ধর্মকে একসাথে সমালোচনা করেছি। যেমন ধর্মে বিজ্ঞানঃ নিমগাছে আমের সন্ধান- সেই লেখায় কোরআন- পুরান (বেদ/ বেদান্ত) পাশাপাশি রেখেই আলাপ করেছি ... সেই লেখার জবাব বা তর্ক-বিতর্কও করেছে- ইসলাম ধর্মের পক্ষের লোকজন- ফলে, পুরানকে যেহেতু কেউ ডিফেন্ড করতে আসেনি কিংবা সেগুলো আপনাদের মত মুসলমানদের চোখেই পড়েনি- ফলে, ইসলামকে নিয়েই পরবর্তী ডিবেটগুলো কন্টিনিউ করতে হয়েছে।
 
দ্বিতীয়ত- আমরা যারা বাংলাদেশের নাস্তিক- স্বভাবতই- ইসলাম ত্যাগ করা নাস্তিকই আমরা বেশি ... বিষয়টা একটু বুঝেন- জীবনের একটা শুরুর অংশটুকু ইসলাম নিয়েই আমাদের চলাফেরা ছিল- এই ধর্ম নিয়েই আমাদের জানাবুঝা বেশি ... যখন নাস্তিক হয়েছি- তখন এই ধর্মের ব্যারিয়ারই আমাদের পার হতে হয়েছে ... সুতরাং, এক্স-মুসলিম নাস্তিক ইসলাম নিয়েই বেশি লেখবে- এটাই স্বাভাবিক ... একই কথা অন্যান্য এক্স-ধার্মিক নাস্তিকের জন্যেও সত্য। এক্স-হিন্দু নাস্তিককে দেখবেন হিন্দু ধর্মের ব্যাপারে বেশি লেখছে, এক্স-খ্রিস্টান নাস্তিক দেখবেন খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে বেশি লেখছে। (যদিও সেই সব লেখাগুলো নিয়ে আপনার তেমন হেডেক নাই বলে সেগুলো আপনার দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়)।
 
তৃতীয়ত- আমাদের মত মুসলিম প্রধান দেশে- ইসলাম ধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ফলে, এইখানে ইসলাম নিয়ে আলাপ যেহেতু বেশি হয়- সেহেতু স্বভাবতই নাস্তিকরা ইসলামের সমালোচনাও বেশি করে করবে। উদাহরণ দেই- এখানে রোজার মাসে ফ্রি-লি খাবার দাবার করা যায় না ... এমনকি বিড়ি নিয়া বাইরে বাইর হইলেও সবাই চোখ বড় করে তাকায় ... ফলে এইখানে এই বাস্তব সমস্যার মুখে যারা পড়ে- সেই অভিজ্ঞতা নিয়াই তো লেখবে। ভারতীয় নাস্তিক বন্ধুদের যেমন হিন্দু বাবা- পুরোহিত- তাদের ধাপ্পা ... ইত্যাদি নিয়া লেখতে বা সিনেমা করতে বেশি দেখি। আমির খানের পিকে বলেন আর সত্যজিতের দেবী, গণশত্রু বলেন- এইরকম সিনেমা অসংখ্য পাবেন ভারতীয় প্রেক্ষাপটে। কিন্তু বাংলাদেশে বা ইরানে মুসলিম প্রধান দেশে এইসব করে কি ফায়দা। তারচে বরং তারেক মাসুদ রানওয়ে বানায়- ইরানে টু-উইমেন তৈরি হয় (নারীর ডিভোর্স নিয়ে বেশ কিছু ডিবেট দেখানোতেই ইরানী মুসলমানরা ধর্ম অবমাননার দায়ে এইটারে ব্যান করেছিল) ...
চতুর্থত- বিশ্বব্যাপি ইসলামী জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস- প্রভৃতি কারণে ইসলাম ধর্ম একটা গ্লোবাল টপিকে পরিণত হয়েছে (সেইটা মাথামোটা মুসলিমদের কারণেই)। ফলে- ইন্টারন্যাশনাল টপিক নিয়া যেকেউই যেকোন জায়গায় কথা বলার অধিকার রাখে ...
 
[প্রথম প্রকাশ ফেসবুক, জুন ২৩, ২০১৬]
 
 
 
 তিনঃ কোনটা নাস্তিকতা, কোনটা ঘৃণা, কোনটা বিদ্বেষ?
 
"আমার নাস্তিক বন্ধুরা পার্থক্য করতে পারছেন না - কোনটা নাস্তিকতা, কোনটা ঘৃণা, কোনটা বিদ্বেষ। কেউ কেউ খুবই গর্বিতভাবেই বলছেন আমি ইসলাম বিদ্বেষী। আমার গলা কেটে ফেললেও আমি ইসলাম বিদ্বেষী"।
"দুইটা শব্দ আছে এইখানে। বিরোধিতা এবং বিদ্বেষ। বিদ্বেষ শব্দটা সরাসরি ঘৃণার চর্চা করা বা ঘৃণা ছড়ানো। আপনি বিরোধিতা নিশ্চয়ই করতে পারেন। যখন নাস্তিকতার চর্চা করছেন, ধর্মের বিরোধী অবস্থান আপনার অবশ্যই থাকতে পারে, কিন্তু আপনি সরাসরি যখন বলছেন আমি বিদ্বেষী, বলছেন- আমি ইসলামোফোবিক বা আমি জেনোফোবিক, হোমোফোবিক ... "
"আমি বলছি যে, বিদ্বেষ শব্দটিই হচ্ছে একটা আনএক্সেপ্টেবল শব্দ। হোয়াই শুড ইউ বি বিদ্বেষী। আপনি বিরোধিতা করেন। আপনি অপছন্দ করেন!" - নাদিয় ইসলামের ফেসবুক পোস্ট!

প্রথম কথা হচ্ছে, "ইসলাম বিদ্বেষ" কিংবা "ইসলামোফোবিক"- এই টার্মোলজিগুলো কাদের আমদানিকৃত? নাস্তিকদের যারা বলছেন- "আমি ইসলামবিদ্বেষী", তারা কোন পরিস্থিতিতে তা বলছেন? ইসলাম সংক্রান্ত যেকোন বিরোধিতাকে, যেকোন সমালোচনাকেই যখন "ইসলাম বিদ্বেষ" হিসেবে দেখিয়ে দিয়ে- নাস্তিকদের খুন করার লেজিটেমেসি তৈরির চর্চা চলছিলো চারদিকে, সেই মুহুর্তে নিজেকে "ইসলাম বিদ্বেষী" বলা, ইসলামকেও ঘৃণা করার অধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে "আমার গলা কেটে ফেললেও ইসলাম বিদ্বেষী থাকবো" বলা- এইসবের ইতিহাস না জেনেই কি তারা প্রশ্ন করছেন, "নাস্তিকরা নিজেদের ইসলাম বিদ্বেষী বলছে কেন?", "জার্মান বা ফ্রেঞ্চ ভাষায় রাস্তায় কোন নাস্তিক নিজেকে বিদ্বেষী বললে- বলবে, এর মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন"? আচ্ছা, নাস্তিকদেরকে "ইসলাম বিদ্বেষ" দিয়ে ডেমোনাইজ করার যে তোরজোড়, তার জবাব দেয়া ছাড়া- কবে কোনদিন কোন নাস্তিককে হরেদরে- রাস্তাঘাটে কিংবা ফেসবুক - ব্লগের লেখাজোখাতেও "আমি ইসলাম বিদ্বেষী" বলে পরিচয় দিয়া বেড়াইতে দেখছেন বলেন!
 
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে- নাস্তিকতা, ঘৃণা আর বিদ্বেষের পার্থক্যটা আসলে নাস্তিকরা নাকি যারা এইসব ট্যাগিং করছেন- তারাই করতে পারছেন না? বস্তুত- ইসলাম (কিংবা যেকোন ধর্ম) এর বিরোধিতা আর বিদ্বেষ- এই দুইয়ের মধ্যে কি কোন ফাইন লাইন টানা সম্ভব? ২০১৩ সালে হেফাজত যখন সরকাররে ২৫-২৮ জন "ইসলাম বিদ্বেষী" নাস্তিকের তালিকা ফাইল সমেত জমা দিয়েছিলো- সেইখানে অভিজিৎ রায়ের সমকামিতা নিয়া লেখা, অনন্ত বিজয়ের বিবর্তনবাদ নিয়া লেখারও উল্লেখ ছিল! ফলে- নাস্তিকতার মধ্যে যারা "বিদ্বেষ" খুজতে চাইতেছেন- এই সমস্যাটা তাদেরই নয় কি? নাস্তিকদের সমস্যা কেমনে হয়?
 
তৃতীয়ত, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়া হিন্দু বিদ্বেষ, ইহুদী বিদ্বেষ- এই সমস্ত টার্মোলজি সবক্ষেত্রে ব্যবহৃত হইলেও- এক মুসলিম বিদ্বেষরে কেমনে আপনেরা "ইসলাম বিদ্বেষ"- টার্ম দিয়া চালাইয়া দিতেছেন? এই টকশোতে নাদিয়া ইসলামও ইসলাম বিদ্বেষের পাশে ইহুদি বিদ্বেষ শব্দবন্ধ ইউজ করছে ... । নাৎসিদের সমস্যা ছিল- তারা ইহুদি বিদ্বেষী ছিল; সেইটারে কেউ মোটেও ইহুদিজম বা ইহুদি ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বলে চিত্রিত করে নাই! আজকে প্যালেস্টাইনে যেই সমস্যা- দুনিয়ার প্রগতিশীলরা জিওনিজম নিপাত যাক কয়, জিওনিজমরে ঘৃণা করে- কিন্তু মোটেও কয় না- ইহুদিরা নিপাত যাক ... !
 
চতুর্থত, নাদিয়া ইসলাম বিদ্বেষ কইতে কইতে ইসলামোফোবিক কথাটাও কইছে। এবং ইসলামোফোবিক এর পাশে ইউজ করছে জেনোফোবিক আর হোমোফোবিক টার্মগুলো! এই টার্মোলজিগুলোর অর্থ বস্তত জানে কি? ফোবিয়া তো হইলো অমূলক ভয়! আর জেনো হইলো অপরিচিত, ফরেনার- অর্থাৎ নিজেদের গোত্র, বর্ণ, জাত, ধর্ম বাদে অন্য যেকোন কমিউনিটির মানুষদের নিয়া অমূলক ভীতি- হইলো জেনোফোবিয়া; হোমো আসছে- হোমোসেক্সুয়ালিটি থাইকা- হোমোফোবিয়া হইলো হোমোসেক্সুয়ালদের প্রতি অমূলক ভয়। সেইদিক দিয়া মুসলিমদের নিয়া যে অমূলক ভীতি- সেইটারে তো কওন দরকার- মুসলিমোফোবিয়া; অথচ তারে চালাইয়া দিতেছেন- ইসলামোফোবিয়া কইয়া! আর, ভালো কথা- নাস্তিকরা নিজেরে ইসলাম বিদ্বেষী কইতে পারে, কিন্তু কোন দিন কি দেখছেন কেউ কইছে- হ্যাঁ আমি ইসলামোফোবিক!
 
পঞ্চমত, এই যে মুসলিম বিদ্বেষ আর ইসলাম বিদ্বেষ-রে একাকার করে- সমার্থক হিসেবে উপস্থাপন করা- এইটা পলিটিকাল ইসলামিস্টদের একটা সুনির্দিষ্ট চাল! ইসলামের সুপ্রিমেসি স্ট্যাবলিশ করতে চায় বলেই- তারা এইভাবে দেখায়! ইসলামের বিরুদ্ধে বলা মানেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে বলা- নাদিয়াও যেই যুক্তিটা করছে- আইডিওলজি তো মানুষই বহন করে, ফলে আইডিওলজির বিরুদ্ধে কইলে কমিউনিটির বিরুদ্ধেই তো যাবে- এই একই যুক্তিটা কিন্তু দেখবেন ইসলামিক টেক্সটের বিরুদ্ধে ইউজ করবার পারবেন না! যাবতীয় ইসলামিক টেক্সটে ভিন্ন আইডিওলজি, ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যত কথা- ইসলামিস্টরা ভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে (এবং ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধেও) যত কথা কয়- সেগুলোকে তারা পারমিটেড মনে করে- কেননা সেইটাও তাদের ধর্মের অংশ, তথা ধর্মীয় স্বাধীনতা।
 
ষষ্ঠত, দুইদিন আগে- এইরকম "উগ্র নাস্তিকরা" বাংলাদেশের জন্যে কতখানি ক্ষতিকর- এই মর্মে লেখা এসেছে! সারওয়ার সাহেব মহাউল্লাসে শেয়ারও করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সবচাইতে নিরীহ, সংখ্যালঘু, এবং বাংলাদেশের পলিটিকাল কনটেক্সটে সবচাইতে গৌন- এই নাস্তিকদের নিয়া যে ফোবিয়ায় তারা আক্রান্ত হচ্ছেন,- সেই জন্যে তাদেরকে নাস্তিকোফোবিক বলা যাবে না? এই যে- তারা নাস্তিকদের - কিংবা তাদের ভাষায় "নব্য নাস্তিকদের" বিরুদ্ধে টানা ঘৃণা ছড়াচ্ছেন- যেইটা বাংলাদেশের মত কনটেক্সটে কতখানি ভয়ানক হইতে পারে সেই অভিজ্ঞতাটা খুব বেশি পুরান না; ব্যক্তি ধরে ধরে পাবলিক শেমিং, চিন্তা- দৃষ্টিভঙ্গি- যুক্তি- মত - পথ নিয়ে তর্ক বিতর্ক বাদ দিয়ে, তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা সংকট, সততা - ইন্টিগ্রিটি - ইন্টেলেকচুয়ালিটি- এইসব নিয়া গড়েবড়ে কথা বলে ঘৃণিত জীব হিসেবে উপস্থাপন করছেন, সেইটা কি রেসিজমের অন্তর্ভূক্ত নয়? হ্যাঁ, আইডিওলজির বিরুদ্ধে ঘৃণা যত জাস্টিফায়েড হউক- কমিউনিটির প্রতি ঘৃণারে রেসিজমই কই ... !
 
সপ্তমত- এইটা কি মনে করেন না- একজন অজ্ঞ, মুর্খ ব্যক্তিরও ধর্মে আস্থা না থাকতে পারে- ইনটেলেকচুয়াল মান যেমনই হোক- সেই অনাস্থার কথা- ব্যক্তির চিন্তা, তার অবস্থান থেকেই কি সে প্রচার করতে পারে না? এমনকি একজন অসৎ, একজন দাগী আসামিও তো নাস্তিক হইতে পারে, মানে তার ধর্মে বা ইশ্বরে বিশ্বাস না থাকতে পারে। একজনের শিক্ষা দীক্ষা, ব্যক্তিগত সততা- অসততা- নৈতিকতা- এইসবের ফিরিস্তি (অনেককিছুর আবার কোন প্রামণ বাদে ঢালাও ফিরিস্তি) টাইনা কি নাস্তিকদের বা "নব্য নাস্তিকদের"- ডেমোনাইজ করবার পারেন?
 
অষ্টমত, মানুষ হিসেবে মানুষকে ট্রিট করা, রেসপেক্ট করা- "আমি" বাদে অপরকেও মানুষ হিসেবে ট্রিট করা- এই শিক্ষাটা খুব জরুরি। একজন আস্তিক হলেই যেমন বেটার কিছু হয়ে যায় না, তেমনি একজন নাস্তিক হইলেই বেটার কিছু হইয়া যায় না- এ কথার সাথে সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু, এই কথা সবকিছুর জন্যেই প্রযোজ্য। আপনি যা যা- তার জন্যেই আপনি অন্যদের চাইতে বেটার না ... আপনার চাকরি আছে, আপনার নানান কিসিমের স্কিল আছে, আপনি কিছু বই অনুবাদ করছেন, বই লেখছেন- মানেই আপনি যারা এইসব করেনি- তাদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারেন কি? আরেকজনের চিন্তা- মত- পথ নিয়া হাজার বিরোধিতা করেন, সমালোচনা করেন; আরেকজনের কোন অন্যায় দেখলে- অপরাধ দেখলে স্পেসিফিক ব্যক্তি ধরে প্রমাণ সহকারে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন ... কিন্তু নিজের যা যা নিয়ে আপনার গর্ব, সেই গর্বের প্রচারে অন্যদেরকে পাবলিক শেমিং করতে পারেন কি?
 
নবমত- বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষদের নেয়ার সামর্থ্য, কোন একটা দেশের লিগ্যাল ফেমওয়ার্ক- ইত্যাদি মেপে মেপে কথা বলার কথা আপনেরা কইলেন! "উসকানি"র কথা আপনারা কইলেন! এইরকম বেশিরভাগ মানুষের মন জুগাইয়া চললে দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা, নৈতিকতা, আইন, কানুন- সবকিছুই এক জায়গায় স্থির হইয়া থাকতো! আমি আশা করবো, নাদিয়া- সারওয়ার দুইজনের কারোরই যেন এই হাল না হয়! নাদিয়ার নারীবাদ যতটুকুই "উসকানি" দিতে পারছে- সেইটারে দরকারীই মনে করি ...
 
দশমত, মানে শেষ পয়েন্টে- একটা আশংকার কথা জানাইয়া যাই। ২০১৩ সালের পরে এই ভিক্টিম ব্লেমিং এর কামটা খুব জোরেশোরে হইছিলো। থাবা বাবা মরার পরে- আমার দেশ পত্রিকা থাবা বাবার - ধর্মকারীর অনেক লেখার অংশ বিশেষ ছাপিয়ে দিয়েছিলো। সোনার বাংলা সহ- ইসলামিস্ট বিভিন্ন সাইট, ব্লগে নাস্তিক ব্লগারদের তালিকা ধরে ধরে- তাদের বিভিন্ন "ইসলাম বিদ্বেষী" লেখার অংশ বিশেষ ছাপানো হচ্ছিলো। এই "ইসলাম বিদ্বেষ" দেখানোর চলটা আরো পুরাতন। হুমায়ুন আজাদ, শামসুর রাহমান, শাহরিয়ার কবির, জাফর ইকবাল, তসলিমা নাসরিন, আহমদ শরীফ, আলী আজগর,- এইরকম অসংখ্য "ইসলাম বিদ্বেষী"র "ইসলাম বিদ্বেষ" এর প্রমাণ স্বরূপ কোটেশন, বক্তব্যাংশ- এইসব উল্লেখ করে ভিডিও, পোস্টার- প্রচারের চল বহুত পুরাতন। কিন্তু, ২০১৩ সালের পর থেকে নাস্তিক ব্লগারদের "ইসলাম বিদ্বেষ" নিয়ে প্রচার প্রপাগাণ্ডাটা ব্যাপক বেড়ে যায়- বলতে গেলে একদম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। একদম রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই এইরকম ইসলাম বিদ্বেষ নিয়া আলাপ সালাপ হইতে থাকে! এর একটা পর্যায়ে- আমাদের প্রগতিশীল, সেক্যুলারদেরও অনেকরেও ইসলামিস্টদের ফাঁদে পা দিয়ে কথিত "উগ্র নাস্তিক"দের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখেছি ... । প্রায় দুই বছরে তৈরি করা সেই গ্রাউণ্ডের উপরে নির্ভর করেই- ২০১৫ সালে এসে আনসার বাংলা- আইএস এইসব গ্রুপ শুরু করে নাস্তিক হত্যার মহোৎসব! "ইসলাম বিদ্বেষ" এর বিরুদ্ধে যে জমিনটা দুই বছরে তৈরি হইছিলো- সেইটারে কাজে লাগাইতেই- প্রতিটা হত্যার পরপরেই- আনসার বাংলা যে স্টেটমেন্ট দিতো- সেইখানে খুন হওয়া ব্লগারের "ইসলাম বিদ্বেষী" কোটেশন জুড়াইয়া দিতো ... যাতে "ইসলাম বিদ্বেষী" ব্লগারদের খুনের লেজিটেমেসি তৈরি হয়। আজকে আবার ইসলাম বিদ্বেষ নিয়া এইরকম নড়াচড়া দেইখা এবং পেছন থেইকা পিনাকি'র মত চিহ্নিত লোকরে কলকাঠি নাড়াইতে দেইখা- সেই রকম পরিকল্পনার আশংকাই হইতেছে!
 
[ফেসবুক, ১৪ অক্টোবর, ২০১৯]
 
চারঃ বিদ্বেষ মাত্রই খারাপ জিনিস? ইসলাম বিদ্বেষ সাম্প্রদায়িকতা?
 
: আমি ইসলাম ইস্যুতে মডারেটদের বিরুদ্ধে লাগি কম। লাগি এক্সট্রিমিস্টদের বিরুদ্ধে।
:: আপনি নিজেই তো মডারেট, লাগবেন কেমনে? 😃 😛
 
: সেটাইতো! আপনাদের সাথে আমার দ্বিমতের জায়গাতো এইখানে বহু বছর ধরেই। আমি দেখেছি যে দুইপক্ষের (ইসলামিস্ট ও নাস্তিকদের) এক্সট্রিমিস্টরা মিলে মডারেটদের পিছে লেগে থাকে।
:: আপনি (ও আপনার মত মডারেটরা) আপনার বিভিন্ন লেখায় নাস্তিকদের ইসলামোফোব বলে তাদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল, বিদ্বেষী, এক্সট্রিমিস্ট বইলা - আপনি নিজেও কি ঘৃণার চর্চা করতেছেন না?
 
: এইটাতো ভাই ঐ সাম্প্রদায়িক ইসলামপন্থীদের মতো যুক্তি হইয়া গেল। যে তাদেরকে বিদ্বেষী বললে নাকি আমরাই বিদ্বেষী। আপনি কি আসলেই মনে করেন যে আমাদের নাস্তিকদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী নাই?
:: কেন থাকবে না! আমি নিজেই ইসলাম বিদ্বেষী। আমি ইসলাম বিদ্বেষকে একটা গুণ মনে করি। ওয়াশিকুর বাবুর ভাষায়ঃ “যে ধর্ম মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়, সে ধর্মকে আমি ঘৃণা করি”, “ধর্মবিদ্বেষ অপরাধ নয়, কিন্তু মানববিদ্বেষ অপরাধ। পৃথিবীর সব ধর্ম মানববিদ্বেষে পূর্ণ। তাই মানববিদ্বেষী ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা পবিত্র দায়িত্ব”।
: আমি মনে করি বিদ্বেষ খারাপ জিনিস। ইসলাম বিদ্বেষ সাম্প্রদায়িকতা।
:: আমি সেইটা মনে করি না ...
 
: না মনে করতে পারেন. আমি মনে করি যে কোন ধর্ম ও ধর্ম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষন করাই সাম্প্রদায়িকতা. কারো হিন্দুবিদ্বেষ আছে, কারো ইহুদিবিদ্বেষ আছে, আপনাদের ইসলামবিদ্বেষ আছে এখন সেই বিদ্বেষী ব্যক্তি ধার্মিক হউক বা নাস্তিক। বিদ্বেষই মূখ্য কথা। তো আমি ইসলামবিদ্বেষী বললে দ্বিমত করেন কেন?
:: আপনি বলার সময়ে হিন্দু বিদ্বেষ, ইহুদি বিদ্বেষ আর ইসলাম বিদ্বেষরে এক করতেছেন- এইটাই হইলো সুবিধাবাদী আলাপ ... হিন্দুইজম বিদ্বেষ, জায়োনিজম বিদ্বেষ, ইসলাম বিদ্বেষ, রেসিজম বিদ্বেষ, প্যাট্রিয়ার্কি বিদ্বেষ আমি ধারণ করি, ধারণ করারে গুণ মনে করি --- কিন্তু হিন্দু বিদ্বেষ, নাস্তিক বিদ্বেষ, মুসলিম বিদ্বেষ, - এইসবরে বর্জনীয় মনে করি ...
 
: আমি সুবিধাবাদি আলাপ করছিনা। আমি শব্দগুলা যেইভাবে আছে, সেইভাবে ব্যবহার করছি। আপনিই শব্দগুলার অর্থের দিকে নজর না দিয়া শব্দের আক্ষরিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন।
:: আপনি তো সুবিধামতন শব্দ ব্যবহার করতেছেন ... যেমনে আছে আবার কি? শব্দগুলার তো নির্দিষ্ট মানে আছে ... শব্দগুলার পেছনে রাজনীতিও আছে ... এইসব নিয়া মেলা আলাপ আলোচনাও হইছে ... তারপরেও আপনি ইসলাম বিদ্বেষ, ইসলামোফোব - এইসব শব্দগুলোকে হিন্দু বিদ্বেষ, নাস্তিক বিদ্বেষের প্যারালাল হিসাবে উপস্থাপন করতেছেন ... কেননা সেইটায় মেলা সুবিধা পাওয়া যায় ...
 
: ইহুদিবিদ্বেষ মানেতো কেবল ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ না, তার সাথে ইহুদি ধর্ম বিদ্বেষ ওতপ্রতভাবে জড়িত। তো ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষের ব্যবহার মুসলিম বিদ্বেষ বুঝাইতে পান নাই কখনো? আমিই প্রথম করলাম. না এইটাই প্রচলিত ব্যবহার?
:: হ্যাঁ, যে ইহুদি বিদ্বেষী বা মুসলিম বিদ্বেষী, সে একইসাথে ইহুদি ধর্মেও বিদ্বেষী বা ইসলামেও বিদ্বেষী হতে পারে, কিংবা বলা যায় তাদের এই ইহুদি বিদ্বেষ বা মুসলিম বিদ্বেষের পেছনে প্রধান কারণ হতে পারে ইহুদি ধর্ম বিদ্বেষ বা ইসলাম বিদ্বেষ। কিন্তু, ইহুদি ধর্মে বিদ্বেষী মাত্রই ইহুদি বিদ্বেষী না, ইসলাম বিদ্বেষী মাত্রই মুসলিম বিদ্বেষী না!
 
: আপনি ইসলাম বিদ্বেষ করবেন, আর মুসলমানদের ভালবাসবেন, এইটাতো হাস্যকর দাবি।
: এইটা কেন হাস্যকর দাবি হবে কেন? আমি ইসলামরে ঘৃণা করি ... কিন্তু আমার ভালোবাসার, শ্রদ্ধার মানুষদের ৯৯% মানুষই মুসলমান! কেননা আমার আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব, যত প্রিয় মানুষ সবাই তো মুসলমান।
 
: এইটা আপনার ব্যক্তিগত মতামত। আপনার ব্যক্তিগত চিন্তার আলাপ করছিনা। আপনি কিভাবে এই ফাইন লাইন মেইনটেইন করেন তাও আমি জানিনা। কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত কোন চর্চা দিয়েতো সামগ্রিকভাবে ইসলামবিদ্বেষ বোঝা যাবেনা।
:: হ্যাঁ - আমরা তো যেহেতু কথা বলছি- ব্যক্তিগত পারস্পেক্টিভই দুইজন তুলে ধরতেছি ... কিন্তু্‌ আপনি যখন বলেন - ইসলামরে ঘৃণা করে মুসলমানরে ভালোবাসা সম্ভবই না, বা হাস্যকর কথা -- তখন আমার উদাহরণটা দিলাম ... এটলিস্ট একটা উদাহরণ দেখাইলাম ... একইভাবে হিন্দু সমাজে বেড়ে ওঠা বা খৃস্টান সমাজে বেড়ে ওঠা একজন নাস্তিক যতই হিন্দুধর্ম বিদ্বেষী হোক, যতই খৃস্ট ধর্ম বিদ্বেষী হোক, একইভাবে বেশিরভাগের পক্ষেই হিন্দুবিদ্বেষী বা খৃস্টান বিদ্বেষী হওয়া সম্ভব হয় না, বরং হিন্দু বা খৃস্টান পরিবার – পরিজন – বন্ধুবান্ধবকে ভালোবাসে।
 
: আমি কিন্তু এখনো কনভিন্সড না যে ইসলাম বিদ্বেষ মনে রেখে মুসলিম বিদ্বেষ এড়ানো যায় কি না।
:: এই ব্যাপারে কনভিন্সড হওয়ার দরকার নাই তো! ইসলাম বিদ্বেষ আর মুসলিম বিদ্বেষ দুইটা আলাদা এক্ট কি না সেইটা কন! কারোর ক্ষেত্রে দুই এক্ট একই সাথেও ঘটতে পারে, বা একটা কারণ ও অন্যটা ফলাফল হইতে পারে। কিন্তু, একটা এক্টরে অন্য এক্ট দিয়া ডাকা কি ঠিক? ইসলাম বিদ্বেষ আর মুসলিম বিদ্বেষরে কি এক পাল্লায় মাপা ঠিক?
 
: ইসলাম বিদ্বেষ থেকেই যদি মুসলিম বিদ্বেষের শুরু হয়, তাহলে কারণটার বিরুদ্ধেই বেশি সোচ্চার থাকা দরকার।
:: না, তাহলে সেটা জেনারেলাইজেশন দোষে দুষ্ট হবে, যেহেতু সব ইসলাম বিদ্বেষীই মুসলিম বিদ্বেষী নয়। বস্তুত আমি অধিকাংশ নাস্তিকদেরই দেখি- তারা ইসলাম বিদ্বেষী হইলেও মুসলিম বিদ্বেষী না ... এইটাই স্বাভাবিক ... এমনটাই হয় চাইরদিকে ... আবার নাস্তিকদের মধ্যে অনেকেই আছে, মুসলিম বিদ্বেষী! যারা ধর্মরে ক্রিটিসাইজ করা বাদ দিয়া মুসলমানদের বিরুদ্ধে জেনারালাইজড ঘৃণা ছড়ায় ... এখন তাদেরকে মুসলিম বিদ্বেষী না বইলা - ইসলাম বিদ্বেষী বলাটা অসাধুতা বা অন্ধত্ব।
 
: কোন টার্ম নিয়া সমালোচনা থাকতেই পারে। টার্মের নামের মধ্যে পুরা চিত্র ধরা না পড়লে সেইটা অসাধুতা মনে করি না।
:: ইসলামোফোব, ইসলাম বিদ্বেষ - এইসব নিয়া অনেকেই মেলা লেখালেখি করছি ... আমি, অভিজিৎ, থেকে শুরু করে - এইদিকে ডকিন্সরাও এই শব্দের রাজনীতিটা দেখাইতে চাইছে ... কেননা এই টার্মের মধ্য দিয়া ইসলামের বিরুদ্ধে বলা, ইসলামরে ক্রিটিসাইজ করা - এগুলাকে ইসলামোফোব, ইসলাম বিদ্বেষ এইসব বলে - এগুলোকে নাস্তিক বিদ্বেষ, হিন্দু বিদ্বেষ, ইহুদি বিদ্বেষ - এইসব রেসিস্ট আচরণের সমর্থক বানায়া দেয়া যায় ... এগুলা আপনি জানেন না, পড়েন নাই, কিংবা বুঝেন না - এমনটা মনে করি না ... তারপরেও এই যে কথায় কথায় ইসলামোভোব, উগ্র নাস্তিক এই রকম নানান টার্ম যে ইউজ করেন- সেইখানেও আপনার রাজনৈতিক গোল নিয়াই তখন সন্দেহ তৈরি হয় আর কি ...
 
: ধরেন, ইসলাম বিদ্বেষের ইনেভেটিবল একটা ফলাফল হইল মডারেট মুসলিমদের সাথে বিদ্বেষী আচরণ করা। কেনোনা, ইসলামের যেই রূপটাকে সামনে রেখে বিদ্বেষ জায়েজ করা হচ্ছে, মডারেটরা তার চাইতে ভিন্ন রূপ হাজির করে।
:: এই কথাটাই ভুলযে, ইসলাম বিদ্বেষের ইনএভিটেবল ফল মুসলিম বিদ্বেষ। ভয়ানক ভুল কথা। হ্যাঁ, ইসলাম বিদ্বেষ থেকে অনেকে মুসলিম বিদ্বেষের দিকে ধাবিত হইতে পারে। কিন্তু, আপনাকে বুঝতে হবে যে- দুইটা দুই জিনিস। এবং যারা ইসলাম বিদ্বেষ থেকে মুসলিম বিদ্বেষের দিকে টার্ণ করছে, তাদেরও বুঝতে হবে - ইসলাম বিদ্বেষ পর্যন্ত তোমার লিমিট, কিন্তু মুসলিম বিদ্বেষটা ঘৃণ্য, রেসিজমের সমান! কিন্তু, আপনি যদি ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধেই আপনার জেহাদ শুরু করেন- সেইটা মোটেও কিছুই আনতে পারে না ... বরং নাস্তিক হেটার যারা আছে - তারাই একরকম সুরসুরি পাবে। রিচার্ড ডকিন্সের আলাপে একটা মজার উদাহরণ ছিল। “আমি ক্যান্সারকে ঘৃণা করি”। “আহ! তার মানে তো তুমি ক্যান্সারের রোগীকেও ঘৃণা করো!” আপনার ব্যাপারটাও এরকম হয়েছে! ক্যান্সারে ঘৃণা করার ইনএভিটেবল একটা ফলাফল ক্যান্সারের রোগীর সাথেও বিদ্বেষী আচরণ করা!
 
: আমাদের এই লড়াইটা আপনারা বোঝেন না। অনেক পোলাপান আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করে জিহাদিদের পোস্ট শেয়ার করে। বুঝেন অবস্থা যে ইসলাম বিদ্বেষ কোন পর্যায়ে পৌছাইত এপারে।
:: কে কার পোস্ট শেয়ার দিবে, সেইটা দিয়াই আপনি কাউরে মুসলিম বিদ্বেষী বলতে পারেন? এইরকম শেয়ার দেয়া- আপনি বা আপনার মত মডারেটদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ কিভাবে হয়, এইটা আমারে বুঝান! হুজুর ওয়াজ করছে, আল্লাহর রাসুলের বিরুদ্ধে কটুক্তি করলে তাকে কেটে টুকরো টুকরো করা হবে! আমি এইটা শেয়ার দিলাম। শফি হুজুর ওয়াজে বললো, নারীরা তেতুলের মত, মুখে লালা ঝরে। এইটাও আমি শেয়ার দিলাম। আরেক সেলিব্রিটি হুজুর পোস্ট দিলো, ৪ বিয়া করার ১২ টা ইসলামসম্মত ফজিলত নিয়া। সেইটাও আমি শেয়ার দিলাম। এগুলা শেয়ার কারণ, আমি দেখাইতে চাইছি, ইসলাম নামের এই মহান ধর্মটা কতখানি বর্বর ও ফালতু। এখন আপনি ও মডারেটরা ইসলামের এইসব নোংরা আবর্জনাগুলারে ঢেকে রাখতে চান, কিংবা ভিন্ন আধুনিক ব্যাখ্যা আনতে চান! খুবই ভালো কথা! কিন্তু, আমাদের যাদের উদ্দেশ্য আপনাদের মত না, তাদেরকে আপনাদের বিদ্বেষী বলাটা কতখানি সুস্থতা?
 
: কিন্তু, ঐ সব সালাফী হুজুরদের ইসলাম, শফি হুজুরের ইসলামকেই ইসলাম হিসেবে তুলে ধরতেছেন কেন? চার বিয়ের পক্ষে বাংলাদেশী আলেমদের মত ইসলামসম্মত নয়। তাইলে ঐ হুজুরদের চার বিয়ের ফতোয়া আপনারা প্রচার করে কি পাইতেছেন?
:: ধরেন, নাস্তিকদের অনেকেই মনে করে, ইসলামের এই রূপটা দেখিয়ে বর্তমান নৈতিকতার ভিত্তিতে এই ইসলামের সমালোচনা করার মাধ্যমেও অনেক মডারেট মুসলমানের মনে ইসলামকে নিয়ে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলা যায়! এবং সালাফি মুসলমান যারা এগুলোকে কোরআন হাদিসের ভিত্তিতে ইসলামের বিধান বলে মনে করে এবং মডারেটদের লুকাছাপা ইসলামকে যারা ইসলাম বলে মনে করে, তাদের মাথাতেও বর্তমান নৈতিকতা, যুক্তি, বিজ্ঞান – এরকম নানান আলাপ দিয়ে তার সেই অবস্থান বা বক্তব্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলার চেস্টা করা যায়!
 
: আপনারাতো ধরেন ইসলামপন্থী বা মুসলমানদের সাথে ঐরকম কোন ডায়ালগে যান না। কিন্তু ধরেন আমাদের যাদের ইসলামপন্থী এবং বিশ্বাসী মুসলমান পাঠক আছে, আমাদের অন্তত তাদের সাথে তর্ক বিতর্ক আলোচনার মাধ্যমে সামাজিক সহাবস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির একটা চেষ্টা আছে। আপনারা সেই কাজে হেল্প না করেন ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে জিহাদীদের সাথে মিলে আমাদের পিছে লাগাটাতো বিরাট বড় বোকামির কাজ।
:: নাস্তিকরাও নিয়মিত ডায়লগে যায়। সেই ডায়লগে আপনাদের মতন মলম দেয়ার কাম করে না, বরং ইসলামরে খোলামেলা ভাবে তুলে ধরার চেস্টা করে! আপনাদের কাছে এইটা বোকামির কাজ মনে হইতে পারে, আপনার মত মডারেটদের কাজটাকে অনেকের কাছে সুবিধাবাদী ও গ্যাটিস দেয়া মনে হইতে পারে। তবে, বোকামির কাজ বলাটা অন্তত ভালো, এটাকে মুসলিম বিদ্বেষ বলা বা মুসলিম বিদ্বেষ অর্থে ইসলাম বিদ্বেষ বলার চাইতে। কিন্তু, আপনাদের পিছে লাগার কিছু নেই। ইসলামের নানা দিক তুলে ধরে মডারেট মুসলিমদের মনে প্রশ্ন তুলতে চাওয়াটা পিছে লাগা হয় না! আর, জিহাদীরা যেসব জঙ্গী, ঘৃণাবাদী, বর্ণবাদী আয়াত – হাদীস – তাফসির উল্লেখ করে ইসলাম প্রচার করে, সেই সুরা, আয়াত, হাদীস, তাফসির নাস্তিকরা যদি ইসলামকে ক্রিটিসাইজ করার জায়গা থেকে সামনে আনে, তাহলে সেটা কিভাবে জিহাদীদের সাথে মিলে করা কাম হইতে পারে?
 
: কিন্তু এই ধরণের ইসলাম বিদ্বেষ তো সমাজে সালাফিজম প্রচারে ভূমিকা রাখছে!
:: মোটেও না! নাস্তিক আর কয়জন! মাদ্রাসায় মাদ্রাসায়, মসজিদে, বিশ্ববিদ্যালয়ে – সালাফিস্ট, ওয়াহাবিরা অবাধ বিচরণ করছে। তারা সমাজে যে চিন্তা ছড়াচ্ছে, সেটার সাথে নাস্তিকদের সমালোচনা সহ, ব্যাঙ্গাত্মক, স্যাটায়ারমূলক, প্রশ্নমূলক চিন্তার বিশাল পার্থক্য আছে। আমি সামুব্লগে একবার একটা পরীক্ষা করছিলাম। আওরঙ্গজেব নামের এক ইসলামিস্ট ব্লগার ছিলো (আসলে শিবির করতো)। সে একবার ইসলামি এক পোস্ট দিলো, ইসলামিক ব্লগাররা সব লাইক কমেন্ট দিয়ে ভাসায় ফেলছিলো। আমি পোস্ট পড়ে দেখলাম, খুবই রিয়াক্টিভ একটা পোস্ট, কোরআন হাদিসের রেফারেন্স সহ আছে। আমি হুবহু পোস্টটা আমার আইডি থেকে কপি পেস্ট করে দিলাম। একই পোস্ট যখন নাস্তিকের ধর্মকথা থেকে প্রকাশ হলো, ইসলামিক ব্লগারদের রেসপন্স পালটে গেলো! মডারেটদের কেউ কেউ, যারা আওরঙ্গজেবের পোস্টে একমত, প্রিয় পোস্টে, শোকেসে- এসব বলে এসেছিলো, তারাও কোরান হাদীসগুলোর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ার চেস্টা করছিলো! ফলে, ইসলাম বিদ্বেষ মোটেও সালাফিজম, ওয়াহাবিজম, কিংবা মডারেটিজম – কোন কিছুই প্রচারে ভূমিকা রাখে না!
 
: কিন্তু, বিদ্বেষ জিনিসটাই তো ভালো না! সাম্প্রদায়িকতা!
:: এই বিদ্বেষ কথাটা তো আপনাদের আমদানি। আমরা তো নিজেদের ইসলাম বিদ্বেষী বলি না। বলি, ইসলামের নানান বিষয় ধরে ধরে আমরা সমালোচনা করি। প্রশ্ন তুলি। অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরি। ইসলামের নামে দুনিয়াজুড়ে ও যুগে যুগে কি কি হয়েছে, সেই ঘটনাও দেখাই। এখন এগুলোকে আপনারা বিদেষ নাম দিলেন! হাসিনা বললো, মন্ত্রী আমলারা বললো, হেফাজত বললো, আনসার বাংলা বললোঃ নাস্তিকরা উগ্র, এরা ইসলাম বিদ্বেষী, আল্লাহর নবী রাসুলকে নিয়ে কটুক্তি করে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়! তাদের বলা থেকে, আপনি / আপনারা পার্মানেন্টলি কোট করে রেখে দিয়েছেন, উগ্র নাস্তিক আর ইসলাম বিদ্বেষী কথা দুইটা। কি আর করা, ইসলামের সমালোচনা করা, কোরআনের ভুল ভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়া, নবী রাসুলের সমালোচনা করা যদি আপনাদের কাছে বিদ্বেষমূলক মনে, তাহলে এরকম উগ্র ও ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক হওয়ার অধিকারও যে আমাদের আছে, সেই জায়গা থেকে প্রথমেই জানিয়েছি, আমিও ইসলাম বিদ্বেষী।
 
[পারভেজ আলমের সাথে কথপোকথন, ফেসবুক পোস্ট আকারে প্রকাশঃ জুলাই ২৫, ২০২১ ]

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১

কোরবানির ইতিহাসঃ বাইবেল ও কোরআনের বিরোধ

এক
কোরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কিত বাইবেল ও কোরআন এর আলাপ লইয়া ইসলামপন্থী, ইসলামবাদী, ইসলামিক বুদ্ধি-জীবীদের ভিতর ইদানিং বহুত কথাবার্তা হইতেছে! খুবই উপাদেয় আলাপ-আলোচনা, ফলে সমূহ পুলক বোধ হইতেছে, হাসিও আসিতেছে! উহারা প্রধানত দুইটি বিষয়ের দিকে উনাদের দৃষ্টিনিবন্ধ করিয়াছেনঃ
প্রথমত - বাইবেলে আব্রাহাম পুত্র ইসহাককে কোরবানির কথা বলা হইলেও, কোরআনে কোন পুত্রের কথাই নাম ধরিয়া বলা হয় নাই, যদিও বর্তমানে মুসলমান বয়ানে ইসমাইলকে কোরবানির কথাই বহুল প্রচলিত ও সর্বজনস্বীকৃত। 
 
দ্বিতীয়ত - বাইবেলে ঈশ্বর সরাসরি আব্রাহামকে ডাকিয়া প্রাণপ্রিয় সন্তানকে বলিদান করিবার নির্দেশ ফর্মাইয়াছিলেন এবং আব্রাহাম সেই মোতাবেক পুত্র সন্তানকে বলিদানে উদ্যত হইয়াছিলেন, অর্থাৎ পুত্রের কোন মত পিতা লন নাই। অন্যদিকে, কোরআনে ইব্রাহীম নবী স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন তিনি তার সন্তানকে জবেহ করিতেছেন, তাহা সন্তানকে জানিয়েছিলেন এবং সন্তান স্বয়ং রাজি হইয়াছিলেন।
 
 
দুই 
ইব্রাহীম নবী তাঁহার কোন সন্তানকে কোরবানি দিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, তাহা সেই সন্তান এবং তাঁহার বংশধরদিগের জন্যে বিশেষ গর্বের হিসাবে গণ্য হইতেছে বলিয়াই ইসহাকের বংশধর হিসাবে পরিচিতি দেওয়া ইহুদী ও খৃস্টানরা ইসহাকের নাম নিতেছেন, এবং ইসমাইলের বংশধর হিসাবে পরিচিতি দেওয়া মুসলমানরা ইসমাইলের নাম নিতেছেন! কিন্তু, সমস্যা হইয়া গিয়াছে যে, কোরআনে কোন সন্তানের নাম মুহাম্মাদ (সা) নিতে পারেন নাই, বা সাহস করেন নাই! জানা যাইতেছে যে, ইবনে কাথিরের পূর্বের ইসলামি আলোচনাসমূহে ইসহাকের কথাও বলা হইয়াছে। ইবনে কাথির ও তদপরবর্তী ইসলামিক আলেমগণ ও তাফসিরকারীগণ যাহারা বলিতেছেন ইসমাইলই আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজে জান কোরবানি দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তাহারা জানাইতেছেন পূর্বের আলেমগণ ভুলক্রমে ইহুদীদিগের প্ররোচণায় ইসহাকের নাম উল্লেখ করিয়া ফেলিয়াছিলেন! কিন্তু, কেন কোরআনে আল্লাহ পাক কিংবা নবীজী ইসমাইলের নাম উল্লেখ করিলেন না, আল্লামা তাবারি, আল্লামা কুরতুবি, আল্লামা কুরতুবির উল্লেখিত হযরত আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত আলি, হযরত উমর এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমর প্রমুখ - সকলেই কেন ইসহাকের নাম লহিয়াছিলেন এবং তাহাঁরা কিভাবে ইহুদীদিগের মারফৎ প্ররোচিত হইয়াছিলেন, বিভ্রান্তিতে পড়িয়াছিলেন, সেই সম্পর্কে কেহই আলোকপাত করিতে পারিতেছেন না! এবং এই সন্তান যে ইসহাক নহে, তিনি ইসমাইলই - ইহার পক্ষে অন্য কোন শক্ত যুক্তিও পাওয়া যাইতেছে না, একমাত্র যুক্তিই হইতেছে পূর্বতন যাহারা ইসহাকের নাম লহিয়াছিলেন - সকলেই ইহুদীদিগের দ্বারা প্ররোচিত হইয়াছিলেন! নবীজী মুহাম্মাদ (সা) এর কুরায়েশ বংশ যে ইসমাইলের বংশধর (বনু ইসমাইল), সেই হিসাবে ইসমাইলের উপরে এই বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হইলে, নবীজী (সা) এবং তাহাঁর উম্মতসকল বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত হইবেন, সেই আকাঙ্খা হইতেই যে ইসহাকের বদলে ইসমাইলকে কোরবানি দেওয়ার জন্যে ইব্রাহীম নবী উদ্যত হইয়াছিলেন - এইভাবে মিথটিকে পুনরুৎপাদন করা হইয়াছিলো, তাহা কেহ গোপন করিতে পারিতেছেন না! কিন্তু, ইহুদীদিগের প্ররোচনায় পূর্বতন সাহাবী ও আলেমগণ ইসহাকের নাম লইতেন, এহেন আলোচনায় এই কথা মনে করিয়া আমার ভীষণ হাসি পাইতেছে যে, স্বয়ং রাসুলে করিম হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ইহুদীদিগের দ্বারা প্ররোচিত হইয়া, তথা ইহুদী - খৃস্টানদের মাধ্যমে প্রচলিত এই মিথটি শুনিয়াই তাহা কোরআনে ঈষৎ পরিবর্তিত করিয়া ঢুকাইয়া দিয়াছিলেন! অর্থাৎ, কোরআনে থাকা কোরবানির সমগ্র আলোচনাই তো ইহুদীদিগের প্ররোচনার ফল (সাহাবা ও অন্যান্য আলেমগণ ইহুদীদিগের দ্বারা প্ররোচিত হইতে পারিলে, নবীজী পারিবেন না কেন?)!
 
 
তিন 
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি বা তুলনাটি আরো চমকপ্রদ। ইশ্বর পিতাকে আদেশ দিলেন, তোমার সন্তানকে বলিদান করো। আর অমনি পাষণ্ড ও উন্মাদ পিতা চলিলেন নিজ সন্তানকে জবেহ করিতে! আর এইদিকে পিতা স্বপ্ন দেখিলেন, তিনি নিজ সন্তানকে জবেহ করিতেছেন! প্রাণপ্রিয় সন্তান দূরের কথা, সন্তানের সহিত খুব তিক্ত সম্পর্ক থাকিলেও তো এমন বীভৎস স্বপ্ন দেখিয়া ভয়ে কুকড়ে গিয়া সন্তানকে জড়াইয়া ধরিবার কথা! আর, সেইখানে এই উন্মাদ পিতা তাহাঁর সন্তানকে স্বপ্নের কথা এমনভাবে জানাইতেছেন যে, উন্মাদ সন্তান নিজেও রাজি হইয়া যাইতেছেন - নিজের জীবনকে পিতার হাতে উৎসর্গ করিয়া দিতে! দুই মিথেই দুই বদ্ধউন্মাদ পিতাকে আমরা পাই, যাহাকে আসলে পাগলাগারদে আটকে রাখা উচিৎ ছিলো! সেইখানে, এনারা আলোচনা করিতেছেন, কোরআনের এই গল্পের পিতা কত মহান, কত গণতান্ত্রিক যে, সন্তানকে তাহা জানাইয়াছিলেন, এবং সন্তানও কত মহান, কত সাহসী ও নির্ভিক যে পিতার আহবানে সাড়া দিয়াছিলেন। ইহা বড়ই মজার বিষয় যে, বাইবেলের এক বদ্ধ উন্মাদের স্থলে কোরআনে দুই বদ্ধ উন্মাদ পাওয়া গেল, এবং তাহাতে মুহম্মদ (সা) এর উম্মতদের ছাতি অনেক বাড়িয়া গেল!

বুধবার, ৫ মে, ২০২১

অবরোধবাসিনী বেগম রোকেয়ার স্ববিরোধিতার স্বরূপসন্ধান

“আমি অনেক বার শুনিয়াছি যে আমাদের “জঘন্য অবরোধ প্রথা” ই নাকি আমাদের উন্নতির অন্তরায়। উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত ভগ্নীদের সহিত দেখা সাক্ষাৎ হইলে তাঁহারা প্রায়ই আমাকে “বোরকা” ছাড়িতে বলেন। বলি উন্নতি জিনিসটা আসলে কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তাহলে জেলেনী, চামারিনী, ডুমিনী, প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা অধিক উন্নতি লাভ করিয়াছে ।” [বোরকা, মতিচূর, প্রথম খণ্ড (পৃষ্ঠাঃ ৫৯, রোকেয়া রচনাবলী)]

মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাত ও বিশেষায়িত বেগম রোকেয়া যখন এভাবে অবরোধ প্রথাকে সমর্থন দিয়েছেন, সেখানে তাকে কি নারী জাগরণের পথিকৃৎ বলা যায়? মতিচূর, প্রথম খন্ডে স্থান পাওয়া “বোরকা” শীর্ষক প্রবন্ধটিতে তিনি আরো বলেছেনঃ  

“আমাদের ত বিশ্বাস যে অবরোধের সহিত উন্নতির বেশী বিরোধ নাই। উন্নতির জন্য অবশ্য উচ্চশিক্ষা চাই। কেহ কেহ বলেন যে ঐ উচ্চশিক্ষা লাভ করিতে হইলে এফ, এ, বি,এ পরীক্ষার জন্য পর্দা ছাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (university hall-এ) উপস্থিত হইতে হইবে। এ যুক্তি মন্দ নহে! কেন? আমাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় (university) হওয়া এবং পরীক্ষক স্ত্রীলোক হওয়া কি অসম্ভব? যতদিন এইরূপ বন্দোবস্ত না হয়, ততদিন আমাদের পাশকরা বিদ্যা না হইলেও চলিবে”।

চিন্তা করে দেখেন, কিভাবে তিনি অবরোধ প্রথাকে সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, অবরোধ প্রথার সাথে উন্নতির নাকি কোন বিরোধ নাই। এই অবরোধ প্রথার সাথে নাকি কোনরকম আপোশরফা করা যাবে না, দরকারে যতদিন নারীদের স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় ও স্ত্রীলোক পরীক্ষকের বন্দোবস্ত না হচ্ছে, ততদিন পাশকরা বিদ্যা না হলেও নাকি চলবে! এরকম একজনকে তবে কেন নারীশিক্ষার, নারী জাগরণের পুরোধা বলা হয়? মুসলিমদের মত নাস্তিক-সেক্যুলাররাও কেন তাঁকে নিয়ে আপ্লুত থাকে, শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যায়? কেবল, অবরোধ প্রথাকে এমন সমর্থনই নয়, তিনি প্রাথমিক শিক্ষায় কোরআন শিক্ষার গুরুত্বের কথাও বলেছেনঃ  

“আমার অমুসলমান ভগিনীগণ! আপনারা কেহ মনে করিবেন না যে, প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কোরআন শিক্ষা দিতে বলিয়া আমি গোড়াঁমীর পরিচয় দিলাম। তাহা নহে, আমি গোঁড়ামী হইতে বহুদূরে। প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থা কোরআনে পাওয়া যায়। আমাদের ধর্ম ও সমাজ অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য কোরআন শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন।”[বঙ্গীয় নারী- শিক্ষা সমিতি,অগ্রন্থিত প্রবন্ধ,(রোকেয়া-রচনাবলী,পৃষ্ঠাঃ ২৩০)]

কি ভয়ঙ্কর! এ তো নির্ঘাত "তালেবান" বানানোর শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন বেগম রোকেয়া! তাই নয় কি? "রোকেয়ার মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনার সবচেয়ে প্রকট রূপ দেখা যায় তাঁর ‘বোরকা’ প্রবন্ধে"। মুক্তমনা ব্লগে ফরিদ আহমেদ তাঁর "রোকেয়াঃ অন্য আলোয় দেখা" প্রবন্ধে বলেছিলেনঃ  

"রোকেয়া যতই বলুক না কেন যে তিনি গোঁড়ামী হইতে বহু দূরে, আমরা কিন্তু ঠিকই তাঁর মধ্যে একজন গোঁড়া মুসলমানকে দেখে ফেলি। কোরান পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, মোল্লাদের এই ধারণার সাথে রোকেয়ার অসম্ভব মিল খুঁজে পেয়েও বিস্মিত হই আমরা"।  

বেগম রোকেয়া গবেষক এবং রোকেয়াকে নিয়ে লেখা বই ‘বিবি থেকে বেগম’ এর লেখক আকিমুন রহমান এর সাথে একমত হয়ে তিনি উদ্ধৃত করেছিলেনঃ  

"সীমাহীন স্ববিরোধ ও পুরুষতন্ত্রের প্রথা মান্য করার অন্য নামই হচ্ছে রোকেয়া। নারীর জীবন গড়ে তোলার কাজে নিবেদিত এক ব্রতী বলে মান্য হন রোকেয়া, তবে তাঁর নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছেমতো কাঠামো দেবার শক্তি ও ইচ্ছেই তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। তাঁর নিজের জীবনই তাঁর নিজের তৈরি নয়। রোকেয়া নারীপ্রতিভা হিশেবে নন্দিত; রোকেয়া প্রতিভা ঠিকই, তবে স্বামীর ছাঁচে বিকশিত প্রতিভা। তিনি অভিজাত পুরুষতন্ত্রের কুপ্রথা ও অবরোধ পীড়নের বিরুদ্ধে মুখর, আর নিজের জীবনে অতিনিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন পতিপ্রভুর পরিয়ে দেওয়া শৃঙ্খল; আমৃত্যু নিয়ন্ত্রিত হন একটি শবদেহ দ্বারা। তাঁর বিবাহিত জীবন স্বল্পকালের, বৈধব্যের কাল দীর্ঘ; স্বল্প বিবাহিত জীবন কাটে তাঁর মহাপাথরের বন্দনায় আর দীর্ঘ বৈধব্যের কাল কাটে মৃতি পতির তৈরি করে রেখে যাওয়া ছক অনুসারে। রোকেয়া বাঙালি মুসলমান নারীর জাগরণের জন্যে লিখে যান জ্বলাময়ী প্রবন্ধ আর নিজের জীবনে অনড় করে রাখেন অন্ধকার ও প্রথার মহিমা। রোকেয়া আদ্যপান্ত স্ববিরোধিতাগ্রস্ত"।

এমন বেগম রোকেয়ার প্রতি কি আমাদের, বিশেষ করে আমাদের মত সেক্যুলার নাস্তিকদের উচ্চবাচ্য করা উচিৎ? দেখাই যাচ্ছে যে, মুক্তমনারা সকলে তার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন না, হুমায়ুন আজাদ যদিও বেগম রোকেয়াকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেছিলেন, ফরিদ আহমেদ এর ভাষায়- ‘বেগম রোকেয়াকে নারীবাদী হিসাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছেন’। নারী গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেনঃ  

"রোকেয়া পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে চালিয়েছিলেন সার্বিক আক্রমণ। তিনি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছেন পুরুষতন্ত্রের তৈরি নারী ও পুরুষের ভাবমূর্তি, বর্জন করেছেন নারীপুরুষের প্রথাগত ভূমিকা; তুলনাহীনভাবে আক্রমণ করেছেন পুরুষতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থা ধর্মকে। রোকেয়া পরে ধর্মের সাথে কিছুটা সন্ধি করেছেন আত্মরক্ষার জন্যে; নইলে তাঁকে ও তাঁর আদর্শকে অত্যন্ত বিপন্ন করে তুলতো মুসলমান পিতৃতন্ত্র। তিনি এমন এক পিতৃতন্ত্রের সদস্য ছিলেন, যেখানে পুত্র মাকে শেখায় সতীত্ব"। 

হুমায়ুন আজাদ অন্য অনেকের চাঁছাছোলা সমালোচনা করলেও বেগম রোকেয়ার প্রতি কেন এরকম সহমর্মিতা দেখালেন, সেটা মুক্তমনা ব্লগের অনেকেই আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করেছেন! ফরিদ আহমেদ তো পুরুষবাদী পুরুষের সাথেও তুলনা করে বেগম রোকেয়াকে অনেক পশ্চাদপদ দেখেছেন। তিনি লিখেছেন,

সুগৃহিনীদের ঘরকন্নার কাজগুলোর তালিকা এবং সেই সাথে সাথে এগুলোকে সফল করার উপায়ও বাতলে দিয়েছেন তিনি। আসুন দেখি রোকেয়া বর্ণিত সুগৃহিনীদের ঘরকন্নার তালিকাগুলো কী কী।
"ঘরকন্নার কাজগুলি প্রধানতঃ এই-
(ক) গৃহ এবং গৃহসামগ্রী পরিস্কার ও সুন্দররূপে সাজাইয়া রাখা।
(খ) পরিমিত ব্যয়ে সুচারুরূপে গৃহস্থালী সম্পন্ন করা।
(গ) রন্ধন ও পরিবেশন।
(ঘ) সূচিকর্ম্ম।
(ঙ) পরিজনদিগকে যত্ন করা।
(চ) সন্তানপালন করা"।
পুরুষবাদী পুরুষেরাও মনে হয় না এরকম নির্লজ্জভাবে মেয়েদের ঘরকন্নার তালিকা তৈরি করে হাতে ধরিয়ে দেবে। সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে সুগৃহিনী হওয়ার জন্য মেয়েদের উদ্দেশ্যে সবশেষে তিনি বলেছেনঃ "যদি সুগৃহিণী হওয়া আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে স্ত্রীলোকের জন্য সুশিক্ষার আয়োজন করিবেন"

  

ফরিদ আহমেদ রচিত "রোকেয়াঃ অন্য আলোয় দেখা" ব্লগ পোস্টে (প্রবন্ধে) মুগ্ধ অভিজিৎ রায় কমেন্টের শুরুতেই জানান, "না পারি গিলতে না পারি উগরাইতে"। কেননা, বেগম রোকেয়া বেশ কিছু লেখা, বক্তব্য বা বানীতে অভিজৎ রায় লিখেছেন,

"রোকেয়ার এই স্ববিরোধিতাটা আমাকেও ভাবায়। ... নারীবাদের ইতিহাসে রোকেয়া একটি অনন্য নাম হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু বলতে হয়, রোকেয়ার মধ্যে স্ব-বিরোধ ছিলো বিস্তর, চোখে পড়ার মতই। ... আসলে এ ধরনের ‘পর্দানসীন ভদ্রবেশী নারী’ যিনি কিনা মাঝে মাঝে উচ্চকিত হবেন নারীমুক্তির বন্দনায়, কিন্তু নিশি-দিন যাপন করে যাবেন এক প্রথাগ্রস্ত, বিনীত, মান্য করে ধন্য হয়ে যাওয়া ছকে বাঁধা জীবন – এমন ‘অধুনিকা’ নারীরূপ কিন্তু পুরুষতন্ত্রের খুব পছন্দের। রোকেয়া তসলিমা বা মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের মত উগ্র, ঝাঁঝালো, আমূল নারীবাদী নন; তিনি বাঙালী মুসলমান নারী জাগরণের জন্য লিখে গেছেন কিছু অমূল্য রচনা, কিন্তু নিজের জীবনে অনড় করে রেখেছিলেন অন্ধকার, বোরখা ও প্রথার মহিমা। যেহেতু তিনি তুষ্ট করেন পুরুষতন্ত্রের ‘উদারনৈতিক’ সকল চাহিদা, তাই বিনিময়ে পুরুষতন্ত্র আজ তাকে দিয়েছে ‘মহীয়সী’ অভিধা, এখন নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে ‘নারী জাগরনের অগ্রদূত’ হিসেবে। আজ তাই দেখা যায় এমনকি চরম রক্ষণশীল, প্রথাগ্রস্ত পুরুষটিকেও রোকেয়া বন্দনায় মুখর হতে"। 

 

"রোকেয়ার জন্যে এবং বালিকা বিদ্যালয়ের জন্যে সমান অংকের অর্থ বরাদ্দ হবার কারণ অতি স্পষ্ট। রোকেয়াকে বৈধব্যের কাল কৃচ্ছতায় কাটাবার এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটাবার ব্যবস্থা সম্পন্ন করার জন্যেই প্রভু এমন ব্যবস্থা করে। আর ওই তরুণীকে নিয়ন্ত্রণ করার শৃঙ্খল প্রস্তুতের এককালীন প্রস্তুতির জন্যে এমন অর্থ বরাদ্দ করতে প্রভু মুক্তহস্ত ও দরাজ হওয়াই স্বাভাবিক। রোকেয়ার জীবন হচ্ছে নিরবচ্ছিন্নভাবে মান্য করার ও মান্য করে নিজেকে ধন্য করার বাস্তবরূপ মাত্র। প্রভুর এমন অন্ধত্ব তাঁকে তাই ক্ষুব্ধ করে না। প্রভুকন্যার পীড়নে স্বামীর ভিটা থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েও তাই রোকেয়া প্রভুর প্রদর্শিত পথ থেকে একচুল বিচ্যুত হয় না। তাঁর এই মর্ষকামিতা ও স্বেচ্ছাদাসীত্বকে অচিরেই পুরস্কৃত করা হয়। তাঁর স্তব রচনা করে পুরুষতন্ত্র এভাবেঃ তাহার অসামান্য এবং পতিব্রতা পত্নী স্বামীর সেই ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্যে কলিকাতায় বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা করিয়া পবিত্রাত্মা স্বর্গীয় সাখাওয়াতের স্মৃতির পূজা করিতেছেন। রোকেয়ার স্কুল চালনা প্রকৃত অর্থেই স্বর্গীয় প্রভুর স্মৃতির পূজা ছাড়া আর কিছু নয়"। - আকিমুন নাহার 

 

রোকেয়া শেকল মুক্তির লড়াইরত লড়াকু মানুষ নন, যদিও তাঁর রচনাবলী পাঠে জাগে অমনই বিভ্রম। রোকেয়া পাথর চাপা ঘাস বা স্বামীর ছাঁচে বিকশিত এক পরিতৃপ্ত বেগম, এখন নারী মুক্তির অগ্রদূত বলে যে পেয়েছে ভুল প্রসিদ্ধি।  - - আকিমুন নাহার

"কন্যাকে এরূপ শিক্ষা দেওয়া হয় না, যাহাতে সে স্বামীর ছায়াতুল্য সহচরী হইতে পারে। প্রভুদের বিদ্যার গতির সীমা নাই, স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সচরাচর বোধোদয় পর্যন্ত"। বেগম রোকেয়ার এই উদ্ধৃতি উল্লেখ করে ফরিদ আহমেদ লিখেছেন,
নারী জাগরণের অগ্রদূতের কী চমৎকার কথাবার্তা! স্বামীও নয়, একেবারে প্রভুই বলছেন আর দাসীদের সবক দিয়ে চলেছেন প্রভুর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে। এর পরেও যদি বাংলাদেশের কোনো নারী রোকেয়ার হয়ে সাফাই গায় তবে তাঁকে পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ বিভ্রান্ত নারী ছাড়া আর কি কিছু বলা যায়? এ কারণেই পুরুষতন্ত্রের অত্যন্ত পছন্দের রমণী এই রোকেয়া। রোকেয়ার মাধ্যমেই নারীকে মানসিকভাবে দাসী বানিয়ে রাখা সম্ভব।

এহেন বেগম রোকেয়া সম্পর্কে আমার মনোভাব কি? আমি কিভাবে দেখি? আমতা আমতা করে যে, বলবো, ঐ সময়ের ও ঐ যুগের তুলনায় বেগম রোকেয়া অনেক এগিয়ে ছিলেন, সেটারও জবাব দেয়া হয়েছে মুক্তমনার ঐ পোস্টে এবং তার কমেন্টে! ইউরোপ – আমেরিকা- রাশিয়ার নারীবাদীরা যে আরো কত আগে কত এগিয়ে ছিল- সেই বিবরণ এসেছে! বেগম রোকেয়ার জন্মের আগে বাংলায় এগিয়ে থাকা নারীদের তালিকাও কমেন্টগুলোতে এসছে! চন্দ্রমুখী বসু, কাদম্বিনী বসু, হেমপ্রভা বসু, বামাসুন্দরী দেবী, সরলা দেবী প্রমুখের নাম এসেছে, ১৯০০ সালের মধ্যেই ২৭ জন নারী বি এ পাশ করেছেন- সেটাও এসেছে।

এরপরেও কি বেগম রোকেয়াকে বর্জন করবো না? তারপরেও পারছি না। বেগম রোকেয়া আমার চোখে বাংলার মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ। পিছিয়ে পড়া মুসলিম নারীদের জাগরণে তার অবদান ভীষণ। সেই অর্থে মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ। মোটেও ইসলামিস্ট ফেমিনিস্ট নন। ঐ সময়ের ইসলামী রক্তচক্ষুকে সহ্য করেই তাকে এগুতে হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তিনি আপোস করেছেন বা আপোস করতে বাধ্য হয়েছে- মূল লক্ষকে এগিয়ে নিতে, কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে- সেখানেও তার নিজের অবস্থানকে তুলে ধরতে পিছপা হননি এবং অন্যত্র ঠিক ভিন্ন রকম বা র‍্যাডিকাল বক্তব্যও দিয়েছেন।

ইতঃপূর্ব্বে আমি “স্ত্রীজাতির অবনতি” প্রবন্ধে আমাদের প্রকৃত অবস্থার চিত্র দেখাইতে প্রয়াস পাইয়াছি কিন্তু সত্য কথা সর্ব্বদাই কিঞ্চিৎ শ্রুতিকটু বলিয়া অনেকে উহা পছন্দ করেন নাই।


যাহা হউক আধ্যাত্মিক সমকতার ভাষা যদি স্ত্রীলোকেরা না বুঝেন, তবে উচ্চ আকাঙ্খা বা উচ্চভাবের কথায় কাজ নাই। আজি আমি জিজ্ঞাসা করি, আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য কি? বোধ হয় আপনারা সমস্বরে বলিবেনঃ
“সুগৃহিণী হওয়া”

বেশ কথা। আশা করি আপনারা সকলেই সুগৃহিণী হইতে ইচ্ছা করেন, এবং সুগৃহিণী হইতে হইলে যে যে গুণের আবশ্যক, তাহা শিক্ষা করিতে যথাসাধ্য চেষ্টাও করিয়া থাকেন। কিন্তু আজ পর্য্যন্ত আপনাদের অনেকেই প্রকৃত সুগৃহিণী হইতে পারেন নাই। কারণ আমাদের বিশেষ জ্ঞানের আবশ্যক, তাহা আমরা লাভ করিতে পারি না। সমাজ আমাদের উচ্চশিক্ষা লাভ করা অনাবশ্যক মনে করেন। পুরুষ বিদ্যালাভ করেন অন্ন উপার্জ্জনের আশায়, আমরা বিদ্যালাভ করিব কিসের আশায়? অনেকের মত আমাদের বুদ্ধি বিবেচনার প্রয়োজন নাই। যেহেতু আমাদিগকে অন্নচিন্তা করিতে হয় না, সম্পত্তি রক্ষার্থে মোকদ্দমা করিতে হয় না, চাকরীলাভের জন্য সার্টিফিকেট ভিক্ষা করিতে হয় না, “নবাব” “রাজা” উপাধিলাভের জন্য স্বেতাঙ্গ প্রভুদের খোসামোদ করিতে হয় না, কিংবা কোন সময়ে দেশরক্ষার্থে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে হইবে না। তবে আমরা উচ্চশিক্ষা লাভ (অথবা Mental culture) করিব কিসের জন্য? আমি বলি, সুগৃহিণী হওয়ার নিমিত্তই সুশিক্ষা (Mental culture) আবশ্যক।
 

 

যদি সুগৃহিণী হওয়া আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে স্ত্রীলোকের জন্য সুশিক্ষার আয়োজন করিবেন।

যাহোক, প্রথম যে- কোটেশন, অবরোধ প্রথার পক্ষে রোকেয়ার একটি প্রবন্ধকে সামনে এনে সকলে যেভাবে রোকেয়াকে একদম শিবির, তালেবান বানানোর কাজ হলো- তাতে মনটি বেশ খারাপ হলো! বেগম রোকেয়াকে কি আমরা হৃদয় দিয়ে পাঠ করেছি? অনুভবে নেয়ার চেস্টা করেছি? অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে তার যে কি ভয়ানক সংগ্রাম ছিল, অবরোধবাসিনীদের প্রতি কি রকম মমত্ব, করুণা, এই প্রথার বিরুদ্ধে কি রকম যে শ্লেষ তিনি ফিল করতেন- সেটা আমার মুক্তমনা বন্ধুরা কেউ বুঝতে পারলো না! অবাকই লাগে! একটি আস্ত বই লিখেছিলেন- বেগম রোকেয়া। নাম অবরোধবাসিনী। সেখানে ৪৭ টি ঘটনায় বিবৃত করেছেন- তার আশেপাশের অবরোধবাসিনীর অবস্থা! তারা তার ঐ সময়ের মুসলিম নারী, তার পরিচিত, আত্মীয়, ছাত্রী, শিক্ষিকা ...। বইটা ওনারা পড়েছেন কি না জানি না, কেননা মনে হয়েছ, এই বইটা অন্তত পড়লে- গড়েবড়ে সবাই ইউরোপ আমেরিকা রাশিয়ার নারীদের, বাংলার হিন্দুসমাজের নারীদের নাম ওভাবে কেউ দিতে যেত না ...। যে হিন্দু নারীদের কথা বলা হলো- সেটার জমিন তৈরি করেছিল- কথিত বাংলার রেনেসাঁস, বিদ্যাসাগর- রামমোহন প্রমুখ পুরুষ অগ্রদূতদের হাত ধরে, ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠিত নারী স্কুলগুলোর হাত ধরে, বিদ্যানুরাগী জমিদারদের হাত ধরে- বেগম রোকেয়ার জন্মের আগেই যেসমস্ত নারী বিএ এমএ পাশ করলো, ডাক্তার হলো, স্কুল প্রতিষ্ঠা করলো- তাদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই; কিন্তু কোন নারী এককভাবে একক চেস্টায় একটা সমাজে প্রথম এই বাতি জ্বালালেন? মুসলিম সমাজে মাথার উপরে রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মত কে ছিল? কোন জমিদার ছিল? মুসলিম সমাজে যত আশরাফ- তত বেশি নারীর কথিত কৌলিন্য ও সম্মান রক্ষার নামে তাদের অন্দর মহলে ঢুকিয়ে রাখার আয়োজন কি ছিল না? 

যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমতঃ যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগন …… ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।

 

 

অবরোধবাসিনীর ভূমিকা থেকেই কোট করছিঃ  

"আমরা বহু কাল হইতে অবরোধ থাকিয়া থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের-বিশেষতঃ আমার কিছুই নাই। মেছোণীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, “পচা মাছের দুর্গন্ধ ভাল না মন্দ?”-সে কি উত্তর দিবে? এস্থলে আমাদের ব্যক্তিগত কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা পাঠিকা ভগিনীদেরকে উপহার দিব-আশা করি, তাঁহাদের ভাল লাগিবে। এস্থলে বলিয়া রাখা আবশ্যক যে গোটা ভারতবর্ষে কুলবালাদের অবরোধ কেবল পুরুষের বিরুদ্ধে নহে, মেয়েমানুষদের বিরুদ্ধেও। অবিবাহিতা বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ীর চাকরাণী ব্যতীত অপর কোন স্ত্রীলোকে দেখিতে পায় না। বিবাহিতা নারীগণও বাজীকর-ভানুমতী ইত্যাদি তামাসাওয়ালী স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে পর্দ্দা করিয়া থাকেন। যিনি যত বেশী পর্দ্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশী পেঁচকের মত লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশী শরীফ। শহরবাসিনী বিবিরাও মিশনারী মেমদের দেখিলে ছুটাছুটি করিয়া পলায়ন করেন। মেম ত মেম-সাড়ী পরিহিতা খ্রীষ্টান বা বাঙ্গালী স্ত্রীলোক দেখিলেও তাঁহারা কামরায় গিয়া অর্গল বন্ধ করেন"।  

ফলে, অবরোধ প্রথাকে উন্নতির অন্তরায় না বলা বেগম রোকেয়াই আস্ত একটি বই লিখেছেন- ভগিনীদিগকে এটা দেখাতে যে- এই অবরোধ প্রথায় অভ্যস্ততা পচা মাছের ভীড়ে থাকা মেছোনির মতই! ৪৭ টির মধ্যে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা যাকঃ

** আজিকার (২৮ শে জুন ১৯২৯) ঘটনা শুনুন। স্কুলের একটী মেয়ের বাপ লম্বা চওড়া চিঠি লিখিয়াছেন যে, মোটর বাস তাঁহার গলির ভিতর যায় না বলিয়া তাঁহার মেয়েকে “বোরকা” পড়িয়া মামার (চাকরাণীর) সহিত হাঁটিয়া বাড়ী আসিতে হয়। গতকলা গলিতে এক ব্যক্তি চায়ের পাত্র হাতে লইয়া যাইতেছিল, তাহার ধাক্কা লাগিয়া হীরার (তাঁহার মেয়ের) কাপড়ে চা পড়িয়া গিয়া কাপড় নষ্ট হইয়াছে। আমি চিঠিখানা আমাদে জনৈকা শিক্ষয়িত্রীর হাতে দিয়া ইহার তদন্ত করিতে বলিলাম। তিনি ফিরিয়া আসিয়া উর্দ্দু ভাষায় যাহা বলিলেন, তাহার অনুবাদ এইঃ “অনুসন্ধানে জানিলাম হীরার বোরকায় চক্ষু নাই। (হীরাকে বোরকা মে আঁখ নেহী হায়)! অন্য মেয়েরা বলিল, তাহারা গাড়ী হইতে দেখে, মামা প্রায় হীরাকে কোলের নিকট লইয়া হাঁটাইয়া লইয়া যায়। বোরকায় চক্ষু না থাকায় হীরা ঠিকমত হাঁটিতে পারে না-সেদিন একটা বিড়ালের গায়ে পড়িয়া গিয়াছিল,-কখনও হোঁচট খায়। গতকল্য হীরাই সে চায়ের পাত্রবাহী লোকের গায়ে ধাক্কা দিয়া তাহার চা ফেলিয়া দিয়াছে।”* দেখুন দেখি, হীরার বয়স মাত্র ৯ বৎসর-এতটুকু বালিকাকে “অন্ধ বোরকা” পরিয়া পথ চলিতে হইবে! ইহা না করিলে অবরোধের সন্মান রক্ষা হয় না!

** প্রায় ২১/২২ বৎসর পূর্ব্বেকাল ঘটনা। আমার দূর-সম্পর্কীয়া এক মামীশাশুড়ী ভাগলপুল হইতে পাটনা যাইতেছিলেন; সঙ্গে মাত্র একজন পরিচারিকা ছিল। কিউল ষ্টেশনে ট্রেণ বদল করিতে হয়। মামানী সাহেবা অপর ট্রেণে উঠিবার সময় তাঁহার প্রকাণ্ড বোরকায় জড়াইয়া ট্রেণ ও প্লাটফরমের মাঝখানে পড়িয়া গেলেন। ষ্টেশনে সে সময় মামানীর চাকরাণী ছাড়া অপর কোন স্ত্রীলোক ছিল না। কুলিরা তাড়াতাড়ি তাঁহাকে ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হওয়ায় চাকরাণী দোহাই দিয়া নিষেধ করিল-“খবরদার! কেহ বিবি সাহেবার গায়ে হাত দিও না।” সে একা অনেক টানাটানি করিয়া কিছুতেই তাঁহাকে তুলিতে পারিল না। প্রায় আধ ঘন্টা পর্য্যন্ত অপেক্ষা করার পর ট্রেণ ছাড়িয়া দিল! ট্রেণের সংঘর্ষে মামানী সাহেবা পিষিয়া ভিন্নভিন্ন হইয়া গেলেন,-কোথায় তাঁহার “বোরকা”-আর কোথায় তিনি! ষ্টেশন ভরা লোক সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়া এই লোমহর্ষক ব্যাপার দেখিল,-কেহ তাঁহার সাহায্য করিতে অনুমতি পাইল না। পরে তাঁহার চুর্ণপ্রায় দেহ একটা গুদামে রাখা হইল; তাঁহার চাকরাণী প্রাণপণে বিনাইয়া কাঁদিল, আর তাঁহাকে বাতাস করিতে থাকিল। এই অবস্থায় ১১ (এগার) ঘণ্টা অতিবাহিত হইবার পর তিনি দেহত্যাগ করিলেন! কি ভীষণ মৃত্যু!

** “এগারো বৎসর বয়সে তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল। শ্বশুরবাড়ী গিয়া তাঁহাকে এক নির্জ্জন কক্ষে থাকিতে হইত। তাঁহার এক ছোট ননদ দিনে তিন চার বার আসিয়া তাঁহাকে প্রয়োজন মত বাথ-রুমে পৌঁছাইয়া দিত। একদিন কি কারণে সে অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত তাঁহার সংবাদ লয় নাই। এদিকে বেচারী প্রকৃতির তাড়নায় অধীরা হইয়া পড়িলেন। লক্ষ্ণৌ-এ মেয়েকে বড় বড় তামার পানদান যৌতুক দেওয়া হয়। তাঁহার মস্ত পানদানটা সেই কক্ষেই ছিল। তিনি পানদান খুলিয়া সুপারীর ডিবেটা বাহির করিয়া সুপারীগুলি একটা রুমালে ঢালিয়া ফেলিলেন। পরে তিনি সেই ডিবেটা যে জিনিষ দ্বারা পূর্ণ করিয়া খাটের নীচে রাখিলেন, তাহা লিখিতব্য নহে! সন্ধ্যার সময় তাঁহার পিত্রালয়ের চাকরাণী বিছানা বাড়িতে আসিলে তিনি তাহার গলা ধরিয়া কাঁদিয়া ডিবের দুর্দ্দশার কথা বলিলেন। সে তাঁহাকে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, “থাক, তুমি কেঁদ না; আমি কালই ডিবেটা কালাই করাইয়া আনিয়া দিব। সুপারী এখন রুমালের বাঁধা থাকুক।”

** এক বাড়ীতে আগুন লাগিয়াছিল। গৃহিণী বুদ্ধি করিয়া তাড়াতাড়ি সমস্ত অলঙ্কার একটা হাত বাক্সে পূরিয়া লইয়া ঘরের বাহির হইলেন। দ্বারে আসিয়া দেখিলেন সমাগত পুরুষেরা আগুন নিবাইতেছে। তিনি তাহাদের সম্মুখে বাহির না হইয়া অলঙ্কারের বাক্সটী হাতে করিয়া ঘরের ভিতর খাটের নীচে গিয়া বসিলেন। তদবস্থায় পুড়িয়া মরিলেন, কিন্তু পুরুষের সম্মুখে বাহির হইলেন না। ধন্য! কুল-কামিনীর অবরোধ!

** গত ১৯২৪ সনে আমি আরায় গিয়াছিলাম। আমার দুই নাতিনীর বিবাহ এক সঙ্গে হইতেছিল, সেই বিবাহের নিমন্ত্রণে গিয়াছিলাম। নাতিনীদের ডাক নাম মজু ও সবু। বেচারীরা তখন “মাইয়াখানায়” ছিল। কলিকাতায় ত বিবাহের মাত্র ৫/৬ দিন পূর্ব্বে “মাইয়াখানা” নামক বন্দীখানায় মেয়েকে রাখে। কিন্তু বেহার অঞ্চলে ৬/৭ মাস পর্য্যন্ত এইরূপ নির্জ্জন কারাবাসে রাখিয়া মেয়েদের আধমরা করে। আমি মজুর জেলখানায় গিয়া অধিকক্ষণ বসিতে পারি না-সে রুদ্ধ গৃহে আমার দম আটকাইয়া আসে। শেষে এক দিন একটা জানালা একটু খুলিয়া দিলাম। দুই মিনিট পরেই এক মাতব্বর বিবি, “দুলহিনকো হাওয়া লাগেগী” বলিয়া জানালা বন্ধ করিয়া দিলেন। আমি আর তিষ্ঠিতে না পারিয়া উঠিয়া আসিলাম। আমি সবুদের জেলখানায় গিয়া মোটেই বসিতে পারিতাম না। কিন্তু সে বেচারীর ছয় মাস হইতে সেই রুদ্ধ কারাগারে ছিল। শেষে সবুর হিষ্টিরিয়া রোগ হইয়া গেল। এইরূপে আমাদের অবরোধে বাস করিতে অভ্যস্ত করা হয়।

** সমাজ আমাদিগকে কেবল অবরোধ-কারাগারে বন্ধ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই। হজরতা আয়শা সিদ্দিকা নাকি ৯ বৎসর বয়সে বয়োপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন; সেই জন্য সম্ভ্রান্ত মুসলমানের ঘরের বালিকার বয়স আট বৎসর পার হইলেই তাহাদের উচ্চহাস্য করা নিষেধ, উচ্চৈস্বরে কথা বলা নিষেধ, দৌড়ান লাফান ইত্যাদি সবই নিষেধ। এক কথায়, তাহার নড়াচড়াও নিষেধ। সে গৃহকোণে মাথা গুঁজিয়া বসিয়া কেবল সূচি-কর্ম্ম করিতে থাকিবে,-নড়িবে না। এমনকি দ্রুতগতি হাঁটিবেও না।

কোন এক সম্ভ্রান্ত ঘরের একটি আট বৎসরের বালিকা একদিন উঠানে আসিয়া দেখিল, রান্নাঘরের চালে ঠেকান ছোট মই আছে। তাহেরা (সেই বালিকা)র মনে কি হইল, সে অন্যমনস্ড়্গভাবে ঐ মইয়ের দুই ধাপ উঠিল। ঠিক সেই সময় তাহার পিতা সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি কন্যাকে মইয়ের উপর দেখিয়া দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া তাহার হাত ধরিয়া এক হেঁচকা টানে নামাইয়া দিলেন। তাহেরা পিতার অতি আদরের একমাত্র কন্যা,-পিতার আদর ব্যতীত অনাদর কখনও লাভ করে নাই; কখনও পিতার অপ্রসন্ন মুখ দেখে নাই। অদ্য পিতার রুদ্রমূর্ত্তি দেখিয়া ও রূঢ় হেঁচকা টানে সে এত অধিক ভয় পাইল যে কাঁপিতে কাঁপিতে বে-সামাল হইয়া কাপড় নষ্ট করিয়া ফেলিল! অ-বেলায় স্নান করাইয়া দেওয়া হইল বলিয়া এবং অত্যধিক ভয়ে বিহবল হইয়াছিল বলিয়া সেই রাত্রে তাহেরার জ্বর হইল।

একে বড় ঘরের মেয়ে, তায় আবার অতি আদরের মেয়ে, সুতরাং চিকিৎসার ক্রটি হয় নাই। সুদূর সদর জেলা হইতে সিভিল সার্জ্জন ডাক্তার আনা হইল। সেকালে (অর্থাৎ ৪০/৫০ বৎসর পূর্ব্বে) ডাক্তার ডাকা সহজ ব্যাপার ছিল না। ডাক্তার সাহেবের চতুর্গুণ দর্শনী, পাল্কী ভাড়া, তদুপরি বত্রিশজন বেহারার সিধা ও পান তামাক যোগান-সে এক বিরাট ব্যাপার। এত যত্ন সত্ত্বেও তৃতীয় দিনেও তাহেরার জ্বর ত্যাগ হইল না। ডাক্তার সাহেব বে-গতিক দেখিয়া বিদায় হইলেন। পিতার রূঢ় ব্যবহারের নিষ্ঠুর প্রত্যুত্তর দিয়া তাহেরা চিরমুক্তি লাভ করিল!

পারলে ৪৭ টি ঘটনাই এখানে কপি করে দিতাম। পড়তে পড়তে অনেক অনেকবার চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়েছে। কোন সমাজে বসে তিনি কি করছেন, কি সংগ্রাম করে গিয়েছেন- এটা যে অনুভব না করবে- তার কাছে আজকের সমাজের সাথে তুলনা আসবে (ফরিদ আহমেদ বলেছেন- আমাদের গীতাদি আর তসলিমা নাসরিনের সামনে বেগম রোকেয়ার ঐ বানী পড়লে যে কি হইতো!), কেউবা ঐ আমলের ইউরোপ- আমেরিকা- রাশিয়ার নারীরা, বিপ্লবীরা কি করছে সেই ফিরিস্তি দিবে, এবং কেউবা এই বাংলার হিন্দু সমাজের এগিয়ে থাকা নারীদের গল্প শুনাবেন! যাহোক, যে নারী স্কুল হয়ে উঠেছিল বেগম রোকেয়া সমস্ত সংগ্রামের স্থল- সেটার অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করেছেন- এই অবরোধবাসিনী। সেটা একটু উল্লেখ করিঃ

প্রায় তিন বৎসরের ঘটনা, আমাদের প্রথম মোটর বাস প্রস্তুত হইল। পূর্ব্বদিন আমাদের স্কুলের জনৈকা শিক্ষয়িত্রী, মেম সাহেবা মিস্ত্রীখানায় গিয়া বাস দেখিয়া আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, মোটর ভয়ানক অন্ধকার···“না বাবা! আমি কখনও মোটরে যা’ব না।” বাস আসিয়া পৌঁছিলে দেখা গেল,-বাসের পশ্চাতের দ্বারের উপর সামান্য একটু জাল আছে এবং সম্মুখ দিকে ও উপরে একটু জাল আছে। এই তিন ইঞ্চি চওড়া ও দেড় ফুট লম্বা জাল দুই টুকরা না থাকিলে বাসখানাকে সম্পূর্ণ “এয়ার টাইট” বলা যাইতে পারিত।

প্রথম দিন ছাত্রীদের নূতন মোটরে বাড়ী পৌঁছান হইল। চাকরাণী ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল-গাড়ী বড্ড গরম হয়,-মেয়েরা বাড়ী যাইবার পথে অস্থির হইয়াছিল। কেহ কেহ বমি করিযাছিল। ছোট মেয়েরা অন্ধকারে ভয় পাইয়া কাঁদিয়াছিল।

দ্বিতীয় দিন ছাত্রী আনাইবার জন্য মোটর পাঠাইবার সময় উপরোক্তা মেম সাহেবা মোটরের দ্বারের খড়খড়িটা নামাইয়া দিয়া একটা রঙীন কাপড়ের পর্দ্দা ঝুলাইয়া দিলেন। তথাপি ছাত্রীগণ স্কুলে আসিলে দেখা গেল,-দুই তিন জন অজ্ঞান হইয়াছে, দুই চারিজনে বমি করিয়াছে, কয়েক জনের মাথা ধরিয়াছে, ইত্যাদি। অপরাহ্নে মেম সাহেবা বাসের দুই পাশের দুইটী কড়খড়ি নামাইয়া দুই খণ্ড কাপড়ের পর্দ্দা দিলেন। এইরূপে তাহাদের বাড়ী পাঠাইয়া দেওয়া গেল। 

সেই দিন সন্ধ্যায় আমার এক পুরাতন বন্ধু মিসেস মুখার্জ্জি আমার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। স্কুলের বিবিধ উন্নতির সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করিয়া বলিলেন,-“আপনাদের মোটরবাস ত বেশ সুন্দর হয়েছে। প্রথমে রাস্তায় দেখে আমি মনে করেছি যে আলমারী যাচ্ছে না কি-চারিদিকে একেবারে বন্ধ, তাই বড় আলমারী বলে ভ্রম হয়! আমার ভাইপো এসে বলেল, “ও পিসীমা! দেখ, সে Moving Black Hole (চলন্ত অন্ধকূপ) যাচ্ছে।” তাই ত, ওর ভিতর মেয়েরা বসে কি করে?”

তৃতীয় দিন অপরাহ্নে চারি পাঁচ জন ছাত্রীর মাতা দেখা করিতে আসিয়া বলিলেন, “আপকা মোটর ত খোদা কা পানাহ! আপ লাড়কীয়োঁ কো জীতে জী ক্ববর মে ভয় রহি হয়ঁ।” আমি নিতান্ত অসহায়ভাবে বলিলাম, “কি করি, এরূপ না হইলে ত আপনারাই বলিতেন, “বেপর্দ্দা গাড়ী।” তাঁহারা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, ‘তব কেয়া আপন জান মারকে পর্দ্দা করেঙ্গী? কালসে হামারী লাড়কীয়াঁ স্কুল নেহী আয়েঙ্গী।” সে দিনও দুই তিনটী বালিকা অজ্ঞান হইয়াছিল। প্রত্যেক বাড়ী হইতে চাকরাণীর মারফতে ফরিয়াদ আসিয়াছিল যে, তাহার আর মোটর বাসে আসিবে না।

সন্ধ্যার পর চারিখানা ঠিকানারহিত ডাকের চিঠি পাইলাম। ইংরাজী চিঠির লেখক স্বাক্ষর করিয়াছেন, “Muslim Brotherhood” বাকী তিনখানা উর্দ্দু ছিল-দুইখানা বেনামী আর চতুর্থখানায় পাঁচজনের স্বাক্ষর ছিল। সকল পত্রেরই বিষয় একই-সকলেই দয়া করিয়া আমাদের স্কুলের কল্যাণ কামনায় লিখিয়াছেন যে, মোটরের দুই পার্শ্বে যে পর্দ্দা দেওয়া হইয়াছে, তাহা বাতাসে উড়িয়া গাড়ী বে-পর্দ্দা করে। যদি আগামীকল্য পর্য্যন্ত মোটরে ভাল পর্দ্দার ব্যবস্থা না করা যায়, তবে তাঁহারা তাতোধিক দয়া করিয়া “খবিছ” “পলীদ” প্রভৃতি উর্দ্দু দৈনিক পত্রিকায় স্কুলের কুৎসা রটনা করিবেন এবং দেখিয়া লইবেন, এরূপ বে-পর্দ্দা গাড়ীতে কি করিয়া মেয়েরা আসে। এ তো ভারী বিপদ,-
“না ধরিলে রাজা বধে,-ধরিলে ভুজঙ্গ!”
রাজার আদেশে এমন করিয়া আর কেহ বোধ হয় জীবন্ত সাপ ধরে নাই!

অবরোধ-বন্দিনীদের পক্ষে বলিতে ইচ্ছা করিল,-
“কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে,
কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নশীন ঘরে!”

যে অবরোধ প্রথাকে বেগম রোকেয়া উন্নতির জন্যে মোটেও অন্তরায় বলছেন না- সেই অবরোধ প্রথার ঘরে কেন জন্ম হলো- তা নিয়ে খেদ করছেন! অবাক না? 

 [৫ মে ২০২১ তারিখে লিখিত ফেসবুক নোটের ঈষৎ পরিবর্তিত ও বর্ধিত সংস্করণ।]