রবিবার, ২৫ জুলাই, ২০২১

ইসলামবিদ্বেষী ???

 একঃ "ব্লগের নাস্তিকেরা কি কেবল ইসলাম বিদ্বেষী"?

"ব্লগের নাস্তিকেরা কি কেবল ইসলাম বিদ্বেষী"???

মাঝে মাঝেই এই প্রশ্ন পাওয়া যায়। ঠিক প্রশ্ন নয়, অনেকটা অভিযোগ আকারে এটি বলেন অনেকে, কেউ কেউ তো প্রচণ্ড রাগ-ক্ষোভও ঝেড়ে দেন। যেমন সেদিন আমার এক পোস্টে ব্লগার সাইফুর বললেন, 
"নাস্তিক ভাই অন্য ধর্ম নিয়েও এরকম পোষ্ট দিন দয়া করে"। 
 
একই পোস্টে ব্লগার ‘কে আমি’ বললেন,  
"নাস্তিকের ধর্মকথা আর এই ব্লগের অনান্য নাস্তিকদের একটা বিনম্র প্রশ্ন: আপনাদের সব লেখাগুলোই ইসলাম কেন্দ্রিক: পৃথিবীর অন্য ২টা ধর্ম: খৃষ্টান আর ইহূদিজম আর সবচেয়ে পুরাতন ধর্ম সনাতন (হিন্দু) ধর্মকে কি ধর্ম মনে হয় না? নাস্তিক হলে তো সব ধর্ম নামের ভন্ডামির বিপক্ষেই চিন্তা আর অবস্থান থাকার কথা!! তাহলে কি আপনারা ইসলামকেই একমাত্র ধর্ম মেনে নিচ্ছেন না???" 
 
এমন অভিযোগ অনেক আগে ফারজানা১৬ তার এক পোস্টেও করেছিলেন, 
"নাস্তিক, এবার এই পোস্টের বিষয়ের বাইরে আপনাকে একটা প্রশ্ন আছে। আপনার নিক অনুযায়ী আপনি নাস্তিক, তাই ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করছেন ভাল কথা। হয়ত আপনি জানতে চাচ্ছেন, মানলাম। কিন্তু আপনিতো নাস্তিক হলে সব ধর্ম নিয়ে নাস্তিক হওয়ার কথা। এখন আপনার সব পোস্ট দেখি শুধু ইসলাম, মুসলিম আর কোরআন নিয়ে। এ থেকে দু’টা সন্দেহ দেখা দেয়-

১- আপনার কাছে একমাত্র সত্যিকার ধর্ম ইসলাম। তাই শুধু ইসলাম নিয়েই জানতে চাচ্ছেন।
২- অথবা, আপনি মোটেও নাস্তিক নন। আপনি শুধু ইসলাম-নাস্তিক। অর্থাৎ, আপনি অন্য কোনো ধর্মালম্বী, তাই ইসলামকে ভুল প্রমান করতে চান।  
৩- অথবা, আপনার পোস্টগুলো সম্পূর্ণভাবে উদ্দেশ্যমূলক, শুধুমাত্র ইসলাম নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোই উদ্দেশ্য"।  
আরো অনেকেই এইরকম অভিযোগ করেন মাঝে মধ্যেই। এসব বিষয়ে দুচারটি কথা তাহলে বলি। 
 
প্রথমেই আমার কৈফিয়াৎঃ
 
১। আমি শুধু ইসলাম-নাস্তিক নই।
 
২। আমি ইসলাম-বিদ্বেষী তো নই-ই, কোন ধর্ম বিদ্বেষীও নই, অর্থাৎ কোন ধর্ম বা ধর্মমতের বিরুদ্ধে কোন রকম বিদ্বেষ আমি পোষণ করি না। তবে, এ সমস্ত ধর্মদর্শনকে ভ্রান্ত দর্শন বলে মনে করি, যদিও এসব ধর্মসমূহের উন্মেষকালীন কিছু ইতিবাচক অবদানকে অস্বীকার করি না।
 
৩। আমার ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম-দর্শন নিয়েও পোস্ট বা আলোচনা আছে। যেমনঃ আমার "নাস্তিক আস্তিক সমাচার" পোস্টে ভারতীয় বিভিন্ন দার্শনিকেরা কিকরে ব্রহ্মার ধারণাকে নাকচ করেছিলেন- সে আলোচনা করেছি। আমার "বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর.." পোস্টে এক জায়গায় আলোচনায় রামকে নিয়েও সমালোচনা করেছি (যুদ্ধনীতির ক্ষেত্রে তাঁকে আমার কাপুরুষ মনে হয়েছে)। "ধর্মে বিজ্ঞানঃ নিম গাছে আমের সন্ধান" শীর্ষক পোস্টে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থের মাঝে বিজ্ঞান খোঁজা সংক্রান্ত আলাপেরও সমালোচনা করেছি, ... ইত্যাদি।
 
৪। আমি ধর্মতত্ত্ব-দর্শন-ইতিহাস-বিজ্ঞান নিয়ে খুবই আগ্রহ বোধ করি এবং যথাসাধ্য পড়ার চেষ্টা করি। এ কারণেই আমার পোস্টগুলোতে ঘুরে-ফিরে এ বিষয়গুলো আসে।
 
৫। এটা ঠিক যে, আমার পোস্টসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, অন্য ধর্মের তুলনায় ইসলাম নিয়ে আলোচনা তুলনামূলক বেশী করেছি। এর কারণ সম্ভবত এরকমঃ
 
 
ক) মুসলিম পরিবারে জন্ম সুবাদে ইসলাম সম্পর্কেই তুলনামূলক বেশী জানি, এবং আস্তিক অবস্থান থেকে যখন নাস্তিক হই তখন ইসলামকে খণ্ডন করেই নাস্তিক হতে হয়েছে। ফলে, এই যুক্তিগুলোই ভালো জানি।
 
খ) আমার চারপাশের মানুষগুলোর মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা বেশী, ফলে তাদের সাথে যখন ধর্ম-দর্শন নিয়ে কথা হয়, ইসলাম-ই বেশীর ভাগ সময় আলোচনার কেন্দ্রে থাকে। কেননা, একজন মুসলিমের সাথে শিব-ব্রহ্মা-নারায়ন প্রমুখকে নিয়ে আলোচনা করলে তার প্রতিক্রিয়া হয় সমর্থনমূলক, যদিও সেই সমর্থনমূলক অবস্থান তার মুক্তচিন্তাকে প্রকাশ করে না। 
 
গ) এই ব্লগেও অধিকাংশ ব্লগার মুসলিম পরিবারের। সেকারণে, এখানে ইসলাম নিয়েই তর্ক-বিতর্ক হওয়া সম্ভব। আমার অন্য ধর্মের সমালোচনামূলক পোস্টগুলোতে সেইসব ধর্মালম্বী কাউকে তর্ক করতে দেখিনা এবং সেগুলো সাধারণত মুসলিম ব্লগারদেরও চোখের অন্তরালে তা চলে গিয়েছে। অথচ, ইসলাম নিয়ে কোন কিছু বললেই আশেপাশের মুসলিম ব্লগাররা যেভাবে ঝাপিয়ে পড়ে- তাতে সেই ব্যাপারটি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে- তর্ক বিতর্কের ফলে। 
 
ঘ) ভারতের বা পশ্চিমবঙ্গের কোন ব্লগে লিখলে (যেখানকার ব্লগাররা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ) নিশ্চিৎভাবেই হিন্দু-ধর্ম নিয়ে বেশী আলোচনা করতাম। কেননা, সেখানে ইসলাম নিয়ে আলোচনা করা মানে সেখানকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সাম্প্রদায়িকতাকেই সুড়সুড়ি দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ হতো না! তেমনি এখানে অন্য ধর্ম নিয়ে বেশী আলোচনা করলে মুসলিম ব্লগারদের সাম্প্রদায়িক চেতনাকে আরো উসকে দেয়ার কাজই হবে বলে মনে হয়! 
 
ঙ) আমার পোস্ট গুলো দেখলে বুঝবেন, অধিকাংশ পোস্টই বিভিন্ন পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় লেখা। এখানে (সামু ব্লগে) ইসলাম নিয়ে যে ধরণের আজে বাজে পোস্ট পড়ে, সেগুলোকে খণ্ডন করতে গিয়েই আমার অনেক পোস্ট অবতারণা করতে হয়। অন্য ধর্মকে নিয়ে যদি এরকম পোস্টের সংখ্যা বেড়ে যায়- তবে সেগুলো নিয়েও আমি লিখবো বৈকি..
 
আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।
 
[প্রথম প্রকাশঃ সামু ব্লগ, তারিখ: ০৪ , ২০০৮ ]
 
দুইঃ  ইসলাম-ই কি সব নাস্তিকের শত্রু?
 
ফেসবুকে আমার কোন এক পোস্টের নীচে এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করেছিলেন, "ভাই, আমি আজ পর্যন্ত একজন নাস্তিক দেখলাম না যে ইসলাম বাদ দিয়ে অন্য কোন ধর্মের সমালোচনা বা কটুক্তি করে ... ইসলাম-ই কি সব নাস্তিকের শত্রু? নাস্তিকদের প্রথম টার্গেট থাকে ইসলাম - এটা যখনই বিভিন্ন নাস্তিক পেজগুলোতে দেখি, তখনই নিজের ধর্মের প্রতি আস্থা চলে আসে। নিঃসন্দেহে ইসলাম ধর্মই সত্য, নাইলে ইসলামের এত শত্রু কেন?" 
 
 
এই প্রশ্নের জবাবে বলবো এর কারণ, -
প্রথমত- আপনি নিজে মুসলমান এবং ইসলাম ধর্মের সমালোচনামূলক লেখাই আপনার চোখে বেশি পড়ে। আমার একাধিক লেখা ছিল/ আছে- যেখানে বিশেষ কোন ধর্মের ব্যাপারে সমালোচনা নেই- ওভারল ইশ্বর, সৃষ্টি -এসবকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞান ভিত্তিক বা দর্শন ভিত্তিক লেখা; সেখানেও তর্ক করতে এসেছে, মুসলমান ব্যক্তি এবং কমেন্টে যেহেতু তারা ইসলাম, কোরআন, আল্লাহ প্রভৃতি নিয়ে এসেছে- ফলে আলোচনা, তর্ক- বিতর্ক শেষ পর্যন্ত ইসলাম কেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে। আবার আমার এমনও লেখা আছে- যেখানে একাধিক ধর্মকে একসাথে সমালোচনা করেছি। যেমন ধর্মে বিজ্ঞানঃ নিমগাছে আমের সন্ধান- সেই লেখায় কোরআন- পুরান (বেদ/ বেদান্ত) পাশাপাশি রেখেই আলাপ করেছি ... সেই লেখার জবাব বা তর্ক-বিতর্কও করেছে- ইসলাম ধর্মের পক্ষের লোকজন- ফলে, পুরানকে যেহেতু কেউ ডিফেন্ড করতে আসেনি কিংবা সেগুলো আপনাদের মত মুসলমানদের চোখেই পড়েনি- ফলে, ইসলামকে নিয়েই পরবর্তী ডিবেটগুলো কন্টিনিউ করতে হয়েছে।
 
দ্বিতীয়ত- আমরা যারা বাংলাদেশের নাস্তিক- স্বভাবতই- ইসলাম ত্যাগ করা নাস্তিকই আমরা বেশি ... বিষয়টা একটু বুঝেন- জীবনের একটা শুরুর অংশটুকু ইসলাম নিয়েই আমাদের চলাফেরা ছিল- এই ধর্ম নিয়েই আমাদের জানাবুঝা বেশি ... যখন নাস্তিক হয়েছি- তখন এই ধর্মের ব্যারিয়ারই আমাদের পার হতে হয়েছে ... সুতরাং, এক্স-মুসলিম নাস্তিক ইসলাম নিয়েই বেশি লেখবে- এটাই স্বাভাবিক ... একই কথা অন্যান্য এক্স-ধার্মিক নাস্তিকের জন্যেও সত্য। এক্স-হিন্দু নাস্তিককে দেখবেন হিন্দু ধর্মের ব্যাপারে বেশি লেখছে, এক্স-খ্রিস্টান নাস্তিক দেখবেন খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে বেশি লেখছে। (যদিও সেই সব লেখাগুলো নিয়ে আপনার তেমন হেডেক নাই বলে সেগুলো আপনার দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়)।
 
তৃতীয়ত- আমাদের মত মুসলিম প্রধান দেশে- ইসলাম ধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ফলে, এইখানে ইসলাম নিয়ে আলাপ যেহেতু বেশি হয়- সেহেতু স্বভাবতই নাস্তিকরা ইসলামের সমালোচনাও বেশি করে করবে। উদাহরণ দেই- এখানে রোজার মাসে ফ্রি-লি খাবার দাবার করা যায় না ... এমনকি বিড়ি নিয়া বাইরে বাইর হইলেও সবাই চোখ বড় করে তাকায় ... ফলে এইখানে এই বাস্তব সমস্যার মুখে যারা পড়ে- সেই অভিজ্ঞতা নিয়াই তো লেখবে। ভারতীয় নাস্তিক বন্ধুদের যেমন হিন্দু বাবা- পুরোহিত- তাদের ধাপ্পা ... ইত্যাদি নিয়া লেখতে বা সিনেমা করতে বেশি দেখি। আমির খানের পিকে বলেন আর সত্যজিতের দেবী, গণশত্রু বলেন- এইরকম সিনেমা অসংখ্য পাবেন ভারতীয় প্রেক্ষাপটে। কিন্তু বাংলাদেশে বা ইরানে মুসলিম প্রধান দেশে এইসব করে কি ফায়দা। তারচে বরং তারেক মাসুদ রানওয়ে বানায়- ইরানে টু-উইমেন তৈরি হয় (নারীর ডিভোর্স নিয়ে বেশ কিছু ডিবেট দেখানোতেই ইরানী মুসলমানরা ধর্ম অবমাননার দায়ে এইটারে ব্যান করেছিল) ...
চতুর্থত- বিশ্বব্যাপি ইসলামী জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস- প্রভৃতি কারণে ইসলাম ধর্ম একটা গ্লোবাল টপিকে পরিণত হয়েছে (সেইটা মাথামোটা মুসলিমদের কারণেই)। ফলে- ইন্টারন্যাশনাল টপিক নিয়া যেকেউই যেকোন জায়গায় কথা বলার অধিকার রাখে ...
 
[প্রথম প্রকাশ ফেসবুক, জুন ২৩, ২০১৬]
 
 
 
 তিনঃ কোনটা নাস্তিকতা, কোনটা ঘৃণা, কোনটা বিদ্বেষ?
 
"আমার নাস্তিক বন্ধুরা পার্থক্য করতে পারছেন না - কোনটা নাস্তিকতা, কোনটা ঘৃণা, কোনটা বিদ্বেষ। কেউ কেউ খুবই গর্বিতভাবেই বলছেন আমি ইসলাম বিদ্বেষী। আমার গলা কেটে ফেললেও আমি ইসলাম বিদ্বেষী"।
"দুইটা শব্দ আছে এইখানে। বিরোধিতা এবং বিদ্বেষ। বিদ্বেষ শব্দটা সরাসরি ঘৃণার চর্চা করা বা ঘৃণা ছড়ানো। আপনি বিরোধিতা নিশ্চয়ই করতে পারেন। যখন নাস্তিকতার চর্চা করছেন, ধর্মের বিরোধী অবস্থান আপনার অবশ্যই থাকতে পারে, কিন্তু আপনি সরাসরি যখন বলছেন আমি বিদ্বেষী, বলছেন- আমি ইসলামোফোবিক বা আমি জেনোফোবিক, হোমোফোবিক ... "
"আমি বলছি যে, বিদ্বেষ শব্দটিই হচ্ছে একটা আনএক্সেপ্টেবল শব্দ। হোয়াই শুড ইউ বি বিদ্বেষী। আপনি বিরোধিতা করেন। আপনি অপছন্দ করেন!" - নাদিয় ইসলামের ফেসবুক পোস্ট!

প্রথম কথা হচ্ছে, "ইসলাম বিদ্বেষ" কিংবা "ইসলামোফোবিক"- এই টার্মোলজিগুলো কাদের আমদানিকৃত? নাস্তিকদের যারা বলছেন- "আমি ইসলামবিদ্বেষী", তারা কোন পরিস্থিতিতে তা বলছেন? ইসলাম সংক্রান্ত যেকোন বিরোধিতাকে, যেকোন সমালোচনাকেই যখন "ইসলাম বিদ্বেষ" হিসেবে দেখিয়ে দিয়ে- নাস্তিকদের খুন করার লেজিটেমেসি তৈরির চর্চা চলছিলো চারদিকে, সেই মুহুর্তে নিজেকে "ইসলাম বিদ্বেষী" বলা, ইসলামকেও ঘৃণা করার অধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে "আমার গলা কেটে ফেললেও ইসলাম বিদ্বেষী থাকবো" বলা- এইসবের ইতিহাস না জেনেই কি তারা প্রশ্ন করছেন, "নাস্তিকরা নিজেদের ইসলাম বিদ্বেষী বলছে কেন?", "জার্মান বা ফ্রেঞ্চ ভাষায় রাস্তায় কোন নাস্তিক নিজেকে বিদ্বেষী বললে- বলবে, এর মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন"? আচ্ছা, নাস্তিকদেরকে "ইসলাম বিদ্বেষ" দিয়ে ডেমোনাইজ করার যে তোরজোড়, তার জবাব দেয়া ছাড়া- কবে কোনদিন কোন নাস্তিককে হরেদরে- রাস্তাঘাটে কিংবা ফেসবুক - ব্লগের লেখাজোখাতেও "আমি ইসলাম বিদ্বেষী" বলে পরিচয় দিয়া বেড়াইতে দেখছেন বলেন!
 
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে- নাস্তিকতা, ঘৃণা আর বিদ্বেষের পার্থক্যটা আসলে নাস্তিকরা নাকি যারা এইসব ট্যাগিং করছেন- তারাই করতে পারছেন না? বস্তুত- ইসলাম (কিংবা যেকোন ধর্ম) এর বিরোধিতা আর বিদ্বেষ- এই দুইয়ের মধ্যে কি কোন ফাইন লাইন টানা সম্ভব? ২০১৩ সালে হেফাজত যখন সরকাররে ২৫-২৮ জন "ইসলাম বিদ্বেষী" নাস্তিকের তালিকা ফাইল সমেত জমা দিয়েছিলো- সেইখানে অভিজিৎ রায়ের সমকামিতা নিয়া লেখা, অনন্ত বিজয়ের বিবর্তনবাদ নিয়া লেখারও উল্লেখ ছিল! ফলে- নাস্তিকতার মধ্যে যারা "বিদ্বেষ" খুজতে চাইতেছেন- এই সমস্যাটা তাদেরই নয় কি? নাস্তিকদের সমস্যা কেমনে হয়?
 
তৃতীয়ত, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়া হিন্দু বিদ্বেষ, ইহুদী বিদ্বেষ- এই সমস্ত টার্মোলজি সবক্ষেত্রে ব্যবহৃত হইলেও- এক মুসলিম বিদ্বেষরে কেমনে আপনেরা "ইসলাম বিদ্বেষ"- টার্ম দিয়া চালাইয়া দিতেছেন? এই টকশোতে নাদিয়া ইসলামও ইসলাম বিদ্বেষের পাশে ইহুদি বিদ্বেষ শব্দবন্ধ ইউজ করছে ... । নাৎসিদের সমস্যা ছিল- তারা ইহুদি বিদ্বেষী ছিল; সেইটারে কেউ মোটেও ইহুদিজম বা ইহুদি ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বলে চিত্রিত করে নাই! আজকে প্যালেস্টাইনে যেই সমস্যা- দুনিয়ার প্রগতিশীলরা জিওনিজম নিপাত যাক কয়, জিওনিজমরে ঘৃণা করে- কিন্তু মোটেও কয় না- ইহুদিরা নিপাত যাক ... !
 
চতুর্থত, নাদিয়া ইসলাম বিদ্বেষ কইতে কইতে ইসলামোফোবিক কথাটাও কইছে। এবং ইসলামোফোবিক এর পাশে ইউজ করছে জেনোফোবিক আর হোমোফোবিক টার্মগুলো! এই টার্মোলজিগুলোর অর্থ বস্তত জানে কি? ফোবিয়া তো হইলো অমূলক ভয়! আর জেনো হইলো অপরিচিত, ফরেনার- অর্থাৎ নিজেদের গোত্র, বর্ণ, জাত, ধর্ম বাদে অন্য যেকোন কমিউনিটির মানুষদের নিয়া অমূলক ভীতি- হইলো জেনোফোবিয়া; হোমো আসছে- হোমোসেক্সুয়ালিটি থাইকা- হোমোফোবিয়া হইলো হোমোসেক্সুয়ালদের প্রতি অমূলক ভয়। সেইদিক দিয়া মুসলিমদের নিয়া যে অমূলক ভীতি- সেইটারে তো কওন দরকার- মুসলিমোফোবিয়া; অথচ তারে চালাইয়া দিতেছেন- ইসলামোফোবিয়া কইয়া! আর, ভালো কথা- নাস্তিকরা নিজেরে ইসলাম বিদ্বেষী কইতে পারে, কিন্তু কোন দিন কি দেখছেন কেউ কইছে- হ্যাঁ আমি ইসলামোফোবিক!
 
পঞ্চমত, এই যে মুসলিম বিদ্বেষ আর ইসলাম বিদ্বেষ-রে একাকার করে- সমার্থক হিসেবে উপস্থাপন করা- এইটা পলিটিকাল ইসলামিস্টদের একটা সুনির্দিষ্ট চাল! ইসলামের সুপ্রিমেসি স্ট্যাবলিশ করতে চায় বলেই- তারা এইভাবে দেখায়! ইসলামের বিরুদ্ধে বলা মানেই মুসলিমদের বিরুদ্ধে বলা- নাদিয়াও যেই যুক্তিটা করছে- আইডিওলজি তো মানুষই বহন করে, ফলে আইডিওলজির বিরুদ্ধে কইলে কমিউনিটির বিরুদ্ধেই তো যাবে- এই একই যুক্তিটা কিন্তু দেখবেন ইসলামিক টেক্সটের বিরুদ্ধে ইউজ করবার পারবেন না! যাবতীয় ইসলামিক টেক্সটে ভিন্ন আইডিওলজি, ধর্ম বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যত কথা- ইসলামিস্টরা ভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে (এবং ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধেও) যত কথা কয়- সেগুলোকে তারা পারমিটেড মনে করে- কেননা সেইটাও তাদের ধর্মের অংশ, তথা ধর্মীয় স্বাধীনতা।
 
ষষ্ঠত, দুইদিন আগে- এইরকম "উগ্র নাস্তিকরা" বাংলাদেশের জন্যে কতখানি ক্ষতিকর- এই মর্মে লেখা এসেছে! সারওয়ার সাহেব মহাউল্লাসে শেয়ারও করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সবচাইতে নিরীহ, সংখ্যালঘু, এবং বাংলাদেশের পলিটিকাল কনটেক্সটে সবচাইতে গৌন- এই নাস্তিকদের নিয়া যে ফোবিয়ায় তারা আক্রান্ত হচ্ছেন,- সেই জন্যে তাদেরকে নাস্তিকোফোবিক বলা যাবে না? এই যে- তারা নাস্তিকদের - কিংবা তাদের ভাষায় "নব্য নাস্তিকদের" বিরুদ্ধে টানা ঘৃণা ছড়াচ্ছেন- যেইটা বাংলাদেশের মত কনটেক্সটে কতখানি ভয়ানক হইতে পারে সেই অভিজ্ঞতাটা খুব বেশি পুরান না; ব্যক্তি ধরে ধরে পাবলিক শেমিং, চিন্তা- দৃষ্টিভঙ্গি- যুক্তি- মত - পথ নিয়ে তর্ক বিতর্ক বাদ দিয়ে, তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা সংকট, সততা - ইন্টিগ্রিটি - ইন্টেলেকচুয়ালিটি- এইসব নিয়া গড়েবড়ে কথা বলে ঘৃণিত জীব হিসেবে উপস্থাপন করছেন, সেইটা কি রেসিজমের অন্তর্ভূক্ত নয়? হ্যাঁ, আইডিওলজির বিরুদ্ধে ঘৃণা যত জাস্টিফায়েড হউক- কমিউনিটির প্রতি ঘৃণারে রেসিজমই কই ... !
 
সপ্তমত- এইটা কি মনে করেন না- একজন অজ্ঞ, মুর্খ ব্যক্তিরও ধর্মে আস্থা না থাকতে পারে- ইনটেলেকচুয়াল মান যেমনই হোক- সেই অনাস্থার কথা- ব্যক্তির চিন্তা, তার অবস্থান থেকেই কি সে প্রচার করতে পারে না? এমনকি একজন অসৎ, একজন দাগী আসামিও তো নাস্তিক হইতে পারে, মানে তার ধর্মে বা ইশ্বরে বিশ্বাস না থাকতে পারে। একজনের শিক্ষা দীক্ষা, ব্যক্তিগত সততা- অসততা- নৈতিকতা- এইসবের ফিরিস্তি (অনেককিছুর আবার কোন প্রামণ বাদে ঢালাও ফিরিস্তি) টাইনা কি নাস্তিকদের বা "নব্য নাস্তিকদের"- ডেমোনাইজ করবার পারেন?
 
অষ্টমত, মানুষ হিসেবে মানুষকে ট্রিট করা, রেসপেক্ট করা- "আমি" বাদে অপরকেও মানুষ হিসেবে ট্রিট করা- এই শিক্ষাটা খুব জরুরি। একজন আস্তিক হলেই যেমন বেটার কিছু হয়ে যায় না, তেমনি একজন নাস্তিক হইলেই বেটার কিছু হইয়া যায় না- এ কথার সাথে সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু, এই কথা সবকিছুর জন্যেই প্রযোজ্য। আপনি যা যা- তার জন্যেই আপনি অন্যদের চাইতে বেটার না ... আপনার চাকরি আছে, আপনার নানান কিসিমের স্কিল আছে, আপনি কিছু বই অনুবাদ করছেন, বই লেখছেন- মানেই আপনি যারা এইসব করেনি- তাদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারেন কি? আরেকজনের চিন্তা- মত- পথ নিয়া হাজার বিরোধিতা করেন, সমালোচনা করেন; আরেকজনের কোন অন্যায় দেখলে- অপরাধ দেখলে স্পেসিফিক ব্যক্তি ধরে প্রমাণ সহকারে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন ... কিন্তু নিজের যা যা নিয়ে আপনার গর্ব, সেই গর্বের প্রচারে অন্যদেরকে পাবলিক শেমিং করতে পারেন কি?
 
নবমত- বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষদের নেয়ার সামর্থ্য, কোন একটা দেশের লিগ্যাল ফেমওয়ার্ক- ইত্যাদি মেপে মেপে কথা বলার কথা আপনেরা কইলেন! "উসকানি"র কথা আপনারা কইলেন! এইরকম বেশিরভাগ মানুষের মন জুগাইয়া চললে দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিন্তা, নৈতিকতা, আইন, কানুন- সবকিছুই এক জায়গায় স্থির হইয়া থাকতো! আমি আশা করবো, নাদিয়া- সারওয়ার দুইজনের কারোরই যেন এই হাল না হয়! নাদিয়ার নারীবাদ যতটুকুই "উসকানি" দিতে পারছে- সেইটারে দরকারীই মনে করি ...
 
দশমত, মানে শেষ পয়েন্টে- একটা আশংকার কথা জানাইয়া যাই। ২০১৩ সালের পরে এই ভিক্টিম ব্লেমিং এর কামটা খুব জোরেশোরে হইছিলো। থাবা বাবা মরার পরে- আমার দেশ পত্রিকা থাবা বাবার - ধর্মকারীর অনেক লেখার অংশ বিশেষ ছাপিয়ে দিয়েছিলো। সোনার বাংলা সহ- ইসলামিস্ট বিভিন্ন সাইট, ব্লগে নাস্তিক ব্লগারদের তালিকা ধরে ধরে- তাদের বিভিন্ন "ইসলাম বিদ্বেষী" লেখার অংশ বিশেষ ছাপানো হচ্ছিলো। এই "ইসলাম বিদ্বেষ" দেখানোর চলটা আরো পুরাতন। হুমায়ুন আজাদ, শামসুর রাহমান, শাহরিয়ার কবির, জাফর ইকবাল, তসলিমা নাসরিন, আহমদ শরীফ, আলী আজগর,- এইরকম অসংখ্য "ইসলাম বিদ্বেষী"র "ইসলাম বিদ্বেষ" এর প্রমাণ স্বরূপ কোটেশন, বক্তব্যাংশ- এইসব উল্লেখ করে ভিডিও, পোস্টার- প্রচারের চল বহুত পুরাতন। কিন্তু, ২০১৩ সালের পর থেকে নাস্তিক ব্লগারদের "ইসলাম বিদ্বেষ" নিয়ে প্রচার প্রপাগাণ্ডাটা ব্যাপক বেড়ে যায়- বলতে গেলে একদম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। একদম রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই এইরকম ইসলাম বিদ্বেষ নিয়া আলাপ সালাপ হইতে থাকে! এর একটা পর্যায়ে- আমাদের প্রগতিশীল, সেক্যুলারদেরও অনেকরেও ইসলামিস্টদের ফাঁদে পা দিয়ে কথিত "উগ্র নাস্তিক"দের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখেছি ... । প্রায় দুই বছরে তৈরি করা সেই গ্রাউণ্ডের উপরে নির্ভর করেই- ২০১৫ সালে এসে আনসার বাংলা- আইএস এইসব গ্রুপ শুরু করে নাস্তিক হত্যার মহোৎসব! "ইসলাম বিদ্বেষ" এর বিরুদ্ধে যে জমিনটা দুই বছরে তৈরি হইছিলো- সেইটারে কাজে লাগাইতেই- প্রতিটা হত্যার পরপরেই- আনসার বাংলা যে স্টেটমেন্ট দিতো- সেইখানে খুন হওয়া ব্লগারের "ইসলাম বিদ্বেষী" কোটেশন জুড়াইয়া দিতো ... যাতে "ইসলাম বিদ্বেষী" ব্লগারদের খুনের লেজিটেমেসি তৈরি হয়। আজকে আবার ইসলাম বিদ্বেষ নিয়া এইরকম নড়াচড়া দেইখা এবং পেছন থেইকা পিনাকি'র মত চিহ্নিত লোকরে কলকাঠি নাড়াইতে দেইখা- সেই রকম পরিকল্পনার আশংকাই হইতেছে!
 
[ফেসবুক, ১৪ অক্টোবর, ২০১৯]
 
চারঃ বিদ্বেষ মাত্রই খারাপ জিনিস? ইসলাম বিদ্বেষ সাম্প্রদায়িকতা?
 
: আমি ইসলাম ইস্যুতে মডারেটদের বিরুদ্ধে লাগি কম। লাগি এক্সট্রিমিস্টদের বিরুদ্ধে।
:: আপনি নিজেই তো মডারেট, লাগবেন কেমনে? 😃 😛
 
: সেটাইতো! আপনাদের সাথে আমার দ্বিমতের জায়গাতো এইখানে বহু বছর ধরেই। আমি দেখেছি যে দুইপক্ষের (ইসলামিস্ট ও নাস্তিকদের) এক্সট্রিমিস্টরা মিলে মডারেটদের পিছে লেগে থাকে।
:: আপনি (ও আপনার মত মডারেটরা) আপনার বিভিন্ন লেখায় নাস্তিকদের ইসলামোফোব বলে তাদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল, বিদ্বেষী, এক্সট্রিমিস্ট বইলা - আপনি নিজেও কি ঘৃণার চর্চা করতেছেন না?
 
: এইটাতো ভাই ঐ সাম্প্রদায়িক ইসলামপন্থীদের মতো যুক্তি হইয়া গেল। যে তাদেরকে বিদ্বেষী বললে নাকি আমরাই বিদ্বেষী। আপনি কি আসলেই মনে করেন যে আমাদের নাস্তিকদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষী নাই?
:: কেন থাকবে না! আমি নিজেই ইসলাম বিদ্বেষী। আমি ইসলাম বিদ্বেষকে একটা গুণ মনে করি। ওয়াশিকুর বাবুর ভাষায়ঃ “যে ধর্ম মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়, সে ধর্মকে আমি ঘৃণা করি”, “ধর্মবিদ্বেষ অপরাধ নয়, কিন্তু মানববিদ্বেষ অপরাধ। পৃথিবীর সব ধর্ম মানববিদ্বেষে পূর্ণ। তাই মানববিদ্বেষী ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা পবিত্র দায়িত্ব”।
: আমি মনে করি বিদ্বেষ খারাপ জিনিস। ইসলাম বিদ্বেষ সাম্প্রদায়িকতা।
:: আমি সেইটা মনে করি না ...
 
: না মনে করতে পারেন. আমি মনে করি যে কোন ধর্ম ও ধর্ম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষন করাই সাম্প্রদায়িকতা. কারো হিন্দুবিদ্বেষ আছে, কারো ইহুদিবিদ্বেষ আছে, আপনাদের ইসলামবিদ্বেষ আছে এখন সেই বিদ্বেষী ব্যক্তি ধার্মিক হউক বা নাস্তিক। বিদ্বেষই মূখ্য কথা। তো আমি ইসলামবিদ্বেষী বললে দ্বিমত করেন কেন?
:: আপনি বলার সময়ে হিন্দু বিদ্বেষ, ইহুদি বিদ্বেষ আর ইসলাম বিদ্বেষরে এক করতেছেন- এইটাই হইলো সুবিধাবাদী আলাপ ... হিন্দুইজম বিদ্বেষ, জায়োনিজম বিদ্বেষ, ইসলাম বিদ্বেষ, রেসিজম বিদ্বেষ, প্যাট্রিয়ার্কি বিদ্বেষ আমি ধারণ করি, ধারণ করারে গুণ মনে করি --- কিন্তু হিন্দু বিদ্বেষ, নাস্তিক বিদ্বেষ, মুসলিম বিদ্বেষ, - এইসবরে বর্জনীয় মনে করি ...
 
: আমি সুবিধাবাদি আলাপ করছিনা। আমি শব্দগুলা যেইভাবে আছে, সেইভাবে ব্যবহার করছি। আপনিই শব্দগুলার অর্থের দিকে নজর না দিয়া শব্দের আক্ষরিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন।
:: আপনি তো সুবিধামতন শব্দ ব্যবহার করতেছেন ... যেমনে আছে আবার কি? শব্দগুলার তো নির্দিষ্ট মানে আছে ... শব্দগুলার পেছনে রাজনীতিও আছে ... এইসব নিয়া মেলা আলাপ আলোচনাও হইছে ... তারপরেও আপনি ইসলাম বিদ্বেষ, ইসলামোফোব - এইসব শব্দগুলোকে হিন্দু বিদ্বেষ, নাস্তিক বিদ্বেষের প্যারালাল হিসাবে উপস্থাপন করতেছেন ... কেননা সেইটায় মেলা সুবিধা পাওয়া যায় ...
 
: ইহুদিবিদ্বেষ মানেতো কেবল ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষ না, তার সাথে ইহুদি ধর্ম বিদ্বেষ ওতপ্রতভাবে জড়িত। তো ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষের ব্যবহার মুসলিম বিদ্বেষ বুঝাইতে পান নাই কখনো? আমিই প্রথম করলাম. না এইটাই প্রচলিত ব্যবহার?
:: হ্যাঁ, যে ইহুদি বিদ্বেষী বা মুসলিম বিদ্বেষী, সে একইসাথে ইহুদি ধর্মেও বিদ্বেষী বা ইসলামেও বিদ্বেষী হতে পারে, কিংবা বলা যায় তাদের এই ইহুদি বিদ্বেষ বা মুসলিম বিদ্বেষের পেছনে প্রধান কারণ হতে পারে ইহুদি ধর্ম বিদ্বেষ বা ইসলাম বিদ্বেষ। কিন্তু, ইহুদি ধর্মে বিদ্বেষী মাত্রই ইহুদি বিদ্বেষী না, ইসলাম বিদ্বেষী মাত্রই মুসলিম বিদ্বেষী না!
 
: আপনি ইসলাম বিদ্বেষ করবেন, আর মুসলমানদের ভালবাসবেন, এইটাতো হাস্যকর দাবি।
: এইটা কেন হাস্যকর দাবি হবে কেন? আমি ইসলামরে ঘৃণা করি ... কিন্তু আমার ভালোবাসার, শ্রদ্ধার মানুষদের ৯৯% মানুষই মুসলমান! কেননা আমার আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব, যত প্রিয় মানুষ সবাই তো মুসলমান।
 
: এইটা আপনার ব্যক্তিগত মতামত। আপনার ব্যক্তিগত চিন্তার আলাপ করছিনা। আপনি কিভাবে এই ফাইন লাইন মেইনটেইন করেন তাও আমি জানিনা। কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত কোন চর্চা দিয়েতো সামগ্রিকভাবে ইসলামবিদ্বেষ বোঝা যাবেনা।
:: হ্যাঁ - আমরা তো যেহেতু কথা বলছি- ব্যক্তিগত পারস্পেক্টিভই দুইজন তুলে ধরতেছি ... কিন্তু্‌ আপনি যখন বলেন - ইসলামরে ঘৃণা করে মুসলমানরে ভালোবাসা সম্ভবই না, বা হাস্যকর কথা -- তখন আমার উদাহরণটা দিলাম ... এটলিস্ট একটা উদাহরণ দেখাইলাম ... একইভাবে হিন্দু সমাজে বেড়ে ওঠা বা খৃস্টান সমাজে বেড়ে ওঠা একজন নাস্তিক যতই হিন্দুধর্ম বিদ্বেষী হোক, যতই খৃস্ট ধর্ম বিদ্বেষী হোক, একইভাবে বেশিরভাগের পক্ষেই হিন্দুবিদ্বেষী বা খৃস্টান বিদ্বেষী হওয়া সম্ভব হয় না, বরং হিন্দু বা খৃস্টান পরিবার – পরিজন – বন্ধুবান্ধবকে ভালোবাসে।
 
: আমি কিন্তু এখনো কনভিন্সড না যে ইসলাম বিদ্বেষ মনে রেখে মুসলিম বিদ্বেষ এড়ানো যায় কি না।
:: এই ব্যাপারে কনভিন্সড হওয়ার দরকার নাই তো! ইসলাম বিদ্বেষ আর মুসলিম বিদ্বেষ দুইটা আলাদা এক্ট কি না সেইটা কন! কারোর ক্ষেত্রে দুই এক্ট একই সাথেও ঘটতে পারে, বা একটা কারণ ও অন্যটা ফলাফল হইতে পারে। কিন্তু, একটা এক্টরে অন্য এক্ট দিয়া ডাকা কি ঠিক? ইসলাম বিদ্বেষ আর মুসলিম বিদ্বেষরে কি এক পাল্লায় মাপা ঠিক?
 
: ইসলাম বিদ্বেষ থেকেই যদি মুসলিম বিদ্বেষের শুরু হয়, তাহলে কারণটার বিরুদ্ধেই বেশি সোচ্চার থাকা দরকার।
:: না, তাহলে সেটা জেনারেলাইজেশন দোষে দুষ্ট হবে, যেহেতু সব ইসলাম বিদ্বেষীই মুসলিম বিদ্বেষী নয়। বস্তুত আমি অধিকাংশ নাস্তিকদেরই দেখি- তারা ইসলাম বিদ্বেষী হইলেও মুসলিম বিদ্বেষী না ... এইটাই স্বাভাবিক ... এমনটাই হয় চাইরদিকে ... আবার নাস্তিকদের মধ্যে অনেকেই আছে, মুসলিম বিদ্বেষী! যারা ধর্মরে ক্রিটিসাইজ করা বাদ দিয়া মুসলমানদের বিরুদ্ধে জেনারালাইজড ঘৃণা ছড়ায় ... এখন তাদেরকে মুসলিম বিদ্বেষী না বইলা - ইসলাম বিদ্বেষী বলাটা অসাধুতা বা অন্ধত্ব।
 
: কোন টার্ম নিয়া সমালোচনা থাকতেই পারে। টার্মের নামের মধ্যে পুরা চিত্র ধরা না পড়লে সেইটা অসাধুতা মনে করি না।
:: ইসলামোফোব, ইসলাম বিদ্বেষ - এইসব নিয়া অনেকেই মেলা লেখালেখি করছি ... আমি, অভিজিৎ, থেকে শুরু করে - এইদিকে ডকিন্সরাও এই শব্দের রাজনীতিটা দেখাইতে চাইছে ... কেননা এই টার্মের মধ্য দিয়া ইসলামের বিরুদ্ধে বলা, ইসলামরে ক্রিটিসাইজ করা - এগুলাকে ইসলামোফোব, ইসলাম বিদ্বেষ এইসব বলে - এগুলোকে নাস্তিক বিদ্বেষ, হিন্দু বিদ্বেষ, ইহুদি বিদ্বেষ - এইসব রেসিস্ট আচরণের সমর্থক বানায়া দেয়া যায় ... এগুলা আপনি জানেন না, পড়েন নাই, কিংবা বুঝেন না - এমনটা মনে করি না ... তারপরেও এই যে কথায় কথায় ইসলামোভোব, উগ্র নাস্তিক এই রকম নানান টার্ম যে ইউজ করেন- সেইখানেও আপনার রাজনৈতিক গোল নিয়াই তখন সন্দেহ তৈরি হয় আর কি ...
 
: ধরেন, ইসলাম বিদ্বেষের ইনেভেটিবল একটা ফলাফল হইল মডারেট মুসলিমদের সাথে বিদ্বেষী আচরণ করা। কেনোনা, ইসলামের যেই রূপটাকে সামনে রেখে বিদ্বেষ জায়েজ করা হচ্ছে, মডারেটরা তার চাইতে ভিন্ন রূপ হাজির করে।
:: এই কথাটাই ভুলযে, ইসলাম বিদ্বেষের ইনএভিটেবল ফল মুসলিম বিদ্বেষ। ভয়ানক ভুল কথা। হ্যাঁ, ইসলাম বিদ্বেষ থেকে অনেকে মুসলিম বিদ্বেষের দিকে ধাবিত হইতে পারে। কিন্তু, আপনাকে বুঝতে হবে যে- দুইটা দুই জিনিস। এবং যারা ইসলাম বিদ্বেষ থেকে মুসলিম বিদ্বেষের দিকে টার্ণ করছে, তাদেরও বুঝতে হবে - ইসলাম বিদ্বেষ পর্যন্ত তোমার লিমিট, কিন্তু মুসলিম বিদ্বেষটা ঘৃণ্য, রেসিজমের সমান! কিন্তু, আপনি যদি ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধেই আপনার জেহাদ শুরু করেন- সেইটা মোটেও কিছুই আনতে পারে না ... বরং নাস্তিক হেটার যারা আছে - তারাই একরকম সুরসুরি পাবে। রিচার্ড ডকিন্সের আলাপে একটা মজার উদাহরণ ছিল। “আমি ক্যান্সারকে ঘৃণা করি”। “আহ! তার মানে তো তুমি ক্যান্সারের রোগীকেও ঘৃণা করো!” আপনার ব্যাপারটাও এরকম হয়েছে! ক্যান্সারে ঘৃণা করার ইনএভিটেবল একটা ফলাফল ক্যান্সারের রোগীর সাথেও বিদ্বেষী আচরণ করা!
 
: আমাদের এই লড়াইটা আপনারা বোঝেন না। অনেক পোলাপান আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করে জিহাদিদের পোস্ট শেয়ার করে। বুঝেন অবস্থা যে ইসলাম বিদ্বেষ কোন পর্যায়ে পৌছাইত এপারে।
:: কে কার পোস্ট শেয়ার দিবে, সেইটা দিয়াই আপনি কাউরে মুসলিম বিদ্বেষী বলতে পারেন? এইরকম শেয়ার দেয়া- আপনি বা আপনার মত মডারেটদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ কিভাবে হয়, এইটা আমারে বুঝান! হুজুর ওয়াজ করছে, আল্লাহর রাসুলের বিরুদ্ধে কটুক্তি করলে তাকে কেটে টুকরো টুকরো করা হবে! আমি এইটা শেয়ার দিলাম। শফি হুজুর ওয়াজে বললো, নারীরা তেতুলের মত, মুখে লালা ঝরে। এইটাও আমি শেয়ার দিলাম। আরেক সেলিব্রিটি হুজুর পোস্ট দিলো, ৪ বিয়া করার ১২ টা ইসলামসম্মত ফজিলত নিয়া। সেইটাও আমি শেয়ার দিলাম। এগুলা শেয়ার কারণ, আমি দেখাইতে চাইছি, ইসলাম নামের এই মহান ধর্মটা কতখানি বর্বর ও ফালতু। এখন আপনি ও মডারেটরা ইসলামের এইসব নোংরা আবর্জনাগুলারে ঢেকে রাখতে চান, কিংবা ভিন্ন আধুনিক ব্যাখ্যা আনতে চান! খুবই ভালো কথা! কিন্তু, আমাদের যাদের উদ্দেশ্য আপনাদের মত না, তাদেরকে আপনাদের বিদ্বেষী বলাটা কতখানি সুস্থতা?
 
: কিন্তু, ঐ সব সালাফী হুজুরদের ইসলাম, শফি হুজুরের ইসলামকেই ইসলাম হিসেবে তুলে ধরতেছেন কেন? চার বিয়ের পক্ষে বাংলাদেশী আলেমদের মত ইসলামসম্মত নয়। তাইলে ঐ হুজুরদের চার বিয়ের ফতোয়া আপনারা প্রচার করে কি পাইতেছেন?
:: ধরেন, নাস্তিকদের অনেকেই মনে করে, ইসলামের এই রূপটা দেখিয়ে বর্তমান নৈতিকতার ভিত্তিতে এই ইসলামের সমালোচনা করার মাধ্যমেও অনেক মডারেট মুসলমানের মনে ইসলামকে নিয়ে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলা যায়! এবং সালাফি মুসলমান যারা এগুলোকে কোরআন হাদিসের ভিত্তিতে ইসলামের বিধান বলে মনে করে এবং মডারেটদের লুকাছাপা ইসলামকে যারা ইসলাম বলে মনে করে, তাদের মাথাতেও বর্তমান নৈতিকতা, যুক্তি, বিজ্ঞান – এরকম নানান আলাপ দিয়ে তার সেই অবস্থান বা বক্তব্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলার চেস্টা করা যায়!
 
: আপনারাতো ধরেন ইসলামপন্থী বা মুসলমানদের সাথে ঐরকম কোন ডায়ালগে যান না। কিন্তু ধরেন আমাদের যাদের ইসলামপন্থী এবং বিশ্বাসী মুসলমান পাঠক আছে, আমাদের অন্তত তাদের সাথে তর্ক বিতর্ক আলোচনার মাধ্যমে সামাজিক সহাবস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির একটা চেষ্টা আছে। আপনারা সেই কাজে হেল্প না করেন ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে জিহাদীদের সাথে মিলে আমাদের পিছে লাগাটাতো বিরাট বড় বোকামির কাজ।
:: নাস্তিকরাও নিয়মিত ডায়লগে যায়। সেই ডায়লগে আপনাদের মতন মলম দেয়ার কাম করে না, বরং ইসলামরে খোলামেলা ভাবে তুলে ধরার চেস্টা করে! আপনাদের কাছে এইটা বোকামির কাজ মনে হইতে পারে, আপনার মত মডারেটদের কাজটাকে অনেকের কাছে সুবিধাবাদী ও গ্যাটিস দেয়া মনে হইতে পারে। তবে, বোকামির কাজ বলাটা অন্তত ভালো, এটাকে মুসলিম বিদ্বেষ বলা বা মুসলিম বিদ্বেষ অর্থে ইসলাম বিদ্বেষ বলার চাইতে। কিন্তু, আপনাদের পিছে লাগার কিছু নেই। ইসলামের নানা দিক তুলে ধরে মডারেট মুসলিমদের মনে প্রশ্ন তুলতে চাওয়াটা পিছে লাগা হয় না! আর, জিহাদীরা যেসব জঙ্গী, ঘৃণাবাদী, বর্ণবাদী আয়াত – হাদীস – তাফসির উল্লেখ করে ইসলাম প্রচার করে, সেই সুরা, আয়াত, হাদীস, তাফসির নাস্তিকরা যদি ইসলামকে ক্রিটিসাইজ করার জায়গা থেকে সামনে আনে, তাহলে সেটা কিভাবে জিহাদীদের সাথে মিলে করা কাম হইতে পারে?
 
: কিন্তু এই ধরণের ইসলাম বিদ্বেষ তো সমাজে সালাফিজম প্রচারে ভূমিকা রাখছে!
:: মোটেও না! নাস্তিক আর কয়জন! মাদ্রাসায় মাদ্রাসায়, মসজিদে, বিশ্ববিদ্যালয়ে – সালাফিস্ট, ওয়াহাবিরা অবাধ বিচরণ করছে। তারা সমাজে যে চিন্তা ছড়াচ্ছে, সেটার সাথে নাস্তিকদের সমালোচনা সহ, ব্যাঙ্গাত্মক, স্যাটায়ারমূলক, প্রশ্নমূলক চিন্তার বিশাল পার্থক্য আছে। আমি সামুব্লগে একবার একটা পরীক্ষা করছিলাম। আওরঙ্গজেব নামের এক ইসলামিস্ট ব্লগার ছিলো (আসলে শিবির করতো)। সে একবার ইসলামি এক পোস্ট দিলো, ইসলামিক ব্লগাররা সব লাইক কমেন্ট দিয়ে ভাসায় ফেলছিলো। আমি পোস্ট পড়ে দেখলাম, খুবই রিয়াক্টিভ একটা পোস্ট, কোরআন হাদিসের রেফারেন্স সহ আছে। আমি হুবহু পোস্টটা আমার আইডি থেকে কপি পেস্ট করে দিলাম। একই পোস্ট যখন নাস্তিকের ধর্মকথা থেকে প্রকাশ হলো, ইসলামিক ব্লগারদের রেসপন্স পালটে গেলো! মডারেটদের কেউ কেউ, যারা আওরঙ্গজেবের পোস্টে একমত, প্রিয় পোস্টে, শোকেসে- এসব বলে এসেছিলো, তারাও কোরান হাদীসগুলোর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ার চেস্টা করছিলো! ফলে, ইসলাম বিদ্বেষ মোটেও সালাফিজম, ওয়াহাবিজম, কিংবা মডারেটিজম – কোন কিছুই প্রচারে ভূমিকা রাখে না!
 
: কিন্তু, বিদ্বেষ জিনিসটাই তো ভালো না! সাম্প্রদায়িকতা!
:: এই বিদ্বেষ কথাটা তো আপনাদের আমদানি। আমরা তো নিজেদের ইসলাম বিদ্বেষী বলি না। বলি, ইসলামের নানান বিষয় ধরে ধরে আমরা সমালোচনা করি। প্রশ্ন তুলি। অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরি। ইসলামের নামে দুনিয়াজুড়ে ও যুগে যুগে কি কি হয়েছে, সেই ঘটনাও দেখাই। এখন এগুলোকে আপনারা বিদেষ নাম দিলেন! হাসিনা বললো, মন্ত্রী আমলারা বললো, হেফাজত বললো, আনসার বাংলা বললোঃ নাস্তিকরা উগ্র, এরা ইসলাম বিদ্বেষী, আল্লাহর নবী রাসুলকে নিয়ে কটুক্তি করে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়! তাদের বলা থেকে, আপনি / আপনারা পার্মানেন্টলি কোট করে রেখে দিয়েছেন, উগ্র নাস্তিক আর ইসলাম বিদ্বেষী কথা দুইটা। কি আর করা, ইসলামের সমালোচনা করা, কোরআনের ভুল ভ্রান্তি ধরিয়ে দেয়া, নবী রাসুলের সমালোচনা করা যদি আপনাদের কাছে বিদ্বেষমূলক মনে, তাহলে এরকম উগ্র ও ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক হওয়ার অধিকারও যে আমাদের আছে, সেই জায়গা থেকে প্রথমেই জানিয়েছি, আমিও ইসলাম বিদ্বেষী।
 
[পারভেজ আলমের সাথে কথপোকথন, ফেসবুক পোস্ট আকারে প্রকাশঃ জুলাই ২৫, ২০২১ ]

বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১

কোরবানির ইতিহাসঃ বাইবেল ও কোরআনের বিরোধ

এক
কোরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কিত বাইবেল ও কোরআন এর আলাপ লইয়া ইসলামপন্থী, ইসলামবাদী, ইসলামিক বুদ্ধি-জীবীদের ভিতর ইদানিং বহুত কথাবার্তা হইতেছে! খুবই উপাদেয় আলাপ-আলোচনা, ফলে সমূহ পুলক বোধ হইতেছে, হাসিও আসিতেছে! উহারা প্রধানত দুইটি বিষয়ের দিকে উনাদের দৃষ্টিনিবন্ধ করিয়াছেনঃ
প্রথমত - বাইবেলে আব্রাহাম পুত্র ইসহাককে কোরবানির কথা বলা হইলেও, কোরআনে কোন পুত্রের কথাই নাম ধরিয়া বলা হয় নাই, যদিও বর্তমানে মুসলমান বয়ানে ইসমাইলকে কোরবানির কথাই বহুল প্রচলিত ও সর্বজনস্বীকৃত। 
 
দ্বিতীয়ত - বাইবেলে ঈশ্বর সরাসরি আব্রাহামকে ডাকিয়া প্রাণপ্রিয় সন্তানকে বলিদান করিবার নির্দেশ ফর্মাইয়াছিলেন এবং আব্রাহাম সেই মোতাবেক পুত্র সন্তানকে বলিদানে উদ্যত হইয়াছিলেন, অর্থাৎ পুত্রের কোন মত পিতা লন নাই। অন্যদিকে, কোরআনে ইব্রাহীম নবী স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন তিনি তার সন্তানকে জবেহ করিতেছেন, তাহা সন্তানকে জানিয়েছিলেন এবং সন্তান স্বয়ং রাজি হইয়াছিলেন।
 
 
দুই 
ইব্রাহীম নবী তাঁহার কোন সন্তানকে কোরবানি দিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, তাহা সেই সন্তান এবং তাঁহার বংশধরদিগের জন্যে বিশেষ গর্বের হিসাবে গণ্য হইতেছে বলিয়াই ইসহাকের বংশধর হিসাবে পরিচিতি দেওয়া ইহুদী ও খৃস্টানরা ইসহাকের নাম নিতেছেন, এবং ইসমাইলের বংশধর হিসাবে পরিচিতি দেওয়া মুসলমানরা ইসমাইলের নাম নিতেছেন! কিন্তু, সমস্যা হইয়া গিয়াছে যে, কোরআনে কোন সন্তানের নাম মুহাম্মাদ (সা) নিতে পারেন নাই, বা সাহস করেন নাই! জানা যাইতেছে যে, ইবনে কাথিরের পূর্বের ইসলামি আলোচনাসমূহে ইসহাকের কথাও বলা হইয়াছে। ইবনে কাথির ও তদপরবর্তী ইসলামিক আলেমগণ ও তাফসিরকারীগণ যাহারা বলিতেছেন ইসমাইলই আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজে জান কোরবানি দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তাহারা জানাইতেছেন পূর্বের আলেমগণ ভুলক্রমে ইহুদীদিগের প্ররোচণায় ইসহাকের নাম উল্লেখ করিয়া ফেলিয়াছিলেন! কিন্তু, কেন কোরআনে আল্লাহ পাক কিংবা নবীজী ইসমাইলের নাম উল্লেখ করিলেন না, আল্লামা তাবারি, আল্লামা কুরতুবি, আল্লামা কুরতুবির উল্লেখিত হযরত আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত আলি, হযরত উমর এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমর প্রমুখ - সকলেই কেন ইসহাকের নাম লহিয়াছিলেন এবং তাহাঁরা কিভাবে ইহুদীদিগের মারফৎ প্ররোচিত হইয়াছিলেন, বিভ্রান্তিতে পড়িয়াছিলেন, সেই সম্পর্কে কেহই আলোকপাত করিতে পারিতেছেন না! এবং এই সন্তান যে ইসহাক নহে, তিনি ইসমাইলই - ইহার পক্ষে অন্য কোন শক্ত যুক্তিও পাওয়া যাইতেছে না, একমাত্র যুক্তিই হইতেছে পূর্বতন যাহারা ইসহাকের নাম লহিয়াছিলেন - সকলেই ইহুদীদিগের দ্বারা প্ররোচিত হইয়াছিলেন! নবীজী মুহাম্মাদ (সা) এর কুরায়েশ বংশ যে ইসমাইলের বংশধর (বনু ইসমাইল), সেই হিসাবে ইসমাইলের উপরে এই বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হইলে, নবীজী (সা) এবং তাহাঁর উম্মতসকল বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত হইবেন, সেই আকাঙ্খা হইতেই যে ইসহাকের বদলে ইসমাইলকে কোরবানি দেওয়ার জন্যে ইব্রাহীম নবী উদ্যত হইয়াছিলেন - এইভাবে মিথটিকে পুনরুৎপাদন করা হইয়াছিলো, তাহা কেহ গোপন করিতে পারিতেছেন না! কিন্তু, ইহুদীদিগের প্ররোচনায় পূর্বতন সাহাবী ও আলেমগণ ইসহাকের নাম লইতেন, এহেন আলোচনায় এই কথা মনে করিয়া আমার ভীষণ হাসি পাইতেছে যে, স্বয়ং রাসুলে করিম হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ইহুদীদিগের দ্বারা প্ররোচিত হইয়া, তথা ইহুদী - খৃস্টানদের মাধ্যমে প্রচলিত এই মিথটি শুনিয়াই তাহা কোরআনে ঈষৎ পরিবর্তিত করিয়া ঢুকাইয়া দিয়াছিলেন! অর্থাৎ, কোরআনে থাকা কোরবানির সমগ্র আলোচনাই তো ইহুদীদিগের প্ররোচনার ফল (সাহাবা ও অন্যান্য আলেমগণ ইহুদীদিগের দ্বারা প্ররোচিত হইতে পারিলে, নবীজী পারিবেন না কেন?)!
 
 
তিন 
দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি বা তুলনাটি আরো চমকপ্রদ। ইশ্বর পিতাকে আদেশ দিলেন, তোমার সন্তানকে বলিদান করো। আর অমনি পাষণ্ড ও উন্মাদ পিতা চলিলেন নিজ সন্তানকে জবেহ করিতে! আর এইদিকে পিতা স্বপ্ন দেখিলেন, তিনি নিজ সন্তানকে জবেহ করিতেছেন! প্রাণপ্রিয় সন্তান দূরের কথা, সন্তানের সহিত খুব তিক্ত সম্পর্ক থাকিলেও তো এমন বীভৎস স্বপ্ন দেখিয়া ভয়ে কুকড়ে গিয়া সন্তানকে জড়াইয়া ধরিবার কথা! আর, সেইখানে এই উন্মাদ পিতা তাহাঁর সন্তানকে স্বপ্নের কথা এমনভাবে জানাইতেছেন যে, উন্মাদ সন্তান নিজেও রাজি হইয়া যাইতেছেন - নিজের জীবনকে পিতার হাতে উৎসর্গ করিয়া দিতে! দুই মিথেই দুই বদ্ধউন্মাদ পিতাকে আমরা পাই, যাহাকে আসলে পাগলাগারদে আটকে রাখা উচিৎ ছিলো! সেইখানে, এনারা আলোচনা করিতেছেন, কোরআনের এই গল্পের পিতা কত মহান, কত গণতান্ত্রিক যে, সন্তানকে তাহা জানাইয়াছিলেন, এবং সন্তানও কত মহান, কত সাহসী ও নির্ভিক যে পিতার আহবানে সাড়া দিয়াছিলেন। ইহা বড়ই মজার বিষয় যে, বাইবেলের এক বদ্ধ উন্মাদের স্থলে কোরআনে দুই বদ্ধ উন্মাদ পাওয়া গেল, এবং তাহাতে মুহম্মদ (সা) এর উম্মতদের ছাতি অনেক বাড়িয়া গেল!