শনিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০০৮

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর......

বিশ্বাস পর্বঃ 

আজ আপনাদের একটি গল্প শুনাবো
একটি প্রেমের গল্প, হৃদয় ছুয়ে যাবার মত প্রেমের গল্প- সত্য প্রেমের গল্প 

"মৃদুভাষী, লাজুক ছিপছিপে গড়নের যুবকটি তার নব পরিনীতা বউটিকে পাগলের মত ভালোবাসেবউটিকে আদর করার সময় প্রায়ই তার মনে হয়, যেন একটি পুতুল পুতুলের মত বউটিও কিন্তু যুবকটিকে দারুন ভালবাসে
দুটি যুব হৃদয় যেন একাকার,
ভালোবাসায়,
আস্থায়,
বিশ্বাসে.........
দুজনই দুজনকে খুব বিশ্বাস করে,
অনেকটা অন্ধের মতই.......

কেউ যদি বলে - আজ সূর্যটি পশ্চিমে উঠেছে, অন্যজনের মনে এতে সামান্য সন্দেহ বা প্রশ্ন জাগে না, যেন সূর্যের পশ্চিমে ওঠাটাই স্বাভাবিক- যদিও কেউ কখনও জানামতে এমনটি করেনা মানে মিথ্যে করে কিছু বলেও না.........
বউটি যুবককে কথা দেয়, তাকে ছেড়ে কোথাও কোনদিন যাবে না, যাবার কথা সে ভাবতেই পারে না এবং যুবকটিও একই কথা দেয়, কেননা সেও নিজেকে একা হিসাবে কখনও কল্পনা করতে পারেনা................
এমনই ভালোবাসায় আস্থায় বিশ্বাসে তাদের দিন কাটে সুখে শান্তিতে..............

দিন যায়
দিন আসে.......... 

তারপর অকস্মাত এক বিপত্তি!
একটি রোড একসিডেন্ট ভিলেনের রূপ নিয়ে আসে যুবকটির জীবনে
কোনরকমে যুবকটি প্রাণে বেঁচে গেলেও,.........
তার পুতুল বউটি মারা যায়!!

কিন্তু একথাটি কেউ তাকে বিশ্বাস করাতে পারে না
সে নিশ্চিত তার পুতুল বউ তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না, তাকে একা রেখে সে নিজে একা কোথাও যায় কি করে?

সে অপেক্ষা করতে থাকে,
তার পুতুল বউ নিশ্চয় আসবে.............. 

অবশেষে সত্যি তার পুতুল বউ একদিন আসে তার কাছে
সেই পুতুল বউ
সেদিন যুবকটি কত কথা বলে,
কত মান অভিমান,
কত প্রশ্ন,
কেন? কোথায়?
আমারে ছেড়ে?

আবার আগের মতই জীবন যাপন,

দুটি যুব হৃদয় যেন একাকার,
ভালোবাসায়,
আস্থায়,
বিশ্বাসে......... 

এমনই ভালোবাসায় আস্থায় বিশ্বাসে তাদের দিন কাটে সুখে শান্তিতে..............
দিন যায়
দিন আসে.........." 

গল্পটি পড়েছিলাম মানসিক রোগ সংক্রান্ত একটি কেস স্টাডিতেমনোরোগ বিশেষজ্ঞ ভদ্রলোকটি তার অসংখ্য কেস স্টাডি নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, তার একটি কেস স্টাডি থেকে গল্পটি নেয়া

প্রশ্ন হচ্ছে, যুবকটির বিশ্বাসটি শেষ পর্যন্ত তাকে আনন্দিত, উত্ফুল্ল, ও অনেকখানি শারিরিকভাবে সুস্থও করেছিল, তাহলে- তার বিশ্বাস ভাঙ্গিয়ে কি লাভ? তা তো তাকে বরং, আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে?
 

মনো-চিকিত্সকটির ভাষায়, যুবকটি সিরিয়াসলি মেন্টালি ডিসঅরডার্ডসে সারাক্ষণ থাকে একটি ঘোরের জগতে, তার স্বপ্ন ও বাস্তব এখন একাকার চিকিত্সক হিসাবে আমার দায়িত্ব তার ভুল ভাঙ্গিয়ে দেয়া, তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসা 

 

তর্ক পর্বঃ 

বিশ্বাসে পাওয়া বস্তু (যেমনটি ঐ যুবক পেয়েছে তার পুতুল বউকে) নিয়ে যদি কেউ সন্তুষ্ট থাকতে চান- তো আর কি আর করা!

আর যারা তর্কে বহুদূর যেতে চান,
তাদের উদ্দেশ্যে কিছু প্রশ্ন

আচ্ছা প্রশ্ন হিসাবে না দিয়ে প্রসঙ্গটি কথোপকথন আকারে উপস্থাপন করি......... 

:এই বিশ্বজগত, এই প্রকৃতি- সবই কত সুশৃঙ্খলভাবে চলতেছেযত দেখি ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে 

:তাহলে ক্যাটরিনা বা সুনামি বা সিডর - এই বিশৃঙ্খলা দেখে কি শ্রদ্ধা কমে

:নারে ভাই, সবই ঈশ্বরের লীলাহয়তো তিনি মানুষের পরীক্ষা নিচ্ছেন, নতুবা মানুষের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিচ্ছেন 

:শাস্তি

:জানেনতো, নুহের সময় মহা প্লাবনের কথা? সেটা তো শাস্তি ছিলতবে, এখন কেন ঈশ্বর এসব দিচ্ছেন, তা ঈশ্বরই ভালো জানেন 

:ভাই, বিশ্বজগতের সুশৃঙ্খলা দেখে আপনার ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা বড়েছে, নাকি ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধার কারণে- এসবের মধ্যে ঈশ্বরের মহিমা দেখেছেন

:মানে

:ঈশ্বরের ধারণাটি পাওয়ার পর আপনি তাঁর মহিমায় পঞ্চমুখ, নাকি সবকিছু দেখে শুনে তারপর আপনি ঈশ্বরের ধারণাটি নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেছেন? আপনার পিতামাতা বা পরিবেশ থেকেই তো জন্মের পর যে ধারণাটি পয়েছেন- তাইতো আপনার মধ্যে অপারেট করছে 

:না, আপনার কথা আংশিক ঠিকআমি হয়তো জন্ম থেকে এই বিশ্বাস পেয়েছি, কিন্তু প্রতিনিয়ত এই বিশ্বাস যুক্তি দিয়েই পাকাপোক্ত হয়েছে ও এখনও হচ্ছে চারপাশে চোখ-কান একটু খোলা রাখলেই ঈশ্বরের মহিমা সকলের কাছে পরিস্কার হয়ে যাবেআর, এমন অনেকেই আছে- যারা জন্মের সময় অন্য ধর্মের ছিল কিন্তু পরে ধর্মান্তরিত হয়ে আমাদের ধর্মে এসেছে 

:চোখে রঙ্গিন চশমা একবার উঠে গেলে, যতক্ষণ তা না খোলা হয় ততক্ষণ দুনিয়াটাকে রঙ্গিনই লাগেআর রঙ্গিন চশমা চোখে যতবেশি সময় ধরে থাকে ততই দুনিয়াটা রঙ্গিন- এ ধারণা আরো পাকাপোক্ত হতে থাকেআর, অনেকে যেমন আপনার ধর্ম গ্রহণ করেছে- তেমনি অনেকে আপনার ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে কনভার্ট হয়েছেএতে কি প্রমান হয়

:দেখুন, আমাদের ধর্মগ্রন্থে সেই কোন সময়ে- এ কথা বলা হয়েছে- এমন অবিশ্বাসী মানুষ যুগে যুগে আসবে, তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করবেএটাও ঈশ্বরের এক ধরণের পরীক্ষা 

:আচ্ছা, আপনি আপনার ধর্মগ্রন্থকে এত বিশ্বাস করেন, তার রেফারেন্স দিচ্ছেন- এর কারণ কি? আপনি কি একে বাছাই করে নিয়েছেন, মানে সব ধর্মগ্রন্থ পড়ে পার্থক্য বুঝে বাছাই করেছেন- নাকি, এটাও জন্মের পর থেকে আপনার মাথার ভিতরে প্রবেশ করেছে, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস জন্মেছে তারপর এটি এক ও অদ্বিতীয় গ্রন্থ হিসাবে আপনার আস্থা অর্জন করেছে?

:পরে কিন্তু আমি অন্য ধর্মগ্রন্থও পড়েছিখুব সহজেই পার্থক্য পরিস্কার হয় আমাদেরটিই একমাত্র, সঠিক ও ঐশী  

:আপনি অন্যগুলো পড়তে পারেন, কিন্তু আপনি আপনারটি পড়েছেন স্থির বিশ্বাস নিয়ে- ফলে যা কিছু পড়েছেন আপনার বিশ্বাস দিয়ে ব্যাখ্যা করে সন্তুষ্ট থেকেছেনআর অন্যদের গুলো পড়েছেন প্রথমেই স্থির অবিশ্বাস নিয়ে- ফলে যা কিছু পড়েছেন তার বিপরীতে একটা যুক্তি অটোমেটিক আপনার মধ্যে তৈরি হয়েছে 

:এখনকার বিজ্ঞানের অনেককিছুই কিন্তু আমাদের ধর্মগ্রন্থে পাবেনসেই কোন আমলে বুঝেন কিভাবে এই অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের আলোচনা স্থান পেল? 

:আপনি কি জানেন, অন্য ধর্মগ্রন্থেও কিন্তু স্ব স্ব বিশ্বাসীরা বিজ্ঞানের অনেক মিল খুঁজে পান? আচ্ছা বলেন তো - এই আপনার জন্ম যদি অন্য কোন ধর্মীয় পরিবারে হত আপনার অবস্থান কি অনুরূপ হতো? আজ আপনি যে শুকর বা গরু এত মজা করে খান- মুসলিম পরিবারে বা হিন্দু পরিবারে জন্ম হলে কি তা খেতে পারতেন

:কিন্তু তাদের অনেকে কিন্তু খায়! 

:সেরকম আপনার ধর্মের অনেকেই অনেক ধর্মীয় ভাবে নিষিদ্ধ কাজ কারবার করে- এটা করে দুকারণে- হয় রঙ্গিন চশমাটা খুলে ফেলে নয়তো- আরেকটা পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে অনেকটা সুবিধাবাদির কারণে 

:আপনি যে চশমার কথা উল্লেখ করেছেন, তা ছাড়া কি উপায়? যে মনে করে, সে চশমা ছাড়াই জগত টিকে দেখছে, সেও কি আসলে কোন রূপ চশমা পড়া নেই

:হুম, থাকতে পারেযেহেতু, প্রতিটি মানুষই একটি নির্দিষ্ট পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠে- তাই সেই পরিমন্ডলের প্রভাব তার উপর থাকতে বাধ্যসে বাচ্চাকাল থেকে যে ভাষা, যে কৃষ্টি, যে কালচারে বেড়ে ওঠে সেটাই তার মধ্যে অনেকাংশে গেথে যায়কিন্তু, পার্থক্যটি হচ্ছে এই যে, একদল এ বিষয়টিতে সচেতন নয়, আরেকদল জানে- আসলে এই সে যেভাবে কথা বলে, যেভাবে চিন্তা করে, যে সামাজিকতা পালন করে- তাতে তার পারিপার্শিকতার ভূমিকা অনেক; সে এটাও মনে করে যে, এই তার জন্মের টাইম স্পেস সামান্য চেঞ্জ হলেই তার সমস্ত কিছুই অন্যরকম হতোফলে, অহেতুক সে তার জন্ম কেন্দ্রিক প্রাপ্ত বিষয় নিয়ে গর্ব বোধ করে না 

:অন্যসব কিছু জন্মের পর পাওয়াটা নিয়ে কিন্তু বলছেন না- তাহলে শুধু ধর্মের ব্যাপারে এটা খারাপ হলো কেন? এটা কি এইজন্যই না যে, অন্যকিছুর ক্ষেত্রে মানুষকে সেগুলো থেকে বিরত রাখতে পারবেন না, -মানুষকে অবশ্যই একটি ভাষা দিতে হবে, সে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট কালচারে বেড়ে উঠবে, এগুলোতে কিছুই করার নেইএসবে সমস্যা না থাকলে- মানুষ যদি কোন ধর্মীয় পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠে, তাতে কি সমস্যা?    

:ভাষা যেহেতু মানুষের মধ্যকার যোগাযোগের মাধ্যম, জ্ঞান বিনিময় ও সৃষ্টিরও মাধ্যম, সেটাকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই, কিন্তু- এই ভাষা স্থবির নয়- তা নদীর স্রোতের মতই চলমানযুগযুগ ধরে অসংখ্য মানুষের সম্মিলিত ফল আজকের একটি ভাষা এবং আজকের ভাষাও একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসে থাকছে না সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাইআর, এসব- মানুষকে ততখানি চিন্তাগত ভাবে বদ্ধ করে না যতখানি ধর্ম মানুষকে করেএকজন মানুষ যত সহজেই তার আচার- আচরণ, কালচার, এমনকি কোন কোন দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টায়, ততো সহজে তার ধর্মীয় সংস্কার ত্যাগ করতে পারে নাফলে এক্ষেত্রে ঐ চশমাটির প্রভাব অনেক বেশি মারাত্মক ও স্থায়িতাইতো, এই চশমা চোখে না ওঠাটাই কাম্য

:কিন্তু আজ ক'জন মানুষকে পাবেন আপনার ঐ চশমা না পড়া? সবাই(হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া) কিন্তু ধর্মীয় পরিমন্ডলেই বড় হয়, বিশ্বাস নিয়েই বড় হয়, তার মানে কি এই- সবাই(হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া) কোন যুক্তি জানেন না, সবাই অন্ধ, সবাই সংস্কারগ্রস্ত

:সবাই যদি এহেন ধর্মীয় পরিমন্ডলে জন্মগ্রহণ করে এবং তার চিন্তাজগতে তার প্রভাব থেকে থাকে তবে সবাইকে সেদিক দিয়ে বলতেই হবে সে বিষয়ে সে যুক্তি মানে না, সে অন্ধ, সে সংস্কারগ্রস্ত বিজ্ঞানী রন্টজেন যখন এক্সরে আবিস্কার করেন, তার পরীক্ষার ফলাফল তিনি গ্রহণ করতে দেয়নি, তার প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস তাকে বলে, এটা সম্ভব না, কিন্তু তার বিজ্ঞানলব্ধ আবিস্কার তাকে বলে ধর্মে যা দেখেছো তা সত্য নাশেষ পর্যন্ত সে তার গবেষণাপত্র ধংস করতেও উদ্যত হয়এখন, তার গবেষণা, তার অধ্যবসায়, তার অ্যানালাইসিস- এসব দেখে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, বিজ্ঞানের সেসব শাখায় সে যথেস্ট জ্ঞান রাখেন, যুক্তিবোধও আছে; কিন্তু ধর্মীয় বোধের ব্যাপারে সে ততখানিই যুক্তিহীনআর তার ক্ষেত্রে যখন এই দুই বোধ মুখোমুখি হলো, তার যুক্তিহীনতা জয়যুক্ত হলোঅনেকের ক্ষেত্রে যুক্তি জয়ি হতে পারেতবে বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এই দুইবোধ মুখোমুখি হয়না 

:তাহলে বলছেন, সবাই অন্ধ? সকলের সম্মিলিত জ্ঞানের কি কোন মূল্য নেই

:সবাইকে অন্ধ বললে- হাজার অন্ধের সম্মিলিত দেখার চেয়ে একজন ভালো চক্ষুঅ'লা মানুষের বেশি দেখার কথা নয় কি? আপনাদের ধর্মের আগমনের ইতিহাস দেখেন- যে সময় যে প্রবর্তকের হাত ধরে তা এসেছে, সে সময় তিনি কিন্তু সর্বপ্রথম একাই ছিলেনতখনকার জন্য কি বলবেন, সকলের সম্মিলিত জ্ঞানের কি মূল্য নেই

:আচ্ছা, এই চশমাটি তো, একজনকে ন্যায়-অন্যায়ের বোধ দিচ্ছে, তাই নয় কি? জন্মের পর থেকে পাওয়া এসব বোধের কারণেই মানুষ- সত্য মিথ্যা সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছেচশমা পরিহার করলে সেটা মানুষের জন্য আরো বিপদ বয়ে আনবে না কি? আর, সত্য-মিথ্যা তাহলে কোনটি? ঠিক-বেঠিক বলে কি তাহলে কিছুই নেই? সমস্ত কিছুই মানুষের পরিবেশ থেকে পাওয়া কিছু ধারণা মাত্র? 

:আমি কিন্তু বলিনি সত্য-মিথ্যা নেই, ন্যায়-অন্যায় নেই, ঠিক-বেঠিক নেইআমি যা বলেছি তা হলো, এ সমস্ত কিছুই চলমান ও গতিশীল, তা স্থির নয়এসমস্ত কিছুর সাথে টাইম-স্পেসের সম্পর্ক জড়িত সত্য-মিথ্যাকে একটি নির্দিষ্ট স্থান/কালের ভিত্তিতেই বিচার করতে হয় নির্বিশেষ বা চরম সত্য বা মিথ্যা বলে কোন কথা থাকতে পারেনা 

:আপনি এ মুহুর্তে যে ধারণাটির কথা বললেন- সেটাও কি পরিবেশ থেকে পাওয়া না? সেটাকে কি বলবো- নির্বিশেষ না চরম? আর সত্য নির্ধারণের মাপকাঠি তাহলে কি হবে? ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণেরই মাপকাঠি কি হবে

:হুম, এটাকেও চরম সত্য বলবো না এই কারণে যে, টাইম-স্পেসের প্রয়োজনীয়তা বলি আর ধারণার কথা বলি- তা আমাদের মানুষের ক্ষেত্রে বিশেষআর এই বিশেষকে বিবেচনা করেই, বলছি- সত্য-মিথ্যা নির্ধারণে বর্তমানে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনই কার্যকর যাছাই-বাছাই, যুক্তি-তর্ক, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, বিজ্ঞান এসবই একটি সময়ের- একটি নির্দিষ্ট পেরিফেরিতে সত্য নির্ধারণের মাপকাঠি হতে পারে ন্যায়-অন্যায় বোধ যেহেতু মানুষকে কেন্দ্র করে, সমগ্র মানব জাতিকে বিবেচ্য ধরেই এর মাপকাঠি হতে পারে 

:আপনার কথা মত মাপকাঠিকে সত্য ধরে- এই বিজ্ঞানকে ধরেই, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে বিবেচনায় নিয়েই বলি- আমাদের ধর্মটি সত্যসমগ্র মানব জাতিকে বিবেচ্য ধরেই বলছি, আমাদের ধর্মই দিতে পারে প্রকৃত ন্যায়ের সন্ধানআজকের আধুনিক বিজ্ঞান, বিগ-ব্যাঙ্গ থিওরি বলেন আর জীবের সৃষ্টি বলেন আর গ্রহ-নক্ষত্রের গতি- তাদের সম্প্রসারণশীলতা বলেন সব কিছুই কিন্তু হাজার বছর আগের আমাদের ধর্মগ্রন্থে পাবেনআরেকটি কথা,- মানুষ বলেন আর বিজ্ঞান বলেন, কেউ কিন্তু কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারে নাযা পারে, অলরেডি যা একজিস্ট করে তা আবিস্কার করতে 

:এটা আপনার ব্যক্তিগত ধারণা, যে ধারণাটি তৈরি হতে আপনার সেই ধর্মীয় বিশ্বাস বোধ তথা রঙ্গীন চশমাটি ভূমিকা নিয়েছে, এবং যার সাথে প্রকৃত সত্যের কোন সম্পর্ক নাও থাকতে পারেসত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রমান চাই, চাই অন্ততপক্ষে কিছু যুক্তি; তা না হলে আপনার কথা হয়ে যায় আপনার ধারণাপ্রসূত কিছু সিদ্ধান্ত ন্যায়ের কথা যদি বলেন, তবে স্বীকার করি, সেই সময়ে এর মানব কল্যাণে একটা ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিলকিন্তু, তা কি উষালগ্নে প্রায় সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়? ইবনের পূর্বেকার রীতি নরবলী প্রথা রদ করে পশুবলী প্রথা চালুতে মানব জাতি যতখানি উপকৃত হয়েছে তার জন্যই তো মানুষ তাঁকে স্মরণ রেখেছেমানুষ যুগে যুগে সেসব ব্যক্তিকেই স্মরণ রাখে যারা বীর নতুবা যাদের দ্বারা একটা সময় মানবকূল সবিশেষ উপকৃত হয়েছেকিন্তু, আজকের মত লিখন যন্ত্র তথা মুদ্রণ যন্ত্র আবিস্কারের পূর্বে মানুষ সেসব ব্যক্তিকে স্মরণ রাখতো মুখে মুখে বংশ পরম্পরায়, ফলে সেসব ক্যারেক্টার মিথিকাল ফর্ম পেয়ে যেতআমাদের এ অঞ্চলের রামের কথাই ধরুন, সে-তো আসলে একটা কাপুরুষ, রাবনের তুলনায় যুদ্ধবিদ্যায়ও নিতান্ত ছেলে মানুষ- তাকে জিততে হয়, ভগবানের সহায়তায় হনুমানকে সাথে নিয়ে- তারপরও পারে না শেষ পর্যন্ত তাকে কন্সপিরেসি করতে হয় বিভিষণকে হাত করতে হয়সীতার প্রতি তার আচরণও কাপুরুষতায় ভরাতথাপি, এহেন একজনকে ব্যক্তিকে বংশ-পরম্পরায় স্মরণে রাখলো কেন মানুষ, তাকে এমন দেবতার মত শ্রদ্ধার উচ্চ আসনে কেন বসালো? সেটাও কিন্তু মানুষের প্রতি অবদানের জন্য, সেটি হচ্ছে কৃষিতে বিশেষ অবদানকৃষির প্রতি এই অবদান মূর্ত হয়ে ওঠে রামায়নের ছত্রেছত্রে মিথিকাল রূপকের ভিতর দিয়েসীতার লাঙ্গলের ফলায় করে আবির্ভাব আবার শেষ পর্যন্ত ধরিত্রি মাতাতেই বিসর্জন, এমনই অনেক রূপকের ভিতরে পাওয়া যায় কৃষি, কৃষি জমির বন্দনা 

:এটাও কি আপনার মনগত ধারণা নয়? বা ধারণা-প্রসূত সিদ্ধান্ত নয়? আপনার এ বক্তব্যের কোন প্রমান আছে

:না যেহেতু ঘটনাকাল সুদূর প্রাচীণ সেহেতু কোন প্রত্যক্ষ প্রমান দেয়া সম্ভব নয়তবে, ইতিহাসবিদরা, নৃত্বাত্তিকরা এভাবেই অতীতের বা প্রাচীণ যুগের ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করেন; মসেস এর নীল নদকে শাসন সংক্রান্ত মিথকে সেচ ব্যবস্থায় তাঁর বিশেষ ভূমিকা হিসাবেই তাঁরা দেখান, এভাবেই বিভিন্ন গুহা চিত্র দেখে তাঁরা প্রাচীণ আমলের লোকদের জীবনপ্রণালী সম্পর্কে ধারণা দেনসবই সম্ভাবনা হিসাবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয় ঠিকই, কিন্তু এসব সম্ভাবনার সত্যের কাছাকাছি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি 

:বই থেকে পাওয়া এসব জ্ঞানকে সত্য মনে করেন? সব বইতেই কি সত্য লেখা থাকে

:হ্যা এসব কে এখন পর্যন্ত সত্য বলে মানি, কেননা এর বিপরীত কোন বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি পাইনি এখনও 

:আর বিজ্ঞান নিয়ে কি বলবেন? বিগ ব্যাঙ থিওরি কতদিন আগের আবিস্কার, কিন্তু সেই কোন আমলে আমদের ধর্মগ্রন্থে সে আলোচনা করে গেছেন আমাদের ঈশ্বর! আজকের বিজ্ঞান বলে জীব সৃষ্টির শুরুর দিকে সাগরের বুকে অ্যামিবা নামক প্রাণীর উদ্ভব, এই বিজ্ঞানও কিন্তু বেশি আগের নাঅথচ, সে কোন আমলে হাজার বছর আগে আমাদের ধর্মগ্রন্থে এটিও পাবেন   

:আপনি যে মিলের কথা বলছেন, তাতে একটা বড় গলদ থেকে যাচ্ছেআপনি বিগ ব্যাঙ থিওরি পড়েন ও আপনি আপনার ধর্মগ্রন্থের এক/দু লাইনের ঐ সংক্রান্ত আলোচনা পড়েন, পাশাপাশি পড়েন- পার্থক্য বুঝতে পারবেনএক জায়গায় ডিটেইলসে পাবেন যুক্তি-প্রমাণ নির্ভর ও গাণিতিক ব্যাখ্যা সহকারে আলোচনা, আর অন্যদিকে পাবেন খুবই সাদাসিধে এক-দুটি বাক্য- যার সাথে কোনভাবেই বিজ্ঞানের আলোচনার কোন মিল পাওয়া যাবে না'আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী মিশে ছিল ওতপ্রোতভাবে?' 'ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিবস এবং সূর্য ও চন্দ্র; প্রত্যেকেই বিচরণ করে আপন আপন কক্ষপথে' এই লাইনসমূহকে বিগ ব্যাঙ থিওরির সমার্থক মনে কি হয়? আকাশমন্ডলী বলতে আজকের বিজ্ঞানে আমরা কি বুঝি? 'প্রাণবান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে'- আপনাদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত এই লাইনটির মাধ্যমেও আপনারা আপনি দাবি করছেন, বর্তমান বিজ্ঞানের জীবসৃষ্টি সংক্রান্ত আলোচনা আপনাদের ধর্মগ্রন্থেই কত আগেই করা হয়েছে! অথচ, বিবর্তন সংক্রান্ত বিজ্ঞানের বাকি আলোচনা কি আপনাদের ধর্মগ্রন্থ সমর্থন করে? সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে অ্যামিবা সমুদ্রে তথা পানিতে অবস্থান ছিল, কিন্তু অ্যামিবার গঠন উপাদান কি শুধুই পানি? অ্যামিবার আরো আগের পর্যায়ের যে জীব অণু, যে নিউক্লিয়িক এসিড- তার গঠন উপাদান কি? এভাবে বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের কোন কথাকে মিলিয়ে দেয়াও এক ধরণের অন্ধতা

এ প্রসঙ্গে, আরেকটি কথা বলতে চাই, নিউটনের ১ম গতিসূত্র আবিস্কারের ২ সহস্রাধিক বছর আগে(খৃষ্টের জন্মেরও ৩০০/ ৩৫০ বছর পূর্বে) এরিস্টোটল বলেছেন, বায়ুশূণ্য অবস্থায় বস্তু একই অবস্থানে থাকবে নতুবা সমগতিতে চিরকাল চলতে থাকবে এরিস্টোটল তার সিদ্ধান্তের পেছনে কোন প্রমাণ তো হাজির করতে পারেনই নি, বরং পরক্ষণেই তার সেই আবিস্কারকে অস্বীকার করেছেন এই ধারণা থেকে যে, বায়ুশূণ্য স্থান থাকতে পারে না, ফলে ইহা অসম্ভব কোপারনিকাসেরও সহস্র বছর পূর্বে আর্যভট্ট (৪৭৬ খৃস্টাব্দ) বলেছেন, পৃথিবী গোলাকার, এটি নিজ অক্ষের চারদিকে ঘুরে এবং সাথে সাথে এটি সূর্যকেও প্রদক্ষিণ করে ভাস্করাচার্য (২), নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র প্রদানেরও ৫ শতাধিক বছর পূর্বে বলেছেন, পৃথবীতে বস্তুসমূহ পতিত হয় পৃথিবীর টানেই, এবং পৃথিবী, গ্রহসমূহ, জ্যোতিস্কসমূহ, চাঁদ ও সূর্য নিজ নিজ কক্ষে এই আকর্ষণের কারণেই অবস্থান করেএমন আরো উদাহরণ দেয়া যেতে পারেএটা এ কারণে প্রয়োজন যে, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশটি বুঝা খুবই দরকারওনারা (এরিস্টোটল, আর্যভট্ট, ভাস্করাচার্য) জ্ঞান সৃষ্টিতে নিরলস সাধনা করেছেন, পৃথিবীর মানুষকে করেছেন ঋদ্ধআর সমসাময়িক ধর্মগুলো কিন্তু তাদের সময়কার প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি, ফলে তাদের ধর্মগ্রন্থেও স্থান পেয়েছে সেসব জ্ঞানতেমনি উদাহরণ আপনার ধর্মগ্রন্থের বিজ্ঞান সম্পর্কিত আলোচনাসমূহ


[সামহোয়ার ইন ব্লগ, মুক্তমনা ও সচলায়তনে (, , , ) ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সালে প্রকাশিত]

কোন মন্তব্য নেই: