বাংলাদেশের আজকের এই ভয়ানক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে দেশে ও দেশের বাইরে জনমত তৈরির অংশ হিসাবে একটা আন্তর্জাতিক যৌথ বিবৃতির জন্যে কাজ করছি। তারই অংশ হিসাবে অনেকের সাথে যোগাযোগ করছি। তার মাঝে ইউরোপের একজন হিউম্যানিস্টের সাথে আলাপ হচ্ছিল।
তিনি বললেন, তোমরা কি এই বিবৃতি নিয়ে মডারেট মুসলিম সংগঠনগুলোর কাছে যাচ্ছো না, যারা ইসলামের নামে এইরকম হত্যা খুনের প্রবল বিরোধিতাকারী!
জবাবে আমতা আমতা করে- হ্যা না করছি দেখে আবার জিজ্ঞাসা করলো- বাংলাদেশে কি এরকম কোন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, ইমাম, নেতা কেউ নেই, যিনি এসবের বিরোধিতা করেন?
- হ্যা আছে। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত- শোলাকিয়ার খতিব বলেছেন, "নাস্তিক আখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যা ইসলাম সমর্থন করে না"- এবং তিনি ঘোষণা দিয়েছেন এইরকম হত্যার বিরুদ্ধে তিনি এক লাখ আলেমের স্বাক্ষর সংগ্রহের চেস্টা করছেন।
- বাহ, খুবই ভালো! তোমরা ওনাদের সাথে যোগাযোগ করছো না? এরকম মানুষদের স্বাক্ষর নিচ্ছো না?
- না, মানে - আসলে হয়েছে কি, আমাদের নাস্তিক মুক্তমনা বন্ধুদের বড় অংশই এই মডারেট মুসলিমদের সন্দেহের চোখে দেখে।
- কি রকম?
- 'ইসলাম হত্যা সমর্থন করে না'- এরকম বক্তব্য দিলেই সকলে কোরআন হাদীস কোট করে দেখিয়ে দেয়, আসলে ইসলাম হত্যা খুনকে সমর্থন করে।
- স্ট্রেঞ্জ! এটা তো নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার মত! শত্রু মিত্র ঠিকভাবে চিনতে পারছো না তোমরা?
- প্রধান ও একমাত্র শত্রু তো আল্লা, আল্লার নবী এবং কোরআন!
- তাহলে সবার নাস্তিক হওয়া ছাড়া কোন উপায় নাই! এটা কি বাস্তব সম্মত?
- অবাস্তব হতে পারে, কিন্তু আস্তিক মুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন দেখে তারা।
- হ্যা, সেই স্বপ্ন দেখা স্বাভাবিক! কিন্তু সমস্ত কিছুর তো ধারাবাহিকতা থাকতে হয়! তুমি একলাফে গাছের আগায় উঠতে পারবে না! আজকে ইউরোপের যে এনলাইটমেন্টের ফল দেখছো, একে একে চার্চগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে- এটা কি একেবারে সম্ভব হয়েছে? ইহুদি- খৃস্টান ধর্মগুলোকে সেক্যুলারাইজ করা, অর্থাৎ বাইবেলে যাই থাক- মানুষের সমাজে, তার আইন কানুনে এবং বর্তমান নৈতিকতায় সেগুলোর কোন প্রভাব রাখা যাবে না- এটা আগে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে। বাইবেলেও এপোস্টেটকে খুন করার কথা অসংখ্যবার বলা আছে, এমন নয় যে- যারা ধার্মিক, তারা বাইবেলকে ভুল মনে করে, তারপরেও সাধারণ ধার্মিক তো বটেই, এমনকি পোপকেও যদি গিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়- এই এপোস্টেটকে খুনের কথা বলা হয়েছে, বিধর্মীদের খুনের কথা বলা হয়েছে- এ সম্পর্কে এখনকার বিধান কি হবে- তিনি জবাব দিবেন, আজকের দিনে এটা প্রযোজ্য নয়, ঐ সময়ে ঐ সমাজে ওটার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা ছিল। তিনি বাইবেলেরই অন্য যেসব শান্তির বানী আছে- সেগুলো বলে দেখাবেন যে- বাইবেল এরকম ঘৃণা অনুমোদন করে না।
- আমাদের অনেক মডারেট মুসলিম এ কাজটি করে। কিন্তু আমাদের নাস্তিক বন্ধুরা তাদের প্রচন্ড সমালোচনা করে- কেননা তারা মনে করে, হত্যা- খুনের যে রক্ত ইসলামের গায়ে লেগে আছে, মডারেট মুসলিমরা সেটা ইসলামের গা থেকে তুলে দিয়ে মানুষকে ইসলামের পথে রাখছে।
- ইসলামের গা থেকে হত্যা খুনের রক্ত সরালে তোমাদের সমস্যা কোথায়? বাংলাদেশের সমস্ত মুসলমান যদি এরকমই মনে করে যে, ইসলাম হত্যা খুন সমর্থন করে না, কেউ নাস্তিক হলে আল্লাহই তার বিচার করবে, তাহলে সেটা তোমাদের জন্যে কি সুবিধাজনক নয়? এরকম সহাবস্থানে সহনশীল মুসলমানরা থাকলে কি তোমাদের কথা তোমরা আরো ভালোভাবে বলতে পারতে না?
- হ্যা, মডারেটরা যে আবার নাস্তিকদের সমালোচনাও করে?
- কি অবাক? সমালোচনা করবে না? সমালোচনায় কি সমস্যা, সমালোচনা- পাল্টা সমালোচনাই তো মুক্ত মত প্রকাশে সহায়ক।
- সমালোচনা মানে, তারা যেমন বলে- ইসলাম হত্যা সমর্থন করে না, হত্যাকারী খুনীদের বিচার করো, তেমনি আবার বলে নাস্তিকদেরও উচিত না- ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া।
- এটা বললে কি সমস্যা? তারা তাদের মতটা প্রকাশ করছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ধার্মিকদের জন্যে অনেক সময় আনটলারেবল হয়ে যায়। তারা নিজেরা ধার্মিক বলে সেটা বেশি অনুভব করতে পারে। কিন্তু এই বক্তব্যের মাঝে তো অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত মুসলিমদের টলারেন্ট হওয়ার আহবানটাই মূল। অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টা তোমরা না মানতে পারো, সেটার কাউন্টার করো। কিন্তু মুসলিমদের টলারেন্ট করার আহবানকে কেন ইতিবাচকভাবে দেখতে পারছো না?
- কিন্তু কোরআন - হাদীসে আসলেই আছে যে, নবীর প্রতি কটুক্তিকারীকে, বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে, কেটে টুকরো টুকরো করতে হবে। ফলে, তারা কি সত্য বলছেন?
- এর জবাবে তারা কিছু বলছেন না? বাইবেলের ক্ষেত্রে যেমন ব্যাখ্যা দেয়া হয়- ঐ আমলে প্রযোজ্য থাকলেও আজকের যুগে এটা প্রযোজ্য নয়।
- বাইবেলের ক্ষেত্রে এই ব্যাখ্যা সবাই মানছে। কিন্তু ইসলাম আলাদা। মুসলমানরা দাবী করে, কোরাআন হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এটা সরাসরি আল্লাহর বিধান এবং কেয়ামত পর্যন্ত এর প্রতিটা বাক্য প্রযোজ্য হবে।
- কোরআন শুধু না, প্রতিটা ধর্মগ্রন্থ এরকম মনে করে। ধর্মগ্রন্থ মানেই আল্লাহ বা গডের কথা, ঐশ্বরিক গ্রন্থ, ফলে অভ্রান্ত ও অলঙ্ঘনীয়! বাইবেলকে কেন্দ্র করে তো ইউরোপে কম রক্ত ঝরেনি। ডাইনি আখ্যা দিয়ে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে অসংখ্য জনকে! তোমাদের তো চাপাতি দিয়ে হুট করে পেছন থেকে মারছে, ইউরোপে একটা সময়ে পুরা শহর এক হয়ে ডাইনি আখ্যা দিয়ে, যাদুকর আখ্যা দিয়ে- সবাই মিলে পুড়িয়ে মেরেছে! ওই পরিস্থিতি থেকে ইউরোপ রক্ষা পেয়েছে কিভাবে? ঐ সময়ে বাইবেল ভুল, গড ভুল- এইসব বলে কি রক্ষা পাওয়া যেত? পরিবর্তন মূলত এসেছে- সেই মডারেট সেইন্টদের হাতেই- সেইসব সংস্কারবাদী ধর্মীয় নেতাদের হাতেই - যারা ঘোষণা করেছিল- বাইবেলের এইসমস্ত বিষয়াদি- আজকের যুগে, আজকের সমাজে প্রযোজ্য নয়। তাদের সেই ভূমিকাকে আমরা স্বীকারই শুধু করি না, শ্রদ্ধাও করি। নাস্তিকদের প্রতি ধার্মিকদের টলারেন্ট করতে পেরেছিল বলেই তো আজ আমরা বাইবেলকে, গডকে, যীশুকে গালি দিতে পারি, ব্যঙ্গ করতে পারি।
- কিন্তু মুসলমানের পক্ষে কি আসলেই সম্ভব, নাস্তিকদের সহ্য করা? কোরআন- নবীর প্রতি কটুক্তি সহ্য করা?
- সম্ভব না হলে, এত এক্স-মুসলিমস কিভাবে ইসলাম ত্যাগ করলো কিভাবে? তারা তো ধর্ম ত্যাগের আগে মডারেটই ছিল বেশিরভাগ, তাই না? মানে, যারা সালাফি অর্থাৎ নবী কোরআন নিয়ে কিছু কথা শুনলেই কানে হাত দিবে- বা চাপাতি নিয়ে ছুটে আসবে- তাদের পক্ষে ইসলাম ত্যাগ করার চাইতে যারা সহনশীল এবং মন দিয়ে বিপরীত চিন্তা শুনতে পারে- তাদের পক্ষে ইসলাম ত্যাগ করা সহজতর নয়কি?তুমি কি বলতে পারবে, তোমার চারপাশে এমন কোন মুসলমান নাই যে, তুমি নাস্তিক জেনেও তোমার সাথে সহজ সম্পর্ক রেখেছে, তোমাকে বন্ধুও ভেবেছে? ওরাই মডারেট! এরা কি চাপাতি ওয়ালাদের চাইতে তোমার জন্যে সহায়ক নয়?
- হ্যা, এই মডারেট বন্ধুদের অনেকে জানেই না যে, কোরআনে কি আছে নাই। তারা অন্ধভাবে বিশ্বাস করে, কোরআনে খুন হত্যা নাই, ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম নারীদের সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়। সত্য জানানো হলে তাদের বোধোদয় হয় এবং ইসলামের প্রতি সেই অগাধ আস্থাও অনেকের দূর হয়ে যায়! আমরা যেভাবে নাস্তিক হয়েছি। আগে ইসলামকে যেভাবে জানতাম, কোরআন পড়তে গিয়ে দেখি- ইসলাম সম্পর্কে যে ধারণা ছিল, তা ভুল! ফলে, কোরআন- হাদীসের এই ঘৃণা, নারীর প্রতি অবমাননাকর কথাগুলো মানুষ জানলে কি তাদের ধর্মত্যাগের সম্ভাবনা বাড়ে না?
- হ্যাঁ সেটা ঠিক আছে। মডারেট মুসলিম যারা কোরআন হাদীসের ঐসব সমস্ত না জেনে কিংবা জেনেও ভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশনের মাধ্যমে, এখনকার নীতি নৈতিকতাকে, আজকের দুনিয়ার সেক্যুলার আউটলুক ধারণ করার কারণেই মডারেট। এই মানুষগুলো যেহেতু নাস্তিক ও বিধর্মী কিংবা ভিন্নমত ভিন্নচিন্তার সাথে সহাবস্থানে আপত্তি দেখে না, সেহেতু তার সাথে আলাপে ইসলামের ভুল ভ্রান্তি, বিজ্ঞানের সাথে কনফ্লিক্ট, এর মধ্যকার হিংসা- নারী বিদ্বেষী বক্তব্য দেখিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে তাকে নাস্তিকতার পথে আনা সম্ভব! কিন্তু, সেই সাথে চিন্তা করো তো- যারা এইসব ঘৃণার বানী- নারী বিদ্বেষী বক্তব্য পড়ে, জেনে বুঝে ধার্মিক, তোমাদের মাদ্রাসার ঐ সব ছাত্র, যাদের সিলেবাসে এগুলো নিয়মিত পড়ানো হয়, কিংবা আইএস- আলকায়দার প্রচারিত বক্তব্য- যেখানে ঠিক এই হাদীস কোরআন প্রচার করার মাধ্যমেই যারা ধর্মপ্রাণ মানুষকে রিক্রুট করে, তাদের জন্যে কিন্তু এভাবে ইসলামকে জানা কোন কাজে লাগছে না, ইসলাম ত্যাগ তো তারা করছেই না- উলটো সালাফিবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। ফলে, কোন স্টেজ আগে দরকার? সালাফিজম থেকে মডারেট মুসলিম হওয়া? নাকি মডারেট মুসলিমদের ধরে ধরে নাস্তিক বানানো? এটাও কি ভেবে দেখেছো তোমরা, এই ঘৃণার বানীগুলোই কোরআন- হাদীস সম্মত- এই প্রচারের মাধ্যমে কতজন মডারেট মুসলিমকে নাস্তিক বানাতে পারছো, আর কতজন মডারেট মুসলিম সালাফিজমে ফিরে যাচ্ছে, সেই হিসাব কি করছো তোমরা?
- তাহলে কি নাস্তিকেরা ইসলামের, নবীর, কোরআনের সমালোচনা করবে না? এসব সমালোচনা বন্ধ করে দিবে?
- না, সেটা কেন বন্ধ করে দিবে? কিন্তু শত্রু মিত্র তো চিনতে হবে! যারা কোরআনের সেই সব হিংসার বানী থাকার পরেও সেগুলোকে মানছে না, চাপাতি সাথে সাথে হাতে নিচ্ছে না, তাদের তো আইএস- আল কায়দার চাইতে তুলনামূলক এগিয়ে থাকা ধরতে হবে, এবং সেই আলেমদের বক্তব্য সালাফি আলেমদের তুলনায় মুসলিম সমাজে বেশি প্রচারিত হলে নাস্তিকদের প্রতি সহনশীল পরিবেশ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাই বাড়ে। এটায় ক্ষতি কি? ফলে, 'এ ধরণের আলেমদের ইসলাম আসল ইসলাম না'- এই দাবি নাস্তিকদের করার দরকার কি? কোরআন বা হাদীসই যে আসল ইসলাম- এটাই বা কে বলেছে? কোরআন হাদীসকে তো ঐশ্বরিক গ্রন্থ হিসাবে যদি না মানি, তাহলে আসল- সহী বলে কি কিছু থাকে? তাছাড়া হাজার বছরের পুরাতন গ্রন্থের নানারকম ইন্টারপ্রিটেশন থাকাটাই স্বাভাবিক, যুগের পরিবর্তনে যুগের সাথে তাল মিলিয়েও নানা ইন্টারপ্রিটেশন থাকাটা স্বাভাবিক, এমনকি খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগেই নবীর বক্তব্য, আল্লাহর বক্তব্য নিয়ে মতভেদ হয়েছে, কোরআন হাদীস লিপিবদ্ধের ইতিহাসেও অনেক রকম ঘটনা পাওয়া যায়, মাযহাবের ইতিহাসও নানারকম ইন্টারপ্রিটেশনের ইতিহাস, সুন্নি- শিয়াদের ট্রেইট বলো, শিয়াদের অনেক ইমাম বলো, আহমাদিয়াদের বলো- এসবই সেই পরিবর্তন, সংস্কারের কথা বলে। ফলে, সুন্নি সালাফিরা যেভাবে কেবল নিজেদের ট্রেইটকেই একমাত্র ও অলঙ্ঘনীয় বলে দাবি করছে, সেটার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই কি এই মুহুর্তে জরুরিতম নয়?
(কথপোকথনটি নিজের ভাষায় এবং অনেকাংশে নিজের মত করে বিস্তৃত করা হয়েছে। তবে সেই হিউম্যানিস্টের কথার মূল ভাব অক্ষুন্ন রাখা হয়েছে।)
[ফেসবুক পোস্ট হতে]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন