তিনি বলেন, “সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যদি বাতিল হয় তাহলে রাষ্ট্রীয়ভাবে, সাংগঠনিকভাবে কোনো মুসলমান তার মুসলমান পরিচয় নিয়ে থাকতে পারবে না। কোনো মুসলমান মুসলমান থাকতে পারবে না”। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষদেরও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রক্ষার আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “ইসলাম শান্তির ধর্ম। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকলে সবার জন্য শান্তি আসবে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সব সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য শান্তি হবে”। এমনই শান্তির ধর্ম যে, তারা জিহাদের হুমকি দেয়, ইসলাম রক্ষায় কোটি তৌহিদি জনতার বুকের তাজা রক্ত ঢেকে দেয়ার কথা বলে। যে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে আহবান জানাচ্ছেন তিনি- রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকার পরেও যদি তারা থাকতে পারে, তাহলে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে কোন বিশেষ ধর্ম না থাকলে- কেন কোন মুসলমান মুসলমান থাকতে পারবে না- সেই ব্যাখ্যা বাবুনগরীর কাছ থেকে জানা দরকার। মুসলমানের একমাত্র সংবিধান কোরআন, যে কোরআন না থাকলে মুসলমানও থাকবে না- এই কথা সারাজীবন শুনে এসে- আজ বাবুনগরীর বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে- কোরআন, কালেমা, নবীর শিক্ষা তথা সুন্নাহর চাইতেও তাদের কাছে যেনবা একটা রাষ্ট্রের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ইসলামের থাকা না থাকাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ! দুনিয়ার অধিকাংশ দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নয়- সেইখানে কি ইসলাম নেই, এমন প্রশ্নও খুব স্বাভাবিকভাবে আসে।
বাবুনগরীঃ রাষ্ট্রধর্ম বাতিল হলে জেহাদ

বাবুনগরী আরো যুক্তি করেন, “ফুল অনেক আছে, কিন্তু জাতীয় ফুল শাপলা। মাছ অনেক আছে, কিন্তু জাতীয় মাছ ইলিশ। ফল অনেক আছে, কিন্তু জাতীয় ফল কাঁঠাল। ভাষা অনেক আছে কিন্তু আমাদের জাতীয় ভাষা বাংলা। তাহলে ধর্ম অনেক থাকলেও রাষ্ট্রধর্ম কেন ইসলাম হবে না”? বড়ই তীক্ষ্ণ যুক্তি বলতে হবে বৈকি! ফুল, মাছ, ফল- এসবের কাতারে ধর্ম তথা শাপলা- ইলিশ- কাঁঠালের কাতারে ইসলামকে তারা নিয়ে যাচ্ছেন, এটা বড়ই কৌতুকপ্রদ। যে সংখ্যাগরিষ্ঠের জোর তারা দেখাচ্ছেন- শাপলা, ইলিশ, কাঁঠালের সেই দাবি নাই, এমনকি বাংলাদেশে শাপলা, ইলিশ ও কাঁঠাল যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ ফুল, মাছ ও ফল হইতো তাতে মানুষের কোন যায় আসতো না, যেমন করে- রয়েল বেঙ্গল টাইগার বিলুপ্ত প্রায় হওয়ার পরেও এইটারে জাতীয় প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করতে সমস্যা নাই। (সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনুসারে- গাদা বা কচুরিপানা ফুল, পুটি মাছ, পেয়ারা/ বড়ই ফল, কাক পাখি আর ছাগল/গরু পশুরে জাতীয় ফুল-ফল-মাছ-পাখি-পশু ঘোষণা করা উচিৎ ছিল)! যাই হোক এসব জাতীয় প্রতীক নির্ধারণ করা, আর একটি রাষ্ট্রের অবস্থিত জনগোষ্ঠীর কোন অংশের ধর্ম, জাতিসত্তা, ভাষা, সংস্কৃতিকে আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়া- মোটেও এক কথা নয়; কেননা এর মাধ্যমে অন্যদের ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্ত্বা, সংস্কৃতিকে হেয় করা, অগণ্য করা, স্বীকৃতি না দেয়া হয়, যেটা ঐ সব জাতীয় প্রতীক করার মধ্য দিয়ে হয় না! দোয়েলরে জাতীয় পাখি করা মানে এই না যে- কাকেরা বা আর সব পাখিরা অমর্যাদাবোধে আচ্ছন্ন হচ্ছে, (বস্তুত মানুষের এইসব প্রতীক নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই)- কিংবা দোয়েল অনুসারী মানুষের বিপরীতে কাক অনুসারী, টিয়া অনুসারী, শালিক অনুসারী- এরকম মানুষেরা অপমানিত হচ্ছে। হ্যা, যখন বাংলাদেশের সংবিধানের ৬ নম্বর ধারায় বলা হয়ঃ “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী”, তখন চাকমা, মারমা, খাসি, ওরাও, মনিপুরি সহ অপরাপর জাতিসত্ত্বার মানুষেরা স্বীকৃতি হারায় এবং সংবিধানিক ভাষ্য হিসাবে তারা আর বাংলাদেশের জনগণ থাকে না। ঠিক তেমনি, রাষ্ট্রধর্ম যদি কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্ম হয়, তখন অন্যান্য ধর্মের মানুষদের সেই রাষ্ট্রকে আপনার ভাবার উপায় থাকে না! রাষ্ট্র যদি সকল ধর্মের, সকল বর্ণের, সকল জাতির, সকল লিঙ্গের মানুষের হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের সংবিধানে কোন বিশেষ ধর্ম, গোত্র, জাতি, লিঙ্গের প্রতি বিশেষ মর্যাদা দেখাতে পারে না, হোক না সেই ধর্ম, গোত্র, জাতি, গোষ্ঠী সংখ্যাধিক্যের কারণে বা ক্ষমতাকেন্দ্রের আশেপাশে থাকার কারণে শক্তিশালী!

খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন প্রভৃতি নানা ইসলামিক দলগুলোও মিছিল সমাবেশ থেকে একই রকম হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। তাদের অধিকাংশের মূল বক্তব্যই হচ্ছে- বাংলাদেশের ৯০%, ৯২% মুসলমান হওয়ার পরেও কেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হবে না। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষমতার বলে অন্যদের – দুর্বল, ক্ষমতাহীনদের উপরে জোর-জবরদস্তিমূলক নিজেদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া মোটেও ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায্য নয়, সেটা তাদের কে বুঝাবে? এভাবে তারা তাদের কথিত শান্তির ধর্মকে অন্যায়ের ধর্ম, জোর-জবরদস্তির ধর্ম, জংলি ধর্ম হিসাবে প্রমাণ করছে। গোটা দুনিয়া জুড়ে ইসলামের যখন এইরকম জঙ্গী, জংলি, অন্যায় রূপ বারেবারে সামনে আসতে থাকে- তখন স্বাভাবিকভাবেই এই ধর্মটি, ধর্মের গ্রন্থ, তাদের নবী, তাদের সৃষ্টিকর্তাকে কাঠগড়ায় দাড়াতে হয় বৈকি!

যাইহোক, এই সব মধ্যযুগীয় ইসলামি দলগুলো, তাদের নেতাদের, তাদের দ্বারা মগজ ধোলাই হওয়া কর্মীরা, বিভ্রান্তিতে থাকা মুসলিম জনগোষ্ঠীদের নিয়ে বলার তেমন কিছু নেই। তার চাইতে বরং, আমাদের শিক্ষিত, প্রগতিশীল অংশ, আমাদের মূল ধারার রাজনীতিবিদদের দিকে, আমাদের ইতিহাসের দিকে, আমাদের রাজনীতির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।

সংবিধান

হঠাৎ করে রাষ্ট্রধর্ম প্রসঙ্গটি নিয়ে এত হট্টগোল কেন?
১৯৮৮ সালে তৎকালীন স্বৈর রাষ্ট্রপতি এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনে – এর প্রথম ভাগ (প্রজাতন্ত্র) এ ২ নং ধারার নিচেই ২ক নাম্বার সংযোজন করে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম বানায়। সেনাশাসক, কুখ্যাত এরশাদ ১৯৮৮ সালে হুট করে এটা করে- নিজের ক্ষমতাকে টিকিয় রাখতে, যখন বুঝতে পারছিল- দেশ জুড়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন অনেক তীব্র হচ্ছে, তখন দেশের বেশিরভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে সুড়সুড়ি দিয়ে সহানুভূতি আদায় করার লক্ষ ছিল তার। ঐ সময়েই ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক আদালতে একটা রিট করেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে- মামলাটি দীর্ঘ ২৭/২৮ বছর ফাইলবন্দী থাকে। ২০১১ সালে আদালতের মাধ্যমে সংবিধানের বেশ কিছু সংশোধনীর ব্যাপারে যুগান্তকারী রায় আসার প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালে এই অষ্টম সংশোধনীর ব্যাপারে আদালাওতে আরেকটি স্বতন্ত্র রিট করা হয়। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯৮৮ সালের ও ২০১১ সালের রিট দুটিকে একত্রিত করে শুনানি শুরু হয়েছে, হাইকোর্টের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চে। মতামতের জন্যে আদালত এমিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছেন। আগামিকাল ২৭ মার্চ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। ফলে মৌলবাদী গোষ্ঠী ২৭ তারিখে তাদের ইসলামকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে, সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের সাথে সাথে তাদের মুসলমানিত্বও খারিজ হয়ে যাবে- এইরকম বিলাপ বকছেন। যদিও, সংবিধানের তৃতীয় ভাগ (মৌলিক অধিকার) এর ৪১ নম্বর ধারা (ধর্মীয় স্বাধীনতা) অনুযায়ী সকল ধর্মের নাগরিকেরই স্বাধীনভাবে ধর্ম অবলম্বন, পালন, প্রচারের অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে।

৪১। (১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে;
(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।
(২) কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না।

আদালতের রায়ে কি আসবে?
বর্তমান সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং ৮, ১২ ও ২৮ নম্বর ধারা প্রভৃতির সাথে ২ক ধারার এই “প্রজাতন্ত্রের রাষ্টধর্ম ইসলাম” সরাসরি সাংঘর্ষিক বিবেচনা করে এবং সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায় বিবেচনা করলে- এবারও আদালতের অষ্টম সংশোধনীর ২ক ধারা বাতিল ছাড়া অন্য কোন সম্ভাবনা দেখি না।
বর্তমান সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ (রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি) এর ৮ নম্বর ধারায় আছেঃ

৮৷ (১) জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই নীতিসমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।
(২) এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূলসূত্র হইবে, আইন-প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না।

সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ (রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি) এর ১২ নম্বর ধারায় (ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা) আছেঃ

১২। ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য
(ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা,
(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,
(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার,
(ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন,
বিলোপ করা হইবে।

ফলে, সংবিধানে একইসাথে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্টধর্ম ইসলাম থাকার কোন স্কোপ নেই, সংবিধান স্পষ্টভাবেই জানাচ্ছে যে, রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান বিলোপ করা হবে। স্বভাবতই আশা করতে পারি যে, আলোচ্য রিট দুটি বিষয়ে হাইকোর্টের বর্তমান বেঞ্চও যৌক্তিক রায় দিবে, অর্থাৎ অষ্টম সংশোধনীর ২ক ধারা বাতিল হবে। ২০১১ সালে ৫ম সংশোধনী বাতিলের রায়েই বাস্তবে ২ক বাতিল করা যেত। এটা যেমন সামনের রায় সম্পর্কে আশাবাদী করে তোলে, তেমনি রায় ঘোষণার পরে আদৌ সরকার তদানুযায়ী সংবিধান সংশোধন করবে কি না- সেই সন্দেহও বাড়িয়ে তোলে। এই সন্দেহের ব্যাপারটি বিস্তারিত করতে গেলে- ২০১১ সালে সংঘটিত আলোচিত পঞ্চদশ সংশোধনীর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

পঞ্চদশ সংশোধনীতে কি হয়েছিল?
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান সর্বমোট ১৬ বার সংশোধিত হয়েছে। তার মধ্যে ম্যাসিভ সংশোধনীগুলো হচ্ছে, আলোচিত, সমালোচিত, কুখ্যাত, প্রশংসিত সংশোধনীগুলো হচ্ছে- ১৯৭৫ সালের চতুর্থ, ১৯৭৯ সালের পঞ্চম, ১৯৮৬ সালের সপ্তম, ১৯৮৮ সালের অষ্টম, ১৯৯১ সালের দ্বাদশ, ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ এবং ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনী। পঞ্চম, সপ্তম আর ত্রয়োদশ সংশোধনী সম্পর্কিত আদালতের রায়ের ভিত্তিতেই পঞ্চদশ সংশোধনীটি হয়। সেদিক দিয়ে এই সংশোধনীটি বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পঞ্চম সংশোধনীতে যথাক্রমে মুশতাক, সায়েম, জিয়ার শাসনকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল, ও সপ্তম সংশোধনীতে এরশাদের স্বৈরশাসনকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল- আদালতের রায়ে সেই বৈধতা তুলে নেয়া হয় এবং তার প্রতিফলন স্বরূপ পঞ্চদশ সংশোধনীতে বৈধতা দানকারী ধারাগুলো বিলুপ্ত করা হয়, সেই সাথে ভবিষ্যতেও এইরকম অবৈধ উপায়ে সংবিধান সংশোধনের চেস্টাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে- যার জন্যে সর্বোচ্চ সাজা পর্যন্ত বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও এই সংশোধনীতে বিলুপ্ত করা হয়। এই আলোচিত সংশোধনীগুলোর বাইরেও বড় যে বিষয়ে সংশোধনী এসেছিল, যেটা নিয়ে ঐ সময়েও ইসলামী দলগুলো অনেক হট্টগোল করেছিল, দেশের গণতন্ত্রকামী, প্রগতিশীল অংশ আশায় বুক বেধেছিল এবং শেষে হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিল- তা হচ্ছে পঞ্চম সংশোধনীর কিছু বিষয়। সে বিষয়ে যাওয়ার আগে, পঞ্চম সংশোধনীর দিকে একটু দৃষ্ট দেয়া যেতে পারে।

পঞ্চম সংশোধনী? কুখ্যাত নাকি বিখ্যাত?
পচাত্তরের রাজনৈতিক হত্যাকান্ডসমূহের কোনরূপ বিচার করা যাবে না (ইমডেমনিটি বিল), অবৈধ ক্ষমতাদখলগুলোর বৈধতা প্রদান, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পাল্টিয়ে ফেলা- এতসব অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও জংলি সংশোধনীর পরেও বিএনপি এই সংশোধনী নিয়ে জোর গলায় গর্ব করে এই বলে যে, এই সংশোধনী দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছে, বহুদলীয় গণতন্ত্র এনেছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছে, সংবিধান স্বীকৃত জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো ফিরিয়ে দিয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনী, যার কারণেই পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে যখনই আলোচনা উঠতো- বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবিরা বলা আরম্ভ করতেন- পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা মানেই হচ্ছে চতুর্থ সংশোধনীতে ফিরে যাওয়া এবং আবার দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা, অর্থাৎ বাকশাল কায়েম করা। যাইহোক, আদালতের রায়ের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পরে যে পঞ্চদশ সংশোধনী হয়েছে, তাতে আমরা দেখতেই পারছি যে- আমাদের সংবিধান চতুর্থ সংশোধনী পরবর্তী অবস্থায় যায়নি (এমনকি আওয়ামীলীগ পন্থী বুদ্ধিজীবি, নেতা কর্মীদের দাবি মোতাবেক, এমনকি পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এটর্ণী জেনারেল, আইন মন্ত্রীর করা দাবি মোতাবেক ৭২ এর সংবিধানেও যায়নি! – এইসব আসলে চটকদারি রাজনৈতিক শ্লোগান)। যাহোক, পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে এটা কোথায় গেছে, সেই বিষয়ে পরে আসছি- রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়ার করা পঞ্চম সংশোধনীর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলোর দিকে এক নজরে চোখ বুলানো যাকঃ
– প্রস্তাবনা শুরুতেই বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম যুক্ত করা হয়। (যেনবা এটি একটি ইসলামী ধর্মীয় গ্রন্থ!)
– প্রস্তাবনায় মুক্তি সংগ্রাম তুলে দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ রাখা হয়! (যেহেতু স্বাধীন হয়েছি এটা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ, কিন্তু একে মুক্তি সংগ্রাম বলতে এত ভয় কিসের?)
– প্রথম ভাগ (প্রজাতন্ত্র) এর ৬। ১ নম্বর ধারায় (নাগরিকত্ব) বাংলাদেশের জনগণ বাঙালি হিসাবে পরিচিত হবে- এটা পাল্টিয়ে বাংলাদেশি হিসাবে পরিচিত হবে- করা হয় (তখন থেকেই মূলত শুরু হয়- বাঙালি বনাম বাংলাদেশি বিতর্ক! আমার কাছে এটাকে ইতিবাচক সংশোধন মনে হয়- যদিও জিয়ার ইনটেনশন নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে)
– দ্বিতীয় ভাগ (রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি) এর ৮ নম্বর ধারায় (মূলনীতি) বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) দুটিই পাল্টিয়ে ফেলা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে “সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” সন্নিবেশিত হয়। সমাজতন্ত্রের স্থলে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র’ যুক্ত করা হয়। সেই সাথে ৬ এর ১(ক) উপধারা যুক্ত করে ‘আল্লাহ্‌র উপর পূর্ন আস্থা ও বিশ্বাসই হবে সকল কার্যাবলির ভিত্তি’ কথাটা যুক্ত করা হয়। (এর মাধ্যমেই বস্তুত ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত করা হয়, যার ধারাবাহিকতায়ই অষ্টম সংশোধনীতে রাষ্টধর্ম ইসলাম সম্পর্কিত ধারাটি যুক্ত করা সম্ভব হয়েছে)
– দ্বিতীয় ভাগ (রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি) এর ২৫ নং ধারায় (আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন) নতুন একটা উপধারা যুক্ত করা হয়ঃ ”রাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে” (এই সম্পর্ক রক্ষার লক্ষকে সামনে রেখেও ধর্মনিরপেক্ষতা বদলে ইসলামী চেহারা নেয়া জরুরি হয়েছিল, মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে অন্য সব মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক করা।)
– তৃতীয় ভাগ (মৌলিক অধিকার) এর ৩৮ নম্বর ধারা (সংগঠনের স্বাধীনতা) থেকে ধর্মিভিত্তিক রাজনীতি থাকবে না অংশটুকু বিলুপ্ত করা হয়। (এর মাধ্যমেই স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনীতির সুযোগলাভ ঘটে!)

পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ঃ
২০০৫ সালে হাইকোর্ট এক রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে। তৎকালীন বিএনপি-জামাত সরকার আপিল করে এই হাইকোর্টের এই রায় স্থগিত রাখে। এরপরে আওয়ামীলীগ সরকার এসে সেই আপিল তুলে নিলে হাইকোর্টের রায় বহাল হওয়ার সম্ভাবনা দেখে, বিএনপি মহাসচিব খদকার দেলোয়ার আপিল করার আবেদন করেন। অবশেষে ২০১১ সালে সেই আপিল খারিজ করে দিলে (সুপ্রিম কোর্ট কিছু নির্দেশনাও দেয়), হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। তবে, হাইকোর্টের যে রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলো- সেটি কিন্তু পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে কোন রিট বা মামলার রায় ছিল না! এই গল্পটিও বেশ চমকপ্রদ। যেহেতু মূল আলোচনার সাথে খুব বেশি সংশ্লিষ্ট নয়- তাই এই আলাপ সংক্ষেপে শেষ করার চেস্টা করছি।

রাজধানীর মুন সিনেমা হলটির মালিক ছিলেন মাকসুদ আলম। হলটি ১৯৭৩ সালে সরকারি আদেশের মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৪ সালে মাকসুদ আলম সরকারি আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালতের রায় তার পক্ষে গেলেও মাকসুদ আলম তার জমির মালিকানা বুঝে নিতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের পর মাকসুদ আলম আবারো সম্পত্তির দখল বুঝে নেয়ার জন্য আদালতে রিট করেন। ১৯৭৭ সালে রিটের নিষ্পত্তি শেষে আদালত আবেদনকারীর পক্ষে রায় দেন। তবে ১৯৭৭ সালে সরকার সামরিক শাসনবিধি ঘোষণা করে যেখানে এ ধরনের সম্পত্তির মালিকানা ফেরত না দেয়ার আইন করা হয়। এ ফরমানে উল্লেখ করা হয় আগে সরকারি আদেশের মাধ্যমে যেসব সম্পত্তি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাভুক্ত করা হয়েছে, সেসব সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে কেউ মামলা করতে পারবে না। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে উক্ত ফরমানকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। মুন সিনেমার মালিকপক্ষ পরে ১৯৯৪ সালে এই রেগুলেশনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ফের রিট আবেদন করেন। তবে আদালত পঞ্চম সংশোধনীর আওতায় সব সামরিক রেগুলেশনের বৈধতা আদালতের চ্যালেঞ্জের আওতাবহির্ভূত বিবেচনা করে আবেদনটি খারিজ করেন। মাকসুদ এ আদেশেও দমে যাননি। এবার তিনি ২০০০ সালে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন উল্লেখ করে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রীট মামলা দায়ের করেন। ওইদিনই হাইকোর্ট সংবিধানের ৫ম সংশোধনী ও এর আওতাধীন সকল ফরমানের বৈধতার প্রশ্নে সরকারের প্রতি রুলনিশি জারি করেন। দীর্ঘ ৫ বছর পর ২০০৫ সালের মে মাসে এ রুলের ওপর শুনানি শুরু হয় এবং জুলাই মাসে এ রিটের শুনানি শেষে ২৯ আগস্ট হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ অভিমত দেন, ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে জেনারেল জিয়ার দায়িত্বগ্রহণ সংবিধান বহির্ভূত এবং অবৈধ, একইভাবে জেনারেল জিয়ার গণভোট সংবিধানের আওতার বাইরে।

এই হচ্ছে সংক্ষেপে হাইকোর্টের রায়ের গল্প। হাইকোর্টের সেই রায় অনুযায়ী (এবং সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শকৃত মডিফিকেশন সহকারে) ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদ অনুমোদন করে। তার আগে, সরকার সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটি করে, যেই কমিটি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে বসেছেন এবং সেখানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম তুলে দেয়া, ধর্মনিরপেক্ষতা পুনর্বহাল করা- এসব বিষয়ে মত দেয়া হয় এবং সেই কমিটি একমতও পোষণ করেন বলে বর্তমান চলমান রিট দুটির আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। যদিও আপিল বিভাগের রায়ের পরপরেই সে সময়ের আইনমন্ত্রীর প্রেস বিফিং এ দেখা যায় যে, তিনি পঞ্চম সংশোধনীর সব কিছুই রদ করা হবে না, যেমন বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম বাদ দেয়া হবে না। এবারে- পঞ্চদশ সংশোধনীর পরিবর্তনগুলো দেখে নেয়া যাক।

পঞ্চদশ সংশোধনীর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনঃ
– প্রস্তাবনার শুরুর বিস্‌মিল্লাহির-রহ্‌মানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে) এর সাথে যুক্ত করা হয় “/ পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে” । (ভাবনাটা এমন যেন- পরম করুনাময় সৃষ্টিকর্তার নামে বলার মধ্য দিয়ে অন্য সব ধর্মের আবদারও মেটানো হলো এবং এর মাধ্যমে সেক্যুলার চরিত্র রক্ষা হলো! এইরকম একক পরম সৃষ্টিকর্তা সকল ধর্মেই আছে কি না সেই প্রশ্ন বাদও যদি দেই- আলাদাভাবে একটি ধর্মের আল্লাহর কথা বলা এবং বিদেশী ভাষার একটি মন্ত্র আওড়ানোর মাধ্যমে কেমন সেক্যুলারিজম হলো- সেই প্রশ্ন করাই যায়!)
– প্রথম ভাগ (প্রজাতন্ত্র) এর ৬। ১ নম্বর ধারায় (নাগরিকত্ব) বাঙালী ও বাংলাদেশী- উভয়কেই আনা হয়!

৬। (১) বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে।
(২) বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।

(জিয়া প্রণীত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের চাইতে এটা অনেক স্মার্ট প্রকাশ সন্দেহ নাই। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ সবাই জাতি হিসাবে তো বাঙালী নয়। অন্য সব জাতিসত্ত্বার উল্লেখ না থাকায়, তাদের কি বাংলাদেশের জনগণ বলে অস্বীকার করা হলো না?)
– দ্বিতীয় ভাগ (রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি) এর ৮ নম্বর ধারায় (মূলনীতি) চার মূলনীতি (জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) ফিরিয়ে আনা হয়। “সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” বিলোপ পেয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা আসে, সমাজতন্ত্রও ফিরে আসে। সেই সাথে ৬ এর ১(ক) উপধারা (‘আল্লাহ্‌র উপর পূর্ন আস্থা ও বিশ্বাসই হবে সকল কার্যাবলির ভিত্তি’)বিলুপ্ত হয়। (প্রত্যাশিত ছিল এবং বাংলাদেশ আবার নিজেকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেল।)
– তৃতীয় ভাগ (মৌলিক অধিকার) এর ৩৮ নম্বর ধারা (সংগঠনের স্বাধীনতা) থেকে বিলুপ্ত হওয়া ধর্মিভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করা অংশটুকু ফিরিয়ে আনা হলো না। (ফলে জামাত ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোর রাজনীতি করার বাধা রইলো না! তবে, স্বীকার করি যে- ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করাটা আজকের পরিস্থিতিতে খুব কঠিন এবং এভাবে নিষিদ্ধ করতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল।)
– দ্বিতীয় ভাগ (রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি) এর ১২ নম্বর ধারা (ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা) যুক্ত করা হয়।

১২। ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য
(ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা,
(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,
(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার,
(ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন,
বিলোপ করা হইবে।

(এটাও প্রত্যাশিত ছিল। মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার একটা ব্যাখ্যা যুক্ত করার দরকার ছিল, সেটা করা হয়েছে।)
– প্রথম ভাগ (প্রজাতন্ত্র) এর ২ক ধারা (রাষ্ট্রধর্ম) বিলুপ্ত করার বদলে এখানে অন্যান্য ধর্মের সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করা যুক্ত করা হয়;

২ক। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন

(এই ভাগটি হচ্ছে- “প্রজাতন্ত্র”- অর্থাৎ এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পরিচিতি মূলক, বাংলাদেশকে কি নামে ডাকা হবে, এর রাজধানী, রাষ্ট্রীয় সীমানা, রাষ্ট্রভাষা, রাষ্ট্রধর্ম, জাতীয় পতাকা, জাতীয় প্রতীক, জাতির জনক প্রভৃতি রয়েছে। এই বিভাগে এই একটি মাত্র ধারা যেখানে- বাংলাদেশের পরিচিতির বাইরে কিছু ধর্মের জনগণের অধিকারের কথা আলাদা করে বলা হচ্ছে! বিষয়টা বেশ চমকপ্রদ! অথচ তৃতীয় বিভাগ- মৌলিক অধিকার, সেখানের ২৮ নম্বর ধারা- ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য, ৪১ নম্বর ধারা- ধর্মীয় স্বাধীনতা- এসবে সকল ধর্মের জনগণের অধিকারের কথা বলা হয়েওছে। তারপরেও আলাদা করে এখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনের সম মর্যাদা আর সম অধিকারের কথা বলার কারণই হচ্ছে- কোন একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করা হলে সকল ধর্মের সম মর্যাদা ও সম অধিকার রক্ষা হয় না! এই ধারা বিলোপ না করে অদ্ভুত গোজামিল দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেস্টা করা হলো!)

এই হচ্ছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে মোটামুটি আমাদের সংবিধানের হাল হকিকত। সংবিধানের ১৬ টি সংশোধনী, এক সংশোধনীতে আগের সংশোধনী বা ধারা পাল্টে যাওয়া, আদালতের রায়ে সংশোধনী বাতিল হওয়া- এই ঘটনাগুলো দেখলে প্রথমেই যে প্রশ্নটা আসে তা হচ্ছে- আমাদের সংবিধানের অবস্থা এমন কেন? সংবিধান সংশোধন এত সহজ কেন? যে ধরণের সংশোধনী আদালতের রায়েই বাতিল হতে পারে, সে রকম সংশোধনী করার এখতিয়ার সংসদের থাকে কি করে? এসবের জবাব আমরা পেতে পারি বাংলাদেশের সংবিধান রচনার ইতিহাসে এবং ৭২ সালের প্রাথমিক সংবিধান থেকে! কিন্তু সেটা আরেক বিশাল আলোচনা ও এই পরিসরে করা সম্ভব নয়। সংক্ষেপে কিছু কথা বলা যাক!

৭২ এর সংবিধানঃ
আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, এমনকি বামপন্থীদের মধ্যেও অনেকেই ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার দাবী তোলেন। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যে চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তার অনেক কিছুই ৭২ এর সংবিধানে স্থান পেয়েছিল- যেগুলো পরবর্তী শাসন আমলে নির্মম ও নির্দয় কাটাছেড়ার সম্মুখীন হয়েছে। ফলে, ন্যুনতম সেইসব গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো যখন আজ অনেক কঠিন ও দূরের পথ মনে হয়, তখন আমিও ৭২ এর সংবিধানের সেই চেতনা, সেই মূল্যবোধগুলোর কথা বলি। কিন্তু, সেই সাথে এটাও মাথায় রাখা দরকার যে- যে সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি রক্ষা করতে পারে না, যে সংবিধান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে পারে না- নিদেন শাসনতান্ত্রিক নিয়ম রক্ষাও করতে পারে না, উল্টো সংবিধান খেয়াল খুশিমত পাল্টে নিয়ে অবৈধ শাসনকে বৈধ করাও সম্ভব হয়- সেই সংবিধানের মাঝে বড় রকমের গলদ না থেকে পারে না। ফলে, ৭২ এর সংবিধান থেকে যেমন বারেবারে খেয়াল খুশিমত কাটাছেড়া হতে হতে আজকের অবস্থায় এসেছে, সংবিধান রচনার দায়িত্বে থাকা শাসকগোষ্ঠীই মাত্র ৪ বছরে ৪ বার পরিবর্তন করে- ৪র্থ সংশোধনীতে তো একদম গণতন্ত্রের কবর করে একনায়কতন্ত্রের একচ্ছত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করে- সেই ৭২ সংবিধানে ফেরা হলে- একই পরিণতি আবার হবে, বারে বারে হবে।
বিস্তারিত পরিসরে আলাপ এই মুহুর্তে সম্ভব নয়- ছোটকরে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা যাকঃ
৭২ এর সংবিধান প্রণয়নে অগণতান্ত্রিকতাঃ ৭০ এর নির্বাচনে স্বাধিকারের প্রশ্ন ছিল প্রধান, অনেক দলই তাতে অংশগ্রহণ করেনি। তদুপরি, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে কোন কোন নির্বাচিত নেতা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, দালাল আইনে কারো কারো বিচারও হচ্ছিল, অনেক নির্বাচিতরা সম্মুখ সমরে অংশ না নিয়ে বা এমনকি প্রবাসী সরকারের সাথে ন্যুনতম সম্পর্ক না রেখেই ভারতে নানারকম সুযোগ সুবিধায় কাটিয়েছে, কেউ কেউ তো অবৈধ কাজ কারবারেও যুক্ত ছিল। ফলে, বিজয়ের পরে একটি সাধারণ নির্বাচন হলে সকল পার্টি অংশ নেয়ার সুযোগ পেত, যদি ধরেও নেই- আওয়ামীলীগের বিপুল জনপ্রিয়তার কাছে তারা জিততো না, আওয়ামীলীগই নিরঙ্কুশ জয়লাভ করতো, তারপরেও অন্তত আওয়ামীলীগেরই মুক্তিযোদ্ধা সাহসী দেশপ্রেমিক অংশটি মানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে দেশ গড়ার ও সংবিধান রচনার সুযোগ পেত। তারপরেও যদি ধরে নেই- ৭০ সালের নির্বাচিত গণ প্রতিনিধিদের নিয়ে যে গণপরিষদ গঠিত হলো- সেখানেও দেশপ্রেমিক, সাহসী দেশপ্রেমিকদের সংখ্যা বেশি, তারপরেও কি বলা যাবে- তারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশে সমর্থ ছিলেন? ৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে এই সংবিধান কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশ চলেছে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে, যে অধ্যাদেশগুলো প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে ও একক কর্তৃত্বে দেয়া হতো। গণপরিষদ সদস্যদের সংবিধান রচনা ছাড়া আর কোন ক্ষমতাই দেয়া হয় না, আইন প্রণয়নের নয়, এমনকি কেবিনেটের উপরও না। ফলে, সংবিধান রচনার আগ থেকেই সরকার দলীয় প্রধানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যে সংস্কৃতি চালু হলো, সেটা সংবিধানেও স্থান পায়। বাস্তবে এই গণপরিষদের সদস্যদের ঠুটো জগন্নাথ করে রাখা হয়- এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে, যে অধ্যাদেশ বলে- দল থেকে বহিস্কৃত হলে – এমনকি সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করলেও তার জনপ্রতিনিধিত্ব খারিজ হয়ে যাবে। ন্যাপ থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সুরঞ্জিত সেন আর স্বতন্ত্র জনপ্রতিনিধি মানবেন্দ্র লারমা দুজনে মিলে খসড়া সংবিধানের উপরে যত সংশোধনী প্রস্তাব আনেন- তার অধিকাংশই নিরঙ্কুশ ভোটে খারিজ হয়ে যায়, কেননা আওয়ামীলীগের জনপ্রতিনিধিদের নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট প্রদানের কোন উপায় ছিল না। শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বের কাছে আওয়ামীলীগের নেতারা সবাই ম্রিয়মান হয়ে যেত- এই ভাষ্যের সত্যতা হয়তো কিছুটা আছে, কিন্তু আওয়ামীলীগ দলটির মধ্যে যেমন গণতন্ত্রের চর্চা হয়নি- বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ক্যারিশমার উপর নির্ভর করে দলটির চলার ঝোক থেকে, তেমনি সরকার গঠনের পরেও বা জাতীয় সংসদে- বঙ্গবন্ধু দলীয় কারোর কাছ থেকে বিরোধিতা, বিপরীত মত সহ্য করতে পারেননি। ঐ সময়ের সংসদের কার্যবিবরণী থেকেও এর লক্ষণ পরিস্কার হয়।


৭২ সংবিধানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করাঃ প্রধানমন্ত্রীর হাতে সমস্ত ক্ষমতা অর্পন করা হয়েছে, কিন্তু তার দায়বদ্ধতার জায়গা রাখা হয়নি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতেও পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেয়া হয়নি। এবং আগের পয়েন্টে উল্লেখিত ধারা মোতাবেক জনপ্রতিনিধিদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বাধীন মত প্রদানের ক্ষমতা রহিত করা হয়েছে। ফলে, সরকারের উপরে, তথা সরকার দলীয় জনপ্রতিনিধিদের উপরে এটি দলীয় ক্ষমতা চর্চার তথা দল প্রধান তথা সরকার প্রধানের ক্ষমতা চর্চার সুযোগ করে দিয়েছে। এই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার ঝোঁক কিংবা নিজ দলের সদস্যদের প্রতি অনাস্থা অবিশ্বাস, শেখ মুজিবকে একনায়কে পরিণত করে এবং দলের ও সরকারের বিভিন্ন স্তরে অন্তর্ঘাত ও ষড়যন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে এবং শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ৭২ এর সংবিধানের প্রদত্ত ক্ষমতাকেও যথেষ্ট না মনে করে- চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা থেকে শুরু করে জনগণের বিভিন্ন রাজনৈতিক, নাগরিক অধিকার রহিত করেন। সেই ধারাবাহিকতায় সমস্ত সরকার প্রধান, অবৈধ সেনা শাসনের সময় তো বটেই এমনকি কথিত গণতান্ত্রিক আমলেও এই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখা অব্যাহত থাকে।
 

সংবিধান সংশোধনঃ কেবলমাত্র সংসদের দুই তৃতীয়াংশের ভোটে সংবিধানের যেকোন ধারা সংশোধনের ক্ষমতা, যা আসলে সংসদের ক্ষমতা নয়- সরকার দলের ক্ষমতাকে নির্দেশ করে (যেহেতু সংসদ সদস্যরা দলের বিপরীতে ভোট দিতে পারে না), একটি ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছে। এটি দুটো ভয়ঙ্কর বিষয় উপজাত হিসাবে আমাদের উপহার দিয়েছে। এক, সংসদ নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভের জন্যে মরিয়া চেস্টা (বিশেষ করে, সামরিক শাসকদের মাঝে এই চেস্টা প্রবল) এবং দুই, কোনভাবে কোন দল নির্বাচনে এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেলে- সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসা। অথচ, আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা যেমন ত্রুটিপূর্ণ, সাংবিধানিকভাবেও নির্বাচন কমিশনকে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান করা হয়নি। সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ১৪২ নম্বর ধারাটিতে এই দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ম্যান্ডেটের বাইরেও আর কিছু বিষয় জরুরি ছিল। বাংলাদেশের কোর মূলনীতিকে অপরিবর্তনীয়, অন্য ধারাসমূহ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও যেগুলো কোর মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হবে- সে পরিবর্তনগুলোও করা যাবে না; এই মূলনীতির বাইরে জনগণের মৌলিক অধিকার, প্রধানমন্ত্রী- রাষ্ট্রপতি- বিচারপতি- প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোট, অন্যান্য ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের ভোট- এইরকম তিন পর্যায় থাকলে, চাইলেই কি ৪র্থ, ৫ম, ৮ম সংশোধনীগুলো করা সম্ভব হতো? জিয়া অবশ্য ৫ম সংশোধনীতে এরকম একটা ব্যবস্থা করেছিল। ৮ নম্বর ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়ে আল্লার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস এনে- ১৪২ নম্বর ধারায় জানিয়ে দিল- ৮ নম্বর ধারা (এবং আরো কয়েকটি ধারা) সংশোধনে দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ভোটে হবে না- গণভোটও লাগবে (নিশ্চিত ভেবেছিলেন যে- গণভোটে ধর্মনিরপেক্ষতা আনা সম্ভব না, ফলে এটা আর কেউ পাল্টাতে পারবে না)। কিন্তু প্রথমে ১৪২ ধারা পাল্টিয়ে, পরে ৮ নম্বর যে পালটানো সম্ভব এই হিসাব ভুলে গিয়েছিলেন। আওয়ামীলীগের শেখ হাসিনা এবারে পঞ্চদশ সংশোধনীতে কড়া হিসাব কষেছেন। ১৪২ ধারাটি ওরকম নির্বিষই রেখেছেন। কেবল দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের ম্যান্ডেট লাগবে। কিন্তু ৭ এর খ ধারা যুক্ত করে সেখানে বলা হয়েছেঃ “সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে”। এই ৭ এর খ ধারাটি প্রথম ভাগের ভেতরে যেহেতু, সেহেতু এটি পরিবর্তনেরর অযোগ্য। দ্বিতীয় ভাগ হচ্ছে- রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, এই ৭খ ধারা মোতাবেক সেটাও পরিবর্তনের অযোগ্য হওয়ার পরেও- ৮ নম্বর ধারার ১ উপধারায় চার মূলনীতি বলার পরে, ২ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছেঃ এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূলসূত্র হইবে, আইন-প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হইবে না”। অর্থাৎ ৮ (১) ধারার জন্যে এবারে ডাবল প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে! এ খুব ভালো, কিন্তু ভয় হয় বজ্র আটুনি ফসকা গেরো না হয়ে ওঠে আবার! বিশেষ করে যখন- এমন বজ্র আটুনি দিয়ে মূলনীতি সংবিধানে গেথে দেয়ার পরেও যখন দেখা যায়- সেই মূলনীতি মেনে চলার কোন বাধ্যবাধকতা সরকার বা রাষ্ট্রের তো নেইই- এমনকি খোদ সংবিধান মহাশয়েরও নেই- তখন এসবকে তামাশাপূর্ণ ছাড়া কিছুই মনে হয় না।

আরো অনেক কিছুই বলা যেত, সময় সুযোগ করে বলা যাবে খন। বিশেষ করে যেগুলো আছে- তার সমস্যা- এটা এক রকমের আলোচনা এবং সেই সাথে সাথে কি কি নাই- এটা আরেক ধরণের আলাপ। শেষ পয়েন্টে একটু করে সে ব্যাপারে বলেছি। আমাদের সংবিধানের একটা বড় ধরণের সমস্যা হচ্ছে- সংসদের, সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার জায়গাটি শুন্য। তার চাইতেও বড় সমস্যার বিষয় হচ্ছে- সংবিধানের ধারাগুলো নিশ্চিত করার ব্যাপারেও রাষ্ট্রের তথা সরকারের কোন বাধ্যবাধকতার জায়গা নেই! আদালত অবমাননা অপরাধ, সামনে সংবিধান অবমাননার আইনও আসছে; কিন্তু সংবিধানে বর্ণিত মূলনীতি, মৌলিক অধিকার প্রভৃতি নিশ্চিত করার জন্যে কোন নির্দেশনা ও বাধ্যবাধকতা এখানে নেই। ফলে মূলনীতির গণতন্ত্র নামেই কেবল গণতন্ত্র (এমনই যে জিয়া বা এরশাদের শাসনামলেও সংবিধান অনুযায়ী আমাদের রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র), একইভাবে এখানকার সমাজতন্ত্র নামে সমাজতন্ত্র, এখানকার ধর্মনিরপেক্ষতা নামেই কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা (এখনতো বটেই, ৭২-৭৫ সালেও! নচেৎ কিভাবে বঙ্গবন্ধু ইসলামিক কনফারেন্সে যোগ দিতে চলে যান, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ইসলামিক ফাউন্ডেশন করেন, শিক্ষাব্যবস্থায় মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখেন!) …

সংবিধান থেকে আবারো বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফিরে আসি। আজকের সময়ে এসে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল প্রসঙ্গে ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর হট্টগোলের পাশাপাশি, প্রগতিশীল মহলের- বিশেষ করে বাম প্রগতিশীল মহলের কারো কারো আলোচনা দেখে, শুনে ও পড়ে চক্ষু চড়কগাছে ওঠার মত অবস্থা! (আবার বামবিরোধী মুক্তমনা বন্ধুরা এটাকে লুফে নিয়ে বামদের ঢালাওভাবে একহাত নিতেও ছাড়ছেন না- বলে রাখি, এনাদের এই সব অযৌক্তিক কাজকারবারের সাথেও আমি নাই)

কোনো কোনো প্রগতিশীল বন্ধুরা এসব কি বলছেন?
আমার এক বাম বন্ধুর স্ট্যাটাসে দেখলামঃ “নতুন করে যারা সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বাদ দিতে চাচ্ছেন, আইন কানুনের হা-ডু-ডু খেলছেন, তাদের সাথে প্রগতিশীলতার ন্যুনতম কোনো সম্পর্ক নেই, এবং যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ছেন লেখালেখি করছেন, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে চোখ রাঙাচ্ছেন, তাদের সাথেও ধর্ম পালন এমনকি এদের অনেকেরই ধর্মবিশ্বাসের সাথেও কোনো সম্পর্ক নেই। এটা তাদের বহু পুরনো রাজনৈতিক খেলা, বিপদে পড়লে যে খেলা তারা খেলে থাকেন। তারা উভয় একে অপরের ব্যবসায়িক জুড়িদার। সময়ের প্রয়োজনে তারা এই খেলা নতুন করে শুরু করেছেন”।

যদি ধরেও নেই যে- আমাদের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার কোন চাল চালতে বা বিশেষ উদ্দেশ্য থেকেই এই “খেলাটি” খেলছে, তারপরেও- রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নামে যে ক্ষতটি আমাদের সংবিধান ও আমাদের রাষ্ট্রের ঘাড়ে ২৭-২৮ বছর ধরে চেপে আছে, সেখান থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেন? একটি জনপ্রিয় ভাষ্য হচ্ছে এই যে- সরকার বিপদে পড়লে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরানোর জন্যে এরকম নানা খেলা খেলতে থাকে। এই মুহুর্তের বিপদ হচ্ছে- বাংলাদেশ ব্যাংক ক্যালেঙ্কারি। তাছাড়া গণবিরোধী রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করছে, শ্যালা নদীতে আবার কয়লাবাহী জাহাজ ডুবেছে, ভারত থেকে কমদামে ডিজেল কিনেছে, ইত্যাদি। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বিতর্ক শুরু হলে এসব ইস্যু ঢাকা পড়বে। কিছুদিন আগে আমার বন্ধুদের অনেকে সমস্বরে বললেন, ক্রিকেট এর জোয়ারে সব ইস্যু ভেসে গেল। তনুকে ধর্ষণের প্রতিবাদে পোস্টার হয়- খেলোয়াড় নিষিদ্ধের প্রতিবাদ হয়, ধর্ষণের প্রতিবাদ হয় না! আমার মতে, এসবই হচ্ছে অপরিপক্ক চিন্তার ফসল এবং নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের দৈন্যতাকে কিংবা যুব সমাজ বা কমনলি সামাজিক অবক্ষয়কে আড়াল করে হতাশা ঝাড়া! বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের অনেক আগে থেকেই রামপাল নির্মাণ হচ্ছে, আমরা আটকানোর মত বড় কোন আন্দোলন তৈরি করতে পারিনি, বিশ্বকাপ ক্রিকেট না চলাকালে শেয়ার ক্যালেঙ্কারি, ডেসটিনি ক্যালেঙ্কারী – এরকম নানাকিছু ঘটেছে, আমরা কিছুই করতে পারিনি। এই ব্যর্থতা আমাদের, এমনকি ক্রিকেট এ মত্ত হওয়া জনগণেরও- কিন্তু সেটার দোষ বা কারণ যখন ক্রিকেট এ মত্ত হওয়া, এমনকি তাসকিন- সানিকে অবৈধ ঘোষণার প্রতিবাদে আন্দোলনের হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় আর কিছু থাকে না! (মজার বিষয় হচ্ছে একইরকম অভিযোগ মোল্লারাও করেছে দেখলাম- তারা বলছে তনু ধর্ষণের প্রতিবাদ আন্দোলনের সোরগোল তুলে আসলে সরকার জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে চুপে চুপে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করতে চায়!)

আসল বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করাকে আপনি কি চোখে দেখেন? এরশাদ যখন এটি করে, তখন এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন কি না (বামরা তো বটেই, আওয়ামীলীগ, বিএনপিও এর বিরোধিতা করেছিল)? যে পনেরজন প্রগতিশীল ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে রিট করেছিলেন, সেটাকে সে সময় সমর্থন করেছিলেন কি না? আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেও কেন সংবিধান পাল্টালো না- এই প্রশ্ন করেছিলেন কি না? যদি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের দাবী আপনার থেকে থাকে, যদি এরশাদের অষ্টম সংশোধনীকে অসৎ, অন্যায় সংশোধণী মনে করেন, যদি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা মানে অন্যসব ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্যে অপমানসূচক, মর্যাদাহানিকর এবং তাদের প্রতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার একটি বাহন মনে করে থাকেন- তাহলে, সরকার যে উদ্দেশ্যেই এই কালো সংশোধনীকে বাতিল করতে চাক না কেন (কেন আদালতকে আমরা দেখছি না, সরকারকে টানছি, সেটাও বোধগম্য নয়)- আমাদের চাওয়া তাতে কি করে নাই হয়ে যায়?

আরেক বন্ধু বলেছেনঃ “মূলত রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম থাকা না থাকার সাথে বাংলাদেশের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির তেমন কোন সম্পর্ক নাই। স্বৈরাচার এরশাদ যখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন তখন আহমদ ছফা এই বিষয়টা উল্লেখ করছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তো অনেকদিন কোন রাষ্ট্রধর্ম ছিল না, কিন্তু তাতে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন ও বৈষম্য কি ছিল না? ছিল তো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ছিল। বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিতে সেকুলারিজম ছিলনা অনেকদিন। এখন আছে। কিন্তু সেকুলারিজমের এই উল্লেখ কি বিগত কয়েক বছরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন কমাইতে পারছে? না কি এইসব অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে পারছে? কোনটাই পারে নাই।
 

কিছু ইসলামিস্ট নেতা যে প্রশ্ন তুলেছেন ‘রাষ্ট্র ভাষা’, ‘জাতীয় মাছ’, ‘জাতীয় পাখি’ ইত্যাদি থাকলে ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ থাকতে সমস্যা কি, এই প্রশ্নটা মোটেই অগুরুত্বপূর্ণ নয়। এতে ‘রাষ্ট্র ভাষা’, ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ ইত্যাদির ব্র্যান্ড ভ্যালুর ব্যাপারটা সামনে চলে আসে। রাষ্ট্রিয় অথবা জাতীয় ব্র্যান্ডিং-এর অংশ হলেই যে কোন কিছুর গুরুত্ব অথবা ক্ষমতা খুব বেড়ে যায় তা তো না। গুরুত্ব ও ক্ষমতা মূলত বাড়ে রাষ্ট্রের, যারা জাতীয়তা নিয়া রাজনীতি ও ব্যবসা করে তাদের। ধর্ম বা ভাষা এইখানে ক্রিকেট দলের জার্সিতে বাঘের ছবির মতোই। বাঘ আমাদের জাতীয় পশু, কিন্তু তাতে তো বাঘের বিলুপ্তি রক্ষা করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্র ভাষা বাঙলা হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি আসলে বুদ্ধিজীবীদের বাঙলা ভাষার সর্বস্তরে ব্যবহার না হওয়া নিয়া দুঃখ করতে হয়। রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে ইসলামের ব্যাপারটাও তেমনি। …”
 

এক/ রাষ্ট্রভাষার ধারণাটি অন্য যেকোন কিছুর চাইতে আলাদা, এটা রাষ্ট্রের কেবল ব্রান্ড নয়, রাষ্ট্র কোন ভাষাটিকে বা ভাষাসমূহকে অফিসিয়াল বা দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে গ্রহণ করছে তার স্বীকৃতি .. বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষার দাবীতে লড়াই ও প্রাণ দেয়া, বাংলাভাষীদের উপরে উর্দু চাপিয়ে দেয়ার জোর জবরদস্তির বিরুদ্ধে, ফলে রাষ্ট্রীয়ভাবে রাষ্ট্রভাষা উর্দুর ঘোষণা কেবল ব্রান্ডিং এর পরিচায়ক নয়, বরং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর নিবর্তনমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ..

দুই/ রাষ্ট্র ধর্মের কনসেপ্টও একইভাবে ভীষণ রকম আলাদা, জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার না হয়ে ছাগল হলে কিংবা পাখি দোয়েল না হয়ে কাক হলে বা জাতীয় ফুল শাপলা না হয়ে গাদা হলে কারোরই কিছু যায় আসতো না, রাষ্ট্রীয় ব্রান্ড বা চিহ্ন বা প্রতীক যাই বলেন, এসব নির্বিষ জিনিসের ব্রান্ডিং নিয়ে সরাসরি মানুষের জীবনে কোন প্রভাব নাই .. কিন্তু যখনই রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে কোন একটি ধর্মকে ঘোষণা করবেন, তখন এখানকার অপরাপর ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর লোকজনকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা দিলেন, যদিও রাষ্ট্র ধর্ম আলংকারিক, মানে রাষ্ট্রভাষার মত এর প্রাক্টিক্যাল ইমপ্লিকেশন নাই (যদি সব ধর্মের মানুষকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের আইন মানতে বাধ্য করা হতো তাহলে তেমনটা বলা যেত), তারপরও বলা যায় এটা রাষ্ট্রীয় চরিত্রকে ইন্ডিকেট করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ .. ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর নিবর্তনমূলক ..

তিন/ এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম বানানোর আগে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে, কিংবা রাষ্ট্রধর্ম তুলে দেয়ার সাথে সাথেই সংখ্যালঘু নির্যাতন কমে যাবে না, তার মানে এই না যে – রাষ্টধর্ম ইসলাম থাকা না থাকা সমান! আমি যদি এই কোন একটি ধর্মের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে থাকাটাকেই অপর ধর্মের লোকদের উপর নিপীড়নমূলক মনে করি, তবে রাষ্ট্রধর্ম তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে সেই নিপীড়ন থেকে তো মুক্তি দেয়া যায় এটলিস্ট? অন্য ফিজিক্যাল নিপীড়নের গ্রাউন্ড তৈরি করে বলে যদি মনে করি, তাহলে এটা তুলে দেয়ার মধ্য দিয়া সেই সব নিপীড়ন বন্ধের দিকে এক ধাপ এগুনো যায় বলেই মনে করি! রাষ্ট্র তার সকল ধর্মের নাগরিককে সমান ও একই মর্যাদা দিচ্ছে, এটা জরুরি, কাগজে কলমে দিলেই যে বাস্তবে দিয়ে ফেলবে তা মনে করি না, কিন্তু তার মানে এই না যে, কমপক্ষে কাগজে কলমের স্বীকৃতির প্রয়োজন নাই ..

চার/ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার আগেও সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে! কেবল তাই নয়, হিন্দু জনগোষ্ঠীর জমিজমা দখলের নিমিত্তে করা শত্রু সম্পত্তি আইন নতুন ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন ‘ নামে বহাল তবিয়তে থাকা, ওআইসিতে যোগদান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মসজিদ মাদ্রাসা প্রভৃতিতে অব্যাহত পৃষ্ঠপোষকতা করার মাধ্যমে বিশেষ এক ধর্মের প্রতি স্পেশাল ফেভার দেখানো .. সেই ধারাবাহিকতায় পচাত্তরে ইসলামিস্টদের উত্থান, সংবিধানে বিসমিল্লাহ ঢুকা .. এ সবই হয়েছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম না থাকা অবস্থায়! এই ইতিহাস থেকে আমরা কি সিদ্ধান্ত নিতে পারি? এসব যেহেতু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম না থাকতেই হয়েছে, সেহেতু রাষ্ট্রধর্ম থাকলেই কি এসে যায় – এমন? নাকি, পূর্বের যাবতীয় ঘটনার কনসিকুয়েন্স বা ধারাবাহিকতায় এরশাদের এই রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বানানোকে দেখবো?
এখনো ভয়ানক সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তাদের জমিজমা দখলের উদ্দেশ্যে মেরেকুটে দেশত্যাগে বাধ্য করা কমেনি, সংখ্যাগুরুর ধর্মকে রাষ্ট্রীয় তোষণ এবং ভরণপোষণও চলে সমানহারে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তুলে দিলেই এসব বন্ধ হবে না, কিন্তু এখান থেকে কি সিদ্ধান্ত নিতে পারি? ওসব বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করে কোন লাভ নাই – এমন? নাকি, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলের দাবির সাথে সাথে ওসব বন্ধের জন্যও জোর দাবি তুলবো?
ওসব বন্ধ করার চাইতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তুলে দেয়াই একমাত্র ও অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এমন দাবীও তো করা হচ্ছে না ..
কলু শেখের জমি জিরে ভিটেমাটি জালিয়াতি করে গ্রামের প্রভাবশালী মাতবররা দখল করছে! তার হালের লাঙলও নিছে একজন, গরুও নিছে আরেক মাতবর, তুলে নিয়ে নিজের কামে ব্যবহার করতে লাগছে .. কলু শেখ গিয়ে তারে ধরছে, ভাই আমার লাঙল নিছেন ক্যান .. জবাবে কয় – ব্যাটা আগে যা গরু উদ্ধার কর, গরু ছাড়া লাঙল দিয়া কি করবি .. তারপর কলু যায় আরেক মাতবরের কাছে যে তার গরু নিছে, মাতবর কয় – আরে বেটা ভিটেমাটি উদ্ধার করগে আগে, নাইলে গরু রাখবি কই, খাওয়াবি কি .. ইত্যাদি ..

পাচ/ আহমেদ ছফার খন্ডিত ও নিজ বক্তব্যের সমর্থন সূচক ব্যবহারের প্রতিবাদ জানালাম .. নিজ বক্তব্যের যুক্তিতে আস্থা না থাকলেই বোধ হয় লোকে এইরকম ওজনদার রেফারেন্স নিয়া টানাটানি করে .. অনেকে এইটা করে, নিজেরে পন্ডিত হিসাবে তুলে ধরার নিমিত্তে .. আপনি কোন উদ্দেশ্যে করেন জানি না, তবে এই রকম যত্রতত্র ভুলভাল রেফারেন্স ইউজ করার বিপত্তি হইতেছে, যার রেফারেন্স ইউজ করা হইতেছে, তার ব্যাপারে জনমানুষে একটা ভুল ধারণা তৈরি হইতে পারে! এইখানে যেমন মনে হইতেছে, ছফা যেনবা ছিলেন, এরশাদের রেসিডেন্ট ভাড় এবং এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বড় সমর্থক ও প্রচারক ..
তাই রিকুয়েস্ট করবো, রেফারেন্স যদি একান্তই উল্লেখ করতে হয়, দয়া করে কোটেশন উল্লেখ করবেন এবং পুস্তক প্রবন্ধ এসব তথ্য সূত্র উল্লেখ করবেন ..
আগেও আলোচনা করেছি- সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা আনা আওয়ামীলীগের সমালোচনা করা ও বিরোধিতা করা মানেই এই না যে- রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করা না করা একই- এমনটা বলা। বরং- ১৯৯৯ সালের আহমদ ছফার একটা সাক্ষাতকারে দেখলাম- তিনি বঙ্গবন্ধুকে দোষারোপ করছেন- সংবিধানে সেক্যুলারিজম রাখার পরে নিজেই সেটা ভঙ্গ করছেন ইসলামি কনফারেন্সে গিয়ে, গণতন্ত্রের কথা লিখে- নিজে একনায়কতন্ত্র শুরু করলেন, সমাজতন্ত্রের কথা বলে চালু করলেন লুটপাটতন্ত্র … ইত্যাদি, এখন শেখ মুজিবের এই সমালোচনার মানে যদি মনে করে কেউ যে- ছফা সেক্যুলারিজম, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র- এসবের বিরোধিতা করার জন্যে ওসব লিখেছেন- তাহলে খুব মুশকিল! একই সাক্ষাতকারে- দেখি, তিনি ঐ সময়ে আওয়ামীলীগ সরকারকে দুষছেন- তারা ক্ষমতায় থেকে কেন- রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করতে পারছে না … ফলে, আহমেদ ছফা সম্পর্কিত আপনার আলোচনাটা ঘোলাটেই থেকে গেল … আহমেদ ছফার সাক্ষাৎকার থেকে কপি করছিঃ

//প্রশ্ন: বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রের কাঠামোগত পরিবতর্ন ঘটেছে। ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। গত একুশে ফেব্রুয়ারি(১৯৯৮) সকালে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে একটা ব্যানার চোখে পড়লো। যেখানে লেখা ছিল একুশের চেতনা রাষ্ট্রধর্ম মানে না। এ বিষয়ে-
আহমদ ছফা: আমি স্পষ্ট ভাষায় এ বিষয়ে লিখেছি। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে, ইসলামের কোন সহায়তা করা হয়নি। বিশেষ বিশেষ শ্রেণী এবং বিশেষ বিশেষ গ্রুপের স্বার্থেই এসব করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের কোন উপকার করা হয় নি। আর রাষ্ট্রের যে চারিত্রের কথা বললেন, শেখ মুজিব যে সংবিধান তৈরি করলেন তা তিনি নিজেই অমান্য করলেন। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তৈরি করে ইসলামি কনফারেন্সে তিনি নিজেই গেলেন। সংবিধান পাল্টে তিনি প্রেসিডেন্ট হলেন। শেখ মুজিব বেচে থাকতেন, তাহলেও এক সময় না এক সময় বাংলাদেশের সংবিধানের পরিবর্তনগুলো হয়েছে, তা তিনি নিজেই করতেন বলে আমার ধারণা। আজকে বাংলাদেশের যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, সব পরিবর্তনগুলো কি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্যগুলো তৈরি হয়েছে, শেখ মুজিবের সময় থেকেই এর সূচনা। তিনি গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে একনায়কতন্ত্রের পথ ধরলেন। পরবর্তীকালে অন্যরা সেই প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। রুচিশীল নাগরিক যারা আছেন, তারা সকলেই রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরোধীতা করেছেন, প্রচণ্ড বিরোধীতা করেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রধর্মকে বাতিল করছে না।///

ছয়/ বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম আগে ছিল না, এটার মাধ্যমে কি বুঝানো হয়েছে? পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এখন আমরা সেক্যুলার রাষ্ট্র? সেক্যুলার রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম – এই অদ্ভুত গাজাখুরী সংমিশ্রণরে সেক্যুলারিজম বলা যায়?

সবশেষে, সাত/ শুরুর লাইনটি : রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা না থাকার সাথে নাকি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কোন সম্পর্ক নাই! এইটা সবচেয়ে প্যাথেটিক লাইন .. সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি অর্থ কি কেবল এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়ের উপর কতখানি ফিজিক্যাল নির্যাতন করলো, মারলো কাটলো পুড়াইলো ভাঙলো উচ্ছেদ করলো দখল করলো .. এসবই? সংখ্যাগুরুর যে ক্ষমতার দম্ভে নিজেদের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার মাধ্যমে এই রাষ্ট্রকে অন্য ধর্মের মানুষের নয় হিসাবে প্রতীয়মান করার চেস্টা হয়, সেই ক্ষমতা চর্চা যদি এইখানে না দেখেন, তাইলে এর চাইতে প্যাথেটিক কিছু নাই .. মর্যাদাবোধের বিষয়টা কি একেবারেই নগন্য? বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম যদি ইহুদী ধর্ম বা খ্রিস্টধর্ম করা হয়, এবং আপনার কথিত সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি একই রাখা হয় বা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সুন্দর রাখা যায়, এখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠী কেমন বোধ করবে? বা এটা কি তারা কল্পনাও করতে পারে? পারে না, কারণ সংখ্যাধিক্যের ক্ষমতা তার কাছে… সেই বলেই তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে, টিকিয়ে রাখে! এই ক্ষমতার জোরেই সাম্প্রদায়িক নিপীড়নগুলো ঘটে, .. ফলে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি কেমন তার একটা বড় ইন্ডিকেশন এই রাষ্ট্রধর্মের উপস্থিতি ..
আর, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের উপস্থিতি, সংখ্যাগুরুদেরকে নিজেদের ক্ষমতার ব্যাপারে সচেতন করে, কনফিডেন্স দেয় এবং সংখ্যালঘুদেরকে দেশ থেকে উচ্ছেদের ব্যাপারে মানসিক বৈধতাও দেয় .. সরকার বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে রাষ্ট্রধর্মের প্রতি বিশেষ দেখভালের দাবী তোলার মোরাল গ্রাউন্ডও তৈরি করে .. এসবভাবেই, রাষ্ট্রীয় ধর্ম সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, নির্যাতন ও সহিংসতায় ভীষণ ভূমিকা রাখে ..

সবশেষে, সাত/ শুরুর লাইনটি : রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা না থাকার সাথে নাকি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কোন সম্পর্ক নাই! এইটা সবচেয়ে প্যাথেটিক লাইন .. সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি অর্থ কি কেবল এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়ের উপর কতখানি ফিজিক্যাল নির্যাতন করলো, মারলো কাটলো পুড়াইলো ভাঙলো উচ্ছেদ করলো দখল করলো .. এসবই? সংখ্যাগুরুর যে ক্ষমতার দম্ভে নিজেদের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার মাধ্যমে এই রাষ্ট্রকে অন্য ধর্মের মানুষের নয় হিসাবে প্রতীয়মান করার চেস্টা হয়, সেই ক্ষমতা চর্চা যদি এইখানে না দেখেন, তাইলে এর চাইতে প্যাথেটিক কিছু নাই .. মর্যাদাবোধের বিষয়টা কি একেবারেই নগন্য? বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম যদি ইহুদী ধর্ম বা খ্রিস্টধর্ম করা হয়, এবং আপনার কথিত সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি একই রাখা হয় বা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও সুন্দর রাখা যায়, এখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠী কেমন বোধ করবে? বা এটা কি তারা কল্পনাও করতে পারে? পারে না, কারণ সংখ্যাধিক্যের ক্ষমতা তার কাছে… সেই বলেই তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে, টিকিয়ে রাখে! এই ক্ষমতার জোরেই সাম্প্রদায়িক নিপীড়নগুলো ঘটে, .. ফলে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি কেমন তার একটা বড় ইন্ডিকেশন এই রাষ্ট্রধর্মের উপস্থিতি ..
আর, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের উপস্থিতি, সংখ্যাগুরুদেরকে নিজেদের ক্ষমতার ব্যাপারে সচেতন করে, কনফিডেন্স দেয় এবং সংখ্যালঘুদেরকে দেশ থেকে উচ্ছেদের ব্যাপারে মানসিক বৈধতাও দেয় .. সরকার বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে রাষ্ট্রধর্মের প্রতি বিশেষ দেখভালের দাবী তোলার মোরাল গ্রাউন্ডও তৈরি করে .. এসবভাবেই, রাষ্ট্রীয় ধর্ম সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, নির্যাতন ও সহিংসতায় ভীষণ ভূমিকা রাখে ..

সবাইকে ধন্যবাদ, কষ্ট করে ও ধৈর্য ধরে এত বিশাল লেখাটি পড়ার জন্যে।

তথ্যসূত্রঃ
১/ http://www.amardeshonline.com/pages/details/2016/03/24/328722#.VvXStuIrKM8
২/ http://doinikamardesh.com/index.php?p=/pages/details/2016/03/25/328905#.VvXRCeIrKM8
৩/ http://www.dw.com/bn/a-19131853
৪/ আহমদ ছফার সাক্ষাৎকারঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/Amrokanon/29643014
৫/ http://studiesbangladesh.blogspot.fi/2011/06/constitutional-amendments-constitution.html
৬/ http://www.ittefaq.com.bd/national/2014/09/18/1814.html
৭/ http://amader-kotha.com/page/394344
৮/ বাংলাদেশ সংবিধানঃ http://bdlaws.minlaw.gov.bd/bangla_pdf_part.php?id=957
৯/ “বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্রের গতিমুখঃ সূচনাকাল” – ফিরোজ আহমেদ