মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৯

'সব মরণ নয় সমান'*

জনপ্রিয় নারীবাদী ফেসবুকার, ব্লগার, লেখক নাদিয়া ইসলাম বলেছেন,

"পিনাকী ভট্টাচার্যরা যদি কন, অভিজিতের রক্ত আর হেফাজতের একজন কর্মীর রক্তে কোনো পার্থক্য নাই, উনাদের শরীর বারুদের বস্তার মত জ্বইলা উঠে। পিনাকীর সাথে আমার রাজনৈতিক দ্বিমত আছে একশবার, কিন্তু উনার এই কথার সাথে আমি একমত। আমি অভিজিতের রক্তের সাথে হেফাজতের একজন কর্মীর রক্ত, একজন হিটলারের রক্তের সাথে একজন এ্যানি ফ্রাংকের রক্তের, ইদি আমিনের রক্তের সাথে মাদার তেরেসার রক্তের, আদিবাসী একজন পাহাড়ির রক্তের সাথে বাঙ্গালী মুসলমানের রক্তের, একজন আসিফ মহিউদ্দীনের রক্তের সাথে গোলাম আজমের রক্তের পার্থক্য দেখি না। একজন মাদার তেরেসার সাথে একজন হিটলারের পার্থক্য তার কাজে। একজন কাদের মোল্লার সাথে একজন বীরশ্রেষ্ঠের পার্থক্য তার কাজে। তার রক্তে না"। 
নাদিয়ার মত আমিও বিশ্বাস করি, দুনিয়ার কোন মানুষেরই "অন্যায্য"ভাবে হত্যার অধিকার পৃথিবীর দ্বিতীয় মানুষের নাই, রাষ্ট্রেরও নাই; এমনকি সেই মানুষ যদি ভয়ংকর ঘৃণা থেকে ছয় মিলিয়ন মানুষরে নির্বিচারে হত্যা করে, তারপরেও সেই সেই মানুষরে বিনা বিচারে হত্যা করা যায় না; এমনকি সেই মানুষ একজন শিশু ধর্ষকও হন, তারপরেও উনারে রাস্তাঘাটে বিনা বিচারে পিটায়ে মাইরা ফেলা যায় না; এমনকি সেই মানুষ ইয়াবা ব্যবসায়ী বা ভয়ানক সন্ত্রাসীও হন, তারপরেও উনারে ক্রসফায়ারে মেরে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়া যায় না ...। আমার ধারণা, দুনিয়ার যেকোন মানবতাবাদী ব্যক্তির বিশ্বাস এ থেকে আলাদা হওয়ার কথা না! এমনকি- যাদের 'শরীর বারুদের বস্তার মত জ্বইলা উঠে' উল্লেখ করে এগুলো লেখা হলো- তাদের বিশ্বাসও ভিন্নরকম নয় বলেই আমার ধারণা, অন্তত আমি সাধারণভাবে তেমনটি দেখিনি (এক ধর্ষককে গণপিটুনির ঘটনা বাদে)! বরং এদের কাউকে কাউকে দেখেছি- "ন্যায্য"ভাবে কিংবা "যথাযথ বিচার" প্রকৃয়ার মাধ্যমেও একজনকে হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার! যাই হোক, প্রতিটা মানুষের রক্তের মূল্য তথা জীবনের মূল্য যে সমান- এ ব্যাপারে নাদিয়ার সাথে কোনই দ্বিমত নেই! কিন্তু, মুশকিলটা হচ্ছে- নাদিয়াকে এই বেসিক ও প্রাইমারি মানবিক অবস্থানটা নেয়ার জন্যেও পিনাকীর উপরে সওয়ার হতে হচ্ছে। পিনাকীর সাম্প্রদায়িক অবস্থান, স্ববিরোধিতা, রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে- কেবল একটি লাইনকে সামনে এনে তার সাথে একমত দেখানো আর পিনাকির পুরা রাজনৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধাচরণকে ঐ একটা মহান মানবিক লাইনের বিরুদ্ধাচরণ হিসেবে দেখানোকেও (শরীর বারুদ বস্তার মত জ্বইলা উঠে) বুদ্ধি-জৈবিক অসততা কওয়া যায় কি?
সোজা হিসাব কিছু দেখা যাইতে পারে- নাদিয়ার দেয়া কনট্রাস্টগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। একজন হিটলারের রক্তের সাথে একজন আনা ফ্রাংকের রক্তের কোন পার্থক্য নাই সত্যি- কিন্তু সেই সাথে এইটাও সত্য যে হিটলার যেমনে ১৫ বছরের কিশোরি আনা ফ্রাঙ্কের মত লাখ লাখ ইহুদির রক্তের কারণ হয়েছিলো- হিটলারের রক্ত কিন্তু অন্য কেউই ঝরায়নি! আদিবাসী একজন পাহাড়ির রক্তের সাথে বাঙ্গালী মুসলমানের রক্তের কোন পার্থক্য নাই ঠিকই, কিন্তু বাঙালি মুসলমান সেটেলাররা যেভাবে রাষ্ট্রীয়যন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ে রক্ত ঝরিয়েছে- ধারাবাহিক এথনিক ক্লিনজিং চালিয়ে যাচ্ছে- তারই মরিয়া প্রতিরোধ সংগ্রামে বাঙালি মুসলমানের যখন রক্ত ঝরে- উভয়পক্ষকে সমান দোষী বলা কি সাজে? একজন বীরশ্রেষ্ঠের রক্তের সাথে গোলাম আজমের রক্তের কোন পার্থক্য নাই -এইটা যেইরকম সত্যি, তেমনি তার চাইতেও বড় সত্যি হচ্ছে- রক্তটা ঝরেছে ঐ বীরশ্রেষ্ঠেরই, গোলাম আজমের না! আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর প্রতিরোধ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হওয়া পাক হানাদারদের রক্তের মধ্যেও নিশ্চয়ই কোন পার্থক্য নেই, কিন্তু কোন মৃত্যুকে স্মরণ করি, গ্লোরিফাই করি?
একইভাবে, কোন সন্দেহ নাই যে, অভজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় কিংবা বেঁচে ফেরা আসিফ মহিউদ্দিন, আহমেদুর রশিদ টুটুল-এর রক্ত আর হেফাজত কর্মীদের রক্ত একদম এক, কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু, সেই সাথে এইটাও সত্য যে- হেফাজতরা অভিজিৎ - আসিফদের রক্ত ঝরাতে চেয়েছে, রক্ত ঝরাতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে, এখনো জীবিত অভিজিৎ- অনন্তদের রক্ত ঝরাতে চায়; অন্যদিকে অভিজিৎ, অনন্ত, আসিফ, টুটুলরা কোনদিনই হেফাজত কর্মীদের রক্ত চায়নি, বরং হেফাজতের ব্রেইন ওয়াশড শিশুদের যেভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটায় উদ্বিগ্ন হয়েছে। নাস্তিকদের ফাঁসীর দাবিসহ ১৩ দফা দাবিতে হেফাজত শাপলা চত্বরে এসে যেভাবে দখল নিয়েছিলো- যে তাণ্ডব শুরু করেছিলো- রাষ্ট্রযন্ত্র সেই অরাজক অবস্থা কাটিয়ে উঠুক- এই প্রত্যাশা থাকলেও- হেফাজত কর্মীর রক্ত কেউই বস্তুত প্রত্যাশা করেনি। পিনাকি - মাহমুদুর - বাবুনগরীদের হাজার হাজার হেফাজতী লাশের গল্পের প্রমাণ চেয়েছে ঠিকই- কিন্তু যে কজন হেফাজতী কর্মী ঢাকায় লাশ হয়েছিলেন- তাতে কেউই আনন্দ প্রকাশ করেনি; বরং প্রতিবাদই জানিয়েছিলো ... ! অভিজিৎ কিংবা একজন হেফাজৎ কর্মীর রক্তের অবশ্যই কোন পার্থক্য নাই- এই অর্থে পার্থক্য নাই যে, কারোরই অস্বাভাবিক মৃত্যু হোক আমরা চাই না। কিন্তু, তাই বলে কি মৃত্যুতে মৃত্যুতে কি কোন পার্থক্য নেই? সব মৃত্যুই কি সমান? একজন নিরীহ নাগরিককে স্রেফ ভিন্নচিন্তা প্রকাশের দায়ে মেরে ফেলা আর খুন ও ধ্বংসের নেশায় উন্মত্তদের হাত থেকে নিরীহ-আতংকিত-আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জানমাল রক্ষায় ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে মেরে ফেলা- দুটো কি এক? কোন সন্দেহ নাই- অভিজিৎ রায় আর হেফাজত কর্মীর রক্তের কোন পার্থক্য নেই, কোন সুস্থ বুদ্ধির মানুষ আরেকজন মানুষের রক্ত কামনা করতে পারে না- তা সে হেফাজত-কর্মীর বেঁচে থাকার দাবি তোলা অভিজিৎ রায় হোক কিংবা অভিজিৎ রায়ের ফাঁসীর দাবি তোলা একজন হেফাজত কর্মীই হোক! কিন্তু,'কুলাঙ্গার নাস্তিক ব্লগার'দের ফাঁসীর দাবিতে মারা যাওয়া (আসল এবং নকল) হেফাজত কর্মীদের রক্তকে শহীদের রক্তের মর্যাদা দেয়া হেফাজতকে কি পিনাকি, কিংবা নাদিয়া - এই আলাপ শুনাতে গিয়েছে, বা যাচ্ছে?
আর, পিনাকির সেই আলাপ উত্থাপনের জায়গা ছিল কি? অভিজিৎ রায় সহ মুক্তমনা ব্লগারদের খুনের বিরুদ্ধে যারা বলছে- তারা কেন একই সাথে হেফাজতকর্মীদের খুনের বিরুদ্ধে কথা বলছে না- এমন প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য কি বলে নাদিয়ার মনে হয়? হেফাজতকর্মী সহ দেশের (কিংবা দুনিয়ার) যেকোন খুনের বিরুদ্ধেই মুক্তমনারা কথা বলে। কিন্তু নির্যাতিত, নিপীড়িত, প্রান্তিক, দুর্বল, জীবন নাশের আশংকা আছে- এরকম গোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়ালে, তাদের বিরুদ্ধে যাবতীয় নির্যাতন, খুনের প্রতিবাদ করলে- অন্য আরেকটি প্রসঙ্গ টেনে আনার উদ্দেশ্যই বস্তুত থাকে, আলোচ্য প্রতিবাদকে একটু খেলো করে দেখানো ...। হেফাজতকর্মী সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের কল্লার দাম কেউ ঘোষণা করেনি- তাদের ফাঁসীর দাবিতে মিছিল সমাবেশও হয়নি, সরকারের তরফ থেকে হেফাজতের উদ্দেশ্যে নানারকম প্রণোদনা- উপঢৌকন অব্যাহত আছে; এইরকম বাস্তবতায় যাদের প্রাণের আশংকা আছে, যারা প্রান্তিক ও নির্যাতিত- নাস্তিকরা, আদিবাসীরা, হিন্দুরা- তাদের উপরে হামলা, আক্রমণের প্রতিবাদ করা হলে- প্রতিক্ষেত্রেই কি সংখ্যাগরিষ্ঠ, ক্ষমতাশালীদেরও কথা আলাদা মেনশন করতে হবে?
আচ্ছা, উল্টোদিক দিয়ে উদাহরণ দেয়া যাক। পিনাকি যে কাজটা করেছে, আবরার হত্যার পরে- ঠিক একই কাজটি করে গিয়েছে - আওয়ামী চামচাদের দল। "পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া আবরার হত্যা নিয়া এত চিল্লাফাল্লা, কিন্তু একই সময়ে যে আরেকটা হিন্দু ছাত্র খুন হলো- সেই ব্যাপারে কোন কথা নাই কেন?" "বাপ-চাচার হাতে নির্মম খুনের শিশুটিকে নিয়ে কই একটা মানব বন্ধনও হইলো না?" কিংবা "এই বুয়েটেই জামাতের হাতে বুয়েট ছাত্র মারা যাওয়ার পরেও তো কিছু হয় নাই" ... ইত্যাদি ইত্যাদি কইয়া- সিলেকটিভ মানবতাবাদীদের নিয়া কয়েকটা গালি ... ! আমি অন্য খুনগুলো নিয়ে বিচলিত, বিমর্ষ, মানসিকভাবে অসুস্থবোধ করলেও- কেবল আবরার খুন নিয়ে যাবতীয় এক্টিভিজম চালিয়েছি, এই কারণে না যে- বুয়েটের "মেধাবী" ছাত্র আবরারের রক্তের মর্যাদা আমার কাছে অন্যদের রক্তের চাইতে বেশি; বরং এই কারণ যে- বুয়েটের হত্যাকাণ্ডটি সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের নিরীহ ছাত্রের উপরে শক্তি প্রদর্শনের বহিপ্রকাশ- যা বুয়েটের মত শিক্ষায়তনগুলোতে খুবই নিয়মিত চর্চা হয়ে দাড়িয়েছিলো বলে এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্যেই একটা শক্ত আন্দোলনের দরকার। অন্য ক্ষেত্রে- অপরাধী বাবা-চাচারা এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে, শক্তি সামর্থ্যের দিক দিয়ে খুনীরা নিজেরাই একদম প্রান্তিক অবস্থানে, তার উপরে গোটা দেশের ঘৃণার পাত্র (এই ঘটনায় অসুস্থবোধ হয়, কিন্তু আন্দোলন করবো কার বিরুদ্ধে?)- আর অন্য ঘটনায় খুনের মোটিভ, খুনী- এসব কিছুই উদঘাটিত হয়নি ... ! যাই হোক, আবরারকে নিয়ে কথা বললেও কেন তুহিন মিয়া বা শাওন ভট্টাচার্যকে নিয়া কথা বলছি না- এই প্রশ্নের উদ্দেশ্য আবরার, তুহিন মিয়া বা শাওন ভট্টাচার্যের রক্তের পার্থক্য দূর করা নয়, বরং আবরার খুনের ইস্যুটিকে হালকা করা চেষ্টা করা ...! - এই ব্যাপারে নাদিয়া (এবং পিনাকিও) খুব সম্ভবত দ্বিমত করবে না! একই কাজ কি পিনাকি করে নাই?
 
* এই লেখার শিরোনামটি নেয়া হয়েছে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান জন্মিলে মরিতে হবে গানটি থেকে। 
*** রাজধানী ঢাকায় গাড়িতে এক নারীকে ধর্ষণের চেষ্টাকালে ধর্ষক রনি হককে পাবলিক ধরে দুচার ঘা বসিয়েছিলো - সম্ভবত কাপড় চোপড়ও ছিড়ে ফেলছিলো এবং সেটা ভিডিও করে গর্বভরে ফেসবুকে ছেড়েছিলো। সেই ঘটনায় অনেক নাস্তিক বন্ধুদের ধর্ষককে গণপিটুনির পক্ষে ওকালতি করতে দেখেছিলাম। ধর্ষককে গণপিটুনির বিরোধিতা করতে গিয়ে কয়েকজন তো ব্লকও করে দিয়েছিলো। সে যাই হোক- এই ব্যাপারে নাদিয়া যে কথাটি বলেছে- তার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। এমনকি শিশু ধর্ষক হলেও- তারে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলা যাবে না। কিন্তু, ঐ ঘটনায় নাদিয়া সহ একটা অংশ, যারা গণপিটুনির বিরোধিতা করছিলো, কি অদ্ভুত কারণে যেন- ধর্ষণের শিকার নারীর বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছিলো, ঐ মেয়েটি কেন গাড়ীতে লিফট চাইলো- মেয়েটি সত্য বলেছে তার প্রমাণ কি, ঢাকায় কোন শ্রেণির মেয়ে এমন অপরিচিত লোকের গাড়িতে উঠে, গাড়িতে ঢাকা শহরে ধর্ষণ করা যায় কি না, রনি যে ধর্ষক- তার প্রমাণ কি, আদালতে প্রমাণের আগে- রনিকে ধর্ষক বলা যাবে কি না ... ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ... ধর্ষককে আদালতে সোপর্দ করা উপস্থিত জনতার দুচার ঘা দেয়াকে সমর্থন করি না, কিন্তু তার চাইতেও অনেক নিন্দনীয় কাজ হচ্ছে- এভাবে ভিক্টিমকেই কাঠগড়ায় দাড় করানো ...
 
[ফেসবুক থেকে]

বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯

"পপুলারিস্ট" নাস্তিকদের প্রতি স্বঘোষিত "সৃজনশীল" সেক্যুলারদের আপত্তি প্রসঙ্গে

বাংলাদেশের "পপুলারিস্ট" নাস্তিকদের চিন্তার ভুল দেখাতে গিয়ে প্রগতিশীল - সেক্যুলার - নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দেয়া ফেসবুকার - ব্লগার দিলশান পারুল বলেছেন, "পপুলারিস্ট" নাস্তিকরা নাকি "ইতিহাসের সাথে অসততা করছেন", "নিজের মতো বিশ্লেষণ করার নামে তারা বিভিন্ন ভাবে তথ্য বিকৃত করেছেন"! তো, এই ইতিহাসের সাথে অসততা আর তথ্য বিকৃতির অভিযোগের পক্ষে ওনার যুক্তি কি? তিনি তাদের অসততার উদাহরণ দিয়েছেনঃ 

অসংখ্য জায়গায় তারা ("পপুলারিস্ট" নাস্তিকরা) মহানবী (সাঃ) কে সরাসরি ধর্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন, পেডোফাইল বলেছেন, বহুগামী বলছেন। 

আজকের নৈতিকতাকে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগের সমাজের উপরে চাপিয়ে সেই আমলের কাউকে পেডোফাইল, ধর্ষক বলা যায় কি না- এই প্রশ্নটার যৌক্তিকতা মেনে নিয়েও বলতে হচ্ছে, কোরান- হাদিস আর নবীর মৃত্যুর পরের তিন-চারশ বছরের মধ্যেই লেখা নবীর জীবনী এগুলোকে যদি ঐতিহাসিক টেক্সট হিসেবে গণ্য করা যায়, ঘটনা হিসেবে অনেক কিছুরই ঐতিহাসিক সত্যতা খুজে পাওয়া যাবে, সে হিসেবে আজকের নৈতিকতা দিয়ে অতীত ঘটনাকে বিচারের অভিযোগ করা যেতে পারে, কিন্তু ইতিহাস বিকৃতি বা ইতিহাসের সাথে অসততার অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন! বরং ইতিহাসের সেই অধ্যায়গুলোকে আড়াল করার চেষ্টার মধ্যেই ইতিহাসের সাথে অসততা বিরাজমান।

ইসলামের নবীর বহুবিবাহ'র তথ্য কবে কে অস্বীকার করতে পারবে? অনেকগুলো বিয়ে করেছেন তিনি, একসাথে সর্বোচ্চ ৯ জন স্ত্রীর কথা জানা যায়। যে সময়ে তিনি কোরানের আয়াতের মাধ্যমে চারের অধিক বিয়েকে নিষিদ্ধ করে সাহাবিদেরকে সর্বোচ্চ চার স্ত্রীকে রেখে তার অধিক স্ত্রী-কের তালাকে বাধ্য করলেন, সেই সময়েও নবীর নিজের ৯ জন স্ত্রী ছিল। এবং তাকে আরেকটি আয়াত নাজিল করিয়ে আগের বিধানটি যে কেবল ও কেবলমাত্র ইসলামের নবীর জন্যে প্রযোজ্য না- সেই মর্মে আরেক বিধান বানাতে হয়েছিলো! আর, এই বহুগামিতা তথা বহুবিবাহের প্রথাটি তো কেবল ১৪০০ বছর আগের নবীর জীবনীতে সীমাবদ্ধ নেই, বরং আজকের এই আধুনিক যুগে এসেও অনেক মুসলমান কোরআনকে দেখিয়ে চার বিয়ের বৈধতা দাবি করে! সেই সাথে, কোরআনে কৃতদাসী বা যুদ্ধে হস্তগত নারীর সাথে বিবাহ বহির্ভূতভাবেই মিলিত হওয়াকে বৈধতা দেয়া হয়েছে, সেই বিধান মোতাবেক নবী নিজে এবং তাঁর সাহাবীদের বৈধ স্ত্রী বাদেও অনেক দাসীও ছিল, যাদের সাথে বিবাহ সম্পর্ক বাদেই মিলিত হয়েছিলেন তারা। আর, সেই বিধান দেখিয়ে দাসীদের সাথে মিলিত হওয়ার অধিকার পায় খোদ নবীর দেশের ও আশপাশের দেশের মুসলমানরা, যার সরাসরি ভুক্তভোগি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের দেশ থেকে যাওয়া অসংখ্য গৃহকর্মী নারী! ফলে, নবীকে এবং ইসলামের বিধানকে বহুবিবাহের জন্যে অভিযুক্ত করা হলে, সেটা কিভাবে ইতিহাসের সাথে অসততা হতে পারে?
 

১৪০০ বছর আগের নৈতিকতায় যখন বাল্যবিবাহ খুবই স্বাভাবিক, নৈমত্তিক ও সামাজিকভাবে খুবই গ্রহণযোগ্য-প্রচলিত প্রথা ছিল, তখন আজকের যুগের নৈতিকতা চাপিয়ে দিয়ে নবী মুহম্মদকে পেডোফাইল বলা যায় না- এমনটা আমিও মনে করি। কিন্তু তার মানে এই না যে, বিয়ের সময়ে আয়েশা নিতান্তই শিশু ছিলেন না! দিলশানা পারুল যুক্তি করেছেন, 

"ওই সময় যেহেতু জন্ম নিবন্ধীকরণ, মানে বার্থ সার্টিফিকেট বা ম্যারেজ সার্টিফিকেটের চল ছিলো না কাজেই বিবি আয়েশার প্রকৃত বয়স আসলে নিশ্চিত করে বলা যায়নি। এটা নিয়ে অনেক মুসলিম স্কলারের অনেক লিখা, কাউন্টার লিখা আছে"!

এমন খেলো যুক্তির মাধ্যমে ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টাকেই অসততা বলতে হয়। ঐ সময়ে বার্থ সার্টিফিকেট, ম্যারিজ সার্টিফিকেট না থাকার পরেও মুহম্মদ কত সালে জন্মিয়েছেন, কবে কত বছর বয়সে খাদিজাকে বিয়া করেছেন, বিয়ের সময়ে খাদিজার বয়স কত ছিল, মুহম্মদ কত বছর বয়সে ইসলাম প্রচার শুরু করেন, কত বছর বয়সে মারা গেলেন- এসবের কোন কিছু নিইয়েই কোন অনিশ্চয়তা নেই, আছে কেবল আয়শার বয়স নিয়ে? ব্যাপারটি খুব হাস্যকর হলো না? স্কলারদের মধ্যে যে মতবিরোধ, তা আসলে কি নিয়ে? বিয়ের বয়স নিয়ে, নাকি বাসর করেছেন কত বছর বয়সে, তা নিয়ে? হাদীসগুলোতে, সীরাত গ্রন্থে আয়েশার দুরকম বয়সের কথা উল্লেখ আছে- ৬ বছর আর ৯ বছর। ফলে, অনেক স্কলার ৬ বছরের পক্ষে মত দেন, অনেকে মত দেন ৯ বছরের পক্ষে। আর, একটা বড় অংশের স্কলাররা বলেন- মুহম্মদ আয়েশাকে বিয়ে করেন ৬ বছর বয়সে, কিন্তু বাসর করেন (মানে কনজুমেট করেন) আয়েশার বয়স যখন ৯ বছর। ৬, কিংবা ৯ বছরের শিশুকে বিয়ে করাটাকে বাল্যবিবাহই বলা হবে। ফলে, এখানেও ইতিহাসকে লুকানোর বা বিকৃত করার কিছু নেই। সমালোচনা করতে চাইলে- এতটুকুই করা যায়, সেই আমলের নৈতিকতা-মূল্যবোধে যে বাল্যবিবাহ খুব স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য প্রথা হিসেবে প্রচলিত, সেই প্রথাকে অপরাধ হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না!

১৪০০ বছর আগের নৈতিকতা অনুযায়ী নবী মুহম্মদকে ধর্ষক বলা যাবে কি না, আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু ইতিহাসের কথা যদি বলতে হয়, কে কবে এটা অস্বীকার করতে পারবে যে মুহম্মদের দুইজন স্ত্রী যুদ্ধ থেকে "হস্তগত" (গণিমতের মাল)? সাফিয়াকে বিয়ে করার আগে- সাফিয়ার গোত্রপ্রধান বাবা, সাফিয়ার স্বামী, সাফিয়ার পুরুষ আত্মীয় স্বজন- পাড়া প্রতিবেশী সহ পুরা গোত্রের সব পুরুষকে কচুকাঁটা করা হয়েছিলো! আর জুহারিয়াকে যুদ্ধ থেকে হস্তগত করার পরে জুহারিয়ার বাবা মুক্তিপন দিয়ে হলেও মেয়েকে ফেরত চেয়েছিলেন। ফেরত দেয়া হয়নি। ইসলামী স্কলার ইমাম কারযাভি এই বিয়েগুলোর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছিলেন, চাইলে নবী বিবাহ না করেও সাফিয়া ও জুহারিয়াকে ভোগ করতে পারতেন বা অন্য সাহাবীদের মাঝে বাটোয়ারা করে দিতে পারতেন (সে সময়ের প্রথা অনুযায়ী এবং ইসলামের বিধান মতে সেটায় কোন সমস্যাই হতো), কিন্তু সেটা না করে নবী তাদেরকে বিয়ে করে উম্মুল মুমিনিনের মর্যাদা দিয়েছিলেন! একজন নারী (সাফিয়া) তার বাবা, স্বামী, আত্মীয় স্বজন- সবাইকে চোখের সামনে খুন হতে দেখেছেন, তার পরে সেই খুনীদের সর্দারকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছেন, এটা তার জন্যে মর্যাদার, নাকি অত্যাচার সেই সময়ের লোকজনই বলতে পারবে! কিন্তু, উম্মুল মুমিনিনের "মর্যাদা"র গল্পের একটি প্রশ্নই মাথায় আসে - সাফিয়া ও জুহারিয়ার বরাত দিয়ে কেন একটা হাদীসও নেই? আবু বকর কন্যা আয়েশা, উমর কন্যা হাফসা কিংবা মুহম্মদের আত্মীয় যয়নবের যে মর্যাদা ছিল, তা কি সাফিয়া, জুহারিয়া, মারিয়াদের ছিল? এমনকি খাদিজার মৃত্যুর পরে সন্তানদের দেখভালের জন্যে বিয়ে করা একটু বয়স্ক স্ত্রী সওদারও কি সমান মর্যাদা ছিল, যাকে নবী তালাক দিতে চেয়েছিলেন, কেবল নিজের ভাগ আয়েশাকে দান করার মাধ্যমে তালাক আটকাতে পেরেছিলেন? যাই হোক, মূল আলাপে আসি! মুহম্মদকে ঐ সময়ের নৈতিকতা দিয়ে ধর্ষক বলা যাবে কি না আমি নিশ্চিত নই, কেননা কোরান-হাদিসে যে নৈতিকতা দেখি, সেখানে ধর্ষণ নামের কোন অপরাধ খুজে পাই না, সেই তুলনায় জেনা বা ব্যভিচার হচ্ছে বিশাল অপরাধ। কিন্তু, আজকের নৈতিকতায় যুদ্ধবন্দী নারীকে যৌনভাবে ভোগ করাকে ধর্ষণ কি বলা যাবে? কোরআনে যখন যুদ্ধবন্দী নারী ও কৃতদাসীর সাথে যৌনমিলনকে যখন জায়েজ করা হয়, যখন কোরান-হাদিস দেখিয়ে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি ও "মালাউন" নারীকে গণিমতের মাল হিসেবে ভোগ করা জায়েজ বলে জামাত ফতোয়া দেয়, আজকেও যখন আইএস কুর্দি নারীদের ধরে ধরে যৌনকাজে ব্যবহার করছে, তখন এসবকে কি "ধর্ষণ" বলা যাবে না?

দিলশানা পারুল "পপুলারিস্ট" নাস্তিকদের সমালোচনায় বলেছেনঃ 

"ধর্ম বা ধর্মীয় ইতিহাসের চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে এরা স্থান, কাল, পাত্র এই বিষয়টিকে সম্পূর্ণ এভয়েড করেছে" ... "আপনি কথা বলছেন ৬ শতকের ঘটনাবলী নিয়ে! ... ১৪০০ বছর আগের নীতি নৈতিকতার সংজ্ঞা আর আজকের নীতি নৈতিকতার সংজ্ঞা কখনই এক না, নীতিনৈতিকতা এমনই একটি সামাজিক ইন্ডিকেটর যেটা দেশে দেশে সময়ে সময়ে পাল্টায়" ... ইত্যাদি ইত্যাদি।  

আরেক স্বঘোষিত "জ্ঞানী-পণ্ডিত" ও "সৃজনশীল" নাস্তিক ব্লগার - ফেসবুকার - লেখক গোলাম সারওয়ার একই রকম যুক্তিতে তাচ্ছিল্য করে বলেছেনঃ 

এইসব নাস্তিকরা পড়ে আছে ৬ষ্ঠ, ৭ম শতকে ...!  

এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণই একমত যে, নীতি নৈতিকতার ধারণা আপেক্ষিক, সবই স্থানিক, কালিক, এবং সামাজিক। ফলে, ইতিহাসের পাঠে সচেতন থাকা দরকার, এক যুগের, এক সমাজের নৈতিকতার চশমা দিয়ে অন্য যুগের, সমাজের মানুষকে বিচার করতে গেলে- ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই কেবল বাড়ে, তারচেয়েও বড় কথা- ইতিহাসের চরিত্রকে ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক এইরকম বাইনারী জাজ করাটাও অনেক সময়ে ইতিহাস পাঠে অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়! কিন্তু "জ্ঞানী"-"সৃজনশীল" প্রগতিজীবীরা যেভাবে বলছেন, তথাকথিত "পপুলারিস্ট" নাস্তিকরা কি আসলে তেমনটাই করছেন? তারা কোন পরিপ্রেক্ষিতে ১৪০০ বছর আগের ব্যক্তিকে আজকের নৈতিকতা দিয়ে বিচার করছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতটা কি ওনারা জানেন না? কথিত "পপুলারিস্ট" নাস্তিকদের আলোচনার অভিমুখ কি সেইসব সেক্যুলার, প্রগতিশীল, নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী হিসেবে দাবি করা লেখক-পাঠকরা, যারা নবীকে একজন ১৪০০ বছর আগে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে মনে করে? নাকি সেইসব ধার্মিক ব্যক্তি, যারা নবী মুহম্মদকে কেবল ১৪০০ বছর আগের একজন মানুষ মনে করে না, বরং মুহম্মদকে সর্বকালের সর্বযুগের, সকল সমাজের মধ্যে সর্বসেরা মানুষ, আল্লাহর রাসুল, যেকোন রকম পাপ-অন্যায়-অপরাধের উর্ধ্বে থাকা একজন প্রেরিত মহাপুরুষ হিসেবে বিশ্বাস করে? তাহলে, সেইসব বিশ্বাসী ব্যক্তিদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধাচারণ করতে যদি কেউ বলেন, সর্বকালের- সর্বযুগের নৈতিকতার নিরিখে সেরা তো দূরের কথা, আজকের নৈতিকতা অনুযায়ীও নবী আদর্শ চরিত্র নন। মুহম্মদের মত আজ কেউ ৬ বা ৯ বছরের কন্যাশিশুকে বিয়ে করতে গেলে কিংবা আজ যদি মুহম্মদ নিজে সেই কাজটা করতে যান, তাকে পেডোফাইল ছাড়া আর কি বলা হবে? আজ কৃতদাসীকে, যুদ্ধবন্দীকে কিংবা শিশুকে ভোগ করতে চাইলে, তাকে কি ধর্ষক বলা হবে না? আজকের যুগে এসে নয় জন স্ত্রী নয়, দ্বিতীয় বিয়ে করতে গেলেও নবীকে যদি আগের স্ত্রী জুতার বাড়ি দিতে চায় তাতে কি খুব বেশী দোষ হবে? - এখন নাস্তিকরা এসব কথা যদি এই কারণে বলে যে, চারদিকের মুমিন ব্যক্তিরা যারা ১৪০০ বছর আগের আইডিওলজিকে সুপ্রিম হিসেবে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে ও প্রচার করে, তাদেরকে পাল্টা জবাব দিতেই এভাবে বলা; তবে কোনভাবে কি বলা যাবে যে, তারা আজকের নৈতিকতা ১৪০০ বছর আগের সমাজের উপরে চাপিয়ে দিচ্ছে?

হ্যাঁ, বাংলাদেশের ও দুনিয়ার নাস্তিকদের অনেকের সাথেই আমার বড় রকম মতভিন্নতা আছে। এমনকি নাস্তিকতা- মুক্তবুদ্ধি- মুক্তচিন্তা প্রসারের কর্মপদ্ধতি নিয়েও আমার অনেক ব্যাপারে অনেকের সাথেই দ্বিমত আছে, ভিন্নতা আছে। রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে যদি কথা বলতে যাই- তাইলে তো অনেকের সাথেই আমি একেবারেই ভিন্নমেরুতে অবস্থান করি। আসিফ মহিউদ্দিন, সুষুপ্ত পাঠক, তসলিমা নাসরিন শুধু নয়- অভিজিৎ রায়ের সাথেও অনেকবার তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলাম। স্যাম হারিসের মত ওয়ার অন টেররের সমর্থক নাস্তিককে মাথায় তুলে রাখার প্রয়োজন কোনদিন দেখিনি। রিচার্ড ডকিন্সের সাথেও সবসময় সব বিষয়ে একমত নই। এরকম দ্বিমত, ভিন্নমত, ভিন্নপন্থা যেকেউই যাকারোর সাথে করতেই পারে। কিন্তু, দ্বিমত, ভিন্নমত, ভিন্নপন্থার জন্যে কাউকে বা তাদের সমচিন্তার বা অনুসারি নাস্তিকদের গ্রুপবন্দী করে একটা নাম দিয়ে ট্যাগিং করে ডেমোনাইজ করা কেমন ধরণের প্রগতিশীলতা, কেমন ধরণের সৃজনশীলতা? চিন্তা-মত-পথকে তো চিন্তা দিয়েই পরাস্ত করতে হয়, নয় কি? কার কি শিক্ষাগত যোগ্যতা, কে কেমন ও কতটুকু সৃজনশীল, কোন বিষয় নিয়ে কে আগ্রহী হচ্ছে, সেগুলোর রুচি কি, ইত্যাদি ইত্যাদি - এসব আলাপ কি কোনদিন চিন্তাকে মোকাবেলা করার আলাপ হতে পারে? আর, সেখানে এসব স্বঘোষিত প্রগতিশীল-সৃজনশীল সেক্যুলাররা দলবেধে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নোংরা ও মিথ্যায় ভরপুর অভিযোগ আনছেন- যেগুলোর অধিকাংশই আসলে কোন অভিযোগই নয়, সিম্পলি আরেকজনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়া নোংরা গসিপিং! এসবের মধ্য দিয়ে বস্তুত তারা নিজেদেরকেই মানুষ হিসেবে নিচে নামিয়ে যাচ্ছেন, তা কি তারা বুঝতে পারছেন?

মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৯

"ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের শক্তিশালী ভূমিকা রাখা কর্তব্য" প্রসঙ্গে

প্রথমত, ইসলাম বিদ্বেষ আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত - এই কথাগুলো ব্যবহারেও সাবধান থাকা দরকার, কেননা- এগুলোই ক্রমাগত নাস্তিকদের ডেমোনাইজ করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটেই হেফাজতের ফাঁসির দাবি, ব্লগার খুন, গ্রেফতার- মামলা এসব চলছে ...
দ্বিতীয়ত, নাস্তিকদের ইসলাম বিদ্বেষ তথা ধর্ম বিদ্বেষ বনাম ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মের সমালোচনা তথা ঈশ্বর সংক্রান্ত দার্শনিক বা জীবনের উদ্ভব ও বিবর্তন সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক আলোচনা- এই দুইয়ের ফাইন লাইন তৈরি করবেন কিভাবে? কে ঠিক করে দিবে কোনটা বিদ্বেষ আর কোনটা বিদ্বেষ না?
তৃতীয়ত, যে নাস্তিকদের উদ্দেশ্যে এই পরামর্শ স্ট্যাটাসটি পয়দা করেছেন- তারা কারা? নিশ্চিতভাবেই ইসলাম বিদ্বেষ বলতে এখানে নাস্তিকদের ইসলাম বিদ্বেষই বুঝিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের ইসলাম বিদ্বেষ বুঝাননি! তার মানে যেটা বুঝতে পারছি, নাস্তিকদের মধ্যে যাদের আলাপে - লেখাপত্রে - বক্তব্যে ইসলাম বিদ্বেষ প্রকাশ পায় (বলে আপনার/ আপনাদের মনে হয়), তাদের বিরুদ্ধে যাদের লেখাপত্র, বক্তব্যে ইসলাম বিদ্বেষ থাকে না তাদেরকে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার কথা বলছেন, তাই তো? কিন্তু সেই ভূমিকা তারা কেনই বা রাখবে? মানে, শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে কেন? নাস্তিকতা কি কোন সমস্বত্ব বডি? বা কোন সংগঠন? যার বিশেষ বা সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ উদ্দেশ্য বিধেয় আছে? নাকি, নাস্তিকরা সিম্পলি ইনডিভিজুয়াল ব্যক্তি মাত্র? তাহলে, যার যা অবস্থান, ভাবনা, মতাদর্শ, রুচি, আদর্শ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অভ্যস্থতা, সক্ষমতা - এসব অনুযায়িই কি আলাদা আলাদা অবস্থান রাখতে পারে না? সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? যেকোন নাস্তিক অন্য নাস্তিকের সাথে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মতবিরোধ, তর্ক-বিতর্ক করতেই পারে, কিন্তু এক প্রকার নাস্তিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াটা অন্য প্রকার নাস্তিকের জন্যে "কর্তব্য" হতে পারে কি?
চতুর্থত, আমাদের দেশটায় ইসলাম বিদ্বেষ বলে যা কিছু দেখেন (আপনার ভাষায় যদি ধরেও নেই), তার হাজার গুণ বেশি পাবেন হিন্দু বিদ্বেষ! মুসলমানের বাচ্চা হয়েও কেবল "হিন্দুয়ানি" নামের জন্যে (বাংলা নাম) সেই বাচ্চাকালে প্রচুর বুলিইং এর শিকার হয়েছি! তাহলে চিন্তা করে দেখেন, একেকটা হিন্দুর বাচ্চার কি অবস্থাটা হয়! প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারের ঘরের সামনে গরুর হাড্ডি ফেলে রাখতে দেখছি, আমার মুসলমান আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন- অনেক জায়গাতেই দেখেছি, "হিন্দু" শব্দটাই যেনবা গালির সমার্থক! স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও হিন্দু ধর্মের প্রতি তাচ্ছিল্য করা লেকচার শুনছি! মসজিদের খুতবায়- ওয়াজগুলোতে ইহুদি-নাসারাদের চাইতেও ঘৃণা ছড়ানো হয় সবচাইতে বেশি- নারী ও হিন্দুর বিরুদ্ধে! শুধু হিন্দু কেন, এদেশে একদম নিরীহ প্রান্তিক আদিবাসীদের বিরুদ্ধেও বিদ্বেষ ভয়ংকর রকম বেশি! এই বিদ্বেষ কেবল কথায়, লেখায়, ওয়াজেই সীমাবদ্ধতা থাকে না, একদম সরাসরি আক্রমণেও চলে যায়, পাহাড়ে যুগ যুগ ধরে চলছে ইথনিক ক্লিনজিং! সমতলের আদিবাসীদেরও জায়গা - জমি থেকে শুরু সংস্কৃতি-ঐতিহ্য দখল সমানতালে চলছে। অথচ, আমাদের দেশে ইসলাম বিদ্বেষ কথাটা যত মার্কেট পেয়েছে, "হিন্দু বিদ্বেষ", "আদিবাসী বিদ্বেষ" নিয়ে কেউ কথা বলেনি! এমন শব্দ বন্ধ তো চোখে পড়ে না - "সংখ্যালঘু আক্রমণ", "সাম্প্রদায়িক হামলা" (অনেক সময়ে তো হামলা/ আক্রমণও উল্লেখ না করে জাতীয় মিডিয়ায় "দাঙ্গা"-"হাঙ্গামা"ও বলে দেয়া হয়)! এসব শব্দ ও শব্দবন্ধ বলা হয়, কিন্তু "হিন্দু বিদ্বেষ", "আদিবাসী বিদ্বেষ", "পাহাড়ি বিদ্বেষ" - তো কেউ কোথাও কোন কালে ব্যবহার করলো না! সেই "হিন্দু বিদেষ", "আদিবাসী বিদ্বেষ", "নাস্তিক বিদ্বেষ" এর বিরুদ্ধে মুমিন-মুসলিমদের শক্তিশালী ভূমিকা রাখা বিষয়ক কোন উপদেশ পরামর্শও দিলেন না আপনারা! কারণ কি?
পঞ্চমত, ইসলাম বিদ্বেষ বা ধরেন যেকোন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ কিভাবে বর্ণবাদ হয়? কিংবা আইডিওলজির প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষকে কি কোনভাবে বর্ণবাদী রাজনীতির আইডিওলজি হিসেবে বলা যেতে পারে? ইসলাম তো একটা আইডিওলজি। দর্শন, কিংবা ইসলামের ভাষাতে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান! এখন, আমাকে বলেন- একটা আইডিওলজির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ থাকলে অসুবিধেটা কোথায়? বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আপনার যদি বিদ্বেষ থাকে, তাহলে বর্ণবাদী আইডিওলজিগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ থাকতে কি পারে না? ধর্মগুলোই কি বর্ণবাদী নয়? কেবল নিজেদের অনুসারীকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, বাকিদের নিচুসারির, পাপিষ্ঠ বলে মনে করে! হ্যাঁ, আপনি বলতে পারেন- কোন ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে তার জন্মগত ভাবে পাওয়া ধর্মের আইডিওলজিকাল জায়গা ধরে ডেমোনাইজ করা, একটা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে ঘৃণা করা, সেই ধর্মের কোন অংশের অপরাধকে সমস্ত ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর উপরে চাপিয়ে দেওয়া- এসবকেই বর্ণবাদী বলতে পারেন, আমিও বলি। যেভাবে, হিন্দু বিদ্বেষ, ইহুদী বিদ্বেষ- এগুলো বর্ণবাদ (সেই বর্ণবাদ ইসলাম ধর্মের পাতায় পাতায় পাওয়া যাবে), একই ভাবে মুসলিম বিদ্বেষকে বর্ণবাদ বলতেই পারেন। কিন্তু, ধর্মকে নিয়ে, তথা ধর্মীয় চিন্তা - দর্শন - রাজনীতির প্রতি বিদ্বেষকে কি বর্ণবাদ বলা যায়? তাহলে, ইসলাম বিদ্বেষ কিভাবে বর্ণবাদী আচরণ হয়, কিভাবে এটা অপরাধ? ইহুদী বিদ্বেষ বর্ণবাদ হলেও, জাওনিজমের প্রতি বিদ্বেষ কি বর্ণবাদ? আপনিও যে দিনরাত হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ - ঘৃণা পোষণ করেন ও ছড়ান, সেই হিন্দুত্ববাদ বিদ্বেষ কি বর্ণবাদ? সেটাকে কি হিন্দুবিদ্বেষ হিসেবে উপস্থাপন করে হিন্দুত্ববাদ বিরুদ্ধতা ও বিদ্বেষের পথ পরিহারের আহবান জানালে, আপনারা শুনবেন?
ষষ্ঠত, আচ্ছা, নাস্তিকদের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষকে কি বর্ণবাদ বলা যাবে? সেটা নিয়ে আপনাদের পরামর্শ কি? আপনিও যখন নাস্তিকদেরকে (এবং বামপন্থীদের নিয়ে) জেনারালাইজ করে "বিদ্বেষ" ছড়ান বা "সমালোচনা" করেন, সেটাকে বর্ণবাদ বলা যাবে কি? কোন নাস্তিক বিশেষের, কোন বাম নেতার/ কর্মীর/ ফেসবুকারের কাজ/ আলাপকে জেনারালাইজ করে যখন নাস্তিকদের/ বামদেরকেই ওভারল একহাত দেখে নেন সেটা কোন পর্যায়ে পড়ে?
সপ্তমত, বিজেপি-আরএসএস এর রাজনীতিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ কিংবা হেফাজতি-জামাতি রাজনীতিতে হেন্দু- খৃস্টানদের নিয়ে যে ঘৃণা, নাজীদের রাজনীতিতে ইহুদীদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা- তার সাথে এই ধর্মীয় আইডিওলজিগুলোর (যেখান থেকে আরএসএস-হেফাজতি-নাজীদের পয়দা হয়) প্রতি নাস্তিকদের ঘৃণাকে এক করে দেখা কি যায়? কবে, কোথায়, কিভাবে বিভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের মৌখিক বা লিখিত বিরোধিতা ও সমালোচনা (আপনাদের ভাষায় বিদ্বেষ) ঐরকম বর্ণবাদী-ঘৃণাবাদী রাজনীতিতে ব্যবহৃত হয়, হয়েছে- উদাহরণ দেন! বরং, দুনিয়ায় যুগে যুগে- এই নাস্তিকরাই এমন ঘৃণাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, সেসব ঘৃণার হাত থেকে নির্যাতিত- নিপীড়িত- ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর পক্ষে সোচ্চার থাকতেও কোনদিন পিছপা হয়নি, যতই তাদের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ থাকুক! নয় কি?
 
[ব্লগার পারভেজ আলমের আহবান "ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের শক্তিশালী ভূমিকা রাখা কর্তব্য" এর জবাবে লেখা ফেসবুক পোস্ট থেকে।] 

শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পিনাকীর 'ওপেন রিলেশনশিপ' ও 'হিন্দু-মুসলিম বিয়ে' প্রসঙ্গে

এক
সম্প্রতি (১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯) সাংবাদিক পুলক ঘটক ফেসবুকে S/he is in an open relationship! শীর্ষক একটি পোস্ট লিখেছেন, যেখানে শুরুতে নানা উদাহরণের মাধ্যমে বিদেশী ভাষা ইংরেজি ব্যবহারে অনেক রকম ভুলভ্রান্তি হয়, সে আলাপ করেছেন। তারপরে, ফেসবুকের রিলেশনশিপ অপশন হিসেবে "ইন এন ওপেন রিলেশনশিপ" বলতে কি বুঝায় তার উপরে একটি জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে জানিয়েছেন, অনেকেই এর প্রকৃত অর্থ না বুঝেই নিজের রিলেশনশিপ হিসেবে "ইন এন ওপেন রিলেশনশিপ" সিলেক্ট করেন। এতটুকু আলাপ পর্যন্ত ঠিক ছিল, পুরোপুরি একমত না হলেও, পড়তে খারাপ লাগেনি। কিন্তু পোস্টের একদম শেষে এসে বুঝা গেলো, এই পুরো পোস্টের উদ্দেশ্য আসলে ইংরেজি ভাষার ব্যবহারে ভুলভ্রান্তি না বা "ইন ওপেন রিলেশনশিপ" এর আসল অর্থ সম্পর্কে পাঠকদের জ্ঞানদানও নয়, বরং ইসলামপন্থী ফেসবুকার ও লেখক পিনাকী ভট্টাচার্যের বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা তুলে ধরা। তার জন্যে পিনাকীর ব্যক্তিগত দাম্পত্য সম্পর্ককের ধরণকে টেনে আনতেই আসলে এই ইংরেজি ভাষার ব্যবহার ও "ইন ওপেন রিলেশনশিপ" প্রসঙ্গের অবতারণা। তিনি পোস্টের শেষে দুই তারকা দিয়ে লিখেছেনঃ
"** পিনাকী কেবল দাম্পত্যে ওপেন নন; তত্ত্বে ও জীবন-সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি আরেক ধাপ এগিয়ে। ওপেন রিলেশনশিপের দম্পতিরা যৌনতার প্রশ্নে উদার হলেও ধর্ষকামী নয়। কিন্তু পিনাকী যে বিশ্বাস, তত্ত্ব, সমাজ বা সম্প্রদায়কে আলিঙ্গন করেন তাকেই ধর্ষণ করেন। বোকারামগুলো জানেনা যে তারা এবং তাদের বিশ্বাস ঐ কথিত অজ্ঞেয়বাদীর দ্বারা নিত্যদিন ধর্ষিত হচ্ছে"। 
পিনাকী ভট্টাচার্য কবে কোন কালে তার ফেসবুকে রিলেশনের জায়গায় "ইন ওপেন রিলেশনশিপ" দিয়েছিলেন, তা নিয়ে সেই পোস্টের কমেন্টে রীতিমত তুলকালাম লেগে যায়! নাস্তিক ব্লগার, ফেসবুকার, লেখক আসিফ মহিউদ্দিন কমেন্টে পিনাকী ভট্টাচার্যের হিন্দু-মুসলিম বিয়ে প্রসঙ্গে টেনে নিয়ে এসেছেন। একবার লিখেছেন, "উনারা কীভাবে বিয়ে করবেন, কোন পদ্ধতিতে সহিহ উপায়ে কীভাবে কী করবেন সম্পূর্ণ উনাদের বিষয়", তারপরেই একটা "কিন্তু" লাগিয়ে আবার জানিয়েছেন,
"ইসলাম ও শরীয়ত প্রেমিক মুশরিক পিনাকী কীভাবে একজন মুসলিম মুমিনা নারীর স্বামী হয়, আমার কাছে তা এক বিস্ময়। আমার কোরান হাদিসের জ্ঞান যথেষ্ট ভাল। সেই সূত্রে আমি জানি, এটি ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক সম্পূর্ণ জেনা এবং ইসলাম অনুসারে তাদের সন্তানের সামাজিক স্ট্যাটাস কী সেটি যেকোন আলেমকে জিজ্ঞেস করতে পারেন"।   
কোরান হাদীস সম্পর্কে আসিফ মহিউদ্দিন যে অনেক ভালো জানেন, তার প্রমাণে তিনি সুরা বাকারার ২২১ নম্বর আয়াতও উল্লেখ করেছেন,
"আর তোমরা মুশরিক নারীদেরকে বিয়ে করোনা, যতক্ষণ না তারা ঈমান গ্রহণ করে। অবশ্য মুসলমান ক্রীতদাসী মুশরিক নারী অপেক্ষা উত্তম, যদিও তাদেরকে তোমাদের কাছে ভালো লাগে। এবং তোমরা (নারীরা) কোন মুশরিকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ো না, যে পর্যন্ত সে ঈমান না আনে। একজন মুসলমান ক্রীতদাসও একজন মুশরিকের তুলনায় অনেক ভাল, যদিও তোমরা তাদের দেখে মোহিত হও। তারা দোযখের দিকে আহ্বান করে, আর আল্লাহ নিজের হুকুমের মাধ্যমে আহ্বান করেন জান্নাত ও ক্ষমার দিকে। আর তিনি মানুষকে নিজের নির্দেশ বাতলে দেন যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে"।
নিজেকে "ধর্মনিরপেক্ষতার সমর্থক" হিসেবে দাবি করে আসিফ মহিউদ্দিন তারপরে "মুশরেক" পিনাকী ভট্টাচার্য ও তার "মুসলিম" স্ত্রীকে কি করতে হবে বা হতো, সে পথ বাতলে দিয়ে বলেছেন,
"আমি চাই পিনাকীর স্ত্রীর ধর্মত্যাগ করে স্পেশাল ম্যারেজ এক্টে মুশরিক পিনাকীকে বিয়ে করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক"!
পিনাকীর স্ত্রী ধর্মত্যাগ করবেন কি না, তারা কিভাবে বিয়ে করবেন না করবেন, এ সবই আসিফ মহিউদ্দিনের এখতিয়ার বহির্ভূত, ফলে তার এমন "চাওয়া" খুব অবাকই করেছে, আর একদম হতবাক হয়ে গিয়েছি, ঠিক তার পরের আলাপে,
"ইসলামী শরীয়ত অনুসারে এতে তার স্ত্রী মুরতাদ ঘোষিত হবে, এবং নারী মুরতাদদের জন্য ইসলামে শাস্তির বিধানও আছে। আর মুসলিম নারীর সাথে জেনার অপরাধে পিনাকীরও মৃত্যুদণ্ড হবে, ইসলামী শরীয়ত অনুসারে"
যদিও তিনি জানিয়েছেন, "আমি এইসব আইনের বিরুদ্ধে", কিন্তু ঠিকই ইসলামী শরীয়তের এমন আইন বের করে ফেলেছেন, যে আইন খোদ কোন মুসলিম দেশে প্রচলিত আছে বলে আমার জানা নেই! ইসলামের জেনার যে বিধান, তা মুসলমানের জন্যে প্রযোজ্য হলেও বিধর্মী বা মুশরিকের জন্যে প্রযোজ্য হবে, তেমন কোন আয়াত বা হাদিস কি আছে? কোন হাদিসে কি আমরা দেখেছি যে মক্কার পৌত্তলিক কিংবা মদীনার ইহুদীদের মধ্যে কাউকে কখনো ব্যভিচার বা জেনার দায়ে পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা হয়েছিলো? আবার, সুরা বাকারার উল্লিখিত আয়াতটিতে মুসলমান পুরুষ বা নারীকে মুশরিককে বিয়ে করতে অনুৎসাহিত করা হয়েছে, কিন্তু বিয়ে করলে সেই বিয়েকে জেনা হিসেবে বিবেচিত করে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে এমন কোন কিছু কি বলা হয়েছে? 
 
একই রকম আলোচনা অবশ্য আরো আগে পুলক ঘটক তাঁর আরেক পোস্টে করেছিলেন, সেখানে পিনাকীর স্ত্রী মুসলমান হয়ে কিভাবে হিন্দু পিনাকীকে বিয়ে করলেন, সেটি তার জন্যে জায়েজ, নাকি হারাম - এমন সব চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছেন,
"আপনারা বলুন দেখি, হিন্দু পুরুষকে বিবাহ করা মুসলমান মেয়েদের জন্য কি জায়েজ? আমার জানামতে যারা কেতাবী নয়, তাদেরকে বিবাহ করা ইসলামে হারাম। পিনাকী একজন মুসলমান নারীকে বিয়ে করেছেন। নিজে ইসলাম গ্রহণ না করে এই কাজটি তিনি কিভাবে করেন? তার মানে কি? তিনি কি ইসলাম গ্রহণ করেছেন? যদি তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে তিনি তা গোপন রাখছেন কেন? পৃথিবীতে ধর্মান্তরিত লোকের তো অভাব নেই। তাতে আইনেও কোনো বাধা নেই" 
অবাক হয়ে দেখলাম, পিনাকী ভট্টাচার্যের চিন্তার বিরুদ্ধে যাদের দাঁড়ানোর কথা, তারা পিনাকীর চিন্তাকে পরাস্ত করা নয়, অবলীলায় তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে পরচর্চা করে বেড়াচ্ছেন! ওপেন রিলেশনশিপ, হিন্দু-মুসলিম বিয়ে- এসব নিয়ে তো আপত্তি এতদিন জানতাম কাঠমোল্লাদের, হেফাজতিদের! অথচ হেফাজতিদের পরম বন্ধু, নাস্তিক ব্লগার খুনের এপোলজিস্ট, জঙ্গীবিস্তার ও নারীবিদ্বেষ বিস্তারে ভূমিকা রাখা ওয়াজ-মাহফিল-কাঠমোল্লাদের পক্ষাবলম্বনকারী পিনাকী ভট্টাচার্যের "ওপেন রিলেশনশিপ", "হিন্দু-মুসলিম বিয়ে" প্রভৃতি নিয়ে সমালোচনায়, মজায়, গালাগালিতে মেতেছেন- প্রগতিশীল, মুক্তচিন্তক খ্যাত ফেসবুকার- ব্লগাররা! সত্যি হতাশাজনক!
 
দুই
পুলক ঘটকের আলোচ্য পোস্টের নীচে অনেক আলাপ-আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে, অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, এবং প্রচুর গালাগালিও হয়েছে। সেখানে এই যে অপরের ব্যক্তিজীবন নিয়ে পরচর্চা, হাসি তামাশা, ঘাটাঘাটি করার প্রতিবাদও কেউ কেউ করেছেন, তার বিপরীতে আবার অনেকে বিভিন্ন যুক্তিও করেছেন! পুলক ঘটক নিজেই প্রশ্ন রেখেছেন,
“ব্যক্তিজীবন নিয়ে কেন সমালোচনা করা যাবে না?” 
কারো ব্যক্তিগত জীবন, সম্পর্ক, পরিবার নিয়ে পরচর্চা তথা অপরের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা আর কারোর ব্যক্তিজীবনের কোন অপরাধ-অন্যায় নিয়ে "সমালোচনা" বা অভাব-অভিযোগ তো এক নয়। আমি মনে করি, সমালোচনা থাকলে যে কারোর ব্যক্তিজীবন, বাহির জীবন- সবকিছু নিয়েই সমালোচনা অবশ্যই করা যাবে; কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, পিনাকীর সমালোচনার জায়গাটি এক্ষেত্রে কি- সেটিই আসলে আমি বুঝতে পারিনি। পিনাকী কি তার স্ত্রীকে প্রহার করেছেন? গালি দিয়েছেন? মেরিটাল রেপ করেছেন? প্রতারণা করেছেন? বা অন্য কোন রকম অপরাধ সংঘটন করেছেন? সেসব কিছু যদি না করে থাকেন, তাহলে কি নিয়ে এই "সমালোচনা" হচ্ছে? একজন ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর ধর্মীয় বিশ্বাস কি, পৈত্রিক ধর্ম কেউ ত্যাগ করেছেন কি না, ধর্মান্তরিত হয়েছেন বা হবেন কি না, তারা কিভাবে বিয়ে করেছেন, কেমন ধরণের রিলেশনশিপে আছেন তারা তথা তাদের রিলেশনশপ "ওপেন" না কি "ক্লোজ"- এসব কিছুই সেই ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত ডোমেইনের বিষয়। সেগুলোতে ঐ দু'জন ব্যতীত দুনিয়ার আর কারোরই নাক গলানোর কিছু নেই, এখতিয়ারই আসলে নেই! মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ডোমেইনে অন্য কারোর অযাচিত নাক গলানোকে মোটেও "সমালোচনা" বলো যায় না, সেগুলো হচ্ছে অন্যের বেডরুমে উকিঝুকি মারা এবং অপরের ব্যক্তিগত সম্পর্ক (বা যৌনতা নিয়ে) আসর জমিয়ে গসিপিং করা! নিঃসন্দেহে এসবই খুব অরুচিকর, কুৎসিত, নোংরা ধরণের কর্মকাণ্ড! 
 
সেই পোস্টের কমেন্ট সেকশনে আরেক ধরণের যুক্তি দেখেছি,
"পিনাকী নিজেই যদি ফেসবুকে নিজের রিলেশনশিপ ওপেন দেখায়, তাহলে সেটা পুলক ঘটক ও অন্যরা কেন বলতে বা লিখতে পারবেন না?
এটিও যুক্তি হিসেবে খুব খেলো ও নীচুস্তরের যুক্তি। একজন সমকামী জুটি নিজেকে যতই সমকামী হিসেবে পরিচয় দেক, তাতে তাদেরকে সমকামী বা গে / লেজবিয়ান বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা হাসাহাসি করার, কিংবা গালাগালি, নিন্দা-মন্দ করার অধিকার কারোর জন্মায় না! কোন নারী যদি তার ছবি আপলোড করে সবার সাথে শেয়ার করে, তার মানে এই নয় যে - তার ব্যক্তিগত ডোমেইন ভেঙ্গে গিয়ে সব পাবলিক হয়ে গেলো, এবং সকলের সেই ছবির নারীর পোশাক নিয়ে ইচ্ছেমত সমালোচনা বা গালমন্দ করার অধিকার জন্মে গেলো! বস্তুত ব্যক্তিগত ডোমেইনটা হচ্ছে, ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাস ধারণ, পছন্দ মাফিক পোশাক পরিধান, বিভিন্ন জনের সাথে বিভিন্ন রকম সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া, পরিবার-সংসার গঠন, রুচি ও খাদ্যাভ্যাস, নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ- প্রভৃতির স্বাধীনতা। সেগুলো যদি অপরের সামনে উপস্থিতও হয়, সেই স্বাধীনতাটা তারই থাকে, "পাবলিক" তা নিয়ে "গসিপ" করার, সমালোচনা - গালমন্দ করার অধিকার পেয়ে যায় না! এমনকি, ব্যক্তিগত ডোমেইনে যখন সমস্যা ঘটে, অপরাধ সংঘটিত হয়, তখন যদি ভিক্টিম সেটিকে পাবলিক করে, তখনো তার ব্যক্তিগত ডোমেইন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে না। যেমনঃ কোন নারী তার ছেলে বন্ধুর সাথে বাসে এক বিভাগীয় শহর থেকে রাজধানীতে ফেরার পথে ঘুমের মধ্যে বন্ধুর হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে যখন অপরাধটিকে পাবলিক করেন, তখনো অন্যের এই প্রশ্ন করার এখতিয়ার থাকে না যে, কেন সেই নারী ছেলেটির সাথে বেড়াতে গেলো, কেন রাতে একা একা একটা ছেলের সাথে বাসে ভ্রমণ করতে গেলো! নারীটি নিজে সেই অপরাধের বিবরণে তার বন্ধুর সাথে ঘুরতে যাওয়া ও বাসে ফেরার ঘটনা পাবলিকলি শেয়ার করার পরেও, সেই নারী কার সাথে কোথায় বেড়াতে যাবেন বা কোথায় কিভাবে ভ্রমণ করবেন - সবকিছুকে তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখতে হবে, তার জন্যে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা (ভিক্টিম ব্লেমিং), দোষারোপ করা, কৈফিয়ৎ চাওয়ার এখতিয়ার কারোর থাকতে পারে না। শ বা হাজার মানুষ নিমন্ত্রণ করে, ঘটা করে সবাইকে জানিয়ে বিয়ে করা হলেই, বর ও কনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, বোঝাপড়া, ভাব-ভালোবাসা, যৌনতা, সন্তান উৎপাদন - কোন কিছু নিয়েই অন্য কারোর নাক গলানো, মন্তব্য করা, এমনকি আড়ালে আবডালে গসিপ করার অধিকার জন্মে যায় কি? আমাদের সংস্কৃতিতে অবশ্য স্বামীর বাড়ির লোকজন, তথা শাশুড়ি, ননদ থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজন, এমনকি পাড়া প্রতিবেশী পর্যন্ত এই অযাচিত নাক গলায়, সেই সংস্কৃতিরই কি বহিঃপ্রকাশ ঘটছে পিনাকী ভট্টাচার্যকে নিয়ে এসব গসিপিং "সমালোচনা"র ক্ষেত্রে?
 
তৃতীয় আরেক যুক্তি দেখেছি, আমার কাছে মনে হয়েছে - সচেতনভাবে এই যুক্তির জায়গা থেকেই প্রগতিশীল, সেক্যুলার বলে পরিচিতজনেরা এমন সোচ্চার হয়েছেন। যুক্তিটি এমন,
"পিনাকী যে হেফাজতি রাজনীতি করেন, সেটায় এরকম ওপেন রিলেশনশিপ চালানোর বৈধতা কি আছে? যদি না থাকে, তাহলে পিনাকী সেই বিশ্বাসের সাথে কি বিশ্বাসঘাতকতা করছেন না?"  
"পিনাকী যে ইসলামী রাজনীতিকে ধারণ ও প্রচার করেন, সেই ইসলাম মোতাবেক তো তাদের হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কই টিকে না! তাহলে তিনি যা প্রচার করছেন, অসংখ্য অনুসারীকে যে পথ দেখাচ্ছেন, নিজেই সেটা পালন করছেন না! এহেন অসততা সবার সামনে উন্মোচন করার জন্যেও তো ব্যক্তিজীবনকে সামনে নিয়ে আসা দরকার"! 
এই ধরণের যুক্তিগুলো শুনলে একটু ধন্দে পড়ে যেতে হয়! ঠিক বুঝে উঠেতে পারি না, এমনতরো যুক্তির উদ্দেশ্য কি? কি চাচ্ছেন তারা? তারা কি ওপেন রিলেশনশিপ কিংবা হিন্দু-মুসলিম বিয়ের দায়ে পিনাকী ও তার স্ত্রীর শরীয়া মাফিক সাজা চাচ্ছেন (মুখে বলছেন, মোটেও তা চান না, কিন্তু পিনাকী ও তার স্ত্রী জেনা করেছে, শরীয়া অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মত অপরাধ করেছে বলে শোরগোল ঠিকই তুলছেন)? নাকি, পিনাকী একজন হেফাজতি-জামাতি রাজনীতির সমর্থক হয়েও কিভাবে ওপেন রিলেশনশিপে থাকতে পারে বা ধর্ম না পাল্টিয়েই হিন্দু-মুসলিম বিয়ের মত "প্রগতিশীল" অবস্থান নিতে পারছেন, সেটাই তাদের অভিযোগ তথা বিদ্বেষ? নাকি, বাংলাভাষী অসংখ্য মুসলিম হেফাজতি সমর্থক তথা পিনাকী ভক্তদের সামনে পিনাকীর প্রকৃত মুখোশ উন্মোচন করার মাধ্যমে পিনাকীকে কোনঠাসা করতে চাইছেন? এই প্রকারে এই কাজে কতখানি সফলকাম হওয়া সম্ভব (কেননা পিনাকীর হিন্দু পরিচয় জানার পরেও পিনাকীর এত মুসলিম ভক্তকূল হওয়ার পেছনে ব্যক্তি পিনাকীর ধর্ম বিশ্বাস বা তার বিয়ের ধরণ-ধারণের চাইতেও পিনাকীর চিন্তাধারা, বক্তব্য, পক্ষাবলম্বনের ভূমিকা প্রধান)? এর চাইতেও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মনে হয়েছে, কি প্রকারে আজকের প্রগতিশীলরা পিনাকীর মুখোশ খুলে দিতে আগ্রহী? সেই হেফাজতি-কাঠমোল্লা মুসলিমদের মধ্যে যে মধ্যযুগীয় কুপমণ্ডুক ধ্যানধারণা আছে, সেটাকেই কি তারা উসকে দিতে চাচ্ছেন? এক পিনাকীকে ঠেকাতে গিয়ে তাহলে তাঁরা কোন পরিস্থিতি তৈরি করছেন?
 
তিন
পিনাকীর সেই পোস্ট ও বিশেষ করে পোস্টের নীচের কমেন্টে নানান তর্ক-বিতর্ককে কেন্দ্র করে আমিও একটি ফেসবুক পোস্ট লিখেছিলাম। সেই পোস্টের কমেন্ট সেকশনে অনেকেই পিনাকীর ব্যক্তিজীবন নিয়ে এত সমালোচনার মূল জায়গা বা মূল উদ্দেশ্যটি ব্যাখ্যা করেছেন। যেমনঃ
"এইখানে তাদের আপত্তির জায়গাটা ছিল পিনাকি যে আদর্শের প্রচার করে বা স্পন্সর করে সেই আদর্শের সাথে তার ব্যাক্তিগত জীবন সাংঘর্ষিক। এইটাও মূল আপত্তি ছিল না। মূল আপত্তি ছিল সে যা বলে, লিখে সেইটার সাথে সে সৎ না। এখন আমি যদি বলি পিনাকি তার আদর্শিক চিন্তার বাস্তবিক প্রয়োগের জায়গায় সৎ না, তাইলে কি সেইটা ব্যাক্তিগত আক্রমন হয়ে যাবে?" 
"পিনাকির বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা প্রমাণ হলে তার আইডিওলজির অসারতা বোঝা যায়। পিনাকি যা বলেন বা সমর্থন করেন সেটা তিনি ব্যক্তিজীবনে নিজেই পালন করেন না, অথবা যেই মতবাদের (সেকুলারিজম) তিনি নোংরাভাবে সমালোচনা করেন সেটার সুফল ব্যক্তিজীবনে পুরোপুরি ভোগ করেন, এটা বোঝা গেলে তার অন্ধ মুরিদদের মনেও তার বুদ্ধিবৃত্তিক হিপোক্রেসী পরিষ্কার হতে বাধ্য। নিদেনপক্ষে এটা তারা বুঝবে যে, পিনাকিকে আর যাই হোক, হেফাজতি কায়দার ইসলামের সমর্থক বলা যায় না। এবং পিনাকি নিজেও আগে পরে হেফাজত তোষণ থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবেন। অর্থাৎ পিনাকি যে আসলেই জনপ্রিয়তা লাভের জন্য হেফাজতের মুখোশ পড়ে আছেন, সেটা উন্মোচন করা"। 
"পিনাকির বর্তমান ইসলামী রাজনীতির সাথে তার ব্যাক্তিজীবনের অবস্থান বিপরীত মুখী। তার সেই ভণ্ডামির বিরুদ্ধে লেখাটি দরকার ছিলো"।

"মূল কথাটা আপনি এড়িয়ে গেছেন বলে মনে হচ্ছে। কথা হচ্ছিলো কেউ যদি দু-মুখো আইডিওলজি একইসঙ্গে ধারণ করেন সেটা জনগণ কিংবা তার নিজস্ব পরিসরের মানুষদের জীবনে বিরূপ প্রভাব নিশ্চয়ই ফেলে। পিনাকী একদিকে হেফাজতি আদর্শ প্রচার করেন অন্যদিকে ব্যক্তিজীবনে করছেন উল্টাটা। এমন হিপক্রেসি কেউ যদি করেন তার সমালোচনা হতে পারে কিনা, সেটাই ছিল মূল আলোচনা"।
পিনাকির প্রচার করা আদর্শ বা ইসলামি/ হেফাজতি রাজনীতির সাথে ব্যক্তিগত জীবনের সংঘর্ষ দেখিয়ে অসততা বা ভণ্ডামি যেভাবে তারা খুঁজে পাচ্ছেন, দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে যে, সেসবে আমি কোন ভণ্ডামি খুঁজে পাচ্ছি না! কেমন করে বা কিভাবে এগুলোকে অসততা ও ভণ্ডামি বলা যেতে পারে, তা আমার বোধগম্য নয়! পিনাকী নিজে ব্যক্তিজীবনে জন্মসূত্রে একজন হিন্দু, ঈশ্বর বিশ্বাসের দিক দিয়া অজ্ঞেয়বাদীও হলেও হতে পারেন, তবে হিন্দু পরিচয় পুরোপুরি তিনি ফেলে দেননি! এখন তিনি হেফাজতি রাজনীতির সমর্থক ও প্রচারক বলে, তাকে ব্যক্তিজীবনে ইসলামী ধর্ম-কর্মও মানতে হবে, না হলে ভণ্ড - এমন কি? ইসলামবাদী রাজনীতির সমর্থক, মোল্লা - হুজুর, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অধিকার নিয়ে কথা বলে জন্যে পিনাকীকে ব্যক্তিজীবনে ইসলামের শরীয়া মোতাবেক চলতে হবে? এমনটাই কি এনাদের দাবি? মানে, তাকে অসততা দূরীকরণে, বা সৎ হওয়ার জন্যে সাচ্চা মুসলমান হতে হবে, হিন্দু-মুসলিম বিয়ে করা যাবে না বা ওপেন রিলেশনশিপে থাকা যাবে না? আশ্চর্য দাবিই বলতে হবে বৈকি! আচ্ছা, হিন্দু - মুসলিম আন্তঃবিবাহের বিরুদ্ধে কোন কালে পিনাকী একটা কথাও কি বলেছেন? অন্য ধর্মের, যেমন হিন্দু, খৃস্টান, ইহুদি যারা তাদের ব্যক্তিজীবনে কিভাবে কেমন করে ধর্মপালন করবে বা করবে না, ধর্মান্তরিত করতে বাধ্য থাকবে কি না, সেসব নিয়ে তিনি কোনকালে কিছু বলেছেন? তাহলে, কেমন করে তার ব্যক্তিজীবন সাংঘর্ষিক হলো? ভাইরে, পিনাকী ও ফরহাদ মাজহারদের মত বিষাক্ত সাপদের এভাবে মোকাবেলা করা যাবে? যেভাবে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে তারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন, উশকে দেন, যেভাবে হিন্দুদের উপরে, সংখ্যালঘু- আদিবাসীদের উপরে আক্রমণের পেছনে ইসলামবাদী ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার অবদানকে আড়াল করে আওয়ামী রাজনীতির ঘাড়ে পুরো দোষ দেন, আমাদের দেশে হিন্দুদের উপরে ইসলামবাদীদের হামলার দায় ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের ঘাড়ে চাপান, নাস্তিক ব্লগারদের উপরে আক্রমণকে বৈধতা দেন নাস্তিকদের উপরে দায় চাপিয়ে, মাদ্রাসা শিক্ষা, ওয়াজ মাহফিলের বাতাবরণে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারকে অস্বীকার করে, দায় এড়িয়ে, অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্তের ঘাড়েই দায় চাপিয়ে এবং ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিত্রিত করে যান- সেসবের ভণ্ডামি ও অসততা ধরিয়ে দেয়া অধিক জরুরী। সেই রাজনৈতিক আলাপ, সমালোচনা ও বিতর্ক বাদ দিয়ে, পিনাকীর বা ফরহাদ মাজহারের ব্যক্তিজীবনের সাথে আদর্শিক জীবনের সংঘর্ষ দেখানোর মাধ্যমে আদতে তাদের এই রাজনীতিকে মোকাবেলা করা আদৌ সম্ভব? 
 
আর, সবার আগে বুঝা দরকার, কথা ও কাজের মধ্যে, কিংবা বাইরের জীবন ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে দ্বিমুখিতা, দ্বিচারিতা, ভণ্ডামি ও অসততা দেখানোর জন্যে, ব্যক্তিগত জীবনে বা কাজেকর্মে নেতিবাচক, অন্যায়মূলক বা সমালোচনাযোগ্য উপাদান আগে থাকতে হয়! যেমনঃ কোন বামপন্থী নেতা রাস্তায় বিশাল শ্রমিক দরদী, শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়, কিন্তু দেখা গেলো - ব্যক্তিগত জীবনে বিনা পারিশ্রমিকে কাজের মেয়ে রেখেছে, তাকে ভোর থেকে রাত অবধি খাটায়, নিজেরা ভালো খেয়ে অবশিষ্টাংশ খেতে দেয়, তার নিজস্ব শোয়ার ঘর বা বিছানা নেই, রাতে রান্নাঘরেই বিছানা পেতে ঘুমাতে দেয়। কিংবা দেখা গেলো, সেই বামপন্থী নেতার একটা শিল্পকারখানা আছে, সেখানে সে কম মজুরি দেয়, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেয় না। সেক্ষেত্রে, তাকে অসৎ ও ভণ্ড রাজনীতিক বলা যাবে, কিন্তু উল্টাটা হলে? একজন পুঁজিপতি নেতা, রাজনৈতিকভাবে শ্রমিকদের দাবিদাওয়া, আন্দোলন, রাস্তায় ভাংচুর- এসবের খুব বিরোধী। কিন্তু তার যে কারখানা আছে, সেখানে সে শ্রমিকদের জন্যে খুব উচ্চ কর্মপরিবেশ রেখেছে, শ্রমিকদের ভালো বেতন দেয়, প্রতিবছর মুনাফার একটা পার্সেন্টেজ শ্রমিকদের বোনাস হিসেবে দেয়, শ্রমিকদের যেকোন অভাব অভিযোগ মন দিয়ে শুনে, দ্রুত সমাধান করে। এমন একজনকে মালিককে সামনে রেখে (মানে মালিকদের সংগঠনের নেতৃত্বে নিয়ে) অন্য মালিকরা আসলে নিজেদের শ্রমিক ঠকানোকে আড়াল করে। এখন, এই মালিকের ব্যাপারে আমাদের অভিযোগ কি হবে? কেন নিজ কারখানায় শ্রমিকদের ভালো কর্ম পরিবেশ দেয়, কেন প্রোফিট বোনাস দেয় বা কেন অন্য মালিকদের মত শ্রম বেতন-ভাতা বকেয়া রাখে না? সেগুলো দেখিয়ে তার কি অসততা, ভণ্ডামি কোনদিনও প্রমাণ করা যাবে আদৌ?
 
একইভাবে, পিনাকী ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত না হয়ে যদি অপরাধ না করে থাকে, হিন্দু হয়ে মুসলিমকে বিয়ে করে যদি কোন অপরাধ না করে থাকে,  কিংবা ওপেন রিলেশনশিপে থাকার কথা জানিয়ে যদি কোন অন্যায় না করে থাকে, এবং কোনকালেই হিন্দুদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার আহবান না জানিয়ে থাকে, কোনকালেই যদি হিন্দু-মুসলিম বিয়ে বা ওপেন রিলেশনশিপে জড়ানোর বিরুদ্ধে কোন কথা না বলে থাকে, তাহলে কিভাবে পিনাকীর ব্যক্তিজীবনে দ্বিমুখিতা, দ্বিচারিতা, ভণ্ডামি খুঁজে পাওয়া সম্ভব? হেফাজতি বা ইসলামবাদী আদর্শ পিনাকী যখন প্রচার করেন, সেসব পড়ে দেখলেও বুঝবেন, সেগুলো ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে মানার বাধ্যবাধকতা তিনি দেন না, বরং সবসময়ই দাবি করেন যে, ইসলাম হচ্ছে সেই উদার ধর্ম - যে অন্য ধর্মের উপরে জুলুম করে না। তিনি হেফাজতি বা ইসলামবাদীদের সমর্থন ও প্রচার করেন এই জায়গা থেকে যে, তারাই আজ দুনিয়াজুড়ে অত্যাচারিত (মজলুম), এবং অত্যাচারিতের অধিকারের পক্ষে, তাদের কন্ঠস্বরের পক্ষে, তাদের রাজনীতির পক্ষে দাঁড়ানোটা যেকোন মানুষের জন্যে কর্তব্য! ফলে, তিনি হিন্দু হিসেবেই মুসলমানদের দাবি ও অধিকারের পক্ষে, নিপীড়িত-নির্যাতিত মুসলমানদের রাজনীতির পক্ষে দাঁড়ান, এবং মুসলিম বিদ্বেষী (তিনি এটাকে ইসলাম-বিদ্বেষী হিসেবে উল্লেখ করেন) পাশ্চাত্য ইহুদী-খৃস্টানবাদী রাজনীতির এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির শেখানো বুলিতে চলা সেক্যুলারিজম ও প্রগতিশীলতার মুখোশ তিনি উন্মোচন করেন, পাশ্চাত্য ও ভারতীয় প্রভুদের অনুগত এদেশীয় সেক্যুলার - প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে তিনি মজলুম মুসলিমের পক্ষে লড়াই চালান, হিন্দু হয়েও! তার এসব আলাপ, যুক্তি ও অবস্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো জরুরী, সেগুলোকে ধরে ধরে সারহীন দেখানো যায়, দেখানো দরকার, কিন্তু একদিকে হেফাজতি আদর্শ প্রচার করে, আর অন্যদিকে ব্যক্তিজীবনে তিনি সেই আদর্শের উল্টা আচরণ করে দ্বিমুখিতা- দ্বিচারিতা-অসততা-ভণ্ডামি করছেন - এমন কি আদৌ বলা যাবে? একজন ব্যক্তি খৃস্টান হয়েও নির্যাতিত ইহুদীর পাশে দাঁড়াতে পারে, মুসলিম হয়েও যেভাবে অনেকে হিন্দুদের মন্দির ভাঙ্গার বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে দাঁড়ান, একজন নাস্তিক মন্দির-মসজিদের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলার পরে, নজরুলের মন্দির-মসজিদ ভাঙ্গার কবিতা প্রচার করার পরেও দেখা যায়, যখন এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের মন্দির বা মসজিদ ভাঙ্গে, তখন সেই মন্দির - মসজিদ রক্ষায় এগিয়ে যায়। এগুলোর কোনটাকে ভণ্ডামি বা অসততা বলে না, এগুলোকে বলে মহত্ব, বড়ত্ব! যেভাবে ব্যক্তিজীবনে বিষমকামী হয়ে সমকামীদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো, একজন সিজ জেণ্ডার হয়ে ট্রান্স জেন্ডারের পক্ষে কথা বলা, বাঙালি হয়েও আদিবাসীদের পক্ষে কথা বলা, পুরুষ হয়ে নারীবাদকে প্রচার করা - এসব কোন কিছুর মধ্যেই স্ববিরোধিতা, দ্বিমুখিতা, দ্বিচারিতা নেই!
 
মূলত, এই ভণ্ডামি ও অসততা কিভাবে ও কেন দেখাতে চাচ্ছেন তারা? বা, ঠিক কোন অর্থে পিনাকীর ব্যক্তিজীবনকে ভণ্ডামি বলতে পারেন? কেবলই একজন কাঠমোল্লা বা হেফাজতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এই ভণ্ডামি পাওয়া সম্ভব। কেননা, তাদের চোখে হিন্দু হচ্ছে পৌত্তলিক, যারা শিরক করে। কাঠমোল্লার দৃষ্টিকোণ থেকে একজন হিন্দু বা মুশরিককে ধর্মান্তরিত না করে বিয়ে করা মুসলমান নারী বা পুরুষের জন্যে হারাম, কেননা সেই মুশরিক ব্যক্তি মুসলিমকে ধর্মের পথ থেকে সরাতে পারে। একজন কাঠমোল্লার দৃষ্টি থেকে ওপেন রিলেশনশিপ বা বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক হচ্ছে ব্যাভিচার বা জেনা। ফলে, তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতে পারেন, ইসলামের পক্ষে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি ব্যক্তিজীবনে এমন "ন্যাক্কারজনক" কাজ করছে, ছিঃ ছিঃ! ফলে, তাদের কাছে পিনাকী ভণ্ড, অসৎ হতে পারে। কিন্তু যারা হিন্দু থেকে যাওয়া, ধর্মান্তরিত না হওয়া, হিন্দু-মুসলিম বিয়ে বা ওপেন রিলেশনশিপকে ন্যাক্কারজনক বা গর্হিত কাজ মনে করেন না, তারা কেন পিনাকীকে ভণ্ড হিসেবে প্রচার করছেন? তার কারণ কি এই না যে, তারা সেই কাঠমোল্লা, হেফাজতিদের ও পিনাকীর অসংখ্য মুসলিম অনুসারী, গুণমুগ্ধ ভক্তদের চোখ খুলে দিতে চাচ্ছেন? "পিনাকীর অন্ধ মুরিদদের মনে তার বুদ্ধিবৃত্তিক হিপোক্রেসি" তুলে ধরা, "পিনাকী যে আসলেই জনপ্রিয়তা লাভের জন্য হেফাজতের মুখোশ পড়ে আছেন" সেটা উন্মোচন করা - এসবই মূল উদ্দেশ্য যখন হয়, তার অর্থ আসলে কি দাঁড়ায়? সেই অন্ধ মুরিদ বা হেফাজতি- কাঠমোল্লাদেরকে দেখিয়ে দেয়া যে, দেখো পিনাকী আসলে জেনা করছে, পিনাকী আসলে একজন মুশরিক, ইত্যাদি, তাকে শরীয়া মোতাবেক যেখানে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কথা, সেখানে তোমরা অনুসরণ করছো! কি ভয়ানক অবস্থান, চিন্তা করা যায়! ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সদা লড়াই করনেওয়ালারাই কিভাবে ধর্মান্ধদেরকে ধর্মান্ধতার শিক্ষা দিচ্ছেন, এক পিনাকীকে ঠেকানোর লক্ষে!
 
আদৌ কি এতে ধর্মান্ধরা পিনাকী থেকে মুখ সরিয়ে নিবে বা নিচ্ছে? একজন "বিধর্মী", "মুশরিক" যখন ইসলামবাদী রাজনীতিকে সমর্থন যোগায়, তখন ইসলামবাদীরা যে পরিমাণ উপকার পায়, এরকম বিধর্মী বা হিন্দু সমর্থনকারীর পিঠে সওয়ার হয়ে ইসলামবাদী রাজনীতি তার সমস্ত অপরাধ যেভাবে ঢাকতে বা আড়াল করতে পারে, অন্য কোনভাবে সম্ভব হয় না! এই কারণেই দেখা যায় দুনিয়ার কোন ধর্মের কে কবে ইসলামকে নিয়ে, মুহাম্মাদকে নিয়ে কত বড় কথা বলেছে, সেটা তারা ফলাও করে প্রচার করে। একদিকে হেফাজত - জাগ্রত মুসলিম জনতা প্রভৃতি মন্দিরে কোরআন পাওয়া, হিন্দু অমুক ফেসবুকে কোরআন বা কাবাকে অবমাননা করেছে, নবীকে কটুক্তি করেছে - বলে একদম তুলকালাম করে- হিন্দু মন্দির- বাড়ি ভাংচুর করেছে, অন্যদিকে সেই হিন্দু ধর্মেরই একজন এসে বলছে- এসবই যুবলীগ-ছাত্রলীগের কাজ, বা এদেশে শিবসেনার এজেন্টরা এগুলো করাচ্ছে। ইসলামকে নিয়ে, কোরআন ও নবীকে নিয়ে আজেবাজে কথা বললে তো একজন সাধারণ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির অনুভূতিতে তো আঘাত লাগবেই, তারা খেপবেই। ইত্যাদি। এমন একজনের "হিন্দু" পরিচয় তাদের জন্যে অনেক কার্যকরী, পিনাকীর কথাগুলিই যদি একজন মুসলমান বা ধর্মান্তরিত মুসলমান বলতো, তাতে তার যে প্রভাব, তার চাইতে "হিন্দু হয়েও" পিনাকী যা বলছে তার প্রভাব অনেক বেশী। যেভাবে রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছে- এর প্রমাণে সবচেয়ে বেশি কোট করা হয় রমেশচন্দ্র মজুমদার আর সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাসকে। সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাসের ভিডিও বক্তব্য শেয়ার করার সময়ে ক্যাপশনে প্রায়ই লেখা থাকে "হিন্দু হয়েও" কথাটা, এই "হিন্দু হয়ে" হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরোধিতার যে ভার, তার তুলনায় সরকার শাহাবুদ্দীন আহমদ কিংবা মোহাম্মদ আবদুল মান্নান এর রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতার ভার অনেক কম! এটা হেফাজতিরা ভালো বুঝে বলেই, পিনাকীর মুশরিক-হিন্দু হওয়া নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই, তাকে ধর্মান্তরিত করা বরং তাদের জন্যে লস প্রজেক্ট। পিনাকীর ওপেন রিলেশনশিপ, কিংবা তার শরীর দেখানো বডি বিল্ডিং বা নোংরা ভাষায় গালিগালাজ - এসব যখনই কোন কাঠমোল্লাকে দেখাবেন, তারা অবলীলায় বলবে - হিন্দু বলেই এমন, মুসলমান হলে এমন হতো না! এক বাক্যেই আলাপ শেষ, এবং সেই পিনাকীকে তাদের দরকার হবে - ইসলামবাদী রাজনীতির পিঠ চাপড়ে দিতে! এই যে এক হিন্দুর ধর্ম ও ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামবাদীরা হস্তক্ষেপ করে না- এবং সে হিন্দু হয়েও মুসলমানদের কাছ থেকে বিরূপতা, ঘৃণার সম্মুখীন হয় না, তাতেই প্রমাণ দেখানো সম্ভব হয় যে, ইসলাম আসলে খুব শান্তির ধর্ম, খুব "সেক্যুলার" একটা ধর্ম! ফলে, জেনা করা কত বড় অপরাধ, তার সাজা মৃত্যুদণ্ড - এসব যতই প্রচার করা হোক, এসব বানী যতই হেফাজতি ও কথিত অন্ধ মুরিদদের মাথায় ঢুকানো হোক, সেগুলো দিয়ে তারা মোটেও পিনাকীকে বর্জন করবে না, বরং আরো অসংখ্য "দুর্বল" মুসলমানের জীবনকেই অতিষ্ঠ করবে!
 
চার
আমার সেই ফেসবুক পোস্টের কমেন্টেই আসিফ মহিউদ্দিন পিনাকীর বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার ব্যাপারটি উদাহরণ সহকারে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন,
"আচ্ছা, আপনি যদি ফেইসবুকে নারীবাদের কান্ডারী সাজেন, নারীর সমান অধিকার নিয়ে ঘণ্টায় তিনবার নাকে কাদেন, এবং ব্যক্তিজীবনে নারীকে ভোগ্যপণ্য ভাবেন এবং আপনার মেয়েকে স্কুলে না পাঠিয়ে আপনার ছেলেকে নামী স্কুলে পাঠান, সেই নিয়ে আমি কী প্রশ্ন তুলতে পারবো? আপনার মত দারুন নিরপেক্ষ ব্যক্তি কী বলে? সেটি ব্যক্তি আক্রমণ হিসেবে গণ্য হবে? মানে, ব্যক্তিজীবনে আমি নামাজ রোজা করে, বাচ্চাকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে, চারবিবি রেখে, দাসী সহবত করে ফেইসবুকে এসে মুক্তচিন্তা নাস্তিকতা নিয়ে নসিহত করতে পারবো?"
আসিফের উদাহরণটি বেশ মজার! আমার পোস্টের আলাপেও আমি বলেছিলাম, "ব্যক্তিজীবন-বাহিরজীবন যেকোন কিছু নিয়েই সমালোচনা থাকলে, অবশ্যই সমালোচনা করা যাবে"! ব্যক্তিজীবনে যদি আমি নারীকে ভোগ্যপণ্যের মত ব্যবহার করি, পুত্র ও কন্যার মাঝে যদি লিঙ্গ অনুযায়ী পার্থক্য করি, তাহলে আমার ফেসবুকে যতই আমি নারীবাদ নিয়ে কাণ্ডারী সাজি বা না সাজি, ঘন্টায় তিনবার নাকি কান্না কাঁদি বা না কাঁদি- আমার সমালোচনা তো যেকেউ করতেই পারে! মানে, যারা জানবে তারা করবে! আমার আত্মীয় স্বজনের মধ্যেও এরকম লক্ষণ যেগুলো কাছ থেকে দেখেছি, আমি সমালোচনা করেছি, করি। বুঝানোর চেষ্টা করি! আমার নিজেরও তো হাজারো সমস্যা-সংকট ছিল, আছে- যারা জানে, কাছ থেকে যারা দেখে, জানে- সমালোচনা করে, সমস্যা কি? কিন্তু প্রশ্নটা তো বস্তুত উল্টো! আপনার উদাহরণটিকেই যদি উল্টে দেই, ধরেন একজন লোক প্রকাশ্যে নারীবাদের মারাত্মক বিরোধী, কিন্তু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে যথেষ্ট নারীদের প্রতি দারুণ শ্রদ্ধাশীল, নিজের স্ত্রীর সাথে তার মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক, স্ত্রীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় বাঁধা দেয় না, কিংবা নিজের কন্যা সন্তানকে পুত্র সন্তানের চাইতেও ভালোবাসে- এসব ক্ষেত্রে আমাদের আপত্তির জায়গাটা কি হবে? নারীবাদের বিরোধী হয়েও ব্যক্তিজীবনে কেন সে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কেন কন্যা সন্তানকে গুরুত্ব দেয়, কেন কন্যাকে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করে? এসব বলে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো, নাকি তার নারীবাদ নিয়ে বিরোধ, আপত্তির জায়গাগুলো ধরে সমালোচনা করবো?

আসিফ মহিউদ্দীন একই রকম আরো কিছু উদাহরণ দিয়েছেন, পিনাকীর ভণ্ডামী বুঝাতে এবং কেন ও কিভাবে পিনাকীর ব্যক্তিজীবন নিয়ে কথা বলা উচিৎ তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে। তিনি বলেছেন,
"ধরুন ফেইসবুকে নারীর অধিকার নিয়ে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস লেখা কোন নারী যদি ব্যক্তিজীবনে কাজের মেয়েকে মারধোর করে, বা নারীবাদী লেখক কোন পুরুষ যদি অফিসে মেয়েদের যৌন নির্যাতন করে, তাহলে ঐগুলা কী আর ব্যক্তিগত বিষয় থাকে? নিজের প্রচারিত মতাদর্শের একদম উল্টোটা যদি ব্যক্তিজীবনে দেখা যায়, তা নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না?"
খুব সহজ হিসাব! কাজের মেয়েকে মারধোর করা ফৌজদারি অপরাধ! ফলে, ফেসবুকে নারীর অধিকার নিয়ে জ্বালাময়ী কথা বলুক বা না বলুক, যে এই কাজ করবে, তার বিরুদ্ধে শুধু সমালোচনা না, এমনকি আইনের হাতেও সোপর্দ করা যেতে পারে। কিংবা কাজের মেয়েটি যদি শিশু হয়, মারধর করা সেই কথিত নারীটির শিশুশ্রম নিয়ে ফেসবুকে কোন বক্তব্য না থাকলেও তার বিরুদ্ধে কথা বলা, সমালোচনা করা যায়, দরকার। ফেসবুকে নারী অধিকারের পক্ষে বা শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলে এমন কাজে লিপ্ত হলে, তাকে ভণ্ড, অসৎ, দ্বিমুখী- এসবও বলা যায়। সেই নারীর সমালোচনা করা, বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, ভণ্ড-অসৎ বলার প্রসঙ্গটা আসছে, কেননা ব্যক্তিজীবনে তার অপরাধ, বা সমস্যা আছে। কিন্তু এই উদাহরণগুলোর সবই পিনাকীর ঘটনার ঠিক উল্টো ধরণের হয়ে যাচ্ছে। ধরা যাক, এক নারী নিজে বাসায় কোন কাজের মেয়ে রাখে না (কিংবা রাখলেও নিজের মেয়ের মত যত্ন নেয়- স্কুলে পাঠায়), কিন্তু ফেসবুকে এক চাকুরীজীবি মায়ের পক্ষ নিয়ে কাজের মেয়েরা-বুয়ারা কত সমস্যা করে, বাচ্চারা সেইফ না- এসব যুক্তি তুলে ধরে কাজের মেয়েকে প্রহার করা আরেক নারীর পক্ষে অবস্থান নিলো ! এখন কি বলবেন? সেই সব যুক্তির সমস্যা নিয়ে আলাপ করবেন? নাকি, নিজের কাজের মেয়েকে না মেরে কেন আরেকজন যে কাজের মেয়েকে বেদম মেরেছে, তার পক্ষ নেয়াটা কতবড় হিপোক্রেসি- সেটা তুলে ধরবেন?
"পিনাকী কেন মেনন ইনুর ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস আর হজ্ব নিয়ে কটাক্ষ করে? সে নিজে যা করে, অন্য একজন ঠিক একই কাজ তার সাথে করলে সেটা অন্যায়?"  
মেনন ও ইনুর হজ্ব পালন নিয়ে পিনাকী কি কটাক্ষ করেছেন আমার জানা নেই। কিন্তু রাষ্ট্রীয় টাকায় ঘটা করে হজ্ব করে, হজ্বের পোশাকে ফটোসেশন করার পরেও, সেটা কিভাবে ব্যক্তিগত ডোমেইনে থাকে, সেটাই তো বুঝতে পারছি না! আমিও মেনন ও ইনুর হজ্ব পালন নিয়ে আপত্তি করেছি, রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করাকে অপরাধ মনে করি, সে জায়গা থেকে। শেখ হাসিনার ভোটের আগে তসবিহ হাতের সেই ছবি, বা তাহাজুদ্দের নামাজের গল্প সংসদে দাঁড়িয়ে জানান দেয়া, এরশাদের জুম্মার নামাজের খবর বিটিভিতে ভিডিও সমেত প্রচার করা- এসবের কোনটাই তো আর ব্যক্তিগত থাকে না, পাবলিক ডোমেইনে চলে আসে, কেননা জনগণকে ধর্মীয়ভাবে প্রভাবিত করাকে আমি সমাজের জন্য ক্ষতিকর মনে করি। সেসব নিয়া কথা বলা, আপত্তি করা, কটাক্ষ করার সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মকর্ম পালন নিয়ে আপত্তি করা বা প্রশ্ন তুলার মূলগত পার্থক্য আছে। অর্থাৎ এরশাদ কেন জুম্মা নামাজ বা ঈদের নামাজ পড়লেন, বা শেখ হাসিনা কেন তাসবিহ গুনেন, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন, সেটি কখনই আমার প্রশ্ন নয় বা সমালোচনার জায়গা নয়, বরং তারা কেন রাজনীতির পাবলিক স্ফিয়ারে তাদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় আচরণগুলোকে নিয়ে আসছেন, রাজনীতিতে কেন ধর্মের ব্যবহার করছেন, আমার সমালোচনার জায়গা সেটি। এর সাথে মেনন ও ইনুর ক্ষেত্রে আরেকটি সমালোচনা যুক্ত হতে পারে, তাদের এককালের বামপন্থী ও মার্কসবাদী রাজনীতির চর্চা। অনেকে সেই জায়গা থেকেও সমালোচনা করে, তাদেরকে অসৎ, ভণ্ড বলেছেন। আমি অবশ্য সেই সমালোচনা করি না, কেননা যেই মুহুর্তে তারা ১৪ দলে যোগ দিয়ে বুর্জোয়া রাজনীতির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছেন, গণ মানুষের ও শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রাজনীতির তল্পিবাহক হয়েছেন, তখন থেকেই তো তাদের আর বামপন্থী হিসেবে স্বীকার করি না। ভণ্ডামি, অসততা, দ্বিমুখিতা, দ্বিচারিতা যা করার তারা সেই সময় থেকেই করেছেন, ভিকারুন্নেসা স্কুল কমিটির দায়িত্ব পালন কালে চুরি চামারি বলি, আর রাষ্ট্রীয় অর্থে হজ্বে যাওয়া বলি- সবই তো সেই ভণ্ডামি ও অসততারই ধারাবাহিকতা মাত্র।
 
মেনন ও ইনুর হজ্ব পালনের চাইতে বরং মঞ্জুরুল আহসান খানের হজ্বে গমন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা এক্ষেত্রে বরং আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হবে। সে সময়ে আমিও এ নিয়ে সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম। ছাত্র ইউনিয়নের কিছু প্রাক্তন কর্মী জানিয়েছিলেন, মঞ্জুরুল আহসান খান নাকি ব্যক্তিগত জীবনে একজন বিশ্বাসী মানুষ। সেক্যুলার, কিন্তু নন-প্রাক্টিসিং মুসলিম। একজন বিশ্বাসী বামপন্থী মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মচর্চা নিয়ে আমার কোন প্রশ্ন বা সমালোচনার জায়গা নেই, ফলে মঞ্জুরুল আহসান খান কেন হজ্বে গেলেন - সেটি নিয়ে আর প্রশ্ন করিনি বা সমালোচনা করিনি। তবে আমি মনে করেছি, তিনি মার্কসবাদী নন, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী নন, কেননা একজন ধার্মিক, আস্তিক বা বিশ্বাসী ব্যক্তি মাত্রই ভাববাদী, মোটেও বস্তুবাদী নয়। আমার সমালোচনা বলতে গেলে অতটুকুই। আমি কেবল প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি কি কখনো কর্মীদের সামনে মার্কসবাদ ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের পাঠ দেননি? কি বলেছিলেন তখন? মঞ্জুরুল আহসান খানের ব্যাপারে আমি জানি না, তবে বাসদ নেতা কমরেড খালেকুজ্জামান বা কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী যেভাবে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের (ও নাস্তিকতার) পাঠ কর্মীদের দিতেন, তার পরে তারা যদি নিজেরা নামাজ, রোজা পড়তেন, হজ্ব করতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তাদেরকে ভণ্ড, অসৎ বলতাম। কমরেড খালেকুজ্জামান ও বজলুর রশিদ চৌধুরী শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতি করে যখন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে যান, তখন তাদেরকে ভণ্ড বলে সমালোচনা করি। কেননা সেক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক শিক্ষা ও আদর্শ আর কর্ম বিরোধাত্মক। মঞ্জুরুল আহসান খানের রাজনৈতিক দর্শন ও চর্চা সম্পর্কে জানা নেই বিধায় হজ্বে গমনকে তাই ভণ্ডামি - অসততা বলছি না। তবে, তাকে মার্কসবাদী বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী বলেও আর মনে করি না। মওলানা ভাসানীর ধর্ম পালন, পীরগিরি নিয়েও আমার কোন সমালোচনা নেই, তবে তাকেও আমি কখনই মার্কসবাদী - বস্তুবাদী মনে করি না (তিনি সেই দাবি করেনও না)! আমার বাবা ও তার বন্ধু বান্ধব সার্কেলে এই সিপিবি ও মোজাফফর ন্যাপ ওরিয়েন্টেড লোকজন প্রচুর। ব্যক্তিগত জীবনে অবিশ্বাসীই মনে হতো, কিন্তু আবার তাদেরকেই দেখতাম গ্রামেগঞ্জে ঘটা করে ধর্মকর্ম পালন করছেন, জুম্মার ও ঈদের নামাজ পড়ছেন, বিভিন্ন পূজা উৎসবে অংশ নিচ্ছেন। বাম রাজনীতি করা সেই কাকাদের এমন ধর্মকর্ম করা নিয়ে প্রশ্ন করায় বলেছিলেন, তারা ধার্মিক নন বা তারা ধর্ম পালন করেন না, তারা এসব কিছুকেই সংস্কৃতি হিসেবে দেখেন এবং জনগণের সংস্কৃতিতে অংশ নেন মাত্র। যুক্তি হিসেবে ভালো, কিন্তু পরে সিপিবি'র জেলা বা শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কাউকে কাউকে ধার্মিক বা আস্তিক হিসেবে পেয়ে মনে হয়েছে, কোথায় যেন তারা মার্কসবাদের চর্চা, তথা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দার্শনিক চর্চা থেকে সরে যাচ্ছেন।
 
এখন, মূল প্রশ্নে আসি। ভণ্ডামি ও অসততা বলতে যদি আমি বুঝে থাকি- যে আদর্শ ধারণ করি বলে প্রচার করি ও অন্যকে যে আদর্শে উদ্বুদ্ধ করি, সেই আদর্শের বিপরীত কর্ম ব্যক্তিগত জীবনে করলে, তাকে ভণ্ডামি, অসততা, দ্বিমুখিতা, দ্বিচারিতা বলা হয়, তাহলে পিনাকীর প্রচারিত ইসলামবাদী আদর্শ আর তার ব্যক্তিগত জীবনে সেক্যুলার সুবিধাভোগকে (যেমন ধর্মান্তরিত না হয়েই হিন্দু-মুসলিম বিয়ে) ভণ্ডামি বলা যাবে কি না? হ্যাঁ, এই অর্থে পিনাকীকে ভণ্ড বলা যেত, যদি পিনাকী হিন্দু ও বিধর্মীকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করে, নিজে হিন্দু ধর্মকে আঁকড়ে ধরতেন। যদি তিনি আন্তঃধর্ম বিয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে, ধর্মান্তরিত না হয়েই হিন্দু-মুসলিম বিয়েকে জেনা বলে প্রিচ করে এবং তার জন্যে মৃত্যুদণ্ড দাবি করে, নিজে ঠিকই হিন্দু-মুসলিম বিয়ে করতেন, তাহলেও তাকে ভণ্ড বলা যেত। কিন্তু, তিনি তো এরকম দ্বিমুখিতা-দ্বিচারিতা কখনো করেননি, তাহলে কিভাবে এটা অসততা-ভণ্ডামি হবে?
 
আসিফ মহিউদ্দিন সেই আলাপে পিনাকীর সাথে সাথে ফরহাদ মাজহারেরও সমালোচনা এনেছিলেন। একই রকম সমালোচনাঃ
"ফরহাদ মজহার দীর্ঘসময় লিভ টুগেদার সম্পর্কে ছিলেন। অসংখ্য নারীর সাথে তার বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল। তা উনার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু প্রকাশ্যে তিনি ইসলামী জিহাদের সমর্থন করেন। দেশে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য লেখালেখি করেন। শরীয়ার পক্ষে সাফাই গান। হেফাজতের সমর্থন করেন। ১৩ দফার সমর্থন করেন। জিজ্ঞেস করাটা কী অন্যায় যে, তিনি যেই মতাদর্শের সমর্থক, তার প্রয়োগ ব্যক্তিজীবনে কতটা? শরীয়া আইনে লিভ টুগেদারের শাস্তি কী? শরীয়া কায়েম হলে তার শাস্তি কী হবে?"  
খুবই আজব ধরণের সমালোচনা! একবার বলছেন, লিভ টুগেদার বা বিবাহিত বহির্ভুত নারীর সাথে সম্পর্ক "উনার ব্যক্তিগত বিষয়", আবার সেই ব্যক্তিগত বিষয়ই তিনি সকলের আলাপের বিষয় বানিয়ে ফেলছেন! “অসংখ্য নারীর সাথে বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক”- এই কথাটার ভিত্তি কি, এই তথ্যের জরুরতই বা কি? এসবকে "ব্যক্তিগত বিষয়" বলে পাশে "কিন্তু" যুক্ত করে দিয়ে, ইসলামী জিহাদ সমর্থন, ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা, হেফাজতের ১৩ দফা সমর্থন নিয়ে ফরহাদ মাজহার যেসব লেখালেখি করেন- তার সাথে ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ কতটা, সেই প্রশ্ন তুলেছেন। ফরহাদ মাজহার ইসলামী জিহাদকে সমর্থন করেন, সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবেলার অংশ হিসেবে, এমনকি দেশে ফ্যাসিবাদ মোকাবেলায় জামাত – বিএনপি- হেফাজতকেও সমর্থন করেন। হেফাজতি উত্থানকে তিনি দেশের একদম প্রান্তিক, গরীব মানুষের উত্থান হিসেবে দেখিয়ে, ১৩ দফাকে ধর্মপ্রাণ আম পাবলিকের নিজস্ব ভয়েস হিসেবে হাজির করেছেন। এসবকিছু নিয়েই ধরে ধরে কথা বলা যায়, কথা বলা দরকারও! কিন্তু শরীয়া আইন আসুক, লিভ টুগেদারের তথা জেনার শাস্তির বিধান হোক, এসবের পক্ষে কি ফরহাদ মাজহার কখনো ওকালতি করেছেন? অন্যদের লিভ টুগেদার করার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন কখনো তিনি? তাহলে, তিনি নিজে কেন লিভ টুগেদার করেন, প্রশ্ন করে তাকে হিপোক্রেট বলা যাবে? ফরহাদ মাজহারকে নিয়ে গড়ে বড়ে কিছু বলা ও সমালোচনা করার আগে তার চিন্তার সাথে পরিচিত হওয়া দরকার। লালন ভক্ত ফরহাদ মাজহারের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস কি বা কেমন? তিনি ইসলামবাদী রাজনীতিকে সমর্থন করেন কোন জায়গা থেকে? আমাদের দেশে ভারতীয় আগ্রাসন ও পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি যে ইসলামে ভর করেন, সেই ইসলাম কি সালাফিস্টদের ইসলাম? এবং গোটা দুনিয়াতেই মুসলমানের উপরে ওয়ার অন টেররের নামে সাম্রাজ্যবাদীদের নিপীড়ন ও আক্রমণের বিরুদ্ধে মজলুম মুসলমানের লড়াই বা ইসলামী জিহাদের মাধ্যমে কোন ধরণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন? এই প্রশ্নগুলোর জবাবের মধ্যেই আসলে বুঝা যাবে, ফরহাদ মাজহারের ব্যক্তিজীবনের কথিত লাইফ স্টাইল, তার আদর্শিক চিন্তার সাথে সাংঘষিক কি না। এখানে ফরহাদ মাজহারকে নিয়ে বিস্তারিত আলাপের সুযোগ নেই। কেবল, এতটুকুই বলছি - ফরহাদ মাজহারের চিন্তা ও যুক্তির মাঝে অসংখ্য ফ্যালাসি আছে, মিথ্যা - কপটতা - ভণ্ডামিও আছে, তার চিন্তার মাঝে পরতে পরতে বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা আমি খুঁজে পাই, কিন্তু নিজস্ব অবস্থান থেকে হেফাজতি - ইসলামবাদী রাজনীতি সমর্থনের সাথে তার ব্যক্তিজীবনের কথিত চর্চাগুলোর (লিভ টুগেদার, নারীর সাথে বিবাহ বহিভূর্ত সম্পর্ক) কোন রকম সংঘর্ষ নেই বা ভণ্ডামি-অসততা আমি খুঁজে পাই না।

এরপরে আসিফ, পিনাকী ভট্টাচার্যের পুরাতন এক লেখার সূত্র টেনেছেন, যেখানে পিনাকী বলেছিলেন - ইউরোপে সেক্যুলারিজমের দরকার থাকলেও আমাদের দেশে তার কোন দরকার নাই, আর জরুরত না থাকলে এ দেশে সেক্যুলারিজমের জন্যে জান কোরবান করে দেয়ারও কোন কারণ নাই। পিনাকীর সেই আলোচনা উল্লেখ করে, আসিফ মহিউদ্দীন প্রশ্ন করেছেন,
"তার এবং তার স্ত্রীর বিবাহ যদি সেক্যুলার কায়দায় হয়ে থাকে, সেখানে প্রশ্ন ওঠে, আমাদের দেশের জন্য সেক্যুলারিজমের দরকার না হয়ে থাকলে, উনি কেন সেই কায়দায় বিবাহ করলেন? উনি ব্যক্তি জীবনে সেক্যুলার রাষ্ট্রের সুবিধাটুকু নেবেন, আবার বলবেন আমাদের জন্য সেক্যুলারিজমের কোন দরকার নাই, এটা কেমন কথা?" 
পিনাকীর সেক্যুলারিজম সংক্রান্ত পোস্টটি (এখন ফেসবুকের সেই লিংক কাজ করে না, সম্ভবত পিনাকীর সেই আইডি ডিলিট বা ব্লক হয়ে গিয়েছে) ফ্যালাসি ও মিথ্যা ইতিহাসে ভরপুর, সেগুলো খুব সহজেই ধরিয়ে দেয়া যায়, সেখান থেকে টানা সিদ্ধান্তের (বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের জন্যে জান কোরবান করার কারণ নেই) জবাবও সুন্দরভাবে দেয়া যায়, পিনাকীর পোস্টেই বেশ কয়েকজন জবাব দিয়েওছে! কিন্তু, আসিফ যেভাবে ব্যক্তিজীবনে সেক্যুলারিজমের সুফল ভোগ করে, পিনাকীর সেক্যুলারিজম-বিরোধিতাকে স্ববিরোধিতা হিসেবে উপস্থিত করলেন, তাতে পিনাকীর পোস্টের অন্তর্নিহিত রাজনীতিটা আসিফ ঠিকমত ধরতে পারেননি বলেই বোধ হচ্ছে! পিনাকীর বক্তব্যে ইউরোপে সেক্যুলারিজমের ইতিহাসের সাথে রাজতন্ত্র ও চার্চের গাটছাড়া সম্পর্ক, রাষ্ট্রের উপরে ধর্মের প্রবল প্রভাব, এসবের যে ফিরিস্তি আছে- সেটার মূল জায়গাই হচ্ছে এটা দেখানো যে, সে কারণেই ইউরোপে সেক্যুলারিজমের জন্যে জানপাত করার এত দরকার ছিল, কিন্তু এখানে আমাদের মত মুসলিম দেশে ধর্ম কখনোই রাষ্ট্রের উপরে সেইভাবে প্রভাব ফেলে নাই (কিংবা তার মতে ইসলাম সব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেয়, রাষ্ট্রের উপরে খবরদারি করে না), ফলে ইউরোপের অনুকরণে সেক্যুলারিজম নিয়া আমাদের এত চিল্লাচিল্লির কিছু নেই। এই হচ্ছে তার বক্তব্যের সারকথা। অর্থাৎ সেক্যুলারিজমের বিরুদ্ধে, তথা ইউরোপে রাষ্ট্রের উপরে চার্চের খবরদারি ছেটে ফেলার বিরুদ্ধে তিনি কিন্তু কথা বলেননি বা সেক্যুলারিজমেরই কোন দরকার নেই - ছিল না - এমন কিছু তিনি বলেননি। তিনি কেবল এটাই বুঝাতে চেয়েছেন যে, আমাদের এখানে কখনোই সেই খবরদারিটাই ছিল না (এর আরেক অর্থ হচ্ছে, এখানে সবসময়ই সেক্যুলারিজম ছিল আছে, বা ইসলাম সম্পূর্ণভাবেই একটা সেক্যুলার ধর্ম)। ফলে, পিনাকী তার বিবাহের ক্ষেত্রে যে সেক্যুলার প্রথার সুফল ভোগ করছেন সেই সেক্যুলারিজমের বিরোধিতা কেন করছেন, সেটা যদি তাকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি হয়তো সুন্দর মতন জবাব দিবেন এভাবে, কি সুন্দর "সেক্যুলার" একটা সমাজে বাস করছি বলেই না এই প্রথায় বিবাহ করতে পেরেছি! এখানে সমস্যা কোথায়? তোমরা কোন সেক্যুলারিজমের জন্যে তাহলে জান কোরবান করছো?
 
 
পাঁচ
পুলক ঘটক আমার ফেসবুক পোস্টের জবাবে আরেকটি পোস্ট লিখেছিলেন। সেই পোস্টের অধিকাংশ বক্তব্য বা যুক্তির জবাব মূলত আমার মূল পোস্টে এবং কমেন্টে অনেকের প্রশ্নের জবাবে করে ফেলেছি। দুই-একটি পয়েন্টে সে সময়ে জবাব দেয়া হয়নি। তিনি বলেছেন,   
"বিয়ের কথা বাদ দিলে “ওপেন রিলেশনশিপ“ নিয়ে আপত্তি কেবল কাঠমোল্লাদের বা হেফাজতিদের; মুক্তমনা ব্লগারদের ওপেন রিলেশনশিপ নিয়ে কোনো আপত্তি বা ভিন্নমত নেই- এটা মোটেই সঠিক নয়"। 
"ওপেন রিলেশনশিপ" হচ্ছে একটা বিশেষ ধরণের সম্পর্ক, এ নিয়ে ভিন্নমতের কি থাকতে পারে, তা আমার বোধগম্য নয়। এমনকি কাঠমোল্লাদের মাঝেও এ নিয়ে ভিন্নমত থাকার কিছু নেই। যেটা তাদের থাকে, তা হচ্ছে তীব্র আপত্তি। গা ঘিন ঘিনে একটা ঘৃণাভাব। কেননা, যেকোন বিবাহ বহির্ভূত যৌনতাই হচ্ছে ব্যভিচার বা জেনা। আর, নারীর বহুগামিতা মানেই হচ্ছে - সেই নারী নষ্টা, বেশ্যা। তারা বিয়ে করা দম্পতির পারস্পরিক সম্মতিতে অন্য নারী বা পুরুষের সাথে মিলিত হওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না বিধায় তাদের মাঝে এই তীব্র আপত্তি তৈরি হয়! কিন্তু, মুক্তমনা ব্লগার বা যেকোন আধুনিক, সেক্যুলার, প্রগতিশীল ব্যক্তির এমন ওপেন রিলেশনশিপের ব্যাপারে আপত্তি থাকার কি আছে, সেটাও আমার বোধগম্য নয়। যতখানি বুঝতে পারছি, পুলক ঘটক খুব সম্ভবত নিজে এরকম ওপেন রিলেশনশিপের বিষয়টি হজম করতে পারছেন না, তিনি এই তীব্র আপত্তি ধারণ করেন বিধায়, এভাবে নিজের আপত্তিকে মুক্তমনা ব্লগারদের উপরে চাপিয়ে দিয়েছেন! এখন, পুলক ঘটকের এই "আপত্তি"র কারণ আসলে কি? সেটি আমার প্রতি ছুড়ে দেয়া তার একটি প্রশ্ন থেকে বুঝা যাবে, 
"আমি যদি আমাদের নাধ ভাইকে বলি, ‘আপনি এবং আপনার স্ত্রী ওপেন রিলেশনে আছেন’ তাহলে আপনিও তো পিনাকীর মত তেড়ে আসবেন - এখন যেভাবে এসেছেন"!
এই যে পুলক ঘটক বলেছেন আমি তেড়ে আসবো, আসলে সেটা এমন পরিস্থিতিতে তিনি নিজে কি করবেন, সেটিই আমার উপরে চাপিয়েছেন। অবশ্য, যেকোন দম্পতি বা জুটি পরস্পরের সাথে কিরকম সম্পর্কে লিপ্ত বা কেমন সম্পর্কের চর্চা করেন, সেটা অন্যের বলার কোন রকম এখতিয়ার থাকে না। আর, যেরকম সম্পর্কে তারা নেই, বা নিজেরা যেরকম সম্পর্কে যাওয়ার কথা চিন্তাও করে না, সেরকম একটা সম্পর্কে তারা আছে - এমনটা বলে দিলে সেই দম্পতি ক্ষিপ্ত হতেই পারে। আসলে পুলক ঘটকের প্রশ্নটা হতে পারে এমন, আমি ও আমার স্ত্রী ওপেন রিলেশনে আছি কি? - এই প্রশ্ন করলে তেড়ে যাব কেন, আমার জবাব দিতে ইচ্ছে না করলে বড়জোর বলতে পারি, আমি ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নই বা অনিচ্ছুক। আমার অবশ্য এই প্রশ্নের জবাব দিতে সমস্যা নেই, আমার জবাব হচ্ছে- না, আমরা কোন রকম ওপেন রিলেশনশিপের মাঝে নেই। আমাদের সম্পর্ক (প্রেম ও বিয়ে) হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি মনোগামাস (এখন পর্যন্ত বলেছি, ভবিষ্যতের কথা আমাদের দুজনের কেউই জানি না)। এখন, পুলক ঘটক প্রশ্ন করতে পারেন, আমি ও আমার স্ত্রী এরকম ওপেন রিলেশনশিপে যেতে এখন আগ্রহী হবো কি না, রাজী হবো কি না, বা পারবো কি না! এই প্রশ্নের জবাবেও বলবো- না, রাজী হবো না, পারবো না। তবে, আগ্রহ যে কখনো হয়নি বা ভনিষ্যতে কোন কালেই আগ্রহ হবেও না, সেটা অবশ্য বলতে পারছি না। বস্তুত, এরকম ওপেন রিলেশনশিপের কথা প্রথম জানতে পেরেছি - জা পল সার্ত্র ও সিমোন দ্য বোভোয়া - এই দুজনের সম্পর্ক থেকে। তাদের মাঝে শেষ জীবন পর্যন্ত দারুণ সম্পর্ক বজায় ছিল, কিন্তু তাঁরা কখনো বিয়ে করেননি, এমনকি সবসময় লিভ টুগেদারও করেন নি, আবার তাঁরা মনোগামাসও ছিলেন না। এই সম্পর্কটি আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিলো - অনেক ভাবিয়েছিলো, চিন্তার খোরাক দিয়েছিলো, নর-নারী প্রেম-ভালোবাসা-যৌনতার সম্পর্ক নিয়ে নতুন ভাবে চিন্তার খোরাক দিয়েছিলো। একটা সম্পর্ক হলেই দুজনকে সারাজীবন একসাথে ঝুলে থাকতে হবে কেন, একে অপরকে দখল করে রাখতে হবে কেন, এই প্রশ্নের জায়গা থেকে আমার কাছে এমন ওপেন সম্পর্ককেই আদর্শ সম্পর্ক বলে মনে হয়েছে। কিন্তু, নিজে যখন প্রেম ও বিয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছি, নিজেদের ক্ষেত্রে সেরকম হতে পারিনি। মানে, আমার প্রেমিকা বা স্ত্রীকে অন্য কারোর সাথে "শেয়ার" কথা চিন্তাও করতে পারিনি, আমার স্ত্রীও আমাকে অন্য নারীর সংস্পর্শে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না। হয়তো মুখে বলেছি, বা মজা করেছি, সে যদি কখনো কারোর সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হয়, তাহলে আমিও আরেকজনের সাথে লিপ্ত হবো। কিন্তু আমার ধারণা, এরকম ক্ষেত্রে আমরা আসলে সম্পর্কচ্ছেদের দিকেই যাবো! অতএব, বুঝতেই পারছেন - আমরা ওপেন রিলেশনশিপের চর্চা করি না, এবং এরকম সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার কথা নিজেদের ক্ষেত্রে কল্পনাও করতে পারি না, খুব সম্ভব আপনার নিজের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমন! 
 
কিন্তু, এটাকে কি ওপেন রিলেশনশিপের ব্যাপারে আমার "আপত্তি" বলা যাবে? আমি তা মনে করি না! একটা হচ্ছে ব্যক্তির চয়েস, আরেকটা হচ্ছে অন্যের চয়েস এর ব্যাপারে শ্রদ্ধার বিষয়। মানে, আমি নিজে বিষমকামী, কিন্তু অন্য কারোর সমকামিতা নিয়ে আমার কোন আপত্তি তো দূরের কথা, হেডেক পর্যন্ত নেই। এটা অনেকটা এরকম, আমি নিজে করল্লা খেতে অপছন্দ করি, আমি খাবো না। কিন্তু অন্যকে কি করল্লা খেতে বাঁধা দিতে পারি? বা আমার নিজের জন্যে খুব উজ্জ্বল - চকচকে পোশাক পরতে পছন্দ করি না, আমার এই পছন্দ অন্যের উপরে চাপাতে পারি কি? একই ভাবে, মনোগামী হওয়াটা আমার চয়েস হতে পারে, কিন্তু অন্যের বহুগামিতা নিয়ে আমি কি বাঁধা দেয়া, সমালোচনা - গালমন্দ করা, সাজার ব্যবস্থা করা, এসব কি করতে পারি, যদি সেখানে কোন রকম অন্যায় বা অপরাধ কর্ম না ঘটে থাকে? ফলে, পুলক ঘটকের বুঝতে হবে - মানুষের কোন একটা নিরীহ চর্চা, অভ্যাস, বা রুচিকে সমর্থন জানানো, তার ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্যে, নিজের মধ্যেও সেই চর্চা অভ্যাস গড়ে তুলাটা পূর্বশর্ত হিসেবে থাকে না! মানে, সমকামীদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো মানে যেমন নিজেরও সমকামী না হওয়া, তেমনি নিজে বিষমকামী হওয়া, বা নিজের জন্যে সমকামী হওয়াটা যতই অকল্পনীয় হোক, যতই গা ঘিন ঘিনে ভাব তৈরি করুক, তার অর্থ কখনই সমকামী জুটির প্রেম - ভালোবাসা - যৌনতার প্রতি আপত্তি নয়! নিজের পছন্দ, রুচি, অভ্যাস, সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন, যৌনাভ্যাস প্রভৃতি অন্যের উপরে চাপিয়ে দেয়া, অন্যকে মূল্যায়ন বা বিচার করা, অন্যকে নিজের মত হতে বাধ্য করা, অন্যের ভিন্নরকম অভ্যাসের বাঁধা দেয়া, আপত্তি করা, "পৃথিবীর পূর্ব পশ্চিম" কোথাও আছে কি না, কত "বিরল ও ব্যতিক্রম" বলে সেই বিরল ও ব্যতিক্রম-এর চর্চাকে ডেমোনাইজ করা, খুবই অন্যায় আচরণ। ফলে, কাঠমোল্লা, হেফাজতিদের মত অন্য মানুষের ভিন্ন রকম সম্পর্কের চর্চা, যৌনতা - প্রভৃতি নিয়ে একই রকম আপত্তি থাকলে কেউ কখনো "মুক্তমনা", "প্রগতিশীল" থাকতে পারে বলে আমি আসলেই মনে করি না। আমি অবাক হয়ে আসলে পুলক ঘটকের এহেন "আপত্তি"র জায়গাই দেখেছি। তিনি জানিয়েছেন,  
"আসলে পূর্ব থেকে পশ্চিম -পৃথিবীর কোথাও ওপেন রিলেশনের বড় কোনও সমাজ নেই। ... হ্যা, পৃথিবী জুড়ে পরকিয়া আছে, যৌনতার চৌর্যবৃত্তি আছে এবং ধরা পরার পর সম্পর্ক বিচ্ছেদের ঘটনা আছে। কিন্তু দম্পতির পরস্পরের সম্মতিতে ওপেন রিলেশন বিরল ও ব্যতিক্রম। অথচ নাধ অবলীলায় বলে দিলেন, ওপেন রিলেশনশিপ নিয়ে আপত্তি কেবল কাঠমোল্লাদের! একদম স্ববিরোধী কথা"
কি গোলমেলে চিন্তা! সংখ্যার বিচারে সমর্থন বা আপত্তি জানানোটা কোন ধরণের নৈতিকতা? বাংলাদেশের মত সমাজে নাস্তিকতা কি খুব সাধারণ ও নৈমত্তিক? আমি যে সময়ে, যে বয়সে নাস্তিক হয়েছি, তখন আমার স্কুলে, পাড়া মহল্লায়- কোথাও কোন নাস্তিক পাই নি, সবচেয়ে বিরল ও ব্যতিক্রম প্রজাতি ছিল নাস্তিকরাই। গোটা দুনিয়ায় মানুষ প্রধানত বিষমকামী, সমকামীরা পার্সেন্টেজ হিসাব করলে খুব বিরল ও ব্যতিক্রম। হিজড়ারা, রূপান্তরকামীরা, আন্তঃলিঙ্গরা বিরল ও ব্যতিক্রম! বিরল ও ব্যতিক্রম হলেই, তাদের প্রতি আপত্তি করাটা সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার হয়ে যেতে পারে কি? কি ভয়ানক ও কত প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা! 
 
পুলক ঘটক কিন্তু নিজেও জানাচ্ছেন, পৃথিবী জুড়ে পরকিয়া আছে, যৌনতার চৌর্যবৃত্তি আছে! এখন পৃথিবী জুড়ে আছে বলেই পরকিয়া ও যৌনতার চৌর্যবৃত্তিকে সমর্থন জুগিয়ে যেতে হবে? না, আমি এমনটা মনে করি না। আমার কাছে, পরকিয়া ও যৌনতার চৌর্যবৃত্তিই অনেক বেশি আপত্তিকর, সেখানে যে প্রতারণা চলে, সেখানে পুরুষরা যেভাবে নারীর উপরে ক্ষমতার চর্চা করে, সেগুলো দুনিয়া জুড়ে থাকে বলেই সমর্থন করতে পারি না। এমনকি, আমার বরং জুনিয়াজুড়ে থাকা পুরুষতান্ত্রিক মনোগামাস বিয়ে প্রথা নিয়েই ব্যাপক মাত্রায় আপত্তি আছে, পুরুষতান্ত্রিক বিয়ের মাধ্যমে যে মনোগামাস পরিবার গড়ে উঠে, সেগুলোকে আমি "প্রাইভেট প্রস্টিটিউশন", "দাস প্রথা", "সামন্তীয় ব্যবস্থা" বলে অভিহিত করি। হ্যাঁ, নারী স্বেচ্ছায় এরকম বিয়ে করলে, তার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান রাখি বিধায়, সেই নারীকে "দাসী", "প্রস্টিটিউট" বলে গালমন্দ করি না, বস্তুত নারীকে যেহেতু ভিক্টিম গণ্য করি, তাদেরকে গালমন্দ করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু, এই বিয়ে ও সংসার থেকে অন্যায় ও অসম সুবিধা ভোগ করা পুরুষকে আমি দোষারোপ করি (কেননা, তখন এটি আর ব্যক্তির ইচ্ছা বা স্বাধীনতা নয়, এখানে অন্যায় বা অপরাধ যুক্ত)। মোট কথা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের চর্চা, সংস্কৃতি, অভ্যাস দিয়ে কখনই মোরালিটি নির্ধারিত হতে পারে না। 
 
আমি পরকিয়ার ব্যাপারে আপত্তি তুলি, সে তুলনায় ওপেন রিলেশনশিপকে অনেক বেশি সমর্থন করি। যেকোন বা অধিকাংশ দাম্পত্য সম্পর্কেই দেখা যায়, অনেক সময়ই একজনের যৌন আকাঙ্ক্ষায় বা আগ্রহে অন্য জনের মাঝে একই রকম আকাঙ্ক্ষা বা আগ্রহ তৈরি হয় না, সেভাবে সাড়া দিতে পারে না। প্রেম ও বিয়ের শুরুর দিকে দুজনের মাঝে যৌন আকাঙ্ক্ষার যে তীব্রতা থাকে, কয়েক বছর পরেই তা আর একইরকম থাকে না, যত বছর যায় ততই সেটা কমতেই থাকে। বিভিন্ন স্টাডিতে দেখা যায়, যারা পার্টনার পরিবর্তন করেছে (একাধিকবার বিচ্ছেদ ও নতুন সম্পর্কে জড়ানো), তাদের মাঝে অনেক বয়স পর্যন্ত যৌনভাবে সক্রিয় ও যৌনতাকে উপভোগ করার হার অনেক বেশি। অন্যদিকে সারাজীবন একই জুটির মাঝে একগামী সম্পর্কে যৌনতাটা একসময় অনেক গৌন হয়ে যায়। আমাদের মত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একগামিতাটা থাকে কেবল নারীর, আর পুরুষরা নানাাভাবে বহুগামিতার চর্চায় লিপ্ত হয় বা হওয়ার চেস্টা করে বিধায় দেখা যায় - পুরুষ অনেক বয়স পর্যন্ত যৌনভাবে সক্রিয় থেকে যায়, কিন্তু নারী দ্রুতই যৌন-নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। অসংখ্য নারীই কেবল স্বামীর যৌন আবেদনে নির্জীব পুতুলের মত সাড়া দিয়ে যায়, সেটা তার জন্যে কোন রকম উপভোগের বিষয় তো থাকেই না, বরং এরকম যৌন উত্তেজনা বিহীন যৌনকর্ম কখনো কখনো খুব পেইনফুল হতে হতে, যাতে একটা যৌন-বিতৃষ্ণা তৈরি হয়ে যায়, যা তার যৌন-নিষ্ক্রিয়তাকেই আরো ত্বরান্বিত করতে পারে। নারীর এই যৌন নিস্ক্রিয়তাকেই সামাজিক নানা ট্যাবু, মূল্যবোধ আর মিথের নামে জেনারালাইজ করার চল রয়েছে। "সন্তান হলে" বা "মধ্যবয়সে" নারীর যৌনতা কমে যায়, যৌন আকাঙ্ক্ষা মরে যেতে থাকে, "মেনোপেজ হওয়ার পরে" নারীর যৌনতা নাই হয়ে যায় - এসবই হচ্ছে মিথ! যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া, নাই হয়ে যাওয়ার কারণ মোটেও সন্তান হওয়া, মধ্যবয়স হওয়া, মেনোপেজ- এসব নয়, বরং একগামিতা (এবং যৌনতার চর্চায় পুরুষের আধিপত্য তথা যৌনতার চর্চায় নারীকে গৌন বা প্যাসিভ করে রাখা, নারীর যৌনতুষ্টিকে গুরুত্ব না দেয়া)। অনেক সময়ই দেখা যায়, পরকিয়া বরং দম্পতির নিজেদের মাঝেও যৌন সক্রিয়তা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে! অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের মাঝে বহুগামিতার একটা ট্রেইট আছে, মানুষ আজকের আধুনিক ও সভ্য হওয়ার আগে লাখ লাখ বছর ধরে বহুগামিতার চর্চাই করে এসেছে। আজকের এই চাপিয়ে দেয়া একগামিতা মানুষের যৌনতাকে উপভোগ করার পথকে অবরুদ্ধ করেছে, যৌনতাকে সীমিত করেছে, যৌন আনন্দকে ধ্বংস করার মাধ্যমে অবদমিত করেছে, বিকৃতির জন্ম দিয়েছে! মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব, প্রবৃত্তি তথা স্বভাবজাত বৈশিষ্টকে জোর করে বা নানারকম সামাজিক মূল্যবোধ বা নৈতিকতার নামে নিয়ন্ত্রণ করা, নির্দিষ্ট ছাঁচে তৈরি করতে বাধ্য করা - এসবের ফল যে ভালো হয় না, তা আজকের বর্তমান পুরুষতান্ত্রিক একগামী সম্পর্কগুলোর দিকে তাকিয়েই আমরা বুঝতে পারি, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা যৌন বিকৃতিগুলোর দিকে তাকালে বুঝতে পারি। 
 
একগামী সম্পর্কে যে অধিকারবোধের ধারণা, পার্টিনারকে নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করা, আমার পার্টনার "আমি" বাদে আর কোন পুরুষ বা নারীর সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারবে না, সেখান থেকে অন্য কারোর প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করতে পারবে না, ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে পারবে না, বন্ধুত্ব করতে পারবে না, এবং মেলামেশাই করতে পারবে না - এমন অধিকারবোধের ধারণা মানুষকে সীমাবদ্ধ করে, মানুষের গণ্ডি ও জগতকে খুব সীমিত করে দেয়। এভাবেই একগামী নিউক্লিয়াস পরিবারগুলোর মাঝে প্রচণ্ডরকম আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতার চর্চা শুরু হয়ে যায়। দুজনের প্রতি এমন চরম কেন্দ্রিকতা প্রথমে দুজনকে বাঁকি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে, তারপরে একে-অপরের প্রতি প্রাথমিক সেই উত্তেজনা থিতিয়ে আসার পরে যখন দুজনের মাঝেও নানা রকম অতৃপ্তি, বিরক্তি, অসহিষ্ণুতা, অনাস্থা দেখা যায়, দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়, তখন দুটি মানুষই হয়ে যায় প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ! পুরুষের তবু কর্মস্থলে যাওয়ার কারণেই, বাসার বাইরের একটা সামাজিক জীবন থাকে, গৃহে বন্দী গৃহিনী নারী বিচ্ছিন্ন, একাকী, নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে থাকেন। একটা পরকিয়া সম্পর্ক এমন নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন, একাকী মানুষকে মুক্তি দিতে পারে, পরকিয়ার মাঝে যে প্রতারণা থাকে - অসততা থাকে, তার বিরোধিতা করি ঠিকই, এমন বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্যে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়াকে আমি বেশ জরুরী বলে মনে করি।
 
সবমিলেই এরকম পুরুষতান্ত্রিক একগামী সম্পর্ক ও পরিবার এই সমাজ প্রগতিতে খুব কমই ভূমিকা রাখতে পারছে বলে আমি মনে করি। সেই জায়গা থেকে যখন বলি ভবিষ্যতে মানুষ যৌন স্বাধীনতা অর্জন করবে, বিয়ে প্রথাকে মানুষ ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলবে, মানুষের যৌনতা ও সম্পর্কের চর্চা হবে বহুমুখী, যৌনতার চর্চায় মানুষ ওপেন রিলেশনশিপকেই অধিক আঁকড়ে ধরবে, সেটা কেবল আমার ভবিষ্যদ্বানীই নয়, বরং সমাজ প্রগতির ধারায় এমন ভবিষ্যতকেই আমি প্রত্যাশা করি। যেভাবে আমি নারী-পুরুষের সমতা চাই, শ্রেণী বৈষম্যের অবসান চাই; তেমনি মানুষের যৌনতাকেও আমি মুক্ত করে দিতে চাই। এই চাওয়া, আর আমার বর্তমান চর্চার মাঝে বিস্তর ফারাক থাকতেই পারে। আমি শ্রেণীবিহীন সমাজ চাই, আবার আমি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করেছি, সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য দুনিয়ায় বাস করি ও তাদের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করি। ঔপনিবেশিকতার চরম বিরোধী হওয়ার পরেও ঔপনিবেশিক যুগের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী দেশগুলোর একটায় বাস করি। নারী-পুরুষের সমতার পক্ষে কথা বলার পরেও, নিজ পরিবারে নিজের দিকে তাকালে ক্ষণে ক্ষণে টের পাই কত বড় পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ আমার মাঝে বাস করে। একইভাবে, বিয়ে প্রথার বিরুদ্ধে থাকার পরেও ও নাস্তিক হয়েও, নিজে পরিবার গঠন করেছি কাজী ডেকে "ইসলাম" মতে বিয়ে করেই। একইভাবে লিভ টুগেদার, ওপেন রিলেশনশিপকে অনেক আধুনিক চর্চা হিসেবে বিবেচনা করলেও, নিজে একগামী সম্পর্কের চর্চা করি। ফলে, আমার মাঝে একটা-দুটা নয়, অসংখ্য স্ববিরোধিতা আছে বৈকি। কিন্তু, পুলক ঘটক যেভাবে আমার মাঝে স্ববিরোধিতা খুঁজে পেয়েছেন, মানে মুক্তমনারাও "ওপেন রিলেশনশিপ" এর ব্যাপারে আপত্তি করার পরেও আমি কেবল কাঠমোল্লা ও হেফাজতিদের মাঝেই আপত্তি খুঁজে পেয়েছি, - এমন কোন স্ববিরোধিতা আমার মাঝে নেই। "ওপেন রিলেশনশিপ" এর ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি তো নেইই, বরং একে আমি সমাজ প্রগতির পথে খুব জরুরী ধাপ বলেই মনে করি। তবে, আমার আগের আলাপে একটা ভুল আমি করেছি। আমি কেবল কাঠমোল্লা ও হেফাজতিদের কথা বলেছিলাম, আসলে এরকম "ওপেন রিলেশনশিপ" এর ব্যাপারে আপত্তিটা কেবল তাদের নয়, কুপমণ্ডুক, সংস্কারগ্রস্ত, প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের পক্ষেও এমনতর সম্পর্ক মেনে নেয়া সম্ভব নয়, এবং অনেক নাস্তিকও এমন কুপমণ্ডুক, প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারে বৈকি!
 
ছয়
পুলক ঘটক তার এই পোস্টের শেষ করেছেন, তার পূর্বের লেখার একটি সংশোধনী দিয়ে। তিনি নাকি "খোঁজ দ্য সার্চ" করে জানতে পেরেছেন,
"পিনাকী যাই করুন না কেন, তার স্ত্রী এসব ওপেন/ সিক্রেট রিলেশনের মধ্যে নেই। তিনি (পিনাকীর স্ত্রী) একজন পরহেজগার ডাক্তার। নামাজ কখনো কাজা করেন না, রোজা যাতে মাকরূহ না হয়, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকেন। তিনি কেন ওপেন রিলেশন করবেন?"
এই যে অন্য ব্যক্তির স্ত্রী'র ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে "খোঁজ" নেয়া, আরেকজন নারীকে নিয়ে, তার ব্যক্তিগত জীবন, তার ধর্মাচরণ, তার সম্পর্ক চর্চার ওপেন/ সিক্রেট হওয়া না হওয়া, এসব সম্পর্কে নাক গলানো, খোঁজ নিয়ে পাবলিকলি "গসিপ" করা, এগুলো কেবল অরুচিকর ও নোংরা কাজই নয়, ঘোরতর অন্যায়ও। অবশ্য সাংবাদিকদের মাঝে এমন "এথিক্স" কেবল কাগজে-কলমেই থাকে, পাবলিক যেহেতু অন্যের ব্যক্তিগত ডোমেইনের কিচ্ছা-কাহিনী খুব খায়, বিখ্যাত - আলোচিত মানুষের "গোপনীয়তা"র একটা বাণিজ্যিক মূল্য আছে, এই বাণিজ্যমূল্যের কাছে সাংবাদিকদের সমস্ত "এথিক্স" মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তাই পাপারাজ্জিরা "স্টার"দের ছবি গোপনে তুলেন, "গোপন" সম্পর্কের কথা খুঁজে বেড়ান এবং তার উপরে রঙ চাপিয়ে, মনের মাধুরি মিশিয়ে কাস্টমারকে খাওয়ান! সাংবাদিক পুলক ঘটকের আলাপেও তাই ঘুরে ফিরে এসেছে ক্লিনটন-মনিকা লিউনেস্কির কথা, এরশাদ-বিদিশার কথা, সন্যাসী - পোপ বা বড় হুজুরের গোপন বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের কথা! বলাই বাহুল্য, এসব বিষয়ে রসিয়ে সরিয়ে কিচ্ছাকাহিনীগুলো পাবলিকলি নিয়ে যাওয়ার কাজটা মিডিয়াগুলোই করে, এমন রসালো-উপাদেয় গসিপের জন্যেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ট্যাবলয়েড। ফলে, এসব চর্চার মধ্যে আজীবন কাটিয়ে দেয়া সাংবাদিকদের মধ্যে এমন চর্চাকে অন্যায় মনে না হওয়াটাই স্বাভাবিক! মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুলক ঘটক নিজেই কিন্তু প্রশ্ন করেছেন,
"ক্লিনটন আর মনিকা সম্মতি নিয়েই সেক্স করেছিলেন, যদিও হিলারির সম্মতি নেননি। সমস্যা সেখানে হয়নি, হিলারি ক্ষমা করলে আমরা বলার কে?" 
হুবহু একই প্রশ্ন আমারও। ক্লিনটন ও মনিকা লিউনেস্কি বা অন্যরা যার সাথে ইচ্ছে সম্পর্ক করুন, সেখানে যদি কোন অন্যায় না ঘটে (মানে, নারী যদি প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ হন বা ড্রাঙ্কড-ড্রাগড না হন, এবং সজ্ঞানে ও কোন রকম চাপ ছাড়া সম্মতি প্রদান করেন), তাহলে তা নিয়ে দুনিয়ার মানুষের তো কোন রকম মাথাব্যথা থাকতে পারে না। হিলারির প্রতি প্রতারণার অভিযোগ বড়জোর আসতে পারে, সেটাও বস্তুত হিলারি'কেই করতে হবে। হিলারি'র যদি কোন মাথাব্যথা না থাকে, তাহলে কিভাবে সেটা নিয়ে দূর বাংলাদেশের সাংবাদিকদের এত আগ্রহ হয় যে, তারা দিনের পর দিন, পাতার পর পাতা আজেবাজে গল্প-কাহিনীতে ভরিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি আমার মনে আছে, আমার এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে জাতীয় দৈনিকের এক সাংবাদিক সেই ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলেছিলেন! [আমি অবশ্য তাকে চুপসে দিয়ে বলেছিলাম, তাদের সমাজে এমন সম্পর্ক (পারস্পরিক সম্মতিতে বহিঃবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক) অহরহই ঘটে এবং খুবই নৈমত্তিক একটা ব্যাপার। সেটা নিয়ে এই দূর বাংলাদেশে বসে আমাদের কথা বলার কি আছে? - আমার সেই মন্তব্য অবশ্য তারা ছাপেননি!]
 
যাই হোক, মূল আলাপে ফিরি। পুলক ঘটক তার সমাপনী বক্তব্য কেবল সংশোধনী দিয়ে এবং পিনাকীর স্ত্রী সম্পর্কে খোঁজ করে ও খোঁজে প্রাপ্ত তথ্যাদি পাবলিক করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি তার সাথে রঙ-ও চড়িয়েছেন। পিনাকী ও তার স্ত্রী'র বেডরুম কল্পনা করেছেন এবং পিনাকীর "পরহেজগার" মুসলিম স্ত্রী পিনাকীকে ঘুমের মধ্যে জবেহ করে (প্রথমে ভেবেছিলাম সুন্নতে খাৎনা করা কথা বলেছেন, পরে ভালোভাবে পড়ে দেখি শল্য চিকিৎসাটা "গলায়" করার কথা বলেছেন) ফেলতে পারেন বলে আশংকাও করেছেন। তিনি বলেছেন, 
"আমার বরং ভয় হচ্ছে - এরকম একজন সহীহ্ পরহেজগার বেহেশত পিয়াসী নারী শেষতক পিনাকীর গলায় শল্য চিকিৎসা সম্পন্ন করেন কিনা! পাসে ঘুমন্ত পিনাকীকে দেখে তার যদি কখনো মনে হয়, “শালা মালুর বাচ্চা মালু, তোর সঙ্গে সম্পর্ক করা যেনা। তোরে নিয়া বেহেশতে যাওয়ার উপায় নাই। বরং শফি হুজুরের ফতোয়া (ওয়াজিব) অনুযায়ী আল্লাহ আকবর বলে দায়িত্ব পালন করলে জান্নাতুল ফেরদৌসের রাস্তা সহজ হতে পারে!”    
একজন সুস্থ-স্বাভাবিক ও শুভ বোধ সম্পন্ন ব্যক্তি এমন সব কথা বলতে পারেন কি? পিনাকী ভট্টাচার্যের প্রতি ঘৃণা কোন পর্যায়ে গেলে তার সাথে তাত্ত্বিক ফাইট বাদ দিয়ে একজন লোক, এমন অসংলগ্ন ও কুৎসিত কথাবার্তা বলতে পারেন! পুলক ঘটক বুঝতেও পারলেন না যে, এখানে তিনি তার ঘৃণা কেবল পিনাকীর প্রতিই নিবিষ্ট রাখতে পারেন নি, বরং আরেকজন নারীর প্রতি, এবং যেকোন "পরহেজগার" ধার্মিক ব্যক্তির প্রতিও সেই ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়েছেন! খুবই নিন্দনীয় ও অন্যায়মূলক কাজ!
 
 
সাত
পুলক ঘটক আমার প্রতি ও যারা পিনাকীর ব্যক্তিজীবন টেনে এমন পরচর্চার নিন্দা করেছেন, তাদের প্রতি একটা আহবান জানিয়ে তার পোস্টটি শেষ করেছেন। তিনি বলেছেন,
"আপনারা যারা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মত ‘করুণায়বতীর্ণ কলৌ’ তারা স্বকরুণায় পিনাকীর প্রাণ সংশয় মোচনের জন্য অবতীর্ণ হন"।
পিনাকীর স্ত্রীর হাতে তার প্রাণ সংশয়ের আশংকা আমার কোনদিনই হয়নি, দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনে পিনাকীর "পরহেজগার বেহেশত পিয়াসী" স্ত্রী কখনই পিনাকীর গলায় শল্য চিকিৎসা সম্পন্নের প্রয়োজন দেখেননি, ফলে এভাবে প্রাণ সংশয়ের আশংকাও কেউ করেনি। তবে, পুলক ঘটক বস্তুত আশংকার নাম করে যেভাবে পিনাকীর স্ত্রীকে বেহেশতে যাওয়ার তরিকা বাতলে দিলেন, সেটা পিনাকীর প্রাণ সংশয়ে ভূমিকা রাখতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে কি? যদিও আমি এমন কোন সম্ভাবনা বা আশংকা দেখি না, তদুপরি পুলক ঘটকের এমন বক্তব্যের মাঝে পিনাকীর প্রাণ সংশয়ের সূক্ষ্ম ইচ্ছা বা প্রচেস্টা খুঁজে পাই। সে জায়গা থেকে বলছি, হ্যাঁ পিনাকীকে যতই শত্রুবৎ বিবেচনা করি, তারও প্রাণ সংশয়ের যেকোন প্রচেষ্টা মোচনের জন্যে অবতীর্ণ আমি হই। আমার মানবিকতা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা- আমাকে এই শিক্ষাই দেয়। তার জন্যে কোন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বা কোন ঋষি-মহামানব বা নবী-রাসুলকে অনুসরণের দরকার আমি দেখি না। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বা বিভিন্ন নবী-রাসুলকে বা তাদের বানীকে অনুসরণ করি না বলেই, আমি যেকোন ধর্মের- বর্ণের- মত ও পথের, এমনকি আমার চিন্তা-রুচি-আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যক্তিরও প্রাণ সংশয় মোচনের জন্যে অবতীর্ণ হওয়াটা আমি কর্তব্যজ্ঞানই করি। এবং, আশা করি, পুলক ঘটক পিনাকীর তথা একজন চরম শত্রুরও প্রাণ সংশয়ের আশা করবেন না বা প্রাণ সংশয়ে পরোক্ষ ভূমিকা রাখবেন না, বরং তিনিও পিনাকীর প্রাণ সংশয় মোচনের জনেই অবতীর্ণ হবেন।
 
 
পরিশেষে, পুলক ঘটকের বোধোদয় ঘটুক, শুভবুদ্ধির উদয় হোক - এই প্রত্যাশাই করে আলোচনা শেষ করছি!

[১। পুলক ঘটকে পোস্টের এবং সেখানকার কমেন্টের তর্ক-বিতর্কের প্রতিক্রিয়ায় ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ এ লেখা পোস্টের পুনর্লিখিত, পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত রূপ। ঐ পোস্টে নাদিয়ার "নারীবাদী" গালিগালাজ সম্পর্কিত একটা অংশ ছিল, তা এখানে বাদ দিয়ে কেবল পিনাকী ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। ঐ পোস্টের মূল আলোচনার সাথে কমেন্টের তর্ক-বিতর্কও এখানে যুক্ত করেছি। এবং আমার পোস্টের জবাবে পুলক ঘটক যেই পোস্ট লিখেছিলেন, সেটিরও জবাব সে সময়ে দেয়া হয়নি, সেই জবাব বর্তমান এই পোস্টে লিখেছি। নতুন করে এই লেখাটি তৈরি করেছি ১২-১৩ জুন, ২০২৪ তারিখে; তবে এখানে এটি পোস্ট করেছি, সেই পুরাতন মূল পোস্টের তারিখেই (২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)।
 
২। পুলক ঘটকের ১ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে জবাব পোস্টের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, পুলক ঘটক ও পিনাকী ভট্টাচার্যের মাঝে এই লেখাগুলোর আগেও বেশ তর্ক-বিতর্ক হয়েছে এবং স্বভাব অনুযায়ী পিনাকী গালাগালির ফোয়ারা ছুটিয়েছেন। সেই গালাগালিতে পিনাকী পুলক ঘটকের স্ত্রীকে টেনে এনে "ধর্ষণের ইচ্ছা"ও নাকি পোষণ করেছেন (পিনাকীর মত মানসিকভাবে বিকৃত একজনের পক্ষে এটা খুব নৈমত্তিক এক কাজই বটে)। যেই সময়ে (পুলক ঘটকের ওপেন রিলেশপনশিপ নিয়ে লেখা পোস্টের সময়টায়) আমি পুলক ঘটক ও অন্যদের সাথে এই তর্ক করছিলাম, তখন এই ঘটনা জানতাম না। আমি যদি পুলকের পিনাকীকে নিয়ে এই সমস্ত আলোচনাকে কেবল পাল্টা গালি হিসেবে দেখতাম, তাহলে এত আলোচনা হয়তো করতাম না, কেননা আমি মনে করি - গালাগালির সময়ে মানুষ অনেক কিছুই বলে যা মিন করে না, ফলে গালির ভাষা নিয়ে এত বিচার বিশ্লেষণ করার কিছু নেই। পিনাকী যেহেতু শুরুতে পুলকের স্ত্রীকে জড়িয়ে বাজে গালি দিয়েছেন, সেহেতু পুলকের পাল্টা গালিতে পিনাকীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও তার স্ত্রীকে টেনে আনার পেছনে পিনাকীর ভূমিকাও আছে। গালাগালিতে এই যে একে অপরকে বাদ দিয়ে বা ছাপিয়ে আরেক নারীকে টেনে আনা (কখনও মাকে, কখনও বোনকে, কখনো স্ত্রীকে), একে আমি প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক ও মিসোজিনিস্টিক আচরণ বলে মনে করি, গালাগালির ক্ষেত্রে সেই দোষে তাদের দুজনই দুষ্ট, তবে পিনাকী এটি শুরু করেছে বিধায় তার দোষ অধিক।
 
৩। তদুপরি, এই পোস্টটায় পিনাকীর "ওপেন রিলেশনপিশ" ও "হিন্দু-মুসলিম বিয়ে" প্রসঙ্গেই সমস্ত আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছি, যেহেতু সেগুলোকে পুলক ঘটকের নিছক গালি হিসেবে বিবেচনা করিনি। কেননা, পুলক ঘটক এবং আরো অসংখ্য নাস্তিক, সেক্যুলার, প্রগতিশীল ফেসবুকার, ব্লগার, লেখক এই তর্ক বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন, তারা বিভিন্ন লেভেলে যে যুক্তিগুলো করেছেন, সেখানে পিনাকীর গালির জবাবে গালি হিসেবে বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকেনি। পুলক ঘটক ও তাদের সেই চিন্তাগুলোকেই আমি আসলে এখানে এই পোস্টে কাউন্টার করার চেস্টা করেছি।]