মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৯

'সব মরণ নয় সমান'*

জনপ্রিয় নারীবাদী ফেসবুকার, ব্লগার, লেখক নাদিয়া ইসলাম বলেছেন,

"পিনাকী ভট্টাচার্যরা যদি কন, অভিজিতের রক্ত আর হেফাজতের একজন কর্মীর রক্তে কোনো পার্থক্য নাই, উনাদের শরীর বারুদের বস্তার মত জ্বইলা উঠে। পিনাকীর সাথে আমার রাজনৈতিক দ্বিমত আছে একশবার, কিন্তু উনার এই কথার সাথে আমি একমত। আমি অভিজিতের রক্তের সাথে হেফাজতের একজন কর্মীর রক্ত, একজন হিটলারের রক্তের সাথে একজন এ্যানি ফ্রাংকের রক্তের, ইদি আমিনের রক্তের সাথে মাদার তেরেসার রক্তের, আদিবাসী একজন পাহাড়ির রক্তের সাথে বাঙ্গালী মুসলমানের রক্তের, একজন আসিফ মহিউদ্দীনের রক্তের সাথে গোলাম আজমের রক্তের পার্থক্য দেখি না। একজন মাদার তেরেসার সাথে একজন হিটলারের পার্থক্য তার কাজে। একজন কাদের মোল্লার সাথে একজন বীরশ্রেষ্ঠের পার্থক্য তার কাজে। তার রক্তে না"। 
নাদিয়ার মত আমিও বিশ্বাস করি, দুনিয়ার কোন মানুষেরই "অন্যায্য"ভাবে হত্যার অধিকার পৃথিবীর দ্বিতীয় মানুষের নাই, রাষ্ট্রেরও নাই; এমনকি সেই মানুষ যদি ভয়ংকর ঘৃণা থেকে ছয় মিলিয়ন মানুষরে নির্বিচারে হত্যা করে, তারপরেও সেই সেই মানুষরে বিনা বিচারে হত্যা করা যায় না; এমনকি সেই মানুষ একজন শিশু ধর্ষকও হন, তারপরেও উনারে রাস্তাঘাটে বিনা বিচারে পিটায়ে মাইরা ফেলা যায় না; এমনকি সেই মানুষ ইয়াবা ব্যবসায়ী বা ভয়ানক সন্ত্রাসীও হন, তারপরেও উনারে ক্রসফায়ারে মেরে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়া যায় না ...। আমার ধারণা, দুনিয়ার যেকোন মানবতাবাদী ব্যক্তির বিশ্বাস এ থেকে আলাদা হওয়ার কথা না! এমনকি- যাদের 'শরীর বারুদের বস্তার মত জ্বইলা উঠে' উল্লেখ করে এগুলো লেখা হলো- তাদের বিশ্বাসও ভিন্নরকম নয় বলেই আমার ধারণা, অন্তত আমি সাধারণভাবে তেমনটি দেখিনি (এক ধর্ষককে গণপিটুনির ঘটনা বাদে)! বরং এদের কাউকে কাউকে দেখেছি- "ন্যায্য"ভাবে কিংবা "যথাযথ বিচার" প্রকৃয়ার মাধ্যমেও একজনকে হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার! যাই হোক, প্রতিটা মানুষের রক্তের মূল্য তথা জীবনের মূল্য যে সমান- এ ব্যাপারে নাদিয়ার সাথে কোনই দ্বিমত নেই! কিন্তু, মুশকিলটা হচ্ছে- নাদিয়াকে এই বেসিক ও প্রাইমারি মানবিক অবস্থানটা নেয়ার জন্যেও পিনাকীর উপরে সওয়ার হতে হচ্ছে। পিনাকীর সাম্প্রদায়িক অবস্থান, স্ববিরোধিতা, রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে- কেবল একটি লাইনকে সামনে এনে তার সাথে একমত দেখানো আর পিনাকির পুরা রাজনৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধাচরণকে ঐ একটা মহান মানবিক লাইনের বিরুদ্ধাচরণ হিসেবে দেখানোকেও (শরীর বারুদ বস্তার মত জ্বইলা উঠে) বুদ্ধি-জৈবিক অসততা কওয়া যায় কি?
সোজা হিসাব কিছু দেখা যাইতে পারে- নাদিয়ার দেয়া কনট্রাস্টগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। একজন হিটলারের রক্তের সাথে একজন আনা ফ্রাংকের রক্তের কোন পার্থক্য নাই সত্যি- কিন্তু সেই সাথে এইটাও সত্য যে হিটলার যেমনে ১৫ বছরের কিশোরি আনা ফ্রাঙ্কের মত লাখ লাখ ইহুদির রক্তের কারণ হয়েছিলো- হিটলারের রক্ত কিন্তু অন্য কেউই ঝরায়নি! আদিবাসী একজন পাহাড়ির রক্তের সাথে বাঙ্গালী মুসলমানের রক্তের কোন পার্থক্য নাই ঠিকই, কিন্তু বাঙালি মুসলমান সেটেলাররা যেভাবে রাষ্ট্রীয়যন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ে রক্ত ঝরিয়েছে- ধারাবাহিক এথনিক ক্লিনজিং চালিয়ে যাচ্ছে- তারই মরিয়া প্রতিরোধ সংগ্রামে বাঙালি মুসলমানের যখন রক্ত ঝরে- উভয়পক্ষকে সমান দোষী বলা কি সাজে? একজন বীরশ্রেষ্ঠের রক্তের সাথে গোলাম আজমের রক্তের কোন পার্থক্য নাই -এইটা যেইরকম সত্যি, তেমনি তার চাইতেও বড় সত্যি হচ্ছে- রক্তটা ঝরেছে ঐ বীরশ্রেষ্ঠেরই, গোলাম আজমের না! আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর প্রতিরোধ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হওয়া পাক হানাদারদের রক্তের মধ্যেও নিশ্চয়ই কোন পার্থক্য নেই, কিন্তু কোন মৃত্যুকে স্মরণ করি, গ্লোরিফাই করি?
একইভাবে, কোন সন্দেহ নাই যে, অভজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় কিংবা বেঁচে ফেরা আসিফ মহিউদ্দিন, আহমেদুর রশিদ টুটুল-এর রক্ত আর হেফাজত কর্মীদের রক্ত একদম এক, কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু, সেই সাথে এইটাও সত্য যে- হেফাজতরা অভিজিৎ - আসিফদের রক্ত ঝরাতে চেয়েছে, রক্ত ঝরাতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে, এখনো জীবিত অভিজিৎ- অনন্তদের রক্ত ঝরাতে চায়; অন্যদিকে অভিজিৎ, অনন্ত, আসিফ, টুটুলরা কোনদিনই হেফাজত কর্মীদের রক্ত চায়নি, বরং হেফাজতের ব্রেইন ওয়াশড শিশুদের যেভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটায় উদ্বিগ্ন হয়েছে। নাস্তিকদের ফাঁসীর দাবিসহ ১৩ দফা দাবিতে হেফাজত শাপলা চত্বরে এসে যেভাবে দখল নিয়েছিলো- যে তাণ্ডব শুরু করেছিলো- রাষ্ট্রযন্ত্র সেই অরাজক অবস্থা কাটিয়ে উঠুক- এই প্রত্যাশা থাকলেও- হেফাজত কর্মীর রক্ত কেউই বস্তুত প্রত্যাশা করেনি। পিনাকি - মাহমুদুর - বাবুনগরীদের হাজার হাজার হেফাজতী লাশের গল্পের প্রমাণ চেয়েছে ঠিকই- কিন্তু যে কজন হেফাজতী কর্মী ঢাকায় লাশ হয়েছিলেন- তাতে কেউই আনন্দ প্রকাশ করেনি; বরং প্রতিবাদই জানিয়েছিলো ... ! অভিজিৎ কিংবা একজন হেফাজৎ কর্মীর রক্তের অবশ্যই কোন পার্থক্য নাই- এই অর্থে পার্থক্য নাই যে, কারোরই অস্বাভাবিক মৃত্যু হোক আমরা চাই না। কিন্তু, তাই বলে কি মৃত্যুতে মৃত্যুতে কি কোন পার্থক্য নেই? সব মৃত্যুই কি সমান? একজন নিরীহ নাগরিককে স্রেফ ভিন্নচিন্তা প্রকাশের দায়ে মেরে ফেলা আর খুন ও ধ্বংসের নেশায় উন্মত্তদের হাত থেকে নিরীহ-আতংকিত-আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জানমাল রক্ষায় ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে মেরে ফেলা- দুটো কি এক? কোন সন্দেহ নাই- অভিজিৎ রায় আর হেফাজত কর্মীর রক্তের কোন পার্থক্য নেই, কোন সুস্থ বুদ্ধির মানুষ আরেকজন মানুষের রক্ত কামনা করতে পারে না- তা সে হেফাজত-কর্মীর বেঁচে থাকার দাবি তোলা অভিজিৎ রায় হোক কিংবা অভিজিৎ রায়ের ফাঁসীর দাবি তোলা একজন হেফাজত কর্মীই হোক! কিন্তু,'কুলাঙ্গার নাস্তিক ব্লগার'দের ফাঁসীর দাবিতে মারা যাওয়া (আসল এবং নকল) হেফাজত কর্মীদের রক্তকে শহীদের রক্তের মর্যাদা দেয়া হেফাজতকে কি পিনাকি, কিংবা নাদিয়া - এই আলাপ শুনাতে গিয়েছে, বা যাচ্ছে?
আর, পিনাকির সেই আলাপ উত্থাপনের জায়গা ছিল কি? অভিজিৎ রায় সহ মুক্তমনা ব্লগারদের খুনের বিরুদ্ধে যারা বলছে- তারা কেন একই সাথে হেফাজতকর্মীদের খুনের বিরুদ্ধে কথা বলছে না- এমন প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য কি বলে নাদিয়ার মনে হয়? হেফাজতকর্মী সহ দেশের (কিংবা দুনিয়ার) যেকোন খুনের বিরুদ্ধেই মুক্তমনারা কথা বলে। কিন্তু নির্যাতিত, নিপীড়িত, প্রান্তিক, দুর্বল, জীবন নাশের আশংকা আছে- এরকম গোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়ালে, তাদের বিরুদ্ধে যাবতীয় নির্যাতন, খুনের প্রতিবাদ করলে- অন্য আরেকটি প্রসঙ্গ টেনে আনার উদ্দেশ্যই বস্তুত থাকে, আলোচ্য প্রতিবাদকে একটু খেলো করে দেখানো ...। হেফাজতকর্মী সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের কল্লার দাম কেউ ঘোষণা করেনি- তাদের ফাঁসীর দাবিতে মিছিল সমাবেশও হয়নি, সরকারের তরফ থেকে হেফাজতের উদ্দেশ্যে নানারকম প্রণোদনা- উপঢৌকন অব্যাহত আছে; এইরকম বাস্তবতায় যাদের প্রাণের আশংকা আছে, যারা প্রান্তিক ও নির্যাতিত- নাস্তিকরা, আদিবাসীরা, হিন্দুরা- তাদের উপরে হামলা, আক্রমণের প্রতিবাদ করা হলে- প্রতিক্ষেত্রেই কি সংখ্যাগরিষ্ঠ, ক্ষমতাশালীদেরও কথা আলাদা মেনশন করতে হবে?
আচ্ছা, উল্টোদিক দিয়ে উদাহরণ দেয়া যাক। পিনাকি যে কাজটা করেছে, আবরার হত্যার পরে- ঠিক একই কাজটি করে গিয়েছে - আওয়ামী চামচাদের দল। "পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া আবরার হত্যা নিয়া এত চিল্লাফাল্লা, কিন্তু একই সময়ে যে আরেকটা হিন্দু ছাত্র খুন হলো- সেই ব্যাপারে কোন কথা নাই কেন?" "বাপ-চাচার হাতে নির্মম খুনের শিশুটিকে নিয়ে কই একটা মানব বন্ধনও হইলো না?" কিংবা "এই বুয়েটেই জামাতের হাতে বুয়েট ছাত্র মারা যাওয়ার পরেও তো কিছু হয় নাই" ... ইত্যাদি ইত্যাদি কইয়া- সিলেকটিভ মানবতাবাদীদের নিয়া কয়েকটা গালি ... ! আমি অন্য খুনগুলো নিয়ে বিচলিত, বিমর্ষ, মানসিকভাবে অসুস্থবোধ করলেও- কেবল আবরার খুন নিয়ে যাবতীয় এক্টিভিজম চালিয়েছি, এই কারণে না যে- বুয়েটের "মেধাবী" ছাত্র আবরারের রক্তের মর্যাদা আমার কাছে অন্যদের রক্তের চাইতে বেশি; বরং এই কারণ যে- বুয়েটের হত্যাকাণ্ডটি সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের নিরীহ ছাত্রের উপরে শক্তি প্রদর্শনের বহিপ্রকাশ- যা বুয়েটের মত শিক্ষায়তনগুলোতে খুবই নিয়মিত চর্চা হয়ে দাড়িয়েছিলো বলে এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্যেই একটা শক্ত আন্দোলনের দরকার। অন্য ক্ষেত্রে- অপরাধী বাবা-চাচারা এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে, শক্তি সামর্থ্যের দিক দিয়ে খুনীরা নিজেরাই একদম প্রান্তিক অবস্থানে, তার উপরে গোটা দেশের ঘৃণার পাত্র (এই ঘটনায় অসুস্থবোধ হয়, কিন্তু আন্দোলন করবো কার বিরুদ্ধে?)- আর অন্য ঘটনায় খুনের মোটিভ, খুনী- এসব কিছুই উদঘাটিত হয়নি ... ! যাই হোক, আবরারকে নিয়ে কথা বললেও কেন তুহিন মিয়া বা শাওন ভট্টাচার্যকে নিয়া কথা বলছি না- এই প্রশ্নের উদ্দেশ্য আবরার, তুহিন মিয়া বা শাওন ভট্টাচার্যের রক্তের পার্থক্য দূর করা নয়, বরং আবরার খুনের ইস্যুটিকে হালকা করা চেষ্টা করা ...! - এই ব্যাপারে নাদিয়া (এবং পিনাকিও) খুব সম্ভবত দ্বিমত করবে না! একই কাজ কি পিনাকি করে নাই?
 
* এই লেখার শিরোনামটি নেয়া হয়েছে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান জন্মিলে মরিতে হবে গানটি থেকে। 
*** রাজধানী ঢাকায় গাড়িতে এক নারীকে ধর্ষণের চেষ্টাকালে ধর্ষক রনি হককে পাবলিক ধরে দুচার ঘা বসিয়েছিলো - সম্ভবত কাপড় চোপড়ও ছিড়ে ফেলছিলো এবং সেটা ভিডিও করে গর্বভরে ফেসবুকে ছেড়েছিলো। সেই ঘটনায় অনেক নাস্তিক বন্ধুদের ধর্ষককে গণপিটুনির পক্ষে ওকালতি করতে দেখেছিলাম। ধর্ষককে গণপিটুনির বিরোধিতা করতে গিয়ে কয়েকজন তো ব্লকও করে দিয়েছিলো। সে যাই হোক- এই ব্যাপারে নাদিয়া যে কথাটি বলেছে- তার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। এমনকি শিশু ধর্ষক হলেও- তারে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলা যাবে না। কিন্তু, ঐ ঘটনায় নাদিয়া সহ একটা অংশ, যারা গণপিটুনির বিরোধিতা করছিলো, কি অদ্ভুত কারণে যেন- ধর্ষণের শিকার নারীর বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছিলো, ঐ মেয়েটি কেন গাড়ীতে লিফট চাইলো- মেয়েটি সত্য বলেছে তার প্রমাণ কি, ঢাকায় কোন শ্রেণির মেয়ে এমন অপরিচিত লোকের গাড়িতে উঠে, গাড়িতে ঢাকা শহরে ধর্ষণ করা যায় কি না, রনি যে ধর্ষক- তার প্রমাণ কি, আদালতে প্রমাণের আগে- রনিকে ধর্ষক বলা যাবে কি না ... ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ... ধর্ষককে আদালতে সোপর্দ করা উপস্থিত জনতার দুচার ঘা দেয়াকে সমর্থন করি না, কিন্তু তার চাইতেও অনেক নিন্দনীয় কাজ হচ্ছে- এভাবে ভিক্টিমকেই কাঠগড়ায় দাড় করানো ...
 
[ফেসবুক থেকে]

কোন মন্তব্য নেই: