মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৯

"ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের শক্তিশালী ভূমিকা রাখা কর্তব্য" প্রসঙ্গে

প্রথমত, ইসলাম বিদ্বেষ আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত - এই কথাগুলো ব্যবহারেও সাবধান থাকা দরকার, কেননা- এগুলোই ক্রমাগত নাস্তিকদের ডেমোনাইজ করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটেই হেফাজতের ফাঁসির দাবি, ব্লগার খুন, গ্রেফতার- মামলা এসব চলছে ...
দ্বিতীয়ত, নাস্তিকদের ইসলাম বিদ্বেষ তথা ধর্ম বিদ্বেষ বনাম ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মের সমালোচনা তথা ঈশ্বর সংক্রান্ত দার্শনিক বা জীবনের উদ্ভব ও বিবর্তন সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক আলোচনা- এই দুইয়ের ফাইন লাইন তৈরি করবেন কিভাবে? কে ঠিক করে দিবে কোনটা বিদ্বেষ আর কোনটা বিদ্বেষ না?
তৃতীয়ত, যে নাস্তিকদের উদ্দেশ্যে এই পরামর্শ স্ট্যাটাসটি পয়দা করেছেন- তারা কারা? নিশ্চিতভাবেই ইসলাম বিদ্বেষ বলতে এখানে নাস্তিকদের ইসলাম বিদ্বেষই বুঝিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের ইসলাম বিদ্বেষ বুঝাননি! তার মানে যেটা বুঝতে পারছি, নাস্তিকদের মধ্যে যাদের আলাপে - লেখাপত্রে - বক্তব্যে ইসলাম বিদ্বেষ প্রকাশ পায় (বলে আপনার/ আপনাদের মনে হয়), তাদের বিরুদ্ধে যাদের লেখাপত্র, বক্তব্যে ইসলাম বিদ্বেষ থাকে না তাদেরকে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার কথা বলছেন, তাই তো? কিন্তু সেই ভূমিকা তারা কেনই বা রাখবে? মানে, শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে কেন? নাস্তিকতা কি কোন সমস্বত্ব বডি? বা কোন সংগঠন? যার বিশেষ বা সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ উদ্দেশ্য বিধেয় আছে? নাকি, নাস্তিকরা সিম্পলি ইনডিভিজুয়াল ব্যক্তি মাত্র? তাহলে, যার যা অবস্থান, ভাবনা, মতাদর্শ, রুচি, আদর্শ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অভ্যস্থতা, সক্ষমতা - এসব অনুযায়িই কি আলাদা আলাদা অবস্থান রাখতে পারে না? সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? যেকোন নাস্তিক অন্য নাস্তিকের সাথে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মতবিরোধ, তর্ক-বিতর্ক করতেই পারে, কিন্তু এক প্রকার নাস্তিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াটা অন্য প্রকার নাস্তিকের জন্যে "কর্তব্য" হতে পারে কি?
চতুর্থত, আমাদের দেশটায় ইসলাম বিদ্বেষ বলে যা কিছু দেখেন (আপনার ভাষায় যদি ধরেও নেই), তার হাজার গুণ বেশি পাবেন হিন্দু বিদ্বেষ! মুসলমানের বাচ্চা হয়েও কেবল "হিন্দুয়ানি" নামের জন্যে (বাংলা নাম) সেই বাচ্চাকালে প্রচুর বুলিইং এর শিকার হয়েছি! তাহলে চিন্তা করে দেখেন, একেকটা হিন্দুর বাচ্চার কি অবস্থাটা হয়! প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারের ঘরের সামনে গরুর হাড্ডি ফেলে রাখতে দেখছি, আমার মুসলমান আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন- অনেক জায়গাতেই দেখেছি, "হিন্দু" শব্দটাই যেনবা গালির সমার্থক! স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও হিন্দু ধর্মের প্রতি তাচ্ছিল্য করা লেকচার শুনছি! মসজিদের খুতবায়- ওয়াজগুলোতে ইহুদি-নাসারাদের চাইতেও ঘৃণা ছড়ানো হয় সবচাইতে বেশি- নারী ও হিন্দুর বিরুদ্ধে! শুধু হিন্দু কেন, এদেশে একদম নিরীহ প্রান্তিক আদিবাসীদের বিরুদ্ধেও বিদ্বেষ ভয়ংকর রকম বেশি! এই বিদ্বেষ কেবল কথায়, লেখায়, ওয়াজেই সীমাবদ্ধতা থাকে না, একদম সরাসরি আক্রমণেও চলে যায়, পাহাড়ে যুগ যুগ ধরে চলছে ইথনিক ক্লিনজিং! সমতলের আদিবাসীদেরও জায়গা - জমি থেকে শুরু সংস্কৃতি-ঐতিহ্য দখল সমানতালে চলছে। অথচ, আমাদের দেশে ইসলাম বিদ্বেষ কথাটা যত মার্কেট পেয়েছে, "হিন্দু বিদ্বেষ", "আদিবাসী বিদ্বেষ" নিয়ে কেউ কথা বলেনি! এমন শব্দ বন্ধ তো চোখে পড়ে না - "সংখ্যালঘু আক্রমণ", "সাম্প্রদায়িক হামলা" (অনেক সময়ে তো হামলা/ আক্রমণও উল্লেখ না করে জাতীয় মিডিয়ায় "দাঙ্গা"-"হাঙ্গামা"ও বলে দেয়া হয়)! এসব শব্দ ও শব্দবন্ধ বলা হয়, কিন্তু "হিন্দু বিদ্বেষ", "আদিবাসী বিদ্বেষ", "পাহাড়ি বিদ্বেষ" - তো কেউ কোথাও কোন কালে ব্যবহার করলো না! সেই "হিন্দু বিদেষ", "আদিবাসী বিদ্বেষ", "নাস্তিক বিদ্বেষ" এর বিরুদ্ধে মুমিন-মুসলিমদের শক্তিশালী ভূমিকা রাখা বিষয়ক কোন উপদেশ পরামর্শও দিলেন না আপনারা! কারণ কি?
পঞ্চমত, ইসলাম বিদ্বেষ বা ধরেন যেকোন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ কিভাবে বর্ণবাদ হয়? কিংবা আইডিওলজির প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষকে কি কোনভাবে বর্ণবাদী রাজনীতির আইডিওলজি হিসেবে বলা যেতে পারে? ইসলাম তো একটা আইডিওলজি। দর্শন, কিংবা ইসলামের ভাষাতে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান! এখন, আমাকে বলেন- একটা আইডিওলজির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ থাকলে অসুবিধেটা কোথায়? বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আপনার যদি বিদ্বেষ থাকে, তাহলে বর্ণবাদী আইডিওলজিগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ থাকতে কি পারে না? ধর্মগুলোই কি বর্ণবাদী নয়? কেবল নিজেদের অনুসারীকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, বাকিদের নিচুসারির, পাপিষ্ঠ বলে মনে করে! হ্যাঁ, আপনি বলতে পারেন- কোন ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে তার জন্মগত ভাবে পাওয়া ধর্মের আইডিওলজিকাল জায়গা ধরে ডেমোনাইজ করা, একটা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে ঘৃণা করা, সেই ধর্মের কোন অংশের অপরাধকে সমস্ত ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর উপরে চাপিয়ে দেওয়া- এসবকেই বর্ণবাদী বলতে পারেন, আমিও বলি। যেভাবে, হিন্দু বিদ্বেষ, ইহুদী বিদ্বেষ- এগুলো বর্ণবাদ (সেই বর্ণবাদ ইসলাম ধর্মের পাতায় পাতায় পাওয়া যাবে), একই ভাবে মুসলিম বিদ্বেষকে বর্ণবাদ বলতেই পারেন। কিন্তু, ধর্মকে নিয়ে, তথা ধর্মীয় চিন্তা - দর্শন - রাজনীতির প্রতি বিদ্বেষকে কি বর্ণবাদ বলা যায়? তাহলে, ইসলাম বিদ্বেষ কিভাবে বর্ণবাদী আচরণ হয়, কিভাবে এটা অপরাধ? ইহুদী বিদ্বেষ বর্ণবাদ হলেও, জাওনিজমের প্রতি বিদ্বেষ কি বর্ণবাদ? আপনিও যে দিনরাত হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ - ঘৃণা পোষণ করেন ও ছড়ান, সেই হিন্দুত্ববাদ বিদ্বেষ কি বর্ণবাদ? সেটাকে কি হিন্দুবিদ্বেষ হিসেবে উপস্থাপন করে হিন্দুত্ববাদ বিরুদ্ধতা ও বিদ্বেষের পথ পরিহারের আহবান জানালে, আপনারা শুনবেন?
ষষ্ঠত, আচ্ছা, নাস্তিকদের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষকে কি বর্ণবাদ বলা যাবে? সেটা নিয়ে আপনাদের পরামর্শ কি? আপনিও যখন নাস্তিকদেরকে (এবং বামপন্থীদের নিয়ে) জেনারালাইজ করে "বিদ্বেষ" ছড়ান বা "সমালোচনা" করেন, সেটাকে বর্ণবাদ বলা যাবে কি? কোন নাস্তিক বিশেষের, কোন বাম নেতার/ কর্মীর/ ফেসবুকারের কাজ/ আলাপকে জেনারালাইজ করে যখন নাস্তিকদের/ বামদেরকেই ওভারল একহাত দেখে নেন সেটা কোন পর্যায়ে পড়ে?
সপ্তমত, বিজেপি-আরএসএস এর রাজনীতিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ কিংবা হেফাজতি-জামাতি রাজনীতিতে হেন্দু- খৃস্টানদের নিয়ে যে ঘৃণা, নাজীদের রাজনীতিতে ইহুদীদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা- তার সাথে এই ধর্মীয় আইডিওলজিগুলোর (যেখান থেকে আরএসএস-হেফাজতি-নাজীদের পয়দা হয়) প্রতি নাস্তিকদের ঘৃণাকে এক করে দেখা কি যায়? কবে, কোথায়, কিভাবে বিভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের মৌখিক বা লিখিত বিরোধিতা ও সমালোচনা (আপনাদের ভাষায় বিদ্বেষ) ঐরকম বর্ণবাদী-ঘৃণাবাদী রাজনীতিতে ব্যবহৃত হয়, হয়েছে- উদাহরণ দেন! বরং, দুনিয়ায় যুগে যুগে- এই নাস্তিকরাই এমন ঘৃণাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, সেসব ঘৃণার হাত থেকে নির্যাতিত- নিপীড়িত- ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর পক্ষে সোচ্চার থাকতেও কোনদিন পিছপা হয়নি, যতই তাদের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ থাকুক! নয় কি?
 
[ব্লগার পারভেজ আলমের আহবান "ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের শক্তিশালী ভূমিকা রাখা কর্তব্য" এর জবাবে লেখা ফেসবুক পোস্ট থেকে।] 

কোন মন্তব্য নেই: