মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৯

'সব মরণ নয় সমান'*

জনপ্রিয় নারীবাদী ফেসবুকার, ব্লগার, লেখক নাদিয়া ইসলাম বলেছেন,

"পিনাকী ভট্টাচার্যরা যদি কন, অভিজিতের রক্ত আর হেফাজতের একজন কর্মীর রক্তে কোনো পার্থক্য নাই, উনাদের শরীর বারুদের বস্তার মত জ্বইলা উঠে। পিনাকীর সাথে আমার রাজনৈতিক দ্বিমত আছে একশবার, কিন্তু উনার এই কথার সাথে আমি একমত। আমি অভিজিতের রক্তের সাথে হেফাজতের একজন কর্মীর রক্ত, একজন হিটলারের রক্তের সাথে একজন এ্যানি ফ্রাংকের রক্তের, ইদি আমিনের রক্তের সাথে মাদার তেরেসার রক্তের, আদিবাসী একজন পাহাড়ির রক্তের সাথে বাঙ্গালী মুসলমানের রক্তের, একজন আসিফ মহিউদ্দীনের রক্তের সাথে গোলাম আজমের রক্তের পার্থক্য দেখি না। একজন মাদার তেরেসার সাথে একজন হিটলারের পার্থক্য তার কাজে। একজন কাদের মোল্লার সাথে একজন বীরশ্রেষ্ঠের পার্থক্য তার কাজে। তার রক্তে না"। 
নাদিয়ার মত আমিও বিশ্বাস করি, দুনিয়ার কোন মানুষেরই "অন্যায্য"ভাবে হত্যার অধিকার পৃথিবীর দ্বিতীয় মানুষের নাই, রাষ্ট্রেরও নাই; এমনকি সেই মানুষ যদি ভয়ংকর ঘৃণা থেকে ছয় মিলিয়ন মানুষরে নির্বিচারে হত্যা করে, তারপরেও সেই সেই মানুষরে বিনা বিচারে হত্যা করা যায় না; এমনকি সেই মানুষ একজন শিশু ধর্ষকও হন, তারপরেও উনারে রাস্তাঘাটে বিনা বিচারে পিটায়ে মাইরা ফেলা যায় না; এমনকি সেই মানুষ ইয়াবা ব্যবসায়ী বা ভয়ানক সন্ত্রাসীও হন, তারপরেও উনারে ক্রসফায়ারে মেরে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়া যায় না ...। আমার ধারণা, দুনিয়ার যেকোন মানবতাবাদী ব্যক্তির বিশ্বাস এ থেকে আলাদা হওয়ার কথা না! এমনকি- যাদের 'শরীর বারুদের বস্তার মত জ্বইলা উঠে' উল্লেখ করে এগুলো লেখা হলো- তাদের বিশ্বাসও ভিন্নরকম নয় বলেই আমার ধারণা, অন্তত আমি সাধারণভাবে তেমনটি দেখিনি (এক ধর্ষককে গণপিটুনির ঘটনা বাদে)! বরং এদের কাউকে কাউকে দেখেছি- "ন্যায্য"ভাবে কিংবা "যথাযথ বিচার" প্রকৃয়ার মাধ্যমেও একজনকে হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার! যাই হোক, প্রতিটা মানুষের রক্তের মূল্য তথা জীবনের মূল্য যে সমান- এ ব্যাপারে নাদিয়ার সাথে কোনই দ্বিমত নেই! কিন্তু, মুশকিলটা হচ্ছে- নাদিয়াকে এই বেসিক ও প্রাইমারি মানবিক অবস্থানটা নেয়ার জন্যেও পিনাকীর উপরে সওয়ার হতে হচ্ছে। পিনাকীর সাম্প্রদায়িক অবস্থান, স্ববিরোধিতা, রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে- কেবল একটি লাইনকে সামনে এনে তার সাথে একমত দেখানো আর পিনাকির পুরা রাজনৈতিক অবস্থানের বিরুদ্ধাচরণকে ঐ একটা মহান মানবিক লাইনের বিরুদ্ধাচরণ হিসেবে দেখানোকেও (শরীর বারুদ বস্তার মত জ্বইলা উঠে) বুদ্ধি-জৈবিক অসততা কওয়া যায় কি?
সোজা হিসাব কিছু দেখা যাইতে পারে- নাদিয়ার দেয়া কনট্রাস্টগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। একজন হিটলারের রক্তের সাথে একজন আনা ফ্রাংকের রক্তের কোন পার্থক্য নাই সত্যি- কিন্তু সেই সাথে এইটাও সত্য যে হিটলার যেমনে ১৫ বছরের কিশোরি আনা ফ্রাঙ্কের মত লাখ লাখ ইহুদির রক্তের কারণ হয়েছিলো- হিটলারের রক্ত কিন্তু অন্য কেউই ঝরায়নি! আদিবাসী একজন পাহাড়ির রক্তের সাথে বাঙ্গালী মুসলমানের রক্তের কোন পার্থক্য নাই ঠিকই, কিন্তু বাঙালি মুসলমান সেটেলাররা যেভাবে রাষ্ট্রীয়যন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পাহাড়ে রক্ত ঝরিয়েছে- ধারাবাহিক এথনিক ক্লিনজিং চালিয়ে যাচ্ছে- তারই মরিয়া প্রতিরোধ সংগ্রামে বাঙালি মুসলমানের যখন রক্ত ঝরে- উভয়পক্ষকে সমান দোষী বলা কি সাজে? একজন বীরশ্রেষ্ঠের রক্তের সাথে গোলাম আজমের রক্তের কোন পার্থক্য নাই -এইটা যেইরকম সত্যি, তেমনি তার চাইতেও বড় সত্যি হচ্ছে- রক্তটা ঝরেছে ঐ বীরশ্রেষ্ঠেরই, গোলাম আজমের না! আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের রক্ত আর প্রতিরোধ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হওয়া পাক হানাদারদের রক্তের মধ্যেও নিশ্চয়ই কোন পার্থক্য নেই, কিন্তু কোন মৃত্যুকে স্মরণ করি, গ্লোরিফাই করি?
একইভাবে, কোন সন্দেহ নাই যে, অভজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় কিংবা বেঁচে ফেরা আসিফ মহিউদ্দিন, আহমেদুর রশিদ টুটুল-এর রক্ত আর হেফাজত কর্মীদের রক্ত একদম এক, কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু, সেই সাথে এইটাও সত্য যে- হেফাজতরা অভিজিৎ - আসিফদের রক্ত ঝরাতে চেয়েছে, রক্ত ঝরাতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে, এখনো জীবিত অভিজিৎ- অনন্তদের রক্ত ঝরাতে চায়; অন্যদিকে অভিজিৎ, অনন্ত, আসিফ, টুটুলরা কোনদিনই হেফাজত কর্মীদের রক্ত চায়নি, বরং হেফাজতের ব্রেইন ওয়াশড শিশুদের যেভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটায় উদ্বিগ্ন হয়েছে। নাস্তিকদের ফাঁসীর দাবিসহ ১৩ দফা দাবিতে হেফাজত শাপলা চত্বরে এসে যেভাবে দখল নিয়েছিলো- যে তাণ্ডব শুরু করেছিলো- রাষ্ট্রযন্ত্র সেই অরাজক অবস্থা কাটিয়ে উঠুক- এই প্রত্যাশা থাকলেও- হেফাজত কর্মীর রক্ত কেউই বস্তুত প্রত্যাশা করেনি। পিনাকি - মাহমুদুর - বাবুনগরীদের হাজার হাজার হেফাজতী লাশের গল্পের প্রমাণ চেয়েছে ঠিকই- কিন্তু যে কজন হেফাজতী কর্মী ঢাকায় লাশ হয়েছিলেন- তাতে কেউই আনন্দ প্রকাশ করেনি; বরং প্রতিবাদই জানিয়েছিলো ... ! অভিজিৎ কিংবা একজন হেফাজৎ কর্মীর রক্তের অবশ্যই কোন পার্থক্য নাই- এই অর্থে পার্থক্য নাই যে, কারোরই অস্বাভাবিক মৃত্যু হোক আমরা চাই না। কিন্তু, তাই বলে কি মৃত্যুতে মৃত্যুতে কি কোন পার্থক্য নেই? সব মৃত্যুই কি সমান? একজন নিরীহ নাগরিককে স্রেফ ভিন্নচিন্তা প্রকাশের দায়ে মেরে ফেলা আর খুন ও ধ্বংসের নেশায় উন্মত্তদের হাত থেকে নিরীহ-আতংকিত-আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জানমাল রক্ষায় ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে মেরে ফেলা- দুটো কি এক? কোন সন্দেহ নাই- অভিজিৎ রায় আর হেফাজত কর্মীর রক্তের কোন পার্থক্য নেই, কোন সুস্থ বুদ্ধির মানুষ আরেকজন মানুষের রক্ত কামনা করতে পারে না- তা সে হেফাজত-কর্মীর বেঁচে থাকার দাবি তোলা অভিজিৎ রায় হোক কিংবা অভিজিৎ রায়ের ফাঁসীর দাবি তোলা একজন হেফাজত কর্মীই হোক! কিন্তু,'কুলাঙ্গার নাস্তিক ব্লগার'দের ফাঁসীর দাবিতে মারা যাওয়া (আসল এবং নকল) হেফাজত কর্মীদের রক্তকে শহীদের রক্তের মর্যাদা দেয়া হেফাজতকে কি পিনাকি, কিংবা নাদিয়া - এই আলাপ শুনাতে গিয়েছে, বা যাচ্ছে?
আর, পিনাকির সেই আলাপ উত্থাপনের জায়গা ছিল কি? অভিজিৎ রায় সহ মুক্তমনা ব্লগারদের খুনের বিরুদ্ধে যারা বলছে- তারা কেন একই সাথে হেফাজতকর্মীদের খুনের বিরুদ্ধে কথা বলছে না- এমন প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য কি বলে নাদিয়ার মনে হয়? হেফাজতকর্মী সহ দেশের (কিংবা দুনিয়ার) যেকোন খুনের বিরুদ্ধেই মুক্তমনারা কথা বলে। কিন্তু নির্যাতিত, নিপীড়িত, প্রান্তিক, দুর্বল, জীবন নাশের আশংকা আছে- এরকম গোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়ালে, তাদের বিরুদ্ধে যাবতীয় নির্যাতন, খুনের প্রতিবাদ করলে- অন্য আরেকটি প্রসঙ্গ টেনে আনার উদ্দেশ্যই বস্তুত থাকে, আলোচ্য প্রতিবাদকে একটু খেলো করে দেখানো ...। হেফাজতকর্মী সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের কল্লার দাম কেউ ঘোষণা করেনি- তাদের ফাঁসীর দাবিতে মিছিল সমাবেশও হয়নি, সরকারের তরফ থেকে হেফাজতের উদ্দেশ্যে নানারকম প্রণোদনা- উপঢৌকন অব্যাহত আছে; এইরকম বাস্তবতায় যাদের প্রাণের আশংকা আছে, যারা প্রান্তিক ও নির্যাতিত- নাস্তিকরা, আদিবাসীরা, হিন্দুরা- তাদের উপরে হামলা, আক্রমণের প্রতিবাদ করা হলে- প্রতিক্ষেত্রেই কি সংখ্যাগরিষ্ঠ, ক্ষমতাশালীদেরও কথা আলাদা মেনশন করতে হবে?
আচ্ছা, উল্টোদিক দিয়ে উদাহরণ দেয়া যাক। পিনাকি যে কাজটা করেছে, আবরার হত্যার পরে- ঠিক একই কাজটি করে গিয়েছে - আওয়ামী চামচাদের দল। "পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া আবরার হত্যা নিয়া এত চিল্লাফাল্লা, কিন্তু একই সময়ে যে আরেকটা হিন্দু ছাত্র খুন হলো- সেই ব্যাপারে কোন কথা নাই কেন?" "বাপ-চাচার হাতে নির্মম খুনের শিশুটিকে নিয়ে কই একটা মানব বন্ধনও হইলো না?" কিংবা "এই বুয়েটেই জামাতের হাতে বুয়েট ছাত্র মারা যাওয়ার পরেও তো কিছু হয় নাই" ... ইত্যাদি ইত্যাদি কইয়া- সিলেকটিভ মানবতাবাদীদের নিয়া কয়েকটা গালি ... ! আমি অন্য খুনগুলো নিয়ে বিচলিত, বিমর্ষ, মানসিকভাবে অসুস্থবোধ করলেও- কেবল আবরার খুন নিয়ে যাবতীয় এক্টিভিজম চালিয়েছি, এই কারণে না যে- বুয়েটের "মেধাবী" ছাত্র আবরারের রক্তের মর্যাদা আমার কাছে অন্যদের রক্তের চাইতে বেশি; বরং এই কারণ যে- বুয়েটের হত্যাকাণ্ডটি সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের নিরীহ ছাত্রের উপরে শক্তি প্রদর্শনের বহিপ্রকাশ- যা বুয়েটের মত শিক্ষায়তনগুলোতে খুবই নিয়মিত চর্চা হয়ে দাড়িয়েছিলো বলে এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্যেই একটা শক্ত আন্দোলনের দরকার। অন্য ক্ষেত্রে- অপরাধী বাবা-চাচারা এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে, শক্তি সামর্থ্যের দিক দিয়ে খুনীরা নিজেরাই একদম প্রান্তিক অবস্থানে, তার উপরে গোটা দেশের ঘৃণার পাত্র (এই ঘটনায় অসুস্থবোধ হয়, কিন্তু আন্দোলন করবো কার বিরুদ্ধে?)- আর অন্য ঘটনায় খুনের মোটিভ, খুনী- এসব কিছুই উদঘাটিত হয়নি ... ! যাই হোক, আবরারকে নিয়ে কথা বললেও কেন তুহিন মিয়া বা শাওন ভট্টাচার্যকে নিয়া কথা বলছি না- এই প্রশ্নের উদ্দেশ্য আবরার, তুহিন মিয়া বা শাওন ভট্টাচার্যের রক্তের পার্থক্য দূর করা নয়, বরং আবরার খুনের ইস্যুটিকে হালকা করা চেষ্টা করা ...! - এই ব্যাপারে নাদিয়া (এবং পিনাকিও) খুব সম্ভবত দ্বিমত করবে না! একই কাজ কি পিনাকি করে নাই?
 
* এই লেখার শিরোনামটি নেয়া হয়েছে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান জন্মিলে মরিতে হবে গানটি থেকে। 
*** রাজধানী ঢাকায় গাড়িতে এক নারীকে ধর্ষণের চেষ্টাকালে ধর্ষক রনি হককে পাবলিক ধরে দুচার ঘা বসিয়েছিলো - সম্ভবত কাপড় চোপড়ও ছিড়ে ফেলছিলো এবং সেটা ভিডিও করে গর্বভরে ফেসবুকে ছেড়েছিলো। সেই ঘটনায় অনেক নাস্তিক বন্ধুদের ধর্ষককে গণপিটুনির পক্ষে ওকালতি করতে দেখেছিলাম। ধর্ষককে গণপিটুনির বিরোধিতা করতে গিয়ে কয়েকজন তো ব্লকও করে দিয়েছিলো। সে যাই হোক- এই ব্যাপারে নাদিয়া যে কথাটি বলেছে- তার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। এমনকি শিশু ধর্ষক হলেও- তারে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলা যাবে না। কিন্তু, ঐ ঘটনায় নাদিয়া সহ একটা অংশ, যারা গণপিটুনির বিরোধিতা করছিলো, কি অদ্ভুত কারণে যেন- ধর্ষণের শিকার নারীর বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছিলো, ঐ মেয়েটি কেন গাড়ীতে লিফট চাইলো- মেয়েটি সত্য বলেছে তার প্রমাণ কি, ঢাকায় কোন শ্রেণির মেয়ে এমন অপরিচিত লোকের গাড়িতে উঠে, গাড়িতে ঢাকা শহরে ধর্ষণ করা যায় কি না, রনি যে ধর্ষক- তার প্রমাণ কি, আদালতে প্রমাণের আগে- রনিকে ধর্ষক বলা যাবে কি না ... ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ... ধর্ষককে আদালতে সোপর্দ করা উপস্থিত জনতার দুচার ঘা দেয়াকে সমর্থন করি না, কিন্তু তার চাইতেও অনেক নিন্দনীয় কাজ হচ্ছে- এভাবে ভিক্টিমকেই কাঠগড়ায় দাড় করানো ...
 
[ফেসবুক থেকে]

বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯

"পপুলারিস্ট" নাস্তিকদের প্রতি স্বঘোষিত "সৃজনশীল" সেক্যুলারদের আপত্তি প্রসঙ্গে

বাংলাদেশের "পপুলারিস্ট" নাস্তিকদের চিন্তার ভুল দেখাতে গিয়ে প্রগতিশীল - সেক্যুলার - নারীবাদী হিসেবে পরিচয় দেয়া ফেসবুকার - ব্লগার দিলশান পারুল বলেছেন, "পপুলারিস্ট" নাস্তিকরা নাকি "ইতিহাসের সাথে অসততা করছেন", "নিজের মতো বিশ্লেষণ করার নামে তারা বিভিন্ন ভাবে তথ্য বিকৃত করেছেন"! তো, এই ইতিহাসের সাথে অসততা আর তথ্য বিকৃতির অভিযোগের পক্ষে ওনার যুক্তি কি? তিনি তাদের অসততার উদাহরণ দিয়েছেনঃ 

অসংখ্য জায়গায় তারা ("পপুলারিস্ট" নাস্তিকরা) মহানবী (সাঃ) কে সরাসরি ধর্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন, পেডোফাইল বলেছেন, বহুগামী বলছেন। 

আজকের নৈতিকতাকে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগের সমাজের উপরে চাপিয়ে সেই আমলের কাউকে পেডোফাইল, ধর্ষক বলা যায় কি না- এই প্রশ্নটার যৌক্তিকতা মেনে নিয়েও বলতে হচ্ছে, কোরান- হাদিস আর নবীর মৃত্যুর পরের তিন-চারশ বছরের মধ্যেই লেখা নবীর জীবনী এগুলোকে যদি ঐতিহাসিক টেক্সট হিসেবে গণ্য করা যায়, ঘটনা হিসেবে অনেক কিছুরই ঐতিহাসিক সত্যতা খুজে পাওয়া যাবে, সে হিসেবে আজকের নৈতিকতা দিয়ে অতীত ঘটনাকে বিচারের অভিযোগ করা যেতে পারে, কিন্তু ইতিহাস বিকৃতি বা ইতিহাসের সাথে অসততার অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন! বরং ইতিহাসের সেই অধ্যায়গুলোকে আড়াল করার চেষ্টার মধ্যেই ইতিহাসের সাথে অসততা বিরাজমান।

ইসলামের নবীর বহুবিবাহ'র তথ্য কবে কে অস্বীকার করতে পারবে? অনেকগুলো বিয়ে করেছেন তিনি, একসাথে সর্বোচ্চ ৯ জন স্ত্রীর কথা জানা যায়। যে সময়ে তিনি কোরানের আয়াতের মাধ্যমে চারের অধিক বিয়েকে নিষিদ্ধ করে সাহাবিদেরকে সর্বোচ্চ চার স্ত্রীকে রেখে তার অধিক স্ত্রী-কের তালাকে বাধ্য করলেন, সেই সময়েও নবীর নিজের ৯ জন স্ত্রী ছিল। এবং তাকে আরেকটি আয়াত নাজিল করিয়ে আগের বিধানটি যে কেবল ও কেবলমাত্র ইসলামের নবীর জন্যে প্রযোজ্য না- সেই মর্মে আরেক বিধান বানাতে হয়েছিলো! আর, এই বহুগামিতা তথা বহুবিবাহের প্রথাটি তো কেবল ১৪০০ বছর আগের নবীর জীবনীতে সীমাবদ্ধ নেই, বরং আজকের এই আধুনিক যুগে এসেও অনেক মুসলমান কোরআনকে দেখিয়ে চার বিয়ের বৈধতা দাবি করে! সেই সাথে, কোরআনে কৃতদাসী বা যুদ্ধে হস্তগত নারীর সাথে বিবাহ বহির্ভূতভাবেই মিলিত হওয়াকে বৈধতা দেয়া হয়েছে, সেই বিধান মোতাবেক নবী নিজে এবং তাঁর সাহাবীদের বৈধ স্ত্রী বাদেও অনেক দাসীও ছিল, যাদের সাথে বিবাহ সম্পর্ক বাদেই মিলিত হয়েছিলেন তারা। আর, সেই বিধান দেখিয়ে দাসীদের সাথে মিলিত হওয়ার অধিকার পায় খোদ নবীর দেশের ও আশপাশের দেশের মুসলমানরা, যার সরাসরি ভুক্তভোগি সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের দেশ থেকে যাওয়া অসংখ্য গৃহকর্মী নারী! ফলে, নবীকে এবং ইসলামের বিধানকে বহুবিবাহের জন্যে অভিযুক্ত করা হলে, সেটা কিভাবে ইতিহাসের সাথে অসততা হতে পারে?
 

১৪০০ বছর আগের নৈতিকতায় যখন বাল্যবিবাহ খুবই স্বাভাবিক, নৈমত্তিক ও সামাজিকভাবে খুবই গ্রহণযোগ্য-প্রচলিত প্রথা ছিল, তখন আজকের যুগের নৈতিকতা চাপিয়ে দিয়ে নবী মুহম্মদকে পেডোফাইল বলা যায় না- এমনটা আমিও মনে করি। কিন্তু তার মানে এই না যে, বিয়ের সময়ে আয়েশা নিতান্তই শিশু ছিলেন না! দিলশানা পারুল যুক্তি করেছেন, 

"ওই সময় যেহেতু জন্ম নিবন্ধীকরণ, মানে বার্থ সার্টিফিকেট বা ম্যারেজ সার্টিফিকেটের চল ছিলো না কাজেই বিবি আয়েশার প্রকৃত বয়স আসলে নিশ্চিত করে বলা যায়নি। এটা নিয়ে অনেক মুসলিম স্কলারের অনেক লিখা, কাউন্টার লিখা আছে"!

এমন খেলো যুক্তির মাধ্যমে ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টাকেই অসততা বলতে হয়। ঐ সময়ে বার্থ সার্টিফিকেট, ম্যারিজ সার্টিফিকেট না থাকার পরেও মুহম্মদ কত সালে জন্মিয়েছেন, কবে কত বছর বয়সে খাদিজাকে বিয়া করেছেন, বিয়ের সময়ে খাদিজার বয়স কত ছিল, মুহম্মদ কত বছর বয়সে ইসলাম প্রচার শুরু করেন, কত বছর বয়সে মারা গেলেন- এসবের কোন কিছু নিইয়েই কোন অনিশ্চয়তা নেই, আছে কেবল আয়শার বয়স নিয়ে? ব্যাপারটি খুব হাস্যকর হলো না? স্কলারদের মধ্যে যে মতবিরোধ, তা আসলে কি নিয়ে? বিয়ের বয়স নিয়ে, নাকি বাসর করেছেন কত বছর বয়সে, তা নিয়ে? হাদীসগুলোতে, সীরাত গ্রন্থে আয়েশার দুরকম বয়সের কথা উল্লেখ আছে- ৬ বছর আর ৯ বছর। ফলে, অনেক স্কলার ৬ বছরের পক্ষে মত দেন, অনেকে মত দেন ৯ বছরের পক্ষে। আর, একটা বড় অংশের স্কলাররা বলেন- মুহম্মদ আয়েশাকে বিয়ে করেন ৬ বছর বয়সে, কিন্তু বাসর করেন (মানে কনজুমেট করেন) আয়েশার বয়স যখন ৯ বছর। ৬, কিংবা ৯ বছরের শিশুকে বিয়ে করাটাকে বাল্যবিবাহই বলা হবে। ফলে, এখানেও ইতিহাসকে লুকানোর বা বিকৃত করার কিছু নেই। সমালোচনা করতে চাইলে- এতটুকুই করা যায়, সেই আমলের নৈতিকতা-মূল্যবোধে যে বাল্যবিবাহ খুব স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য প্রথা হিসেবে প্রচলিত, সেই প্রথাকে অপরাধ হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না!

১৪০০ বছর আগের নৈতিকতা অনুযায়ী নবী মুহম্মদকে ধর্ষক বলা যাবে কি না, আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু ইতিহাসের কথা যদি বলতে হয়, কে কবে এটা অস্বীকার করতে পারবে যে মুহম্মদের দুইজন স্ত্রী যুদ্ধ থেকে "হস্তগত" (গণিমতের মাল)? সাফিয়াকে বিয়ে করার আগে- সাফিয়ার গোত্রপ্রধান বাবা, সাফিয়ার স্বামী, সাফিয়ার পুরুষ আত্মীয় স্বজন- পাড়া প্রতিবেশী সহ পুরা গোত্রের সব পুরুষকে কচুকাঁটা করা হয়েছিলো! আর জুহারিয়াকে যুদ্ধ থেকে হস্তগত করার পরে জুহারিয়ার বাবা মুক্তিপন দিয়ে হলেও মেয়েকে ফেরত চেয়েছিলেন। ফেরত দেয়া হয়নি। ইসলামী স্কলার ইমাম কারযাভি এই বিয়েগুলোর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছিলেন, চাইলে নবী বিবাহ না করেও সাফিয়া ও জুহারিয়াকে ভোগ করতে পারতেন বা অন্য সাহাবীদের মাঝে বাটোয়ারা করে দিতে পারতেন (সে সময়ের প্রথা অনুযায়ী এবং ইসলামের বিধান মতে সেটায় কোন সমস্যাই হতো), কিন্তু সেটা না করে নবী তাদেরকে বিয়ে করে উম্মুল মুমিনিনের মর্যাদা দিয়েছিলেন! একজন নারী (সাফিয়া) তার বাবা, স্বামী, আত্মীয় স্বজন- সবাইকে চোখের সামনে খুন হতে দেখেছেন, তার পরে সেই খুনীদের সর্দারকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছেন, এটা তার জন্যে মর্যাদার, নাকি অত্যাচার সেই সময়ের লোকজনই বলতে পারবে! কিন্তু, উম্মুল মুমিনিনের "মর্যাদা"র গল্পের একটি প্রশ্নই মাথায় আসে - সাফিয়া ও জুহারিয়ার বরাত দিয়ে কেন একটা হাদীসও নেই? আবু বকর কন্যা আয়েশা, উমর কন্যা হাফসা কিংবা মুহম্মদের আত্মীয় যয়নবের যে মর্যাদা ছিল, তা কি সাফিয়া, জুহারিয়া, মারিয়াদের ছিল? এমনকি খাদিজার মৃত্যুর পরে সন্তানদের দেখভালের জন্যে বিয়ে করা একটু বয়স্ক স্ত্রী সওদারও কি সমান মর্যাদা ছিল, যাকে নবী তালাক দিতে চেয়েছিলেন, কেবল নিজের ভাগ আয়েশাকে দান করার মাধ্যমে তালাক আটকাতে পেরেছিলেন? যাই হোক, মূল আলাপে আসি! মুহম্মদকে ঐ সময়ের নৈতিকতা দিয়ে ধর্ষক বলা যাবে কি না আমি নিশ্চিত নই, কেননা কোরান-হাদিসে যে নৈতিকতা দেখি, সেখানে ধর্ষণ নামের কোন অপরাধ খুজে পাই না, সেই তুলনায় জেনা বা ব্যভিচার হচ্ছে বিশাল অপরাধ। কিন্তু, আজকের নৈতিকতায় যুদ্ধবন্দী নারীকে যৌনভাবে ভোগ করাকে ধর্ষণ কি বলা যাবে? কোরআনে যখন যুদ্ধবন্দী নারী ও কৃতদাসীর সাথে যৌনমিলনকে যখন জায়েজ করা হয়, যখন কোরান-হাদিস দেখিয়ে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি ও "মালাউন" নারীকে গণিমতের মাল হিসেবে ভোগ করা জায়েজ বলে জামাত ফতোয়া দেয়, আজকেও যখন আইএস কুর্দি নারীদের ধরে ধরে যৌনকাজে ব্যবহার করছে, তখন এসবকে কি "ধর্ষণ" বলা যাবে না?

দিলশানা পারুল "পপুলারিস্ট" নাস্তিকদের সমালোচনায় বলেছেনঃ 

"ধর্ম বা ধর্মীয় ইতিহাসের চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে এরা স্থান, কাল, পাত্র এই বিষয়টিকে সম্পূর্ণ এভয়েড করেছে" ... "আপনি কথা বলছেন ৬ শতকের ঘটনাবলী নিয়ে! ... ১৪০০ বছর আগের নীতি নৈতিকতার সংজ্ঞা আর আজকের নীতি নৈতিকতার সংজ্ঞা কখনই এক না, নীতিনৈতিকতা এমনই একটি সামাজিক ইন্ডিকেটর যেটা দেশে দেশে সময়ে সময়ে পাল্টায়" ... ইত্যাদি ইত্যাদি।  

আরেক স্বঘোষিত "জ্ঞানী-পণ্ডিত" ও "সৃজনশীল" নাস্তিক ব্লগার - ফেসবুকার - লেখক গোলাম সারওয়ার একই রকম যুক্তিতে তাচ্ছিল্য করে বলেছেনঃ 

এইসব নাস্তিকরা পড়ে আছে ৬ষ্ঠ, ৭ম শতকে ...!  

এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণই একমত যে, নীতি নৈতিকতার ধারণা আপেক্ষিক, সবই স্থানিক, কালিক, এবং সামাজিক। ফলে, ইতিহাসের পাঠে সচেতন থাকা দরকার, এক যুগের, এক সমাজের নৈতিকতার চশমা দিয়ে অন্য যুগের, সমাজের মানুষকে বিচার করতে গেলে- ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই কেবল বাড়ে, তারচেয়েও বড় কথা- ইতিহাসের চরিত্রকে ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক এইরকম বাইনারী জাজ করাটাও অনেক সময়ে ইতিহাস পাঠে অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়! কিন্তু "জ্ঞানী"-"সৃজনশীল" প্রগতিজীবীরা যেভাবে বলছেন, তথাকথিত "পপুলারিস্ট" নাস্তিকরা কি আসলে তেমনটাই করছেন? তারা কোন পরিপ্রেক্ষিতে ১৪০০ বছর আগের ব্যক্তিকে আজকের নৈতিকতা দিয়ে বিচার করছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতটা কি ওনারা জানেন না? কথিত "পপুলারিস্ট" নাস্তিকদের আলোচনার অভিমুখ কি সেইসব সেক্যুলার, প্রগতিশীল, নাস্তিক বা অজ্ঞেয়বাদী হিসেবে দাবি করা লেখক-পাঠকরা, যারা নবীকে একজন ১৪০০ বছর আগে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে মনে করে? নাকি সেইসব ধার্মিক ব্যক্তি, যারা নবী মুহম্মদকে কেবল ১৪০০ বছর আগের একজন মানুষ মনে করে না, বরং মুহম্মদকে সর্বকালের সর্বযুগের, সকল সমাজের মধ্যে সর্বসেরা মানুষ, আল্লাহর রাসুল, যেকোন রকম পাপ-অন্যায়-অপরাধের উর্ধ্বে থাকা একজন প্রেরিত মহাপুরুষ হিসেবে বিশ্বাস করে? তাহলে, সেইসব বিশ্বাসী ব্যক্তিদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধাচারণ করতে যদি কেউ বলেন, সর্বকালের- সর্বযুগের নৈতিকতার নিরিখে সেরা তো দূরের কথা, আজকের নৈতিকতা অনুযায়ীও নবী আদর্শ চরিত্র নন। মুহম্মদের মত আজ কেউ ৬ বা ৯ বছরের কন্যাশিশুকে বিয়ে করতে গেলে কিংবা আজ যদি মুহম্মদ নিজে সেই কাজটা করতে যান, তাকে পেডোফাইল ছাড়া আর কি বলা হবে? আজ কৃতদাসীকে, যুদ্ধবন্দীকে কিংবা শিশুকে ভোগ করতে চাইলে, তাকে কি ধর্ষক বলা হবে না? আজকের যুগে এসে নয় জন স্ত্রী নয়, দ্বিতীয় বিয়ে করতে গেলেও নবীকে যদি আগের স্ত্রী জুতার বাড়ি দিতে চায় তাতে কি খুব বেশী দোষ হবে? - এখন নাস্তিকরা এসব কথা যদি এই কারণে বলে যে, চারদিকের মুমিন ব্যক্তিরা যারা ১৪০০ বছর আগের আইডিওলজিকে সুপ্রিম হিসেবে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে ও প্রচার করে, তাদেরকে পাল্টা জবাব দিতেই এভাবে বলা; তবে কোনভাবে কি বলা যাবে যে, তারা আজকের নৈতিকতা ১৪০০ বছর আগের সমাজের উপরে চাপিয়ে দিচ্ছে?

হ্যাঁ, বাংলাদেশের ও দুনিয়ার নাস্তিকদের অনেকের সাথেই আমার বড় রকম মতভিন্নতা আছে। এমনকি নাস্তিকতা- মুক্তবুদ্ধি- মুক্তচিন্তা প্রসারের কর্মপদ্ধতি নিয়েও আমার অনেক ব্যাপারে অনেকের সাথেই দ্বিমত আছে, ভিন্নতা আছে। রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে যদি কথা বলতে যাই- তাইলে তো অনেকের সাথেই আমি একেবারেই ভিন্নমেরুতে অবস্থান করি। আসিফ মহিউদ্দিন, সুষুপ্ত পাঠক, তসলিমা নাসরিন শুধু নয়- অভিজিৎ রায়ের সাথেও অনেকবার তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলাম। স্যাম হারিসের মত ওয়ার অন টেররের সমর্থক নাস্তিককে মাথায় তুলে রাখার প্রয়োজন কোনদিন দেখিনি। রিচার্ড ডকিন্সের সাথেও সবসময় সব বিষয়ে একমত নই। এরকম দ্বিমত, ভিন্নমত, ভিন্নপন্থা যেকেউই যাকারোর সাথে করতেই পারে। কিন্তু, দ্বিমত, ভিন্নমত, ভিন্নপন্থার জন্যে কাউকে বা তাদের সমচিন্তার বা অনুসারি নাস্তিকদের গ্রুপবন্দী করে একটা নাম দিয়ে ট্যাগিং করে ডেমোনাইজ করা কেমন ধরণের প্রগতিশীলতা, কেমন ধরণের সৃজনশীলতা? চিন্তা-মত-পথকে তো চিন্তা দিয়েই পরাস্ত করতে হয়, নয় কি? কার কি শিক্ষাগত যোগ্যতা, কে কেমন ও কতটুকু সৃজনশীল, কোন বিষয় নিয়ে কে আগ্রহী হচ্ছে, সেগুলোর রুচি কি, ইত্যাদি ইত্যাদি - এসব আলাপ কি কোনদিন চিন্তাকে মোকাবেলা করার আলাপ হতে পারে? আর, সেখানে এসব স্বঘোষিত প্রগতিশীল-সৃজনশীল সেক্যুলাররা দলবেধে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নোংরা ও মিথ্যায় ভরপুর অভিযোগ আনছেন- যেগুলোর অধিকাংশই আসলে কোন অভিযোগই নয়, সিম্পলি আরেকজনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়া নোংরা গসিপিং! এসবের মধ্য দিয়ে বস্তুত তারা নিজেদেরকেই মানুষ হিসেবে নিচে নামিয়ে যাচ্ছেন, তা কি তারা বুঝতে পারছেন?

মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৯

"ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের শক্তিশালী ভূমিকা রাখা কর্তব্য" প্রসঙ্গে

প্রথমত, ইসলাম বিদ্বেষ আর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত - এই কথাগুলো ব্যবহারেও সাবধান থাকা দরকার, কেননা- এগুলোই ক্রমাগত নাস্তিকদের ডেমোনাইজ করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে হচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটেই হেফাজতের ফাঁসির দাবি, ব্লগার খুন, গ্রেফতার- মামলা এসব চলছে ...
দ্বিতীয়ত, নাস্তিকদের ইসলাম বিদ্বেষ তথা ধর্ম বিদ্বেষ বনাম ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মের সমালোচনা তথা ঈশ্বর সংক্রান্ত দার্শনিক বা জীবনের উদ্ভব ও বিবর্তন সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক আলোচনা- এই দুইয়ের ফাইন লাইন তৈরি করবেন কিভাবে? কে ঠিক করে দিবে কোনটা বিদ্বেষ আর কোনটা বিদ্বেষ না?
তৃতীয়ত, যে নাস্তিকদের উদ্দেশ্যে এই পরামর্শ স্ট্যাটাসটি পয়দা করেছেন- তারা কারা? নিশ্চিতভাবেই ইসলাম বিদ্বেষ বলতে এখানে নাস্তিকদের ইসলাম বিদ্বেষই বুঝিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের ইসলাম বিদ্বেষ বুঝাননি! তার মানে যেটা বুঝতে পারছি, নাস্তিকদের মধ্যে যাদের আলাপে - লেখাপত্রে - বক্তব্যে ইসলাম বিদ্বেষ প্রকাশ পায় (বলে আপনার/ আপনাদের মনে হয়), তাদের বিরুদ্ধে যাদের লেখাপত্র, বক্তব্যে ইসলাম বিদ্বেষ থাকে না তাদেরকে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার কথা বলছেন, তাই তো? কিন্তু সেই ভূমিকা তারা কেনই বা রাখবে? মানে, শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে কেন? নাস্তিকতা কি কোন সমস্বত্ব বডি? বা কোন সংগঠন? যার বিশেষ বা সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ উদ্দেশ্য বিধেয় আছে? নাকি, নাস্তিকরা সিম্পলি ইনডিভিজুয়াল ব্যক্তি মাত্র? তাহলে, যার যা অবস্থান, ভাবনা, মতাদর্শ, রুচি, আদর্শ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অভ্যস্থতা, সক্ষমতা - এসব অনুযায়িই কি আলাদা আলাদা অবস্থান রাখতে পারে না? সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? যেকোন নাস্তিক অন্য নাস্তিকের সাথে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মতবিরোধ, তর্ক-বিতর্ক করতেই পারে, কিন্তু এক প্রকার নাস্তিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াটা অন্য প্রকার নাস্তিকের জন্যে "কর্তব্য" হতে পারে কি?
চতুর্থত, আমাদের দেশটায় ইসলাম বিদ্বেষ বলে যা কিছু দেখেন (আপনার ভাষায় যদি ধরেও নেই), তার হাজার গুণ বেশি পাবেন হিন্দু বিদ্বেষ! মুসলমানের বাচ্চা হয়েও কেবল "হিন্দুয়ানি" নামের জন্যে (বাংলা নাম) সেই বাচ্চাকালে প্রচুর বুলিইং এর শিকার হয়েছি! তাহলে চিন্তা করে দেখেন, একেকটা হিন্দুর বাচ্চার কি অবস্থাটা হয়! প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারের ঘরের সামনে গরুর হাড্ডি ফেলে রাখতে দেখছি, আমার মুসলমান আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন- অনেক জায়গাতেই দেখেছি, "হিন্দু" শব্দটাই যেনবা গালির সমার্থক! স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও হিন্দু ধর্মের প্রতি তাচ্ছিল্য করা লেকচার শুনছি! মসজিদের খুতবায়- ওয়াজগুলোতে ইহুদি-নাসারাদের চাইতেও ঘৃণা ছড়ানো হয় সবচাইতে বেশি- নারী ও হিন্দুর বিরুদ্ধে! শুধু হিন্দু কেন, এদেশে একদম নিরীহ প্রান্তিক আদিবাসীদের বিরুদ্ধেও বিদ্বেষ ভয়ংকর রকম বেশি! এই বিদ্বেষ কেবল কথায়, লেখায়, ওয়াজেই সীমাবদ্ধতা থাকে না, একদম সরাসরি আক্রমণেও চলে যায়, পাহাড়ে যুগ যুগ ধরে চলছে ইথনিক ক্লিনজিং! সমতলের আদিবাসীদেরও জায়গা - জমি থেকে শুরু সংস্কৃতি-ঐতিহ্য দখল সমানতালে চলছে। অথচ, আমাদের দেশে ইসলাম বিদ্বেষ কথাটা যত মার্কেট পেয়েছে, "হিন্দু বিদ্বেষ", "আদিবাসী বিদ্বেষ" নিয়ে কেউ কথা বলেনি! এমন শব্দ বন্ধ তো চোখে পড়ে না - "সংখ্যালঘু আক্রমণ", "সাম্প্রদায়িক হামলা" (অনেক সময়ে তো হামলা/ আক্রমণও উল্লেখ না করে জাতীয় মিডিয়ায় "দাঙ্গা"-"হাঙ্গামা"ও বলে দেয়া হয়)! এসব শব্দ ও শব্দবন্ধ বলা হয়, কিন্তু "হিন্দু বিদ্বেষ", "আদিবাসী বিদ্বেষ", "পাহাড়ি বিদ্বেষ" - তো কেউ কোথাও কোন কালে ব্যবহার করলো না! সেই "হিন্দু বিদেষ", "আদিবাসী বিদ্বেষ", "নাস্তিক বিদ্বেষ" এর বিরুদ্ধে মুমিন-মুসলিমদের শক্তিশালী ভূমিকা রাখা বিষয়ক কোন উপদেশ পরামর্শও দিলেন না আপনারা! কারণ কি?
পঞ্চমত, ইসলাম বিদ্বেষ বা ধরেন যেকোন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ কিভাবে বর্ণবাদ হয়? কিংবা আইডিওলজির প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষকে কি কোনভাবে বর্ণবাদী রাজনীতির আইডিওলজি হিসেবে বলা যেতে পারে? ইসলাম তো একটা আইডিওলজি। দর্শন, কিংবা ইসলামের ভাষাতে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান! এখন, আমাকে বলেন- একটা আইডিওলজির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ থাকলে অসুবিধেটা কোথায়? বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আপনার যদি বিদ্বেষ থাকে, তাহলে বর্ণবাদী আইডিওলজিগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ থাকতে কি পারে না? ধর্মগুলোই কি বর্ণবাদী নয়? কেবল নিজেদের অনুসারীকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, বাকিদের নিচুসারির, পাপিষ্ঠ বলে মনে করে! হ্যাঁ, আপনি বলতে পারেন- কোন ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে তার জন্মগত ভাবে পাওয়া ধর্মের আইডিওলজিকাল জায়গা ধরে ডেমোনাইজ করা, একটা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে ঘৃণা করা, সেই ধর্মের কোন অংশের অপরাধকে সমস্ত ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর উপরে চাপিয়ে দেওয়া- এসবকেই বর্ণবাদী বলতে পারেন, আমিও বলি। যেভাবে, হিন্দু বিদ্বেষ, ইহুদী বিদ্বেষ- এগুলো বর্ণবাদ (সেই বর্ণবাদ ইসলাম ধর্মের পাতায় পাতায় পাওয়া যাবে), একই ভাবে মুসলিম বিদ্বেষকে বর্ণবাদ বলতেই পারেন। কিন্তু, ধর্মকে নিয়ে, তথা ধর্মীয় চিন্তা - দর্শন - রাজনীতির প্রতি বিদ্বেষকে কি বর্ণবাদ বলা যায়? তাহলে, ইসলাম বিদ্বেষ কিভাবে বর্ণবাদী আচরণ হয়, কিভাবে এটা অপরাধ? ইহুদী বিদ্বেষ বর্ণবাদ হলেও, জাওনিজমের প্রতি বিদ্বেষ কি বর্ণবাদ? আপনিও যে দিনরাত হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ - ঘৃণা পোষণ করেন ও ছড়ান, সেই হিন্দুত্ববাদ বিদ্বেষ কি বর্ণবাদ? সেটাকে কি হিন্দুবিদ্বেষ হিসেবে উপস্থাপন করে হিন্দুত্ববাদ বিরুদ্ধতা ও বিদ্বেষের পথ পরিহারের আহবান জানালে, আপনারা শুনবেন?
ষষ্ঠত, আচ্ছা, নাস্তিকদের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষকে কি বর্ণবাদ বলা যাবে? সেটা নিয়ে আপনাদের পরামর্শ কি? আপনিও যখন নাস্তিকদেরকে (এবং বামপন্থীদের নিয়ে) জেনারালাইজ করে "বিদ্বেষ" ছড়ান বা "সমালোচনা" করেন, সেটাকে বর্ণবাদ বলা যাবে কি? কোন নাস্তিক বিশেষের, কোন বাম নেতার/ কর্মীর/ ফেসবুকারের কাজ/ আলাপকে জেনারালাইজ করে যখন নাস্তিকদের/ বামদেরকেই ওভারল একহাত দেখে নেন সেটা কোন পর্যায়ে পড়ে?
সপ্তমত, বিজেপি-আরএসএস এর রাজনীতিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বিদ্বেষ কিংবা হেফাজতি-জামাতি রাজনীতিতে হেন্দু- খৃস্টানদের নিয়ে যে ঘৃণা, নাজীদের রাজনীতিতে ইহুদীদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা- তার সাথে এই ধর্মীয় আইডিওলজিগুলোর (যেখান থেকে আরএসএস-হেফাজতি-নাজীদের পয়দা হয়) প্রতি নাস্তিকদের ঘৃণাকে এক করে দেখা কি যায়? কবে, কোথায়, কিভাবে বিভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের মৌখিক বা লিখিত বিরোধিতা ও সমালোচনা (আপনাদের ভাষায় বিদ্বেষ) ঐরকম বর্ণবাদী-ঘৃণাবাদী রাজনীতিতে ব্যবহৃত হয়, হয়েছে- উদাহরণ দেন! বরং, দুনিয়ায় যুগে যুগে- এই নাস্তিকরাই এমন ঘৃণাবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, সেসব ঘৃণার হাত থেকে নির্যাতিত- নিপীড়িত- ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর পক্ষে সোচ্চার থাকতেও কোনদিন পিছপা হয়নি, যতই তাদের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ থাকুক! নয় কি?
 
[ব্লগার পারভেজ আলমের আহবান "ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নাস্তিকদের শক্তিশালী ভূমিকা রাখা কর্তব্য" এর জবাবে লেখা ফেসবুক পোস্ট থেকে।]