বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০২৪

সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের বানী, যুক্তি ও খণ্ডন

ইউরোপে ২২ বছর ধরে বাস করা ও কাজ করা ইউরোপীয় সংস্কৃতির গর্বে মহাগর্বিত নাস্তিক ব্লগার ওমর ফারুক লুক্স তাঁর ফেসবুক পোস্টে  গৌতম বুদ্ধের ২৪ টা দর্শন বা বিখ্যাত বাণী, যা তাঁর কাছে মনে হয়েছে এই আধুনিক সময়ে এসে ভুল, অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক, সেগুলোর একটি তালিকা করেছেন, এবং প্রতিটি বানীর নীচে যুক্তি দেয়ার চেস্টা করেছেন কেন তিনি গৌতম বুদ্ধের সেই বানীকে ভুল, অপ্রাসঙ্গিক বা অপ্রয়োজনীয় মনে করেন! একে তিনি গৌতম বুদ্ধের বানীগুলোর অগ্রপশ্চাৎ বাদ দিয়ে, মানে কোন প্রসঙ্গে গৌতম বুদ্ধ সেই কথাটা বলেছেন, কি বুঝাতে চেয়েছেন, আগে পরে কি বলেছেন- ইত্যাদির সব বাদ দিয়ে কেবল বানী চিরন্তনীর মত করে এক-দুই লাইনের বানীগুলো উপস্থাপন করেছেন, তারপরে সেগুলোর অংশবিশেষকে কিছু জাজমেন্টাল মন্তব্য ছুড়ে দিয়ে খণ্ডানোর চেস্টা করেছন, কখনো বা কৌতুক করেছে! আবার কিছু কিছু বানীর সাথে যখন একমত হয়েছেন, সেগুলোকে খণ্ডিয়েছেন এই বলে যে, দুনিয়ার মানুষ তা জানে, এর জন্যে বুদ্ধের দর্শন পড়ার দরকার হয় না! বুদ্ধের দর্শন না পড়েই দুনিয়ার মানুষ যদি সেটা জানেও, তাতে তো বুদ্ধের সেই বানীটা ভুল, অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় না! এছাড়া গৌতম বুদ্ধের বেশ কিছু বানীর জবাবে লুক্স বারেবারে বলেছেন, মন বলে নাকি কোন কিছু নেই! ফলে, বুদ্ধের ২৪ টি বানী নিয়ে লুক্সের যুক্তিগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়ার আগে "মানব মনের" অনস্তিত্বতার দাবিটি খতিয়ে দেখা দরকার।
 
 
মানুষের মন বলে কোন কিছুই কি নেই? 
মানুষের মন বলে কেন কিছু থাকবে না? মানুষের মনোজগৎ তৈরি হয় এবং তার সমস্ত ক্রিয়াকলাপই ঘটে মস্তিস্কে, তার মানে এই না যে, মন বলে কিছু থাকবে না, কল্পনা বলে কিছু নেই, চিন্তা - ভাবনা বলে কিছু নেই! তাহলে মন বা মাইন্ড - কি জিনিস? ব্রিটানিকার সংজ্ঞা অনুযায়ীঃ
"মাইণ্ড বা মন হচ্ছে একটা জটিল ক্ষেত্র বা ফ্যাকাল্টি যেখানে অনুধাবন (পারসিভিং), স্মরণ (রিমেমবারিং), মূল্যায়ন (ইভালুয়েটিং), বিবেচনা (কনসিডারিং), আর সিদ্ধান গ্রহণ (ডিসাইডিং) - এর কাজগুলো চলে। মন কিছু অর্থে সংবেদন (সেনসেশনস), উপলব্ধি (পারসেপশনস), আবেগ (ইমোশনস), স্মৃতি (মেমোরি), আকাঙ্ক্ষা (ডিজায়ার), বিভিন্ন ধরণের যুক্তি (রিজনিং), লক্ষ (মোটিভস), পছন্দ (চয়েস), ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য (ট্রেইটস অব পারসোনালিটি) এবং অচেতন (আনকনসাশনেস) -এর মতো ঘটনাগুলিতে প্রতিফলিত হয়"। 
তার মানে, মন হচ্ছে এমন একটা ভাবজগৎ, যেখানে অনেকগুলো কাজ চলতে থাকে। লুক্স যখন বলেন, মন বলে কিছু নেই, তখন তাঁর যুক্তি কি? একটাই যুক্তি এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, তা হচ্ছে - যেহেতু সমস্ত কাজই চলে মস্তিস্কে, ফলে মন বলে কিছু নেই! হ্যাঁ, মন বা মানুষের মানসিক জগতের পুরাটা, মানুষের আবেগ-অনুভূতি, স্মৃতি, চিন্তা-ভাবনা - সবকিছুর মূলে আছে তার মস্তিস্ক, তাই বলে কি বলা হবে যে, আবেগ - অনুভূতি, স্মৃতি, চিন্তা-ভাবনা এসব বলেও কিছু নেই? তা নিশ্চয় লুক্সও বলবেন না! বস্তুত এই আবেগ - অনুভূতি, স্মৃতি, চিন্তা-ভাবনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ - এই সবকিছুকে মিলিতভাবে বা ভার্চুয়াল পাটাতনটাকেই বলা হয় মন, যা প্রতিটি মানুষকে একটি ব্যক্তিসত্ত্বা দেয়! অর্থাৎ প্রতিটা মানুষের মাঝে "আমি" থাকে, যে আমি সিদ্ধান্ত নেয়, কাজ করে, চিন্তা করে - সেটাও আসলেই এই মানব মন। মানব মস্তিস্কই শরীরের প্রতিটা ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে ঠিকই, কিন্তু এই যে মানুষের ব্যক্তিসত্ত্বার এই "আমি" সচেতন কার্যপালনের নির্দেশগুলো দেয় মস্তিস্ককে। ছোট একটি উদাহরণ দেয়া যাক। আমরা আমাদের হাত নড়াই কিভাবে? মস্তিস্ক থেকে স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে এই নির্দেশনাটা যায় হাতের পেশীগুলোতে, সেই নির্দেশনা অনুযায়ী পেশীগুলো সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমে হাতের হাড়গুলোকে নড়াতে পারে। এখন, মস্তিস্ক হাতকে কোন নির্দেশনাটা দিবে, তা কিভাবে ঠিক হবে? মানে, আপনি এখন আপনার ডান হাতটি উপরে তুলবেন, নাকি নীচে নামাবেন, নাকি একপাশে চক্রাকারে ঘুরাতে থাকবেন, এটা কি মস্তিস্ক আপনা থেকে ঠিক করে? মস্তিস্ক অনেক সিদ্ধান্ত একা একা নেয়, যেমন আমাদের হৃৎপিণ্ডের পাম্পিং, আমাদের শরীরের রক্ত চলাচল, ফুসফুসের মাধ্যমে শ্বাসপ্রশ্বাস, এমন অসংখ্য কার্যকলাপ মস্তিস্ক একা একা করে, আমরা টেরও পাই। কিন্তু, সচেতনভাবে আমরা যা যা করি, মস্তিস্ক একা একা বা নিজে নিজে সেগুলো করে না, আমাদের মাঝের এই "আমি" সত্ত্বাটা মস্তিস্ককে সেই নির্দেশনাগুলো দেয়, মানে আমরা গান গাইবো - নাকি গালি দিবো, আমার হাত দিয়ে কাউকে আদর করবো নাকি সপাটে আঘাত করবো, এমন সচেতন যাবতীয় ক্রিয়াকলাপের নির্দেশনাটা মস্তিস্ক "মন" থেকে পাওয়ার পরে, মস্তিস্ক সেই নির্দেশনাটা স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অঙ্গের পেশীতে পাঠিয়ে কাজটি করিয়ে নেয়! মানুষের এই "ব্যক্তিসত্ত্বা" বা "আমি"টাও হচ্ছে মানব মনেরই একটা পার্ট বা অংশ!
 
অবশ্যই মানব মস্তিস্কের বিভিন্ন ফাংশনের ফলেই এই মনের তথা মানুষের মনোজগতের অস্তিত্ব। মানে, আমাদের মস্তিস্ক যাবতীয় সচেতন নির্দেশনা যেই "মন" থেকে পায়, সেই মনটাও মস্তিস্কেরই ক্রিয়াকলাপের ফল। মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা কোমায় মন কাজ করে না বা মনের কার্যকারিতা হারিয়ে যেতে পারে (যেমনঃ স্মৃতি নাই হতে পারে, চিন্তা করার ক্ষমতা নাই হয়ে যেতে পারে, চেতনা বা কনসাশনেস লোপ পেয়ে যেতে পারে), যদিও তখনও মস্তিস্ক থাকে। কিন্তু মস্তিস্ক বাদে মনের কোন অস্তিত্বই থাকা সম্ভব নয়। মস্তিস্ক বাদে যদি মনের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব না হয়, তাহলে সেটাকে আলাদাভাবে মন না বলে মস্তিস্ক বললে সমস্যা কোন জায়গায়, এমন প্রশ্ন করতে পারেন। সমস্যাটা হচ্ছে - মস্তিস্ক আর মন এক নয়, মস্তিস্ক বা ব্রেইন হচ্ছে কেবলই ফিজিকাল বস্তু, আর মন হচ্ছে এই ফিজিকাল বস্তুর ক্রিয়াকলাপের ফলে মানুষের যে স্মৃতি, চিন্তাশক্তি, চেতনা, আবেগ-অনুভূতি, ব্যক্তিসত্ত্বা গড়ে ওঠে এবং যা সেই মানুষের আচার-আচরণ-ব্যবহারে প্রকাশিত হয়, সেগুলোর সম্মিলন। 
 
মন বলে যে কিছু নেই, তার যুক্তি হিসেবে লুক্স কমেন্টে লিখেছেন,
"মানুষের মনের একটা ছবি আমাকে দেনতো প্লিজ"! 
জবাবে একজন যখন বলেছেন, "আপনি যদি আমাকে তাপ বা শব্দ -এসবের ছবি দিতে পারেন, আমি আপনাকে মনেরও একটা ছবি দিয়ে দেবো", তখন লুক্সের যুক্তিঃ 
"তাপ আর শব্দ হচ্ছে শক্তি, যা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে। মন কি বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত? ফিজিকস এর সঙ্গে অন্ধবিশ্বাসের তুলনা করছেন?"

 সেই তিনিই আবার চেতনা সম্পর্কে লিখেছেন,

"চেতনা হচ্ছে Consciousness. এটাও মস্তিষ্কের একটা কাজ/ প্রভাব/ আচরণ"

 লুক্স নিজেও সম্ভবত নিজের এহেন যুক্তির অসংলগ্নতাগুলো ধরতে পারছেন না! মনের অস্তিত্ব প্রমাণে মানুষের মনের ছবি চাইলেন, অথচ চেতনার অস্তিত্বের প্রমাণে কিন্তু মানুষের চেতনার প্রমাণে কোন রকম ছবির দরকার হলো না! চেতনাকে যেমন মস্তিস্কের কাজ, প্রভাব, আচরণ হিসেবে স্বীকার করা গেলে, মনকেই বা কেন মস্তিস্কের কাজ, প্রভাব, আচরণ বলা যাবে না? বস্তুত, চেতনা শুধু নয়, মানুষের চিন্তা ও চিন্তাশক্তি, স্মৃতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, আবেগ-অনুভূতি, সমস্ত কিছুই মস্তিস্কের কাজ, প্রভাব, আচরণ, এবং এগুলোর কোনটারই ছবি তোলা যায় না। যেমন ছবি তোলা যায় না শব্দের বা তাপের। অথচ, ছবি বাদেই তাপ আর শব্দ শক্তিকে লুক্স মেনে নিচ্ছেন, তার কারণ এসবকে বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে (যেনবা, বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণের পূর্বে শব্দ আর তাপ শক্তির অস্তিত্ব মানতেন না)! তার পরে তিনি প্রশ্ন করেছেন মন বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত কি না, তাপ - শব্দ পদার্থবিদ্যার বিষয়, আর তার মতে মন হচ্ছে অন্ধবিশ্বাস! অথচ, দুনিয়ায় মনোবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান বা সাইকোলজি একটা স্বীকৃত বিজ্ঞান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠ করা হয়! মনের সমস্যা ও অসুস্থতায় সাহায্য ও চিকিৎসা করার জন্যে মনোবিদ, মনঃরোগ বিশেষজ্ঞ আর মনোচিকিৎসকরা কি করছেন, যদি "মন" বলে কিছু না থাকে? লুক্স অবশ্য আরেক কমেন্টে বাংলা ভাষায় অনুবাদের সমস্যা দেখছেন। তিনি লিখেছেন,
"মনোরোগ পুরনো বাঙলা শব্দ। আধুনিক শব্দ হচ্ছে- মানসিক রেগ। মনোরোগ সেই মন থেকেই সৃষ্টি। কিন্তু মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা কি আসলেই মনের চিকিৎসা করেন? ডাক্তার কারো মন অপারেশন করতে শুনেছেন কখনো?"
এখন কথা হচ্ছে, "মানসিক" শব্দের অর্থ কি? এর অর্থ হচ্ছে "মন-সম্বন্ধীয়", "মনে জাত", "মনোগত"। "মন" (mind) বিশেষ্য পদেরই বিশেষণ পদরূপ হচ্ছে এই "মানসিক" (mental), ইংরেজিতেও "mental" শব্দের অর্থ হচ্ছে "relating to the mind" (cambridge dictionary), "connected with or happening in the mind" (oxford dictionary)! ফলে, মনোরোগ আর মানসিক রোগ - বাংলা ভাষায় এই দুটির মাঝে অর্থগত কোন তফাৎ আসলে নেই। আর, হ্যাঁ - মনোরগ বিশেষজ্ঞরা বস্তুত মনের চিকিৎসাই করেন, মনের রোগই সারিয়ে তোলার চেস্টা করেন। মনের সমস্যা ও রোগ দূর করার জন্যে মন অপারেশন করতে হয় না (মানুষের রোগের চিকিৎসা বলতে কেবল অপারেশনই বুঝায় না)। মনের সমস্যা ও অসুস্থতায় দুই জায়গায় যাওয়া যেতে পারে। সাইকোলজিস্ট বা মনোবিদ বা মনোবিজ্ঞানীরা রোগীর সাথে কেবল আলাপ-আলোচনা করেন (কাউন্সেলিং) এবং বিভিন্ন রকম বিহেভিয়ারিয়াল থেরাপি দেন, আর সাইকিয়াট্রিস্ট বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মেডিকেল ডাক্তার হিসেবে মেডিকেশনও দেন। লুক্স আসলে মনে করেন, এসবের কোনটাই মনের রোগ নয়, রোগ হচ্ছে মস্তিস্কের, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে - মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় কি তিনি কখনো মস্তিস্কের অপারেশন করতে শুনেছেন?
 
দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাইকোলজি বা মনোবিজ্ঞান নামক বিষয়টি পড়ানো হয়, সেই বিষয়টাও কি বিজ্ঞানের কোন শাখা নয়, বা সাইকোলজির বাংলা হিসেবে মনোবিজ্ঞান একইভাবে ভুল? তাহলে, দেখা যাক - বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেই এই সাইকোলজি সাবজেক্টটি সম্পর্কে কি কি বলা হয়েছেঃ
Psychology has been defined as the science of mental life and its scope includes a wide variety of issues. (University of Oxford)

Academic psychology is a biological and experimental branch of science concerned with the mind, brain and behaviour. (University of York)

Psychology is the scientific study of the mind and behavior. Psychologists are actively involved in studying and understanding mental processes, brain functions, and behavior. (The Ohio State University)

The scientific study of the way the human mind works and how it influences behaviour, or the influence of a particular person's character on their behaviour. (Cambridge dictionary)

অর্থাৎ মানুষের মন কিভাবে কাজ করে, মানুষের মানসিক জীবন, মানুষের মন ও মস্তিস্ক, ব্যবহার - প্রভৃতির সাইন্টিফিক স্টাডির ফিল্ডটাই হচ্ছে সাইকোলজি, ফলে "মনোবিজ্ঞান" সাইকোলজি'র সবচেয়ে সঠিক অনুবাদ। মানব মন নিয়ে নানারকম তত্ত্ব ও দর্শন রয়েছে, "ফিলোসফি অব মাইণ্ড" নামে স্বতন্ত্র একটা বিষয় সাইকোলজি আর দর্শন - দুই ডিপার্টমেন্টেই পড়ানো হয়! মন (mind) বনাম শরীর (body)/ মস্তিস্ক (brain) তথা ভাব (idea) বনাম বস্তু (matter) এর সম্পর্ক, একটিকে বাদে অপরটির অস্তিত্ব তথা একটা থেকে অন্যটিকে আলাদাকরণ - এসব প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই দর্শনের বিভিন্ন শাখা গড়ে উঠেছে। সেই প্রশ্নগুলোর কেন্দ্রে আছে, 

১। মন এবং মস্তিস্ক কিভাবে সম্পর্কিত (How are the mind and the brain related)?

২। মন ও মস্তিস্ক কি অভিন্ন বা এক (Is the mind identical to the brain)?

৩। মন কি মস্তিস্কের কিছু কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ভূত হয় (Does the mind emerge from some brain function)?

৪। মন কি মস্তিস্ক থেকে স্বাধীন থাকতে পারে (Can a mind exist independent from a brain)? 

মন ও মস্তিস্কের নির্ভরশীলতার তত্ত্ব (যা আধুনিক বিজ্ঞানও অনুরূপ মনে করে) অনুযায়ী "মনের অস্তিত্বই নির্ভর করে মস্তিস্কের উপরে, মস্তিস্ক বাদে মনের কোন অস্তিত্বই নেই" (Minds depend on brains to exist, without a brain there is no mind)। এই প্রশ্নগুলোর জবাবকে কেন্দ্র করে দর্শনের নানা শাখা বিদ্যমান। সেগুলোর মধ্যে কেবল নির্মূল বস্তুবাদ (Eliminative materialism) এ বলা হয় "মনের কিছু কিছু দিক বাস্তব নয়" (Some aspects of minds are not real)! বাঁকি সবগুলো শাখাতেই "মন"কে বাস্তব ধরা হয়। যেমনঃ

ক) মনের দ্বৈতবাদী তত্ত্ব (Dualist theories):

১। পদার্থ দ্বৈতবাদ (Substance dualism): মন ও দেহ বিদ্যমান, ভিন্ন, একে অপর থেকে স্বাধীন, কিন্তু সংযুক্ত - এই দর্শন দেকার্তের।
২। বৈশিষ্ট দ্বৈতবাদ (Property Dualism): মন ও দেহের দুটি ভিন্ন অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট রয়েছে। বৈশিষ্ট দ্বৈতবাদ এর আবার দুটি শাখা রয়েছেঃ মিথস্ক্রিয়াবাদ (Interactionalism) ও এপিফেনোমেনালিজম (epiphenomenalism)।

খ) মনের অদ্বৈতবাদী তত্ত্ব (Monist theories of mind):

১। ভাববাদ (Idealism): একমাত্র মন ও ভাবের অস্তিত্বই দুনিয়ায় বিদ্যমান (Minds and ideas are all that exist)। বস্তুজগৎ হচ্ছে মন বা ভাবের প্রতিফলন মাত্র। ভাববাদের বিভিন্ন উপশাখার মাঝে আছে অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism), যুক্তিবাদ (Rationalism), Panpsychism, Panprotopsychism প্রভৃতি।

২। ভৌতিকতা (Physicalism) বা বস্তুবাদ (Materialism): বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু বিরাজমান তার সবই শেষ অবধি ভৌত, মনও ভৌত (Everything that exists including minds is ultimately physical)। যা কিছু বিরাজমান তার সবই বস্তুময়, ভাবের উদয়ও বস্তু তথা মানব মস্তিস্কে। এর আবার বিভিন্ন উপশাখা রয়েছে, যেমনঃ

 i) আচরণবাদ (Behaviorism): মন হচ্ছে মানুষের বিভিন্ন আচার-আচরণেরই এক জটিল সংগ্রহশালা (Minds are complex collections of behaviors)। মনোবিদরা বস্তুত এই তত্ত্বের উপরে ভিত্তি করেই চিকিৎসা করেন। সাইকোলজির একটা বড় শাখার নাম হচ্ছে বিহেভিরিয়াল সায়েন্স। একজন মানুষ কেবল তার নিজের মনের মাঝেই কি আছে, সেখানে কি কি ঘটছে, জানতে পারে, কিন্তু অন্য মানুষের মনের মধ্যে আসলেই কি চলছে, তা জানা কখনোই তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে, সে অন্য মানুষের বা একজন মনোবিদ তার পেশেন্টের বিভিন্ন আচার-আচরণ দেখে বা বিশ্লেষণ করে তার মনের সমস্যা সম্পর্কে একটা ধারণালাভ করতে পারে, এমনকি কখনো কখনো এই ধারণা বা পেশেন্টের আচার-আচরণ ও বিশেষ কোন অনুভূতির বা তার মানসিক জগতের তথা তার ব্যক্তিত্ব, চিন্তা প্রকৃয়া প্রভৃতির ব্যাখ্যা সম্পর্কে সেই মানুষটি বা পেশেন্ট নিজেও অজ্ঞাত, অসচেতন থাকতে পারে (অর্থাৎ নিজের মনের গভীর কোন ক্ষত, যা অচেতন বা অবচেতন অংশে লুকিয়ে থাকে, তাও হয়তো কোন কোন আচরণে প্রকাশ পেয়ে যেতে পারে)। মনের সমস্যার ট্রিটমেন্টের উপায় হিসেবেও তাই বিহেভিরিয়াল থেরাপি দেয়া হয়!

ii) কর্মবাদ (Functionalism): মন হচ্ছে বস্তু (মস্তিস্ক) থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সংগ্রহ (Minds are collections of functions built from matter)। মনের আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক সংজ্ঞায় এটাই বলা হয়, সেই কাজ বা ফাংশনগুলো হচ্ছে, অনুধাবন, চিন্তন, স্মরণ, মূল্যায়ন, বিবেচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা সমাধান প্রভৃতি। শুরুতে ব্রিটানিকার সংজ্ঞা দ্রষ্টব্য।

iii) নির্মূল বস্তুবাদ (Eliminative Materialism), প্রভৃতি।

 ৩। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence): বর্তমান দুনিয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্সের যুগে প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে প্রশ্ন আসছে, কোন অ-মানব, নির্মাংস ব্যবস্থার কি মন থাকা সম্ভব (Can a non-human, non-meat system have a mind)? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রি-প্রোগ্রামড অনেক কাজ এককভাবে বা স্বাধীনভাবে একটা যন্ত্রের পক্ষে করা সম্ভব, ডাটা কালেকশন ও স্টোর করা ও খুব সহজেই স্টোরড ডাটাকে ব্যবহার করার কাজটায় বরং মানব স্মরণশক্তির চাইতে যন্ত্রের পক্ষেই আরো ভালোভাবে করা সম্ভব, এমনকি সে সমস্যার সমাধানও করতে সক্ষম হতে পারে। কিন্তু তার কি মন বলে কিছু থাকতে পারে? মানে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কি চিন্তা করা সম্ভব, নানা রকম আবেগ অনুভূতি কি তার থাকতে পারে? সবচেয়ে বড় কথা, সে কি নিজের মত করে ও স্বাধীনভাবে, অর্থাৎ তাকে যেসব কাজের জন্যে প্রোগ্রামড করা হয়েছে, তার বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কাজ করতে পারে? মন যেভাবে প্রতিনিয়ত ইভোলভড হয়ে পুরাতন একটা চিন্তার উপরে ভর করে ও সাহায্যে নতুন নতুন চিন্তা উৎপাদন করতে পারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে কি তা সম্ভব, অর্থাৎ তাকে দেয়া কোন প্রোগ্রামের উপরে ভর করে নিজেই নতুন কোন প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারে? এখন পর্যন্ত পারে না (সায়েন্স ফিকশনে অবশ্য পারে, অর্থাৎ মন যুক্ত রোবট বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে, যারা মানুষকেও পরাজিত করতে সক্ষম)। 

৪। নিউরোফিলোসফি: মন সম্পর্কিত ভৌতিকতাবাদী বা বস্তুবাদী বিভিন্ন দর্শন এবং নিউরো সায়েন্স এর বিভিন্ন জ্ঞানকে সমন্বিত করে গড়ে উঠেছে নিউরোফিলোসফি, এবং যা মূলত মন সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনকি প্রশ্নের সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত জবাব দিতে সক্ষম!

 "মন" নিয়ে এই দর্শনের এই লম্বা আলাপটা এখানে নিয়ে এলাম, এই কারণে যে - গৌতম বুদ্ধের "দর্শন" নিয়েই আমরা আলাপ করছি, ফলে দর্শনের আলোকে "মন"কে বুঝা দরকার। কোন দর্শনেই মনের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়নি, বিজ্ঞানও মনকে অলীক, অবাস্তব, বা অন্ধবিশ্বাস বলে মনে করে না! এছাড়াও, "মন" শব্দটার একটা ভাষাতাত্ত্বিক তাৎপর্যও আছে। "মন কেমন", "মন ভালো নেই", "খুব মন খারাপ", "পড়া মনে থাকে না", "মনে করে দেখো", "মন দিয়ে শুনো", "মন লাগিয়ে কাজ করো", "মনস্কামনা", "মনোবেদনা", "কিছু মনে করো না", "কুটিল/ দুষ্ট মন" - ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্ন ভাবের ভাষাগত বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে, "মন" বলে যদি কিছু নাও থাকতো, তারপরেও - এসবের কোন কিছুই অর্থহীন হয়ে যেতো না (আসলে, মন আছে এবং মন যেহেতু মস্তিস্কের বিভিন্ন কাজের সমন্বিত ফ্যাকাল্টি, সে কারণে "মন" শব্দটিও এরকম অসংখ্য অর্থেও ব্যবহৃত হয়! মন কেমন মানে হচ্ছে হাউ ডু ইউ ফিল, মন দিয়ে শুনো মানে লিসেন এটেনটিভলি, মনে রাখা ও করা হচ্ছে মেমোরাইজ এণ্ড রিমেমবার, মনস্কামনা হচ্ছে ডিজায়ার, মনোবেদনা হচ্ছে সরো, মন লাগিয়ে কাজ করা হচ্ছে ওয়ার্ক উইথ ফুল কনসেন্ট্রেশন! মস্তিস্কের যে সব ফাংশন এই "মন" এর অন্তর্গত, তার সবই "মন" শব্দটির ভাষাগত বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশে ব্যবহৃত হচ্ছে। "মন" বাস্তবে কিছু না থাকলেও - এসব এক্সপ্রেশনের জবাবে সেটা বলার কিছু থাকতো না। যেমনঃ আমরা এখন জানি, মানুষের হৃৎপিণ্ডের সাথে মানুষের প্রেম ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতির কোন সম্পর্ক নেই, সবই ঘটে মস্তিস্কে। তারপরেও যখন আমরা ভাষাগতভাবে বলি, "হৃদয় দিয়ে ভালোবাসি", "হৃদয়ে লিখে রেখেছি তার নাম", "কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে", "হৃদয়ে বাংলাদেশ", "কষ্টে বুক আনচান করে" (এটা অবশ্য পুরোপুরি ভুল নয়, মানুষের বিভিন্ন আবেগ অনুভূতিতে বুক ধকধক করে, মানে হার্টিবিট বেড়ে যায়), "বুকের গভীরে বা এক বুক ভালোবাসা", "হৃদয়বৃত্তি", "আমি হৃদয়ের কথা শুনিতে ব্যাকুল", "ওগো হৃদয়হীনা, কখনো কি তোমার মনে পড়ে না", "হৃদয়শূণ্য বা পাষাণ হৃদয়" - ইত্যাদি যখন বলা হয়, কেউ বলি না যে, হৃদয়ে নয়, প্রেম - ভালোবাসা - আনন্দ - বেদনা - স্মৃতি সমস্ত কিছু মস্তিস্কে ঘটে, ফলে এসব এক্সপ্রেশনে হৃদয়কে মস্তিস্ক দিয়ে প্রতিস্থাপন করো, মানে "মস্তিস্ক দিয়ে ভালোবাসি", "কে হায় মস্তিস্ক খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে", "ওগো মস্তিস্কহীনা, মনে কি পড়ে না", "মস্তিস্কবৃত্তি", "পাষাণ মস্তিস্ক" - ভাষায় এসবের আমদানি করতে হয় না! বরং, যখন বলা হয় উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি, তখন তার অর্থ বুঝে নিতে হয় - এই উচ্চতর কিংবা নিম্নতর হৃদয়বৃত্তির কোনটাই হৃৎপিণ্ডে নয়, বরং মস্তিস্কেই ঘটে! কাউকে যখন পাষাণ হৃদয় বলা হয়, তখন বুঝে নিতে হয়, তার মস্তিস্কে আবেগ-অনুভূতি তথা সহানভূতি-সহমর্মিতা ঠিকভাবে কাজ করে না (বস্তুত অভিযোগকারী আরেকজনের আচরণে সেই সহানুভূতি - সহমর্মিতার অভাব পায় বলে এভাবে বলে)! ফলে, গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন আলাপ - আলোচনায় তথা বানীতে "মন" শব্দের যতবার উল্লেখ আছে, ততবার "মানুষের মন বলে কিছু নেই" কথাটার পুনরাবৃত্তি করার চাইতে দরকার ছিল, এর ব্যবহারিক অর্থ বুঝেই খণ্ডন করা! মানে, গৌতম বুদ্ধ যদি বলে থাকেন, "মানুষের মনই আসল", এবং লুক্স যদি মনে করেন, মন বলে কিছু নেই- সবই আসলে মস্তিস্ক, তাহলে গৌতম বুদ্ধের এই এক্সপ্রেশনটিকে লুক্সের ধরে নিতে "মানুষের মস্তিস্কই আসল" অর্থে!
 
এবারে, গৌতম বুদ্ধের উল্লেখিত ২৪ টি বানী সম্পর্কে লুক্সের দেয়া কথিত "যুক্তি"গুলো নিয়ে ধরে ধরে আলোচনা করা যাক।
১। বুদ্ধ: অতীতকে প্রাধান্য দিও না, ভবিষ্যত নিয়ে দিবাস্বপ্নও দেখবে না। তার চেয়ে বরং বর্তমান মুহূর্ত নিয়ে ভাবো।

লুক্স: বুদ্ধ অতীতকে প্রাধান্য দিতে নিষেধ করেছেন, অথচ তার ভক্ত অনুসারীরা গত আড়াই হাজার বছর ধরে সেই একই অতীত, মানে তার দর্শন নিয়েই পড়ে আছে। স্বপ্ন দিনেই বা জেগে জেগেই দেখতে হয়। যার কোনো স্বপ্ন নাই, তার জীবনের কোনো লক্ষ্যও নাই। রাতের বা ঘুমের স্বপ্নই বরং এক ধরনের অসুস্থতা।

নাধঃ প্রথমত, গৌতম বুদ্ধের কথা-বানী-বক্তব্য সঠিক বা প্রয়োজনীয় কি না, সেটা কি তাঁর ভক্ত অনুসারীদের মেনে চলা বা না চলার উপরে নির্ভর করে? দ্বিতীয়ত, অতীতকে প্রাধান্য না দেয়ার অর্থ মোটেও অতীতকে ভুলে যাওয়া নয়! গৌতম বুদ্ধের এই বানীর মানে আমি বুঝি এভাবে যে, তিনি অতীত - বর্তমান - ভবিষ্যৎ এই তিনকালের মধ্যে বর্তমানকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে বলেছেন! কেননা, বর্তমানের এই সময়টাই হচ্ছে কাজে লাগানোর সময়। ফলে, তিনি অতীতকে নিয়ে আটকে পড়ে থাকতে যেমন মানা করেছেন, তেমনি বর্তমানকে বাদ দিয়ে, ভবিষ্যতকে নিয়ে আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখতেও মানা করেছেন। রাতের ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখাটা মোটেও অসুস্থতা নয়, প্রতিটা মানুষই ঘুমের মাঝে নানারকম স্বপ্ন দেখে, যার অধিকাংশই আসলে ভুলে যায়। বাংলাভাষায় দিবাস্বপ্ন এর অর্থ মোটেও দিনের বেলায় বা জেগে জেগে মানুষ যে স্বপ্ন দেখে, সেটা বুঝায় না, বরং দিবাস্বপ্ন হচ্ছে - আকাশ কুসুম বা অলীক কল্পনা! ভবিষ্যতের জন্যে স্বপ্ন দেখা, জীবনের লক্ষ স্থির করা, তার জন্যে কাজ করা- এগুলোর কোনটাই দিবাস্বপ্ন নয়, এবং ভবিষ্যতের এমন স্বপ্ন বর্তমানকে বাদ দিয়েও সম্ভব নয়, বর্তমানের উপরে নির্ভর করে যে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ - উদ্দেশ্য গড়া হয়, সেই স্বপ্ন হয় বাস্তবানুগ! সেগুলোর কোনটাই অলীক কল্পনা বা দিবাস্বপ্ন নয়!
২। বুদ্ধ: সবকিছুর জন্য মনই আসল। 
লুক্স: একদম ভুল কথা। মানুষের মন বলে কিছু নেই। মানুষের কল্পনা, চিন্তা আর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার মস্তিষ্ক। দূঃখ, কষ্ট এবং সকল অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক।
 
নাধঃ মানুষের "মন" বলে কিছু নেই - এটি একেবারেই ভুল আলাপ। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আগেই করেছি। এখানেও যে "মন" এর কথা শুনেই লুক্স মানুষের "কল্পনা", "চিন্তা", "সিদ্ধান্ত গ্রহণ", "দুঃখ", "কষ্ট', "সকল অনুভূতি"র কথা এনেছেন, তাতেও বুঝা যায়, মুখে যতই "মন" শব্দটিকে উড়িয়ে দেন না কেন, এই শব্দটিও লুক্সের "মনের" ভিতরে কিছু দ্যোতনা তৈরি করে বৈকি। কেননা মানুষের "কল্পনা", "চিন্তা", "সিদ্ধান্ত গ্রহণ", "দুঃখ", "কষ্ট', "সকল অনুভূতি" - এসবকিছুই মানব মনেরই অংশ, এবং মনের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপই চলে মানবমস্তিস্কেই, তাতে "মন" অবিরাজমান হয়ে যায় না! 
 
গৌতম বুদ্ধ এই কথার মধ্য দিয়ে আসলে কি বুঝাতে চেয়েছেন? তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, মানুষের দুঃখ, কষ্ট, জরা, শোক, লোভ, লালসা, কাম, ক্ষুধা, মন্দা - সমস্ত কিছুর মূলে আছে মানব মন (লুক্স যদি বলেন মানব মস্তিস্ক, তাতেও মূল ভাবটি একই থাকে), ফলে বুদ্ধের মতে সেই মনকেই (লুক্সের ভাষায় মস্তিস্ককেই) উপযুক্ত ও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হয়, যদি কেউ জাগতিক দুঃখ, কষ্ট, জরা, লোভ, লালসা, কাম- এসবের উর্ধ্বে যেতে চায়! যোগ- ধ্যান - তপস্যা করে, দিনের পর দিনে শারীরিক কষ্টকে সহ্য করার মাধ্যমে যে নির্বাণ লাভের প্রকৃয়া, তার মাঝে কেবল লোভ ও লালসার উর্ধ্বে উঠতে পারার কার্যকারিতাটুকুই আমি দেখি! তার বাইরে শারীরিক কষ্ট, বা জাগতিক দুঃখ-দুর্দশা ভুলার জন্যে মনকে প্রবোধ দেয়ার বা প্রশিক্ষিত করার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বস্তুত এভাবে মনের উপরে চাপ প্রয়োগের ফল যে ভালো হয় না, সেটা গৌতম বুদ্ধের "মধ্যমনীতি" অবলম্বন থেকেই বুঝা যায়, কেননা চরম অনাহার তিনিও সহ্য করতে না পেরেই পরিমিত ভোগের পথে তিনি গিয়েছিলেন। তার মানে, অন্তত তিনিও স্বীকার করেছেন যে, কেবল মন দিয়ে চরম ক্ষুধা, শোক, জরাকে অতিক্রম করা সম্ভব নয়, সেই অর্থে "সবকিছুর জন্যেই" মন আসল নয়! আরেকটি দিক দিয়ে আমি গৌতম বুদ্ধের এই নির্বাণ লাভের দর্শনের বিরোধিতা করি। এখানে ব্যক্তির বাইরের জগৎকে অগৌণ ও অগ্রাহ্য করে, দুঃখ-দর্দশায় জর্জরিত ব্যক্তিকেই দুনিয়ার যাবতীয় অন্যায় - অবিচার - শোষণ - নিপীড়নের ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে, "মন"কে উপযুক্ত করার মাধ্যমে সহ্য করে যাওয়ার পথ বাতলে দেয়, দুনিয়ার অন্যায্য, অন্যায়, অনাচারের ব্যবস্থাকে পাল্টিয়ে নিজ অধিকার আদায়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারে না। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, সবাই যদি দুঃখ-কষ্টের উর্ধ্বে উঠে লোভ মুক্ত হয়ে যায়, তাহলেও তো অন্যায় - অন্যায্যতা - অনাচারের হাত থেকে মুক্তি মিলতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে - মানুষের শরীর - স্বাস্থ্য - মনের যাবতীয় চাহিদাগুলোকে অস্বীকার কেন করতে হবে? বস্তুত শোষক, ক্ষমতাবানদের অধিক লোভ ও অন্যায় শোষণ - নিপীড়নের সাথে গৌতম বুদ্ধের পন্থায় নিজেই নিজের শরীর ও মনের উপরে চালানো নির্যাতন, বঞ্চনা ও নিপীড়নের ফলগত কোন পার্থক্য আমি দেখি না। সেই অর্থে, গৌতম বুদ্ধের এই শিক্ষা বা দর্শনের সাথে আমি একমত নই, তবে একটা পর্যায় পর্যন্ত "মন" এর কার্যকারিতা আমি দেখি, এবং মন বা চিন্তাও এই বস্তুগত দুনিয়াটাকে পাল্টাতে অনেক বড় ভূমিকা রাখে বলে মনে করি। ফলে, "সবকিছুর" জন্যে না হলেও, "অনেক কিছুর" জন্যে মনই আসল বলে মনে করি।
৩। বুদ্ধ: সবার আগে মনকে উপযুক্ত করো, চিন্তাশীল হও। আগে ভাবো তুমি কী হতে চাও। 
লুক্স: আবারও বলছি, মানুষের বা প্রাণীর মন বলে কিছু নাই, এটা মস্তিষ্ক। আগেই জীবনের লক্ষ স্থির করা অনেক পুরনো চিন্তা। আধুনিক সময়ে পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যোগ্যতা এবং আগ্রহ বিবেচনা করে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার বিষয় বা ভবিষ্যতের পেশা নির্ধারণ করে থাকে।
 
নাধঃ মানুষের "মন" বলে কিছু নেই - এটি একেবারেই ভুল আলাপ। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আগেই করেছি। যেকোন কাজের আগে, ভেবে-চিন্তে, মনকে প্রস্তুত করে অগ্রসর হওয়ার এই পরামর্শের সাথে কেউ দ্বিমত করতে পারে, ধারণাতেই ছিল না। প্রচলিত প্রবাদ আছে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না! যেকোন কাজে সফলতার জন্যে সেই কাজের প্রতি ভালো লাগা, প্যাশন, তীব্র আগ্রহ - এসব জরুরী। সে কারণেই গৌতম বুদ্ধ মনকে উপযুক্ত করতে বলেছেন, ভাবতে বলেছেন, চিন্তাশীল হতে বলেছেন। মানে, একজন মানুষ আসলে কী হতে চায় (বা কী করতে চায়) - সেটাই আগে খুঁজে বের করতে বলেছেন। এর জবাবে লুক্স বলেছেন - আধুনিক সময়ে পড়াশুনার বিষয় ও ভবিষ্যতের পেশা নাকি শিক্ষার্থীর পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করে থাকে! সেখানে অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন, "শিক্ষার্থীর আগ্রহ" বিবেচনা করা হয়, তো সেই আগ্রহটাই বা কি? শিক্ষার্থী আসলে কি হতে চায়, বা কোন পেশায় যেতে চায়, কোন শিক্ষা পেতে চায় - সেটা সম্পর্কে তার ভাবনাই কি নয়? এছাড়া, আধুনিক সময়ে পরিবার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মোটেও সন্তানের পাঠ্য বিষয় বা পেশা নির্ধারণ করে না, সেটা বাংলাদেশের মত পশ্চাদপদ সমাজে ও শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সত্য, যেখানে বাবামা - শিক্ষকরা সন্তান ও শিক্ষার্থীর উপরে শিক্ষার বিষয় ও পেশা চাপিয়ে দেয় (আমাদের দেশের প্রচুর ছেলেমেয়ে বাবামা'র জবরদস্তিতে ডাক্তারি - ইঞ্জিনিয়রিং পড়তে গিয়ে ক্যারিয়ার ও জীবনই নষ্ট করে ফেলেছে)! আধুনিক সমাজগুলোতে এমনটা আর করা হয় না! শিক্ষার্থীর মধ্যে আগে থেকে আগ্রহ গড়ে তোলার চেস্টা করা হয়, তার আগ্রহকে খুঁজে বের করতে উদ্বুদ্ধ করা হয় এবং সেই আগ্রহ অনুযায়ীই পড়াশুনার বিষয় বা পেশা নির্ধারণ করতে সহযোগিতা করা হয়। আধুনিক দেশগুলোর উন্নত শিক্ষাব্যবস্থায় সে কারণে দেখা যায়, মাধ্যমিক স্কুলে থাকাকালেই শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজে নিয়ে গিয়ে, বিভিন্ন বিষয়ের সাথে পরিচিত করা হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্ণশিপ, ডে-ট্যুর - এসবের মাধ্যমে বিভিন্ন পেশার সাথেও পরিচিত করা হয়! তারপরে, সেই শিক্ষার্থীকেই ভাবতে বলা হয়- সে আসলে কোনটায় বেশি আগ্রহ পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে, সেরকম আগ্রহের বিষয়ের উপরে কাজ করে পার্সোনাল প্রজেক্টও করতে দেয়া হয়! ফলে, বাবামা বা শিক্ষকরা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মোটেও শিক্ষার্থী বা সন্তানের উপরে কিছু চাপিয়ে দেয়ার কথা চিন্তাও করতে পারে না! বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন, তথা উপদেশও অনুরূপ!
 
৪। বুদ্ধ: আনন্দ হলো বিশুদ্ধ মনের সহচর। বিশুদ্ধ চিন্তাগুলো খুঁজে খুঁজে আলাদা করতে হবে। তাহলে সুখের দিশা তুমি পাবেই। 
লুক্স: আবারও মন। মন বলে কিছু নাই। চিন্তার বিশুদ্ধতা সময় ও স্থান ভেদে ভিন্ন হয়। যেমন, প্রেম, যৌনতা, সমকামীতা, নারীর অধিকার, ইত্যাদি অতীতে অন্যায় এবং অপরাধ, মানে বিশুদ্ধ চিন্তা নয় বলে বিবেচিত হতো, কিন্তু উন্নত আর শিক্ষিত বিশ্বে এসব বিশুদ্ধ চিন্তা।
 
নাধঃ আবারও একইভাবে মনকে অস্বীকার! মানুষের "মন" বলে কিছু নেই - এটি একেবারেই ভুল আলাপ। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আগেই করেছি। লুক্স যেসব উদাহরণ দিয়েছেন, সেগুলো বস্তুত নীতি - নৈতিকতা - ন্যায়ের ধারণা - মূল্যবোধ প্রভৃতির উদাহরণ, এবং সেগুলো অবশ্যই সময় ও স্থান ভেদে বিভিন্ন হয়! কিন্তু চিন্তার বিশুদ্ধতা মানে তো এইসব নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ নয়! চিন্তার বিশুদ্ধতা হচ্ছে, চিন্তার মধ্যে খাঁদ বা ভেজাল না থাকা, তথা চড়াই-উতরাই, সংশয় - সন্দেহ মুক্ত চিন্তা, চিন্তার বিশুদ্ধতা হচ্ছে বৈপরীত্যহীনতা। মানুষ চায় এক- পায় আরেক, ভাবে এক - হয় আরেক, ভেবে-চেয়ে পাওয়ার পরেও দেখে অবচেতনে আসলে এটা নয়, অন্যটি চেয়েছিলো, অনেক সময় মানুষ বুঝতেই পারে না- সে আসলে কি চায়, কোনটাকে ঠিক বা ন্যায় মনে করে! এ সবই মানুষকে অসন্তুষ্ট করে, বিচলিত করে, এসবই তার আনন্দের পথে বাঁধা! সেই অর্থে বিশুদ্ধ চিন্তা মানুষকে আনন্দিত করতে পারে, বিশুদ্ধ চিন্তা তথা বৈপরীত্য বিহীন বিশুদ্ধ চিন্তার অধিকারী মানুষ সুখের দিশা সহজে পায়! ফলে, এই অর্থে গৌতম বুদ্ধের আলোচনা সঠিক। তবে, চিন্তার প্রবাহমানতার জন্যে, নতুন নতুন চিন্তা উৎপাদনের জন্যে, বিশুদ্ধ চিন্তাকে আঁকড়ে ধরাটা বাঁধাই প্রদান করে। চিন্তা এগিয়ে যায় আসলে অশুদ্ধ চিন্তার প্রভাবে, চিন্তার খাঁদ - ভেজাল, চড়াই - উৎরাই, সন্দেহ - সংশয়, নানা রকম বৈপরীত্যের কারণেই আসলে নতুন চিন্তা তৈরি হয়, এগুলো মানুষকে বিভ্রান্ত, বিচলিত, অসন্তুষ্ট করতে পারে ঠিকই, কিন্তু চিন্তার সংঘর্ষের পরে যখন নতুন কোন চিন্তা পাওয়া যায়, তার আনন্দটাও বিশাল হতে পারে বৈকি!
৫। বুদ্ধ: তুমিই কেবল তোমার রক্ষাকর্তা, অন্য কেউ নয়। 
লুক্স: কথাটা হাস্যকর। অসুস্থ হলে ডাক্তার, বিপদে পড়লে পুলিশ, আর অধিকার বঞ্চিত হলে রাষ্ট্রের আদালত আধুনিক মানুষের রক্ষাকর্তা।
 
নাধঃ না, কথাটা মোটেও হাস্যকর নয়! প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রেই তার ব্যক্তিসত্ত্বাই সবার আগে নিজের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, সুস্থতা-অসুস্থতা প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে পারে। কারো যেকোন সমস্যা-রোগ-শোক-ক্ষুধা-মন্দা-ভীতি কিংবা যেকোন রকম আবেগ-অনুভূতি সে যেভাবে বুঝতে পারে বা টের পায়, যেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে যায়, সেটা সেভাবে অনুধাবন করা অন্যের পক্ষে সম্ভব নয়। খুব কাছের একজন কেউ হয়তো সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হলে বাহ্যিক আচার-আচরণ-ব্যবহারে অনেক খানি টের পেতে পারে, তদুপরি সেটাও হুবহু একই অনুভূতি হতে পারে না! সে কারণেই - বলা যে, অন্য কেউ নয়, তুমিই তোমাকে রক্ষা করতে পারো। এখানে, লুক্স যে অসুস্থ হলে ডাক্তার, বিপদে পড়লে পুলিশ, অধিকার বঞ্চিত হলে রাষ্ট্রের আদালতের রক্ষাকর্তা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সেখানেও বলা যায় - ডাক্তারের কাছে যেতে হলেও আগে একজনকে বুঝতে হবে যে - সে অসুস্থ এবং সে সুস্থ হতে চায়, একইভাবে পুলিশ বা আদালতের কাছে যাওয়ার আগে নিজের বিপদ বা অধিকার বঞ্চনার কথা আগে ওয়াকিবহাল হতে হবে, এবং সেখান থেকে পরিত্রাণ চাইতে হবে। এটা মোটেও অন্য কেউ করে দিবে না! রাষ্ট্রের আদালত, আইন কানুন, পুলিশী ব্যবস্থাও তৈরির পেছনে আছে - সেই চাওয়া, নিজেকে বা নিজেদের রক্ষা করার দাবি! অনেক সময়ই মনে করা হয় - শিক্ষত বুর্জোয়ারাই হয়তো শ্রমিকের অধিকারের পক্ষে বেশি লড়েন, নারীর হয়ে পুরুষেরাই সোচ্চার হন, আমাদের দেশে আদিবাসীদের সমস্যা সংকট নিরসনে অনেক বাঙালিই খুব সংগ্রাম করেন, ইরাক - আফগানিস্তান - লিবিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কতন্ত্র, রাজনৈতিক নিপীড়ন দূর করতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ত্রাতা হয়ে হাজির হয় - কেননা সেই শ্রমিকরা, নারীরা, আদিবাসীরা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো হয়তো তাদের উপরে চলা অন্যায়ের ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন নাও থাকতে পারে; কিন্তু সবার আগে বুঝা দরকার, শ্রমিকদের, নারীদের, আদিবাসীদের, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর, যুগে যুগে নিপীড়িতদেরই বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে হয়, নিজের অধিকার চাইতে হয়, নিজেদের লড়াইটায় নেতৃত্ব দিতে হয়! অন্য কেউ সাহায্যকর্তা হতে পারে বড়জোর, কিন্তু রক্ষাকর্তা হতে পারে না। নিজেকে রক্ষার ভার অন্যকে দেয়ার অর্থই হচ্ছে, নিজের সত্ত্বাকেই একভাবে বিকিয়ে দেওয়া!
 
৬। বুদ্ধ: অনিয়ন্ত্রিত মন মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে। মনকে প্রশিক্ষিত করতে পারলে চিন্তাগুলোও তোমার দাসত্ব মেনে নেবে।
 
লুক্স: মন বলে কিছু নাই। মনকে প্রশিক্ষিত করারও প্রশ্নই আসে না। মানুষ অপরাধে লিপ্ত হয় অশিক্ষা, দারিদ্র্য এবং সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে।
 
নাধঃ মানুষের "মন" বলে কিছু নেই - এটি একেবারেই ভুল আলাপ। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আগেই করেছি। এখানে লুক্স নিজেও মানুষের অপরাধে লিপ্ত হওয়ার প্রথম কারণ হিসেবে "অশিক্ষা"র কথা বলেছেন, বিভিন্ন পয়েন্টের আলাপে "শিক্ষিত" হওয়া, "শিক্ষালাভ", "জ্ঞান অর্জন" -এর আলাপ করেছেন! আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে - শিক্ষা, জ্ঞান এর অর্থ আসলে কি বুঝায়, শিক্ষাদীক্ষা - জ্ঞান অর্জন ঠিক কিভাবে, কোন জায়গাটিতে কাজ করে? বস্তুত শিক্ষার অপরনাম হচ্ছে মনকেই প্রশিক্ষিত করা (শারীরিক বা গায়ে গতরে বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনের শিক্ষা হলে অবশ্য শরীরকে প্রশিক্ষিত করাটাও যুক্ত হয়ে যায়)। মানে, মনের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টিকে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে মনকে সেই বিষয়ের তথ্য জমা করা, সেই বিষয়ে চিন্তা করতে পারা, সিদ্ধান্ত নিতে পারা, সমস্যা সমাধান করতে পারা - চর্চার মাধ্যমে এসব দক্ষতা অর্জন করার প্রশিক্ষণই হচ্ছে শিক্ষা! এখন, লুক্স এখানে "মন" এর বদলে মস্তিস্ক বলতেই পারেন, কিন্তু শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জন হচ্ছে এই মন বা মস্তিস্কের বিশেষ বিশেষ ফাংশনকে বিশেষ বিশেষ বিষয়ে বা কাজের জন্যে প্রশিক্ষিত করে তোলাই! ফলে, চিন্তা ঠিক ভাবে করা, চিন্তাকে আয়ত্বের মধ্যে রাখা, চিন্তাশীল হওয়ার জন্যে মনকে প্রশিক্ষিত করা বা একরকম শিক্ষাচর্চার মধ্য দিয়ে যাওয়াটা খুব জরুরী বা আবশ্যক। আর, অনিয়ন্ত্রিত মন মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলতেই পারে। এই সমাজে বাস করতে গেলে অনেক সময়ই আমাদেরকে নিজের উপরে লাগাম টানতে হয়, নিজের উপরে লাগাম টানা মানেই হচ্ছে নিজের মনের উপরে লাগাম টানা! মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, সেই লাগাম ছাড়া হয়ে যায়, ফলে বিভ্রান্তি আসতেই পারে।
৭। বুদ্ধ: তোমাদের সবাইকে সদয়, জ্ঞানী ও সঠিক মনের অধিকারী হতে হবে। যতই বিশুদ্ধ জীবনযাপন করবে, ততোই উপভোগ করতে পারবে জীবনকে।  
লুক্স: জ্ঞানী এবং সদয় হওয়ার উপদেশটা সঠিক। তবে বিশুদ্ধ জীবন বিশ্বের এক এক অঞ্চলে এক এক রকম। যেমন লিভটুগেদার বা সমকামী জীবন বিশ্বের বিরাট অঞ্চলে এবং বিশুদ্ধ বলে বিবেচিত হয়, যা অতীতে বিশুদ্ধ বলে গ্রহণযোগ্য ছিলো না।  
নাধঃ  এখানে বিশুদ্ধ জীবন বলতে গৌতম বুদ্ধ কি বুঝিয়েছেন, তা এই বানী পড়েই বুঝা কঠিন। লুক্স বিশুদ্ধ জীবন বলতে নৈতিক ও ন্যায় সঙ্গত জীবন হিসেবে ধরে আলোচনা করেছেন, সেই অর্থে ধরে নিলেও গৌতম বুদ্ধের এই বানীর মাঝে ভুল নেই, মানে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নৈতিকতার বিভিন্নতার কারণে জীবনকে উপভোগের এই উপদেশটা বাতিল হয়ে যায় না! কেননা, স্থান - কাল ভেদে নৈতিকতা পাল্টাতে পারে, কিন্তু কোন এক কালে ও স্থানে বা সমাজ-সংস্কৃতিতে বাস করা কেউ যদি তার স্থান-কাল-সমাজ-সংস্কৃতি অনুযায়ী নৈতিক জীবনযাপন করতে পারে, তাতেও তার পক্ষে জীবনকে উপভোগ করা সম্ভব! ব্যভিচার বা সমকামিতাকে যারা অনৈতিক - অন্যায় - পাপ হিসেবে বিবেচনা করে, তারা যখন ব্যভিচারিতা, সমকামিতায় লিপ্ত হয়, তখন কি তার নৈতিকতা ও মূল্যবোধের জায়গা বা পাপবোধের ধারনা একইরকম রেখে, সেই জীবনকে উপভোগ করা সম্ভব হয়, নাকি নানারকম অপরাধবোধ, নিজের উপরে ধিক্কার, মনোযন্ত্রণা, অবদমন, বিকৃতি এসে সেই উপভোগকে ক্ষতিগ্রস্তও কখনো কখনো করতে পারে?
৮। বুদ্ধ: আমরা অনেকেই একটা কিছুর সন্ধানে পুরো জীবন কাটিয়ে দেই। কিন্তু তুমি যা চাও তা হয়তো এরইমধ্যে পেয়েছ। সুতরাং, এবার থামো।

লুক্স: সৎ বা বৈধ পথে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বা অঢেল অর্থ উপার্জন অন্যায় বা খারাপ কিছু নয়, চমৎকার একটা বিষয়। আপনার কাছে যতো বেশি অর্থ থাকবে আপনি জীবনকে উপভোগ এবং দরিদ্রকে সাহায্য করতে পারবেন ততো বেশি। 

নাধঃ এই থামতে জানার উপদেশটাও একটা চমৎকার উপদেশ! বুদ্ধের বানীর জবাবে লুক্স যখন অর্থকড়ির পেছনে সারাজীবনে ছুটার উপকারিতা বিবৃত করেছেন, তখনই আসলে গৌতম বুদ্ধের প্রথম স্টেটেমেন্টের সত্যতা প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, আসলেই আমাদের অনেকে এরকম একটা কিছুর সন্ধানে পুরো জীবন কাটিয়ে দেই। এই ছুটতে গিয়ে, চাওয়ার অনেক গুণ বেশি পাওয়ার পরেও আমাদের ছুটা থামে না, যত পেতে থাকি, চাওয়ার পরিমাণ ততই বাড়তে থাকে, ফলে জীবনটাকে আমরা আসলে সেভাবে আর উপভোগই করতে পারি না। লুক্স জানিয়েছেন, যত বেশি অর্থ থাকবে, তত বেশি জীবনকে উপভোগ করা সম্ভব, কিন্তু এই অর্থ উপার্জনের নেশা কখনো কখনো এমনই অর্থহীন নেশায় পরিণত হয়ে যায় যে, সেই উপভোগের কথাটাও আর মাথায় থাকে না! ফলে, উপভোগ করার জন্যেও তো একটু খানি থামাটা দরকার, নয় কি? আর, অর্থ বেশি উপার্জন করলে দরিদ্রকে সাহায্য বেশি করা যায় - এই আলাপটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিথ্যা ও ধোঁকা! কেননা, ধনসম্পদ অর্জন মানেই হচ্ছে, অন্যকে ঠকিয়ে, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করেই বিপুল অর্থ উপার্জন করা, মানে অন্যের গরীব হওয়ার মাঝেই আছে আরেকজনের ধনী হওয়ার মূল সূত্র। ফলে, অন্যকে গরীব বানিয়ে অঢেল অর্থ কড়ি কামিয়ে সেখান থেকেই কিছু অর্থ দান খয়রাতি করে আসলে গরীবকে সাহায্য করা হয় না, বরং নিজের ধনী ও অন্যের ফকিরি স্ট্যাটাসকেই গর্ব সহকারে দুনিয়ার সামনে প্রচার করা হয়! যেভাবে পশ্চিম ইউরোপ পুরা কয়েকশ বছর ধরে উপনিবেশগুলো থেকে লুটতরাজ করে আর দাসব্যবস্যার মাধ্যমে জমা করা সম্পদের উপরে ভর করেই যে ধন-সম্পদ-সভ্যতা অর্জন করেছে, সেই ধন-সভ্যতা-জ্ঞান এখন তাদের শোষণ-নিষ্পেষণে গরীব হওয়া দুনিয়ার দেশগুলোতে ফেরি করে, গরীবদের অনুদান - ঋণ - বিনিয়োগ - সাহায্যের নামে এভাবে আসলে একদিকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বই প্রচার করছে, অন্যদিকে নিজের বাজারকে প্রসারিত করছে!

৯। বুদ্ধ: সুখের জন্ম হয় মনের গভীরে। এটি কখনও বাইরের কোনো উৎস থেকে আসে না। 
লুক্স: সুখের জন্ম হয় না, সুখ অর্জন করতে হয়। সুখ হচ্ছে মানুষের কর্ম ফল।
 

নাধঃ সুখের ধারণা আসলে বিচিত্র ও ব্যক্তিভেদে স্বতন্ত্র। যেমনঃ লুক্সের মতে সুখ হচ্ছে মানুষের কর্মফল। কারো কাছে সুখ হচ্ছে - কোন কিছু অর্জন, মানে তীব্র ভাবে চাওয়া কোন কিছু পাওয়া। কারোর কাছে আবার সুখ হচ্ছে, ভোগ। একটা ভালো স্বাদের খাবার খেয়ে কেউ সুখ লাভ করে, কেউ দামি গয়নায় সুখ লাভ করে, কেউ বা নিরিবিলিতে একটু বিশ্রামে সুখ লাভ করে, কেউ ঘুরে বেড়িয়ে সুখ পায়, কেউ বা গান বাজনা করে সুখ পায়, কেউ গানবাজনা শুনে সুখ লাভ করে। কেউ মনের আনন্দে ছবি এঁকে সুখ পায়, কেউ একটা খেলা দেখে সুখ পায়, আবার কেউ বা খেলে সুখ পায়। অনেকে আবার অন্যের মুখে হাসি দেখে সুখ পায়, অন্যের মুখে হাসি ফুঁটাতে পারলে সেই সুখের মাত্রা তীব্র হয়, আবার অনেকে অন্যকে খেপিয়ে, অন্যকে বিপদে ফেলে, অপদস্থ করে - বেকায়দায় ফেলেও সুখ পায় (ইউটিউবে জাস্ট ফর লাফ এর প্রাঙ্ক ভিডিও দেখলেও বুঝা যাবে, মানুষ কিসে হাসে)! ফলে, সুখের ধারণা বিচিত্র ও বিভিন্ন। সবার জন্যেই সুখলাভ একই রকমভাবে কাজ করে না। লুক্স যেমন কাজের ফল দেখে সুখ লাভ করেন, তেমনি তার পাশের একজনকে হয়তো দেখবেন কাজের কর্মফলের চাইতে বরং কাজের ফাঁকে পাওয়া বিশ্রামের সময়টিই তার কাছে অনেক বেশি সুখময়! আমার যেমন খেলা দেখতে অনেক ভালো লাগে, আমার সন্তানদের নিয়ে যখন বার্সেলোনা - রিয়াল মাদ্রিদ বা ব্রাজিল - আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে বসি, কিছুক্ষণ দেখার পরে তারা উশখুশ করে উঠে গিয়ে একটা ভিডিও গেম খেলতে বসে যায়। মানে, এক্সবক্স, পিএস-ফোর এগুলোতে খেলতে তারা অনেক ভালোবাসে। ফুটবল খেলা তবু কিছুক্ষণ তারা দেখে, ক্রিকেট তো একদমই পছন্দ করে না - নিয়ম কানুন বুঝিয়ে দেয়ার পরেও তারা এক মুহুর্ত বসে দেখতে চায় না। আমি একটা ভালো টেস্ট ম্যাচ পাঁচদিন ধরে আগ্রহ ও আনন্দের সাথে দেখি, এবং এতে যে সুখ লাভ করি, অনেক ইউরোপিয়ান বন্ধু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে- এত ধৈর্য ধরে কিভাবে এই খেলা দেখতে পারি! কোক স্টুডিও'র একটা গান নিয়েই যে কত জনের কত মত, কারো তীব্র ভালো লাগে - সেই গান শুনে কত সুখ পায়, আবার কারোর কাছে একই গান একদম অখাদ্য লাগে, সুখ তো দূরের কথা, প্রচণ্ড বিরক্ত হয়! তাহলে, প্রশ্ন হচ্ছে - একই জিনিস যখন একজনকে সুখ দিচ্ছে, আরেকজনকে সুখ দিচ্ছে না, তাহলে এই সুখ পাওয়া বা না পাওয়ার পার্থক্যটা হচ্ছে ঠিক কোন জায়গায়? দুটা মানুষের সুখের অনুভূতিটি কোন জায়গাটিতে গিয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে? এর জবাব পাওয়া যাবে, আরেক প্রশ্নে- মানুষের সুখের অনুভূতি তৈরি হয় কোথায়? জবাব হচ্ছে, মানুষের মনে তথা লুক্সের ভাষায় মস্তিস্কে। ফলে, গৌতম বুদ্ধের বলা "সুখের জন্ম হয় মনের গভীরে" - কথাটার মাঝে কোন ভুল নেই (সুখ অর্জন করতে হলেও সেটা তো কোথাও না কোথাও বা কোন মুহুর্তে তৈরিই হয়, ফলে সেই অর্থে সুখের জন্মও হয়)! এখন "সুখের জন্ম মনে" -এমনটা না বলে গৌতম বুদ্ধ কেন বলেছেন, এর জন্ম "মনের গভীরে", বা এই "মনের গভীর" বলতে আসলে কি বুঝায়? এটা বুঝায় - কষ্ট বা সুখের অনুভূতিটা আমাদের মনের সচেতন অংশে অবস্থান করে না। মানে, আমার ইচ্ছা হলো, আর আমি একটা ফুল দেখে সুখ অনুভব করবো, বা অন্য একজনের পড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে আমার দুঃখই পেতে হবে, এভাবে এগুলো কাজ করে না। এগুলো অনেকটা স্বয়ংক্রিয় বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে আসে। অর্থাৎ, এই যে অচেতন বা অবচেতন লেভেল বুঝাতেই "মনের গভীর" শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয়। অতএব, "সুখের জন্ম হয় মনের গভীরে" - এই বানীর সাথে দ্বিমত করার কোন উপায় নেই। তবে, গৌতম বুদ্ধের বানীর দ্বিতীয় অংশের সাথে আমি একমত নই! সুখ বা দুঃখ মনের গভীরে জন্ম নিলেও, মনের বাইরের কোন উৎস বা বিষয়ের সাথে সুখের সরাসরি সম্পর্ক। উপরের আলাপে সুখ লাভের যত উদাহরণ দিয়েছি- সবই আসলে মনের বাইরের বিষয়-আশয় বা ঘটনাই! বাইরের জগৎকে বাদ দিয়ে সুখ কিংবা দুঃখের কোন অস্তিত্বই আসলে নেই!

১০। বুদ্ধ: জীবনের খুব কম মানুষের জীবনে পরিপক্কতা আসে। সঙ্গী হিসেবে এই পরিপক্কতাকে তোমার অর্জন করতে হবে। তবে তা ভুল মানুষকে অনুসরণ করে নয়। এই পরিপক্কতা অর্জনে বরং একলা চলো নীতি অনুসরণ করো।

লুক্স: একদম বাজে কথা। একলা চললে আপনি কখনোই মানুষ চিনতে পারবেন না। জীবনে পরিপক্বতা বা মানুষ চেনার জন্য আপনাকে প্রচুর মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, কাজ করতে হবে, বন্ধুত্ব করতে হবে এবং প্রেম করতে হবে।

নাধঃ মোটেও বাজে কথা নয়, বস্তুত লুক্স বুদ্ধের বানী বুঝতেই ভুল করেছেন বলে ধারণা করি। কেননা, গৌতম বুদ্ধ এখানে মানুষের সাথে মিশতে, কাজ করতে, বন্ধুত্ব করতে, প্রেম করতে মোটেও মানা করেননি। তিনি যখন বলেছেন, "সঙ্গী" হিসেবে পরিপক্কতা অর্জন করতে, তখন পরিস্কারভাবে বুঝতে পারা উচিৎ যে, "সঙ্গী" হওয়ার ব্যাপারে গৌতম বুদ্ধের কোন নিষেধ বা মানা নাই। তাহলে, এই বানীর মাধ্যমে গৌতম বুদ্ধ কি বুঝাতে চেয়েছেন? "জীবনের পরিপক্কতা" অর্জন করতে বলেছেন, যেটি খুব অল্প মানুষের মাঝে আসে। এখন জীবনের পরিপক্কতা অর্থ কি? জ্ঞানে ও বোধে সফলকাম হওয়া, হতে পারে বোধিসত্ত্ব লাভ করা। প্রথমত, গৌতম বুদ্ধ জীবনের পরিপক্কতা অর্জনের যে উপদেশ দিয়েছেন, সেই উপদেশের উদ্দেশ্যও সাথে সাথে বলেছেন, "সঙ্গী" হিসেবে পরিপক্কতা অর্জন করতে হবে। মানে, এই পরিপক্কতা অর্জনকারী ব্যক্তি যার সঙ্গী হবে, তার উপকারে বা কাজে লাগবে। দ্বিতীয়ত, এই পরিপক্কতা অর্জন করার পথ তিনি বাতলে দিয়েছেন, সেখানে তিনি বলেছেন - ভুল মানুষকে অনুসরণ করে পরিপক্কতা অর্জন করা সম্ভব নয়! তারপরেই যখন একলা চলো নীতি অনুসরণের কথা বলেছেন, সেটা হচ্ছে পরিপক্কতা অর্জনের জন্যে কাকে বা কার পথ অনুসরণ করবেন, সেই প্রসঙ্গে। অর্থাৎ, মানুষ চেনার জন্যে (এবং সমাজে চলার ও সমাজকে চালিয়ে নেয়ার জন্যেই) প্রচুর মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, কাজ করতে হবে, বন্ধুত্ব করতে হবে, প্রেমও করতে হবে; কিন্তু পরিপক্কতা অর্জনের জন্যে কাউকে অনুসরণ করতে হলে সঠিক মানুষকেই অনুসরণ করতে হবে, ভুল মানুষকে অনুসরণ করে পরিপক্কতা অর্জন যেহেতু সম্ভব নয়, সেহেতু দরকারে কাউকেই অনুসরণ না করে, একলাই পরিপক্কতা অর্জনের চেস্টা করতে হবে, যদি অনুসরণ করার মত কোন সঠিক মানুষকে পাওয়া না যায়!
১১। বুদ্ধ: করুণাই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি।

লুক্স: করুণা অবশ্যই শক্তি এবং মহৎ গুণ। তবে করুণা সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি নয়। আধুনিক মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হচ্ছে - সুস্থতা, জ্ঞান, দক্ষতা আর টাকা। 

নাধঃ  এটা আসলে মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীর উপরে নির্ভর করে। কেউ ভাবতেই পারে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি অর্থ, কেউ ভাবতে পারে জ্ঞান, আবার কেউ (কোন পুরুষ) ভাবতে পারে নারী! গৌতম বুদ্ধের মতে - সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হচ্ছে করুণা (compassion)। একজন দার্শনিক ও ব্যক্তি মানুষের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে, দার্শনিক বৃহত্তর মানুষের তথা সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করতে পারেন, একজন ব্যক্তি মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে পারে না। ফলে, আমরা যদি তুলনা করি, গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা (করুণাই সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি) আর কোন ব্যক্তি মানুষের শিক্ষা (টাকা, টাকা উপার্জনের দক্ষতা এবং নারী হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি) দুটির মাঝে কোন শিক্ষা সমাজে বেশি প্রচারিত হলে দুনিয়াটা সুন্দর হতে পারে? আমি গৌতম বুদ্ধের এই বক্তব্যের সাথে বস্তুত একমত, কেননা গৌতম বুদ্ধ কোন মানুষের জন্যে কোনটি সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি, সে সম্পর্কে বলেননি, বরং বলেছেন - "বিশ্বের" সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি সম্পর্কে। এই বিশ্বের বুকে আমাদের মানব সমাজ টিকেই থেকেছে বস্তুত পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতির উপরে, যেখানে এই "করুণা" বা কম্প্যাশন এর ভূমিকা মুখ্য! টাকা বা মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা তো এসেছে এই সেদিন, তারও আগে বড় সময় ধরে মানুষ প্রকৃতির প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টিকে থেকেছে, আজকের অবস্থানে যে এসেছে, তার মূলেই আছে - একে অপরের প্রতি করুণা। প্রকৃতির বিরূপতার মাঝে থাকলেই সার্ভাইবেল অব দ্য ফিটেস্ট এর মর্মটা সবচেয়ে ভালো বুঝা যায়। তারপরেও সেই মানুষ সবচেয়ে অবলা - সবচেয়ে দুর্বল শিশুকে ত্যাগ করেনি, গর্ভাবস্থায় থাকা দুর্বল নারীকে ত্যাগ করেনি, এমনকি রোগগ্রস্ত, আহত, বৃদ্ধদেরও একান্ত বাধ্য না হলে ত্যাগ করেনি, বরং গোষ্ঠীগুলোতে সবলরা পশুশিকার, ফলমূল সংগ্রহ করে যৎসামান্য যা কিছু পেত, সব একাই না খেয়ে গুহায় বা আবাসস্থলে ফিরে সেগুলো দুর্বলদের সাথে, শিশুর সাথে, রোগগ্রস্তের সাথে শেয়ারও করতো। এবং এই যুথবদ্ধ জীবনযাপনই আসলে মানুষকে প্রকৃতির সেই তুমুল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রেখেছে, মানব প্রজাতি এভাবেই টিকে থেকেছে। ফলে, সমগ্র মানব সমাজের আলাপ যদি করা হয়, করুণার উপরে শক্তি আর কি থাকতে পারে? আজকেও যখন গোটা বিশ্বের উপরে ছড়ি ঘুরানো মানুষের আলাপ করি, যেখানে টাকা - সম্পত্তির লোভ বা ব্যক্তি মানুষের সুস্থতা - দক্ষতা এসবের পেছনে ছুটে চলা যখন বিশ্বটাকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তখন মানুষের এই করুণা বা কম্প্যাশন, অন্য মানুষের প্রতি কম্প্যাশন, পশুপাখির প্রতি কম্প্যাশন, গাছের প্রতি কম্প্যাশন, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ এর প্রতি কম্প্যাশন এর গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। ফলে, বিশ্বের প্রেক্ষাপটে করুণাই তো সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি, নয় কি?

১২। বুদ্ধ: সুখ কখনও আবিষ্কার করা যায় না। এটি সবসময় তোমার কাছে আছে এবং থাকবে। তোমাকে কেবল দেখার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। 
লুক্স: ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের মতো জাতিগুলো তাদের সুখ ঠিকই আবিষ্কার করেছে শিক্ষা, বিজ্ঞান, আর পরিশ্রমের মাধ্যমে। 
 
নাধঃ  ফিনল্যাণ্ড, ডেনমার্ক, নিউজিল্যাণ্ড, সুইজারল্যাণ্ডকে যে হ্যাপিনেস ইন্ডেক্সের ভিত্তিতে সুখী দেশ হিসেবে চিত্রিত করা হয়, সেই সুখ আর গৌতম বুদ্ধের বলা ব্যক্তি পর্যায়ের সুখ একই বিষয় নয়। হ্যাপিনেস ইনডেক্স নির্ধারণের ক্রাইটেরিয়াগুলো হচ্ছে মাথাপিছু জিডিপি, সোশাল সাপোর্ট, সুস্বাস্থ্য তথা লাইফ এক্সপেক্টেন্সি, স্বাধীনতা, উদারতা এবং দুর্নীতিহীনতা। এগুলোকে কোন দেশের নাগরিককে সুখী হিসেবে চিত্রিত করার ক্রাইটেরিয়া বলে ধরা যেতেই পারে, কিন্তু ব্যক্তি মানুষের সুখ সবসময় এসবের উপরে নির্ভর করে না। একজন ধনী ব্যক্তি দুঃখী হতে পারে, তেমনি একজন হতঃদরিদ্র ব্যক্তিও সুখী হতে পারে। যাই হোক, গৌতম বুদ্ধের এই বানীটি নয় নাম্বার পয়েন্টে উল্লেখ করা বানীরই (সুখের জন্ম মনের গভীরে) পুনরুল্লেখ। সেই পয়েন্টেই বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আগেই জানিয়েছি, আমি গৌতম বুদ্ধের এই চিন্তার সাথে পুরোপুরি একমত নই। জাহান্নামের আগুনে পুস্পের হাসি কেউ কেউ হাসতে পারলেও, মানুষের সুখের হাসির জন্যে আমি জাহান্নামকে জান্নাতে পরিণত করার প্রয়োজনও দেখি।
১৩। বুদ্ধ: রেগে যাওয়া মানে নিজেকেই শাস্তি দেওয়া। 
লুক্স: এই কথাটা এখনো সঠিক। তবে এটা সারাবিশ্বের মানুষই এটা জানে বুদ্ধের দর্শন না পড়েই।
 
নাধঃ  সারাবিশ্বের মানুষ বুদ্ধের দর্শন না পড়েই এটা জানলে, বুদ্ধের দর্শনটি ভুল, অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় কি?
১৪। বুদ্ধ: জীবনে ব্যথা থাকবেই, কিন্তু কষ্টকেই ভালোবাসতে শেখো। 
লুক্স: এটাও সুন্দর কথা। তবে প্রতিটি মানুষ এটা তার অভিজ্ঞতা থেকেই শেখে। যেমন আইয়ুব বাচ্চুও শিখেছিলেন।
 
নাধঃ  প্রতিটা মানুষ যদি অভিজ্ঞতা থেকে শিখেও থাকে, তাতে গৌতম বুদ্ধের শিক্ষাটা ভুল হয়ে যায় না! আমি অবশ্য, গৌতম বুদ্ধের এই শিক্ষার সাথে একমত নই। কষ্টকে ভালোবাসার কিছু নেই, কষ্টবিলাসিতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। কষ্টকে ভালো না বেসে বরং তাকে অতিক্রম করার চেস্টা করা উচিৎ, কষ্টের কারণগুলো দূরীকরণের ব্যবস্থা নেয়া ও লড়াই - সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া বেশি জরুরী।
১৫। বুদ্ধ: অনেক মোমবাতি জ্বালাতে আমরা কেবল একটি মোমবাতিই ব্যবহার করি। এর জন্য ওই মোমবাতিটির আলো মোটেও কমে না। সুখের বিষয়টিও এমনই।

 লুক্স: এটা সুন্দর এবং চিরন্তন কথা। এটাও সারাবিশ্বেই জনপ্রিয় একটা প্রবাদ যা বুদ্ধকে না লিখলেও হতো।

নাধঃ সুন্দর ও চিরন্তন কথা, সারাবিশ্বে যা জনপ্রিয়, সেটা কেন বুদ্ধকে না লিখলেও হবে? বুদ্ধ এমন সুন্দর কথা বলায়, লুক্সের পক্ষে সমালোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই কি বুদ্ধ কেন এমন কথা লিখলেন বলে হাপিত্যেশ করছেন? সারাবিশ্বের অসংখ্য জনপ্রিয় প্রবাদ কি কেউ না কেউ কখনো লিপিবদ্ধ করেননি বা বলেননি? গৌতম বুদ্ধ আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে যে এমন কথা বলেছেন, মানুষের মাঝে এক মোমবাতি থেকে আরো অনেক মোমবাতিতে আলো ছড়ানোর মত করে- সুখকে ছড়িয়ে দেয়ার আহবান জানিয়েছেন, এভাবে অন্য মানুষের মাঝে সুখ ছড়িয়ে দিলে নিজের সুখ কমে না যেভাবে মোমবাতি দিয়ে অনেক মোমবাতির আলো জ্বালানোতে সেই মোমবাতির আলো এতটুকু কমে না! এই উপদেশটিকে এভাবে দারুণ এক উপমা সহকারে বলা এবং সেই আড়াই হাজার বছর আগের মানুষের মাঝে এই শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়ার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও এখনও এর প্রাসঙ্গিকতা- সব মিলে তো মুগ্ধ না হয়ে পারি না।
১৬। বুদ্ধ: অন্যকে কখনও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করো না, নিয়ন্ত্রণ করো কেবল নিজেকে।

লুক্স: আধুনিক রাষ্ট্র আইন ও সংবিধানের মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে। তা না হলে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।

নাধঃ সমাজ সংগঠন, রাষ্ট্র যে আইন - কানুন - নিয়ম - নীতির মাধ্যমে মানুষের মাঝে একরকম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, সেটার মূলেও আছে, বৃহত্তর স্বার্থে সমাজের সকলে মিলে নিজেদেরকেই নিয়ন্ত্রণ করা। এটা ভালো বুঝবেন, অন্য কোন সমাজ বা রাষ্ট্র এসে যখন একটা আইন চাপিয়ে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে, সেটা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলা হয় না, বরং পরাধীনতাই বলা হয়! একই ভাবে, ব্যক্তি পর্যায়েও একজন আরেকজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারোরই থাকতে পারে না। ফলে, সমাজ ও রাষ্ট্রও আসলে তার কোন মানুষকে অপর মানুষকে নিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয় না। প্রকৃত আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তো জনগণের উপরে ক্ষমতাবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাও করে, সেই অর্থে বর্তমান দুনিয়ায় প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে কিছু নেই, যেহেতু রাষ্ট্র মাত্রই শাসকশ্রেণীর হাতে ক্ষমতা কুক্ষীগত করার প্রতিষ্ঠান!
১৭। বুদ্ধ: আলোকিত হতে চাইলে প্রথমে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করো। 
লুক্স: আবারও সেই মন। আলোকিত হলে চাইলে লোভ আর অভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। লোভী আর দরিদ্র মানুষের আলোকিত হওয়ার সুযোগ কম।
 
নাধঃ আবারও একইভাবে মনকে অস্বীকার! মানুষের "মন" বলে কিছু নেই - এটি একেবারেই ভুল আলাপ। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আগেই করেছি। লুক্স আলোকিত হওয়ার জন্যে শুরুতেই যেটির কথা বলেছেন, সেই "লোভ"কে নিয়ন্ত্রণ করার অর্থই হচ্ছে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করা, কেননা লোভের সৃষ্টিই হচ্ছে মানুষের মনে। আর, যেহেতু মানুষের "অভাব" সৃষ্টির পেছনে রয়েছে অসাম্য - অন্যায্য - অন্যায়ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা, ফলে অভাবকে নিয়ন্ত্রণ করার কিছু নেই, অভাব দূরীকরণের জন্যে আয়-উপার্জনের পেছনে ছুটতে হয়, কখনো কখনো লোভীও হতে হয়, নতুবা সমাজের অসাম্য - দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে হয়! লোভী মানুষের পক্ষে আলোকিত হওয়া সম্ভব না হলেও, অর্থ-সম্পদের দিক দিয়ে দরিদ্র মানুষের আলোকিত হওয়া সম্ভব, নির্লোভ দরিদ্র ব্যক্তিই প্রকৃত প্রস্তাবে আলোকিত মানুষ হয়ে উঠেন।
১৮। বুদ্ধ: এই তিনটি সর্বদা দেখা দেবেই: চাঁদ, সূর্য এবং সত্য।

লুক্স: এই কথাটা নিয়ে জোকস করা যায়। যেমন, বাংলাদেশে ঈদের চাঁদ একদিন পরে দেখা দেয়, উত্তর মেরুতে সূর্য ৬ মাস পর পর দেখা দেয়, এবং ঈশ্বর জীবনেও দেবেন না, যাকে ধর্মান্ধরা সত্য বলে দাবী করে।

নাধঃ কোন কথা বা বানীকে নিয়ে কৌতুক করার আগে সেই কথাটা বুঝা দরকার, নাহলে এরকম কৌতুক প্রচেস্টাই আসলে হাস্যকর বা কৌতুককর হয়ে দাঁড়ায়। গৌতম বুদ্ধ যখন বলেছেন, "সর্বদা দেখা দেবেই" - তার অর্থ এই নয় যে প্রতি মুহুর্তে বা প্রতিটা সেকেণ্ডেই সেটা দেখা দিবে। চাঁদ দিনের বেলা দেখা যায় না, অমাবস্যায় দেখা দেয় না, মেঘলা আকাশে দেখা যায় না, তারপরেও একদিন না একদিন সে দেখা দেয়ই। একইভাবে সূর্যকে রাতের বেলা দেখা যায় না, বর্ষাকালে দিনের পর দিন মেঘের আড়ালে থাকে, শীতেও কোন কোন দিন কুয়াশায় ঢেকে থাকে। কিন্তু একটা সময় রাত শেষে দিন হয়, আঁধার দূর হয়, মেঘ কেটে যায়, কুয়াশা দূর হয়, সূর্য ওঠে। ফলে, ঈদের চাঁদ একদিন পরে উঠলে, কিংবা মেরুতে ছয় মাস পরে সূর্য দেখা দিলেও - চাঁদ বা সূর্য শেষ পর্যন্ত আসেই বা দেখা দেয়ই! চাঁদ - সূর্য আসলে এই বানীতে উপমা, গৌতম বুদ্ধ বলতে চেয়েছেন, চাঁদ - সূর্য যেভাবে দেখা দেয়, সত্যও একটা সময়ে দেখা দেয়। মিথ্যা অনন্ত কালের জন্যে টিকে থাকতে পারে না! মানুষের সত্যানুসন্ধানের ক্রমাগত প্রচেস্টাই মানুষকে সত্যের দিকে ধাবিত করে। এখানে, কৌতুক করতে গিয়ে ঈশ্বর প্রসঙ্গ যেটি লুক্স এনেছেন, সেটাও বড় হাস্যকর হয়েছে, কেননা ঈশ্বর জীবনেও দেখা দিবে না, কারণ সেটি সত্য নয় - ফলে এই উদাহরণটির মাধ্যমে বুদ্ধের বানীকেই লুক্স প্রমাণ করলেন মাত্র! লুক্সকে আসলে গৌতম বুদ্ধের এই বানীকে ভুল, অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক দেখাতে হলে, কোন মিথ্যাটি জীবনেও দেখা দেয়নি- সেটা বললে হবে না, বরং এমন কোন সত্যকে দেখাতে হবে, যেটি জীবনেও দেখা দেয়নি! আমি অবশ্য গৌতম বুদ্ধের মত এত আশাবাদী নই, আমি জানি বিচারের বানী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে, কত শত মানুষ মিথ্যার অভিযোগ কাঁধে নিয়ে প্রাণ দিয়েছেন, তার জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর পরেও হয়তো সত্য উদঘাটিত হয়নি। এখনও দুনিয়াজুড়ে মিথ্যার জয়জয়কার দেখি! এসবই অনেক হতাশ করে, সেই হতাশা কাটিয়ে তুলতে গৌতম বুদ্ধের এমন বানী অনেক সাহায্যও করে। তখন পৃথিবীর ইতিহাসে অসংখ্য মিথ্যাকে পরাভূত হয়ে- সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গল্পগুলো মনে পড়ে যায়, আশার আলোও দেখতে পাই!
১৯। বুদ্ধ: নিজের কথার মূল্য দিতে হবে নিজেকেই। কেননা, তোমার নিজের কথার ওপর নির্ভর করবে অন্যের ভালো কাজ কিংবা মন্দ কাজ।

লুক্স: গত এক সপ্তাহের আমার গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে লেখা পোস্টগুলোর কমেন্টে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নিজের কথাগুলো পড়ে দেখুন দয়া করে।  

নাধঃ  বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কথাগুলোর উপরে কি কোনভাবে গৌতম বুদ্ধের বানীর সঠিকতা, প্রয়োজনীয়তা বা প্রাসঙ্গিকতা নির্ভর করতে পারে? আর, গত এক সপ্তাহে লুক্সের বুদ্ধকে নিয়ে লেখা পোস্টগুলোর কমেন্টে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কথাগুলো যতখানি পড়েছি, তাতে মনে হয়েছে - গৌতম বুদ্ধের এই বানীর সঠিকতা ও প্রাসঙ্গিকতা যেন নতুন করে আবার প্রমাণিত হয়েছে। কেননা, লুক্স যা বলেছেন - তার মূল্য তিনি নিজেই দিচ্ছেন, এবং কমেন্টেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যা যা বলেছেন, তার মূল্যও তারা দিচ্ছেন। লুক্স যে ভুল, মিথ্যা ও অন্যকে হেয় - অশ্রদ্ধা করে যেসব কথা বলেছেন, তার জবাবই তিনি পাচ্ছেন, লুক্সের প্রতি যাবতীয় অশ্রদ্ধাসূচক বাক্যবাণের মূলে আছে লুক্সের সেই অসংলগ্ন ও খুব নিম্ন রুচি ও মানের পোস্টগুলো! আবার, এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যখন বৌদ্ধাবলম্বীদের কেউ কেউ গালিগালাজ করেছেন, লুক্সকে হুমকি-ধামকি দিয়েছেন, তখন আসলে সেগুলোর মূল্য তাদেরকেই দিতে হচ্ছে এভাবে যে, তারা নিজেরাই যে গৌতম বুদ্ধের শিক্ষার ধারেকাছেও নেই- তা প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, আর এভাবেই গৌতম বুদ্ধের পক্ষে লড়াই করতে এসে, গৌতম বুদ্ধের বানীগুলোকে চরম অশ্রদ্ধা করে নিজেরাই হাসির পাত্র হয়ে উঠেছেন! এটাকেই গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, একজনের কথার উপরে অনেক সময়ে আরেকজনের ভালো বা মন্দ কাজ নির্ভর করে। যেমনঃ লুক্সের বাজে পোস্টগুলো তাদের খারাপ কাজ, যেমন গালিগালাজ-হুমকি ধামকি দেওয়াতে ভূমিকা রেখেছে। আবার, অনেকেই যারা লুক্সের ভুল, মিথ্যা উন্মোচন করেছে, গৌতম বুদ্ধের সম্পর্কে ও বুদ্ধ দর্শন সম্পর্কে না জেনে না পড়েই যে লুক্স গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে এমন আজেবাজে ও ভুলভাল পোস্ট করেছে বলে সমালোচনামূলক কথা বলেছে, সেই কথার প্রভাবেই লুক্স বৌদ্ধ দর্শনের ৫ টা বই পড়ে ফেলেছেন, আরো ৫ টা বই অর্ডারও দিয়েছেন, অর্থাৎ ভালো কাজ করেছেন। বুঝতে পারছেন, কথার মূল্য? গৌতম বুদ্ধের বানী এভাবেই প্রমানিত হয়ে গেলো!

২০। বুদ্ধ: ঘৃণায় কখনও ঘৃণা দূর হয় না। অন্ধকারে আলো আনতে তোমাকে কোনো কিছুতে আগুন জ্বালতেই হবে।

লুক্স: বুদ্ধ আগুন যুগের মানুষ। তিনি জানতেন না যে, মানুষ একদিন বিদ্যুৎ আবিষ্কার করবে। 

নাধঃ হা হা, বুদ্ধ আগুন যুগের মানুষ বটেই, তাতে তো কোন সমস্যা নাই! যুগ অনুযায়ীই মানুষ কথা বলে, যুগের সাথে মিলিয়েই উপমাগুলো দেয়! উপমাগুলোর কার্যকারিতা কেবল মূল ভাবটি বুঝতে পারা পর্যন্ত, মূলভাবটি বুঝতে পারলে নিজের মত করে উপমাগুলো পাল্টানোও সম্ভব! ফলে, আজকের বৈদ্যুতিক বাতির যুগে অন্ধকারে আলো আনতে আগুন জ্বালানোর বদলে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর কথা বললেও - বস্তুত গৌতম বুদ্ধের উপদেশের মূলভাবটি একই থাকে। যেমনঃ কবি বলেছেন, "যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি" - এখানে মোমের বাতির যুগ এখনো আছে কি না - সেটা গুরুত্বপূর্ণ  নয়, বরং অপচয় করলে যে প্রয়োজনের সময়ে আর দরকারী বস্তু  পাওয়া যায় না, এই মূলভাবটাই এখানে আসল। আজকের যুগে যে অপ্রয়োজনে  বৈদ্যুতিক বাতি - পাখা ইত্যাদি জ্বালায় - চালায়, হয়তো দেখা যাবে, খুব প্রয়োজনের সময়ই তার বৈদ্যুতিক লাইনটি কাঁটা পড়ে বৈদ্যুতিক বাতি ও পাখা জ্বালাতে-চালাতে পারবে না - এভাবে বললেও- সেই একই ভাবটিই প্রকাশ পায়! ফলে, গৌতম বুদ্ধের উপমার যুগগত সীমাবদ্ধতা নিয়ে কৌতুক করে নিজেকে কৌতুককর করার চাইতেও বুদ্ধের বানীর মূলভাবের দিকে দৃষ্টি দেয়া দরকার। বানীটির মূলভাব হচ্ছে - ঘৃণা দিয়ে ঘৃণা দূর হয় না, যেভাবে দূর হয় না অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার। অন্ধকারকে দূর করতে গেলে যেমন আলো জ্বালানো দরকার যেমন (তা আগুন জ্বালিয়েই হোক আর বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়েই হোক), তেমনি ঘৃণাকে দূর করতে দরকার প্রেম - ভালোবাসা - সহানুভূতি - করুণা প্রভৃতি! এই মূলভাবের সাথে কি লুক্সের কোন দ্বিমত আছে?

২১। বুদ্ধ: আমরা প্রত্যেকেই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। একজন আরেকজনের পরিপূরক। অর্থাৎ সমাজে আমরা কেউ একা নই।

 লুক্স: অথচ একই বুদ্ধ ১০ নং দর্শনে মানুষকে একা থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।  

নাধঃ প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, ১০ নাম্বার বানীতে গৌতম বুদ্ধ যদি বিপরীত কথা বলে থাকেন, তাহলে এই বানী ও দশ নাম্বার বানীর মধ্যে অন্তত একটা তো সঠিক, প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক, নয় কি? আগের সেই বানীকে লুক্স খণ্ডিয়েছেন, কিন্তু এই বানীর বিপরীতে কিছু বলেননি, বিধায় ধরে নিচ্ছি - তিনি গৌতম বুদ্ধের এই বানীকে সঠিক বলেই মেনে নিয়েছেন। তাহলে, এই বানীকে ভুল, অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক দর্শন/ বানীর তালিকায় আলাদা পয়েন্ট হিসেবে উপস্থাপন করা কি উচিৎ কাজ হলো? নাকি, সেই দশ নাম্বার পয়েন্টেই দেখানো দরকার ছিলো যে, গৌতম বুদ্ধের অন্য বানীর সাথে ঐ বানীটি সাংঘর্ষিক বা বিপরীত! দ্বিতীয়ত, দশ নাম্বার পয়েন্টেই আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি, কিভাবে লুক্স গৌতম বুদ্ধের বানী বুঝতে ভুল করেছেন। গৌতম বুদ্ধ যে সেখানে মোটেও একা থাকার পরামর্শ দেননি, সেটা আরো বেশি করে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, তাঁর এই বানীতে। সেই বানীতে গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, পরিপক্কতা অর্জনে অনুসরণ করার জন্যে ভালো মানুষকে খুঁজতে হবে, না পাওয়া গেলে, একলা চলতে হবে। রবি ঠাকুর লিখেছেন, "যদি তো ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে" - এর অর্থ যদি কেউ করে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে সবাইকে হরে দরে যেকোন সময়ে একলা চলার বা একা থাকার পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা কি সঠিক বুঝ হবে?

২২। বুদ্ধ: খারাপটি সর্বদা তুমি নিজেই পছন্দ করছো। সুতরাং, তোমার খারাপ কাজের জন্য তুমি নিজেই দায়ী। এর দায়ভার অন্য কারো নয়।

লুক্স: বাংলাদেশে ক্ষেত্রে কথাটা সবসময় সঠিক নয়। কারণ আমরা শেখ হাসিনাকে পছন্দ করেছি তার কোনো বিকল্প নেই বলে।

নাধঃ "বাংলাদেশের ক্ষেত্রে" ও "সবসময়" এই বানী সঠিক নয়, তার মানে কি দুনিয়ার অন্য দেশে কথাটা সঠিক? বা, বাংলাদেশেও কখনো কখনো কথাটা সঠিক? আসলে, কোন কথাই তো সর্বকালের, সর্বস্থানের জন্যে সঠিক বা সত্য হয় না, সত্যের ধারণা মাত্রই আপেক্ষিক। সত্য বা সঠিকতা-বেঠিকতা, ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা হচ্ছে কালিক, স্থানিক। তবে, গৌতম বুদ্ধ তাঁর এই বানীটিকেই অনেক বেশি স্পেসিফিক করে দিয়েছেন, মানে এখানে থাকা "তুমি" বলতে এখানে যেকোন মানুষের ব্যক্তি সত্ত্বাকে বুঝানোর মাধ্যমে। ফলে, যেকোন কাজের ক্ষেত্রেই আসলে কাজটা যে নিজের পছন্দে করে, যে খুব বাধ্য না হয়েই কাজটা করে, সেই কাজের দায়ভারটা পুরোপুরি তারই। গৌতম বুদ্ধ এখানে এটাই বুঝাতে চেয়েছেন যে, কোন একটা খারাপ কাজ করার পরে, সেই কাজটা যে করেছে, সে কোনভাবে অন্য কারোর প্ররোচনা - বুদ্ধি - পরামর্শ, কিংবা পরিবেশ - পরিস্থিতির অযুহাত দিয়ে দায়মুক্তি পেতে পারে না! এখানে, শেখ হাসিনাকে পছন্দ করা, তার বিকল্প নাই -এমন ধরণের আলোচনাগুলোর সম্পর্ক কি, তা বুঝা ভার। আর, শেখ হাসিনাকে পছন্দ করা এই "আমরা"ই আসলে কারা, বাংলাদেশের কতজন আসলে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে, সেটাও বড় প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ যে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার দেয়ার সাহস করতে পারে না, তার পেছনেও আছে তাদের এই ভয় যে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতাটা ধরে রাখা সম্ভব হবে না! আর, আপনার এই আলাপের অর্থ যদি এটা বুঝান - শেখ হাসিনাকে যারা পছন্দ করার মত খারাপ কাজটা করেন, সেই খারাপ কাজের দায় আসলে তাদের না, বরং শেখ হাসিনার বিকল্প না থাকার মত বাস্তবতার, তাহলেও এই আলাপটা পুরোপুরি ভুল!
২৩। বুদ্ধ: তোমার চিন্তাই তোমার শক্তির উৎস। নেতিবাচক চিন্তা তোমাকে অনেক বেশি আঘাত করে যা তোমার ধারণায় নেই।
 
লুক্স: অশিক্ষিত মানুষের চিন্তা তার জীবন শক্তি হিসেবে কাজ করে না। 
 
নাধঃ লুক্স এই যে বললেন "অশিক্ষিত" মানুষের চিন্তা জীবন শক্তি হিসেবে কাজ করে না, তার কারণও হচ্ছে "চিন্তা"র একটা শক্তি আছে, সেই চিন্তাকে তাই "শিক্ষিত" করে তুলতে হয়, যাতে সেটা মানুষের জীবন শক্তি হিসেবে অধিক কাজে লাগতে পারে। এখন, লুক্স যদি এই "শিক্ষিত" বা "অশিক্ষিত" বলতে কেবল বুঝিয়ে থাকেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বা স্কুল - কলেজ - বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ করা আর পুঁথিগত শিক্ষায় "শিক্ষিত" বা "অশিক্ষিত", তাহলে তার আলাপটাই বরং ভুল। যেকোন মানুষের, শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, তার চিন্তাই তো আসলে তার জীবনের শক্তি হিসেবে কাজ করে। কেননা তার চিন্তাই তাকে কাজে কর্মে সমস্যা - সংকট মোকাবেলায় কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণে পরিচালিত করে, চিন্তাকে কাজে লাগিয়েই এগুতে হয়! ফলে, "অশিক্ষিত", "কম শিক্ষিত" হলে অনেক সময় চিন্তা করার তথা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বা সমস্যা সমাধানের সামর্থ্য কম থাকতে পারে, কিন্তু তারপরেও সে চিন্তা করে, সেই চিন্তা অনুযায়ী কাজ করে, সিদ্ধান্ত নেয়! সাথে এটাও বুঝা দরকার যে, শিক্ষা মানে কেবল "প্রাতিষ্ঠানিক" আর "পুঁথিগত" শিক্ষাই নয়। মানুষ তার চারপাশ থেকে জন্মের পর থেকেই শিখতে থাকে। তার মেমোরি সেলে যখন তথ্যাদি জমা হতে থাকে, সে শিখতে থাকে। জন্মের পরে যে গোটা দুনিয়াকে চিনতে থকে, একটা ভাষা আয়ত্ব করে ফেলে, এভাবেই তার চিন্তাটা গড়ে উঠে, মানে তার চিন্তা করার সামর্থ্য তৈরি হয়- চিন্তা শিক্ষিত হতে থাকে! একটা শিশুকে যখন কোন গাছ দেখিয়ে শেখানো হয় এটা গাছ, তারপরে সে যখন দুনিয়ার বিভিন্ন গাছ দেখে সেটাকে গাছ বলে চিহ্নিত করতে পারে, বুঝতে হবে - সেখানেও এই চিন্তার ভূমিকা আছে! সে গাছের সাধারণ বৈশিষ্টগুলোর সাথে মিলিয়ে বিশেষ একটা গাছকে চিহ্নিত করতে পারছে। এভাবে একদম প্রাথমিক পর্যায় থেকে অনেক জটিল পর্যায় পর্যন্ত চিন্তার রেঞ্জটা বিস্তৃত। এই চিন্তাশক্তি যেমন জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনেক রহস্য সমাধান করে ফেলতে পারে, তেমনি শিশু বেলাতে ঐ সবকিছুকে চেনা, আলাদা করা, ছোটখাট সমস্যা সমাধান করাও সেই শিশুর জন্যেও শক্তি হিসেবেই থাকে। একটা প্রাতিষ্ঠানিক বা পুঁথিগত শিক্ষা না পাওয়া "অশিক্ষিত" - "মুর্খ" কৃষকটা যখন প্রকৃতি দেখে দেখে ফসল ফলানোর সঠিক মৌসুম, মাটি, সার, সেচের পদ্ধতি বের করে ফেলে বা ধানের নতুন জাত তৈরি করে ফেলে, কিংবা একজন "অশিক্ষিত" গৃহিনী যখন নকশী কাঁথায় নতুন একটা নকশা বানিয়ে ফেলে- সেখানেও তার সেই চিন্তাই তার মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে বৈকি! এমনকি, এরকম উদ্ভাবনী চিন্তার দরকার নেই, দৈনন্দিন জীবনের প্রাত্যহিক সাধারণ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও তো আসলে মানুষের চিন্তাই মূল শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে। আর, বুদ্ধের এই বানীর দ্বিতীয় অংশ নিয়ে লুক্স কোন কথা বলেননি, তার মানে সেটাকে কি তিনি ভুল, অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক নয় মনে করেন না?
২৪। বুদ্ধ: তুমি মুখে কী বলছো সেটি কোনো বিষয় নয়, বিষয় হলো তোমার কাজ।  
লুক্স: এই কথাটাও সঠিক নয়। রাজনীতিবিদদের আর ক্ষমতাবানদের মুখের কথার শক্তি অনেক।
 
নাধঃ  কেন এই কথা সঠিক হবে না! মুখে অনেক কিছুই বলা যায়, মুখের কথায় তো আসলে কোন কিছুই নড়ে চড়ে না, কোন কিছু নড়াতে চড়াতে হলে কাজ করতেই হবে। রাজনীতিবিদদের আর ক্ষমতাবানদের যেই উদাহরণটা লুক্স দিয়েছেন, সেটাও বাস্তবে ভুল উদাহরণ। কেননা তাদের মুখের কথারও শক্তি অনেক বলে যে মনে হয়, তার পেছনে আছে কাজ! কেননা শুধু তাদের মুখের কথায় কোন কিছু হয় না, তাদের মুখের কথাকে কেউ না কেউ এসে কাজে রূপান্তর করে ফেলে! মানুষের দুনিয়াটা কোন কল্পজগৎ নয় যে, একজন মহাশক্তিধর কেউ "হও" বলবে, আর সব হয়ে যাবে! এমনকি সেই কল্পজগতেও তো দেখা যায়, "হও" বলার পরেও একগাদা পাইক-পেয়েদা-চাকর-বাকর তথা ফেরেশতাদের লাগে, সেই কাজগুলো সমাধা করার জন্যে! আবার, রাজনীতিবিদ বা ক্ষমতাবানরাও যে ক্ষমতার মালিক হয়েছে, তাদের মুখের কথাকে কাজে রূপান্তরিত করার মত বাহিনী তৈরি করা, বা মুখের কথাকে অন্যদের গণ্য করা - ভয় পাওয়া - এমন পরিস্থিতিটাও তৈরি করতে পেরেছে, তাদের কোন না কাজের মাধ্যমেই, হয়তো প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছে, মাসল পাওয়ার করেছে, কিংবা জনহিতকর কাজ করে বা জনগণের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে - যেভাবেই হোক যেই ক্ষমতা অর্জন করেছে, তার পেছনেও আছে কথা নয়, কাজেরই ভূমিকা! আর, গৌতম বুদ্ধের এই সাদামাটা উপদেশটা আসলে মানুষকে কথার বড়াই করার চাইতেও, বড় বড় কথা বলার চাইতেও কাজের মাধ্যমে কোন কিছু অর্জন করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে! সেখানে, কথার শক্তি কতটুকু, কথার কি কোন গুরুত্ব কিছু নাই, এমন আলাপগুলো হবে কুটতর্ক, কেননা গৌতম বুদ্ধ এখানে কথা বলার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা বা কথার শক্তিকে অস্বীকার করেননি, কেবল বলার চাইতে ক্রিয়া করার গুরুত্বকে সামনে এনেছেন (আগের আরেক বানীতে নিজের কথার মূল্য নিয়ে বলেছেন, তার সাথে মেলালেই বুঝা যাবে, তিনি আসলে এখানে কি বুঝাতে চেয়েছে)!
 
 
উপসংহারঃ গৌতম বুদ্ধের দর্শন সম্পর্কে জানতে, আলোচনা করতে, কিংবা সমালোচনা করতেও - কখনই এরকম ছোট ছোট খণ্ডিত, বিচ্ছিন্ন বানী পাঠ যথেষ্ট নয়! শুধু গৌতম বুদ্ধ নয়, যেকোন ব্যক্তিরই চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গী ও দর্শন সম্পর্কে ন্যুনতম ধারণাও যদি পেতে হয়, তা কোনভাবেই তার বিভিন্ন সময়ে করা আলোচনা বা কথা থেকে এক দুই বাক্যকে বিচ্ছিন্ন ভাবে তুলে ধরা বানী পড়ে সম্ভব নয় (এমনকি, আমি এই লেখাটিতেও লুক্সের কোট করা বুদ্ধের বানীগুলোর জবাব দিতে গিয়েও অনেকাংশেই বুদ্ধের এই খণ্ডিত - বিচ্ছিন্ন বানী আমার মনে কিভাব তৈরি করছে, তার ভিত্তিতে লিখেছি, যা বুদ্ধের মূল দর্শনচিন্তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে)। লুক্স বস্তুত গৌতম বুদ্ধকে খারিজ করার লক্ষে গৌতম বুদ্ধের দর্শন সম্পর্কে হাতড়ে বেড়িয়েছেন, হাতের কাছে পেয়েছেন গুগল, সেখানে সার্চ দেয়াতে চলে এসেছে গৌতম বুদ্ধের বানীর বিভিন্ন লিংক। কালের কন্ঠ সহ কয়েকটা ওয়েবসাইটে আমি পেলাম বুদ্ধের ৩১ টি বাণীর সংকলন (কালের কন্ঠ, ৮ জুলাই - ২০১৯: "এই ৩১ বাণী মনে রাখলে জীবন হবে সফল, শান্তিময়")। লুক্সের উল্লেখ করা বুদ্ধের ২৪ বানীর সবকটিই হুবহু সেখান থেকে কপি করা, অর্থাৎ সেই ৩১ টি বানীর মধ্যে যেগুলোকে খারিজ করা সম্ভব বলে লুক্সের মনে হয়েছে, সেগুলোকে তুলে ধরে তিনি আলোচ্য ফেসবুক পোস্টটা পয়দা করেছেন। এখান থেকেই প্রতিভাত হয় যে, লুক্স আসলে গৌতম বুদ্ধের দর্শন পাঠ করে গৌতম বুদ্ধের দর্শনকে ভুল, অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক হিসেবে আবিস্কার করেননি, বরং বুদ্ধের দর্শনকে আগে ভাগে ভুল, অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রসাঙ্গিক ধরে নিয়ে, তারপরে সেটা প্রমাণের লক্ষে তিনি এখানে ওখানে বুদ্ধের দর্শন বা বানী খুঁজে বেড়িয়েছেন। এতে করে, তিনি আসলে গৌতম বুদ্ধের কথা, বানী, দর্শন সম্পর্কে যতখানি যাই পাঠ করেছেন, তার মর্মোদ্ধ্বার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার চেয়েও ভয়ানক হচ্ছে, গৌতম বুদ্ধের দর্শনচিন্তা, তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে কোন রকম গভীর পাঠ ছাড়াই, এবং কেবল গুগলে পাওয়া এসব বিচ্ছিন্ন কিছু কথা বা বানী ভুলভাল "বুঝ" অনুযায়ী পাঠ করেই - তিনি সিদ্ধান্ত জানিয়ে ফেলেছেনঃ
"সত্যি কথা বলতে কি, উপমহাদেশের এই সময়ের সাধু-সন্ন্যাসীরা আড়াই হাজার বছর আগের গৌতম বুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞান রাখেন। আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি, আর সমাজনীতি নিয়ে তাদের জ্ঞান অনেক বেশি সময়োপযোগী। আর তাদের দার্শনিক ভাবনাও অনেক যৌক্তিক আর গভীর। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের দর্শনটা আসলে কী? আড়াই হাজার বছর আগের গৌতম বুদ্ধের জীবনী আর তার বাণী সমৃদ্ধ ত্রিপিটক এই আধুনিক সভ্য যুগে মানুষের কী কাজে লাগছে"।
কত বড় নির্লজ্জ হলে একজন বড় গলায় বলতে পারে যে, "আমি মূর্খ, আমি অশিক্ষিত, আমি পড়াশোনা করি না"- কিন্তু তা নিয়ে কোন লজ্জা নাই! এই লজ্জা নাই বলেই, পড়াশুনা না করেই - একজন দার্শনিকের জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে একজন এমন হাস্যকর প্রশ্ন তুলতে পারে বৈকি! আড়াই হাজার বছর আগের একজন দার্শনিকের জ্ঞানকে "আধুনিক বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি"র জ্ঞানের সাথে তুলনা করা যে কি পরিমাণ হাস্যকর, সেই সাধারণ বোধটিও লোপ পেয়ে যাওয়া একজন ব্যক্তি আবার গর্বের সাথে ঘোষণা করছেনঃ
"একজন সচেতন মানুষ হিসেবে সমাজের বিভিন্ন অসংগতি, অন্যায় আর ভন্ডামীর বিরুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত ফেসবুকে লিখি"।
লুক্স নিজের এই মূর্খামি ও অশিক্ষা ধরতে পেরে তা দূর করতে অবশেষে যে বৌদ্ধ দর্শনের উপরে ৫ টা বই পাঠ করলেন এবং আরো ৫ টা বই অর্ডার করলেন, তার জন্যে সাধুবাদ জানাই! খোলামনে বইগুলো তিনি পাঠ করবেন, জ্ঞান অর্জন করবেন, এবং এই বইগুলো পড়া শেষে আগের না পড়ে, না বুঝে, না জেনে যেসব ভুলভাল পোস্ট পয়দা করেছিলেন, সেগুলোর জন্যে অনুতপ্ত হবেন, এই প্রত্যাশাই করি।
 
সবাইকে এই বড় লেখাটি ধৈর্য সহকারে পাঠ করার জন্যে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।