সোমবার, ২৭ মে, ২০২৪

প্রসঙ্গ যাদুবিদ্যা ও অন্যান্যঃ বিশ্বাস বনাম অবিশ্বাস

এক
"বুয়েটে আড়িপেতে শোনা" নামে বুয়েটিয়ানদের একটা গ্রুপে গত কিছুদিন ধরে "কালা যাদু" নিয়ে খুব তর্ক বিতর্ক হচ্ছে, পক্ষে বিপক্ষে অনেকেই অনেক পোস্ট দিচ্ছে, ট্রল হচ্ছে, তর্ক-বিতর্কও কিছু হচ্ছে! যাদুবিদ্যায়, ঝাড়ফুঁক-তুকতাকে যার ইচ্ছে বিশ্বাস রাখতেই পারে! ভূত-প্রেত-জিন-দৈত্য-দানব-রাক্ষস-খোক্ষস যার যেটায় ইচ্ছা বিশ্বাস রাখবে, যার ইচ্ছে অবিশ্বাস করবে। গোটা দুনিয়ায় কত জায়গায় কত মানুষ কত বিচিত্র রকম জিনিসপাতিতে বিশ্বাস করে, তা বলে শেষ করা যাবে না! আবার সেগুলো অন্য অনেকেই বিশ্বাস করে না। যারা বিশ্বাস করে না, তাদের কাছে এসব বিশ্বাসের অনেক কিছুই অনেক হাস্যকর, উদ্ভট! এমনকি যারা নিজেরাও অলীক-অবাস্তব-অপ্রমাণযোগ্য কোন একটা কিছুতে বিশ্বাস করে, তারাই আবার দেখা যায়, অন্যের আরেক বিশ্বাসকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেয়! এসবই আসলে মানবের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে মিশে গিয়ে বিশ্বাসীদের কাছে খুব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, মানে একটায় বিশ্বাস ও অন্যটায় অবিশ্বাস এটাও এখন সংস্কৃতিরই বিষয়!
 
দুই
আমার এক আফ্রিকান ক্লাসমেট (মোজাম্বিকের) এর কাছে একটা গল্প শুনেছিলাম। তার গ্রামে একটা ট্রাইবের খুব নামডাক ওয়ালা এক ওঝা ছিল, সে খুব ঝাড়ফুঁক দিতে পারতো, দূর দূরান্তের গ্রামের মানুষ আসতো সমস্যা সমাধানের জন্যে। তার একটা পোষা জিন ছিল (আফ্রিকান ভাষায় আলাদা একটা টার্ম আছে, সে ইংরেজিতে যা বুঝাতে চেয়েছে, তার বাংলা ভূত হতে পারে, অশরীরি সত্ত্বা হতে পারে, আত্মা হতে পারে। জিনও হতে পারে)! তো, তার কাছে মানুষের মুশকিল আশানের অনেক রকম পন্থা আছে, তার মধ্যে একটা উপায় হচ্ছে - একটা কাগজে রক্তে লেখা সমাধানপত্র! সেটা আবার ঘটা করে খুঁজে বের করতে হয়, কখনো খালের পাড়ে, কখনো গাছে গোড়ায়, কখনো টিলার চুড়ায় - এরকম। আমি জিজ্ঞেস করলাম -- লোকজন এগুলো বিশ্বাস করে?
- শুধু বিশ্বাসই করে না, একদম মনে প্রাণে বিশ্বাস করে!
-- তুমি বিশ্বাস করো?
- পাগল! এগুলো মানুষকে ঠকানোর ব্যবস্থা!
-- মানুষ যদি ঠকবেই, এরকম পাগলের মত বিশ্বাস করবে কেন? নিশ্চয়ই বিশ্বাস করার মত কিছু না কিছু পেয়েছে!
 
সাথে ছিল তার্কিশ এক ক্লাসমেট, আরেকজন স্পানিশ। দুজনই হো হো করে উঠলো!
 
- কাগজে রক্তে লিখে জানাচ্ছে যে, এটা নাকি জিনের লেখা! সেটাতেই বুঝা যাচ্ছে সব ধাপ্পাবাজি।
-- ধাপ্পাবাজি হতে যাবে কেন? আসলেই কি জিনে এটা লিখে রাখতে পারে না?
- কি বলো, এ-ফোর সাইজের কাগজ, এগুলো খাতা কলমের দোকানে কিনতে পাওয়া যায়, জিন বানায় না! সেখানে যেই লেখা সেটাও ঐ লোকের বা তার সাগরেদদের কারোর!
-- এর কি কোন প্রমাণ আছে? মানে কেউ কি দেখেছে যে, সেগুলো ঐ লোক নিজে লিখেছে?
- না, তারা তো এত বোকা না যে সবার সামনে লিখবে! নিশ্চয়ই গোপনে লিখে রাখে।
-- কিন্তু এগুলো যে জিন লিখে নাই, সেই ব্যাপারে কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছো! জিন যে লেখে নাই, সেই প্রমাণ কোথায়?
- মানুষ বাদে তো আর কেউ সেই কাগজ বানাতে পারেনি, সেই কাগজে মানুষই লিখে! সবার সামনে যদি এরকম জিন বা অশরীরি কোন আত্মা বা অদৃশ্য কেউ লিখছে- দেখাতে পারলে না হয় বিশ্বাস করা যেত!
-- আচ্ছা ধরলাম, সেই কাগজ ঐ ওঝাই বাজার থেকে কিনে আনে। তারপরে সেখানে লাল কালি বা মুরগীর রক্ত দিয়ে নিজেই লিখে। কিন্তু, এমন কি হতে পারে না যে, জিনই তাকে সমাধানটা দিয়েছে, সে কেবল সেটাই লিখে রেখেছে? তখনও তো এটাকে জিনের সমাধান বলা যেতে পারে।
- কিন্তু, জিনই যে তাকে সমাধানটা দিচ্ছে, তার প্রমাণ কোথায়?
-- তাহলে, জিন যে এই সমাধান দেয় নাই, তার প্রমাণই বা কোথায়?
- বাহ, ওঝা দাবি করছে এটা জিনের সমাধান - তাহলে তাকেই প্রমাণ করতে হবে না? যেকেউই যেকোন কিছু একটা দাবি করে বসতে পারে! এখন যে দাবি করবে, তাকেই সেই প্রমাণটা করতে হবে, নাকি অন্যদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে, সেই দাবিটা ভুল! যেমনঃ আমি যদি দাবি করে মানুষ আসলে অনেক দূরের একটা গ্রহ থেকে আসা প্রাণী, সেই গ্রহটা ধ্বংস হওয়ার আগে একটা যানে কিছু মানবশিশুকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিলো, সেখান থেকে পুরা পৃথিবী আজকের মানুষ ছড়িয়েছে। অন্যরা বিশ্বাস করবে কিভাবে? আমার কাছে, আমার দাবির প্রমাণ চাইলে আমি যদি বলি, তোমরাই প্রমাণ করো যে - মানুষতে শুরুতে দূরের অন্য কোন গ্রহ থেকে আসেনি, তাহলে কেমন হবে ব্যাপারটা।
-- বুঝলাম, বেশ ভালো যুক্তি। তাহলে, ওঝাকেই এটা প্রমাণ করতে হবে। ওঝা যদি কোন প্রমাণ না দেয়, তাহলে লোকজন এটা কিভাবে বিশ্বাস করছে?
- ঐ কাগজগুলোর নিচে লেখা থাকে - এই সমাধান জিনের দেয়া বা লিখা।
-- বাহ! এই তো প্রমাণ হয়ে গেল!
- এটা তো কোন প্রমাণ হলো না, যেকেউই লিখে দাবি করতে পারে- এটা জিনের লেখা! তাহলে কি সেটাকে প্রমাণ ধরা যাবে?
-- তাই তো, তাহলে এই প্রশ্ন উঠছে না কেন?
- ওঝার ঘরে আরেকটা বড় লেখা বাঁধাই করে রাখা আছে। সেখানে জিন বলেছে, মানুষের বিভিন্ন সমস্যার কথা ওঝা মারফৎ তাকে জানানো হলে, সেই সঠিক সমাধান লিখে জানাবে!
-- বেশ মজার তো! এমন অকাট্য প্রমাণকে খণ্ডাবে কি করে?
- এটাও তো প্রমাণ নয়! এগুলোকে বলে সার্কুলার লজিক! মানে - এই লেখাটাও তো ওঝাই লিখে টাঙ্গিয়ে রাখতে পারে!

খুবই ইন্টারেস্টিং আলোচনা! আমি বললাম, আমি তোমাদের সাথে পুরাপুরিই একমত! কিন্তু, ঐ ওঝার পালিত জিনের কথা তোমরা ঠিকই অবিশ্বাস করছো, উড়িয়ে দিচ্ছো, কিন্তু এই দুনিয়ারই আরো বিশেষ বিশেষ কিছু বই আছে, যেগুলো মানুষের লিখা নয় বলে তোমরা বা দুনিয়ার একটা বড় অংশের মানুষ বিশ্বাস করো! সেই ক্ষেত্রে কি তোমরা কি একই যুক্তি দাও, নাকি এরকম যুক্তি শুনলে জবাব দেয়ার চেস্টা করো?

No photo description available. 

 
তিন
একবার ভারতীয় সেক্যুলার এক লেখকের মহাভারতের উপরে একটা লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকজন ছেলেমেয়ে আলাপ করছিলো! তারা কেউই নিজেরা হিন্দু বা সনাতন ধর্মালম্বী নয়, এবং মহাভারতের অনেক কাহিনী নিয়ে একটু বেশি হাসাহাসি করছিলো দেখে, আমি আলাপে যুক্ত হলাম! সেই লেখকের যুক্তির জায়গাটা ছিল এই যে, মহাভারত সহ বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন নারী বিভিন্ন দেবতার কাছে বর পেত, আর সন্তান জন্ম নিয়ে নিতো - কিংবা অনেক স্বামীহীন, অবিবাহিতা/ কুমারী কিংবা স্বামী-পরিত্যক্তা নারী, বিধবা নারী বা নপুংসুক স্বামীওয়ালা নারীর যে মুনি - ঋষি - দেবতার বরে সন্তান জন্ম নিতো, কিংবা ঈশ্বর বা দেবতাদের সন্তান বলে যারা যারাই ছিল, সবাই আসলে স্বামীভিন্ন অপর কোন পুরুষের সাথে যৌন মিলনে জন্ম নেয়া সন্তান, কোন ক্ষেত্রে পিতার পরিচয় আড়াল করতেই দেবতার সন্তান বলা হয়েছে, কখনো পুরোহিত শ্রেণীর ঋষি - মুনিরা নিজের কুকীর্তি আড়াল করতেই কিংবা বিয়ে করে সেই নারীর দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করতেই আশীর্বাদ বা বরের আলাপ লাগিয়ে দিয়ে পালিয়েছে! আর, এদিকে ওদিকে অমুক তমুক দেবতার বা ভগবানের বীর্জ পড়েই যেসব পুত্র ও কন্যার জন্ম হয়েছে, সেগুলো আসলে পিতৃ ও মাতৃ উভয় পরিচয় হারা, কুড়িয়ে পাওয়া সন্তানদেরকে যারা লালন-পালন করেছে, তাদেরকে এরকম দেব-দেবীর সন্তান হিসেবে একটা সামাজিক পরিচয় দেয়া হয়েছে, সেগুলোই পরে মিথে জায়গা পেয়েছে! যুক্তিগুলো অতি উত্তম, সেই ছেলেমেয়ের হাসাহাসির কারণ কি জানার চেস্টা করলে বুঝতে পারলাম - ভারতীয় পুরাণে যেরকমভাবে সন্তান জন্মানোর এসব গল্প আছে, সেগুলো প্রচণ্ড রকম হাস্যকর, সেগুলোই তাদেরকে প্রচুর হাসির উদ্রেক করেছে।
 
যেমনঃ নপুংসুক পাণ্ডুর (এটাও এক ঋষির অভিশাপের ফল, যৌনমিলনেই মৃত্যুর শাপ ছিল) স্ত্রী কুন্তী ঋষী দুর্বাসার কাছে একটা বর পেয়েছিলেন যে, বৈবাহিক সম্পর্ক বাদেই দেবতার কাছ থেকে সন্তানলাভ করতে পারবেন। তিনি সূর্যদেবতার কাছে কর্ণ, ধর্ম দেবতার কাছে যুধিষ্ঠির, বায়ু দেবতার কাছে ভীম আর দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে অর্জুনকে পান, কুন্তীর কাছ থেকে এই বর নিয়ে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী অশ্বিনীকুমার দেবতাদ্বয়ের কাছ থেকে নকুল ও সহদেবকে লাভ করেন! পুরাণে আছে শিবের বীর্যস্খলিত হয়ে মাটিতে পড়লে জন্ম নেন আয়াপ্পন, শিবের স্বেদবিন্দু (ঘাম) ভূমিতে পড়ে জন্ম নেন ভৌম, ধ্যানরত শিবের শরীর থেকে নির্গত তীব্র জ্যোতি মাটিতে পড়লে জন্ম নেন লৌহের দেবতা খুজ। ইত্যাদি ইত্যাদি। এইরকম প্রচণ্ড এবসার্ড গল্পগুলোই যে এই আধুনিক কালেও কত মানুষ বিশ্বাস করে, সেটাই আসলে তাদের (যে ছেলেমেয়ের সাথে আলাপে লিপ্ত হলাম) হাসির কারণ! আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এতে এত হাসাহাসির কি আছে? জবাব পেলাম -
 
- বাহ রে! এইরকম মিথে লোকজন এখনো বিশ্বাস করে যায়, একটু বুদ্ধি-চিন্তা প্রয়োগ করলেই তো বুঝা যায় এসব কিচ্ছাকাহিনী বিশ্বাস করার মত নয়!
-- বিশ্বাস করার মত না হলে, হাজার হাজার বছর ধরে এত এত মানুষ কেন এগুলোতে বিশ্বাস করছে?
- মানুষ তো কত কিছুই বিশ্বাস করে, তাই না? আমার কাছে তো এই ভদ্রলোকের ব্যাখ্যাই অনেক বেশি যৌক্তিক মনে হলো!
-- কোন ব্যাখ্যা?
- এই যে, দেবতার বা ভগবানের সন্তান বলে কিছু নেই। ঋষি - মুনি - দেবতা বর দিলো, আর টপাটপ সন্তান পয়দা হলো, কিংবা এখানে ওখানে ভগবান বা দেবতার বীর্য - ঘাম - তেজ - জ্যোতি ইত্যাদি পড়লো, আর সন্তানের জন্ম হলো, এমন কাহিনীগুলোর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হচ্ছে- এসবই বিবাহ বহির্ভূত যৌন মিলনের ফলে জন্ম নেয়া সন্তান, কোন ক্ষেত্রে পিতৃ পরিচয়ের অভাবে মা সেই সন্তানকে ভগবানের সন্তান হিসেবে দাবি করেছে, কখনো মা-বাবা সন্তানকে পরিত্যাগ করলে সেটাকে ভগবানের বীর্য মাটিতে পড়ে জন্ম নেয়া ভগবানের সন্তান হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়েছে! এই চলটা তো এখনো আছে, বিভিন্ন প্রস্টিটিউশনে জন্ম নেয়া বাচ্চাকে ঈশ্বরের সন্তান বা সন/ ডটার অব গড বলা হয়!
-- কিন্তু, দেবতা/ ভগবানের বরে আসলেই কি কোন মানবী কোন পুরুষের সাথে যৌনমিলন বাদে সন্তান লাভ করতে পারে না? ভগবান যদি থেকেই থাকেন, এবং তিনি যদি সৃষ্টি - ধ্বংস এসব করতেই পারেন, তাহলে তার বীর্য মাটিতে পড়েই বা কেন সন্তান জন্ম নিতে পারবে না?
- আমার তো মনে হয়, মাটিতে বিভিন্ন গাছের বীজ মাটিতে পড়লে চারা হয়, নতুন গাছ জন্ম নেয়, সেখান থেকেই মিথে মানুষ এরকম ভগবানের বীর্য মাটিতে পড়েই সন্তানের জন্মের বিষয়টা কল্পনা করে নিয়েছে! এই কাহিনীগুলোর বিভিন্ন দেবতা যেমনঃ ধর্ম, সূর্য, অশ্বিনীকুমার, শিব, বিভিন্ন ঋষি, মুনি - এদের সবাইই ছিল আসলে রক্ত মাংসের মানুষ, এবং পুরুষ মানুষ। তারাই এরকম বিভিন্ন নারীর সাথে যৌনমিলন করে তাদেরকে ফেলে চলে যেত, সেই যে সন্তান হতো সেগুলোকে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে অভিধা দেয়া হতো!
-- কিন্তু, এমন ব্যাখ্যাও তো ধারণামাত্র। আসলেই এই মিথগুলো কেবল কল্পনা, বা বানানো গল্প তার প্রমাণ কি? মানে, শিবের বীর্য/ ঘাম/ জ্যোতি যে মাটিতে পড়েই আয়াপ্পান, ভৌম ও খুজের জন্ম হয়নি, কিংবা বিভিন্ন দেবতার সাথে যৌনমিলন বাদেই কেবল বরেই যে পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম হয়নি, সেটা আমরা কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছি? এমনটা যে হয়ই নি, তার কোন প্রমাণ আছে?
- মানুষের ক্ষেত্রে (এবং সকল যৌনপ্রজননক্ষম প্রাণীর ক্ষেত্রেই) পুরুষ ও নারীর যৌনমিলন ছাড়া কি আদৌ সন্তান জন্ম নিতে পারে? আমাদের চারপাশে কি এমন কোন নারী আছে, যার গর্ভে কোন সন্তান এসেছে কোন রকম যৌনমিলন বা পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণূর মিলন বাদে? নারীর গর্ভ বাদে বা মা ছাড়া কেবল পুরুষের বীর্য দ্বারা কোনকালেই কি কেউ কি দেখেছে যে, কোন সন্তানের জন্ম নেয়া সম্ভব?
-- এই কালে আমরা এরকম দেখিনি, কিন্তু কিভাবে দাবি করতে পারি যে, কোনকালেই এমন হয়নি? কোন এক কালে দেবতা বা ভগবানরা চাইলে এমন হতে পারে না? সেই সময়ে ভগবান ও দেবতারা, ঋষি - মুনিরা এভাবে বর দিতো, কিন্তু এখন দেয় না! এমনও কি হতে পারে না? সেকালের মানুষ এসব দেখেছে বলেই তো এমন কাহিনীগুলো তারা লিখে গিয়েছে, যুগে যুগে মানুষ তা বিশ্বাস করেছে। আজকে দেখি না বলে অতীতে কোনকালেই হয় না, এমনটা কি দাবি করা যায়?
- কিন্তু, আজকে আমরা অনেক প্রাকৃতিক ঘটনার কার্যকরণ, পুরো প্রসেস সম্পর্কে জানতে পেরেছি, যা একসময়ের মানুষ জানতো না! যেমনঃ সন্তান জন্ম নেয়ার পুরো প্রসেসটা আমরা জানি। সেখান থেকেই তো বলতে পারি, একটা সন্তান জন্ম নেয়ার জন্যে বাবার শুক্রাণূ আর মায়ের ডিম্বাণূর মিলনে ভ্রুণের জন্ম হওয়া, সেই ভ্রুণকে মাতৃগর্ভে বড় হওয়া- এই ধাপগুলো আবশ্যক! এটা এখনকার জন্যে যেমন, তেমনি সুদূর অতীতেও, একদম মানুষের শুরু থেকে, এবং অন্যান্য যৌনজ প্রাণীর ক্ষেত্রেও আবশ্যক, নয় কি?
-- ঠিক আছে, বুঝলাম! এই যুক্তি যদি ঠিক হয়, তাহলে দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি মানুষ যে বিশ্বাস করে আজ থেকে ২০২৪ বছর আগে বাবা ছাড়াই একজন ত্রাতার জন্ম হয়েছিলো! তাদের অনেকে মনে করে- এই সন্তান সরাসরি ঈশ্বরেরই সন্তান, আবার অনেকে মনে করে - এই সন্তান ঈশ্বরের অলৌকিক ক্ষমতায় বাবা বাদেই নারীর গর্ভে জন্ম নেয়া এক নবী বা প্রফেট! এই কাহিনী বা মিথের ক্ষেত্রেও কি উপরের যুক্তিগুলো সমান প্রযোজ্য? মানে, কথিত এই ঈশ্বর পুত্র বা ঈশ্বরের অলৌকিক ক্ষমতায় পিতার শুক্রানূ বাদেই জন্ম নেয়া কথিত নবী কি আসলেই কি অবিবাহিত নারীর গোপন প্রণয়ের ফসল নয়?
 
 
চার
আসলে, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মাঝে দূরত্ব বা পার্থক্য খুবই কম! উপরের দুই পয়েন্টের আলোচনাতেই দেখা যাবে, বিশ্বাসীরা একইরকম যুক্তি ভিন্ন বিশ্বাসগুলোকে খণ্ডাতে দিতে থাকবে, কেবল নিজের বিশ্বাসের বেলায় যুক্তিকে অচল বলে দাবি করবে! অবিশ্বাসীদের সাথে তাদের পার্থক্য হচ্ছে এতটুকুই যে, তারা সেই একই যুক্তি সবক্ষেত্রেই সমান প্রযোজ্য বলে মনে করে। মানে, দুনিয়ার সকল অবিশ্বাসী কালেমা তাইয়েবার প্রথম অংশটুকু সঠিক বলে মনে করে, "লা ইলাহা" বা কোন উপাস্য নাই, বা ঈশ্বর বলে কোন কিছুই নাই। সকল বিশ্বাসীর ক্ষেত্রেও এটা একইভাবে কমন, মানে বিশ্বাসের শুরুটা এই যুক্তি তথা অবিশ্বাস দিয়েই। "লা ইলাহা"! কিন্তু, তারপরেই তাদের যুক্তি এসে মুখ থুবড়ে পড়ে, একটি স্পেসিফিক বিশ্বাসে আটকে যেতে কালেমার পরের অংশে বিশ্বাস আনে। "লাইলাহা"র পরে কেউ বা বলবে "ইল্লাল্লাহু" বা আল্লাহ ছাড়া, কেউ বা বলবে "ইল্ভগবানাহু" বা ভগবান ছাড়া, কেউ বা "ইলযিহোভাহু" বা যিহোভা বাদে, কেউ বা "ইলগডাহু" বা গড বাদে ... ইত্যাদি! দুনিয়াতে অসংখ্য বিশ্বাস আছে, বিভিন্ন বিশ্বাস অনুযায়ী বিভিন্ন ঈশ্বর - দেবদেবীর ধারণা প্রচলিত আছে। আজ যারা নিজেকে বিশ্বাসী বলেও দাবি করছে, তারা সালে একটায় বিশ্বাসী, এবং বাকি অন্যসবে অবিশ্বাসী। একজন অবিশ্বাসীর সাথে তাদের পার্থক্যটা কেবল মাত্র ঐ একটিরই!
 
পাঁচ
তো, বিশ্বাসীরা যে এই একটা বিশ্বাসে বিশ্বাস আনয়ন করে এবং দুনিয়ার অন্য সব বিশ্বাসে একজন অবিশ্বাসীর চাইতেও চরম বেগে অবিশ্বাস করে, তার মূল রহস্যটা কি? রহস্য আসলে কিছু না, জন্ম - জন্মের পর থেকে জ্ঞান হওয়া - বেড়ে ওঠার পর্যায়ে সে যা কিছু শিখে সেটাই আসলে তার প্রশ্নহীনভাবে মাথায় গেঁথে যায়! দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষই আসলে এভাবে বিশ্বাসী হয়! মানে, সে যে বিশ্বাসের ঘরে জন্ম নেয় ও বড় হয়ে উঠে, সেই বিশ্বাসটাই তার ভেতরে গেঁথে যায়! মানুষ জন্মের পর থেকে যেভাবে ভাষাটা শিখে, তার ভিতরে ভাষার মাধ্যমে দুনিয়ার চারপাশটাকে চিনতে থাকে, সেটা একদম গেঁথে যায়, সেরকমভাবেই এই বিশ্বাসও গেঁথে যায়! ফলে, আজ যেই বিশ্বাসীটা নিজের নিরাকার ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান মনে করে মাটির মূর্তির দেবদেবী নিয়ে হাসি তামাশা করছে, কিন্তু যেই যুক্তিতে মাটির মূর্তির দেবদেবীকে নিয়ে হাসাহাসি করছে - সেই যুক্তিগুলো ঈশ্বরকে ডাকার জন্যে ঈশ্বরের ঘরের ধারণার ক্ষেত্রে, পাঁচবার ঘড়ি ধরে ডাকাডাকি করার ক্ষেত্রে, কথিত শয়তানের উদ্দেশ্যে তিনবার পাথর ছুড়ার ক্ষেত্রে, কিংবা বিশেষ পাথরকে চুম্বন দেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছে না; সেই বিশ্বাসী ব্যক্তিটিরই জন্ম যদি অন্য বিশ্বাসের ঘরে হয়ে যেত, তাকেই হয়তো দেখা যেত মহা আড়ম্বরে মাটির দেবদেবী তৈরি করে উপাসনা করতে! আর, এই বিশ্বাসীদেরই যদি জন্মটা হতো আমাজন জঙ্গলের গহীনে বাস করা কোন ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীতে, তাহলে ঈশ্বর, ভগবান নিরাকার না সাকার- এইসব চিন্তা দূরের কথা, ঈশ্বর নয়, বরং হয়তো দুনিয়ারই বিভিন্ন উপাদান বা বস্তুকে বা বিশেষ বিশেষ প্রাণিকে মহাশক্তিধর ভেবে উপাসনা তথা নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন করতো! তার পোশাক আশাক, চাল চলন, জীবন যাপন পদ্ধতি, খাদ্যাভ্যাস - সবই আলাদা হয়ে যেত! মানে, মানুষ যেভাবে তার পোশাক-আশাক, চাল চলন, আদব কায়দা, রীতিনীতি, জীবন যাপন পদ্ধতি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা - সবকিছু পায় যেখানে ও যে সময়ে জন্ম নেয় সেখানকার ও সে সময়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বা কৃষ্টি-কালচার থেকে, তেমনি সেখান থেকেই পায় তার বিশ্বাস বা বিশ্বাসগুলো!
 
 
ছয়
একজন বিশ্বাসী অবশ্য বলতেই পারে, তার ঈশ্বরই আসলে নির্ধারণ করে দিচ্ছেন, মানুষের কে কোথায় জন্ম নিবে। তাহলে, এটাও আসলে মানা দরকার - সেই ঈশ্বরই ঠিক করে দিচ্ছেন কোন মানুষ কোন বিশ্বাস করবে আর কোনটায় অবিশ্বাস করবে! এমন যদি হয়, তাহলে বিশ্বাসী মানুষের পক্ষে আসলে কোনদিনই জানা সম্ভব নয়, দুনিয়ার কোন বিশ্বাসটা সঠিক, বা তার বিশ্বাসটা আদৌ সঠিক কি না, তা কোনদিনই তার পক্ষে জানার কোন উপায়ই নেই! তাহলে, নিজের বিশ্বাস যা কেবল ও কেবল মাত্র জন্মের মাধ্যমে প্রাপ্ত, সেটি একমাত্র সঠিক বিশ্বাস আর আর অন্য সব বিশ্বাস বেঠিক বলে যেই গর্ব, আর সেই গর্ব থেকে যে ঘৃণা-বিদ্বেষ আর যুগে যুগে এত লড়াই, তা আসলে পুরোপুরিই ঠুনকো নয় কি? এমন এক বিশ্বাস নিয়ে এত মাতামাতি কি পণ্ডশ্রম নয়?
 
 
সাত
অপরের ক্ষতি না করে, এক বিশ্বাসের সাথে আরেক বিশ্বাসের মাঝে ঘৃণা-বিদ্বেষ না রেখে, হানাহানি - লড়াই না করে যদি কেউ এমন পণ্ডশ্রম করে, একটা বেঠিক বিশ্বাসের পেছনে সারাজীবন ছুটে (নিজের বিশ্বাসকে সঠিক মনে করলেও তো স্বীকার করবেন, বাকি সব বিশ্বাসের বিশ্বাসীরা সারাজীবন বেঠিক বিশ্বাসের পেছনে ছুটছে), তাহলেও আসলে খুব বেশি আপত্তির কিছু দেখি না! অন্যের ক্ষতি না করলে, যার ইচ্ছে যা ইচ্ছে বিশ্বাস করুকগে! যার যার বিশ্বাস তার তার কাছে! যাদুবিদ্যা - ঝাড়ফুঁক - তুকতাকে কেউ বিশ্বাস করতে চাইলে কেউ করতেই পারে, কেবল অনুরোধ থাকবে অসুস্থ সন্তানকে সুস্থ করার জন্যে এইসব ঝাড়ফুক-তুকতাক- পানিপড়া - যাদুবিদ্যা - মন্ত্রসাধণা - তাবিজ - কবজ যার উপরেই পরম বিশ্বাসে আশ্রয় নেন না কেন, ডাক্তারি চিকিৎসাটা করাতে অন্তত ভুলবেন না! বাড়িতে আগুন লাগলে যত ইচ্ছে দোয়াদরুদ পড়ুন, কিন্তু বিপদ হওয়ার আগেভাগেই নিরাপদে বাড়ির বাইরে সবাইকে নিয়ে বেড়িয়ে আসুন, আগুন নিভানোর জন্যে ব্যবস্থা নিন। সন্তান না হলে যত ইচ্ছে তাবিজ পড়ুন, মানত করুন, ছিন্নি দেন, কিন্তু তার সাথে সাথে সঠিক সময়ে যৌনমিলনে লিপ্ত হন (তারপরেও সন্তান না হলে সমস্যার কারণ জানতে ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন, পুরুষ সঙ্গীর স্পার্ম কাউন্ট ঠিক আছে কি না, নারী সঙ্গীর ওভুলুশন ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, জরায়ুতে কোন সমস্যা আছে কি না, ইত্যাদি)! গরমে খরায় অতিষ্ঠ হয়ে ইচ্ছেমত নামাজ পড়ুন - মন্দিরে পূজা দেন বা ব্যাঙের বিয়ে দেন, কিন্তু তার সাথে সাথে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন আর জলাশয় দখল করে ভরাটের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, আর গাছ লাগাতে ভুলেন না! পরীক্ষায় ভালো নাম্বারের জন্যে ইচ্ছেমত দোয়া চান, পানিপড়া খান, তাবিজ পড়েন, কিন্তু ভালোভাবে প্রস্তুতিটুকু নিতে মোটেও ভুলবেন না!
 
 
আট
"বুয়েটের আড়িপেতে শোনা" গ্রুপটাতে যার যেমনই বিশ্বাস থাকুক, আমার ধারণা বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে এখানকার সকলেই বর্ণবাদকে ঘৃণ্য মনে করেন। সেখান থেকেই সবার প্রতি আহবান থাকবে, "কালা" যাদু বা "কালো" যাদু শব্দগুলো পরিহার করে, কেবল যাদু, কিংবা খারাপ যাদু, দুষ্ট যাদু - এই শব্দগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলা ভাষায় খারাপ - দুষ্ট - অশুভ বুঝাতে "কালো", "কালা" শব্দের ব্যবহার বর্ণবাদের দোষে দুষ্ট বিধায়, বর্তমানে শিক্ষিত ও সচেতন লোকজন এই শব্দগুলো পরিহার করেন! বুয়েটিয়ানরাও বর্ণবাদী নন বলেই আমার "বিশ্বাস"! যারাও অসচেতনভাবে ও অসাবধানতায় "কালো" / "কালা" যাদু বলে বিভিন্ন সময়ে পোস্ট দিয়েছেন, আশা করি - সেগুলো এডিট করবেন।
 
 
নয়
লম্বা লেখাটা পড়ার জন্য পাঠকদের জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
 
(27 - 05 - 2024) 

কোন মন্তব্য নেই: