বৃহস্পতিবার, ৩০ মে, ২০২৪

নাস্তিকতা, নারী ও যৌনতা, বৌদ্ধধর্ম এবং সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ

বাঙালি নাস্তিকের একটা বড় অংশেরই নাস্তিকতার ভারকেন্দ্র থাকে যৌনতা! ধর্ম প্রচারক, ধর্মীয় মহাপুরুষ, ধর্মগুরু, সাধু, সন্যাসী, নবী, রাসুল থেকে শুরু করে এ সময়ের ধর্মবাবা, পীর, মঙ্ক, পোপ, হুজুরদের যৌন জীবন নিয়ে "রসিয়ে রসিয়ে" আলাপ করার মাধ্যমে অনেকে নাস্তিকতার চর্চা চালু রাখেন। এদেশে বিভিন্ন ওয়াজ-মাহফিলে হুজুররা বিবাহ বহির্ভুত যৌনমিলন তথা ব্যভিচারের বিরুদ্ধে সবক দিতে দিতেই, ব্যভিচারে প্রলুব্ধ করতে পর্দাহীন নারীদের বিরুদ্ধে সাবধান করতে করতেই এবং ইহকালের যৌনসংযমের মাধ্যমে পরকালের অবাধ যৌন-উদ্যানে যাওয়ার পথ বাতলে দিতেই দিতেই যে রগরগে বর্ণনা দেন, তাতে অবদমিত বাঙালির শ্রবণেই যৌনসুখ লাভ হয় যেমন, নাস্তিকদেরও ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটে সম্ভবত! ফলে, ইসলামের কামকেলি বা কৃষ্ণের লীলাখেলা বা মহাভারত - বেদ - পুরাণে যৌনতার ছড়াছড়ি সহ বিভিন্ন কথিত নবীর শত শত নারীগমন- এসবের আলাপ বাদ দিয়ে নাস্তিকতার চর্চা যেন পূর্ণতাই পায় না, সেই ধরণের লেখাগুলোই নাস্তিকদের মাঝে হিটও সবচেয়ে বেশি! ধর্ম ও ধর্মীয় গ্রন্থে বিশ্বাস স্থাপনকারী মানুষের মাঝে যৌনতা নিয়ে যেরূপ ট্যাবু বিরাজমান এবং এই বিশ্বাস ও তার মধ্যে থাকা ট্যাবু যেভাবে নারীর প্রতি অবমাননামূলক ও নিবর্তনমূলক, তাতে বিভিন্ন ধর্মে যৌনতা ও নারীকেন্দ্রিক আলোচনা ও ঘটনাগুলোকে ধরে ধরে কথা বলাটা জরুরী, সেই জরুরী কাজটি নাস্তিকরা করতেই পারেন, ধর্মীয় মহাপুরুষদের প্রতি তার অনুগতদের মাঝে যে বিপুল শ্রদ্ধা ও ভক্তি কাজ করে, তা ভাঙ্গতে সেই মহাপুরুষের ব্যক্তিজীবনের নানা সমস্যা, বৈপরীত্য এসব দেখানোতে কোন সমস্যা নাই, তার অংশ হিসেবে যৌন জীবনের আলাপও আসতেই পারে! কিন্তু আমাদের নাস্তিক বন্ধুদের বড় অংশের মাঝেই এই কাজে আগ্রহটা অনেক বেশি, সেটি করতে গিয়ে তারা অনেকক্ষেত্রেই সময় - যুগ - সমাজ এসবের সাথে সাথে যে মানুষের রীতনীতি, নৈতিকতার বোধ বা মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটে- সেরকম কোন বিবেচনা রাখেন না (যেমন আজকের মূল্যবোধ দিয়ে হাজার বছর আগের সমাজের বাল্যবিবাহকে বিচার করে নবীকে পেডোফাইল বলা), ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মীয় মহাপুরুষদের যৌন জীবন বিবৃত করতে গিয়ে একরকম অবসেশনে ভুগতে থাকেন, সত্য - মিথ্যা মিশিয়ে কাল্পনিক ভাবজগৎ তুলে ধরেন!



সেরকমই কয়েকটা লেখা পড়লাম- "আধুনিক গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আর সুপ্রতিষ্ঠিত আইনের শাসনের প্রাণকেন্দ্র" পশ্চিম ইউরোপে ২২ বছর ধরে বাস ও কাজ করার গর্বে ভীষণ গর্বিত আমাদের এক নাস্তিক বন্ধুর লেখনীতে। ২২ বছর ধরে তিনি তার স্বপ্নভূমিতে বাস ও কাজ করলেও, তিনি লেখালেখি করেন বাংলায়, যার পাঠক বাংলাদেশী। যেই বাংলাদেশকে তিনি আবার মনে করেন, গণতান্ত্রিকতাহীন, ধর্মনিরপেক্ষতা যেখানে অসম্ভব, জনগণ ও তার বুদ্ধিজীবীরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে অজ্ঞই শুধু নন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার শত্রুও। তার মতে বাংলাদেশ তার স্বপ্নের ভূস্বর্গ ইউরোপ (পশ্চিম) থেকে "গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, আর মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কয়েক শত বছর পিছিয়ে আছে", এবং "উন্নত, শিক্ষিত আর আধুনিক গণতান্ত্রিক" ভূস্বর্গে বাস করায় "বাংলাদেশের জনগণ, সমাজ বা রাজনীতি"র কাছে ওনার "চাওয়া পাওয়া"র কিছুই নেই! তো, চাওয়া পাওয়ার কিছু যদি নাই থাকবে, কেন তিনি বাংলাদেশী পাঠকদের উদ্দেশ্যে বাংলায় লেখালেখি করেন? আমার ধারণা, বাংলাদেশের ধর্মান্ধ (তার মতে "বাংলাদেশের ৯৯% মানুষই ধর্মান্ধ, ধর্মব্যবসায়ীর সংখ্যাও বিরাট"), অজ্ঞ, মূর্খ বা অজ্ঞান মানুষকে জ্ঞানদান করতে চান, পশ্চিমা আলোয় আলোকিত তথা শিক্ষিত ও আধুনিক করে তুলতে চান! তিনি জানিয়েছেন, তার "ভাবনা জায়গা"ই হচ্ছে ইউরোপ এবং তিনি "আধুনিক ইউরোপীয় সংস্কৃতি"তে উদ্বুদ্ধ হয়েই "রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় অন্ধ" মানুষকে "আঘাত" করেন, "উসকানি" দেন। ইউরোপিয়ান উপনিবেশগুলো যেভাবে গোটা দুনিয়ার "অশিক্ষিত", "মুর্খ", "অসভ্য" ও "বর্বর" জাতিগুলোকে আধুনিক - সভ্য - ভব্য করে তুলেছে, সেই সংস্কৃতিতে বলীয়ান একজন একই কাজই করতে চাইবেন, এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই! তবে, তিনি একটা বিষয় ভুলে যাচ্ছেন - এমন সবক দিতে চাওয়াটা যেমন তার "মহান" ইউরোপীয় সংস্কৃতির মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তেমনি সেই "সবক" নিতে অস্বীকৃতি জানানো, ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করাটাও কথিত "ধর্মান্ধ", "মুর্খ", "অজ্ঞান" বাংলাদেশীর মত প্রকাশের স্বাধীনতার মাঝেই পড়ে, এটা শুধু মত প্রকাশের স্বাধীনতাই নয়, তার চাইতে বেশি কিছু!


সেই ইউরোপীয় স্বর্গে বাস ও কাজ করা, ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি গুণমুগ্ধ মত প্রকাশের স্বাধীনতায় সোচ্চার, নাস্তিক বন্ধু এবারে ধর্মান্ধ, মুর্খ ও অজ্ঞান বাংলাদেশীকে আঘাত ও উসকানি করার লক্ষে, বেছে নিয়েছেন সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধকে। সেই পুরাতন তরিকাই গ্রহণ করলেন, মানে "নারী" দিয়ে গৌতম বুদ্ধকে ঘায়েল করার পথ নিলেন। তিনি লিখেছেন, 

"গৌতম বুদ্ধ মানুষের জীবনের ভোগ-বিলাস আর লোভ সংবরণ করার শিক্ষক ছিলেন। অথচ তিনি নিজেই একজন সুন্দরী নারীর হাতের পায়েস খাওয়ার লোভ সামলাতে পারেন নি। তিনি সামান্য পায়েসের লোভে তার মহামূল্যবান ধ্যান ভঙ্গ করেছেন"। 

আমাদের এই নাস্তিক বন্ধুর আলোচনায় "সুন্দরী" আর "লোভ" - শব্দদুটার দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি চলে যায়! একজন নারীর বিবরণে দর্শনদারির বিচার আর একটা গল্পকে সেনশনালাইজ করতে নারীর আগে "সুন্দরী", "অপরূপা", "নজরকাড়া", "সর্বঅঙ্গে উপচে পড়া রূপের অধিকারিণী" ইত্যাদি বিশেষণ জুড়ে দেয়াটা প্রাচীণ যুগের মিথ, পুরাণ সাহিত্য থেকে শুরু করে এ যুগের মিডিয়ায় ও ব্লগ সাহিত্যেও বিশেষ করে পুরুষ লেখকদের একটা মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে (যদিও নাস্তিক বন্ধুর দাবি, যেকোন নারীর সামনে "সুন্দরী" আর "ইয়াং" লাগিয়ে দেয়া নাকি ইউরোপীয় ভদ্রতার নিদর্শন!)

 
সিদ্ধার্থ গৌতমের এই পায়েস খাওয়ার কাহিনী বা মিথটি আসলে কি? দুরকম ভাষ্য পাওয়া যায়। উরুবিল্বের নিকটে সেনানী নামের এক গ্রামের ধনী কৃষক পরিবারে সুজাতা নাম্নী এক কুমারী কন্যা স্বপ্নে দেখেন তার স্বামী ও পুত্র সন্তান লাভ হবে। কিন্তু এরপরেও তার কোনভাবেই বিয়ে হচ্ছিলো না। ফলে, তিনি নিরঞ্জনা নদীর তীরস্থ এক নির্দিষ্ট বটবৃক্ষের পাদদেশে গিয়ে বৃক্ষদেবতার কাছে স্বামী ও পুত্র সন্তান প্রার্থণা করেন, মানে পূজা দেন। এর পরে তার বিয়ে হয় এবং পুত্র সন্তানও হয়। খুশী হয়ে সেই বৃক্ষদেবতার জন্যে পায়েস রান্না করেন (অনেক ঘন দুধের), তারপরে এক বাটি পায়েস বৃক্ষদেবতার উদ্দেশ্যে যখন নিয়ে যাবেন, সেই সময়ে গৌতম বুদ্ধ সেই অঞ্চলে এসে বৃক্ষের নীচে ধ্যান করছিলেন, সুজাতা নামক সেই নারী ভাবলেন - স্বয়ং বৃক্ষদেবতাই চলে এসে ধ্যান করছেন। সেই মনে করে তাকে এই পায়েসের বাটি খেতে দেন। অন্য ভাষ্য মোতাবেক, সুজাতা ছিলেন এক ধনী কৃষকের স্ত্রী, কিন্তু তার কোন সন্তান হচ্ছিলো না। সেই সময়ে নিরঞ্জনা নদীর পাশের বটবৃক্ষের নীচে সিদ্ধার্থ গৌতম এসে ধ্যানে বসেন। দীর্ঘদিন অনাহারে, অনিদ্রায়, চুলের জটা মিলে সন্যাসীর যেই রূপ হয়েছিলো, তাতে গ্রামে ছড়ায় যে- অনেক বড় সাধু এসেছেন, সাক্ষাৎ দেবতা এসেছেন। ফলে, অনেকেই ভীড় জমায়, সুজাতা নাম্নী সেই নারীও পায়েস সাথে করে নিয়ে যান, এক পুত্র সন্তান লাভের আশায়!


এদিকে, বটবৃক্ষের নীচে কয়েক মাস ধরে ধ্যানরত সিদ্ধার্থ গৌতম নিরঞ্জন নদীতে স্নান শেষে আসার সময়ে অনাহারে-অনিদ্রায় মুর্ছা যান। যখন জ্ঞান ফেরে, তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, এমন তপস্যা আসলে নিস্ফল তপস্যা। কঠোর তপস্যা করেও নয় , চরম ভোগ বিলাসে জীবন এলিয়ে দিয়েও নয় , মাঝের পথ বা মধ্যপথই হচ্ছে আসল পথ, সত্য লাভের উপায়। তখনি তিনি স্থির করলেন আর চরম কৃচ্ছ সাধন নয়, পরিমিত আহার করে তপস্যা করতে হবে। তার এমন সিদ্ধান্তে তার সাথে সাথে তপস্যায় থাকা অন্যসব সন্যাসীরা তাকে ত্যাগ করে নিজ নিজ পথে চলে যান। সেসময়ই এসে হাজির হন সুজাতা, এক বাটি পায়েস হাতে নিয়ে। সিদ্ধার্থ গৌতম সেই পায়েস গ্রহণ করেন, এবং তা ৪৯ ভাগে ভাগ করেন, প্রতিদিন এক ভাগ করে খাওয়ার জন্যে। এভাবে ৪৯ তম দিনে সেই পায়েস শেষ করার পরেই সিদ্ধার্থ গৌতম বোধি লাভ করেন, সেখান থেকে হন বুদ্ধ! ফলে, "সুন্দরী" নারী সুজাতা এখানে ঘটনাক্রমে খাদ্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, সিদ্ধার্থ গৌতম মূলত সুন্দরী নারীতে নয়, জীবন বাঁচানোর খাদ্যই গ্রহণ করতে গিয়ে আগের সেই কঠোর তপস্যার পথ থেকে সরে এসেছিলেন! সিদ্ধার্থ গৌতম বোধিলাভ করেছিলেন বা বুদ্ধ হয়েছিলেন, তারও মাসাধিক সময় পড়ে, ফলে তিনি সত্য সন্ধানে বা নির্বাণ লাভের জন্যে তপস্যা করছিলেন, সেটা তখনও অর্জিত হয়নি! ফলে, তখনো তিনি "মানুষের জীবনের ভোগ-বিলাস আর লোভ সংবরণ করার" শিক্ষা দেওয়া শুরু করেননি, তখনও শিক্ষক হয়ে উঠেননি। ফলে, সেই তপস্যাকালীন সময়ে "লোভ" (এটা মোটেও "সুন্দরী" নারীর প্রতি লোভ নয়, লোভ কিছু থেকে থাকলে খাদ্যের প্রতি লোভ) থাকতেই পারে, তপস্যার আগে থেকেই যদি তিনি নিজে সমস্ত রকম ভোগ-বিলাসের লোভ মুক্তই যদি থাকবেন, তাহলে আর তপস্যারই বা কি দরকার! তদুপরি, সেই পায়েস পাওয়ার সাথে সাথে তিনি সব চেটে পুটে খেয়ে সাবাড় করেননি, বা তপস্যা বাদ দিয়ে - গ্রামে গিয়ে নিয়মিত আহার করেছেন - এমনও নয়। কেবল, আগের অনাহার বাদ দিয়ে কঠোর তপস্যার বদলে, পরিমিত আহারের পথ নিয়েছেন, ফলে এক বাটি পায়েস ৪৯ দিন ধরে খেয়েছেন! একে কি "লোভ" বলা যায়?


গৌতম বুদ্ধ ও তার অনুসারী ভিক্ষুরা ভিক্ষার বাটিতে ভিক্ষা সংগ্রহ করতেন, কিন্তু গৌতম বুদ্ধের শর্ত ছিল, তারা ভিক্ষা চাইতে পারবেন না, ভিক্ষার বাটিতে এসে যা উপস্থিত হবে, তাতেই তারা সন্তুষ্ট থাকবেন! সেখান থেকে গ্রহণ করবেন, যা একান্ত প্রয়োজন, তারও চাইতে কম (পরিমিত)। মানুষের বেঁচে থাকার জন্যেই ভোগের দরকার, ভোগ করতে চাওয়া মাত্রই লোভ নয়, বরং প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগ করতে চাওয়া, অপরকে বঞ্চিত করে ভোগ করতে চাওয়া ও ভোগবিলাসে নিমজ্জিত হতে চাওয়াকে লোভ বলে, তার সাথে কি গৌতমের সেই পরিমিত পরিমাণে পায়েস খাওয়াকে কি লোভ বলা যায়? আর, সেটাকে যদি লোভ বলতেই হয় - গৌতম বুদ্ধের শিক্ষার মাঝে এমন "লোভ" করার কথাই বলা আছে, এই বেঁচে থাকার ন্যুনতম রসদ অন্যের কাছ থেকে ভিক্ষা নেয়ার কাজ তিনি রাজ্য ত্যাগ করার থেকে পুরা জীবদ্দশায় করেছেন, তার অনুসারী ভিক্ষুরাও শত শত বছর ধরে করেছেন; সেগুলো বাদ দিয়ে সেই "সুন্দরী নারীর" পায়েস খাওয়ার লোভের গল্প আনার উদ্দেশ্য আসলে কি?
 

ফলে, আমাদের সেই নাস্তিক বন্ধুর আসল দৃষ্টি যে গৌতমের এই পায়েস খাওয়ার লোভের দিকে ছিল না, বরং ছিল "সুন্দরী নারী"র দিকে, তা তার বিভিন্ন কমেন্টের আলোচনায় এবং পরের পোস্টে পরিস্কার হয়ে যায়! কেননা সেই পোস্টের কমেন্টে তিনি লিখেছেনঃ 

"আমার কাছে মনে হয়- তিনি ছিলেন সংসারত্যাগী ভন্ড",  

তার বন্ধুর বলা "বাড়ি ফিরে নাকি স্ত্রীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন" এর জবাবে বলেছেন, 

"পরকীয়া করে এসে বেশির ভাগ পুরুষই সাধারণত স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চায়"!  

গৌতম বুদ্ধ নারীসঙ্গ বিবর্জিত ছিলেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, 

"সেটা দিনের বেলায়। রাতের বেলায় কে কোন সাধুর খবর রাখে?"  

অর্থাৎ, রাতের বেলায় সাধুর খবর কেউ না রাখলেও, আমাদের ইউরোপিয়ান নাস্তিক বন্ধুটি সেই খবর ঠিকই রেখেছেন। তার এই খবরের সম্পূর্ণ উৎস হচ্ছে- তার কল্পনাশক্তি! তার এহেন কল্পনাশক্তির পেছনে যে যুক্তিটা কাজ করেছে সেটি আরেকটি পোস্টে লিখেছেন, "খাদ্য পানীয়, গোসল, ঘুম, নিদ্রা, যৌনতার মতো মানুষের জীবনের জৈবিক চাহিদাগুলো পূরণ না হলে একটা মানুষ কি জঙ্গলে মাসের পর মাস বেঁচে থাকতে পারে?" অর্থাৎ একজন "সুস্থ এবং আধুনিক মানুষ হিসেবে" তিনি সন্যাসীদের অভূক্ত, অনাহারে-অনিদ্রায়-অযৌন জীবন যাপনের দাবিতে বিশ্বাস করেন না! কিন্তু, ভারতের পথে ঘাটে অসংখ্য সাধু-সন্যাসীকে যখন দেখেছেন - কথা বলেছেন (চারবার ভারতে গিয়ে), একদম শীর্ণকায়, জরাজীর্ণ চর্মসার শরীর দেখেও কি টের পান নি যে, তারা ভয়ানক অপুষ্টিতে ভুগছেন, প্রয়োজনের তুলনায় ভীষণ রকম কম আহারাদি তারা গ্রহণ করেন (কখনো কখনো কেবল পানি পান করেই কাটান), তাদের নিদ্রাযাপনের জন্যে আরামদায়ক বিছানা নেই, অনেকেই লম্বা সময় অনিদ্রায় থাকার পরে হয়তো, এক জায়গায় বসে বসেই ধ্যানের মত করে একটু খানি নিদ্রায় পতিত হন (মানে নিজে নিদ্রায় যান না, বরং শরীরই আপনা থেকে নিদ্রা গ্রহণ করে)! এবং, এরকম অনাহার - অনিদ্রায় শরীরের উপরে তবু অনেক প্রভাব পড়ে, - শরীরটা অনেক সময় ভেঙ্গে যায়, কিন্তু অযৌন জীবন যাপনে সেই ভয়ানক প্রভাবটাও পড়ে না! যৌন চাহিদা পূরণ না হলে একজন মানুষের মানসিক, কিছু কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক সমস্যাও হতে পারে - যৌন অবদমন থেকে সামাজিক নানান সংকটেরও শুরু হয়, কিন্তু তার অভাবে কোন মানুষ মারা যায় না, পানি - খাবার - বাতাস বাদে পুরোপুরি বাদ দিলে একটা মানুষের বেঁচে থাকা সম্ভব না হলেও, সারাজীবন যৌনতা বাদ দিয়েও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারবে! এই দুনিয়ায় অধিকাংশ মানুষকেই (বিশেষ করে নারীকে), জীবনের একটা বড় সময় যৌনক্ষম হওয়ার পরেও বা যৌন আকাঙ্ক্ষা থাকার পরেও অযৌন জীবন কাটাতে হয়! সামাজিক-ধর্মীয় নানা মূল্যবোধ - নৈতিকতার ধারণা মানুষকে যৌন সংযমে উদ্বুদ্ধ যে করতে পারে তা আমরা আমাদের চারপাশেই দেখতে পাই। ফলে, প্রচণ্ড রকম মানসিক ইচ্ছা, তপস্যা -প্রভৃতিও কাউকে যৌনতা বিমুখ জীবন যাপনে সাহায্য করতে পারে বৈকি! ফলে, এটাকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দিয়ে - গৌতম বুদ্ধকে পরকীয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে হলে- কিছু ন্যুনতম রেফারেন্স হাজির করা দরকার সবার আগে! তা নাহলে, এসব কাল্পনিক রগরগে গল্প বানানোটার মাধ্যমে নিজের চিন্তার ও মানসিকতার বৈকল্যই কেবল প্রকাশ পায়! আর, নাস্তিক বন্ধুটির "পরকীয়া" আর "স্ত্রীর কাছে এসে ক্ষমা" চাওয়ার অংশটাও সেই উত্তপ্ত (অবদমিত যৌন বাসনায়) মস্তিস্কেরই কল্পনাই বটে! সিদ্ধার্থ গৌতম তার স্ত্রী গোপা-যশোধরা বা বিম্বা বা শুভদ্রকা - কে এবং তার পুত্র রাহুলকে, পুরো রাজ্য ও সংসার ত্যাগ করেই সন্যাসব্রত নিয়েছিলেন! কখনই আর সেই সংসার জীবনে, বা পারিবারিক জীবনে ফিরেননি। স্ত্রী - পরিবার - সংসার ত্যাগ করার পরে যদি সিদ্ধার্থ কোথাও কোন নারীর সাথে মিলিতও হতেন, সেটাকে কি কোনভাবেই "পরকীয়া" বলা যেতো? কিন্তু এই নাস্তিক বন্ধুর ভাষায় এটি হচ্ছে "পরকীয়া"ই। এবং, সেই সমাজে বহুবিবাহ নৈমত্তিক ছিল, বিশেষ করে রাজার - রাজপুত্রের বহু নারীতে গমনটা খুব স্বাভাবিক বিষয় ছিল, সেই সময়ে সাবেক স্ত্রী, যার সাথে আবারও পরিবার-সংসার করার কোন আগ্রহই ছিল না, গৌতম বুদ্ধ গিয়ে ক্ষমা চাইবেন পরকীয়ার জন্যে? আমাদের নাস্তিক বন্ধু যেই গল্পটি ফেঁদেছেন, তা কি খুব বিশ্বাসযোগ্য হলো? গৌতম বুদ্ধ সাবেক স্ত্রীর কাছে আদৌ ক্ষমা চেয়েছিলেন কি না জানি না, কিন্তু এই যে স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন শুনেই "পরকীয়া"র কথা মাথায় আসা, সিদ্ধার্থ গৌতম স্বামী ও পিতা হিসেবে যে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, পরিবার-সংসার ত্যাগ করে স্ত্রীর প্রতি যে অবিচার করেছেন - তার জন্যেও তিনি তার স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন, এমনটাও ভাবতে না পারার কারণ হচ্ছে - ঐ উত্তপ্ত মস্তিকের উত্তপ্ত (হট) কল্পনাই!


সেই নাস্তিক বন্ধু অবশ্য এর পরে, গৌতম বুদ্ধের যৌন জীবনের প্রমাণ হিসেবে কিছু ইরোটিক "বুদ্ধ" মূর্তির ছবি হাজির করে জানিয়েছেন, "এই ছবিগুলো সব বৌদ্ধমূর্তির। এশিয়া মহাদেশের চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, নেপাল সহ আরো অনেক দেশে বুদ্ধের এই ধরনের প্রেমময় সঙ্গমরত মূর্তি পাওয়া যায়। এসব মূর্তি শত বছর ধরে শিল্পীরা তৈরী করেছেন বুদ্ধের প্রেমময় সন্ন্যাস জীবনের ইতিহাস থেকে, আমার ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়ে নয়"! মানে শত বছর ধরে শিল্পীরা এসব মূর্তি নাকি তৈরি করেছেন বুদ্ধেরই "প্রেমময় সন্যাস জীবনের ইতিহাস" থেকে! সেই প্রেমময় জীবনের ইতিহাস তিনি পেয়েছেন, এসব মূর্তি থেকে, কিন্তু গৌতম বুদ্ধের যাবতীয় আলোচনা, বক্তব্য, তার জীবনী - এসব তার কাছে গৌণ হয়ে যায়। সিদ্ধার্থ গৌতমকে নারীসঙ্গে প্রলুব্ধ করার জন্যে যে সে সময়ে নানারকম উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো, শুধু তাকে নয় - তার অনুগত শিষ্য ভিক্ষুকেও প্রলুব্ধ করতে বিভিন্ন সময়ে "সুন্দরী" ও "আকর্ষণীয়" নারীকে পাঠানো হয়েছিলো, এবং কেউই সফলকাম হয়নি - এমন কাহিনীগুলোও যে শত শত বছর পার হয়ে হাজার বছর ধরে মানুষের মাঝে মিথের মত করে আছে, সেগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য আমাদের নাস্তিক বন্ধুটির কাছে নেই! কেননা, নারীসঙ্গ আর জৈবিক চাহিদাকে অস্বীকার করে বেঁচে থাকা অসম্ভব বলেই তার ধারণা! সে যাই হোক, এই বুদ্ধ মূর্তিগুলোর রেফারেন্স আসলে কেমন, সেই আলাপই করি।


নাস্তিক বন্ধুর ছবিদ্গুলোতে দুই রকমের ছবি আছে, চারটি হচ্ছে - নগ্ন বুদ্ধের কোলে এক নারীর জড়িয়ে রাখা আসনের মূর্তি, আর দুটি স্যাণ্ড স্টোনে খোদাই করা সঙ্গম রত নারী-পুরুষের ভাস্কর্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে- এই দুটি ভাস্কর্যের কোনটিই আসলে বুদ্ধের কিংবা গৌতম বুদ্ধের নয়। থাইল্যাণ্ডের বুরিরাম শিব পার্কে থাকা এই ভাস্কর্যের পুরুষ চরিত্রগুলোর সবই আসলে শিবের। বুরিরাম প্রদেশে অবস্থিত এই Phanom Rung Historical Park এখন পুরাকীর্তির অন্যতম আকর্ষণ, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজেরই অংশ। হিন্দু খমের সাম্রাজ্যের সময়ে এই হিন্দু মন্দির কল্পেক্সটা গড়ে তোলা হয়। কিন্তু, থাইল্যাণ্ড হচ্ছে একটা বৌদ্ধ দেশ, এবং এই খমের সাম্রাজ্যও একটা সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে, সেহেতু আমাদের নাস্তিক বন্ধুটি কল্পনা করে নিয়েছেন- বৌদ্ধদেশ থাইল্যান্ডের অন্য সব বিখ্যাত মন্দির ও সেখানকার মূর্তিগুলোর মত এমন ভাস্কর্যগুলোও হয়তো বুদ্ধের! অথবা, তিনি জেনে শুনেই মিথ্যাচার করেছেন, গৌতম বুদ্ধের নারীসঙ্গের প্রমাণ হাজির করার লক্ষে! 

থাইল্যাণ্ডের শিবপার্কের ভাস্কর্য - ১

থাইল্যাণ্ডের শিবপার্কের ভাস্কর্য - ২

 

সঙ্গমরত বুদ্ধ মূর্তি - ১

এবারে আসা যাক, বুদ্ধ মূর্তিগুলোর ব্যাপারে। প্রথমে বলে নেয়া যাক, গৌতম বুদ্ধের দর্শন আর বৌদ্ধ ধর্ম এক নয়, তেমনি পরবর্তী কালের প্রচলিত বিভিন্ন ধারার বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মচিন্তা, ধর্মীয় আচার আচরণ দিয়ে গৌতম বুদ্ধকে খুঁজতে চাওয়াটাও বড় ভুল। গৌতম বুদ্ধ কখনো বৌদ্ধ ধর্মের কথা বলেননি, নিজেকে ভগবান বুদ্ধ হিসেবে দাবি করা তো দূরের কথা ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারেই তিনি কখনো কিছু বলেননি। ঈশ্বর আছে কি নাই- এই প্রশ্নের জবাব দেয়া তো পরের কথা- এই প্রশ্নটাকেই অগুরুত্বপূর্ণ বলেছেন, ব্রহ্মার অস্তিত্বের ব্যাপারে ভারতীয় বিভিন্ন ঋষি-মুনির উদ্দেশ্যে উপহাস করেছেন এই বলে যে, যাকে কেউ কোন কাল দেখেনি, কেবল একজন আরেকজনকে প্রজন্ম পরম্পরায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানিয়েছে, আর তাতেই বিশ্বাস করে গিয়েছে ("ব্রাহ্মণগণের পূর্বজ ঋষি, মন্ত্রকর্তা, প্রবক্তা…. অষ্টক,বামক, বামদেব, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, অঙ্গিরা, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ, ভৃগু……. এদের মধ্যে কি কেউ ব্রহ্মাকে স্বচক্ষে দেখেছেন? ……যাঁকে দেখেননি, জানেননি তাঁরই অস্তিত্ব নিয়ে উপদেশ করেন!…….. বাশিষ্ঠ! এ যেন সেই অন্ধগণকে ক্রমপর্যায়ে পংক্তিবদ্ধ করা; প্রথমজনও দেখতে পায় না, দ্বিতীয়জনও দেখতে পায় না, তৃতীয়জনও নয়")! ভিক্ষুদের নিয়ে সংঘ করা, ভিক্ষুদের জন্যে আশ্রমের মত করে বিহার বানানো, সেখানে বোধিলাভের জন্যে তপস্যা করা, যা ক্রমে জ্ঞান সাধণার বিহারের রূপ ধারণ করেছিলো, সেটাকেই একটা সময়ে বৌদ্ধ মন্দির করে বুদ্ধ মূর্তি বানিয়ে পুজা-আর্চনার চল শুরু হয়ে যায়। এসমস্ত আচার আচরণের সাথে গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন কোন সম্পর্কই আসলে নেই। বুদ্ধের এই মূর্তি বানানোর চলটাও শুরু হয় গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর শত বছর পরে! বলাই বাহুল্য সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন থেকে পরবর্তীতে যে বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে, সেটা আসলে ভারতীয় সংস্কৃতির সনাতনীয় আচার আচরণের প্রভাবেই তৈরি হয়েছে! মানে, গৌতম বুদ্ধের দর্শনের প্রভাবের সাথে সনাতন ধর্মের পূজা আর্চনা ও বিশ্বাসগুলোর একরকম সংমিশ্রণেই গড়ে উঠেছে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন রীতি নীতি, আচার আচরণ!


এখন, প্রশ্ন হচ্ছে - যত বুদ্ধ মূর্তি আছে, সবই কি সিদ্ধার্থ গৌতম বা গৌতম বুদ্ধের? না, বুদ্ধ মূর্তি হিসেবে পরিচিত সমস্ত মূর্তিই আসলে গৌতম বুদ্ধের নয়। যখন বলা হয় বুদ্ধ, সেটা আসলে বোধিসত্ত্ব লাভ করা মহাসিদ্ধকে বুঝানো হয়! ফলে, বুদ্ধ মূর্তির সবাই গৌতম বুদ্ধ নন, বরং অনেকক্ষেত্রেই বুদ্ধ হচ্ছেন - বোধিসত্ত্ব লাভ করা একজন মহাসিদ্ধ ব্যক্তি। যেমনঃ লাফিং বুদ্ধা বা ফ্যাট বুদ্ধার যেসব মূর্তি পাওয়া যায় (চীনে খুব জনপ্রিয়), সেগুলোর কোনটা শাক্যমুনি বুদ্ধ বা গৌতম বুদ্ধ, কিংবা The Buddha নয়, বরং "কিসি" নামের এক চাইনিজ ভিক্ষু, যার হাত ধরেই আসলে চীনে চান বৌদ্ধধর্মের (মহাযান বৌদ্ধধর্মেরই চাইনিজ ভার্সন) প্রসার ঘটে, তিনি ভিয়েতনাম, কোরিয়া, জাপানেও বৌদ্ধধর্মকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি "বুদাই" নামে প্রসিদ্ধিলাভ করেন! আমাদের নাস্তিক বন্ধু যে "ইরোটিক" আসনে বসা বুদ্ধের মূর্তির ছবিগুলো পোস্ট করেছেন, সেগুলোকে বলা হয় ইয়াব-ইয়াম (Yab-yum), তিব্বতীয় ভাষায় যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে বাবা-মা। বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের একটা শাখা হচ্ছে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম। বলাই বাহুল্য, ভারতীয় পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ানো তন্ত্র সাধক যোগীদের সাথে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের - সম্মিলনেই এই তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ভিত গড়ে উঠে। বৈদিক যুগ থেকে চলে আসা তন্ত্র সাধনার সাথে মিলে মিশে এই তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে বিভিন্ন আচার-মন্ত্র যোগে সেই মহাসিদ্ধ হওয়া, নির্বাণ লাভ এগুলোর চর্চা হওয়া শুরু হয়! তান্ত্রিক সাধনার একটা গুরুত্বপূর্ণ আচার হচ্ছে যৌন আচার। ইয়াব-ইয়াম এর যে মূর্তিগুলোর ছবি আমাদের নাস্তিক বন্ধু গৌতম বুদ্ধের প্রেমময় জীবনের ইতিহাস বুঝাতে পোস্ট করেছেন, সেগুলো আসলে এরকমই তিব্বতীয় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মেরই বুদ্ধ মূর্তি। মূর্তির পুরুষটি হচ্ছে করুণা (কম্প্যাশন) আর উপায় কৌশল (স্কিলফুল মিনস) কে ধারণ করে, আর পুরুষের কোলে থাকা নারী হচ্ছে প্রজ্ঞা (উইজডম) এর প্রতিভূ। এই দুইয়ের মিলনে হচ্ছে মহাসিদ্ধ বুদ্ধ! অর্থাৎ, ইয়াব-ইয়ামের বুদ্ধ মোটেও শাক্যমুনি বৌদ্ধ বা সিদ্ধার্থ গৌতম বা দ্য বুদ্ধ নয়, বরং মহাসিদ্ধ বা বোধিসত্ত্ব প্রাপ্ত অর্থে বুদ্ধ!



কিন্তু, আমাদের সেই নাস্তিক বন্ধুর এত কিছু জানলে চলবে কিভাবে! যেহেতু তিনি বুদ্ধের সঙ্গমরত মূর্তি পেয়েছেন, তিনি চোখ বন্ধ করেই বলে দিয়েছেন - এগুলো গৌতম বুদ্ধেরই, যা শত শত বছর ধরে নাকি শিল্পীরা বুদ্ধের প্রেমময় সন্যাস জীবনের ইতিহাস থেকে বানিয়েছেন! সেখান থেকে তিনি সিদ্ধান্তও টেনে দিয়েছেন, "বুদ্ধেরও আর দশজন মানুষের মতো সকল জৈবিক চাহিদা ছিলো, তিনিও সুস্থ ছিলেন" - অর্থাৎ সকল জৈবিক চাহিদা তথা যৌন চাহিদা বুদ্ধের ছিলো এটা প্রমাণ করার সাথে সাথে জানিয়ে দিলেন, এই যৌন চাহিদা না থাকা বা যৌন চাহিদাকে সংযত রাখা - স্বেচ্ছায় নিয়ন্ত্রণ করাটাও নাকি অসুস্থতা! এলজিবিটিকিউএএ - মুভমেন্টের দারুণ অনুসারী আমাদের নাস্তিক বন্ধুটি কর্তৃক "এ" বা আসেক্সুয়ালদের এভাবে "অসুস্থ" হিসেবে চিহ্নিত করাকেই বা কি বলা যেতে পারে?


সূত্রঃ
১। আমাদের নাস্তিক বন্ধুটির পোস্ট সমূহ, যেগুলোর জবাবে এই লেখাটি লিখেছিঃ
i) https://www.facebook.com/omarfarooq.lux/posts/pfbid028SrUZkZW13fSaCxQcnG2FYL1owTD85HdQJUHgWpLETo3kSULS97rzZpPFwxxRYGel
ii) https://www.facebook.com/omarfarooq.lux/posts/pfbid04VqmjDRNUsXnWqeQ5mABGTD5Py1Eqi8fQ8fTTdVgxV22jvzjq3N7wNcyrsr5HzDJl
iii) https://www.facebook.com/omarfarooq.lux/posts/pfbid02nbLkobjfqiDK2VPga132bBD4jphfmjtZXPSrbncsQqzGJQEyeB5YuBiJh5iuEFvil
iv) https://www.facebook.com/omarfarooq.lux/posts/pfbid0qR3nXrd6jgDFfKpC5vMSkZPgm1F3FXhxAx7kAfobV7Ep5Y2h4XPdjPgE7YhxhpDBl

২। ইয়াব-ইয়াম সম্পর্কে জানতে ব্রিটানিকার পেজে ক্লিক করতে পারেনঃ https://www.britannica.com/topic/yab-yum

৩। বুদাই সম্পর্কে জানতে উইকি পিডিয়া লিংকঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Budai

৪। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ পেজে Phanom Rung সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। https://whc.unesco.org/en/tentativelists/6401/

৫। Phanom Rung Historical Park সম্পর্কে উইকিপিডিয়ায় আলোচনাঃ
https://en.wikipedia.org/wiki/Phanom_Rung_Historical_Park

৬। এখানেও কিছু ছবি আছে (https://live-less-ordinary.com/sex-park-in-buriram-thailand/), সেই আলাপে বলা হয়েছেঃ //And this somewhat unnecessary erotica comes more from the Khmer influences found here, where, more or less, they worship the penis of the God Shiva. But this is ancient Hindu culture, not local Buddhist culture, and penises are often brushed over in modern times using old-world lingo like leungs, and lingums. As people prefer not to highlight the significance of these big stone penises which are found throughout. So I guess this new park is embracing these old-world traditions, albeit in the worst place possible. And right next to the park is a replica of Phanom Rung, the ancient Khmer temple and pride of the province, which centres around a majestic stone phallus of Shiva. And now the same goes for this playground where, smack bang in the centre of the sand pit, is a towering and proud stone penis, or lingum, or leung, whichever you prefer.// ভাস্কর্য গুলো খেয়াল করলেও দেখা যাবে, নর ও নারীর সেক্স এক্টগুলোতে নরের (শিবের) লিঙ্গ অনেক বেশি হাইলাইটেড ও প্রায়োর।



সংযুক্ত ছবিঃ
১। ইয়াব-ইয়াম তথা "সঙ্গমরত বুদ্ধ"মূর্তির কিছু ছবি।

সঙ্গমরত বুদ্ধ মূর্তি - ২

সঙ্গমরত বুদ্ধ মূর্তি - ৩

সঙ্গমরত বুদ্ধ মূর্তি - ৪

সঙ্গমরত বুদ্ধ মূর্তি - ৫

সঙ্গমরত বুদ্ধ মূর্তি - ৬






 
২। লাফিং/ ফ্যাট বুদ্ধার কিছু ছবি।

লাফিং/ ফ্যাট বুদ্ধ - ১

 

লাফিং/ ফ্যাট বুদ্ধ -২

 

লাফিং/ ফ্যাট বুদ্ধ - ৩

 

লাফিং/ ফ্যাট বুদ্ধ - ৪

  
৩। Phanom Rung Historical Park এর সেই পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্যগুলোর ছবি, যেগুলোতে মূলত শিবের সেক্স এক্ট তুলে ধরা হয়ছে, বুদ্ধের নয়।

থাইল্যাণ্ডের শিবপার্কের ভাস্কর্য - ৩


থাইল্যাণ্ডের শিবপার্কের ভাস্কর্য - ৪

থাইল্যাণ্ডের শিবপার্কের ভাস্কর্য - ৫

থাইল্যাণ্ডের শিবপার্কের ভাস্কর্য - ৬

থাইল্যাণ্ডের শিবপার্কের ভাস্কর্য - ৭

থাইল্যাণ্ডের শিবপার্কের ভাস্কর্য - ৮



বিঃদ্রঃ

১। নাস্তিক বন্ধুটি অনেকদিন আমার বন্ধুতালিকায় নেই, ফলে তার পোস্টে গিয়ে কমেন্ট করার অনুমতিও আমার নেই। দেখলাম, তিনি তার সর্বশেষ পোস্টে দাবি করেছেন, "বৌদ্ধ ধর্ম বা বুদ্ধের দর্শন নিয়ে আমার পোস্টগুলোর ভুল ধরিয়ে দিতে আমি এখন পর্যন্ত কাউকে দেখিনি"! খুব সম্ভবত আমার এই লেখাটি তার দৃষ্টিগোচর হয়নি। আমার বন্ধুতালিকার কারোর যদি ইউরোপিয়ান সেই নাস্তিক বন্ধুটির পোস্টে কমেন্ট করার অনুমতি থাকে, অনুগ্রহ করে এই লেখার লিংকটি তার পোস্টের নিচে একটু শেয়ার করবেন! ধন্যবাদ। এছাড়াও তিনি "গৌতম বুদ্ধের ২৫টা দর্শণ বা বিখ্যাত বাণী, যা এই আধুনিক সময়ে এসে কেনো ভুল, অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক", তা "যুক্তি দিয়ে" আলোচনা করেছেন বলে একটা পোস্ট লিখেছেন। সময় পেলে, সেটিরও একটা জবাব দেয়ার চেস্টা করবো খন!

২। তার পোস্টে বৌদ্ধা ধর্মালবম্বী অনেকেই খুব ক্ষিপ্তভঙ্গীতে গালাগালি করেছেন, কয়েকজন নাকি নাস্তিক বন্ধুটিকে হুমকি-ধামকিও দিয়েছেন (সেগুলো থেকেও বুঝা যায়, তারা বৌদ্ধধর্মের অনুসারি হলেও, গৌতম ধর্মের দর্শন বা শিক্ষার ধারেকাছেও নেই)! যদিও ইসলামিক জঙ্গীদের সাথে এনাদের আমি তুলনা করি না, তারা কেবল চরম আক্রোশেই রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন, তারপরেও নাস্তিক বন্ধুটির আসল উদ্দেশ্য সফল করায়, মানে বাংলাদেশীদের "ধর্মান্ধ" হিসেবে তার দাবিকে হাতে নাতে প্রমাণ করার সুযোগ দেয়ার, তাদের প্রতি হতাশা! যেকোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, এমনকি তা সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের নামে চলা ধর্ম হলেও, বুঝি মানুষকে ধর্মানুভূতিতে সামান্য আঘাতেই এমন অসহিষ্ণু করে ফেলে !

কোন মন্তব্য নেই: