এক
কোরআনকে বিজ্ঞানময় করার আপ্রাণ চেস্টা মোল্লারা অব্যাহত রেখেছে। ফলে নানারকম দাবির কথাও কানে আসে। সেদিন সেরকমই এক মজার দাবির কথা চোখে পড়লো। কোরআনেই নাকি সেই ১৪০০ বছর আগেই পরমাণুর কথা বলা আছে!! কি সেই দাবি? আল কোরআনের ৩৪ নং সুরার ৩ নং আয়াতে নাকি আল্লাহ পরিস্কারভাবে পরমাণুর কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন যে- কোন কিছুই আল্লাহর অজ্ঞাত নয়।
তাহলে প্রথমে সুরা সাবা’র ৩ নং আয়াতটি দেখা যাক। ইউসুফ আলি, পিকথাল ও শাকির তিনজনের অনুবাদেই দেখা যায় “atom” শব্দটি বিদ্যমান:
034.003
YUSUFALI: The Unbelievers say, “Never to us will come the Hour”: Say, “Nay! but most surely, by my Lord, it will come upon you;- by Him Who knows the unseen,- from Whom is not hidden the least little atom in the heavens or on earth: Nor is there anything less than that, or greater, but is in the Record Perspicuous:PICKTHAL: Those who disbelieve say: The Hour will never come unto us. Say: Nay, by my Lord, but it is coming unto you surely. (He is) the Knower of the Unseen. Not an atom‘s weight, or less than that or greater, escapeth Him in the heavens or in the earth, but it is in a clear Record,
SHAKIR: And those who disbelieve say: The hour shall not come upon us. Say: Yea! by my Lord, the Knower of the unseen, it shall certainly come upon you; not the weight of an atom becomes absent from Him, in the heavens or in the earth, and neither less than that nor greater, but (all) is in a clear book.
অবাক হয়ে যাই। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে, কোরআনেই তো পরমাণুর কথা উল্লেখ আছে। একদম তাজ্জব ব্যাপার। আরবী কোন শব্দের অনুবাদ atom করা হয়েছে- তা জানার আগ্রবোধ করি। পুরা আয়াতটি হচ্ছে:
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُواْ لاَ تَأْتِينَا السَّاعَةُ قُلْ بَلَى وَرَبِّى لَتَأْتِيَنَّكُمْ عَـلِمِ الْغَيْبِ لاَ يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِى السَّمَـوَتِ وَلاَ فِى الاٌّرْضِ وَلاَ أَصْغَرُ مِن ذَلِكَ وَلاَ أَكْبَرُ إِلاَّ فِى كِتَـبٍ مُّبِينٍ
এখানে مِثْقَالُ ذَرَّةٍ এর অনুবাদ ধরা হয়েছে পরমাণু পরিমাণে। এই শব্দটি
নিয়ে ঘাটাঘাটির আগে ভাবলাম আরো কিছু কোরআনের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। হাতের
কাছে ডঃ মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান কর্তৃক অনুদিত কোরআন শরীফ ছিল- সেটাই
হাতে নিলাম। সেখানে কোন পরমাণু অবশ্য পেলাম না। অনুবাদটি অনেকটা এরকম:
“কাফিররা বলেঃ আমাদের উপর কিয়ামত আসবে না। আপনি বলে দিন, কেন আসবে না? কসম আমার রবের! অবশ্যই তা তোমাদের উপর আসবে। তিনি অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। আসমানে ও যমীনে রেণু পরিমাণ বস্তুও তাঁর অগোচরে নয়, কিংবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্রও নেই এবং বৃহৎও নেই, কিন্তু এ সবই সুস্পষ্ট কিতাবে আছে।”
এখানে তো مِثْقَالُ ذَرَّةٍ এর অর্থ করা হয়েছে রেণু পরিমাণ। কি মুশকিল? একেক জায়গায় একেক রকম অনুবাদ! ফলে নিরূপায় হয়ে ইবনে কাথিরের শরণাপন্ন হলাম:
Those who disbelieve say: “The Hour will not come to us.” Say: “Yes, by my Lord, the All-Knower of the Unseen, it will come to you; not even the weight of a speck of dust or less than that or greater escapes His knowledge in the heavens or in the earth but it is in a Clear Book.”
ইবনে কাথিরও তো দেখি এটম ব্যবহার করেননি- করেছেন “বালিকণার সমান ওজনের”।
এবারে কি করা যায়? খুঁজতে গিয়ে দেখি এই مِثْقَالُ ذَرَّةٍ শব্দটি কোরআণের
সুরা যিলযাল (৯৯ নং) এর ৭ ও ৮ নং আয়াতেও আছে:
فَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ
৭. অতঃপর কেউ অনু পরিমান সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে ।
وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ
৮. এবং কেউ অনু পরিমান অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে ।
বাংলা অনুবাদে তো দেখি পরমাণুর বদলে এবার অণু! হায় হায়! তাহলে কি
হুজুরেরা এবার দাবি জানাবে কোরআনে কেবল “পরমাণু” নয় “অণু”র কথাও আল্লাহ পাক
সেই ১৪০০ বছর আগে জানিয়েছেন? কি মসিবতে পড়লাম! তাড়াতাড়ি করে আবার ইউসুফ আলি, পিকথাল ও শাকিরের অনুবাদ দেখি:
099.007
YUSUFALI: Then shall anyone who has done an atom‘s weight of good, see it!
PICKTHAL: And whoso doeth good an atom‘s weight will see it then,
SHAKIR: So. he who has done an atom‘s weight of good shall see it099.008
YUSUFALI: And anyone who has done an atom‘s weight of evil, shall see it.
PICKTHAL: And whoso doeth ill an atom‘s weight will see it then.
SHAKIR: And he who has done an atom‘s weight of evil shall see it.
এবং দেখি- ইবনে কাথির কি অনুবাদ করেছেন:
7. So, whosoever does good equal to the weight of a speck of dust shall see it.
8. And whosoever does evil equal to the weight of a speck of dust shall see it.
ভালো মুশকিলেই পড়া গেল! অণু পরিমাণ, পরমাণু বা এটমের ওজনের সমান, রেণু পরিমাণ, ধুলিকণার সমান- কোনটা ঠিক? নাকি সবই? সবগুলো আয়াত ভালো করে পড়ার চেস্টা করলাম। পড়ে মনে হলো- সব অনুবাদই সঠিক। সবগুলোকে সঠিক অবশ্য কেবল তখনই বলা যাবে যখন مِثْقَالُ ذَرَّةٍ শব্দটিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বা সামান্য পরিমাণে এরকম অর্থে ধরা হবে। অর্থাৎ আয়াতসমূহে উল্লেখিত ‘পরমাণু’ বা ‘অণু’ পরিমাণ মানে পদার্থের গঠন উপাদান “অণু” বা “পরমাণু” নয়- বা ‘ধুলি কণা সম’ মানে রাস্তাঘাটের ধুলাবালিও নয়- এটা মানে একদম ক্ষুদ্র পরিমাণ। এভাবে ধরলে কোন সমস্যাই থাকে না। তাই ভাবলাম- দেখি অভিধানে مِثْقَالُ ذَرَّةٍ শব্দটির কি অর্থ করা হয়েছে? হাতের কাছে ছিল ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান এর “আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান” বইটা, সেখানে দেখলাম مِثْقَالُ শব্দের অর্থ করা হয়েছে: পরিমাণ বা ওজন, বাটখারা, সামান্য পরিমাণ, বিন্দুমাত্র, রত্তি। আর, ذَرَّة এর অর্থ করা হয়েছে- বিন্দু (ডট), অতি ক্ষুদ্র, শস্যদানা, ক্ষুদ্র কণিকা, বালি কণা। এবং এই ذَرَّة শব্দের অর্থ কখনো কখনো পরমাণুও করা হয়েছে বটে!
তারপরেও বলববো- সুরা সাবা আর সুরা যিলযাল এ مِثْقَالُ ذَرَّة এর ব্যবহারই বলে দেয় ব্যবহৃত অণু-পরমাণু কোনমতেই পদার্থের মৌলিক কণিকারূপী অণু-পরমাণু নয়।
দুই
তদুপরি তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে- সুরা সাবা’র ৩ নং আয়াতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণুর কথাই বলা হয়েছে, তাহলেও কিছু কথা থেকে যায়:
১। আজকে আমরা জানি যে- পরমাণুও ক্ষুদ্রতম কণা নয়, একেও ভাঙ্গা যায়। আমি ভাবছি- একসময় مِثْقَالُ ذَرَّة কে “সামান্য পরিমাণে” বা “বিন্দুমাত্র” হিসাবে ধরা হতো, তারপরে ইবনে কাথির এর অর্থ করেছেন “ধুলি কণা সম”, তারপরে এসে করা হলো “অণু পরিমাণে” বা “পরমাণুর পরিমাণে”- এই ধারাবাহিকতায় তো অচিরেই কোরআনের কোন এক অনুবাদে দেখবো مِثْقَالُ ذَرَّة এর অর্থ করা হবে “ইলেকট্রন” বা “প্রোটন” বা ফোটন- পজিট্রন-এন্টি নিউট্রিনো .. ইত্যাদি।
২। খৃস্টের জন্মেরও কয়েকশো বছর আগে ভারতীয় ও গ্রীক দর্শনে এটম এর আবির্ভাব। গ্রীক দার্শনিক Leucippus, তার ছাত্র Democritus জানান – বস্তুজগৎ মাত্রই ক্ষুদ্রতম কণিকার সমন্বয়ে গঠিত এবং সবচেয়ে ক্ষুদ্র কণিকার নাম এটম বা পরমাণু বা অবিভাজ্য কণিকা। আমাদের ভারতীয় দর্শনেও জৈন, ন্যায় ও বৈশেষিকরাও অনুরূপ অবিভাজ্য ক্ষুদ্রতম কণিকার কথা বলেছিল (ন্যায় ও বৈশেষিকেরা যাকে পরমব্রহ্মা হিসাবে অভিহিত করেছিলেন)। আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে কেউ একথা বললে যতখানি অবাক হই- তারচেয়েও কি আজ থেকে ২৫০০ বছর আগে বললে বেশী অবাক হওয়া উচিৎ নয়?
৩। ডালটনের এটমিক থিউরির ৫ টি অনুসিদ্ধান্তের একটির সাথে সরাসরি মিলে গেলেও Leucippus, Democritus বা জৈন-ন্যায় ও বৈশেষিক দার্শনিকদের এটম আর ডালটনের এটমের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ফলে- আজকের পরমাণু আর প্রাচীণ গ্রীক বা ভারতীয় দর্শনের পরমাণু মোটেও একই নয়। দেকার্ত প্রথম মোলিকিউল শব্দটি ব্যবহার করলেও এটাও আজকের অণু থেকে যোজন যোজন দুরতম বিষয়। আর, কোরআনের পরমাণু তো- আজকের পরমাণুর সাথে দূরের কথা- গ্রীক-ভারতীয় দর্শনের পরমাণুর সাথে তুলনীয় হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
তিন
ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান খোঁজাটা আজ যেন বাতিকে পরিণত হয়েছে। আগেও একটা পোস্টে
(ধর্মে বিজ্ঞানঃ নিম গাছে আমের সন্ধান) এবিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। দেখছি- এ
আলোচনা শেষ হবার নয়- কেননা মোল্লারা নিত্য নতুন আবিষ্কার করছে। সামনে হয়তো
এরকম পোস্ট আরো লিখতে হবে। তবে, এ মুহুর্তে অতীতে এরকম কাজ আরেক ব্যক্তি
করেছিলেন- তার কথা স্মরণ করেই আজকের এই পোস্টে শেষ করবো।
প্রথিতযশা বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা (অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের জনক হিসাবে বিবেচিত) একবার এক উকিলের সাথে কথা বলছিলেন, উকিল সাহেব মেঘনাদ সাহার গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি নক্ষত্রের উপাদান ও নানা বিষয়ে বুঝাতে বসলেন। এক পর্যায়ে সেই উকিল সাহেব বলেই ফেললেন, ” এ আর নতুন কি- এসবই তো বেদে আছে”। সাহা আপত্তি জানিয়ে বলেন, “অনুগ্রহ করে বলবেন কি- বেদের কোন জায়গাটিতে নক্ষত্রের আয়নীভবনের তথ্যটি আছে?” ভদ্রলোক অবলীলায় জবাব দেন, “আসলে আমার বেদ পড়া হয়নি, তবে আমার বিশ্বাস বেদে সমস্তই আছে”। এ ঘটনার পরে মেঘনাদ সাহা ২০ বছর ধরে বেদ, উপনিষদ, হিন্দু জ্যোতিষ আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলেন। তারপরে লিখেন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ “সবই ব্যাদে আছে”।
এতে তিনি লিখেন:
” ….. বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্রগ্রন্থ এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীণ গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীণ গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। …..”
” … বর্তমান লেখক বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হিন্দুর বেদ ও অপরাপর ধর্মের মূলতত্ত্ব বুঝিতে চেস্টা করিয়াছেন। ইহাতে অবজ্ঞা বা অবহেলার কথা উঠিতে পারে না। তাঁহার বিশ্বাস যে, প্রাচীণ ধর্মগ্রন্থসমূহ যে সমস্ত জাগতিক তথ্য, ঐতিহাসিক জ্ঞান ও মানবচরিত্রের অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত , তাহাদের উপর বর্তমান যুগের উপযোগী জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। ….”
মেঘনাদ সাহা প্রাচীণ ভারতীয় জ্যোতিষ (যাকে হিন্দু জ্যোতিষ আখ্যা দিয়ে ধর্মের শ্রেষ্টত্ব খুঁজে পায় একদল পুরোহিত শ্রেণীর লোকেরা) নিয়েও কথা বলেছেন:
” … এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন আর নতুন কি করিয়াছে? কিন্তু এ সমস্ত ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্কারাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন না। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণ কক্ষ নিরূপন করা যায়। সুতরাং, ভাস্করাচার্য বা কোনো হিন্দু, গ্রিক বা আরবীয় পণ্ডিত কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছুই নয়। ….”
চার
আজকের বিজ্ঞান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোন আবিষ্কার বা কোন জ্ঞানের কাছাকাছি
কিছূ বা অংশত কিছু সরাসরি বা ঘুরিয়ে পেচিয়ে যদি কোন ধর্মগ্রন্থে মিলেও যায়-
তারপরেও তাকে আজকের বিজ্ঞানের সাথে মেলানো যাবে না, কারণ বিজ্ঞান হতে গেলে
একটা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি লাগে। কেন ধর্মগ্রন্থের ঐ সব মিলকে বিজ্ঞান বলা
যাবে না- তা আশা করি মেঘনাদ সাহা’র উপরের আলোচনা থেকেই পরিষ্কার হয়েছে!
আর, এত কিছুর পরেও যদি পরিষ্কার না হয়- আমার আর কিছুই করার নেই। চোখের ঠুলি যদি কেউ সরাতে না চায় – অন্যের কি সাধ্য?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন